alt

উপ-সম্পাদকীয়

রবীন্দ্র ভাবনায় কৃষি এবং আজকের প্রেক্ষাপট

জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস

: শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতাটির মাধ্যমে। তখন আমি দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র। কবিতটিা পড়ে আমার কখনও মনে হয়নি যে রবীন্দ্রনাথ আমাদের কেউ নয়। কারণ নদীর বর্ণনাটা। আমাদের পাশের গ্রামে তো এমন একটি ছিল। যে নদীতে শীতে জায়গায়-জায়গায় হাঁটুজল থাকতো, ছেলেমেয়েরা আঁচল দিয়ে ছোট মাছ ধরতো। গরুরগাড়ি পার হয়ে যেতো। নদীর চরে চিক চিক করা বালির উপর দিয়ে গাঙ-শালিকের ঝাঁক উড়ে বেড়াতো। আর ভরা বর্ষায় প্রবল বেগে জলের স্রোত বয়ে যেতো। দুঃখের বিষয় হলো নদীটি আর আগের মতো নেই; মরে গেছে। বিশাল এক পরিবর্তন।

শুধু ছোট নদী নয়, জীবনের সবখানে এই পরিবর্তনের ঢেউ। তাই রবীন্দ্রনাথ আজ যেন কাছের কেউ নয়। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রচর্চা নিষিদ্ধ করেছিল। কারণটি স্পষ্ট নয়। ধর্মগত কারণ হতে পারে। রবীন্দ্রনাথ তো কবি ছিলেন। কবিদের কি কোনো ধর্ম থাকতে আছে, মানব ধর্ম ছাড়া। অনেকে সান্ত¡নার সুরে বলে থাকেনÑ আরে তিনি তো হিন্দু ছিলেন না; একেশ^রবাদী ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী ছিলেন।

সেটা সত্যি কথা। তাই বা বলতে হবে কেন। তিনি ব্রাহ্মণ না হয়ে খ্রিস্টান হতে পারতেন। বৌদ্ধ হতে পারতেন বা হিন্দু-বাহ্মণই থেকে যেতে পারতেন। তাহলেই বা কী এমন হতো! তার রচিত সাহিত্য কি কখনও নির্দিষ্ট ধর্মের পক্ষে কিছু বলেছে! হ্যাঁ তার অনেক কবিতা এবং সঙ্গীতে উপনিষদের প্রভাব বিদ্যমান। উপনিষদ তো আমাদের মানবিক চিন্তা-চেতনাবোধের বাইরে কিছু বলেনি। যেমন- মন্দ থেকে আমাকে ভালোর দিকে নিয়ে যাও,/ অন্ধকার থেকে আমাকে আলোর দিকে নিয়ে যাও,/ মৃুত্যু থেকে আমাকে অমরত্বের দিকে নিয়ে যাও। রবীন্দ্রনাথের বিরূদ্ধে অভিযোগ তিনি মুসলমানদের জন্য কিছুই লেখেননি। সাধারণ পাঠকদের মনে এ প্রশ্ন আসতেই পারে। অনেক দার্শনিক-লেখকরাও এর ব্যতীক্রম নয়। যেমন আহমদ ছফা। তিনি রবীন্দ্রনাথের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। তার এক প্রবন্ধ ‘জীবিত থাকলে রবীন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করতাম’ এ বিষয়টি নিয়ে তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি সেখানে ভারতীয় উপমহাদেশে মহামানব হিসাবে গৌতম বুদ্ধের পরে রবীন্দ্রনাথের স্থান দিয়ে তার বিরূদ্ধে অভিযোগ করেছেন, ‘আমি মুসলমান চাষা সম্প্রদায় থেকে আগত একজন মানুষ। রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিয়ে কিছু লেখেন নি কেন?’ ঠিকই তো।

