alt

উপ-সম্পাদকীয়

মাদকের বিরুদ্ধে লড়তে হবে

অরূপরতন চৌধুরী

: শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

দেশের এই ক্রান্তিকালে অন্তর্বর্তী সরকারকে নিঃসন্দেহে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এই চ্যালঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো তরুণদের মাদকের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করা। দেশে বর্তমানে মাদকাসক্তদের পরিসংখ্যানের কোনো তথ্য না থাকলেও বেসরকারি তথ্যমতে, দেশে ১ কোটিরও বেশি মাদকাসক্ত রয়েছে এবং মাদকসেবীদের মধ্যে ৮০ শতাংশই যুবক। তাদের মধ্যে ৪৩ শতাংশ বেকার। ৬০ শতাংশ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। কিছুদিন আগেও যারা ফেনসিডিলে আসক্ত ছিলো তাদের অধিকাংশই এখন ইয়াবা আসক্ত। ইয়াবা আমাদের দেশের তরুণ- যুবসমাজকে গ্রাস করেছে।

প্রতিদিন যেমন ইয়াবা চোরাচালান ধরা হচ্ছে তেমনি, প্রতিদিন হাজার হাজার পিস ইয়াবা তরুণরা গ্রহণ করছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মাদকাসক্তদের ৩০ শতাংশই শুধু নেশার খরচ জোগান দিতে অপরাধ, অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। জরিপে যে তথ্যটি সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক ও ভয়ের কারণ তা হচ্ছে, দেশে মাদকাসক্তদের ৮০ শতাংশই কিশোর তরুণ ও যুবক বয়সী। আর এই আসক্তির ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে ছাত্র এবং শিক্ষিত বেকারদের মধ্যে। আমাদের দেশে মহিলাদের মধ্যেও মাদকাসক্তদের সংখ্যা বাড়ছে। এটা উদ্বেগের কারণ! নারী আসক্তদের ৯০ ভাগের বয়স ১৫-৩৫ বছরের মধ্যে। বাদ বাকি ৩৫-৪৫ বছরের মধ্যে।

মাদক সম্পর্কিত চাঞ্চল্যকর একটি নতুন তথ্য উদঘাটিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মাদক ব্যবসার কারণে বাংলাদেশে বছরে পাচার হয় প্রায় ৫ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। আঙ্কটাড (ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) তাদের ওয়েবসাইটে অবৈধ অর্থপ্রবাহ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করেছে।

জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাড পাচার করা টাকার হিসাব অনুমানভিত্তিক হিসেবে তুলে ধরেছে। এতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৯টি দেশের মাদকসংশ্লিষ্ট অবৈধ অর্থপ্রবাহের হিসাব তুলে ধরা হয়েছে। তথ্য বিবরণীতে আরও বলা হয়েছে, মাদকসংশ্লিষ্ট অর্থ পাচারের দিক থেকে বিশে^ বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। আর এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে। অবৈধ অর্থপ্রবাহ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- মাদক ব্যবসার কারণে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর পাচার হয় ৪৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ৫ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। অন্য দেশগুলো হলো আফগানিস্থান, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, মালদ্বীপ, মেক্সিকো, মিয়ানমার, নেপাল ও পেরু।

বাংলাদেশে মাদক উৎপাদন হয় না, সবই বাইরে থেকে আসে। সুতরাং, মাদক আনতে ব্যয় করা অর্থও পুরোটাই দেশের বাইরে চলে যায়। যে কোন সামাজিক সমস্যায় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব আছে। এখন তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের যুগ। এই সময়ে শিশু-কিশোরার অনলাইনে অনেক কিছু দেখে, যার ভেতর নেতিবাচকতা বেশি এবং তারা সহজেই সংগঠিত হয়। শহরগুলোতে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ নাই, সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। শরীরচর্চা, খেলাধুলার সাথে সংস্কৃতিচর্চা থাকলে কিশোর-তরুণরা অপরাধ ও মাদক থেকে দূরে থাকে। আমাদের সেই ব্যবস্থা নেয়াটা জরুরি। শিক্ষা ব্যবস্থায় এ ধরনের বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন। পথশিশু ও অভিভাবকহীনদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় এনে সুশিক্ষিত করতে প্রয়োজনী পদক্ষেপ নিলে সুফল মিলবে। কারণ, ভালো নাগরিক হতে তাদের শিক্ষা ও ভালো পরিবেশ দরকার। এক্ষেত্রে শিক্ষা, যুব ও ক্রীড়া এবং সংস্কৃতি বিষয়ক, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নিতে পারে।

