মাহরুফ চৌধুরী
রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও তার কাঠামো সংস্কারের জন্য পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি যে বিষয়টি নিয়ে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের সর্বাগ্রে ভাবার কথা সেটা হলো শিক্ষা। মৌলিক মানবিক চাহিদাগুলোর সারিতে চতুর্থ অবস্থানে থাকলেও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে শিক্ষার প্রাধান্যটা অনস্বীকার্য।
বলা হয়ে থাকে, শিক্ষাই জাতির মেরুদ-। তাই শিক্ষাকে শক্ত ভিতের উপর গড়ে তোলা না গেলে একটি রাষ্ট্রের নাগরিকেরা বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয় না। অপরদিকে ধারাবাহিক সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে আমাদের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থায় দেখা দিয়েছে গভীর ক্ষতের নানা উপসর্গ। সেসব আমাদের কারোরই অজানা নয়। তাই বলতেই হয়, ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা’। দীর্ঘদিন ধরে আমরা সেসব ক্ষত বয়ে চলেছি নানা কায়দায় ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছায়। প্রকৃতপক্ষে একদিকে শাসকের স্বেচ্ছারিতার সুবিধাবাদ অন্যদিকে শোষিতের ঐক্যের অভাব ও সংঘবদ্ধভাবে প্রতিরোধের অক্ষমতা এসব অনাচারের জন্য দায়ী। সাম্প্রতিক পরিবর্তিত পরিস্থিতে খোলস থেকে সেসব ক্ষত বেরিয়ে পড়েছে নানাভাবে ব্যাপক মাত্রায়।
শিক্ষাক্ষেত্রে নানা বৈষম্যের রূপকার অনেক রথী-মহারথী আত্মগোপন করেছেন। বাংলাদেশে ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো একটা দুটো নয়, অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ শিক্ষা প্রশাসনের বেশ কিছু ঊর্ধ্বতন পদাধিকারী পদত্যাগ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত অনেকেই পদত্যাগ করেছেন, আবার অনেকে হয়েছেন নিরুদ্দেশ। শিক্ষা প্রশাসনে দেখা দিয়েছে কূণ্যতা। যদিও অন্তর্র্বতীকালীন সরকার দ্রুততার সাথে শূন্য পদগুলো পূরণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে, তবুও বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারেনি। এ অবস্থায় দেশের প্রয়োজনে এখন সর্বস্তরের সাধারণ শিক্ষাসেবকদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে আর নানা পন্থায় ব্যথা উপসম করে শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষতগুলোকে সারিয়ে তুলতে হবে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শত সীমাবদ্ধতা ও প্রতিবন্ধকতার মাঝেও আমরা খুবই আশাবাদী যে অনেক প্রাণের আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমাদের দ্বারপ্রান্তে এমন একটা সুযোগ এসেছে আলোর পথে ভালোর দিকে যাবার যেটা হয়ত সহসা আর আসবে না। শিক্ষা সংস্কারের জন্য যদি আমরা এখনই সবাই মিলে যার যার জায়গা থেকে কাজ না করি, কিংবা কাজ করতে একত্রিত হতে চেষ্টা না করি, তবে তার জন্যে নব প্রজন্মের নতুন শিশুর কাছে সুকান্ত ভট্টাচার্যের যে অঙ্গীকার ছিল, তা পূর্ণ করা হবে না। তিনি ‘ছাড়পত্র’ কবিতায় দৃপ্ত কন্ঠে বলেছিলেন, চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,/ এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি-/ নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
আমরা যারা ভালোবেসে শিক্ষা নিয়ে কাজ করছি, তাদের অনেকেই নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকি শিক্ষাসেবক হিসেবে। বর্তমানে আমরা যারা এখন বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছি, আগামী প্রজন্মের কাছে আমাদেরও সুকান্ত ভট্টাচার্যের সেই একই অঙ্গীকার। তাই আমাদের উচিত হবে সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করে অব্যাহতভাবে শিক্ষার বিনির্মাণের মাধ্যমে টেকসই রাষ্ট্র সংস্কারের এ অনন্য সুযোগের সদ্ব্যবহার করা। আর নানা অবক্ষয়ের পথ ধরে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক পরিমন্ডলে যেসব জঞ্জাল জন্মেছে সেগুলোকে একে একে পরিষ্কার করে আমরা আমাদের প্রাথমিক নৈতিক দায়টুকু অন্তত শেষ করি। সেই ক্ষেত্রে জীবনমুখী যুগোপযোগী শিক্ষাই হোক আমাদের প্রেরণা আর দিক-নির্দেশনার উৎস। তবেই না অনেক প্রাণ আর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই মুক্তি অর্থবহ হয়ে উঠবে।
