রিয়াজ মো. নোমান
বিজ্ঞানপ্রেমীদের মনে প্রায়শই একটা কৌতূহল বারবার ঊঁকি দেয়Ñ এই যে মানুষের এই বিবর্তন; চারপেয়ে পশু থেকে দুপেয়ে বিশ্বজয়ী প্রাণীÑ একটা সুদীর্ঘ প্রণালি, এই লম্বা পথ পাড়ি দিতে মানুষকে কতটুকু শ্রম দিতে হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে মানুষের সমসামীয়ক চৌকস বুদ্ধিমান প্রাণী এই পৃথিবীতে রাজত্ব করতে পারবে কি না? পারলেও সেটা কোন প্রাণী!
সে প্রশ্নের উত্তরে নিশ্চিত করে কিছু বলা না গেলেও মানুষের পর বুদ্ধিমত্তার পরিমাপ করতে গেলে সে তালিকায় গ্রেইট এপ বর্গের নাম প্রথমেই উঠে আসবে। শিম্পাঞ্জি, ওরাংওটাং, বানরÑ যাদের সঙ্গে আমাদের ডিএনএগত মিল অন্তত ৯৭ থেকে ৯৮ শতাংশ। আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী। মোটামুটি ৬০ লাখ বছর আগে আমরা তাদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে মানব প্রজাতির যাত্রা আরম্ভ করি, যেই যাত্রা আজ অবধি চলছেই।
আমরা যদি ছয় কোটি বছর আগের পৃথিবীর দিকে তাকাই তাহলে আমরা ডায়নাসোরের রাজত্ব দেখতে পাব। জলে ডোবা ডায়নোসর, আকাশে ওড়া ডায়নোসর, লম্বা গলার ডায়নোসর।
আবার আমরা যদি তিন লাখ বছর আগের পৃথিবীর দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব হোমো প্রজাতির রাজত্ব। যেখানে পৃথিবীজুড়ে মানুষের বিভিন্ন প্রজাতির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাম্রাজ্য। মানুষের এসব প্রজাতি হাজার হাজার লাখ লাখ বছর রাজত্ব করে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে।
অনুরূপ অদূর ভবিষ্যতে আমরা ঠিক কোন প্রাণীর রাজত্ব দেখতে পাব তা নিয়ে বিজ্ঞানমহলে চলে আসছে নানা জল্পনা-কল্পনা, নানা হিসাবনিকাশ।
এই তো কদিন আগে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে রাকুস নামের এক ওরাংওটাং ক্ষতস্থানে আকার কুনিং নামক এক ঔষধি গাছের পাতা লাগিয়ে নিজে নিজে সুস্থ হয়ে ওঠে। রাকুসের এই চিকিৎসাপদ্ধতি দেখে বিজ্ঞানীদের চোখ চড়ক গাছ কপালে।
ঘটনাটি মানুষের পূর্ব প্রজন্মের ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়, একটু একটু করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শেখা, একটু একটু করে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করতে শেখা, একটু একটু করে সাংকেতিক শব্দ থেকে ভাষার প্রয়োগ রপ্ত করা।
ভাষার প্রসঙ্গ আসায় একটি চমকপ্রদ তথ্য জানানো যাক, সাধারণত দলবদ্ধভাবে বসবাস করা প্রাণীরা নিজেদের নামকরণ করে থাকে তা মোটামুটি অনেকের জানা। অর্থাৎ দলবদ্ধ দলের প্রত্যেকের পৃথক নাম থাকে, সেই নামে তারা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ কিংবা কথোপকথন প্রক্রিয়া চালনা করে থাকে।
দলবদ্ধ উচ্চ বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন প্রাণীর তালিকায় এবার যুক্ত হয়েছে মারমোসেট বানরের নাম। সায়েন্স ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে জানা যায় এ তথ্য। জেরুজালেমের হিব্রু ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক মারমোসেট বানরের ওপর গবেষণা করে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
