মাহরুফ চৌধুরী
(শেষাংশ)
আর মোটা দাগে শিক্ষা প্রশাসনের এ সমস্যাগুলোই হলো বাংলাদেশের শিক্ষার গতিশীলতা ও গুণগত মানোন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধা। মাঠপর্যায়ের সমস্যাগুলোর সমাধানে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা না করে স্থানীয় শিক্ষা প্রশাসনকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া উচিত। ফলে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করে সমস্যার সমাধান নিশ্চিত করা যায়। যেহেতু স্থানীয় শিক্ষা কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ের সমস্যাগুলোর ব্যাপারে বিশেষভাবে অবহিত ও অভিজ্ঞ, সে কারণে তাদের দ্বারা গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো হবে বেশি বাস্তবসম্মত, কার্যকর এবং প্রাসঙ্গিক। অপর দিকে সে সিদ্ধান্তগুলো দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
উদাহরণস্বরূপ, কোন বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সমস্যা বা শিক্ষকের ঘাটতি দ্রুত সমাধানে স্থানীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হলে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করাও হবে সহজ। তবে মনে রাখতে হবে, ক্ষমতার এ বিকেন্দ্রীকরণ স্থানীয় ও মাঠপর্যায়ে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। সেক্ষেত্রে নিবিড় পরিবীক্ষণ ও তত্ত্বাবধান ব্যবস্থা নিশ্চিত এবং জোরদার করতে হবে। একই সঙ্গে মাঠপর্যায়ের প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে এই কাঠামো বাস্তবায়নে সফলতা অর্জন সম্ভব হয়।
৩. মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে কর্মকান্ড পরিচালনায় সমন্বয়হীনতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন অপরিহার্য। শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় শিক্ষা খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত দুটো মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ের মাধ্যমে। কিন্তু এই দুই মন্ত্রণালয় এবং এদের অধীনস্থ অধিদপ্তরগুলো এবং বিভিন্ন সংস্থার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, নীতি ও কৌশলের সামঞ্জস্যহীনতায় তৈরি হয় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা যা সিদ্বান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে মন্থর করে দেয়। ফলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়। মন্ত্রণালয় দ্ুেটা ও অন্যান্য স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এই রেষারেষী বা রশি টানাটানি ধরনের সমস্যাগুলো শুধু নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নকেই বাধাগ্রস্ত করে না, বরং অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদানের কাজকে কঠিন করে তোলে। এমনকি বাস্তবতা হলো দুই মন্ত্রণালয়ের খবরদারিতে একই প্রতিষ্ঠানের দুটো ইউনিট একত্রে কাজ করতে পারে না। তার উজ্জ্বল উদাহরণ হল জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সর্বশেষ পাঠ্যক্রম প্রণয়নে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক ধারা নিয়ে কাজের সমন্বয় ও সামঞ্জস্যহীনতা। অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা জানেন যে, এই দুই মন্ত্রণালয়সহ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কোন কাজ করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক ব্যক্তিদের এক টেবিলে নিয়ে আসা কতটা কঠিন কাজ।
শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় প্রশাসনিক কর্মকান্ডে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা অনেক সমস্যা তৈরি করে। চলমান রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক সঙস্কৃতিতে প্রশাসনিক সামঞ্জস্যহীনতা আর ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা একটি দুরূহ কাজ। ক্ষমতার এই পার্থক্য যেমন সামঞ্জস্যহীনতার বিস্তারের মাধ্যমে সমন্বয়হীনতার আবহ তৈরি করে, তেমনি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সম্পর্কের মাঝেও দূরত্বের সৃষ্টি করে। এ ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা শুধু শিক্ষা কার্যক্রমের বাস্তবায়নেই বাধা দেয় না, বরং শিক্ষার মানোন্নয়নের প্রচেষ্টাগুলোকেও স্তব্ধ করে দেয়। এসব সমস্যার সমাধান ছাড়া প্রকৃত অর্থে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন করা অসম্ভব। তাই, প্রশাসনিক কর্মকান্ডে সামঞ্জস্য আনা এবং মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোর মধ্যে কার্যকর যোগাযোগ ও সহযোগিতা নিশ্চিত করা জরুরি, যাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া দ্রুততর হয় এবং সময়ের ধারাবাহিকতায় ক্রমাগত শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব হয়।
৪. বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সফলতা অর্জনে প্রশাসনিক স্বৈরাচার নিরোধসহ সব ধরনের স্বৈরাচারী আচার-আচরণ ও কর্মকান্ড প্রতিরোধ করতে হবে। শিক্ষাপ্রশাসনের সরকারি অধিকর্তা, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা প্রজান্ত্রের সেবক মাত্র, তারা জনগণের শাসক কিংবা প্রভু নন।
কথাটা তাদের প্রায়োগিক অর্থে বিশ্বাসে ও কর্মে প্রতিফলিত করতে হবে। আর যদি তা না করা যায়, তবে ক্ষমতা যাদের কাছে থাকবে, তারা সবসময় হাতে থাকা ছড়িটা রাষ্ট্রের জনগণের মাথার ওপর ঘোরানোর চেষ্টা চালাবে। ফলে সুযোগ পেলে তাদের ভেতরে জন্ম নেবে স্বৈরাচারী মনোভাব তাদের আচার-আচরণ ও কর্মকা-ে প্রকাশ পাবে। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সংস্কারের জন্য গণ-অভ্যুত্থান উত্তর যে গণদাবি উঠেছে, তার জন্যে শিক্ষাখাতসহ বিভিন্ন খাত উপখাতে বিরাজমান ছোট ছোট স্বৈরাচারী আচার-আচরণ ও কর্মকা-গুলোকে হঠানো দরকার। সর্বক্ষেত্রে স্বৈরাচারী আচার-আচরণ ও কর্মকান্ড নির্মূল করা গেলেই কেবল রাষ্ট্র থেকে স্বৈরতন্ত্র দূর করা সম্ভব হবে।
৫. শিক্ষা পরিকল্পনায় প্রশাসনিক উদ্যোগে অংশীজনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। ফলপ্রসূ শিক্ষাব্যবস্থার জন্য নানা স্তরের শিক্ষাপরিকল্পনায় সমন্বয় সাধন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি তাতে অংশীজনের মতামতের প্রতিফলন থাকা অত্যাবশ্যক। তা নাহলে কেন্দ্র থেকে প্রশাসনিকভাবে গৃহীত পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্তগুলোকে মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নে দেখা দেয় নানা সমস্যা। তাই শিক্ষাপরিকল্পনায় মূল অংশীজনদের মতামত ছাড়া কার্যকর পরিকল্পনা তৈরি করা অসম্ভব। অতীতে একদিকে শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রম প্রণয়নে বিশেষজ্ঞদের চাইতে রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মতামতকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। অপর দিকে যারা অংশীজন বা সুবিধাভোগী তাদের কাছ থেকে মতামত নেয়া হয়নি কিংবা নেয়া হলেও সেসব নামে মাত্র নেয়া হয়েছে এবং শেষপর্যন্ত উপেক্ষা করা হয়েছে।
৬. শিক্ষা পরিকল্পনায় শিক্ষা প্রশাসনের কর্তৃত্ববাদী আচরণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব ফেলার প্রচেষ্টাকে রোধ করা জরুরি। স্বাধীনতা উত্তর কাল থেকে শিক্ষা পরিকল্পনার বিশেষায়িত বিষয়গুলোতে (যেমন- শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষায় অর্থায়ন ইত্যাদি) প্রশাসনের অভিভাবকসূলভ আচরণ এবং নীতিমালা তৈরি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার প্রভাব দেখা যায়। এর ফলে শিক্ষা পরিকল্পনায় একপেশে চিন্তাভাবনার প্রতিফলন যেমন দেখা যায়, তেমনি মানসম্মত শিক্ষার জন্য উপযুক্ত শিক্ষাক্রম ও তার বাস্তবায়নে ঘাটতিও পরিলক্ষিত হয়। এরই উজ্জ্বল উদাহরণ বিগত সরকারের সময়ে প্রনীত নতুন শিক্ষাক্রম। উপযোগিতার বিচারে এটা যে বাস্তবায়নযোগ্য নয়, সেটা শিক্ষা উপদেষ্টা তার প্রথম কর্মদিবসেই ঘোষণা করেছেন।
