alt

উপ-সম্পাদকীয়

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সামাজিক অর্থায়নের ভূমিকা

মতিউর রহমান

: বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সামাজিক অর্থায়ন বলতে এমন এক ধরনের অর্থায়ন প্রক্রিয়াকে বোঝায়, যেখানে আর্থিক মুনাফার পাশাপাশি সমাজে ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টির লক্ষ্যে বিনিয়োগ করা হয়। এর মূল লক্ষ্য হলো সামাজিক, পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানে সহায়তা করা। সামাজিক অর্থায়নের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠী, পরিবেশ সুরক্ষা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং সমতা বৃদ্ধির মতো ক্ষেত্রগুলোতে বিনিয়োগ করা হয়, যা সাধারণ ব্যবসায়িক মুনাফার বাইরে বৃহত্তর সামাজিক উপকারে আসে। এ ধরনের অর্থায়ন বিভিন্ন আকারে হতে পারে, যেমন ক্ষুদ্রঋণ, সামাজিক প্রভাব বন্ড, দাতব্য সংস্থার অনুদান, বা সামাজিক উদ্যোগে বিনিয়োগ।

বাংলাদেশ একটি জলবায়ু-সংবেদনশীল দেশ, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশেষভাবে প্রবল। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, বন্যা, ঘন ঘূর্ণিঝড়, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং লবণাক্ততার কারণে কৃষিজমির ক্ষতি বাংলাদেশের জনগণের জীবন ও জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলছে। প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যা মূলত লাভের ওপর কেন্দ্রীভূত, জলবায়ু পরিবর্তনের এই জটিল সমস্যাগুলোর সমাধানে সম্পূর্ণ কার্যকর হতে পারেনি। তবে সামাজিক অর্থায়ন একটি নতুন সম্ভাবনার পথ খুলে দিয়েছে, যা আর্থিক এবং সামাজিক উভয় দিক থেকেই ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম।

সামাজিক অর্থায়নের মূল লক্ষ্য হলো এমন প্রকল্প বা উদ্যোগে বিনিয়োগ করা যা আর্থিক মুনাফার পাশাপাশি সামাজিক এবং পরিবেশগত উন্নয়ন ঘটায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তন সরাসরি দেশের অর্থনীতি, কৃষি এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উপর প্রভাব ফেলে, সামাজিক অর্থায়ন পরিবেশগত সমস্যা মোকাবিলায় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিশেষত, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হ্রাস করার লক্ষ্যে এই অর্থায়নের মাধ্যমে টেকসই প্রকল্প ও উদ্ভাবনের প্রসার ঘটানো সম্ভব।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সামাজিক অর্থায়নের অন্যতম প্রধান দিক হলো ইমপ্যাক্ট ইনভেস্টিং বা প্রভাবমূলক বিনিয়োগ। এ ধরনের বিনিয়োগ মূলত নবায়নযোগ্য জ্বালানি, জলবায়ু সহনশীল কৃষি এবং টেকসই জলব্যবস্থাপনার মতো খাতে কেন্দ্রীভূত হয়। বাংলাদেশে বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে সৌরশক্তির মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পগুলো সামাজিক অর্থায়নের মাধ্যমে দ্রুত প্রসার লাভ করেছে। এই প্রকল্পগুলো শুধুমাত্র জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাচ্ছে না, বরং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কাছে সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব শক্তির উৎস সরবরাহ করছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য উদ্ভাবনী প্রযুক্তির বিকাশেও সামাজিক অর্থায়নের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠী আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সামাজিক অর্থায়ন এই ধরনের উদ্ভাবনী সমাধানে বিনিয়োগ করে যা এ সম্প্রদায়গুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। যেমন লবণাক্ততামুক্ত চাষাবাদ বা ভাসমান কৃষি ব্যবস্থার মতো টেকসই কৃষি পদ্ধতির উন্নয়ন কৃষকদের জীবিকা রক্ষায় সহায়ক হতে পারে। সামাজিক অর্থায়ন এ ধরনের উদ্যোগে অর্থায়ন করে, যা কৃষকদের খাদ্য নিরাপত্তা এবং জীবিকা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।

ক্ষুদ্রঋণও সামাজিক অর্থায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো নিম্নআয়ের পরিবারগুলোকে ছোট ঋণ ও আর্থিক পরিষেবা প্রদান করে, যা তাদের জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করে। গ্রামীণ এলাকায়, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি, ক্ষুদ্রঋণ সুবিধার মাধ্যমে পরিবারগুলো তাদের বাড়ি পুনঃনির্মাণ করতে, কৃষি খাতের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে এবং বিভিন্ন উপায়ে তাদের জীবিকা রক্ষা করতে সক্ষম হচ্ছে। এই উদ্যোগগুলো জলবায়ু সহনশীলতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