গবেষণায় দেখা যায়, বানরগুলো নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে এক ধরনের শব্দ ব্যবহার করে। একই ডাক যখন তাদের আবার শোনানো হয় তখন সেটা তারা চিনতে পারে এবং সাড়া দেয়। তবে সবচেয়ে বেশি সাড়া দেয় যখন তাদের নাম ধরে ডাকা হয়। শুধু যে নাম ধরে ডাকতে পারে তা-ই নয়, প্রতিটি পরিবারের সদস্যরা আলাদা আলাদা নাম ডাকতে একই ধরনের শব্দ ব্যবহার করে এবং পরিবার অনুযায়ী শব্দগুলো ভিন্ন ভিন্ন হয়। একেক অঞ্চলের একেক ভাষার মতো ভিন্ন।
জোড়ায় জোড়ায় তিনটি পরিবার থেকে আনা দশটি মারমোসেট বানরের গতিবিধি, কার্যকলাপ ও চালচিত্র বিশ্লেষণ করে জ্যেষ্ঠ গবেষক ডেভিড ওমর বলেন, ‘আমরা সামাজিক আচরণের ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। কারণ, আমরা মনে করি অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় মানুষ যে বিশেষ, সেটা বোঝাতে সামাজিক আচরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দ্রুত দৌড়াতে পারি না, উড়তে পারি না, সামাজিক হওয়া ছাড়া অন্য কিছুতে আমরা সেরা নই। একটি সমাজ হিসেবে আমাদের সব অর্জন আমাদের সামাজিক অর্জন।’
সামাজিকতার বিবর্তন বিশ্লেষণ কিংবা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে দেখা যায় আধুনিক মানুষের উত্তরসূরি প্রাইমেটরাই মানুষের খুব কাছাকাছি পর্যায়ে রয়েছে। যারা মানুষের মতো সমাজ গড়ে থাকতে পারে, মানুষের ভাষা বুঝতে পারে, মানুষের মতো করে ভাবতে পারে, প্রাচীন মানুষদের মতো নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ভাষার ব্যবহার করতে পারে। মানুষের সংস্পর্শে দ্রুত বিকশিত হওয়া প্রাণীদের মধ্যে এরা অন্যতম। এখন দেখার বিষয় প্রকৃতির নির্বাচনী খেলায় এরা কতদিন অবধি টিকে থাকে।
[লেখক : সংবাদকর্মী]
রিয়াজ মো. নোমান
বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
বিজ্ঞানপ্রেমীদের মনে প্রায়শই একটা কৌতূহল বারবার ঊঁকি দেয়Ñ এই যে মানুষের এই বিবর্তন; চারপেয়ে পশু থেকে দুপেয়ে বিশ্বজয়ী প্রাণীÑ একটা সুদীর্ঘ প্রণালি, এই লম্বা পথ পাড়ি দিতে মানুষকে কতটুকু শ্রম দিতে হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে মানুষের সমসামীয়ক চৌকস বুদ্ধিমান প্রাণী এই পৃথিবীতে রাজত্ব করতে পারবে কি না? পারলেও সেটা কোন প্রাণী!
সে প্রশ্নের উত্তরে নিশ্চিত করে কিছু বলা না গেলেও মানুষের পর বুদ্ধিমত্তার পরিমাপ করতে গেলে সে তালিকায় গ্রেইট এপ বর্গের নাম প্রথমেই উঠে আসবে। শিম্পাঞ্জি, ওরাংওটাং, বানরÑ যাদের সঙ্গে আমাদের ডিএনএগত মিল অন্তত ৯৭ থেকে ৯৮ শতাংশ। আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী। মোটামুটি ৬০ লাখ বছর আগে আমরা তাদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে মানব প্রজাতির যাত্রা আরম্ভ করি, যেই যাত্রা আজ অবধি চলছেই।
আমরা যদি ছয় কোটি বছর আগের পৃথিবীর দিকে তাকাই তাহলে আমরা ডায়নাসোরের রাজত্ব দেখতে পাব। জলে ডোবা ডায়নোসর, আকাশে ওড়া ডায়নোসর, লম্বা গলার ডায়নোসর।
আবার আমরা যদি তিন লাখ বছর আগের পৃথিবীর দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব হোমো প্রজাতির রাজত্ব। যেখানে পৃথিবীজুড়ে মানুষের বিভিন্ন প্রজাতির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাম্রাজ্য। মানুষের এসব প্রজাতি হাজার হাজার লাখ লাখ বছর রাজত্ব করে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে।
