মাহতাব হোসাইন মাজেদ
বন্যার পানি কমতে শুরু করায় বন্যাকবলিত জেলাগুলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র। বানভাসি মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় এখনও পানিবন্দি রয়েছে অনেক মানুষ। টিউবওয়েলগুলো ডুবে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে সুপেয় পানির সংকট। দূষিত পানি ব্যবহারের কারণে ডায়রিয়া ও চর্মরোগসহ বাড়ছে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ।
পানি কমতে শুরু করায় দেখা দিয়েছে খাদ্য ও সুপেয় পানির সংকট। নিচু এলাকায় এখনও পানিবন্দি রয়েছে কয়েক লাখ মানুষ। তাদের ঘরবাড়ি কোমরসমান পানির নিচে। প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ শহরের অনেক এলাকায়ও ভেঙে পড়েছে স্যানিটেশন ব্যবস্থা। ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে পড়ছে বন্যার পানিতে। এতে দেখা দিচ্ছে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগবালাই।
ডায়রিয়া : বন্যার দূষিত পানি খাবার পানির উৎসগুলোকে দূষিত ও সংক্রমিত করে। এতে স্যানিটারি টয়লেটগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সময় বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ হতে পারে। পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়া হলে শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি ও লবণ বেরিয়ে যায়। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীকে খাওয়ার স্যালাইন বা ওআরএস দিতে হয়। স্যালাইন বানানোর জন্য অবশ্যই বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করতে হবে।
কলেরা : এই সময় পানিবাহিক রোগ কলেরা হতে পারে। এ রোগটি দূষিত পানি ও খাদ্যের মাধ্যমে ছড়ায়। কলেরায় আক্রান্ত হলে ডায়রিয়া ও বমি হয়। এ ছাড়া জীবাণু ও দূষিত পানি খাবারের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে টাইফয়েড হতে পারে। টাইফয়েড জ্বরে দীর্ঘস্থায়ী জ্বর, মাথাব্যথা ও পেটে ব্যথা হয়। পানিবাহিত রোগ থেকে রক্ষা পেতে বিশুদ্ধ পানি পান এবং সচেতনতা অবলম্বন করুন।
ঠা-া-জ্বর : বৃষ্টির পানিতে ঠা-া লেগে অনেক সময় সর্দি-কাশি ও জ্বর হয়ে থাকে। বন্যার পানির ভেজা ও ঠা-া আবহাওয়া থেকে শ্বাসকষ্ট ও শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই ঠা-ার উপসর্গ থেকে দূরে থাকুন।
চর্মরোগ ও ফাঙ্গাসের সংক্রমণ : বন্যার দূষিত পানি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার ফলে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ সময় ত্বকে খোসপাঁচড়াসহ নানা ধরনের অসুখ হয়। এ ছাড়া বন্যার সময় আবহাওয়া আর্দ্র হয়ে যায়। স্যাঁতসেঁতে ও ভেজা আবহাওয়ায় ফাঙ্গাসের বংশবিস্তার ঘটে। চর্মরোগের ক্ষেত্রে মেডিকেল টিম বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
মশার উপদ্রব : বন্যার পর পানি জমে থাকা জায়গাগুলোতে মশার বংশবৃদ্ধি হয়, যা ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার মতো মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটাতে পারে। মশার জন্মস্থান ধ্বংস করতে জমে থাকা পানি সরিয়ে ফেলতে হবে।
সাপের কামড় : বন্যার পানি সাপের গর্তে ঢুকে যাওয়ার ফলে সাপ শুকনো জায়গার সন্ধানে মানুষের কাছাকাছি চলে আসে, তাই বন্যার পর লোকালয়ে সাপের চলাচল বেড়ে যায়। বাসস্থানের চারদিকে কার্বলিক এসিড রেখে দিলে সাপের উপদ্রব হ্রাস পায়।
তা ছাড়া বন্যপ্রাণী, ইঁদুর ইত্যাদির জন্য বিভিন্ন ধরনের রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। তাই এসব ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন ও নিরাপদে থাকা প্রয়োজন। পানিবন্দি মানুষরা চাইলেও সব রকম নিয়মকানুন মেনে চলতে পারে না। তাই যে কোনো অসুস্থতার লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতেই হবে। অথবা নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।
