alt

উপ-সম্পাদকীয়

জাতীয় সংগীত নিয়ে বিতর্ক

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আবদুল্লাহিল আমান আযমী জাতীয় সংগীত ও সংবিধান পরিবর্তন করার দাবি তুলেছেন। তার অভিমত, বর্তমানের জাতীয় সংগীত স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের পরিপন্থি এবং এই সংগীত রচিত হয়েছে বঙ্গভঙ্গ রদ করার অভিপ্রায়ে। তার কথামতে দুই বাংলাকে এক করার জন্য রচিত গান ভারত আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। এই আবদুল্লাহিল আমান আযমী হচ্ছেন জামায়াতে ইসলাম বাংলাদেশের সাবেক আমির গোলাম আযমের ছেলে। তিনি ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। সম্প্রতি তিনি কথিত ‘আয়নাঘর’ থেকে দীর্ঘ আট বছর পর মুক্তি পেয়ে ট্রলের সম্মুখীন হয়েছেন। দীর্ঘ আট বছর ধরে ‘আয়নাঘরে’ তার ব্যবহৃত একটি গামছা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যঙ্গ ও উপহাস করা হচ্ছে, এই গামছা দিয়েই তিনি এক দীঘির সমপরিমাণ চোখের পানি মোছেন। ট্রলের প্রধান কারণ তার প্রদর্শিত গামছাটি প্রায় নতুন, ব্যবহৃত পুরনো গামছা বলে প্রতিপন্ন হয়নি। অন্যদিকে বাংলাদেশকে নিয়ে, বাংলাদেশের কোন লেখক দ্বারা, মৌলিক সুরে রচিত নয় বিধায় এলডিপির প্রেসিডেন্ট বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমেদও জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের কথায় সুর মিলিয়েছেন। জাতীয় সংসদেও একবার জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের প্রস্তাব উঠেছিল।

জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দেশজুড়ে লাখো কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জাতীয় সংগীত গেয়ে অনেকে প্রতিবাদ করছেন, কেউ কেউ রাস্তায় নেমে জাতীয় সংগীতের সুর তুলছেন। শুধু জাতীয় সংগীত নয়, জাতীয় পতাকা পরিবর্তনের কথাও অনেকে বলছেন। তাই বোধহয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে বিভিন্ন রকমের পতাকা নিয়ে বিভিন্ন লোকজন নিজেদের ভিন্ন মতাদর্শের কথা প্রচার করে গেছেন। ছাত্রদের তখন একটিই লক্ষ্য, সরকারের পতন, ভিন্ন মতাদর্শের লোকদের ভিন্ন পতাকার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন করার অবকাশ ছাত্রদের হাতে তখন ছিল না। অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘদিন চুপ ছিল, পরবর্তীতে তাদের বোধোদয় হয় এবং জাতীয় সংগীত বদলানোর কোন পরিকল্পনা বা অভিপ্রায় নেই মর্মে অন্তর্বর্তী সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়। জাতীয় সংগীতের পক্ষে জনগণের জাগরণ দেখে জামায়াতে ইসলামও ঘোষণা দেয় যে, জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের অভিমত আবদুল্লাহিল আমান আযমীর নিজস্ব, এই অভিমতের সঙ্গে তাদের দলের কোন সম্পর্ক নেই।

বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর ১৯৭৬ সালে সহরোওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত ইসলামি জলসায় দাবি উঠেছিল, ‘তোয়াব ভাই, তোয়াব ভাই, চাঁন-তারা পতাকা চাই!’ এই তোয়াব ভাই ছিলেন জিয়াউর রহমানের ডেপুটি, বিমান বাহিনীর প্রধান এম জি তোয়াব এবং তিনি ছিলেন সেই ইসলামি জলসার প্রধান অতিথি। ইসলামি জলসার আয়োজন করেছিলেন জামায়েতে ইসলামের নেতারা এবং জলসার সভাপতি ছিলেন দেলোয়ার হোসেন সাঈদী। জলসায় উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তান ও লিবিয়ার রাষ্ট্রদূত। সেই জলসায় উত্থাপিত দাবি ছিল, দেশকে শুধু ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ করলেই হবে না, পরিবর্তন করতে হবে জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত এবং সংবিধান, আর ধ্বংস করতে হবে শহীদ মিনার। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জামায়াত সমর্থক শিক্ষক দৈনিক ইনকিলাবে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের পক্ষে কলাম লিখে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটান। তবে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সব সময় জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত বদলানোর বিপক্ষে ছিলেন।