সাদামাটা একটি প্রশ্ন- কেমন শিক্ষাব্যবস্থা চাই? এ প্রশ্নের কোন সহজ সরল জবাব না থাকলেও আমাদের এ বিশেষ পরিস্থিতিতে বিধ্বস্ত শিক্ষা ব্যবস্থার বিনির্মাণের জন্য কোন না কোন জায়গা থেকে আলোচনাটা শুরু করতে হবে। তাই বলছি, আমরা এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা চাই যে শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের জন্যে এমন শিক্ষার সুযোগ এনে দেবে যে শিক্ষা আমাদেরকে শানিত ও প্রাণিত করবে জাতি গঠনের মূলমন্ত্র ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যকে অনুশীলন করতে। একই সাথে যে শিক্ষা হবে আমাদের জন্য ‘বৈষম্যহীন’ ও ‘স্বৈরাচারমুক্ত’ রাষ্ট্র বিনির্মাণে একটি ভেদাভেদহীন সমাজ কাঠামো তৈরির মূল চালিকাশক্তি। তেমনি একটি শিক্ষাব্যবস্থা চাই যেখানে শিক্ষার বিষয়বস্তু শিক্ষার্থীর প্রয়োজন ও আগ্রহকে লালন করবে এবং সাথে সাথে সে অনুযায়ী ‘শিক্ষার ঢালী’ সাজাবে। যেখানে শিক্ষক হবেন শিক্ষার্থীর শিক্ষা লাভের অনুপ্রেরণা আর শিক্ষার্থীদের কল্যাণই হবে শিক্ষকের ধ্যান-জ্ঞান, চিন্তা-ভাবনা ও কর্মকা-ের কেন্দ্রবিন্দু। আর তেমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা বিনির্মাণে এই মুহূর্তে যা যা সংস্কার করা দরকার, তার সব কয়টাই করা এখন সময়ের দাবি। কিন্তু সবকিছু তো আর রাতারাতি করা সম্ভব না। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনের অগ্রাধিকার ও আয়োজনের সীমাবদ্ধতাকে বিচার করেই আমাদের এগোতে হবে। আর বিদ্যমান জঞ্জালগুলোকে সরিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতা উতরিয়ে আমাদের আস্তে আস্তে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে অগ্রসর হতে হবে আর অব্যাহত রাখতে হবে বিনির্মাণের সুযোগ ও চেষ্টা-প্রচেষ্টাকে।
কথায় বলে, ‘নানা মুনির নানা মত’। বহুধা বিভক্ত সমাজে যুক্তির চেয়ে আবেগ বেশি কাজ করে। যৌথ কাজ করার সমস্যাটা সেখানে প্রকট। আমাদের মনে রাখতে হবে, যে অসহিষ্ণুতা স্বৈরাচারের বৈশিষ্ট্য সেটা যেন আমাদের আচার আচরণে প্রতিফলিত না হয়। আমাদের মাঝে মত দ্বৈততা বা মত বিরোধ থাকতেই পারে। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরিতে বদ্ধপরিকর। আমরা চাইলে খুব সহজেই মুক্ত আলোচনায় মুক্ত মনের পরিচয় দিয়ে মুক্ত বুদ্ধির চর্চায় একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করত পারি। রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করার জন্যে প্রথমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। শিক্ষাক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করা গেলে কেবল তখনই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পরিবেশ তৈরিতে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। আশা করছি, সমাজের সবাই শ্রেণী, বর্ণ, গোত্র, দল বা মতের মানুষকে সম্মান দিয়েই গণতন্ত্রের প্রধান যে ভিত্তি পরমত সহিষ্ণুত, সেটাকে আমাদের কথাবার্তা ও আচরণে প্রতিফলিত করেই পারস্পরিক বোঝাপড়ায় চিন্তা-ভাবনার দূরত্ব কিংবা দৈন্যকে কমিয়ে আনার সদিচ্ছাকে অঙ্গীকার করেই শিক্ষা সংস্কার বা শিক্ষা ব্যবস্থার বিনির্মাণের এ আলোচনা অব্যাহত থাকবে।