বন্যায় মানুষের শারীরিক সমস্যাগুলোকে আমরা যেমন গুরুত্ব দিই, মানসিক সমস্যাগুলোকে তেমনি অবহেলা করি বা ভুলে যাই। কিন্তু সহায় সম্পত্তি হারিয়ে বেশির ভাগ মানুষই বন্যা ও বন্যাপরবর্তী সময়ে মন খারাপ, দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা, অনিদ্রা, মানসিক বিপর্যয়ে ভোগেন। পরবর্তীকালে একটু বৃষ্টি হলেই অস্থির হয়ে যেতে দেখা যায়।
বন্যা ও পরবর্তী সময়ে দুর্গত এলাকায় খাবারের অপ্রতুলতা, ফসলের মাঠের ক্ষতি, গবাদিপশু ও পুকুরের মাছে ভেসে যাওয়ায় খাদ্যসংকট দেখা দেয়। ফলস্বরূপ মানুষ অপুষ্টিতে ভোগে।
বন্যার কারণে সৃষ্ট রোগের অধিকাংশ হয়ে থাকে পানি ও খাবার থেকে। এ সময় পানি পানে সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। সম্ভব হলে আধা ঘণ্টা ফুটিয়ে পান করতে হবে, ফুটানো সম্ভব না হলে ১০ লিটার পানিতে দুটি পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট আধা ঘণ্টা মিশিয়ে রাখলেই ওই পানি পানের উপযোগী হবে। বন্যার সময় স্থানীয়দের শরীরে চর্মরোগ দেখা দেয়। এ সময় যতটা সম্ভব শরীর শুকনো রাখতে হবে। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা এসব রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে বেশি থাকে। এসব রোগ প্রতিরোধে সুপেয় পানি নিশ্চিত করার পাশাপাশি পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বন্যা উপদ্রুত এলাকার টিউবওয়েলগুলোকে জীবাণুমুক্ত করা এবং সবার জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা জরুরি। আমরা প্রত্যাশা করি, বন্যাপরবর্তী রোগবালাই নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টরা কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন।
[লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি ]
মাহতাব হোসাইন মাজেদ
শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
বন্যার পানি কমতে শুরু করায় বন্যাকবলিত জেলাগুলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র। বানভাসি মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় এখনও পানিবন্দি রয়েছে অনেক মানুষ। টিউবওয়েলগুলো ডুবে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে সুপেয় পানির সংকট। দূষিত পানি ব্যবহারের কারণে ডায়রিয়া ও চর্মরোগসহ বাড়ছে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ।
পানি কমতে শুরু করায় দেখা দিয়েছে খাদ্য ও সুপেয় পানির সংকট। নিচু এলাকায় এখনও পানিবন্দি রয়েছে কয়েক লাখ মানুষ। তাদের ঘরবাড়ি কোমরসমান পানির নিচে। প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ শহরের অনেক এলাকায়ও ভেঙে পড়েছে স্যানিটেশন ব্যবস্থা। ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে পড়ছে বন্যার পানিতে। এতে দেখা দিচ্ছে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগবালাই।
ডায়রিয়া : বন্যার দূষিত পানি খাবার পানির উৎসগুলোকে দূষিত ও সংক্রমিত করে। এতে স্যানিটারি টয়লেটগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সময় বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ হতে পারে। পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়া হলে শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি ও লবণ বেরিয়ে যায়। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীকে খাওয়ার স্যালাইন বা ওআরএস দিতে হয়। স্যালাইন বানানোর জন্য অবশ্যই বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করতে হবে।