জাতীয় সংগীত বদলানোর পক্ষে কথা বলে আযমী সহেবরা কোন অপরাধ করেননি। বাকস্বাধীনতা স্বীকার করা হলে জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা বদলানোর কথা বলার অধিকার অস্বীকার করা সমীচীন নয়। কেউ ইচ্ছে করলে বাতিল করার বিপক্ষেও যুক্তি তুলে ধরার অধিকার ভোগ করতে পারেন। মীমাংসিত বলে কিছু আঁকড়ে ধরতে চাইলে পরিবেশ পরিস্থিতি পরিবর্তনের কারণে তা ধরে রাখা সম্ভব হয় না। ইরান, আফগানিস্তানে যে আমূল পরিবর্তন এসেছে তার মধ্যে কোন নাগরিক যদি আগের মূল্যবোধ, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত অক্ষুণœ রাখতে চায় তার অবস্থান হবে পাগলা গারদে। জামায়াতে ইসলাম বা কোন ইসলামপন্থী দল বাংলাদেশের ক্ষমতায় এলে জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় সংগীতের পরিবর্তন কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। শুধু তাই নয়, ইসলামপন্থী কোন দল ক্ষমতায় এলে বাকি সব রাজনৈতিক দল হবে নিষিদ্ধ, কারণ শরিয়া আইনের সঙ্গে গণতন্ত্র সাংঘর্ষিক। শরিয়া আইন প্রবর্তিত হওয়ার পর অন্য কোন রাজনৈতিক দল মনুষ্য প্রণীত আইনকানুনের আদর্শ দিয়ে রাজনীতি করার সুযোগই পাবে না।

বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পরিবর্তনের যে সূচনা হয়েছে, সেই সূচনায় সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, বদল করার কথা নয়। অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে সংস্কারের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে কমিশন গঠন করেছে। তবে প্রকৃত গণতান্ত্রিক দেশে জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীতের চেয়ে বাকস্বাধীনতার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনেক বেশি এবং বেশি বলেই সেই সব দেশে জাতীয় ক্ষেত্রে মীমাংসিত বিষয় নিয়েও কথা বলা যায়। আমেরিকার নাগরিকরা ক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় তাদের পতাকায় আগুন দিয়েছে; পতাকায় আগুন লাগানোর বিরুদ্ধে মামলা হলে আদালত বলেছে, ক্ষুব্ধ ব্যক্তি নিজের অধীনে থাকা জাতীয় পতাকা ছিঁড়তে পারবে, আগুন লাগাতে পারবে, কিন্তু অন্যের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে পতাকার অমর্যাদা করতে পারবে না। তাই যে কোন ইস্যুতে পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক হতেই পারে, যুক্তিসঙ্গত কথা বলে জনমত গঠনের অধিকার সবার থাকা উচিত।