এই প্রশ্ন আমার মনেও যে আসেনি এমন নয়। তবে একটু ভিন্নভাবেÑ রবীন্দ্র সাহিত্যে মুসলিম চরিত্র কম দেখা গেলেও একেবারে বিরল নয়। যেমন কাবুলিওয়ালা গল্পের রহমত কিংবা মুসলমানির গল্পের হবির খাঁ। কিংবা শাহজাহান কবিতায় শাহজাহান চরিত্রগুগুলো। এমনকি তিনি বিশ^ভারতীর ইসলামী সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক মৌলানা জিয়াউদ্দনকে স্মরণ করে ‘মৌলানা জিয়াউদ্দিন’ নামে একটি নাতিদীর্ঘ কবিতা লিখেছিলেন, উক্ত শিক্ষকের অকাল মৃত্যুর পর। পাশাপাশি প্রাচীন চরিত্র ‘চ-ালিকা’ ছাড়া আধুনিক সনাতনী সমাজের অন্তজ জনগোষ্ঠীর কোনো চরিত্র নিয়ে তার কোনো রচনা আমার নজরে পড়েনি। তবে আমাদেরও সীমাবদ্ধতা আছে। রবীন্দ্রনাথকে কি সেভাবে বিশ্লেষণ করার যোগ্যতা আমাদের আছে? তিনি যেন কাদের উদ্দেশ্য করে লিখেছেনÑ ওরা চিরকাল/ টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল,/ ওরা মাঠে মাঠে/ বীজ বোনে, পাকা ধান কাটে/ ওরা কাজ করে/ নগরে প্রান্তরে।

এই শ্রমজীবী মানুষগুলো কারা? এদেরকে কবি মুসলমান চাষা, প্রান্তিক হিন্দু সমাজের খেটে খাওয়া মানুষ চাঁড়াল, জেলে বা চামার বলে আলাদাভাবে বিবেচনা করতে পারতেন কি? আমাদের মতো সাধারণ হলে নিশ্চয়ই পারতেন। কিন্তু অসাধারণ এবং কবি বলেই সেটা করেননি। এরপর থেকে আমি আর বলতে পারিনে যে তিনি খেটে খাওয়া মানুষ আর অন্তজ জনগোষ্ঠীর জন্য কিছু লেখেননি।

কবি কী রচনা করবে বা তার রচনার পরিসীমা কতদূর বিস্তৃত হবে তা নিয়ে আদি কবি বাল্মীকিকে দেবর্ষি নারদ কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন-রবীন্দ্রনাথের ভাষায়ই বলতে হচ্ছে- ‘নারদ কহিলা হাসি, সেই সত্য রচিবে তুমি,/ ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি,/ রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।’

অতএব কবি যা রচনা করে সেখানেই সব সত্য নিহিত আছে। সেখানে নিজেকে বিশেষ গোষ্ঠীভুক্ত মনে করে একপাশে সরিয়ে রাখার অর্থ হলো নিজেকে পিছিয়ে রাখা। তারপরেও বলি তার সাহিত্য-কর্মে খেটে খাওয়া মুসলমান বা অন্তজ হিন্দুর কথা যথেষ্ট পরিমাণে না থাকলেও তার অন্যান্য কর্মকা-ে যা আছে তাই বা কম কিসে! বরং সাহিত্যের প্রকাশ ছিল পরোক্ষ আর সাহিত্যের বাইরে সমাজসেবার মাধ্যমে তিনি যা করেছেন সেটা ছিল প্রত্যক্ষ।

সাহিত্য জগতের বাইরে রবীন্দ্রনাথ একজন কৃষিবান্ধব সমাজকর্মী ছিলেন। আর সেটা তিনি একদিনে হয়ে উঠেননি। জমিদার হিসেবে শিলাইদহ, শাহজাদপুর বা পতিসরে আসার পর থেকেই তিনি কৃষকদেরকে বুঝার চেষ্টায় ছিলেন। পাশাপাশি তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের তাগিদে কৃষিকে কাজে লাগানোর চেষ্টায় ছিলেন।

