রেজাউল করিম খোকন
দেশ এখন কোন পথে এগোচ্ছে? আজকাল অনেকেই প্রশ্ন করেন। এই সরকার সফল হলে দেশের মানুষের জন্য ভালো হবে। আর যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে দেশের মানুষকে ভুগতে হবে। তাই সরকারকে সফল করার জন্য সবার সহযোগিতা করা উচিত।
বাজারে এখনও চালের দাম বাড়তির দিকে। চালের পাশাপাশি বেড়েছে ব্রয়লার মুরগি ও ফার্মের ডিমের দামও। কিছুটা স্বস্তি আছে সবজির বাজারে। বন্যার ধকল কেটে যাওয়ার পর সবজির দাম কমতে শুরু করেছে। চালের দাম বাড়লে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েন গরিব ও নিম্নআয়ের মানুষ। গ্রামাঞ্চলে এই শ্রেণির মানুষের আয়ের সিংহভাগই ব্যয় হয় চাল কিনতে। চালের দাম কমলে যেমন তারা কিছুটা স্বস্তি পান, দাম বাড়লে অস্বস্তিতে পড়তে হয়। চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সরকারকে বাড়তি কিছু পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন ছিল। দায়িত্ব নেয়া অন্তর্র্বতী সরকার সেই পদক্ষেপ কতটা নিয়েছে, সেই প্রশ্ন উঠবেই।
দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রথম যে পদক্ষেপটি নিতে হয়- সেটি হলো চাহিদা অনুযায়ী বাজারে পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত বিকল্প ব্যবস্থায় সীমিত আয়ের মানুষের কাছে অপেক্ষাকৃত কম দামে নিত্যপণ্য সরবরাহ করা। প্রতিবেশী ভারতসহ অনেক দেশেই রেশনিং ব্যবস্থা আছে, যেখানে সরকার বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে পণ্য বিক্রি করে থাকে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চালসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে বাজার সিন্ডিকেটের দোহাই দেয়া হতো। ক্ষমতার পালাবদলের পর অনেক কিছু বদল হলেও বাজার সিন্ডিকেটের প্রভাব এতটুকু কমেছে, এর প্রমাণ নেই। পরিবহনে চাঁদাবাজিও কমেনি, যদিও চাঁদাবাজদের চেহারা বদল হয়েছে।
অন্তর্র্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার পর বড় বড় সংস্কারের আওয়াজ উঠেছে। এসব সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা কেউ অস্বীকার করছে না। কিন্তু নিত্যপণ্যের দাম সীমিত আয়ের মানুষের নাগালে না রাখতে পারলে কোনো সংস্কারই কাজে আসবে বলে মনে হয় না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বাজার নিয়ন্ত্রণে চোখে পড়ার মতো কোনো পদক্ষেপ সরকার নেয়নি। বাজার ব্যবস্থাপনা চলছে আগের মতোই। কয়েক মাসের মধ্যে নিত্যপণ্যের দাম কমে আসবে। কিন্তু গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষের পক্ষে সেই কয়েক মাস অপেক্ষা করা সম্ভব কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। চাল, ডাল, আটা ও ভোজ্যতেলের মতো নিত্যপণ্যগুলো যাতে তারা সাশ্রয়ী দামে কিনতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। জ্বালানির দাম কিছুটা কমায় কৃষি ও শিল্পপণ্যের উৎপাদন ব্যয় ও পরিবহন খরচ কমবে আশা করা যায়। বিচ্ছিন্ন ও লোকদেখানো কর্মসূচি নয়, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে নিতে হবে কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন উপসর্গ দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ দাবি আদায় করতে সড়ক অবরোধ ও সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি নিয়েছেন। সরকার সচিবালয়কে কেন্দ্র করে সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে, কিন্তু বিভিন্ন দাবিতে সড়ক অবরোধ চলছেই। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর প্রত্যাশী তরুণেরা সড়ক অবরোধ করে রেখেছিলেন। এই অবরোধের কারণে পুরো ঢাকা শহরে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এরপর সড়ক অবরোধ করেন ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। এতে পুরো শহরই হয়ে পড়ে স্থবির। আন্দোলন তথা অবরোধের কারণে কোনো সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকলে সারা শহরের জনজীবন অসহনীয় হয়ে পড়ে। দাবি আদায়ে সড়ক অবরোধের মতো কর্মসূচি থেকে সরে না এলে জনদুর্ভোগ বাড়তেই থাকবে। জনগোষ্ঠী ও পেশাজীবীদের ন্যায়সংগত যেকোনো দাবি নিয়ে সড়ক অবরোধের চেয়ে উচিত যৌক্তিক পথ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তা তুলে ধরা।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হত্যাকা-সহ অন্যান্য অপরাধ ঘিরে যেসব মামলা হচ্ছে, তার বেশির ভাগই সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণহীন বলে অভিযোগ উঠেছে। হত্যা কিংবা অন্য কোনো ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে ন্যূনতম নিয়মনীতি অনুসরণ করা হয়নি। এসব ঢালাও মামলা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে উদ্বেগ ও সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সদর দপ্তর নির্দেশনা দিয়েছে তদন্তে কোনো আসামির সম্পৃক্ততা পাওয়া না গেলে মামলা থেকে তার নাম প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে সঠিক তথ্যপ্রমাণ ছাড়া এসব মামলায় কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করা যাবে না বলেও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যাচাই-বাছাই না করে মিথ্যা বা ভুয়া মামলা দিয়ে নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি না করার অনুরোধ এসেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকেও। জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে বিগত সরকার যে চরম নিষ্ঠুরতার আশ্রয় নিয়েছিল, তার বিচার অবশ্যই হতে হবে। কিন্তু বিচারের নামে নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি করার অধিকার কারও নেই। ঢালাও মামলায় জড়ানোটা আওয়ামী লীগ আমলের গায়েবি মামলার সঙ্গেও তুলনা করা যায়। পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনার পর আমাদের প্রত্যাশা, ঢালাও মামলায় আর কাউকে অযথা আসামি করা হবে না। আমরা চাই হত্যা, দুর্নীতিসহ সব অপরাধের বিচার হোক। কিন্তু অপরাধীকে শনাক্ত না করে এ রকম গয়রহ মামলা করলে যেমন নিরপরাধ মানুষ হয়রানির শিকার হবেন, তেমনি ন্যায়বিচারের পথও রুদ্ধ হবে।
শিল্পাঞ্চলে সাম্প্রতিক শ্রমিক অসন্তোষে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা ও অশান্তি যেন কাটছেই না। শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে আশুলিয়া, সাভার ও গাজীপুরের অনেক শিল্পকারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়েছে। বিভিন্ন কারখানার সামনে সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন করেও পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাচ্ছে না। হাজিরা বোনাস বৃদ্ধি, শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ, টিফিন বিল বৃদ্ধি, বেতনসহ সমানুপাতিক হারে পুরুষ শ্রমিক নিয়োগসহ বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ করছেন শ্রমিকেরা। পোশাক খাতে অস্থিরতার পেছনে কয়েকটি কারণ উঠে এসেছে। আওয়ামী লীগ সরকার ও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কারখানামালিকদের অনেকে সরকার পতনের পর গা-ঢাকা দিয়েছেন, কেউ কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের কারখানাগুলোর শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকে তৈরি হয়েছে অস্থিরতা। অস্থিরতার পেছনে রয়েছে ঝুট ব্যবসা শ্রমিক বিরোধ। আগে সেই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এখন সেই ব্যবসা দখল নিতে চায় তাদের বিরোধীপক্ষ। কেউ কেউ মনে করছেন, তৃতীয় কোনো পক্ষ শ্রমিক অস্থিরতায় ইন্ধন দিচ্ছে। একেক কারখানার শ্রমিকেরা একেক ধরনের দাবি-দাওয়ার কথা জানাচ্ছেন। অনেক দাবি মালিকেরা মেনেও নিয়েছেন। এরপরও বিক্ষোভ থামছে না। ব্যবসায়ীরা শিল্পাঞ্চলে ভাঙচুর ও লুট বন্ধে ব্যবস্থা নিতে ও ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্ধসঢ়;বান জানিয়েছেন।
