শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
সম্প্রতি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরির্বতনের দাবি জানিয়েছেন বহিষ্কৃত এক সেনা কর্মকর্তা। তিনি হলেন আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে দ-প্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের পুত্র আব্দুল্লাহিল আযমী। জামায়াত স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধাচারণকারী একটি রাজনৈতিক দল। স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতের প্রথম আমির গোলাম আযম। তার ছেলে এরকম দাবি করতে পারে তা স্বাভাবিক বিষয়।
কোন আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আমার সোনার বাংলা গানটির জন্ম সেই ইতিহাসটাও সকলের জানা দরকার। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন শুরু হয়। এবং এই বঙ্গভঙ্গ রদ হয় ১৯১১ সালে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আন্দোলনে ফলে। এই আন্দোলনের বাংলা অঞ্চলের মানুষ একত্রিত হয়েছিল আমার সেনার বাংলা গানটির জাদুময় সুরে। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার ফলে বাঙালিদের অঞ্চলটি বাংলা প্রশাসনিক অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি পায় ব্রিটিশ আমলে। ঠিক বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ৬৬ বছর পর ১৯৭১ সালে বাংলা জনপদটি জাতির জনক শেখ মুজিবের নেতৃত্বে স্বাধীন হয়। তাই ওই সময়ের বঙ্গভঙ্গ রদের গানটিই বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের পায় সংবিধানে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনটি বাঙালি জাতির চেতনা সৃষ্টির একটি বিপ্লব। তাই এই সংগীতে বাংলার সবকিছু মিশে আছে।
অনেকেই প্রশ্ন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি বাংলাদেশের মানুষ। এই প্রশ্নটা একটি অবান্তর প্রশ্ন। কারণ রবীন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে, তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট। রবীন্দ্রনাথ তার সারাটা জীবন কাটিয়েছেন অবিভক্ত বাংলায়। বাংলাসহ সমগ্র উপমহাদেশ বিভক্ত হয় ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট। তাছাড়া তার পূর্ব পুরুষের আবাস ভূমি পূর্ব বাংলার (বর্তমানে বাংলাদেশ) খুলনা জেলার অন্তর্গত রুপসা উপজেলার পিঠাভোগ গ্রামে। এখন প্রশ্ন হলো রবীন্দ্রনাথ কি ভারতের মানুষ। যারা রবীন্দ্রনাথের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তাদের জ্ঞাতার্থে বলা ভালো রবীন্দ্রনাথের দুটো গ্রামের বাড়ি বাংলাদেশে। একটি গ্রামের বাড়ি ভারতের পশ্চিম বাংলায়। তৎকালীন কলকাতা শহরে ছিল তাদের শহরের বাড়ি। রবীন্দ্রনাথ বাংলার নাগরিক। তিনি একজন বাঙালি। তার লেখনির মাধ্যমে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সারা বিশ্বে স্থান করে নিয়েছে। কবি গুরুর কর্মজীবনটা কেটেছে পূর্ব বাংলায়, যা বর্তমান বাংলাদেশ। তিনি ছিলেন পূর্ব বাংলার পতিসর, শাহাজাদপুর ও শিলাইদহের জমিদার। পূর্ব বাংলার কৃষকদের জন্য নানা ধরনের উন্নয়ন কর্মসূচি নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ কৃষক সমবায় সমিতি গঠন করেছিলেন। এই সমবায় সমিতি পূর্ব বাংলায় রবীন্দ্রনাথের জমিদারি এলাকায় বন্ধকহীন ক্ষুদ্র ঋণ চালু করে। প্রকৃতার্থে কবি গুরু পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের মানুষ ছিলেন।
‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ এই গানটিতে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে আবহমান কালের বাংলার সংস্কৃতি। এবং বাঙালি জাতি সত্ত্বার কথা। বিশ্বের প্রতিটি মানুষ জানে জন্মভূমি বা মাতৃভূমি, যা তার দেশ সেটি মায়ের সমতুল্য। তাই বিশ্বের প্রতিটি মানুষ মায়ের ন্যায় শ্রদ্ধা করে মাতৃভূমিকে। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতে মায়ের বন্দনার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন কবি গুরু। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতে বর্ণিত আছে, মা তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো। বাঙালির মাতৃভাষা বাংলা তাই বাংলার শব্দগুলো প্রতিটি বাঙালির কাছে অমৃত সুধার মতো শোনায়।