সময়ের সাথে সাথে মানুষের ভাবনা পাল্টে গেছে। দেশে তামাক উন্নয়ন বোর্ড থেকে ‘জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল’ এবং ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর’ গঠন হয়েছে। কিন্তু ধূমপান, মাদকের বিস্তার ও সহজলভ্যতা দূর করা যাচ্ছে না।

নতুন সমাজ গঠনে মাদকের আগ্রাসন অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধে, দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও তরুণদের সঠিকভাবে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে ধূমপান, মাদকাসক্তি একটি বিরাট অন্তরায়। সুতরাং রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে নতুনভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার, ধূমপানসহ ক্ষতিকর নেশা প্রতিরোধে বিশেষ নজর দিতে হবে। এ ধরনের দ্রব্যের অবৈধ পাচার ও সহজলভ্যতা কমাতে হবে এবং মাদকাসক্তদের উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময় করে সমাজে পুনর্বহাল করতে হবে। কারণ গবেষণায় প্রমাণিত যে, অন্যান্য রোগের মতোই মাদকাসক্তি একটি রোগ। এই রোগকে বলা হয় ‘ক্রনিক রিল্যাপ্সিং ব্রেন ডিজিজ।’ সঠিক নিয়মে এবং একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে অ্যাভিডেন্স বেজড ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে এই রোগের চিকিৎসা সম্ভব এবং চিকিৎসা পরবর্তী নিয়মিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সুস্থ থাকা সম্ভব। কিন্তু আমাদের সমাজের বৈষম্যমূলক আচরণের জন্য এই সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীরাও চিকিৎসা সম্পর্কে সচেতনতায় সঠিকভাবে কাজ করতে পারেন না।

গবেষণায় দেখা গেছে, মাদকাসক্তদের মধ্যে শতকরা ৯৮ ভাগই ধূমপায়ী এবং তাদের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ বিভিন্ন অপরাধ ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত। যারা মাদকদ্রব্য সেবন করে তারা প্রথমে ধূমপানে অভ্যস্ত হয়, তারপর মাদকদ্রব্য সেবন শুরু করে থাকে। পরবর্তীকালে তারা গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল, সিসা, হেরোইন, কোকেনসহ বিভিন্ন মরণ নেশায় আসক্ত হয়। বর্তমানে কিশোর-তরুণরা বন্ধুদের প্ররোচনায় ধূমপান শুরু করে এবং ক্রমান্বয়ে এর একটি বিরাট অংশ মাদক সেবন ও বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়ায়। বৈশি^কভাবেও বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত যে, তরুণ বয়সেই বেশিরভাগ তরুণ ছেলে-মেয়ে কৌতূহলবশত বা পারিপাশির্^ক প্ররোচনায় ভয়াবহ মাদক ও ধূমপানের নেশায় জড়িয়ে পড়ে। হয়তো বা তার উপলক্ষ্য থাকে কোন একটি বিশেষ দিন বা বিশেষ অনুষ্ঠান।