জাতীয় সংগীত নিয়ে অভিযোগ হচ্ছে, মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশে একজন হিন্দু কবির গান জাতীয় সংগীত হতে পারে না। একই ধারণার বশবর্তী পাকিস্তান সরকারও ১৯৬৭ সালে লিখিতভাবে নিষিদ্ধ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। পাকিস্তান সরকার চেয়েছিল ‘হিন্দু’ কবি রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করে ‘মুসলমান’ কবি ইকবালকে প্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু ইকবাল ছিলেন উর্দু ও ফারসি ভাষার কবি। এই অবস্থায় বাংলা ভাষার ‘মুসলমান’ কবি নজরুল ইসলামকেও তারা বিবেচনায় রেখেছিল, কিন্তু নজরুল ছিলেন আলেমদের ঘোষিত ‘কাফের’, আর তিনি যা লিখেছেন তাকে কাটা-ছেঁড়া না করে হুবহু মুসলমানদের জন্য গ্রহণযোগ্য করে তোলা কঠিন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরুদ্ধে ধর্মের অভিযোগ সত্য নয়, কারণ তিনি হিন্দু ছিলেন না, ছিলেন ব্রাহ্ম; ব্রাহ্মরা একেশ্বরবাদী, এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী। অন্যদিকে হিন্দুর লেখা জাতীয় সংগীত হতে পারবে না, এমন কথা বলা আইনসম্মত নয়। তাছাড়া হিন্দুদের চাল, ডাল, গম, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, ডিম, কাঁচা মরিচ খাচ্ছি, তাদের গরু দিয়ে কোরবানি দিচ্ছি, তাদের ডাক্তারের চিকিৎসা নিচ্ছি, তাদের তুলা দিয়ে সুতা বানাচ্ছি, তাদের ডিজেলে গাড়ি চালাচ্ছি, তাদের বিদ্যুতে বাংলাদেশ আলোকিত হচ্ছে, দোষ শুধু জাতীয় সংগীতের।

আরেকটি অভিযোগ হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলাদেশের লোক নন। সেই বিবেচনায় কাজী নজরুল ইসলামও বাংলাদেশের লোক নন, কিন্তু তিনি আমাদের জাতীয় কবি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম বাংলাদেশে না হলেও তার পিতৃপুরুষের আবাসভূমি এবং শ্বশুরালয় খুলনায়। অন্য বিবেচনায় রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল উভয়ই বাংলাদেশের লোক, কারণ তাদের দুজনেরই জন্ম ভারতবর্ষে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু ১৯৪১ সালে, আর নজরুল ইসলাম বাকরুদ্ধ হন ১৯৪২ সালে; তাই তারা উভয়ই ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের কবি; কোন খ-িত ভূখ-ের কবি নন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুধু পিতৃপুরুষের বাড়ি পূর্ববঙ্গে নয়, তিনি তার জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন পূর্ববঙ্গের শিলাইদহ, পতিসর ও শাহজাদপুরে। তিনি ভারতের গঙ্গায় নয়, বাংলাদেশের পদ্মা নদীর বজরায় শুয়ে, বসে, কবিতা লিখে সময় কাটিয়েছেন। তিনি ইউরোপ থেকে ট্রাক্টর, বীজ এনে পূর্ববঙ্গের কৃষকদের আধুনিক চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ করেছেন, নিজের ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ব্যারিস্টার পড়াননি, ইউরোপ থেকে প-িত করে এনেছিলেন কৃষিবিদ্যায়। রথীন্দ্রনাথকে কাজে লাগিয়েছিলেন পূর্ববঙ্গের কৃষির উন্নয়নে। তিনি পতিসরের কৃষকদের জন্য ব্যাংক করেছেন, তার নোবেল পুরস্কারের সব টাকা দিয়ে পতিসরের কৃষকদের জামানতবিহীন লোন দিয়েছেন। তাই জামানতবিহীন লোন প্রদানে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পথিকৃত হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কৃষকদের প্রদত্ত লোন তিনি শেষ পর্যন্ত আর ফেরত পাননি।