জাতীয় সংগীতে বলা আছে, মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি, মায়ের বদন মলিন হলে সন্তানেরা দুঃখ পায়। তাই সন্তানের দু নয়ন জলে ভেসে যায়। বাংলাদেশের বদন মলিন হয় দুর্দশা বা দুর্গতিতে (বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, যুদ্ধবিগ্রহ)। দেশের এমন পরিস্থিতি হলে বাঙালিদের চোখ অশ্রুতে ভরে যায়। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতটি হলো দেশবন্ধনার অমর গীতি কাব্য। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের মধ্যে অন্তর্নিহিত আছে দেশপ্রেম এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা। ফেইসবুকে দেখলাম একটি ওয়াজ বেশ ভাইরাল হয়েছে। এক হুজুর তার কঠিন বক্তৃতায় বলেছেন যে, এই সংগীতটি কালী মূর্তির উদ্দেশে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন। হয়তো তিনি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তেমন একটা জানেন না। তিনি শুধু জানেন রবীন্দ্রনাথ হিন্দু তাই তার বিরোধিতা করতে হবে। তিনি জানেন না রবীন্দ্রনাথ ১৯০১ সালে পশ্চিম বঙ্গের শান্তি নিকেতনে ব্রহ্মাচার্য শ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। যে ব্যক্তি জাতীয় সংগীতকে মূর্তিভক্তি ভাবেন। কবি গুরু সম্পর্কে ন্যূনতম পড়াশোনা থাকলে তিনি বুঝতে পারতেন কবি গুরু কে ছিলেন, কী ছিলেন। এসব অসত্য বয়ান বিশ্বাস করেন দেশের কতিপয় মানুষ। যার জন্য সংঠিত হয় সংঘাত।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাঙালি। তিনি কোনো ধর্মীয় মৌলবাদের গ-িতে আবদ্ধ ছিলেন না। তার সৃষ্টিতে কোথাও কোনো ধর্মের মৌলবাদ নেই।
[লেখক : উন্নয়নকর্মী]
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
সম্প্রতি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরির্বতনের দাবি জানিয়েছেন বহিষ্কৃত এক সেনা কর্মকর্তা। তিনি হলেন আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে দ-প্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের পুত্র আব্দুল্লাহিল আযমী। জামায়াত স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধাচারণকারী একটি রাজনৈতিক দল। স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতের প্রথম আমির গোলাম আযম। তার ছেলে এরকম দাবি করতে পারে তা স্বাভাবিক বিষয়।
কোন আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আমার সোনার বাংলা গানটির জন্ম সেই ইতিহাসটাও সকলের জানা দরকার। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন শুরু হয়। এবং এই বঙ্গভঙ্গ রদ হয় ১৯১১ সালে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আন্দোলনে ফলে। এই আন্দোলনের বাংলা অঞ্চলের মানুষ একত্রিত হয়েছিল আমার সেনার বাংলা গানটির জাদুময় সুরে। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার ফলে বাঙালিদের অঞ্চলটি বাংলা প্রশাসনিক অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি পায় ব্রিটিশ আমলে। ঠিক বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ৬৬ বছর পর ১৯৭১ সালে বাংলা জনপদটি জাতির জনক শেখ মুজিবের নেতৃত্বে স্বাধীন হয়। তাই ওই সময়ের বঙ্গভঙ্গ রদের গানটিই বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের পায় সংবিধানে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনটি বাঙালি জাতির চেতনা সৃষ্টির একটি বিপ্লব। তাই এই সংগীতে বাংলার সবকিছু মিশে আছে।