তার সেই চেষ্টার শুরু ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বিহারের পুষায় কৃষি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার বেশ আগে থেকেই। ফলশ্রুতিতে শিলাইদহে নিজের উদ্যোগে কিছু কিছু কাজ শুরু করে দেন। দক্ষিণ ভারত থেকে আনা সরু ধানের জাত এনে পরীক্ষামূলক আবাদ শুরু করেন। ১৯০৬ সালে নিজের পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বন্ধু পুত্র সন্তোষ চন্দ্র মজুমদারকে আমেরিকার ইলিনয় বিশ^বিদ্যালয়ে পাঠান যথাক্রমে কৃষিবিদ্যা ও গো-পালন বিদ্যায় ¯œাতক হওয়ার জন্য। তারা সার্থকতার সাথে তাদের শিক্ষা শেষ করে ১৯০৯ সালে দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু তার আগেই তিনি নিজের জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে আমেরিকার একই বিশ^বিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন কৃষিবিদ্যায় স্নাতক হওয়ার জন্য। ঠিক একই সময়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকাতে আরেকটি কৃষি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। ছেলে রথীন্দ্রনাথের পরামর্শ মোতাবেক ১৯০৬ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ সুবিধেজনক কোথাও চাষবাসের উপর গবেষণা ও বিজ্ঞানসম্মত আবাদের জন্য জায়গার খোঁজে ছিলেন। এজন্য নিজের জমিদারি এলাকা শিলাইদহ, পতিসর এবং শাহজাদপুর নিয়েই কাজ শুরু করেন। এজন্য শুরুতে তিনি স্বদেশী আন্দোলন ফেরৎ ভুপেন্দ্রনাথ নামক এক যুবককে দিয়ে কৃষি-সংক্রান্ত জরিপ কাজ সম্পন্ন করিয়ে নিয়েছিলে নেন। এ সময় আমেরিকায় অধ্যয়নরত রথীন্দ্রনাথকে এবং নগেন্দ্রনাথকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন, ‘তোমরা দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজার অন্নগ্রাসের অংশ নিয়ে বিদেশে কৃষি শিখতে গেছ-ফিরে এসে এই হতভাগ্যদের অন্নগ্রাস কিছু পরিমাণে হলেও যদি বাড়িয়ে দিতে পার তাহলেই ক্ষতিপূরণ হলে মনে সান্ত¡না পাব। মনে রেখো জমিদারের টাকা চাষিদের টাকা এবং এই চাষিরাই তোমাদের শিক্ষার ব্যয়ভার নিজেরা আধপেটা খেয়ে এবং না খেয়ে বহন করছে। এদের এই ঋণ সম্পূর্ণ শোধ করবার দায় তোমাদের উপর রইল-নিজেদের সাংসারিক উন্নতির চেয়েও এইটেই তোমাদের প্রথম কর্তব্য হবে।

সত্যি কথা হলোÑ রথীন্দ্রনাথ দেশে ফিরে শিলাইদা এবং পতিসরে তার কৃষি গবেষণা ও সম্প্রসারণমূলক কর্মকা- শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ তার নবেল পুরস্কারের বেশিরভাগ অর্থ বিনিয়োগ করেছিলেন পতিসরে কৃষিব্যাঙ্ক স্থাপন করতে। তিনি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের জন্য কলের লাঙ্গল প্রচলন করেন। আমেরিকা থেকে ভুট্টা আমদানি করেন। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে পদ্মা নদীর অতিরিক্ত ইলিশ মাছ মাটির নিচে পুঁতে জৈব সার তৈরির করেন। মাটি পরীক্ষার ব্যবস্থা চালু করেন।

সাধারণ ফসলের স্থলে লাভজনক ফসল আবাদ প্রচলন করেন। জমির আইলে সবজি লাগিয়ে জমির সদ্ব্যবহার করতে শিখান। আনারসের পাতা থেকে উন্নত মানের আঁশ ছাড়ানোর সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন। পশ্চিম ভারত থেকে সিন্ধু ও শাহিওয়াল জাতের ষাঁড় আমদানি করে শাহজাদপুরে উন্নত গো-প্রজনন খামার প্রতিষ্ঠা করেন। এরই প্রতিফল হিসেবে উদ্ভাবিত হয় বিখ্যাত ‘পাবনাই গাইয়ের’ বিশেষ গোরুর জাত। বৃহত্তর পাবনায় আজ যে দুধ শিল্পের ঐতিহ্য বহন করে আছে তা রবীন্দ্রনাথেরই অবদান। এছাড়াও পতিসরে শিক্ষা প্রসারের জন্য স্কুল চালু করেন। এসবই করেছিলেন তার প্রজাসাধারণের জন্যÑ যাদের অধিকাংশই ছিল গরিব-দুঃখী মুসলমান।