সামাজিক প্রভাব বন্ড (সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট বন্ড) নামে একটি নতুন সামাজিক অর্থায়ন পদ্ধতিও বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত প্রকল্পে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ধরনের বন্ডের মাধ্যমে বেসরকারি বিনিয়োগকারী, সরকারি সংস্থা এবং এনজিওদের মধ্যে একটি অংশীদারিত্ব তৈরি হয়, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য অর্থায়ন করা হয়। এই বন্ডগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশে দুর্যোগ প্রস্তুতি বা কার্বন নিঃসরণ কমানোর মতো প্রকল্পে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। প্রকল্প সফল হলে, বিনিয়োগকারীরা তাদের অর্থ ফেরত পায়, যা বিনিয়োগকারীদের আর্থিক সুবিধা প্রদান করার পাশাপাশি পরিবেশগত লক্ষ্যও অর্জন করে।

সামাজিক অর্থায়ন বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন প্রক্রিয়াও প্রচার করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়গুলো প্রায়ই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। সামাজিক অর্থায়নের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় যে এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলোতে যথাযথ সম্পদ পৌঁছায়, যা তাদের পরিবেশগত পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে সহায়তা করে।

বাংলাদেশের অনেক নারীরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশেষভাবে অনুভব করেন, বিশেষ করে কৃষিক্ষেত্রে। সামাজিক অর্থায়ন নারীদের নেতৃত্বাধীন প্রকল্প বা উদ্যোগে বিনিয়োগের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায়িত করে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সাহায্য করে।

সামাজিক অর্থায়নের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এটি বিভিন্ন অংশীদারদের মধ্যে সহযোগিতা উৎসাহিত করে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন এবং সামাজিক অর্থায়ন সরকার, বেসরকারি খাত এবং সিভিল সোসাইটির মধ্যে একটি সেতু হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান, এনজিও এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোর মধ্যে অংশীদারিত্ব ইতোমধ্যেই সফল প্রকল্প তৈরি করেছে, যা জলবায়ু সহনশীলতা বৃদ্ধি করেছে। সামাজিক অর্থায়ন এ ধরনের অংশীদারিত্বকে আরও ত্বরান্বিত করতে পারে এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বৃহত্তর ভূমিকা রাখতে পারে। যদিও সামাজিক অর্থায়নের মাধ্যমে অনেক সুযোগ তৈরি হয়েছে, তবে এটি চ্যালেঞ্জমুক্ত নয়। অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিনিয়োগগুলো যেন প্রকৃতপক্ষে পরিবেশ এবং সম্প্রদায়ের জন্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এজন্য প্রকল্পের আর্থ-সামাজিক প্রভাব নির্ধারণে সঠিক মানদ- ও যাচাই প্রক্রিয়া থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, এটির জন্য একটি মানসম্মত মানদ- তৈরি করা যেতে পারে যা জলবায়ু সম্পর্কিত প্রকল্পগুলোর সাফল্য পরিমাপ করবে এবং এর আর্থিক ব্যবহার সম্পর্কে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে।

সর্বশেষে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সামাজিক অর্থায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং উদ্ভাবনী সমাধানে অর্থায়ন করে, এটি দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রচারে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

মানুষের পর কারা হবে বিশ্বজয়ী

স্বাস্থ্য খাতে ফার্মাসিস্টদের অবদান

টেকসই রাষ্ট্রীয় সংস্কারে শিক্ষা ব্যবস্থার অব্যাহত বিনির্মাণের বিকল্প নাই

বিশ্ব নরসুন্দর দিবস

মধু পূর্ণিমা ও প্রাসঙ্গিক কথা

‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়ন জলে ভাসি’

ছয়টি কমিশন গঠিত হলো কিন্তু শিক্ষা কোথায়?

বৃষ্টি হলেই নগরে জলাবদ্ধতা

‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়ন জলে ভাসি’

শিক্ষাব্যবস্থার বিনির্মাণে শিক্ষা প্রশাসনের পুনর্গঠন ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা

বন্যা পরবর্তী রোগবালাই

রম্যগদ্য : থামব কবে কাইজ্জা-ফ্যাসাদ

প্রসঙ্গ : জাতীয় সংগীত

পানির ব্যবহার, পানির রাজনীতি

রবীন্দ্র ভাবনায় কৃষি এবং আজকের প্রেক্ষাপট

শিক্ষা ব্যবস্থার বিনির্মাণে শিক্ষা প্রশাসনের পুনর্গঠন ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা

‘আবার তোরা মানুষ হ’

ভোজ্যতেল সংকট মেটাতে পাম চাষের গুরুত্ব

গোপনে ধারণকৃত ভিডিও ও ছবি দিয়ে প্রতারণা

হুন্ডি কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না

আকস্মিক বন্যা প্রতিরোধ ও প্রস্তুতির কৌশল

পতিতাবৃত্তি কি অপরাধ?