৭. শিক্ষা প্রশাসনে যোগ্য, দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবল নিয়োগ এবং মূল্যায়নের ভিত্তিতে কর্মরত কর্মীদের পদায়নের সুযোগ নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। বর্তমানে শিক্ষা প্রশাসনের উচ্চপদগুলোতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে বদলি বা পদোন্নতির মাধ্যমে আসা ব্যক্তিরা আসীন হন। তাদের অনেকেরই শিক্ষা ব্যবস্থার বিশেষায়িত ও সম্পর্কিত বিষয়গুলো সম্পর্কে পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা কিংবা স্বচ্ছ ধারণা থাকে না। ফলে সঠিক জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাবের কারণে তারা প্রায়ই রাষ্ট্রের স্বার্থে নয়, নিজেদের চিন্তাভাবনা বা কোন বিশেষ মহলের অভিপ্রায়কে বাস্তবায়নে কাজ করে। ফলে শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃত উন্নয়ন তো দূরের কথা, তারা তৈরি করেন নানা জটিলতা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শিক্ষাক্ষেত্রে অনভিজ্ঞ ও যথাযথ দক্ষতাহীন ব্যক্তিরা যদি শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রম প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তবে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের পরিবর্তে সৃষ্টি হতে পারে বিভিন্ন সমস্যার। তাই শিক্ষাপ্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হবে, যাদের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান, পর্যাপ্ত দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা রয়েছে। ফলে তাদের জ্ঞান, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও গবেষণাজাত অবদান দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও কার্যকর ও ফলপ্রসূ করে তুলবে।
৮. অব্যাহতভাবে শিক্ষা প্রশাসনের প্রতিটি পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির কর্মদক্ষতা মূল্যায়নে কার্যকর কর্মদক্ষতা ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি অনুসরণ অত্যন্ত জরুরি। এর
মাধ্যমে দায়-দায়িত্বের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কর্মীদের পেশাগত উন্নয়নের জায়গাগুলো চিহ্নিত করা সহজ হবে। জ্ঞান, দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রশাসনে পদোন্নতির সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে যোগ্য ব্যক্তিরা উচ্চপদে উন্নীত হয়ে তাদের মেধা ও দক্ষতা সর্ব্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও জনগণের সেবার সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন। শিক্ষকতা কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছাড়া শিক্ষাপ্রশাসনে অধিকর্তা বা কর্মকর্তার পদে অধিষ্ঠিত হওয়া ব্যক্তির পক্ষে বাস্তব অনেক বিষয় সম্পর্কে ওয়াকিফহাল না থাকার ফলে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থতার পরিচয় দিতে হয়। তাই অব্যাহত কর্মদক্ষতা মূল্যায়ণের মাধ্যমে যোগ্যতাসম্পন্ন ও দক্ষ শিক্ষকদেরই শিক্ষা প্রশাসক হিসেবে পদায়নের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। বর্তমানে প্রচলিত ব্যবস্থায় একজন প্রধান শিক্ষক পর্যাপ্ত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও প্রশাসনিক উচ্চপদে পদোন্নতি লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। সঙ্গত কারণে আমরা মনে করি, যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে অভিজ্ঞ শিক্ষকদের জন্য প্রশাসনিক উচ্চপদে উন্নীত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা একান্ত প্রয়োজন, যা শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
৯. শিক্ষাব্যবস্থায় বিশেষায়িত পরিকল্পনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও পরিকল্পনা প্রণয়নে বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করে তাদের মতামতকে প্রাধাণ্য দিতে হবে। নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও পরিকল্পনা প্রণয়নে কিংবা শিক্ষাক্ষেত্রে কোন মৌলিক পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের সিদ্ধান্ত নিতে গবেষণা ও দলিল-প্রমাণাদির ওপর ভিত্তি করেই করতে হবে। শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রম প্রণয়ন রাষ্ট্রের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এসব পরিকল্পনা তৈরিতে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রের মূল অংশীজনদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা আবশ্যক। প্রকৃতপক্ষে