সরকারের নীতি-নির্ধারকদের বুঝতে হবে, শুধু প্রতিশ্রুতি দিয়ে শ্রমিক অসন্তোষ নিরসন করা যাবে না। তাদের ন্যূনতম ন্যায্য মজুরির পাশাপাশি সুন্দর ও নিরাপদ কর্মপরিবেশও নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয় পক্ষের কোনো ইন্ধন থাকলে তা অনুসন্ধান করে দেখা হোক। তৈরি পোশাকশিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি। এর ওপর লাখো শ্রমিকের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে কোনো অসন্তোষ দেখা দিলে প্রতিযোগী রপ্তানিকারক দেশগুলো এর সুযোগ নেবে। ইতোমধ্যে কেউ কেউ সেই চেষ্টা চালাচ্ছে বলে জানা গেছে। আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করে রাষ্ট্র সংস্কার সম্ভব নয়, এরই মধ্যে তাদের মদদে সর্বত্র বিশৃঙ্খলা শুরু হয়েছে।
অতএব সরকারকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে দ্রুত শিল্পাঞ্চলে শান্তি ও নিরাপদ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। শ্রমিকদেরও বুঝতে হবে, কারখানা বন্ধ বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে নিজেদেরও ক্ষতি হবে। আন্দোলন হতে হবে নিয়মতান্ত্রিক ও অহিংস। কাউকে আইন হাতে তুলে নিতে দেয়া যাবে না। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে গিয়ে মূল জীবিকাই বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে সেটা ঠিক হবে না। মালিক-শ্রমিক উভয় পক্ষের সঙ্গে আলাপ করে এসব সমস্যার সমাধান অবশ্যই বের করতে হবে। আমরা আশা করব, অবিলম্বে শিল্পাঞ্চলে শান্তি ফিরে আসবে এবং উৎপাদন ব্যাহত হয়- এমন কোনো কাজ কোনো পক্ষই করবে না।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]
রেজাউল করিম খোকন
শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪
দেশ এখন কোন পথে এগোচ্ছে? আজকাল অনেকেই প্রশ্ন করেন। এই সরকার সফল হলে দেশের মানুষের জন্য ভালো হবে। আর যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে দেশের মানুষকে ভুগতে হবে। তাই সরকারকে সফল করার জন্য সবার সহযোগিতা করা উচিত।
বাজারে এখনও চালের দাম বাড়তির দিকে। চালের পাশাপাশি বেড়েছে ব্রয়লার মুরগি ও ফার্মের ডিমের দামও। কিছুটা স্বস্তি আছে সবজির বাজারে। বন্যার ধকল কেটে যাওয়ার পর সবজির দাম কমতে শুরু করেছে। চালের দাম বাড়লে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েন গরিব ও নিম্নআয়ের মানুষ। গ্রামাঞ্চলে এই শ্রেণির মানুষের আয়ের সিংহভাগই ব্যয় হয় চাল কিনতে। চালের দাম কমলে যেমন তারা কিছুটা স্বস্তি পান, দাম বাড়লে অস্বস্তিতে পড়তে হয়। চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সরকারকে বাড়তি কিছু পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন ছিল। দায়িত্ব নেয়া অন্তর্র্বতী সরকার সেই পদক্ষেপ কতটা নিয়েছে, সেই প্রশ্ন উঠবেই।
দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রথম যে পদক্ষেপটি নিতে হয়- সেটি হলো চাহিদা অনুযায়ী বাজারে পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত বিকল্প ব্যবস্থায় সীমিত আয়ের মানুষের কাছে অপেক্ষাকৃত কম দামে নিত্যপণ্য সরবরাহ করা। প্রতিবেশী ভারতসহ অনেক দেশেই রেশনিং ব্যবস্থা আছে, যেখানে সরকার বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে পণ্য বিক্রি করে থাকে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চালসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে বাজার সিন্ডিকেটের দোহাই দেয়া হতো। ক্ষমতার পালাবদলের পর অনেক কিছু বদল হলেও বাজার সিন্ডিকেটের প্রভাব এতটুকু কমেছে, এর প্রমাণ নেই। পরিবহনে চাঁদাবাজিও কমেনি, যদিও চাঁদাবাজদের চেহারা বদল হয়েছে।
অন্তর্র্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার পর বড় বড় সংস্কারের আওয়াজ উঠেছে। এসব সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা কেউ অস্বীকার করছে না। কিন্তু নিত্যপণ্যের দাম সীমিত আয়ের মানুষের নাগালে না রাখতে পারলে কোনো সংস্কারই কাজে আসবে বলে মনে হয় না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বাজার নিয়ন্ত্রণে চোখে পড়ার মতো কোনো পদক্ষেপ সরকার নেয়নি। বাজার ব্যবস্থাপনা চলছে আগের মতোই। কয়েক মাসের মধ্যে নিত্যপণ্যের দাম কমে আসবে। কিন্তু গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষের পক্ষে সেই কয়েক মাস অপেক্ষা করা সম্ভব কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। চাল, ডাল, আটা ও ভোজ্যতেলের মতো নিত্যপণ্যগুলো যাতে তারা সাশ্রয়ী দামে কিনতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। জ্বালানির দাম কিছুটা কমায় কৃষি ও শিল্পপণ্যের উৎপাদন ব্যয় ও পরিবহন খরচ কমবে আশা করা যায়। বিচ্ছিন্ন ও লোকদেখানো কর্মসূচি নয়, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে নিতে হবে কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন উপসর্গ দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ দাবি আদায় করতে সড়ক অবরোধ ও সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি নিয়েছেন। সরকার সচিবালয়কে কেন্দ্র করে সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে, কিন্তু বিভিন্ন দাবিতে সড়ক অবরোধ চলছেই। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর প্রত্যাশী তরুণেরা সড়ক অবরোধ করে রেখেছিলেন। এই অবরোধের কারণে পুরো ঢাকা শহরে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এরপর সড়ক অবরোধ করেন ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। এতে পুরো শহরই হয়ে পড়ে স্থবির। আন্দোলন তথা অবরোধের কারণে কোনো সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকলে সারা শহরের জনজীবন অসহনীয় হয়ে পড়ে। দাবি আদায়ে সড়ক অবরোধের মতো কর্মসূচি থেকে সরে না এলে জনদুর্ভোগ বাড়তেই থাকবে। জনগোষ্ঠী ও পেশাজীবীদের ন্যায়সংগত যেকোনো দাবি নিয়ে সড়ক অবরোধের চেয়ে উচিত যৌক্তিক পথ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তা তুলে ধরা।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হত্যাকা-সহ অন্যান্য অপরাধ ঘিরে যেসব মামলা হচ্ছে, তার বেশির ভাগই সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণহীন বলে অভিযোগ উঠেছে। হত্যা কিংবা অন্য কোনো ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে ন্যূনতম নিয়মনীতি অনুসরণ করা হয়নি। এসব ঢালাও মামলা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে উদ্বেগ ও সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সদর দপ্তর নির্দেশনা দিয়েছে তদন্তে কোনো আসামির সম্পৃক্ততা পাওয়া না গেলে মামলা থেকে তার নাম প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে সঠিক তথ্যপ্রমাণ ছাড়া এসব মামলায় কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করা যাবে না বলেও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যাচাই-বাছাই না করে মিথ্যা বা ভুয়া মামলা দিয়ে নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি না করার অনুরোধ এসেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকেও। জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে বিগত সরকার যে চরম নিষ্ঠুরতার আশ্রয় নিয়েছিল, তার বিচার অবশ্যই হতে হবে। কিন্তু বিচারের নামে নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি করার অধিকার কারও নেই। ঢালাও মামলায় জড়ানোটা আওয়ামী লীগ আমলের গায়েবি মামলার সঙ্গেও তুলনা করা যায়। পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনার পর আমাদের প্রত্যাশা, ঢালাও মামলায় আর কাউকে অযথা আসামি করা হবে না। আমরা চাই হত্যা, দুর্নীতিসহ সব অপরাধের বিচার হোক। কিন্তু অপরাধীকে শনাক্ত না করে এ রকম গয়রহ মামলা করলে যেমন নিরপরাধ মানুষ হয়রানির শিকার হবেন, তেমনি ন্যায়বিচারের পথও রুদ্ধ হবে।