বন্যা-পরবর্তী কৃষকের সুরক্ষা করণীয়

নদী সংস্কার : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

নিজের চরকায় তেল দেবার নাম দেশপ্রেম

রম্যগদ্য : ডাক্তারি যখন আইসিইউতে

ডায়াবেটিস ও মুখের স্বাস্থ্য

বাঙালির ইলিশচর্চা

এসডিজি অর্জনে চ্যালেঞ্জ হতে পারে কুষ্ঠ রোগ

প্রসঙ্গ : পরিসংখ্যানের তথ্য বিকৃতি

বোরো ধান বিষয়ে কিছু সতর্কতা এবং সার ব্যবস্থাপনা

বন্যার জন্য ভারত কতটুকু দায়ী

গ্রাফিতিতে আদিবাসীদের বঞ্চনার চিত্র

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা

পুলিশের সংস্কার হোক জনগণের কল্যাণে

জলবায়ু পরিবর্তন ও আমাদের মনস্তত্ত্ব

tab

উপ-সম্পাদকীয়

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সামাজিক অর্থায়নের ভূমিকা

মতিউর রহমান

বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সামাজিক অর্থায়ন বলতে এমন এক ধরনের অর্থায়ন প্রক্রিয়াকে বোঝায়, যেখানে আর্থিক মুনাফার পাশাপাশি সমাজে ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টির লক্ষ্যে বিনিয়োগ করা হয়। এর মূল লক্ষ্য হলো সামাজিক, পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানে সহায়তা করা। সামাজিক অর্থায়নের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠী, পরিবেশ সুরক্ষা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং সমতা বৃদ্ধির মতো ক্ষেত্রগুলোতে বিনিয়োগ করা হয়, যা সাধারণ ব্যবসায়িক মুনাফার বাইরে বৃহত্তর সামাজিক উপকারে আসে। এ ধরনের অর্থায়ন বিভিন্ন আকারে হতে পারে, যেমন ক্ষুদ্রঋণ, সামাজিক প্রভাব বন্ড, দাতব্য সংস্থার অনুদান, বা সামাজিক উদ্যোগে বিনিয়োগ।

বাংলাদেশ একটি জলবায়ু-সংবেদনশীল দেশ, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশেষভাবে প্রবল। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, বন্যা, ঘন ঘূর্ণিঝড়, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং লবণাক্ততার কারণে কৃষিজমির ক্ষতি বাংলাদেশের জনগণের জীবন ও জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলছে। প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যা মূলত লাভের ওপর কেন্দ্রীভূত, জলবায়ু পরিবর্তনের এই জটিল সমস্যাগুলোর সমাধানে সম্পূর্ণ কার্যকর হতে পারেনি। তবে সামাজিক অর্থায়ন একটি নতুন সম্ভাবনার পথ খুলে দিয়েছে, যা আর্থিক এবং সামাজিক উভয় দিক থেকেই ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম।

সামাজিক অর্থায়নের মূল লক্ষ্য হলো এমন প্রকল্প বা উদ্যোগে বিনিয়োগ করা যা আর্থিক মুনাফার পাশাপাশি সামাজিক এবং পরিবেশগত উন্নয়ন ঘটায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তন সরাসরি দেশের অর্থনীতি, কৃষি এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উপর প্রভাব ফেলে, সামাজিক অর্থায়ন পরিবেশগত সমস্যা মোকাবিলায় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিশেষত, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হ্রাস করার লক্ষ্যে এই অর্থায়নের মাধ্যমে টেকসই প্রকল্প ও উদ্ভাবনের প্রসার ঘটানো সম্ভব।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সামাজিক অর্থায়নের অন্যতম প্রধান দিক হলো ইমপ্যাক্ট ইনভেস্টিং বা প্রভাবমূলক বিনিয়োগ। এ ধরনের বিনিয়োগ মূলত নবায়নযোগ্য জ্বালানি, জলবায়ু সহনশীল কৃষি এবং টেকসই জলব্যবস্থাপনার মতো খাতে কেন্দ্রীভূত হয়। বাংলাদেশে বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে সৌরশক্তির মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পগুলো সামাজিক অর্থায়নের মাধ্যমে দ্রুত প্রসার লাভ করেছে। এই প্রকল্পগুলো শুধুমাত্র জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাচ্ছে না, বরং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কাছে সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব শক্তির উৎস সরবরাহ করছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য উদ্ভাবনী প্রযুক্তির বিকাশেও সামাজিক অর্থায়নের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠী আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সামাজিক অর্থায়ন এই ধরনের উদ্ভাবনী সমাধানে বিনিয়োগ করে যা এ সম্প্রদায়গুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। যেমন লবণাক্ততামুক্ত চাষাবাদ বা ভাসমান কৃষি ব্যবস্থার মতো টেকসই কৃষি পদ্ধতির উন্নয়ন কৃষকদের জীবিকা রক্ষায় সহায়ক হতে পারে। সামাজিক অর্থায়ন এ ধরনের উদ্যোগে অর্থায়ন করে, যা কৃষকদের খাদ্য নিরাপত্তা এবং জীবিকা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।