আগামীর বাংলাদেশ এগিয়ে নিতে যোগ্য নেতৃত্বের শঙ্কা যেন না থাকে, সেই দিকটাতে আশু সুনজর দেয়া অপরিহার্য। এজন্য শিশু-কিশোরদের মেধা ও সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক মনন বিকাশে পরিবার, সমাজ সরকারি সবাই পদক্ষেপের সাথে আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। নতুবা এর পরিণাম থেকে আমরা কেউ মুক্ত থাকতে পারবো না। তাই কিশোর-তরুণ প্রজন্মের সর্বোচ্চ সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করে তামাক ও মাদকের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একসাথে কাজ করতে হবে।

মাদক এমনই ক্ষতিকর একটি নেশা, যেটা বারবার নিতে ইচ্ছে করে। কৌতূহলবশত কিংবা প্ররোচনায় যে তরুণটি মাদকের জালে জড়িয়ে পড়ছে তাদের ফেরানো কঠিন। এমনিতেই তামাক ও মাদকের আগ্রাসনে তরুণরা বিপথগামী হয়ে পড়ছে। উপরন্তু নাটক, সিনেমাতেও তরুণদের আইডল ও জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা নায়ক, নায়িকাদের দ্বারা ধূমপানে, মাদকে উৎসাহিত করে এমন দৃশ্য অহরহ প্রচার করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সিগারেট কোম্পানিগুলোর বিভ্রান্তিকর প্রচারণায় তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেটের ব্যবহার বাড়ছে। যে হারে ছড়িয়ে পড়ছে সেটা রীতিমতো উদ্বেগজনক! সুতরাং, বসে থাকার সময় নেই। তরুণদের রক্ষায় কাজ করতে হবে।

বর্তমানে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিসাধন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তেমনি মাদকদ্রব্যের অবৈধ পাচার রোধেও সজাগ হওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীতে এখনো নানাবিধ সংকট রয়েছে। আন্দোলনের সময় মাদকবিরোধী আন্দোলনে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে যৌথ বাহিনীর মাদক বিরোধী অভিযান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ধূমপান ও তামাকজাতদ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের দিকেও সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দপ্তর, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি বিশেষের সক্রিয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি আমাদের কিছু বিষয়ে করণীয় হলোÑ কেউ আসক্ত হলে গোপন না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া; মাদকাসক্তকে ঘৃণা না করে ভালোবাসা দেয়া; কেউ আসক্ত হলে স্বজন, বন্ধু, ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করা; আসক্তির লক্ষণ দেখা দিলেই নিরাময় কেন্দ্রে যোগাযোগ করা এবং আসক্তকে ভালোবেসে তাকে দীর্ঘদিন চিকিৎসা দেয়া প্রয়োজন।

এখানে পরিবারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনতিবিলম্বে তামাক, মাদক নির্মূলে সর্বাত্মক প্রয়াস নেয়া হবেÑ এটাই আজকের দিনের প্রত্যাশা।

[লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস)]

অতীত থেকে মুক্তি এবং ইতিবাচক জীবনযাপন

মুক্তি সংগ্রামে তিনটি ধারা

বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকা কেন পিছিয়ে

শুধু নিচেই নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর

উপেক্ষিত আটকে পড়া পাকিস্তানিরা

রম্যগদ্য : সিন্দাবাদের বুড়ো ও আমরা

নেই কেনো সেই পাখি

বায়ুদূষণ থেকে মুক্তি কোন পথে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : রাষ্ট্র সংস্কারের দুর্গম পথ

পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র

বিজয়ের প্রেরণা

মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার পুনর্বীক্ষণ

সিদরাত জেবিনের মৃত্যু অথবা প্রশ্নহীন বায়ুদূষণ

বিজয়ের গৌরব ও সম্ভাবনাময় তরুণ সমাজ

ছবি

মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের অবদান

ছবি

বিজয় সংগ্রামের সূচনার সন্ধানে

মানসম্মত কনটেন্ট ও টিআরপির দ্বৈরথ

জিকা ভাইরাস রোধে প্রয়োজন সচেতনতা

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবার গুরুত্ব

ঢাকার বাতাস বিষাক্ত কেন

চরের কৃষি ও কৃষকের জীবন

নিম্ন আয়ের মানুষ ভালো নাই

সবার আগে নিজেকে পরিবর্তন করা দরকার

পুলিশ কবে পুলিশ হবে

জীবন ফিরে আসুক বাংলার নদীগুলোতে

কান্দন সরেন হত্যা ও ভূমি বিরোধ কি এড়ানো যেত না

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র: রাষ্ট্র বিনির্মাণে সমস্যা কোথায়?