কলেরা : এই সময় পানিবাহিক রোগ কলেরা হতে পারে। এ রোগটি দূষিত পানি ও খাদ্যের মাধ্যমে ছড়ায়। কলেরায় আক্রান্ত হলে ডায়রিয়া ও বমি হয়। এ ছাড়া জীবাণু ও দূষিত পানি খাবারের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে টাইফয়েড হতে পারে। টাইফয়েড জ্বরে দীর্ঘস্থায়ী জ্বর, মাথাব্যথা ও পেটে ব্যথা হয়। পানিবাহিত রোগ থেকে রক্ষা পেতে বিশুদ্ধ পানি পান এবং সচেতনতা অবলম্বন করুন।
ঠা-া-জ্বর : বৃষ্টির পানিতে ঠা-া লেগে অনেক সময় সর্দি-কাশি ও জ্বর হয়ে থাকে। বন্যার পানির ভেজা ও ঠা-া আবহাওয়া থেকে শ্বাসকষ্ট ও শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই ঠা-ার উপসর্গ থেকে দূরে থাকুন।
চর্মরোগ ও ফাঙ্গাসের সংক্রমণ : বন্যার দূষিত পানি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার ফলে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ সময় ত্বকে খোসপাঁচড়াসহ নানা ধরনের অসুখ হয়। এ ছাড়া বন্যার সময় আবহাওয়া আর্দ্র হয়ে যায়। স্যাঁতসেঁতে ও ভেজা আবহাওয়ায় ফাঙ্গাসের বংশবিস্তার ঘটে। চর্মরোগের ক্ষেত্রে মেডিকেল টিম বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
মশার উপদ্রব : বন্যার পর পানি জমে থাকা জায়গাগুলোতে মশার বংশবৃদ্ধি হয়, যা ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার মতো মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটাতে পারে। মশার জন্মস্থান ধ্বংস করতে জমে থাকা পানি সরিয়ে ফেলতে হবে।
সাপের কামড় : বন্যার পানি সাপের গর্তে ঢুকে যাওয়ার ফলে সাপ শুকনো জায়গার সন্ধানে মানুষের কাছাকাছি চলে আসে, তাই বন্যার পর লোকালয়ে সাপের চলাচল বেড়ে যায়। বাসস্থানের চারদিকে কার্বলিক এসিড রেখে দিলে সাপের উপদ্রব হ্রাস পায়।
তা ছাড়া বন্যপ্রাণী, ইঁদুর ইত্যাদির জন্য বিভিন্ন ধরনের রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। তাই এসব ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন ও নিরাপদে থাকা প্রয়োজন। পানিবন্দি মানুষরা চাইলেও সব রকম নিয়মকানুন মেনে চলতে পারে না। তাই যে কোনো অসুস্থতার লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতেই হবে। অথবা নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।
বন্যায় মানুষের শারীরিক সমস্যাগুলোকে আমরা যেমন গুরুত্ব দিই, মানসিক সমস্যাগুলোকে তেমনি অবহেলা করি বা ভুলে যাই। কিন্তু সহায় সম্পত্তি হারিয়ে বেশির ভাগ মানুষই বন্যা ও বন্যাপরবর্তী সময়ে মন খারাপ, দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা, অনিদ্রা, মানসিক বিপর্যয়ে ভোগেন। পরবর্তীকালে একটু বৃষ্টি হলেই অস্থির হয়ে যেতে দেখা যায়।
বন্যা ও পরবর্তী সময়ে দুর্গত এলাকায় খাবারের অপ্রতুলতা, ফসলের মাঠের ক্ষতি, গবাদিপশু ও পুকুরের মাছে ভেসে যাওয়ায় খাদ্যসংকট দেখা দেয়। ফলস্বরূপ মানুষ অপুষ্টিতে ভোগে।
বন্যার কারণে সৃষ্ট রোগের অধিকাংশ হয়ে থাকে পানি ও খাবার থেকে। এ সময় পানি পানে সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। সম্ভব হলে আধা ঘণ্টা ফুটিয়ে পান করতে হবে, ফুটানো সম্ভব না হলে ১০ লিটার পানিতে দুটি পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট আধা ঘণ্টা মিশিয়ে রাখলেই ওই পানি পানের উপযোগী হবে। বন্যার সময় স্থানীয়দের শরীরে চর্মরোগ দেখা দেয়। এ সময় যতটা সম্ভব শরীর শুকনো রাখতে হবে। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা এসব রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে বেশি থাকে। এসব রোগ প্রতিরোধে সুপেয় পানি নিশ্চিত করার পাশাপাশি পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বন্যা উপদ্রুত এলাকার টিউবওয়েলগুলোকে জীবাণুমুক্ত করা এবং সবার জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা জরুরি। আমরা প্রত্যাশা করি, বন্যাপরবর্তী রোগবালাই নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টরা কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন।
[লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি ]