alt

উপ-সম্পাদকীয়

‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়ন জলে ভাসি’

মানজার চৌধুরী সুইট

: মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

(শেষাংশ)

১৯৪৭ সালের পর থেকে এ ভূখ-টি পূর্ববাংলা নামেই পরিচিত ছিল। ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদের যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও পূর্ববাংলার বেশিরভাগ নেতা পূর্ববাংলা নামের বিলুপ্তির তীব্র বিরোধিতা করেন। পূর্ববাংলা নাম মুছে ফেলার রাষ্ট্রীয় চক্রান্তের বছর ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হলো জহির রায়হানের ‘আরেক ফাগুন’ উপন্যাসটি। উপন্যাসে তিনি দেখিয়েছিলেন ২১ ফেব্রুয়ারি পালন করতে গিয়ে যারা গ্রেপ্তার বরণ করেছিল কারাগারে তারা সমবেত কন্ঠে গাইছেÑ ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি। ১৯৫৬ সালে কার্জন হলে পাকিস্তান গণপরিষদ সদস্যদের সংবর্ধনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই অনুষ্ঠানে আয়োজকরা সনজীদা খাতুনকে গান গাইতে অনুরোধ করেন। মঞ্চে উঠে তিনি কি গাইবেন ভাবছেন, সে সময় গণপরিষদের সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান দর্শক সারিতে বসেছিলেন। তিনি তখনও বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেননি। দর্শক সারি থেকে তিনি সনজীদা খাতুনকে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গাইতে অনুরোধ করেন। তখনই বোঝা গিয়েছিল এই গানটির প্রতি তার বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও স্বাধিকার আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমার সোনার বাংলাসহ রবীন্দ্র ও নজরুলের অসংখ্য দেশাত্মবোধক গান তখন থেকেই মানুষের মুখে মুখে ফিরতে শুরু করে। চলচ্চিত্রে ‘আমার সোনার বাংলা’ সুরটি প্রথম ব্যবহার হয়েছিল, সত্যজিৎ রায়ের ‘অপু ট্রিলজির’ তৃতীয় চলচ্চিত্র অপুর সংসারে।

মূলত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসাবে গানটির ভিত্তি তৈরি হচ্ছিল সাংস্কৃতিক স্বাধিকার আন্দোলনের সময় থেকে। কিন্তু শুদ্ধরূপে এই গান গাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিল। সে সময় পূর্ববঙ্গে যে সুরে গানটি গাওয়া হতো, সেই সুরটি ছিল ১৯৪৮ সালে সুচিত্রা মিত্রের গাওয়া গ্রামোফোন রেকর্ডের সুরে। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত স্বরবিতানের ইন্দিরা দেবীর স্বরলিপি অনুযায়ী নয়। গানটি আরেকটি বিশেষ কারণে জনপ্রিয়তা পায় ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনের ক্ষেত্রে তৎকালিন মুসলিম লীগ সরকার বাধা প্রদান করেন এবং তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানে টেলিভিশনে রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধ করে। পূর্ববঙ্গে তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৯৬৭ সালের ৪ জুলাই তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী খাজা সাহাবুদ্দিন তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেয়। তার বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা উপস্থিত করার জন্য সংবাদপত্রগুলোর দোষারোপ করেন। পূর্ববঙ্গের নানা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে স্বাধীকার আন্দোলন স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে এগোতে থাকে। এমন সময় ১৯৭০ সালে বহু বাধা বিপত্তি পেরিয়ে জহির রায়হান নির্মিত দেশের প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’ মুক্তি পায়। এই চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি যথেষ্ট মর্যাদার সঙ্গে পরিবেশিত হয়। এই গানটির চলচ্চিত্রে পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন আতাউর রহমান। চলচ্চিত্রে তার নান্দনিক উপস্থাপনা ও চিত্রায়নে প্রতিটি বাঙ্গালীর বুকে গভীরভাবে দাগ কাটে।