ক্ষুদ্রঋণও সামাজিক অর্থায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো নিম্নআয়ের পরিবারগুলোকে ছোট ঋণ ও আর্থিক পরিষেবা প্রদান করে, যা তাদের জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করে। গ্রামীণ এলাকায়, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি, ক্ষুদ্রঋণ সুবিধার মাধ্যমে পরিবারগুলো তাদের বাড়ি পুনঃনির্মাণ করতে, কৃষি খাতের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে এবং বিভিন্ন উপায়ে তাদের জীবিকা রক্ষা করতে সক্ষম হচ্ছে। এই উদ্যোগগুলো জলবায়ু সহনশীলতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

সামাজিক প্রভাব বন্ড (সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট বন্ড) নামে একটি নতুন সামাজিক অর্থায়ন পদ্ধতিও বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত প্রকল্পে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ধরনের বন্ডের মাধ্যমে বেসরকারি বিনিয়োগকারী, সরকারি সংস্থা এবং এনজিওদের মধ্যে একটি অংশীদারিত্ব তৈরি হয়, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য অর্থায়ন করা হয়। এই বন্ডগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশে দুর্যোগ প্রস্তুতি বা কার্বন নিঃসরণ কমানোর মতো প্রকল্পে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। প্রকল্প সফল হলে, বিনিয়োগকারীরা তাদের অর্থ ফেরত পায়, যা বিনিয়োগকারীদের আর্থিক সুবিধা প্রদান করার পাশাপাশি পরিবেশগত লক্ষ্যও অর্জন করে।

সামাজিক অর্থায়ন বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন প্রক্রিয়াও প্রচার করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়গুলো প্রায়ই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। সামাজিক অর্থায়নের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় যে এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলোতে যথাযথ সম্পদ পৌঁছায়, যা তাদের পরিবেশগত পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে সহায়তা করে।

বাংলাদেশের অনেক নারীরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশেষভাবে অনুভব করেন, বিশেষ করে কৃষিক্ষেত্রে। সামাজিক অর্থায়ন নারীদের নেতৃত্বাধীন প্রকল্প বা উদ্যোগে বিনিয়োগের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায়িত করে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সাহায্য করে।

সামাজিক অর্থায়নের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এটি বিভিন্ন অংশীদারদের মধ্যে সহযোগিতা উৎসাহিত করে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন এবং সামাজিক অর্থায়ন সরকার, বেসরকারি খাত এবং সিভিল সোসাইটির মধ্যে একটি সেতু হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান, এনজিও এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোর মধ্যে অংশীদারিত্ব ইতোমধ্যেই সফল প্রকল্প তৈরি করেছে, যা জলবায়ু সহনশীলতা বৃদ্ধি করেছে। সামাজিক অর্থায়ন এ ধরনের অংশীদারিত্বকে আরও ত্বরান্বিত করতে পারে এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বৃহত্তর ভূমিকা রাখতে পারে। যদিও সামাজিক অর্থায়নের মাধ্যমে অনেক সুযোগ তৈরি হয়েছে, তবে এটি চ্যালেঞ্জমুক্ত নয়। অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিনিয়োগগুলো যেন প্রকৃতপক্ষে পরিবেশ এবং সম্প্রদায়ের জন্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এজন্য প্রকল্পের আর্থ-সামাজিক প্রভাব নির্ধারণে সঠিক মানদ- ও যাচাই প্রক্রিয়া থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, এটির জন্য একটি মানসম্মত মানদ- তৈরি করা যেতে পারে যা জলবায়ু সম্পর্কিত প্রকল্পগুলোর সাফল্য পরিমাপ করবে এবং এর আর্থিক ব্যবহার সম্পর্কে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে।

সর্বশেষে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সামাজিক অর্থায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং উদ্ভাবনী সমাধানে অর্থায়ন করে, এটি দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রচারে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

back to top