আজ রবীন্দ্রনাথের বিরূদ্ধে অনেক সমালোচনা শুনছি। তার রচিত আমাদের জাতীয় সঙ্গীত বদলে ফেলার কথা শুনছি। কারণ অনেক। স্বাধীনতার অনেক আগে বিদেশি কবি রবীন্দ্রনাথ এটি নকল সুরে রচনা করেছিলেন। এই সঙ্গীতে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি নেই। আর দেশকে মা সম্বোধন করায় সেটা নাকি শিরকের পর্যায়ে পড়ে। আমার কথা হলোÑ বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের অধিকাংশ মানুষ যদি তাই মনে করে তাহলে তো জাতীয় সঙ্গীত বদলাতেই হয়। তবে তার আগে আমার মতো সাধারণ মানুষের জানার বিষয়- জ্ঞানতাপস ড. মোহাম্মদ শহীদুুল্লাহ্; ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন- ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ দিয়েছেন যে, তা মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জোটি নেই।’ এখানে প্রকৃতিকে তিনি মা বলে সম্বন্ধ করেছিলেন। জ্ঞানতাপসের এই বক্তব্যটি আমাদের বিবেককে নাড়া দেওয়ার জন্য যথেষ্ট বলে মনে করি।

[লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট; সাবেক নির্বাহী পরিচালক, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট]

স্বাস্ব্য সংস্কার : কী কী বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া জরুরি

জনশিক্ষা, গণশিক্ষা ও পারিবারিক শিক্ষা : রাষ্ট্রসংস্কারের মৌলিক ভিত্তি

জাহাজ ভাঙা শিল্প ও পরিবেশ বিপর্যয়

ছিন্নমূল মানুষের ‘শীত-জীবন’

বিভাজিত তাবলিগ জামাতের দ্বন্দ্ব

কোন পথে দেশ?

অহেতুক মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে কি লাভ হচ্ছে?

অনিরাপদ সড়ক, সমাধান কোথায়?

চাই দৃশ্যমান পরিবর্তন

বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং পরিবেশ নিয়ে ভাবনা

সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন

ধনিক শ্রেণীর চলমান সংকট

ছবি

বৈচিত্র্যের সৌন্দর্য এবং আমাদের প্রান্তিক মানুষ

বায়ু দূষণের কারণে বাড়ছে ওষুধের ব্যবহার

শুভ বড়দিন

উগান্ডায় নতুন ভাইরাস ডিঙ্গা ডিঙ্গা

পরিবেশবান্ধব ঢাকা চাই

বনভূমি রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন

ছবি

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা : ফ্যাসিবাদী প্রবণতা সৃষ্টির প্রথম ভ্রুণ

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভূমিকা

প্রগতিতে অগ্রগতি

পরিবারতন্ত্র ও পরিবারতত্ত্ব : উত্তরণের উপায়

উপেক্ষিত উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীরা

সরিষার তেল গবেষণায় সাফল্য

সিরিয়ায় রাজনৈতিক পালাবদল : কার লাভ, কার ক্ষতি?

অতীত থেকে মুক্তি এবং ইতিবাচক জীবনযাপন

মুক্তি সংগ্রামে তিনটি ধারা

বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকা কেন পিছিয়ে

শুধু নিচেই নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর

উপেক্ষিত আটকে পড়া পাকিস্তানিরা

রম্যগদ্য : সিন্দাবাদের বুড়ো ও আমরা

নেই কেনো সেই পাখি

বায়ুদূষণ থেকে মুক্তি কোন পথে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : রাষ্ট্র সংস্কারের দুর্গম পথ

পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র

বিজয়ের প্রেরণা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

রবীন্দ্র ভাবনায় কৃষি এবং আজকের প্রেক্ষাপট

জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস

শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতাটির মাধ্যমে। তখন আমি দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র। কবিতটিা পড়ে আমার কখনও মনে হয়নি যে রবীন্দ্রনাথ আমাদের কেউ নয়। কারণ নদীর বর্ণনাটা। আমাদের পাশের গ্রামে তো এমন একটি ছিল। যে নদীতে শীতে জায়গায়-জায়গায় হাঁটুজল থাকতো, ছেলেমেয়েরা আঁচল দিয়ে ছোট মাছ ধরতো। গরুরগাড়ি পার হয়ে যেতো। নদীর চরে চিক চিক করা বালির উপর দিয়ে গাঙ-শালিকের ঝাঁক উড়ে বেড়াতো। আর ভরা বর্ষায় প্রবল বেগে জলের স্রোত বয়ে যেতো। দুঃখের বিষয় হলো নদীটি আর আগের মতো নেই; মরে গেছে। বিশাল এক পরিবর্তন।