অনেকের অভিযোগ হচ্ছে, রবি ঠাকুর কুষ্টিয়ার শিলাইদহের ডাকপিয়ন গগনচন্দ্র ড্যাম বা গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে’ গানের সুর নকল করে আমাদের জাতীয় সংগীতে সুরারোপ করেছেন। কথাটি মিথ্যা নয়। রবীন্দ্রনাথ শুধু আমাদের জাতীয় সংগীতে নয়, তার অনেক গানের সুর হয়েছে পশ্চিমের গানের সুর থেকে ধার করে। লালনের গানের সুরও তার গানে রয়েছে। কিন্তু ধার করা সুর নিয়ে তিনি কখনো লুকোচুরি করেননি। যারা সুর ‘চুরি’ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অভিযুক্ত করছেন তারা হয়তো জানেন না যে, রবীন্দ্রনাথ না থাকলে গগন হরকরার নাম আমাদের জানারই কথাই ছিল না; গগন হরকরা এবং লালন বিখ্যাত হয়েছেন ঠাকুরবাড়ির হাতে। রবীন্দ্রনাথের আয়োজনে গানের বহু জলসায় গগন হরকরা তার সেই বিখ্যাত ‘আমি কোথায় পাব তারে’ গানটিই গাইতেন। গগন হরকরার জীবনের ছায়া অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন ‘ডাকঘর’ নাটকটি, নাটকের গগেন্দ্রনাথ ঠাকুর চরিত্রটি মূলত গগন হরকরা। বাংলা লোকগীতি অধ্যাপক মনসুর উদ্দিনের লেখা ‘হারামণি’র ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে’ গানের কথা ও সুরের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।’ আমি কোথায় পাব তারে’ গানটির সুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চুরি করে নয়, সর্বত্র ঢাকঢোল পিটিয়ে গগন হরকরার প্রশংসা ও শ্রদ্ধার্পণের মধ্যে দিয়ে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানে আরোপ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ গগনের নাম ও তার গানটির বিষয়ে তার ‘অ্যান ইন্ডিয়ান ফোক রিলিজিয়ন’ প্রবন্ধেও উল্লেখ করেছেন।

অনেকের মতে, দুই বাংলার মিলনের জন্য যে গান রচিত হয়েছিল তাকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত করাটা সাংঘর্ষিক। কিন্তু ভারতবর্ষ বিভাজনের সময় সোহরাওর্দীসহ অনেক মুসলিম লীগ নেতাও অখ- বাংলার দাবিদার ছিলেন। নবাব সলিমুল্লাহও বঙ্গভঙ্গের পক্ষে ছিলেন এবং এজন্য নবাবকে নামমাত্র সুদে বিপুল অঙ্কের ঋণ দেয় ইংরেজ সরকার। বঙ্গভঙ্গ রদ হয়েছিল বলেই অখ- বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন সোহরাওর্দী। জামায়াতে ইসলামও কিন্তু পাকিস্তানেরও বিরোধিতা করেছিল। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় কলকাতার দাবিদার ছিলাম আমরা, এখনো বাংলাকে ভাগ করার জন্য আমরা কংগ্রেসকে দায়ী করে থাকি, তাই বঙ্গভঙ্গ রদ করার গান জাতীয় সংগীত হতে কোন বাধা থাকার কথা নয়। অন্যদিকে গানে বঙ্গভঙ্গ নিয়ে একটি শব্দও নেই।

জাতীয় সংগীতের ‘ওগো মা’ এবং ‘তোমার আকাশ তোমার বাতাস’ নিয়ে কয়েকজন আলেম প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের মতে মা হচ্ছে হিন্দুদের ‘দুর্গা মা’ এবং ‘আকাশ, বাতাস’ সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত কেউ মালিকানা দাবি করতে পারে না। মাতৃভূমি বা জন্মভূমিকে ‘মা’ সম্বোধন করেছেন পৃথিবীর অসংখ্য লেখক, জাতীয় সংগীতে দেশাত্মবোধের যে চিত্রকল্প ফুটে ওঠেছে তাতে ‘মাতৃভূমি’ না হয়ে ‘দুর্গা মা’ হতেই পারে না। অন্যদিকে আল্লাহর জমিনকে খ--বিখ- করে পৃথিবীতে ১৯৩টি দেশ বানিয়েছি, প্রত্যেক দেশের লোক নিজের ভূখ-ের স্বার্বভৌমত্বের দাবিদার; কিন্তু মানুষ কী করে স্বার্বভৌমত্বের অধিকারী হয়? যুদ্ধ লাগলে বলে, ‘আমাদের আকাশ পথে’ বিমান চলাচল বন্ধ। রাজনৈতিক দলগুলো বলে ‘জনগণ সব ক্ষমতার উৎস’। এসব সাংঘর্ষিক কথা বলার বিরুদ্ধে কাউকে সোচ্চার হতে দেখা যায় না, শুধু জাতীয় সংগীতের ক্ষেত্রে শিরিকসহ দোষত্রুটির পাহাড়।

