alt

উপ-সম্পাদকীয়

শিক্ষা ব্যবস্থার বিনির্মাণে শিক্ষা প্রশাসনের পুনর্গঠন ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা

মাহরুফ চৌধুরী

: শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশে বিদ্যমান শিক্ষা প্রশাসনের ধ্যান-ধারণা ও অবকাঠামো গড়ে উঠেছে উপনিবেশিক উত্তরাধিকার থেকে। আঠারো শতকের প্রারম্ভে পশ্চাত্যের ধ্যান-ধারণায় প্রভাবিত ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর উদ্ভবসহ বঙ্গীয় রেনেসাঁসের উদ্ভোধন ও তাবেদার জনগোষ্ঠী তৈরির যে শিক্ষা কারখানা উপনিবেশ শাসকশ্রেণী গোড়াপত্তন করছিল, সেই শিক্ষাব্যবস্থা ও তার প্রশাসনিক কাঠামোই আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে গ্রহণ করেছি।

শিক্ষা প্রশাসনের মূল দায়িত্ব শিক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া তদারকি করা। যেমন- জাতীয় শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রম প্রণয়ন, সেগুলোর ভিত্তিতে শিক্ষা কার্যক্রমের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন। তাই শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষা প্রশাসনের ভূমিকা কী হবে সে সর্ম্পকে স্পষ্ট ধারণা থাকা জরুরি। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, শিক্ষাকার্যক্রম বলতে শিক্ষানীতি প্রণয়নে দাপ্তরিক সহযোগিতা প্রদান থেকে শুরু করে বিদ্যালয় পর্যায়ে সুষ্ঠুভাবে শিখন পরিবেশ তৈরিসহ সব শিক্ষার্থীর উপযোগী শিক্ষা দানে ভূমিকা পালন পর্যন্ত সবই হতে পারে।

প্রকৃতপক্ষে জাতীয় পর্যায় থেকে স্থানীয় বা মাঠপর্যায় পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও নানা কাজে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জন্যে শিক্ষাকার্যক্রম সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা। শিক্ষাপ্রশাসনের পুনর্গঠন নিয়ে প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয় নিচে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। চিহ্নিত এ সমস্যাগুলোকে অগ্রাধিকারে ভিত্তিতে বিবেচনা করা দরকার বলে মনে করছি।

১. শিক্ষা ব্যবস্থার গতিশীলতা ও সক্ষমতা নিশ্চিত করতে শিক্ষার প্রশাসনিক কাঠামোর পুনর্গঠন অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশের সরকারের কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক কাঠামোয় শিক্ষাখাতের জন্যে একটি মাত্র মন্ত্রণালয়ই যথেষ্ট। বর্তমানে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার পরিচালনার দায়িত্বে আছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর সাধারণ শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা, কারিগরি-প্রযুক্তি ও

বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং অন্যান্য পেশাগত শিক্ষাসহ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাপনা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। অন্যদিকে কয়েকটা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান; যেমন- জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এবং জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি নেপ), বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। এখানে লক্ষণীয় যে, এপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন হলেও এদের কর্মপরিধি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যন্ত বিস্তৃত। ফলে দ্ইু মন্ত্রণালয়ের রশি টানাটানির মাঝে পড়ে সৃষ্টি হয় নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং পরিলক্ষিত হয় বিভিন্ন কাজের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব।

সরকারের এ দুটো মন্ত্রণালয়কে একত্রিত করলে সহজেই নিষ্কৃতি মিলবে নানা জটিলতা ও সমন্বয়হীনতা থেকে। সেটা করার জন্যে শিক্ষাকে একটি খাত হিসেবে বিবেচনা করে, সেই খাতের মাঝে কয়েকটা উপখাত তৈরি করতে হবে। যেমন, শিশু-কিশোর ও প্রাথমিক শিক্ষা, মাধ্যমিক শিক্ষা, পেশাগত ও কারিগরী শিক্ষা, বয়স্ক, অব্যাহত ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা, এবং উচ্চ শিক্ষা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য একজন মন্ত্রী ও প্রতিটি উপখাতের জন্য একজন করে প্রতিমন্ত্রী থাকতে পারে। সেটা প্রয়োজন ও সক্ষমতার ভিত্তিতে সরকারই সিদ্ধান্ত নিবেন। একই সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থায় প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় প্রতিটি অধিদপ্তর ও সংস্থার ভূমিকা, লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি পদে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের জন্য নির্ধারণ করতে হবে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য, যাতে কর্মপ্রবাহ সুসংগঠিত ও কার্যকর হয়।

২. বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রশাসনিক কাঠামোর সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণও অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষাখাতের কেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় সংখ্যাগত দিক থেকে বিশেষ করে, শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংখ্যার দিকে দিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা বিশ্বের সবচেয়ে বড়। পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও জীবন-বাস্তবতায় সব ক্ষমতা কেন্দ্রীয় প্রশাসনের হাতে না রেখে স্থানীয় ও মাঠপর্যায়ে শিক্ষাপ্রশাসনের ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ সময়ে দাবি। লক্ষ্যণীয় যে, কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার কারণে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি (নিয়োগ-বাণিজ্য, বদলি-বাণিজ্য ও ভর্তি-বাণিজ্য), স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, শিক্ষা পরিকল্পনায় কর্তৃত্ববাদী আচরণ আর ঢালাওভাবে দলীয় প্রভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টায় শিক্ষা ব্যবস্থার রাজনীতিকরণের সুযোগকে অবারিত করে দিয়েছে। আর মোটা দাগে শিক্ষা প্রশাসনের এ সমস্যাগুলোই হলো বাংলাদেশের শিক্ষার গতিশীলতা ও গুণগত মানোন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধা। মাঠপর্যায়ের সমস্যাগুলোর সমাধানে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা না করে স্থানীয় শিক্ষা প্রশাসনকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া উচিত। ফলে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করে সমস্যার সমাধান নিশ্চিত করা যায়। যেহেতু স্থানীয় শিক্ষা কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ের সমস্যাগুলোর ব্যাপারে বিশেষভাবে অবহিত ও অভিজ্ঞ, সে কারণে তাদের দ্বারা গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো হবে বেশি বাস্তবসম্মত, কার্যকর এবং প্রাসঙ্গিক। অপর দিকে সে সিদ্ধান্তগুলো দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

উদাহরণস্বরূপ, কোন বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সমস্যা বা শিক্ষকের ঘাটতি দ্রুত সমাধানে স্থানীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হলে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করাও হবে সহজ। তবে মনে রাখতে হবে, ক্ষমতার এ বিকেন্দ্রীকরণ স্থানীয় ও মাঠপর্যায়ে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। সেক্ষেত্রে নিবিড় পরিবীক্ষণ ও তত্ত্বাবধান ব্যবস্থা নিশ্চিত এবং জোরদার করতে হবে। একই সঙ্গে মাঠপর্যায়ের প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে এই কাঠামো বাস্তবায়নে সফলতা অর্জন সম্ভব হয়।

৩. মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে কর্মকান্ড পরিচালনায় সমন্বয়হীনতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন অপরিহার্য। শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় শিক্ষাখাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত দ্ুেটা মন্ত্রনালয় ও বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ের মাধ্যমে। কিন্তু এই দুই মন্ত্রণালয় এবং এদের অধীনস্থ অধিদপ্তরগুলো এবং বিভিন্ন সংস্থার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, নীতি ও কৌশলের সামঞ্জস্যহীনতায় তৈরি হয় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা যা সিদ্বান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে মন্থর করে দেয়। ফলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়। মন্ত্রণালয় দ্ুেটা ও অন্যান্য স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এই রেষারেষী বা রশি টানাটানি ধরনের সমস্যাগুলো শুধু নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নকেই বাধাগ্রস্ত করে না, বরং অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদানের কাজকে কঠিন করে তোলে। এমনকি বাস্তবতা হলো দুই মন্ত্রণালয়ের খবরদারিতে একই প্রতিষ্ঠানের দুটো ইউনিট একত্রে কাজ করতে পারে না। তার উজ্জ্বল উদাহরণ হল জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সর্বশেষ পাঠ্যক্রম প্রণয়নে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক ধারা নিয়ে কাজের সমন্বয় ও সামঞ্জস্যহীনতা। অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা জানেন যে, এই দুই মন্ত্রণালয়সহ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কোন কাজ করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক ব্যক্তিদের এক টেবিলে নিয়ে আসা কতটা কঠিন কাজ।

শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় প্রশাসনিক কর্মকান্ডে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা অনেক সমস্যা তৈরি করে। চলমান রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক সঙস্কৃতিতে প্রশাসনিক সামঞ্জস্যহীনতা আর ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা একটি দূরূহ কাজ। ক্ষমতার এই পার্থক্য যেমন সামঞ্জস্যহীনতার বিস্তারের মাধ্যমে সমন্বয়হীনতার আবহ তৈরি করে, তেমনি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সম্পর্কের মাঝেও দূরত্বের সৃষ্টি করে। এ ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা শুধু শিক্ষা কার্যক্রমের বাস্তবায়নেই বাধা দেয় না, বরং শিক্ষার মানোন্নয়নের প্রচেষ্টাগুলোকেও স্তব্ধ করে দেয়। এসব সমস্যার সমাধান ছাড়া প্রকৃত অর্থে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন করা অসম্ভব। তাই, প্রশাসনিক কর্মকান্ডে সামঞ্জস্য আনা এবং মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোর মধ্যে কার্যকর যোগাযোগ ও সহযোগিতা নিশ্চিত করা জরুরি, যাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া দ্রুততর হয় এবং সময়ের ধারাবাহিকতায় ক্রমাগত শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব হয়।

৪. বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সফলতা অর্জনে প্রশাসনিক স্বৈরাচার নিরোধসহ সব ধরনের স্বৈরাচারী আচার-আচরণ ও কর্মকান্ড প্রতিরোধ করতে হবে। শিক্ষাপ্রশাসনের সরকারি অধিকর্তা, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা প্রজান্ত্রের সেবক মাত্র, তারা জনগণের শাসক কিংবা প্রভু নন।