শুধু ছোট নদী নয়, জীবনের সবখানে এই পরিবর্তনের ঢেউ। তাই রবীন্দ্রনাথ আজ যেন কাছের কেউ নয়। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রচর্চা নিষিদ্ধ করেছিল। কারণটি স্পষ্ট নয়। ধর্মগত কারণ হতে পারে। রবীন্দ্রনাথ তো কবি ছিলেন। কবিদের কি কোনো ধর্ম থাকতে আছে, মানব ধর্ম ছাড়া। অনেকে সান্ত¡নার সুরে বলে থাকেনÑ আরে তিনি তো হিন্দু ছিলেন না; একেশ^রবাদী ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী ছিলেন।

সেটা সত্যি কথা। তাই বা বলতে হবে কেন। তিনি ব্রাহ্মণ না হয়ে খ্রিস্টান হতে পারতেন। বৌদ্ধ হতে পারতেন বা হিন্দু-বাহ্মণই থেকে যেতে পারতেন। তাহলেই বা কী এমন হতো! তার রচিত সাহিত্য কি কখনও নির্দিষ্ট ধর্মের পক্ষে কিছু বলেছে! হ্যাঁ তার অনেক কবিতা এবং সঙ্গীতে উপনিষদের প্রভাব বিদ্যমান। উপনিষদ তো আমাদের মানবিক চিন্তা-চেতনাবোধের বাইরে কিছু বলেনি। যেমন- মন্দ থেকে আমাকে ভালোর দিকে নিয়ে যাও,/ অন্ধকার থেকে আমাকে আলোর দিকে নিয়ে যাও,/ মৃুত্যু থেকে আমাকে অমরত্বের দিকে নিয়ে যাও। রবীন্দ্রনাথের বিরূদ্ধে অভিযোগ তিনি মুসলমানদের জন্য কিছুই লেখেননি। সাধারণ পাঠকদের মনে এ প্রশ্ন আসতেই পারে। অনেক দার্শনিক-লেখকরাও এর ব্যতীক্রম নয়। যেমন আহমদ ছফা। তিনি রবীন্দ্রনাথের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। তার এক প্রবন্ধ ‘জীবিত থাকলে রবীন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করতাম’ এ বিষয়টি নিয়ে তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি সেখানে ভারতীয় উপমহাদেশে মহামানব হিসাবে গৌতম বুদ্ধের পরে রবীন্দ্রনাথের স্থান দিয়ে তার বিরূদ্ধে অভিযোগ করেছেন, ‘আমি মুসলমান চাষা সম্প্রদায় থেকে আগত একজন মানুষ। রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিয়ে কিছু লেখেন নি কেন?’ ঠিকই তো।

এই প্রশ্ন আমার মনেও যে আসেনি এমন নয়। তবে একটু ভিন্নভাবেÑ রবীন্দ্র সাহিত্যে মুসলিম চরিত্র কম দেখা গেলেও একেবারে বিরল নয়। যেমন কাবুলিওয়ালা গল্পের রহমত কিংবা মুসলমানির গল্পের হবির খাঁ। কিংবা শাহজাহান কবিতায় শাহজাহান চরিত্রগুগুলো। এমনকি তিনি বিশ^ভারতীর ইসলামী সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক মৌলানা জিয়াউদ্দনকে স্মরণ করে ‘মৌলানা জিয়াউদ্দিন’ নামে একটি নাতিদীর্ঘ কবিতা লিখেছিলেন, উক্ত শিক্ষকের অকাল মৃত্যুর পর। পাশাপাশি প্রাচীন চরিত্র ‘চ-ালিকা’ ছাড়া আধুনিক সনাতনী সমাজের অন্তজ জনগোষ্ঠীর কোনো চরিত্র নিয়ে তার কোনো রচনা আমার নজরে পড়েনি। তবে আমাদেরও সীমাবদ্ধতা আছে। রবীন্দ্রনাথকে কি সেভাবে বিশ্লেষণ করার যোগ্যতা আমাদের আছে? তিনি যেন কাদের উদ্দেশ্য করে লিখেছেনÑ ওরা চিরকাল/ টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল,/ ওরা মাঠে মাঠে/ বীজ বোনে, পাকা ধান কাটে/ ওরা কাজ করে/ নগরে প্রান্তরে।