বাঙালির জীবনে অবিস্মরণী ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনে জয়লাভ, ৩১৩ বিশিষ্ট জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠনের অধিকার অর্জন করে। ছয় দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র রচনার প্রস্তুতি চলে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগের সারাদেশের জনপ্রতিনিধিদের দু’দিন ব্যাপী এক সভা অনুষ্ঠিত হয় ইঞ্জিনিয়িারিং ইনষ্টিটিউটে। এই সভা শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পর্বে ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা’ ও ‘আমার সোনার বাংলা’ গান দুটি পরিবেশিত হয়েছিল।

৩ মার্চ ১৯৭১ বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ঘোষণাপত্র প্রচার হয়। এই ঘোষণাপত্রে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসাবে গ্রহণ করা হয়। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ পাকিস্তান বেতারে প্রচারের অনুমতি না পাওয়ায় ঢাকা বেতারে প্রায় সবাই কর্মকর্তার/কর্মচারী কর্মক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে এলে তখন রেডিওতে যন্ত্রসঙ্গীতে ‘আমার সোনার বাংলা’ বাজছিল।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের কয়েকজন বেতার কর্মী বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীকারের পক্ষে জনগণকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করতে গঠন করেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতারকেন্দ্র। এ বেতারকেন্দ্র থেকে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি প্রথম প্রচারিত হয় ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ সকাল ৯টার প্রথম অধিবেশনে। গানটি ছিল ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছায়াছবির গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে।

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে মুজিব নগর সরকার গঠন করা হয়। সেখানে জাতীয় নেতারা মঞ্চে উঠতেই শুরু হয় কোরআন তেলাওয়াৎ আর জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’। আসাদুল ও আইয়ুব জাতীয় সঙ্গীতে কণ্ঠ দেন। তারপর শুরু হয় গার্ড অব অনার পর্বটি। বাংলাদেশের জাতীয় সরকার শপথ গ্রহণ করে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী হয়ে আসা সংগীত শিল্পীদের নিয়ে কলকাতার শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের সহায়তায় গঠন করা হলো ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’। এ সংগঠনের শিল্পীরা শরণার্থী শিবিরসহ বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে দেশাত্মবোধক গান গেয়ে বেড়াতেন। গানগুলোর মধ্যে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি ছিল অন্যতম। দলের উল্লেখযোগ্য শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন- মাহমুদুর রহমান বেনু, জিয়াউদ্দিন আলী তারিক, শাহীন সামাদ, ডালিয়া নওশীন, বিপুল ভট্টাচার্য, মোসাদ আলীসহ অনেকে।

মুক্তিযুদ্ধ চালাকালীন মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে শিল্পী মান্না দে ও সহশিল্পীদের কন্ঠে হিজ মাষ্টার ভয়েজ থেকে ‘আমার সোনার বাংলা’ আরেকটি ডিস্ক রেকর্ড বের করা হয়। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের কোন একসময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সমাপ্তি সুর হিসাবে জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ প্রচারের সূত্রপাত হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে রবীন্দ্র সংগীত শিক্ষক ও স্বরলিপিকার শৈলজারঞ্জন মজুমদার, মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার পুরোধা ব্যক্তিত্ব ওয়াহিদুল হককে বারবার তাগাদা দিয়েছিলেন তোমরা সোনার বাংলা গানটির সুর ঠিক করে নিচ্ছ না কেন।

অবশেষে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুক্ত হলো বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর ‘আমার সোনার বাংলা’ জাতীয় সংগীতটির আবার সঠিক স্বরলিপি ও শুদ্ধ সুরের প্রসঙ্গটি উঠলো। এ সময় বিশ্বভারতী বাংলাদেশকে উপহার স্বরূপ দেবার জন্য ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীকৃত স্বরলিপিটি দশ হাজার কপি ছাপিয়েছিল। পরে তারা যখন জানতে পারলো বাংলাদেশে যে সুরটি গাওয়া হয় তা ঐ স্বরলিপি অনুযায়ী নয়। সূচিত্রা মিত্রের গাওয়া রেকর্ডের মতো। তখন সেই মুদ্রিত স্বরলিপি পাঠানো স্থগিত হয়। সুচিত্রা মিত্রের গীত ১৯৪৮ এ প্রকাশিত গ্রামোফোন রেকর্ড অনুসারে শান্তি দেব ঘোষকৃত স্বরলিপি (স্বরলিপি পত্র ১৩৭৮) পুনরায় ছেপে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাঠিয়েছিলেন বলে জানা যায়। এ স্বরলিপিটি ৪৬নং স্বরবিতানে সুরভেদ/ছন্দভেদ অংশে পরে সংযোজিত হয়।

স্বাধীনতার পর আব্দুল আহাদ ও দুজন রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী সমবিহারে শান্তিনিকেতনে আমাদের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলার’ স্বরলিপি বিশ্বভারতী সংগীত বোর্ডকে অনুমোদনের জন্য আব্দুল আহাদের সংগীত শিক্ষক শান্তি দেব ঘোষের সহায়তায় বিশ্বভারতী সংগীত বোর্ড থেকে গানটির স্বরলিপি অনুমোদন করিয়ে আনা হয়।

১৯৭২ এর ১৩ জানুয়ারি তারিখে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে ‘আমার সোনার বাংলার’ পঁচিশ লাইনের প্রথম দশ লাইন সদ্য গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত এবং প্রথম চার লাইন যন্ত্রসঙ্গীতে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করার ঘোষণা দেওয়া হয়। জাতীয় সংসদে স্বরলিপিসহ জাতীয় সংগীত বিল পাশের পর সংগীতজ্ঞ বিশিষ্ট সুরকার সমর দাসের তত্ত্বাবধানে বিবিসি লন্ডন সামরিক ব্রাসব্যান্ড স্টুডিও থেকে জাতীয় সঙ্গীতের অর্কেস্ট্রেশন তৈরি করে আনা হয়। আজও এই সুরই বাজানো হয় জাতীয় অনুষ্ঠানে।

২০০৫ সালে আমাদের জাতীয় সংগীত রচনা ও সুরারোপে শতবর্ষ অতিক্রম করে। ২০০৬ সালের মার্চজুড়ে বিবিসি বাংলার শ্রোতা জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গানের মর্যাদা লাভ করে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি।

অনেক ইতিহাস চড়াই, উৎরাই, সংগ্রাম অসংখ্য শহীদদের রক্তের বিনিময়ে আজকের এই জাতীয় সংগীত আমরা পেয়েছি। তাইতো আমরা বলি- ‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়ন জলে ভাসি।’

পৃথিবীর অন্যান্য সভ্য দেশের মতো মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে অর্জিত মৌলনীতির কোনকিছুকেই বিতর্কের মধ্যে না আনা ভালো, তাহলেই আমরা পৃথিবীতে একটি সভ্য জাতি হিসেবে নিজেদের নিয়ে গর্ব করতে পারব।

[লেখক : সাধারণ সম্পাদক, সত্যেন সেন শিল্পী গোষ্ঠী]

মানুষের পর কারা হবে বিশ্বজয়ী

স্বাস্থ্য খাতে ফার্মাসিস্টদের অবদান

টেকসই রাষ্ট্রীয় সংস্কারে শিক্ষা ব্যবস্থার অব্যাহত বিনির্মাণের বিকল্প নাই

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সামাজিক অর্থায়নের ভূমিকা

বিশ্ব নরসুন্দর দিবস

মধু পূর্ণিমা ও প্রাসঙ্গিক কথা

ছয়টি কমিশন গঠিত হলো কিন্তু শিক্ষা কোথায়?

বৃষ্টি হলেই নগরে জলাবদ্ধতা

‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়ন জলে ভাসি’

শিক্ষাব্যবস্থার বিনির্মাণে শিক্ষা প্রশাসনের পুনর্গঠন ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা

বন্যা পরবর্তী রোগবালাই

রম্যগদ্য : থামব কবে কাইজ্জা-ফ্যাসাদ

প্রসঙ্গ : জাতীয় সংগীত

পানির ব্যবহার, পানির রাজনীতি

রবীন্দ্র ভাবনায় কৃষি এবং আজকের প্রেক্ষাপট

শিক্ষা ব্যবস্থার বিনির্মাণে শিক্ষা প্রশাসনের পুনর্গঠন ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা

‘আবার তোরা মানুষ হ’

ভোজ্যতেল সংকট মেটাতে পাম চাষের গুরুত্ব

গোপনে ধারণকৃত ভিডিও ও ছবি দিয়ে প্রতারণা

হুন্ডি কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না

আকস্মিক বন্যা প্রতিরোধ ও প্রস্তুতির কৌশল

পতিতাবৃত্তি কি অপরাধ?

বন্যা-পরবর্তী কৃষকের সুরক্ষা করণীয়

নদী সংস্কার : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

নিজের চরকায় তেল দেবার নাম দেশপ্রেম

রম্যগদ্য : ডাক্তারি যখন আইসিইউতে

ডায়াবেটিস ও মুখের স্বাস্থ্য

বাঙালির ইলিশচর্চা

এসডিজি অর্জনে চ্যালেঞ্জ হতে পারে কুষ্ঠ রোগ

প্রসঙ্গ : পরিসংখ্যানের তথ্য বিকৃতি

বোরো ধান বিষয়ে কিছু সতর্কতা এবং সার ব্যবস্থাপনা

বন্যার জন্য ভারত কতটুকু দায়ী

গ্রাফিতিতে আদিবাসীদের বঞ্চনার চিত্র

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা

পুলিশের সংস্কার হোক জনগণের কল্যাণে

জলবায়ু পরিবর্তন ও আমাদের মনস্তত্ত্ব

tab

উপ-সম্পাদকীয়

‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়ন জলে ভাসি’

মানজার চৌধুরী সুইট

মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

(শেষাংশ)

১৯৪৭ সালের পর থেকে এ ভূখ-টি পূর্ববাংলা নামেই পরিচিত ছিল। ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদের যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও পূর্ববাংলার বেশিরভাগ নেতা পূর্ববাংলা নামের বিলুপ্তির তীব্র বিরোধিতা করেন। পূর্ববাংলা নাম মুছে ফেলার রাষ্ট্রীয় চক্রান্তের বছর ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হলো জহির রায়হানের ‘আরেক ফাগুন’ উপন্যাসটি। উপন্যাসে তিনি দেখিয়েছিলেন ২১ ফেব্রুয়ারি পালন করতে গিয়ে যারা গ্রেপ্তার বরণ করেছিল কারাগারে তারা সমবেত কন্ঠে গাইছেÑ ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি। ১৯৫৬ সালে কার্জন হলে পাকিস্তান গণপরিষদ সদস্যদের সংবর্ধনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই অনুষ্ঠানে আয়োজকরা সনজীদা খাতুনকে গান গাইতে অনুরোধ করেন। মঞ্চে উঠে তিনি কি গাইবেন ভাবছেন, সে সময় গণপরিষদের সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান দর্শক সারিতে বসেছিলেন। তিনি তখনও বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেননি। দর্শক সারি থেকে তিনি সনজীদা খাতুনকে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গাইতে অনুরোধ করেন। তখনই বোঝা গিয়েছিল এই গানটির প্রতি তার বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও স্বাধিকার আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমার সোনার বাংলাসহ রবীন্দ্র ও নজরুলের অসংখ্য দেশাত্মবোধক গান তখন থেকেই মানুষের মুখে মুখে ফিরতে শুরু করে। চলচ্চিত্রে ‘আমার সোনার বাংলা’ সুরটি প্রথম ব্যবহার হয়েছিল, সত্যজিৎ রায়ের ‘অপু ট্রিলজির’ তৃতীয় চলচ্চিত্র অপুর সংসারে।

মূলত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসাবে গানটির ভিত্তি তৈরি হচ্ছিল সাংস্কৃতিক স্বাধিকার আন্দোলনের সময় থেকে। কিন্তু শুদ্ধরূপে এই গান গাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিল। সে সময় পূর্ববঙ্গে যে সুরে গানটি গাওয়া হতো, সেই সুরটি ছিল ১৯৪৮ সালে সুচিত্রা মিত্রের গাওয়া গ্রামোফোন রেকর্ডের সুরে। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত স্বরবিতানের ইন্দিরা দেবীর স্বরলিপি অনুযায়ী নয়। গানটি আরেকটি বিশেষ কারণে জনপ্রিয়তা পায় ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনের ক্ষেত্রে তৎকালিন মুসলিম লীগ সরকার বাধা প্রদান করেন এবং তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানে টেলিভিশনে রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধ করে। পূর্ববঙ্গে তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৯৬৭ সালের ৪ জুলাই তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী খাজা সাহাবুদ্দিন তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেয়। তার বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা উপস্থিত করার জন্য সংবাদপত্রগুলোর দোষারোপ করেন। পূর্ববঙ্গের নানা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে স্বাধীকার আন্দোলন স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে এগোতে থাকে। এমন সময় ১৯৭০ সালে বহু বাধা বিপত্তি পেরিয়ে জহির রায়হান নির্মিত দেশের প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’ মুক্তি পায়। এই চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি যথেষ্ট মর্যাদার সঙ্গে পরিবেশিত হয়। এই গানটির চলচ্চিত্রে পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন আতাউর রহমান। চলচ্চিত্রে তার নান্দনিক উপস্থাপনা ও চিত্রায়নে প্রতিটি বাঙ্গালীর বুকে গভীরভাবে দাগ কাটে।

বাঙালির জীবনে অবিস্মরণী ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনে জয়লাভ, ৩১৩ বিশিষ্ট জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠনের অধিকার অর্জন করে। ছয় দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র রচনার প্রস্তুতি চলে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগের সারাদেশের জনপ্রতিনিধিদের দু’দিন ব্যাপী এক সভা অনুষ্ঠিত হয় ইঞ্জিনিয়িারিং ইনষ্টিটিউটে। এই সভা শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পর্বে ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা’ ও ‘আমার সোনার বাংলা’ গান দুটি পরিবেশিত হয়েছিল।

৩ মার্চ ১৯৭১ বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ঘোষণাপত্র প্রচার হয়। এই ঘোষণাপত্রে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসাবে গ্রহণ করা হয়। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ পাকিস্তান বেতারে প্রচারের অনুমতি না পাওয়ায় ঢাকা বেতারে প্রায় সবাই কর্মকর্তার/কর্মচারী কর্মক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে এলে তখন রেডিওতে যন্ত্রসঙ্গীতে ‘আমার সোনার বাংলা’ বাজছিল।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের কয়েকজন বেতার কর্মী বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীকারের পক্ষে জনগণকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করতে গঠন করেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতারকেন্দ্র। এ বেতারকেন্দ্র থেকে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি প্রথম প্রচারিত হয় ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ সকাল ৯টার প্রথম অধিবেশনে। গানটি ছিল ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছায়াছবির গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে।

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে মুজিব নগর সরকার গঠন করা হয়। সেখানে জাতীয় নেতারা মঞ্চে উঠতেই শুরু হয় কোরআন তেলাওয়াৎ আর জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’। আসাদুল ও আইয়ুব জাতীয় সঙ্গীতে কণ্ঠ দেন। তারপর শুরু হয় গার্ড অব অনার পর্বটি। বাংলাদেশের জাতীয় সরকার শপথ গ্রহণ করে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী হয়ে আসা সংগীত শিল্পীদের নিয়ে কলকাতার শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের সহায়তায় গঠন করা হলো ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’। এ সংগঠনের শিল্পীরা শরণার্থী শিবিরসহ বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে দেশাত্মবোধক গান গেয়ে বেড়াতেন। গানগুলোর মধ্যে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি ছিল অন্যতম। দলের উল্লেখযোগ্য শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন- মাহমুদুর রহমান বেনু, জিয়াউদ্দিন আলী তারিক, শাহীন সামাদ, ডালিয়া নওশীন, বিপুল ভট্টাচার্য, মোসাদ আলীসহ অনেকে।