কথাটা তাদের প্রায়োগিক অর্থে বিশ্বাসে ও কর্মে প্রতিফলিত করতে হবে। আর যদি তা না করা যায়, তবে ক্ষমতা যাদের কাছে থাকবে, তারা সবসময় হাতে থাকা ছড়িটা রাষ্ট্রের জনগণের মাথার ওপর ঘোরানোর চেষ্টা চালাবে। ফলে সুযোগ পেলে তাদের ভেতরে জন্ম নেবে স্বৈরাচারী মনোভাব তাদের আচার-আচরণ ও কর্মকান্ডে প্রকাশ পাবে। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সংস্কারের জন্যে গণ-অভ্যুত্থান উত্তর যে গণদাবি উঠেছে, তার জন্যে শিক্ষাখাতসহ বিভিন্ন খাত উপখাতে বিরাজমান ছোট ছোট স্বৈরাচারী আচার-আচরণ ও কর্মকান্ডগুলোকে হঠানো দরকার। সর্বক্ষেত্রে স্বৈরাচারী আচার-আচরণ ও কর্মকান্ড নির্মূল করা গেলেই কেবল রাষ্ট্র থেকে স্বৈরতন্ত্র দূর করা সম্ভব হবে।

৫. শিক্ষা পরিকল্পনায় প্রশাসনিক উদ্যোগে অংশীজনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। ফলপ্রসূ শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য নানাস্তরের শিক্ষাপরিকল্পনায় সমন্বয় সাধন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি তাতে অংশীজনের মতামতের প্রতিফলন থাকা অত্যাবশ্যক। তা নাহলে কেন্দ্র থেকে প্রশাসনিকভাবে গৃহীত পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্তগুলোকে মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নে দেখা দেয় নানা সমস্যা। তাই শিক্ষাপরিকল্পনায় মূল অংশীজনদের মতামত ছাড়া কার্যকর পরিকল্পনা তৈরি করা অসম্ভব। অতীতে একদিকে শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রম প্রণয়নে বিশেষজ্ঞদের চাইতে রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মতামতকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। অপর দিকে যারা অংশীজন বা সুবিধাভোগী তাদের কাছ থেকে মতামত নেয়া হয়নি কিংবা নেয়া হলেও সেসব নামে মাত্র নেয়া হয়েছে এবং শেষপর্যন্ত উপেক্ষা করা হয়েছে।

৬. শিক্ষা পরিকল্পনায় শিক্ষা প্রশাসনের কর্তৃত্ববাদী আচরণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব ফেলার প্রচেষ্টাকে রোধ করা জরুরি। স্বাধীনতা উত্তর কাল থেকে শিক্ষা পরিকল্পনার বিশেষায়িত বিষয়গুলোতে (যেমন- শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষায় অর্থায়ন ইত্যাদি) প্রশাসনের অভিভাবকসূলভ আচরণ এবং নীতিমালা তৈরি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার প্রভাব দেখা যায়। এর ফলে শিক্ষা পরিকল্পনায় একপেশে চিন্তাভাবনার প্রতিফলন যেমন দেখা যায়, তেমনি মানসম্মত শিক্ষার জন্য উপযুক্ত শিক্ষাক্রম ও তার বাস্তবায়নে ঘাটতিও পরিলক্ষিত হয়। এরই উজ্জ্বল উদাহরণ বিগত সরকারের সময়ে প্রনীত নতুন শিক্ষাক্রম। উপযোগিতার বিচারে এটা যে বাস্তবায়নযোগ্য নয়, সেটা শিক্ষা উপদেশষ্টা তাঁর প্রথম কর্ম দিবসেই ঘোষণা করেছেন।

৭. শিক্ষা প্রশাসনে যোগ্য, দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবল নিয়োগ এবং মূল্যায়নের ভিত্তিতে কর্মরত কর্মীদের পদায়নের সুযোগ নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। বর্তমানে শিক্ষা প্রশাসনের উচ্চপদগুলোতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে বদলি বা পদোন্নতির মাধ্যমে আসা ব্যক্তিরা আসীন হন। তাদের অনেকেরই শিক্ষা ব্যবস্থার বিশেষায়িত ও সম্পর্কিত বিষয়গুলো সম্পর্কে পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা কিংবা স্বচ্ছ ধারণা থাকে না। ফলে সঠিক জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাবের কারণে তারা প্রায়ই রাষ্ট্রের স্বার্থে নয়, নিজেদের চিন্তাভাবনা বা কোন বিশেষ মহলের অভিপ্রায়কে বাস্তবায়নে কাজ করে। ফলে শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃত উন্নয়ন তো দূরের কথা, তারা তৈরি করেন নানা জটিলতা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শিক্ষাক্ষেত্রে অনভিজ্ঞ ও যথাযথ দক্ষতাহীন ব্যক্তিরা যদি শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রম প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তবে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের পরিবর্তে সৃষ্টি হতে পারে বিভিন্ন সমস্যার। তাই শিক্ষাপ্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হবে, যাদের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান, পর্যাপ্ত দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা রয়েছে। ফলে তাদের জ্ঞান, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও গবেষণাজাত অবদান দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও কার্যকর ও ফলপ্রসূ করে তুলবে।