চাহিদাভিত্তিক ও সময়োপযোগী শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করতে শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক, অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের মতামত ও পরামর্শকে অগ্রাধিকার দিয়েই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষা প্রশাসনকে এ ধরনের বিশেষায়িত শিক্ষা পরিকল্পনায় অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ বা বিশেষ হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এই শিক্ষানীতি বা শিক্ষাক্রম প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় প্রশাসনের ভূমিকা হবে সহায়ক, যাতে বিশেষজ্ঞদের পরিকল্পনা সহজভাবে ও দ্রুত বাস্তবায়িত হতে পারে এবং শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে বাস্তবভিত্তিক কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়।
এই নিবন্ধের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে, আঠারো শতকে প্রারম্ভে পশ্চাত্যের ধ্যান-ধারণায় প্রভাবিত বঙ্গীয় রেনেসাঁসের উদ্ভোধন ও তাঁবেদার জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য যে প্রশাসনিক কাঠামো উপনিবেশিক শাসক শ্রেণী চালু করেছিল স্বাধীন বাংলাদেশে সেটা বহু আগেই তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের সম্ভাবনাময় জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক বিকেন্দ্রীকরণের জন্য শিক্ষা প্রশাসনের দ্রুত পুনর্গঠন যেমন জরুরি, তেমনি যুগোপযোগী শিক্ষার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ সৃষ্টি করে মানুষের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটানো এখন সময়ের দাবি। আশা করছি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আলোচ্য বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার বিনির্মাণে দ্রুত শিক্ষা প্রশাসনের সংস্কার সাধন করবে।
[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, লন্ডন, যুক্তরাজ্য]
মাহরুফ চৌধুরী
শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
(শেষাংশ)
আর মোটা দাগে শিক্ষা প্রশাসনের এ সমস্যাগুলোই হলো বাংলাদেশের শিক্ষার গতিশীলতা ও গুণগত মানোন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধা। মাঠপর্যায়ের সমস্যাগুলোর সমাধানে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা না করে স্থানীয় শিক্ষা প্রশাসনকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া উচিত। ফলে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করে সমস্যার সমাধান নিশ্চিত করা যায়। যেহেতু স্থানীয় শিক্ষা কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ের সমস্যাগুলোর ব্যাপারে বিশেষভাবে অবহিত ও অভিজ্ঞ, সে কারণে তাদের দ্বারা গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো হবে বেশি বাস্তবসম্মত, কার্যকর এবং প্রাসঙ্গিক। অপর দিকে সে সিদ্ধান্তগুলো দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
উদাহরণস্বরূপ, কোন বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সমস্যা বা শিক্ষকের ঘাটতি দ্রুত সমাধানে স্থানীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হলে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করাও হবে সহজ। তবে মনে রাখতে হবে, ক্ষমতার এ বিকেন্দ্রীকরণ স্থানীয় ও মাঠপর্যায়ে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। সেক্ষেত্রে নিবিড় পরিবীক্ষণ ও তত্ত্বাবধান ব্যবস্থা নিশ্চিত এবং জোরদার করতে হবে। একই সঙ্গে মাঠপর্যায়ের প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে এই কাঠামো বাস্তবায়নে সফলতা অর্জন সম্ভব হয়।