এই শ্রমজীবী মানুষগুলো কারা? এদেরকে কবি মুসলমান চাষা, প্রান্তিক হিন্দু সমাজের খেটে খাওয়া মানুষ চাঁড়াল, জেলে বা চামার বলে আলাদাভাবে বিবেচনা করতে পারতেন কি? আমাদের মতো সাধারণ হলে নিশ্চয়ই পারতেন। কিন্তু অসাধারণ এবং কবি বলেই সেটা করেননি। এরপর থেকে আমি আর বলতে পারিনে যে তিনি খেটে খাওয়া মানুষ আর অন্তজ জনগোষ্ঠীর জন্য কিছু লেখেননি।

কবি কী রচনা করবে বা তার রচনার পরিসীমা কতদূর বিস্তৃত হবে তা নিয়ে আদি কবি বাল্মীকিকে দেবর্ষি নারদ কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন-রবীন্দ্রনাথের ভাষায়ই বলতে হচ্ছে- ‘নারদ কহিলা হাসি, সেই সত্য রচিবে তুমি,/ ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি,/ রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।’

অতএব কবি যা রচনা করে সেখানেই সব সত্য নিহিত আছে। সেখানে নিজেকে বিশেষ গোষ্ঠীভুক্ত মনে করে একপাশে সরিয়ে রাখার অর্থ হলো নিজেকে পিছিয়ে রাখা। তারপরেও বলি তার সাহিত্য-কর্মে খেটে খাওয়া মুসলমান বা অন্তজ হিন্দুর কথা যথেষ্ট পরিমাণে না থাকলেও তার অন্যান্য কর্মকা-ে যা আছে তাই বা কম কিসে! বরং সাহিত্যের প্রকাশ ছিল পরোক্ষ আর সাহিত্যের বাইরে সমাজসেবার মাধ্যমে তিনি যা করেছেন সেটা ছিল প্রত্যক্ষ।

সাহিত্য জগতের বাইরে রবীন্দ্রনাথ একজন কৃষিবান্ধব সমাজকর্মী ছিলেন। আর সেটা তিনি একদিনে হয়ে উঠেননি। জমিদার হিসেবে শিলাইদহ, শাহজাদপুর বা পতিসরে আসার পর থেকেই তিনি কৃষকদেরকে বুঝার চেষ্টায় ছিলেন। পাশাপাশি তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের তাগিদে কৃষিকে কাজে লাগানোর চেষ্টায় ছিলেন।

তার সেই চেষ্টার শুরু ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বিহারের পুষায় কৃষি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার বেশ আগে থেকেই। ফলশ্রুতিতে শিলাইদহে নিজের উদ্যোগে কিছু কিছু কাজ শুরু করে দেন। দক্ষিণ ভারত থেকে আনা সরু ধানের জাত এনে পরীক্ষামূলক আবাদ শুরু করেন। ১৯০৬ সালে নিজের পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বন্ধু পুত্র সন্তোষ চন্দ্র মজুমদারকে আমেরিকার ইলিনয় বিশ^বিদ্যালয়ে পাঠান যথাক্রমে কৃষিবিদ্যা ও গো-পালন বিদ্যায় ¯œাতক হওয়ার জন্য। তারা সার্থকতার সাথে তাদের শিক্ষা শেষ করে ১৯০৯ সালে দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু তার আগেই তিনি নিজের জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে আমেরিকার একই বিশ^বিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন কৃষিবিদ্যায় স্নাতক হওয়ার জন্য। ঠিক একই সময়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকাতে আরেকটি কৃষি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। ছেলে রথীন্দ্রনাথের পরামর্শ মোতাবেক ১৯০৬ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ সুবিধেজনক কোথাও চাষবাসের উপর গবেষণা ও বিজ্ঞানসম্মত আবাদের জন্য জায়গার খোঁজে ছিলেন। এজন্য নিজের জমিদারি এলাকা শিলাইদহ, পতিসর এবং শাহজাদপুর নিয়েই কাজ শুরু করেন। এজন্য শুরুতে তিনি স্বদেশী আন্দোলন ফেরৎ ভুপেন্দ্রনাথ নামক এক যুবককে দিয়ে কৃষি-সংক্রান্ত জরিপ কাজ সম্পন্ন করিয়ে নিয়েছিলে নেন। এ সময় আমেরিকায় অধ্যয়নরত রথীন্দ্রনাথকে এবং নগেন্দ্রনাথকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন, ‘তোমরা দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজার অন্নগ্রাসের অংশ নিয়ে বিদেশে কৃষি শিখতে গেছ-ফিরে এসে এই হতভাগ্যদের অন্নগ্রাস কিছু পরিমাণে হলেও যদি বাড়িয়ে দিতে পার তাহলেই ক্ষতিপূরণ হলে মনে সান্ত¡না পাব। মনে রেখো জমিদারের টাকা চাষিদের টাকা এবং এই চাষিরাই তোমাদের শিক্ষার ব্যয়ভার নিজেরা আধপেটা খেয়ে এবং না খেয়ে বহন করছে। এদের এই ঋণ সম্পূর্ণ শোধ করবার দায় তোমাদের উপর রইল-নিজেদের সাংসারিক উন্নতির চেয়েও এইটেই তোমাদের প্রথম কর্তব্য হবে।