৮. অব্যাহতভাবে শিক্ষা প্রশাসনের প্রতিটি পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির কর্মদক্ষতা মূল্যায়নে কার্যকর কর্মদক্ষতা ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি অনুসরণ অত্যন্ত জরুরি। এর

মাধ্যমে দায়-দায়িত্বের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কর্মীদের পেশাগত উন্নয়নের জায়গাগুলো চিহ্নিত করা সহজ হবে। জ্ঞান, দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রশাসনে পদোন্নতির সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে যোগ্য ব্যক্তিরা উচ্চপদে উন্নীত হয়ে তাদের মেধা ও দক্ষতা সর্ব্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও জনগণের সেবার সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন। শিক্ষকতা কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছাড়া শিক্ষাপ্রশাসনে অধিকর্তা বা কর্মকর্তার পদে অধিষ্ঠিত হওয়া ব্যক্তির পক্ষে বাস্তব অনেক বিষয় সম্পর্কে ওয়াকিফহাল না থাকার ফলে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থতার পরিচয় দিতে হয়। তাই অব্যাহত কর্মদক্ষতা মূল্যায়ণের মাধ্যমে যোগ্যতাসম্পন্ন ও দক্ষ শিক্ষকদেরই শিক্ষা প্রশাসক হিসেবে পদায়নের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। বর্তমানে প্রচলিত ব্যবস্থায় একজন প্রধান শিক্ষক পর্যাপ্ত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও প্রশাসনিক উচ্চপদে পদোন্নতি লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। সঙ্গত কারণে আমরা মনে করি, যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে অভিজ্ঞ শিক্ষকদের জন্য প্রশাসনিক উচ্চপদে উন্নীত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা একান্ত প্রয়োজন, যা শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

৯. শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশেষায়িত পরিকল্পনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও পরিকল্পনা প্রণয়নে বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করে তাদের মতামতকে প্রাধাণ্য দিতে হবে। নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও পরিকল্পনা প্রণয়নে কিংবা শিক্ষাক্ষেত্রে কোন মৌলিক পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের সিদ্ধান্ত নিতে গবেষণা ও দলিল-প্রমাণাদির ওপর ভিত্তি করেই করতে হবে। শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রম প্রণয়ন রাষ্ট্রের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এসব পরিকল্পনা তৈরিতে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রের মূল অংশীজনদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা আবশ্যক। প্রকৃতপক্ষে চাহিদাভিত্তিক ও সময়োপযোগী শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করতে শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক, অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের মতামত ও পরামর্শকে অগ্রাধিকার দিয়েই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষা প্রশাসনকে এ ধরনের বিশেষায়িত শিক্ষা পরিকল্পনায় অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ বা বিশেষ হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এই শিক্ষানীতি বা শিক্ষাক্রম প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় প্রশাসনের ভূমিকা হবে সহায়ক, যাতে বিশেষজ্ঞদের পরিকল্পনা সহজভাবে ও দ্রুত বাস্তবায়িত হতে পারে এবং শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে বাস্তবভিত্তিক কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়।

এই নিবন্ধের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে, আঠারো শতকে প্রারম্ভে পশ্চাত্যের ধ্যান-ধারণায় প্রভাবিত বঙ্গীয় রেনেসাঁসের উদ্ভোধন ও তাঁবেদার জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য যে প্রশাসনিক কাঠামো উপনিবেশিক শাসক শ্রেণী চালু করেছিল স্বাধীন বাংলাদেশে সেটা বহু আগেই তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের সম্ভাবনাময় জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক বিকেন্দ্রীকরণের জন্য শিক্ষা প্রশাসনের দ্রুত পুনর্গঠন যেমন জরুরী, তেমনি যুগোপযোগী শিক্ষার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ সৃষ্টি করে মানুষের আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটানো এখন সময়ের দাবি। আশা করছি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আলোচ্য বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার বিনির্মাণে দ্রুত শিক্ষা প্রশাসনের সংস্কার সাধন করবে।

[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, লন্ডন, যুক্তরাজ্য]

অতীত থেকে মুক্তি এবং ইতিবাচক জীবনযাপন

মুক্তি সংগ্রামে তিনটি ধারা

বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকা কেন পিছিয়ে

শুধু নিচেই নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর

উপেক্ষিত আটকে পড়া পাকিস্তানিরা

রম্যগদ্য : সিন্দাবাদের বুড়ো ও আমরা

নেই কেনো সেই পাখি

বায়ুদূষণ থেকে মুক্তি কোন পথে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : রাষ্ট্র সংস্কারের দুর্গম পথ

পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র

বিজয়ের প্রেরণা

মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার পুনর্বীক্ষণ

সিদরাত জেবিনের মৃত্যু অথবা প্রশ্নহীন বায়ুদূষণ

বিজয়ের গৌরব ও সম্ভাবনাময় তরুণ সমাজ

ছবি

মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের অবদান

ছবি

বিজয় সংগ্রামের সূচনার সন্ধানে

মানসম্মত কনটেন্ট ও টিআরপির দ্বৈরথ

জিকা ভাইরাস রোধে প্রয়োজন সচেতনতা

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবার গুরুত্ব

ঢাকার বাতাস বিষাক্ত কেন

চরের কৃষি ও কৃষকের জীবন

নিম্ন আয়ের মানুষ ভালো নাই

সবার আগে নিজেকে পরিবর্তন করা দরকার

পুলিশ কবে পুলিশ হবে

জীবন ফিরে আসুক বাংলার নদীগুলোতে

কান্দন সরেন হত্যা ও ভূমি বিরোধ কি এড়ানো যেত না

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র: রাষ্ট্র বিনির্মাণে সমস্যা কোথায়?