আমার কাছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রথম ও প্রধান ব্যর্থতা হলো মানুষকে মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে শেখাতে না পারা। আমাদের মনে রাখতে হবে, একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রধান নিয়ামক হলো তার রাষ্ট্রীয় দর্শনের মূলমন্ত্র ‘মানবতাবোধ’। আর যে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা তার নাগরিকদের মাঝে সে বোধ জন্মাতে ব্যর্থ সে রাষ্ট্র কখনই কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে না, কিংবা রাষ্ট্রের মানবতাবাদী চরিত্রকে বেশি সময় ধরে রাখতে পারে না। তাই আমাদের রাষ্ট্রীয় দর্শনে মানবতাবোধকে ধারণ করে শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবন-চর্যায় প্রতিফলিত করে সেটাকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এখানে পুনরায় বলতে চাই যে, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও কাঠামো সংস্কারকে টেকসই করতে শিক্ষা ব্যবস্থার অব্যাহত বিনির্মাণ জরুরি।
অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার সেই বিষয়টা মাথায় রেখে দ্রুত একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা উচিত যাতে প্রতিফলিত হবে গণঅভ্যুত্থান উত্তর ছাত্র-জনতার আশা আকাক্সক্ষার। দীর্ঘ দিনের অন্যায়-অত্যাচার আর বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার অনবরত সংগ্রামের সংস্কৃতি বজায় রাখার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধকারী শিক্ষাই আমরা চাই। জাতির নতুন প্রজন্মের জন্য তেমন শিক্ষা দেয়ার দার্শনিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা থেকেই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা বিনির্মাণের সব আয়োজন হওয়া উচিত। আমরা আশা করব, অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার তেমন একটা শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের জন্য বিনির্মাণ করবে যেটা হবে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের জাতীয় ঐক্য, সংহতি ও সমৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি।
[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]
মাহরুফ চৌধুরী
বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও তার কাঠামো সংস্কারের জন্য পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি যে বিষয়টি নিয়ে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের সর্বাগ্রে ভাবার কথা সেটা হলো শিক্ষা। মৌলিক মানবিক চাহিদাগুলোর সারিতে চতুর্থ অবস্থানে থাকলেও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে শিক্ষার প্রাধান্যটা অনস্বীকার্য।
বলা হয়ে থাকে, শিক্ষাই জাতির মেরুদ-। তাই শিক্ষাকে শক্ত ভিতের উপর গড়ে তোলা না গেলে একটি রাষ্ট্রের নাগরিকেরা বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয় না। অপরদিকে ধারাবাহিক সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে আমাদের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থায় দেখা দিয়েছে গভীর ক্ষতের নানা উপসর্গ। সেসব আমাদের কারোরই অজানা নয়। তাই বলতেই হয়, ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা’। দীর্ঘদিন ধরে আমরা সেসব ক্ষত বয়ে চলেছি নানা কায়দায় ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছায়। প্রকৃতপক্ষে একদিকে শাসকের স্বেচ্ছারিতার সুবিধাবাদ অন্যদিকে শোষিতের ঐক্যের অভাব ও সংঘবদ্ধভাবে প্রতিরোধের অক্ষমতা এসব অনাচারের জন্য দায়ী। সাম্প্রতিক পরিবর্তিত পরিস্থিতে খোলস থেকে সেসব ক্ষত বেরিয়ে পড়েছে নানাভাবে ব্যাপক মাত্রায়।