শিল্পাঞ্চলে সাম্প্রতিক শ্রমিক অসন্তোষে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা ও অশান্তি যেন কাটছেই না। শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে আশুলিয়া, সাভার ও গাজীপুরের অনেক শিল্পকারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়েছে। বিভিন্ন কারখানার সামনে সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন করেও পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাচ্ছে না। হাজিরা বোনাস বৃদ্ধি, শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ, টিফিন বিল বৃদ্ধি, বেতনসহ সমানুপাতিক হারে পুরুষ শ্রমিক নিয়োগসহ বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ করছেন শ্রমিকেরা। পোশাক খাতে অস্থিরতার পেছনে কয়েকটি কারণ উঠে এসেছে। আওয়ামী লীগ সরকার ও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কারখানামালিকদের অনেকে সরকার পতনের পর গা-ঢাকা দিয়েছেন, কেউ কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের কারখানাগুলোর শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকে তৈরি হয়েছে অস্থিরতা। অস্থিরতার পেছনে রয়েছে ঝুট ব্যবসা শ্রমিক বিরোধ। আগে সেই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এখন সেই ব্যবসা দখল নিতে চায় তাদের বিরোধীপক্ষ। কেউ কেউ মনে করছেন, তৃতীয় কোনো পক্ষ শ্রমিক অস্থিরতায় ইন্ধন দিচ্ছে। একেক কারখানার শ্রমিকেরা একেক ধরনের দাবি-দাওয়ার কথা জানাচ্ছেন। অনেক দাবি মালিকেরা মেনেও নিয়েছেন। এরপরও বিক্ষোভ থামছে না। ব্যবসায়ীরা শিল্পাঞ্চলে ভাঙচুর ও লুট বন্ধে ব্যবস্থা নিতে ও ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্ধসঢ়;বান জানিয়েছেন।
সরকারের নীতি-নির্ধারকদের বুঝতে হবে, শুধু প্রতিশ্রুতি দিয়ে শ্রমিক অসন্তোষ নিরসন করা যাবে না। তাদের ন্যূনতম ন্যায্য মজুরির পাশাপাশি সুন্দর ও নিরাপদ কর্মপরিবেশও নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয় পক্ষের কোনো ইন্ধন থাকলে তা অনুসন্ধান করে দেখা হোক। তৈরি পোশাকশিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি। এর ওপর লাখো শ্রমিকের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে কোনো অসন্তোষ দেখা দিলে প্রতিযোগী রপ্তানিকারক দেশগুলো এর সুযোগ নেবে। ইতোমধ্যে কেউ কেউ সেই চেষ্টা চালাচ্ছে বলে জানা গেছে। আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করে রাষ্ট্র সংস্কার সম্ভব নয়, এরই মধ্যে তাদের মদদে সর্বত্র বিশৃঙ্খলা শুরু হয়েছে।
অতএব সরকারকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে দ্রুত শিল্পাঞ্চলে শান্তি ও নিরাপদ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। শ্রমিকদেরও বুঝতে হবে, কারখানা বন্ধ বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে নিজেদেরও ক্ষতি হবে। আন্দোলন হতে হবে নিয়মতান্ত্রিক ও অহিংস। কাউকে আইন হাতে তুলে নিতে দেয়া যাবে না। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে গিয়ে মূল জীবিকাই বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে সেটা ঠিক হবে না। মালিক-শ্রমিক উভয় পক্ষের সঙ্গে আলাপ করে এসব সমস্যার সমাধান অবশ্যই বের করতে হবে। আমরা আশা করব, অবিলম্বে শিল্পাঞ্চলে শান্তি ফিরে আসবে এবং উৎপাদন ব্যাহত হয়- এমন কোনো কাজ কোনো পক্ষই করবে না।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]