অনুরূপ অদূর ভবিষ্যতে আমরা ঠিক কোন প্রাণীর রাজত্ব দেখতে পাব তা নিয়ে বিজ্ঞানমহলে চলে আসছে নানা জল্পনা-কল্পনা, নানা হিসাবনিকাশ।
এই তো কদিন আগে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে রাকুস নামের এক ওরাংওটাং ক্ষতস্থানে আকার কুনিং নামক এক ঔষধি গাছের পাতা লাগিয়ে নিজে নিজে সুস্থ হয়ে ওঠে। রাকুসের এই চিকিৎসাপদ্ধতি দেখে বিজ্ঞানীদের চোখ চড়ক গাছ কপালে।
ঘটনাটি মানুষের পূর্ব প্রজন্মের ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়, একটু একটু করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শেখা, একটু একটু করে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করতে শেখা, একটু একটু করে সাংকেতিক শব্দ থেকে ভাষার প্রয়োগ রপ্ত করা।
ভাষার প্রসঙ্গ আসায় একটি চমকপ্রদ তথ্য জানানো যাক, সাধারণত দলবদ্ধভাবে বসবাস করা প্রাণীরা নিজেদের নামকরণ করে থাকে তা মোটামুটি অনেকের জানা। অর্থাৎ দলবদ্ধ দলের প্রত্যেকের পৃথক নাম থাকে, সেই নামে তারা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ কিংবা কথোপকথন প্রক্রিয়া চালনা করে থাকে।
দলবদ্ধ উচ্চ বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন প্রাণীর তালিকায় এবার যুক্ত হয়েছে মারমোসেট বানরের নাম। সায়েন্স ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে জানা যায় এ তথ্য। জেরুজালেমের হিব্রু ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক মারমোসেট বানরের ওপর গবেষণা করে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
গবেষণায় দেখা যায়, বানরগুলো নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে এক ধরনের শব্দ ব্যবহার করে। একই ডাক যখন তাদের আবার শোনানো হয় তখন সেটা তারা চিনতে পারে এবং সাড়া দেয়। তবে সবচেয়ে বেশি সাড়া দেয় যখন তাদের নাম ধরে ডাকা হয়। শুধু যে নাম ধরে ডাকতে পারে তা-ই নয়, প্রতিটি পরিবারের সদস্যরা আলাদা আলাদা নাম ডাকতে একই ধরনের শব্দ ব্যবহার করে এবং পরিবার অনুযায়ী শব্দগুলো ভিন্ন ভিন্ন হয়। একেক অঞ্চলের একেক ভাষার মতো ভিন্ন।
জোড়ায় জোড়ায় তিনটি পরিবার থেকে আনা দশটি মারমোসেট বানরের গতিবিধি, কার্যকলাপ ও চালচিত্র বিশ্লেষণ করে জ্যেষ্ঠ গবেষক ডেভিড ওমর বলেন, ‘আমরা সামাজিক আচরণের ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। কারণ, আমরা মনে করি অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় মানুষ যে বিশেষ, সেটা বোঝাতে সামাজিক আচরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দ্রুত দৌড়াতে পারি না, উড়তে পারি না, সামাজিক হওয়া ছাড়া অন্য কিছুতে আমরা সেরা নই। একটি সমাজ হিসেবে আমাদের সব অর্জন আমাদের সামাজিক অর্জন।’
সামাজিকতার বিবর্তন বিশ্লেষণ কিংবা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে দেখা যায় আধুনিক মানুষের উত্তরসূরি প্রাইমেটরাই মানুষের খুব কাছাকাছি পর্যায়ে রয়েছে। যারা মানুষের মতো সমাজ গড়ে থাকতে পারে, মানুষের ভাষা বুঝতে পারে, মানুষের মতো করে ভাবতে পারে, প্রাচীন মানুষদের মতো নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ভাষার ব্যবহার করতে পারে। মানুষের সংস্পর্শে দ্রুত বিকশিত হওয়া প্রাণীদের মধ্যে এরা অন্যতম। এখন দেখার বিষয় প্রকৃতির নির্বাচনী খেলায় এরা কতদিন অবধি টিকে থাকে।
[লেখক : সংবাদকর্মী]