শিক্ষাক্ষেত্রে নানা বৈষম্যের রূপকার অনেক রথী-মহারথী আত্মগোপন করেছেন। বাংলাদেশে ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো একটা দুটো নয়, অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ শিক্ষা প্রশাসনের বেশ কিছু ঊর্ধ্বতন পদাধিকারী পদত্যাগ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত অনেকেই পদত্যাগ করেছেন, আবার অনেকে হয়েছেন নিরুদ্দেশ। শিক্ষা প্রশাসনে দেখা দিয়েছে কূণ্যতা। যদিও অন্তর্র্বতীকালীন সরকার দ্রুততার সাথে শূন্য পদগুলো পূরণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে, তবুও বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারেনি। এ অবস্থায় দেশের প্রয়োজনে এখন সর্বস্তরের সাধারণ শিক্ষাসেবকদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে আর নানা পন্থায় ব্যথা উপসম করে শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষতগুলোকে সারিয়ে তুলতে হবে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শত সীমাবদ্ধতা ও প্রতিবন্ধকতার মাঝেও আমরা খুবই আশাবাদী যে অনেক প্রাণের আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমাদের দ্বারপ্রান্তে এমন একটা সুযোগ এসেছে আলোর পথে ভালোর দিকে যাবার যেটা হয়ত সহসা আর আসবে না। শিক্ষা সংস্কারের জন্য যদি আমরা এখনই সবাই মিলে যার যার জায়গা থেকে কাজ না করি, কিংবা কাজ করতে একত্রিত হতে চেষ্টা না করি, তবে তার জন্যে নব প্রজন্মের নতুন শিশুর কাছে সুকান্ত ভট্টাচার্যের যে অঙ্গীকার ছিল, তা পূর্ণ করা হবে না। তিনি ‘ছাড়পত্র’ কবিতায় দৃপ্ত কন্ঠে বলেছিলেন, চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,/ এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি-/ নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
আমরা যারা ভালোবেসে শিক্ষা নিয়ে কাজ করছি, তাদের অনেকেই নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকি শিক্ষাসেবক হিসেবে। বর্তমানে আমরা যারা এখন বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছি, আগামী প্রজন্মের কাছে আমাদেরও সুকান্ত ভট্টাচার্যের সেই একই অঙ্গীকার। তাই আমাদের উচিত হবে সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করে অব্যাহতভাবে শিক্ষার বিনির্মাণের মাধ্যমে টেকসই রাষ্ট্র সংস্কারের এ অনন্য সুযোগের সদ্ব্যবহার করা। আর নানা অবক্ষয়ের পথ ধরে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক পরিমন্ডলে যেসব জঞ্জাল জন্মেছে সেগুলোকে একে একে পরিষ্কার করে আমরা আমাদের প্রাথমিক নৈতিক দায়টুকু অন্তত শেষ করি। সেই ক্ষেত্রে জীবনমুখী যুগোপযোগী শিক্ষাই হোক আমাদের প্রেরণা আর দিক-নির্দেশনার উৎস। তবেই না অনেক প্রাণ আর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই মুক্তি অর্থবহ হয়ে উঠবে।
সাদামাটা একটি প্রশ্ন- কেমন শিক্ষাব্যবস্থা চাই? এ প্রশ্নের কোন সহজ সরল জবাব না থাকলেও আমাদের এ বিশেষ পরিস্থিতিতে বিধ্বস্ত শিক্ষা ব্যবস্থার বিনির্মাণের জন্য কোন না কোন জায়গা থেকে আলোচনাটা শুরু করতে হবে। তাই বলছি, আমরা এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা চাই যে শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের জন্যে এমন শিক্ষার সুযোগ এনে দেবে যে শিক্ষা আমাদেরকে শানিত ও প্রাণিত করবে জাতি গঠনের মূলমন্ত্র ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যকে অনুশীলন করতে। একই সাথে যে শিক্ষা হবে আমাদের জন্য ‘বৈষম্যহীন’ ও ‘স্বৈরাচারমুক্ত’ রাষ্ট্র বিনির্মাণে একটি ভেদাভেদহীন সমাজ কাঠামো তৈরির মূল চালিকাশক্তি। তেমনি একটি শিক্ষাব্যবস্থা চাই যেখানে শিক্ষার বিষয়বস্তু শিক্ষার্থীর প্রয়োজন ও আগ্রহকে লালন করবে এবং সাথে সাথে সে অনুযায়ী ‘শিক্ষার ঢালী’ সাজাবে। যেখানে শিক্ষক হবেন শিক্ষার্থীর শিক্ষা লাভের অনুপ্রেরণা আর শিক্ষার্থীদের কল্যাণই হবে শিক্ষকের ধ্যান-জ্ঞান, চিন্তা-ভাবনা ও কর্মকা-ের কেন্দ্রবিন্দু। আর তেমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা বিনির্মাণে এই মুহূর্তে যা যা সংস্কার করা দরকার, তার সব কয়টাই করা এখন সময়ের দাবি। কিন্তু সবকিছু তো আর রাতারাতি করা সম্ভব না। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনের অগ্রাধিকার ও আয়োজনের সীমাবদ্ধতাকে বিচার করেই আমাদের এগোতে হবে। আর বিদ্যমান জঞ্জালগুলোকে সরিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতা উতরিয়ে আমাদের আস্তে আস্তে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে অগ্রসর হতে হবে আর অব্যাহত রাখতে হবে বিনির্মাণের সুযোগ ও চেষ্টা-প্রচেষ্টাকে।