৩. মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে কর্মকান্ড পরিচালনায় সমন্বয়হীনতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন অপরিহার্য। শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় শিক্ষা খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত দুটো মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ের মাধ্যমে। কিন্তু এই দুই মন্ত্রণালয় এবং এদের অধীনস্থ অধিদপ্তরগুলো এবং বিভিন্ন সংস্থার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, নীতি ও কৌশলের সামঞ্জস্যহীনতায় তৈরি হয় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা যা সিদ্বান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে মন্থর করে দেয়। ফলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়। মন্ত্রণালয় দ্ুেটা ও অন্যান্য স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এই রেষারেষী বা রশি টানাটানি ধরনের সমস্যাগুলো শুধু নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নকেই বাধাগ্রস্ত করে না, বরং অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদানের কাজকে কঠিন করে তোলে। এমনকি বাস্তবতা হলো দুই মন্ত্রণালয়ের খবরদারিতে একই প্রতিষ্ঠানের দুটো ইউনিট একত্রে কাজ করতে পারে না। তার উজ্জ্বল উদাহরণ হল জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সর্বশেষ পাঠ্যক্রম প্রণয়নে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক ধারা নিয়ে কাজের সমন্বয় ও সামঞ্জস্যহীনতা। অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা জানেন যে, এই দুই মন্ত্রণালয়সহ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কোন কাজ করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক ব্যক্তিদের এক টেবিলে নিয়ে আসা কতটা কঠিন কাজ।
শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় প্রশাসনিক কর্মকান্ডে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা অনেক সমস্যা তৈরি করে। চলমান রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক সঙস্কৃতিতে প্রশাসনিক সামঞ্জস্যহীনতা আর ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা একটি দুরূহ কাজ। ক্ষমতার এই পার্থক্য যেমন সামঞ্জস্যহীনতার বিস্তারের মাধ্যমে সমন্বয়হীনতার আবহ তৈরি করে, তেমনি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সম্পর্কের মাঝেও দূরত্বের সৃষ্টি করে। এ ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা শুধু শিক্ষা কার্যক্রমের বাস্তবায়নেই বাধা দেয় না, বরং শিক্ষার মানোন্নয়নের প্রচেষ্টাগুলোকেও স্তব্ধ করে দেয়। এসব সমস্যার সমাধান ছাড়া প্রকৃত অর্থে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন করা অসম্ভব। তাই, প্রশাসনিক কর্মকান্ডে সামঞ্জস্য আনা এবং মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোর মধ্যে কার্যকর যোগাযোগ ও সহযোগিতা নিশ্চিত করা জরুরি, যাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া দ্রুততর হয় এবং সময়ের ধারাবাহিকতায় ক্রমাগত শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব হয়।
৪. বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সফলতা অর্জনে প্রশাসনিক স্বৈরাচার নিরোধসহ সব ধরনের স্বৈরাচারী আচার-আচরণ ও কর্মকান্ড প্রতিরোধ করতে হবে। শিক্ষাপ্রশাসনের সরকারি অধিকর্তা, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা প্রজান্ত্রের সেবক মাত্র, তারা জনগণের শাসক কিংবা প্রভু নন।
কথাটা তাদের প্রায়োগিক অর্থে বিশ্বাসে ও কর্মে প্রতিফলিত করতে হবে। আর যদি তা না করা যায়, তবে ক্ষমতা যাদের কাছে থাকবে, তারা সবসময় হাতে থাকা ছড়িটা রাষ্ট্রের জনগণের মাথার ওপর ঘোরানোর চেষ্টা চালাবে। ফলে সুযোগ পেলে তাদের ভেতরে জন্ম নেবে স্বৈরাচারী মনোভাব তাদের আচার-আচরণ ও কর্মকা-ে প্রকাশ পাবে। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সংস্কারের জন্য গণ-অভ্যুত্থান উত্তর যে গণদাবি উঠেছে, তার জন্যে শিক্ষাখাতসহ বিভিন্ন খাত উপখাতে বিরাজমান ছোট ছোট স্বৈরাচারী আচার-আচরণ ও কর্মকা-গুলোকে হঠানো দরকার। সর্বক্ষেত্রে স্বৈরাচারী আচার-আচরণ ও কর্মকান্ড নির্মূল করা গেলেই কেবল রাষ্ট্র থেকে স্বৈরতন্ত্র দূর করা সম্ভব হবে।