মানবাধিকার দিবস : মানুষের অধিকার নিয়ে কেন এত কথা?

আমলাতান্ত্রিক স্বচ্ছতা : সংস্কারের পথে নাকি পুনরাবৃত্তি?

খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কিছু কথা

ছবি

বেগম রোকেয়া : নারী জাগরণের অগ্রদূত

দুর্নীতির সর্বগ্রাসী বিস্তার বন্ধ করতে হবে

মা তোর বদনখানি মলিন হলে

ব্যবসায়ী নেতৃত্বশূন্য ই-ক্যাব

মূল্যস্ফীতির হিসাব নির্ণয়ে নতুন পদ্ধতির প্রাসঙ্গিকতা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

মাদকের বিরুদ্ধে লড়তে হবে

অরূপরতন চৌধুরী

শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

দেশের এই ক্রান্তিকালে অন্তর্বর্তী সরকারকে নিঃসন্দেহে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এই চ্যালঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো তরুণদের মাদকের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করা। দেশে বর্তমানে মাদকাসক্তদের পরিসংখ্যানের কোনো তথ্য না থাকলেও বেসরকারি তথ্যমতে, দেশে ১ কোটিরও বেশি মাদকাসক্ত রয়েছে এবং মাদকসেবীদের মধ্যে ৮০ শতাংশই যুবক। তাদের মধ্যে ৪৩ শতাংশ বেকার। ৬০ শতাংশ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। কিছুদিন আগেও যারা ফেনসিডিলে আসক্ত ছিলো তাদের অধিকাংশই এখন ইয়াবা আসক্ত। ইয়াবা আমাদের দেশের তরুণ- যুবসমাজকে গ্রাস করেছে।

প্রতিদিন যেমন ইয়াবা চোরাচালান ধরা হচ্ছে তেমনি, প্রতিদিন হাজার হাজার পিস ইয়াবা তরুণরা গ্রহণ করছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মাদকাসক্তদের ৩০ শতাংশই শুধু নেশার খরচ জোগান দিতে অপরাধ, অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। জরিপে যে তথ্যটি সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক ও ভয়ের কারণ তা হচ্ছে, দেশে মাদকাসক্তদের ৮০ শতাংশই কিশোর তরুণ ও যুবক বয়সী। আর এই আসক্তির ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে ছাত্র এবং শিক্ষিত বেকারদের মধ্যে। আমাদের দেশে মহিলাদের মধ্যেও মাদকাসক্তদের সংখ্যা বাড়ছে। এটা উদ্বেগের কারণ! নারী আসক্তদের ৯০ ভাগের বয়স ১৫-৩৫ বছরের মধ্যে। বাদ বাকি ৩৫-৪৫ বছরের মধ্যে।

মাদক সম্পর্কিত চাঞ্চল্যকর একটি নতুন তথ্য উদঘাটিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মাদক ব্যবসার কারণে বাংলাদেশে বছরে পাচার হয় প্রায় ৫ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। আঙ্কটাড (ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) তাদের ওয়েবসাইটে অবৈধ অর্থপ্রবাহ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করেছে।

জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাড পাচার করা টাকার হিসাব অনুমানভিত্তিক হিসেবে তুলে ধরেছে। এতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৯টি দেশের মাদকসংশ্লিষ্ট অবৈধ অর্থপ্রবাহের হিসাব তুলে ধরা হয়েছে। তথ্য বিবরণীতে আরও বলা হয়েছে, মাদকসংশ্লিষ্ট অর্থ পাচারের দিক থেকে বিশে^ বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। আর এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে। অবৈধ অর্থপ্রবাহ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- মাদক ব্যবসার কারণে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর পাচার হয় ৪৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ৫ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। অন্য দেশগুলো হলো আফগানিস্থান, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, মালদ্বীপ, মেক্সিকো, মিয়ানমার, নেপাল ও পেরু।

বাংলাদেশে মাদক উৎপাদন হয় না, সবই বাইরে থেকে আসে। সুতরাং, মাদক আনতে ব্যয় করা অর্থও পুরোটাই দেশের বাইরে চলে যায়। যে কোন সামাজিক সমস্যায় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব আছে। এখন তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের যুগ। এই সময়ে শিশু-কিশোরার অনলাইনে অনেক কিছু দেখে, যার ভেতর নেতিবাচকতা বেশি এবং তারা সহজেই সংগঠিত হয়। শহরগুলোতে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ নাই, সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। শরীরচর্চা, খেলাধুলার সাথে সংস্কৃতিচর্চা থাকলে কিশোর-তরুণরা অপরাধ ও মাদক থেকে দূরে থাকে। আমাদের সেই ব্যবস্থা নেয়াটা জরুরি। শিক্ষা ব্যবস্থায় এ ধরনের বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন। পথশিশু ও অভিভাবকহীনদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় এনে সুশিক্ষিত করতে প্রয়োজনী পদক্ষেপ নিলে সুফল মিলবে। কারণ, ভালো নাগরিক হতে তাদের শিক্ষা ও ভালো পরিবেশ দরকার। এক্ষেত্রে শিক্ষা, যুব ও ক্রীড়া এবং সংস্কৃতি বিষয়ক, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নিতে পারে।

সময়ের সাথে সাথে মানুষের ভাবনা পাল্টে গেছে। দেশে তামাক উন্নয়ন বোর্ড থেকে ‘জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল’ এবং ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর’ গঠন হয়েছে। কিন্তু ধূমপান, মাদকের বিস্তার ও সহজলভ্যতা দূর করা যাচ্ছে না।

নতুন সমাজ গঠনে মাদকের আগ্রাসন অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধে, দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও তরুণদের সঠিকভাবে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে ধূমপান, মাদকাসক্তি একটি বিরাট অন্তরায়। সুতরাং রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে নতুনভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার, ধূমপানসহ ক্ষতিকর নেশা প্রতিরোধে বিশেষ নজর দিতে হবে। এ ধরনের দ্রব্যের অবৈধ পাচার ও সহজলভ্যতা কমাতে হবে এবং মাদকাসক্তদের উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময় করে সমাজে পুনর্বহাল করতে হবে। কারণ গবেষণায় প্রমাণিত যে, অন্যান্য রোগের মতোই মাদকাসক্তি একটি রোগ। এই রোগকে বলা হয় ‘ক্রনিক রিল্যাপ্সিং ব্রেন ডিজিজ।’ সঠিক নিয়মে এবং একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে অ্যাভিডেন্স বেজড ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে এই রোগের চিকিৎসা সম্ভব এবং চিকিৎসা পরবর্তী নিয়মিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সুস্থ থাকা সম্ভব। কিন্তু আমাদের সমাজের বৈষম্যমূলক আচরণের জন্য এই সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীরাও চিকিৎসা সম্পর্কে সচেতনতায় সঠিকভাবে কাজ করতে পারেন না।