কথায় বলে, ‘নানা মুনির নানা মত’। বহুধা বিভক্ত সমাজে যুক্তির চেয়ে আবেগ বেশি কাজ করে। যৌথ কাজ করার সমস্যাটা সেখানে প্রকট। আমাদের মনে রাখতে হবে, যে অসহিষ্ণুতা স্বৈরাচারের বৈশিষ্ট্য সেটা যেন আমাদের আচার আচরণে প্রতিফলিত না হয়। আমাদের মাঝে মত দ্বৈততা বা মত বিরোধ থাকতেই পারে। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরিতে বদ্ধপরিকর। আমরা চাইলে খুব সহজেই মুক্ত আলোচনায় মুক্ত মনের পরিচয় দিয়ে মুক্ত বুদ্ধির চর্চায় একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করত পারি। রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করার জন্যে প্রথমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। শিক্ষাক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করা গেলে কেবল তখনই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পরিবেশ তৈরিতে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। আশা করছি, সমাজের সবাই শ্রেণী, বর্ণ, গোত্র, দল বা মতের মানুষকে সম্মান দিয়েই গণতন্ত্রের প্রধান যে ভিত্তি পরমত সহিষ্ণুত, সেটাকে আমাদের কথাবার্তা ও আচরণে প্রতিফলিত করেই পারস্পরিক বোঝাপড়ায় চিন্তা-ভাবনার দূরত্ব কিংবা দৈন্যকে কমিয়ে আনার সদিচ্ছাকে অঙ্গীকার করেই শিক্ষা সংস্কার বা শিক্ষা ব্যবস্থার বিনির্মাণের এ আলোচনা অব্যাহত থাকবে।
আমার কাছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রথম ও প্রধান ব্যর্থতা হলো মানুষকে মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে শেখাতে না পারা। আমাদের মনে রাখতে হবে, একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রধান নিয়ামক হলো তার রাষ্ট্রীয় দর্শনের মূলমন্ত্র ‘মানবতাবোধ’। আর যে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা তার নাগরিকদের মাঝে সে বোধ জন্মাতে ব্যর্থ সে রাষ্ট্র কখনই কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে না, কিংবা রাষ্ট্রের মানবতাবাদী চরিত্রকে বেশি সময় ধরে রাখতে পারে না। তাই আমাদের রাষ্ট্রীয় দর্শনে মানবতাবোধকে ধারণ করে শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবন-চর্যায় প্রতিফলিত করে সেটাকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এখানে পুনরায় বলতে চাই যে, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও কাঠামো সংস্কারকে টেকসই করতে শিক্ষা ব্যবস্থার অব্যাহত বিনির্মাণ জরুরি।
অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার সেই বিষয়টা মাথায় রেখে দ্রুত একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা উচিত যাতে প্রতিফলিত হবে গণঅভ্যুত্থান উত্তর ছাত্র-জনতার আশা আকাক্সক্ষার। দীর্ঘ দিনের অন্যায়-অত্যাচার আর বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার অনবরত সংগ্রামের সংস্কৃতি বজায় রাখার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধকারী শিক্ষাই আমরা চাই। জাতির নতুন প্রজন্মের জন্য তেমন শিক্ষা দেয়ার দার্শনিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা থেকেই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা বিনির্মাণের সব আয়োজন হওয়া উচিত। আমরা আশা করব, অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার তেমন একটা শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের জন্য বিনির্মাণ করবে যেটা হবে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের জাতীয় ঐক্য, সংহতি ও সমৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি।
[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]