মানবাধিকার দিবস : মানুষের অধিকার নিয়ে কেন এত কথা?

আমলাতান্ত্রিক স্বচ্ছতা : সংস্কারের পথে নাকি পুনরাবৃত্তি?

খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কিছু কথা

ছবি

বেগম রোকেয়া : নারী জাগরণের অগ্রদূত

দুর্নীতির সর্বগ্রাসী বিস্তার বন্ধ করতে হবে

মা তোর বদনখানি মলিন হলে

ব্যবসায়ী নেতৃত্বশূন্য ই-ক্যাব

মূল্যস্ফীতির হিসাব নির্ণয়ে নতুন পদ্ধতির প্রাসঙ্গিকতা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

শিক্ষা ব্যবস্থার বিনির্মাণে শিক্ষা প্রশাসনের পুনর্গঠন ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা

মাহরুফ চৌধুরী

শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশে বিদ্যমান শিক্ষা প্রশাসনের ধ্যান-ধারণা ও অবকাঠামো গড়ে উঠেছে উপনিবেশিক উত্তরাধিকার থেকে। আঠারো শতকের প্রারম্ভে পশ্চাত্যের ধ্যান-ধারণায় প্রভাবিত ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর উদ্ভবসহ বঙ্গীয় রেনেসাঁসের উদ্ভোধন ও তাবেদার জনগোষ্ঠী তৈরির যে শিক্ষা কারখানা উপনিবেশ শাসকশ্রেণী গোড়াপত্তন করছিল, সেই শিক্ষাব্যবস্থা ও তার প্রশাসনিক কাঠামোই আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে গ্রহণ করেছি।

শিক্ষা প্রশাসনের মূল দায়িত্ব শিক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া তদারকি করা। যেমন- জাতীয় শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রম প্রণয়ন, সেগুলোর ভিত্তিতে শিক্ষা কার্যক্রমের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন। তাই শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষা প্রশাসনের ভূমিকা কী হবে সে সর্ম্পকে স্পষ্ট ধারণা থাকা জরুরি। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, শিক্ষাকার্যক্রম বলতে শিক্ষানীতি প্রণয়নে দাপ্তরিক সহযোগিতা প্রদান থেকে শুরু করে বিদ্যালয় পর্যায়ে সুষ্ঠুভাবে শিখন পরিবেশ তৈরিসহ সব শিক্ষার্থীর উপযোগী শিক্ষা দানে ভূমিকা পালন পর্যন্ত সবই হতে পারে।

প্রকৃতপক্ষে জাতীয় পর্যায় থেকে স্থানীয় বা মাঠপর্যায় পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও নানা কাজে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জন্যে শিক্ষাকার্যক্রম সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা। শিক্ষাপ্রশাসনের পুনর্গঠন নিয়ে প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয় নিচে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। চিহ্নিত এ সমস্যাগুলোকে অগ্রাধিকারে ভিত্তিতে বিবেচনা করা দরকার বলে মনে করছি।

১. শিক্ষা ব্যবস্থার গতিশীলতা ও সক্ষমতা নিশ্চিত করতে শিক্ষার প্রশাসনিক কাঠামোর পুনর্গঠন অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশের সরকারের কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক কাঠামোয় শিক্ষাখাতের জন্যে একটি মাত্র মন্ত্রণালয়ই যথেষ্ট। বর্তমানে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার পরিচালনার দায়িত্বে আছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর সাধারণ শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা, কারিগরি-প্রযুক্তি ও

বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং অন্যান্য পেশাগত শিক্ষাসহ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাপনা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। অন্যদিকে কয়েকটা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান; যেমন- জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এবং জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি নেপ), বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। এখানে লক্ষণীয় যে, এপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন হলেও এদের কর্মপরিধি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যন্ত বিস্তৃত। ফলে দ্ইু মন্ত্রণালয়ের রশি টানাটানির মাঝে পড়ে সৃষ্টি হয় নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং পরিলক্ষিত হয় বিভিন্ন কাজের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব।

সরকারের এ দুটো মন্ত্রণালয়কে একত্রিত করলে সহজেই নিষ্কৃতি মিলবে নানা জটিলতা ও সমন্বয়হীনতা থেকে। সেটা করার জন্যে শিক্ষাকে একটি খাত হিসেবে বিবেচনা করে, সেই খাতের মাঝে কয়েকটা উপখাত তৈরি করতে হবে। যেমন, শিশু-কিশোর ও প্রাথমিক শিক্ষা, মাধ্যমিক শিক্ষা, পেশাগত ও কারিগরী শিক্ষা, বয়স্ক, অব্যাহত ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা, এবং উচ্চ শিক্ষা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য একজন মন্ত্রী ও প্রতিটি উপখাতের জন্য একজন করে প্রতিমন্ত্রী থাকতে পারে। সেটা প্রয়োজন ও সক্ষমতার ভিত্তিতে সরকারই সিদ্ধান্ত নিবেন। একই সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থায় প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় প্রতিটি অধিদপ্তর ও সংস্থার ভূমিকা, লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি পদে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের জন্য নির্ধারণ করতে হবে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য, যাতে কর্মপ্রবাহ সুসংগঠিত ও কার্যকর হয়।

২. বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রশাসনিক কাঠামোর সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণও অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষাখাতের কেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় সংখ্যাগত দিক থেকে বিশেষ করে, শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংখ্যার দিকে দিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা বিশ্বের সবচেয়ে বড়। পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও জীবন-বাস্তবতায় সব ক্ষমতা কেন্দ্রীয় প্রশাসনের হাতে না রেখে স্থানীয় ও মাঠপর্যায়ে শিক্ষাপ্রশাসনের ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ সময়ে দাবি। লক্ষ্যণীয় যে, কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার কারণে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি (নিয়োগ-বাণিজ্য, বদলি-বাণিজ্য ও ভর্তি-বাণিজ্য), স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, শিক্ষা পরিকল্পনায় কর্তৃত্ববাদী আচরণ আর ঢালাওভাবে দলীয় প্রভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টায় শিক্ষা ব্যবস্থার রাজনীতিকরণের সুযোগকে অবারিত করে দিয়েছে। আর মোটা দাগে শিক্ষা প্রশাসনের এ সমস্যাগুলোই হলো বাংলাদেশের শিক্ষার গতিশীলতা ও গুণগত মানোন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধা। মাঠপর্যায়ের সমস্যাগুলোর সমাধানে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা না করে স্থানীয় শিক্ষা প্রশাসনকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া উচিত। ফলে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করে সমস্যার সমাধান নিশ্চিত করা যায়। যেহেতু স্থানীয় শিক্ষা কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ের সমস্যাগুলোর ব্যাপারে বিশেষভাবে অবহিত ও অভিজ্ঞ, সে কারণে তাদের দ্বারা গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো হবে বেশি বাস্তবসম্মত, কার্যকর এবং প্রাসঙ্গিক। অপর দিকে সে সিদ্ধান্তগুলো দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

উদাহরণস্বরূপ, কোন বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সমস্যা বা শিক্ষকের ঘাটতি দ্রুত সমাধানে স্থানীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হলে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করাও হবে সহজ। তবে মনে রাখতে হবে, ক্ষমতার এ বিকেন্দ্রীকরণ স্থানীয় ও মাঠপর্যায়ে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। সেক্ষেত্রে নিবিড় পরিবীক্ষণ ও তত্ত্বাবধান ব্যবস্থা নিশ্চিত এবং জোরদার করতে হবে। একই সঙ্গে মাঠপর্যায়ের প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে এই কাঠামো বাস্তবায়নে সফলতা অর্জন সম্ভব হয়।

৩. মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে কর্মকান্ড পরিচালনায় সমন্বয়হীনতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন অপরিহার্য। শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় শিক্ষাখাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত দ্ুেটা মন্ত্রনালয় ও বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ের মাধ্যমে। কিন্তু এই দুই মন্ত্রণালয় এবং এদের অধীনস্থ অধিদপ্তরগুলো এবং বিভিন্ন সংস্থার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, নীতি ও কৌশলের সামঞ্জস্যহীনতায় তৈরি হয় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা যা সিদ্বান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে মন্থর করে দেয়। ফলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়। মন্ত্রণালয় দ্ুেটা ও অন্যান্য স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এই রেষারেষী বা রশি টানাটানি ধরনের সমস্যাগুলো শুধু নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নকেই বাধাগ্রস্ত করে না, বরং অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদানের কাজকে কঠিন করে তোলে। এমনকি বাস্তবতা হলো দুই মন্ত্রণালয়ের খবরদারিতে একই প্রতিষ্ঠানের দুটো ইউনিট একত্রে কাজ করতে পারে না। তার উজ্জ্বল উদাহরণ হল জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সর্বশেষ পাঠ্যক্রম প্রণয়নে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক ধারা নিয়ে কাজের সমন্বয় ও সামঞ্জস্যহীনতা। অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা জানেন যে, এই দুই মন্ত্রণালয়সহ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কোন কাজ করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক ব্যক্তিদের এক টেবিলে নিয়ে আসা কতটা কঠিন কাজ।

শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় প্রশাসনিক কর্মকান্ডে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা অনেক সমস্যা তৈরি করে। চলমান রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক সঙস্কৃতিতে প্রশাসনিক সামঞ্জস্যহীনতা আর ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা একটি দূরূহ কাজ। ক্ষমতার এই পার্থক্য যেমন সামঞ্জস্যহীনতার বিস্তারের মাধ্যমে সমন্বয়হীনতার আবহ তৈরি করে, তেমনি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সম্পর্কের মাঝেও দূরত্বের সৃষ্টি করে। এ ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা শুধু শিক্ষা কার্যক্রমের বাস্তবায়নেই বাধা দেয় না, বরং শিক্ষার মানোন্নয়নের প্রচেষ্টাগুলোকেও স্তব্ধ করে দেয়। এসব সমস্যার সমাধান ছাড়া প্রকৃত অর্থে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন করা অসম্ভব। তাই, প্রশাসনিক কর্মকান্ডে সামঞ্জস্য আনা এবং মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোর মধ্যে কার্যকর যোগাযোগ ও সহযোগিতা নিশ্চিত করা জরুরি, যাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া দ্রুততর হয় এবং সময়ের ধারাবাহিকতায় ক্রমাগত শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব হয়।

৪. বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সফলতা অর্জনে প্রশাসনিক স্বৈরাচার নিরোধসহ সব ধরনের স্বৈরাচারী আচার-আচরণ ও কর্মকান্ড প্রতিরোধ করতে হবে। শিক্ষাপ্রশাসনের সরকারি অধিকর্তা, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা প্রজান্ত্রের সেবক মাত্র, তারা জনগণের শাসক কিংবা প্রভু নন।

কথাটা তাদের প্রায়োগিক অর্থে বিশ্বাসে ও কর্মে প্রতিফলিত করতে হবে। আর যদি তা না করা যায়, তবে ক্ষমতা যাদের কাছে থাকবে, তারা সবসময় হাতে থাকা ছড়িটা রাষ্ট্রের জনগণের মাথার ওপর ঘোরানোর চেষ্টা চালাবে। ফলে সুযোগ পেলে তাদের ভেতরে জন্ম নেবে স্বৈরাচারী মনোভাব তাদের আচার-আচরণ ও কর্মকান্ডে প্রকাশ পাবে। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সংস্কারের জন্যে গণ-অভ্যুত্থান উত্তর যে গণদাবি উঠেছে, তার জন্যে শিক্ষাখাতসহ বিভিন্ন খাত উপখাতে বিরাজমান ছোট ছোট স্বৈরাচারী আচার-আচরণ ও কর্মকান্ডগুলোকে হঠানো দরকার। সর্বক্ষেত্রে স্বৈরাচারী আচার-আচরণ ও কর্মকান্ড নির্মূল করা গেলেই কেবল রাষ্ট্র থেকে স্বৈরতন্ত্র দূর করা সম্ভব হবে।

৫. শিক্ষা পরিকল্পনায় প্রশাসনিক উদ্যোগে অংশীজনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। ফলপ্রসূ শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য নানাস্তরের শিক্ষাপরিকল্পনায় সমন্বয় সাধন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি তাতে অংশীজনের মতামতের প্রতিফলন থাকা অত্যাবশ্যক। তা নাহলে কেন্দ্র থেকে প্রশাসনিকভাবে গৃহীত পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্তগুলোকে মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নে দেখা দেয় নানা সমস্যা। তাই শিক্ষাপরিকল্পনায় মূল অংশীজনদের মতামত ছাড়া কার্যকর পরিকল্পনা তৈরি করা অসম্ভব। অতীতে একদিকে শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রম প্রণয়নে বিশেষজ্ঞদের চাইতে রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মতামতকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। অপর দিকে যারা অংশীজন বা সুবিধাভোগী তাদের কাছ থেকে মতামত নেয়া হয়নি কিংবা নেয়া হলেও সেসব নামে মাত্র নেয়া হয়েছে এবং শেষপর্যন্ত উপেক্ষা করা হয়েছে।

৬. শিক্ষা পরিকল্পনায় শিক্ষা প্রশাসনের কর্তৃত্ববাদী আচরণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব ফেলার প্রচেষ্টাকে রোধ করা জরুরি। স্বাধীনতা উত্তর কাল থেকে শিক্ষা পরিকল্পনার বিশেষায়িত বিষয়গুলোতে (যেমন- শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষায় অর্থায়ন ইত্যাদি) প্রশাসনের অভিভাবকসূলভ আচরণ এবং নীতিমালা তৈরি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার প্রভাব দেখা যায়। এর ফলে শিক্ষা পরিকল্পনায় একপেশে চিন্তাভাবনার প্রতিফলন যেমন দেখা যায়, তেমনি মানসম্মত শিক্ষার জন্য উপযুক্ত শিক্ষাক্রম ও তার বাস্তবায়নে ঘাটতিও পরিলক্ষিত হয়। এরই উজ্জ্বল উদাহরণ বিগত সরকারের সময়ে প্রনীত নতুন শিক্ষাক্রম। উপযোগিতার বিচারে এটা যে বাস্তবায়নযোগ্য নয়, সেটা শিক্ষা উপদেশষ্টা তাঁর প্রথম কর্ম দিবসেই ঘোষণা করেছেন।