অনেকেই প্রশ্ন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি বাংলাদেশের মানুষ। এই প্রশ্নটা একটি অবান্তর প্রশ্ন। কারণ রবীন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে, তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট। রবীন্দ্রনাথ তার সারাটা জীবন কাটিয়েছেন অবিভক্ত বাংলায়। বাংলাসহ সমগ্র উপমহাদেশ বিভক্ত হয় ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট। তাছাড়া তার পূর্ব পুরুষের আবাস ভূমি পূর্ব বাংলার (বর্তমানে বাংলাদেশ) খুলনা জেলার অন্তর্গত রুপসা উপজেলার পিঠাভোগ গ্রামে। এখন প্রশ্ন হলো রবীন্দ্রনাথ কি ভারতের মানুষ। যারা রবীন্দ্রনাথের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তাদের জ্ঞাতার্থে বলা ভালো রবীন্দ্রনাথের দুটো গ্রামের বাড়ি বাংলাদেশে। একটি গ্রামের বাড়ি ভারতের পশ্চিম বাংলায়। তৎকালীন কলকাতা শহরে ছিল তাদের শহরের বাড়ি। রবীন্দ্রনাথ বাংলার নাগরিক। তিনি একজন বাঙালি। তার লেখনির মাধ্যমে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সারা বিশ্বে স্থান করে নিয়েছে। কবি গুরুর কর্মজীবনটা কেটেছে পূর্ব বাংলায়, যা বর্তমান বাংলাদেশ। তিনি ছিলেন পূর্ব বাংলার পতিসর, শাহাজাদপুর ও শিলাইদহের জমিদার। পূর্ব বাংলার কৃষকদের জন্য নানা ধরনের উন্নয়ন কর্মসূচি নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ কৃষক সমবায় সমিতি গঠন করেছিলেন। এই সমবায় সমিতি পূর্ব বাংলায় রবীন্দ্রনাথের জমিদারি এলাকায় বন্ধকহীন ক্ষুদ্র ঋণ চালু করে। প্রকৃতার্থে কবি গুরু পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের মানুষ ছিলেন।
‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ এই গানটিতে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে আবহমান কালের বাংলার সংস্কৃতি। এবং বাঙালি জাতি সত্ত্বার কথা। বিশ্বের প্রতিটি মানুষ জানে জন্মভূমি বা মাতৃভূমি, যা তার দেশ সেটি মায়ের সমতুল্য। তাই বিশ্বের প্রতিটি মানুষ মায়ের ন্যায় শ্রদ্ধা করে মাতৃভূমিকে। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতে মায়ের বন্দনার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন কবি গুরু। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতে বর্ণিত আছে, মা তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো। বাঙালির মাতৃভাষা বাংলা তাই বাংলার শব্দগুলো প্রতিটি বাঙালির কাছে অমৃত সুধার মতো শোনায়।
জাতীয় সংগীতে বলা আছে, মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি, মায়ের বদন মলিন হলে সন্তানেরা দুঃখ পায়। তাই সন্তানের দু নয়ন জলে ভেসে যায়। বাংলাদেশের বদন মলিন হয় দুর্দশা বা দুর্গতিতে (বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, যুদ্ধবিগ্রহ)। দেশের এমন পরিস্থিতি হলে বাঙালিদের চোখ অশ্রুতে ভরে যায়। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতটি হলো দেশবন্ধনার অমর গীতি কাব্য। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের মধ্যে অন্তর্নিহিত আছে দেশপ্রেম এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা। ফেইসবুকে দেখলাম একটি ওয়াজ বেশ ভাইরাল হয়েছে। এক হুজুর তার কঠিন বক্তৃতায় বলেছেন যে, এই সংগীতটি কালী মূর্তির উদ্দেশে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন। হয়তো তিনি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তেমন একটা জানেন না। তিনি শুধু জানেন রবীন্দ্রনাথ হিন্দু তাই তার বিরোধিতা করতে হবে। তিনি জানেন না রবীন্দ্রনাথ ১৯০১ সালে পশ্চিম বঙ্গের শান্তি নিকেতনে ব্রহ্মাচার্য শ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। যে ব্যক্তি জাতীয় সংগীতকে মূর্তিভক্তি ভাবেন। কবি গুরু সম্পর্কে ন্যূনতম পড়াশোনা থাকলে তিনি বুঝতে পারতেন কবি গুরু কে ছিলেন, কী ছিলেন। এসব অসত্য বয়ান বিশ্বাস করেন দেশের কতিপয় মানুষ। যার জন্য সংঠিত হয় সংঘাত।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাঙালি। তিনি কোনো ধর্মীয় মৌলবাদের গ-িতে আবদ্ধ ছিলেন না। তার সৃষ্টিতে কোথাও কোনো ধর্মের মৌলবাদ নেই।
[লেখক : উন্নয়নকর্মী]