মুক্তিযুদ্ধ চালাকালীন মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে শিল্পী মান্না দে ও সহশিল্পীদের কন্ঠে হিজ মাষ্টার ভয়েজ থেকে ‘আমার সোনার বাংলা’ আরেকটি ডিস্ক রেকর্ড বের করা হয়। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের কোন একসময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সমাপ্তি সুর হিসাবে জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ প্রচারের সূত্রপাত হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে রবীন্দ্র সংগীত শিক্ষক ও স্বরলিপিকার শৈলজারঞ্জন মজুমদার, মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার পুরোধা ব্যক্তিত্ব ওয়াহিদুল হককে বারবার তাগাদা দিয়েছিলেন তোমরা সোনার বাংলা গানটির সুর ঠিক করে নিচ্ছ না কেন।

অবশেষে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুক্ত হলো বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর ‘আমার সোনার বাংলা’ জাতীয় সংগীতটির আবার সঠিক স্বরলিপি ও শুদ্ধ সুরের প্রসঙ্গটি উঠলো। এ সময় বিশ্বভারতী বাংলাদেশকে উপহার স্বরূপ দেবার জন্য ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীকৃত স্বরলিপিটি দশ হাজার কপি ছাপিয়েছিল। পরে তারা যখন জানতে পারলো বাংলাদেশে যে সুরটি গাওয়া হয় তা ঐ স্বরলিপি অনুযায়ী নয়। সূচিত্রা মিত্রের গাওয়া রেকর্ডের মতো। তখন সেই মুদ্রিত স্বরলিপি পাঠানো স্থগিত হয়। সুচিত্রা মিত্রের গীত ১৯৪৮ এ প্রকাশিত গ্রামোফোন রেকর্ড অনুসারে শান্তি দেব ঘোষকৃত স্বরলিপি (স্বরলিপি পত্র ১৩৭৮) পুনরায় ছেপে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাঠিয়েছিলেন বলে জানা যায়। এ স্বরলিপিটি ৪৬নং স্বরবিতানে সুরভেদ/ছন্দভেদ অংশে পরে সংযোজিত হয়।

স্বাধীনতার পর আব্দুল আহাদ ও দুজন রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী সমবিহারে শান্তিনিকেতনে আমাদের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলার’ স্বরলিপি বিশ্বভারতী সংগীত বোর্ডকে অনুমোদনের জন্য আব্দুল আহাদের সংগীত শিক্ষক শান্তি দেব ঘোষের সহায়তায় বিশ্বভারতী সংগীত বোর্ড থেকে গানটির স্বরলিপি অনুমোদন করিয়ে আনা হয়।

১৯৭২ এর ১৩ জানুয়ারি তারিখে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে ‘আমার সোনার বাংলার’ পঁচিশ লাইনের প্রথম দশ লাইন সদ্য গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত এবং প্রথম চার লাইন যন্ত্রসঙ্গীতে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করার ঘোষণা দেওয়া হয়। জাতীয় সংসদে স্বরলিপিসহ জাতীয় সংগীত বিল পাশের পর সংগীতজ্ঞ বিশিষ্ট সুরকার সমর দাসের তত্ত্বাবধানে বিবিসি লন্ডন সামরিক ব্রাসব্যান্ড স্টুডিও থেকে জাতীয় সঙ্গীতের অর্কেস্ট্রেশন তৈরি করে আনা হয়। আজও এই সুরই বাজানো হয় জাতীয় অনুষ্ঠানে।

২০০৫ সালে আমাদের জাতীয় সংগীত রচনা ও সুরারোপে শতবর্ষ অতিক্রম করে। ২০০৬ সালের মার্চজুড়ে বিবিসি বাংলার শ্রোতা জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গানের মর্যাদা লাভ করে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি।

অনেক ইতিহাস চড়াই, উৎরাই, সংগ্রাম অসংখ্য শহীদদের রক্তের বিনিময়ে আজকের এই জাতীয় সংগীত আমরা পেয়েছি। তাইতো আমরা বলি- ‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়ন জলে ভাসি।’

পৃথিবীর অন্যান্য সভ্য দেশের মতো মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে অর্জিত মৌলনীতির কোনকিছুকেই বিতর্কের মধ্যে না আনা ভালো, তাহলেই আমরা পৃথিবীতে একটি সভ্য জাতি হিসেবে নিজেদের নিয়ে গর্ব করতে পারব।

[লেখক : সাধারণ সম্পাদক, সত্যেন সেন শিল্পী গোষ্ঠী]

back to top