৫. শিক্ষা পরিকল্পনায় প্রশাসনিক উদ্যোগে অংশীজনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। ফলপ্রসূ শিক্ষাব্যবস্থার জন্য নানা স্তরের শিক্ষাপরিকল্পনায় সমন্বয় সাধন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি তাতে অংশীজনের মতামতের প্রতিফলন থাকা অত্যাবশ্যক। তা নাহলে কেন্দ্র থেকে প্রশাসনিকভাবে গৃহীত পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্তগুলোকে মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নে দেখা দেয় নানা সমস্যা। তাই শিক্ষাপরিকল্পনায় মূল অংশীজনদের মতামত ছাড়া কার্যকর পরিকল্পনা তৈরি করা অসম্ভব। অতীতে একদিকে শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রম প্রণয়নে বিশেষজ্ঞদের চাইতে রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মতামতকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। অপর দিকে যারা অংশীজন বা সুবিধাভোগী তাদের কাছ থেকে মতামত নেয়া হয়নি কিংবা নেয়া হলেও সেসব নামে মাত্র নেয়া হয়েছে এবং শেষপর্যন্ত উপেক্ষা করা হয়েছে।
৬. শিক্ষা পরিকল্পনায় শিক্ষা প্রশাসনের কর্তৃত্ববাদী আচরণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব ফেলার প্রচেষ্টাকে রোধ করা জরুরি। স্বাধীনতা উত্তর কাল থেকে শিক্ষা পরিকল্পনার বিশেষায়িত বিষয়গুলোতে (যেমন- শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষায় অর্থায়ন ইত্যাদি) প্রশাসনের অভিভাবকসূলভ আচরণ এবং নীতিমালা তৈরি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার প্রভাব দেখা যায়। এর ফলে শিক্ষা পরিকল্পনায় একপেশে চিন্তাভাবনার প্রতিফলন যেমন দেখা যায়, তেমনি মানসম্মত শিক্ষার জন্য উপযুক্ত শিক্ষাক্রম ও তার বাস্তবায়নে ঘাটতিও পরিলক্ষিত হয়। এরই উজ্জ্বল উদাহরণ বিগত সরকারের সময়ে প্রনীত নতুন শিক্ষাক্রম। উপযোগিতার বিচারে এটা যে বাস্তবায়নযোগ্য নয়, সেটা শিক্ষা উপদেষ্টা তার প্রথম কর্মদিবসেই ঘোষণা করেছেন।
৭. শিক্ষা প্রশাসনে যোগ্য, দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবল নিয়োগ এবং মূল্যায়নের ভিত্তিতে কর্মরত কর্মীদের পদায়নের সুযোগ নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। বর্তমানে শিক্ষা প্রশাসনের উচ্চপদগুলোতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে বদলি বা পদোন্নতির মাধ্যমে আসা ব্যক্তিরা আসীন হন। তাদের অনেকেরই শিক্ষা ব্যবস্থার বিশেষায়িত ও সম্পর্কিত বিষয়গুলো সম্পর্কে পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা কিংবা স্বচ্ছ ধারণা থাকে না। ফলে সঠিক জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাবের কারণে তারা প্রায়ই রাষ্ট্রের স্বার্থে নয়, নিজেদের চিন্তাভাবনা বা কোন বিশেষ মহলের অভিপ্রায়কে বাস্তবায়নে কাজ করে। ফলে শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃত উন্নয়ন তো দূরের কথা, তারা তৈরি করেন নানা জটিলতা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শিক্ষাক্ষেত্রে অনভিজ্ঞ ও যথাযথ দক্ষতাহীন ব্যক্তিরা যদি শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রম প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তবে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের পরিবর্তে সৃষ্টি হতে পারে বিভিন্ন সমস্যার। তাই শিক্ষাপ্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হবে, যাদের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান, পর্যাপ্ত দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা রয়েছে। ফলে তাদের জ্ঞান, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও গবেষণাজাত অবদান দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও কার্যকর ও ফলপ্রসূ করে তুলবে।
৮. অব্যাহতভাবে শিক্ষা প্রশাসনের প্রতিটি পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির কর্মদক্ষতা মূল্যায়নে কার্যকর কর্মদক্ষতা ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি অনুসরণ অত্যন্ত জরুরি। এর