৭. শিক্ষা প্রশাসনে যোগ্য, দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবল নিয়োগ এবং মূল্যায়নের ভিত্তিতে কর্মরত কর্মীদের পদায়নের সুযোগ নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। বর্তমানে শিক্ষা প্রশাসনের উচ্চপদগুলোতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে বদলি বা পদোন্নতির মাধ্যমে আসা ব্যক্তিরা আসীন হন। তাদের অনেকেরই শিক্ষা ব্যবস্থার বিশেষায়িত ও সম্পর্কিত বিষয়গুলো সম্পর্কে পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা কিংবা স্বচ্ছ ধারণা থাকে না। ফলে সঠিক জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাবের কারণে তারা প্রায়ই রাষ্ট্রের স্বার্থে নয়, নিজেদের চিন্তাভাবনা বা কোন বিশেষ মহলের অভিপ্রায়কে বাস্তবায়নে কাজ করে। ফলে শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃত উন্নয়ন তো দূরের কথা, তারা তৈরি করেন নানা জটিলতা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শিক্ষাক্ষেত্রে অনভিজ্ঞ ও যথাযথ দক্ষতাহীন ব্যক্তিরা যদি শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রম প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তবে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের পরিবর্তে সৃষ্টি হতে পারে বিভিন্ন সমস্যার। তাই শিক্ষাপ্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হবে, যাদের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান, পর্যাপ্ত দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা রয়েছে। ফলে তাদের জ্ঞান, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও গবেষণাজাত অবদান দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও কার্যকর ও ফলপ্রসূ করে তুলবে।

৮. অব্যাহতভাবে শিক্ষা প্রশাসনের প্রতিটি পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির কর্মদক্ষতা মূল্যায়নে কার্যকর কর্মদক্ষতা ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি অনুসরণ অত্যন্ত জরুরি। এর

মাধ্যমে দায়-দায়িত্বের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কর্মীদের পেশাগত উন্নয়নের জায়গাগুলো চিহ্নিত করা সহজ হবে। জ্ঞান, দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রশাসনে পদোন্নতির সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে যোগ্য ব্যক্তিরা উচ্চপদে উন্নীত হয়ে তাদের মেধা ও দক্ষতা সর্ব্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও জনগণের সেবার সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন। শিক্ষকতা কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছাড়া শিক্ষাপ্রশাসনে অধিকর্তা বা কর্মকর্তার পদে অধিষ্ঠিত হওয়া ব্যক্তির পক্ষে বাস্তব অনেক বিষয় সম্পর্কে ওয়াকিফহাল না থাকার ফলে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থতার পরিচয় দিতে হয়। তাই অব্যাহত কর্মদক্ষতা মূল্যায়ণের মাধ্যমে যোগ্যতাসম্পন্ন ও দক্ষ শিক্ষকদেরই শিক্ষা প্রশাসক হিসেবে পদায়নের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। বর্তমানে প্রচলিত ব্যবস্থায় একজন প্রধান শিক্ষক পর্যাপ্ত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও প্রশাসনিক উচ্চপদে পদোন্নতি লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। সঙ্গত কারণে আমরা মনে করি, যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে অভিজ্ঞ শিক্ষকদের জন্য প্রশাসনিক উচ্চপদে উন্নীত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা একান্ত প্রয়োজন, যা শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

৯. শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশেষায়িত পরিকল্পনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও পরিকল্পনা প্রণয়নে বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করে তাদের মতামতকে প্রাধাণ্য দিতে হবে। নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও পরিকল্পনা প্রণয়নে কিংবা শিক্ষাক্ষেত্রে কোন মৌলিক পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের সিদ্ধান্ত নিতে গবেষণা ও দলিল-প্রমাণাদির ওপর ভিত্তি করেই করতে হবে। শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রম প্রণয়ন রাষ্ট্রের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এসব পরিকল্পনা তৈরিতে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রের মূল অংশীজনদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা আবশ্যক। প্রকৃতপক্ষে চাহিদাভিত্তিক ও সময়োপযোগী শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করতে শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক, অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের মতামত ও পরামর্শকে অগ্রাধিকার দিয়েই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষা প্রশাসনকে এ ধরনের বিশেষায়িত শিক্ষা পরিকল্পনায় অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ বা বিশেষ হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এই শিক্ষানীতি বা শিক্ষাক্রম প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় প্রশাসনের ভূমিকা হবে সহায়ক, যাতে বিশেষজ্ঞদের পরিকল্পনা সহজভাবে ও দ্রুত বাস্তবায়িত হতে পারে এবং শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে বাস্তবভিত্তিক কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়।

এই নিবন্ধের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে, আঠারো শতকে প্রারম্ভে পশ্চাত্যের ধ্যান-ধারণায় প্রভাবিত বঙ্গীয় রেনেসাঁসের উদ্ভোধন ও তাঁবেদার জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য যে প্রশাসনিক কাঠামো উপনিবেশিক শাসক শ্রেণী চালু করেছিল স্বাধীন বাংলাদেশে সেটা বহু আগেই তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের সম্ভাবনাময় জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক বিকেন্দ্রীকরণের জন্য শিক্ষা প্রশাসনের দ্রুত পুনর্গঠন যেমন জরুরী, তেমনি যুগোপযোগী শিক্ষার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ সৃষ্টি করে মানুষের আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটানো এখন সময়ের দাবি। আশা করছি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আলোচ্য বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার বিনির্মাণে দ্রুত শিক্ষা প্রশাসনের সংস্কার সাধন করবে।

[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, লন্ডন, যুক্তরাজ্য]

back to top