গবেষণায় দেখা গেছে, মাদকাসক্তদের মধ্যে শতকরা ৯৮ ভাগই ধূমপায়ী এবং তাদের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ বিভিন্ন অপরাধ ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত। যারা মাদকদ্রব্য সেবন করে তারা প্রথমে ধূমপানে অভ্যস্ত হয়, তারপর মাদকদ্রব্য সেবন শুরু করে থাকে। পরবর্তীকালে তারা গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল, সিসা, হেরোইন, কোকেনসহ বিভিন্ন মরণ নেশায় আসক্ত হয়। বর্তমানে কিশোর-তরুণরা বন্ধুদের প্ররোচনায় ধূমপান শুরু করে এবং ক্রমান্বয়ে এর একটি বিরাট অংশ মাদক সেবন ও বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়ায়। বৈশি^কভাবেও বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত যে, তরুণ বয়সেই বেশিরভাগ তরুণ ছেলে-মেয়ে কৌতূহলবশত বা পারিপাশির্^ক প্ররোচনায় ভয়াবহ মাদক ও ধূমপানের নেশায় জড়িয়ে পড়ে। হয়তো বা তার উপলক্ষ্য থাকে কোন একটি বিশেষ দিন বা বিশেষ অনুষ্ঠান।

আগামীর বাংলাদেশ এগিয়ে নিতে যোগ্য নেতৃত্বের শঙ্কা যেন না থাকে, সেই দিকটাতে আশু সুনজর দেয়া অপরিহার্য। এজন্য শিশু-কিশোরদের মেধা ও সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক মনন বিকাশে পরিবার, সমাজ সরকারি সবাই পদক্ষেপের সাথে আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। নতুবা এর পরিণাম থেকে আমরা কেউ মুক্ত থাকতে পারবো না। তাই কিশোর-তরুণ প্রজন্মের সর্বোচ্চ সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করে তামাক ও মাদকের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একসাথে কাজ করতে হবে।

মাদক এমনই ক্ষতিকর একটি নেশা, যেটা বারবার নিতে ইচ্ছে করে। কৌতূহলবশত কিংবা প্ররোচনায় যে তরুণটি মাদকের জালে জড়িয়ে পড়ছে তাদের ফেরানো কঠিন। এমনিতেই তামাক ও মাদকের আগ্রাসনে তরুণরা বিপথগামী হয়ে পড়ছে। উপরন্তু নাটক, সিনেমাতেও তরুণদের আইডল ও জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা নায়ক, নায়িকাদের দ্বারা ধূমপানে, মাদকে উৎসাহিত করে এমন দৃশ্য অহরহ প্রচার করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সিগারেট কোম্পানিগুলোর বিভ্রান্তিকর প্রচারণায় তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেটের ব্যবহার বাড়ছে। যে হারে ছড়িয়ে পড়ছে সেটা রীতিমতো উদ্বেগজনক! সুতরাং, বসে থাকার সময় নেই। তরুণদের রক্ষায় কাজ করতে হবে।

বর্তমানে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিসাধন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তেমনি মাদকদ্রব্যের অবৈধ পাচার রোধেও সজাগ হওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীতে এখনো নানাবিধ সংকট রয়েছে। আন্দোলনের সময় মাদকবিরোধী আন্দোলনে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে যৌথ বাহিনীর মাদক বিরোধী অভিযান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ধূমপান ও তামাকজাতদ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের দিকেও সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দপ্তর, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি বিশেষের সক্রিয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি আমাদের কিছু বিষয়ে করণীয় হলোÑ কেউ আসক্ত হলে গোপন না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া; মাদকাসক্তকে ঘৃণা না করে ভালোবাসা দেয়া; কেউ আসক্ত হলে স্বজন, বন্ধু, ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করা; আসক্তির লক্ষণ দেখা দিলেই নিরাময় কেন্দ্রে যোগাযোগ করা এবং আসক্তকে ভালোবেসে তাকে দীর্ঘদিন চিকিৎসা দেয়া প্রয়োজন।

এখানে পরিবারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনতিবিলম্বে তামাক, মাদক নির্মূলে সর্বাত্মক প্রয়াস নেয়া হবেÑ এটাই আজকের দিনের প্রত্যাশা।

[লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস)]

back to top