মাধ্যমে দায়-দায়িত্বের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কর্মীদের পেশাগত উন্নয়নের জায়গাগুলো চিহ্নিত করা সহজ হবে। জ্ঞান, দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রশাসনে পদোন্নতির সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে যোগ্য ব্যক্তিরা উচ্চপদে উন্নীত হয়ে তাদের মেধা ও দক্ষতা সর্ব্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও জনগণের সেবার সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন। শিক্ষকতা কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছাড়া শিক্ষাপ্রশাসনে অধিকর্তা বা কর্মকর্তার পদে অধিষ্ঠিত হওয়া ব্যক্তির পক্ষে বাস্তব অনেক বিষয় সম্পর্কে ওয়াকিফহাল না থাকার ফলে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থতার পরিচয় দিতে হয়। তাই অব্যাহত কর্মদক্ষতা মূল্যায়ণের মাধ্যমে যোগ্যতাসম্পন্ন ও দক্ষ শিক্ষকদেরই শিক্ষা প্রশাসক হিসেবে পদায়নের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। বর্তমানে প্রচলিত ব্যবস্থায় একজন প্রধান শিক্ষক পর্যাপ্ত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও প্রশাসনিক উচ্চপদে পদোন্নতি লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। সঙ্গত কারণে আমরা মনে করি, যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে অভিজ্ঞ শিক্ষকদের জন্য প্রশাসনিক উচ্চপদে উন্নীত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা একান্ত প্রয়োজন, যা শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
৯. শিক্ষাব্যবস্থায় বিশেষায়িত পরিকল্পনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও পরিকল্পনা প্রণয়নে বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করে তাদের মতামতকে প্রাধাণ্য দিতে হবে। নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও পরিকল্পনা প্রণয়নে কিংবা শিক্ষাক্ষেত্রে কোন মৌলিক পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের সিদ্ধান্ত নিতে গবেষণা ও দলিল-প্রমাণাদির ওপর ভিত্তি করেই করতে হবে। শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রম প্রণয়ন রাষ্ট্রের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এসব পরিকল্পনা তৈরিতে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রের মূল অংশীজনদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা আবশ্যক। প্রকৃতপক্ষে চাহিদাভিত্তিক ও সময়োপযোগী শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করতে শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক, অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের মতামত ও পরামর্শকে অগ্রাধিকার দিয়েই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষা প্রশাসনকে এ ধরনের বিশেষায়িত শিক্ষা পরিকল্পনায় অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ বা বিশেষ হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এই শিক্ষানীতি বা শিক্ষাক্রম প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় প্রশাসনের ভূমিকা হবে সহায়ক, যাতে বিশেষজ্ঞদের পরিকল্পনা সহজভাবে ও দ্রুত বাস্তবায়িত হতে পারে এবং শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে বাস্তবভিত্তিক কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়।
এই নিবন্ধের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে, আঠারো শতকে প্রারম্ভে পশ্চাত্যের ধ্যান-ধারণায় প্রভাবিত বঙ্গীয় রেনেসাঁসের উদ্ভোধন ও তাঁবেদার জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য যে প্রশাসনিক কাঠামো উপনিবেশিক শাসক শ্রেণী চালু করেছিল স্বাধীন বাংলাদেশে সেটা বহু আগেই তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের সম্ভাবনাময় জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক বিকেন্দ্রীকরণের জন্য শিক্ষা প্রশাসনের দ্রুত পুনর্গঠন যেমন জরুরি, তেমনি যুগোপযোগী শিক্ষার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ সৃষ্টি করে মানুষের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটানো এখন সময়ের দাবি। আশা করছি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আলোচ্য বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার বিনির্মাণে দ্রুত শিক্ষা প্রশাসনের সংস্কার সাধন করবে।
[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, লন্ডন, যুক্তরাজ্য]