সত্যি কথা হলোÑ রথীন্দ্রনাথ দেশে ফিরে শিলাইদা এবং পতিসরে তার কৃষি গবেষণা ও সম্প্রসারণমূলক কর্মকা- শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ তার নবেল পুরস্কারের বেশিরভাগ অর্থ বিনিয়োগ করেছিলেন পতিসরে কৃষিব্যাঙ্ক স্থাপন করতে। তিনি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের জন্য কলের লাঙ্গল প্রচলন করেন। আমেরিকা থেকে ভুট্টা আমদানি করেন। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে পদ্মা নদীর অতিরিক্ত ইলিশ মাছ মাটির নিচে পুঁতে জৈব সার তৈরির করেন। মাটি পরীক্ষার ব্যবস্থা চালু করেন।

সাধারণ ফসলের স্থলে লাভজনক ফসল আবাদ প্রচলন করেন। জমির আইলে সবজি লাগিয়ে জমির সদ্ব্যবহার করতে শিখান। আনারসের পাতা থেকে উন্নত মানের আঁশ ছাড়ানোর সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন। পশ্চিম ভারত থেকে সিন্ধু ও শাহিওয়াল জাতের ষাঁড় আমদানি করে শাহজাদপুরে উন্নত গো-প্রজনন খামার প্রতিষ্ঠা করেন। এরই প্রতিফল হিসেবে উদ্ভাবিত হয় বিখ্যাত ‘পাবনাই গাইয়ের’ বিশেষ গোরুর জাত। বৃহত্তর পাবনায় আজ যে দুধ শিল্পের ঐতিহ্য বহন করে আছে তা রবীন্দ্রনাথেরই অবদান। এছাড়াও পতিসরে শিক্ষা প্রসারের জন্য স্কুল চালু করেন। এসবই করেছিলেন তার প্রজাসাধারণের জন্যÑ যাদের অধিকাংশই ছিল গরিব-দুঃখী মুসলমান।

আজ রবীন্দ্রনাথের বিরূদ্ধে অনেক সমালোচনা শুনছি। তার রচিত আমাদের জাতীয় সঙ্গীত বদলে ফেলার কথা শুনছি। কারণ অনেক। স্বাধীনতার অনেক আগে বিদেশি কবি রবীন্দ্রনাথ এটি নকল সুরে রচনা করেছিলেন। এই সঙ্গীতে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি নেই। আর দেশকে মা সম্বোধন করায় সেটা নাকি শিরকের পর্যায়ে পড়ে। আমার কথা হলোÑ বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের অধিকাংশ মানুষ যদি তাই মনে করে তাহলে তো জাতীয় সঙ্গীত বদলাতেই হয়। তবে তার আগে আমার মতো সাধারণ মানুষের জানার বিষয়- জ্ঞানতাপস ড. মোহাম্মদ শহীদুুল্লাহ্; ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন- ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ দিয়েছেন যে, তা মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জোটি নেই।’ এখানে প্রকৃতিকে তিনি মা বলে সম্বন্ধ করেছিলেন। জ্ঞানতাপসের এই বক্তব্যটি আমাদের বিবেককে নাড়া দেওয়ার জন্য যথেষ্ট বলে মনে করি।

[লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট; সাবেক নির্বাহী পরিচালক, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট]

back to top