১৯৭১ সালে পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানের মৃত্যুর পর অতি সম্প্রতি আবার পাকিস্তানের ভূতটি বাংলাদেশের ওপর আছর করেছে। রবীন্দ্রনাথ আবার আক্রান্ত হচ্ছেন। একাত্তরে ৩০ লাখ মানুষের আত্মাহুতি ও ২ লাখ নারীর ত্যাগের বিনিময়ে ভূমিষ্ট হওয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির যে জাতীয় সংগীতটি নির্ধারিত ও নিশ্চিত হয় তার পরিবর্তন যে এই মুহূর্তে অসম্ভব তা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে।

[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক; সাবেক এমডি, টাকশাল]

ছবি

ক্ষমতা এখন ‘মব’-এর হাতে

উচ্চ ফলনশীল বারি মসুর-৮

শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে বামপন্থির উত্থান

আমন ধানে আগাম ফুল আসার কারণ

উচ্চ ফলনশীল বারি মসুর-৮

কী হবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনীতি

রম্যগদ্য : ‘বল করে দুর্বল...’

মধ্যপ্রাচ্যে প্রযুক্তিগত যুদ্ধ

বন্যাপরবর্তী কৃষি উৎপাদনে সময়োপযোগী সহায়তা প্রদান

গুণগত উন্নয়নই সমাজের প্রকৃত উন্নতির চাবিকাঠি

বিশেষ শিশু ও বিশেষ শিক্ষালয়

বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস

সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার অধিকার

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি

প্রসঙ্গ : আনসার বাহিনী

শান্তির সংস্কৃতি : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

মব লিঞ্চিং আইনের শাসনের পরিপন্থি

মব জাস্টিসের মতো বর্বরতা বন্ধ হোক

বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে রাজনীতি

জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে বিতর্ক

ভূমি অধিগ্রহণে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হলে কী করবেন?

ছবি

নিবেদিত প্রাণ এক কৃষিবিজ্ঞানী

জনমনে স্বস্তি ফিরুক

দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার সুযোগ

মাদকের বিরুদ্ধে লড়তে হবে

রম্যগদ্য : আমার আসল আব্বা গো, তুমি কোই

মানুষের পর কারা হবে বিশ্বজয়ী

স্বাস্থ্য খাতে ফার্মাসিস্টদের অবদান

টেকসই রাষ্ট্রীয় সংস্কারে শিক্ষা ব্যবস্থার অব্যাহত বিনির্মাণের বিকল্প নাই

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সামাজিক অর্থায়নের ভূমিকা

বিশ্ব নরসুন্দর দিবস

মধু পূর্ণিমা ও প্রাসঙ্গিক কথা

‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়ন জলে ভাসি’

ছয়টি কমিশন গঠিত হলো কিন্তু শিক্ষা কোথায়?

বৃষ্টি হলেই নগরে জলাবদ্ধতা

‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়ন জলে ভাসি’

tab

উপ-সম্পাদকীয়

জাতীয় সংগীত নিয়ে বিতর্ক

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আবদুল্লাহিল আমান আযমী জাতীয় সংগীত ও সংবিধান পরিবর্তন করার দাবি তুলেছেন। তার অভিমত, বর্তমানের জাতীয় সংগীত স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের পরিপন্থি এবং এই সংগীত রচিত হয়েছে বঙ্গভঙ্গ রদ করার অভিপ্রায়ে। তার কথামতে দুই বাংলাকে এক করার জন্য রচিত গান ভারত আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। এই আবদুল্লাহিল আমান আযমী হচ্ছেন জামায়াতে ইসলাম বাংলাদেশের সাবেক আমির গোলাম আযমের ছেলে। তিনি ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। সম্প্রতি তিনি কথিত ‘আয়নাঘর’ থেকে দীর্ঘ আট বছর পর মুক্তি পেয়ে ট্রলের সম্মুখীন হয়েছেন। দীর্ঘ আট বছর ধরে ‘আয়নাঘরে’ তার ব্যবহৃত একটি গামছা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যঙ্গ ও উপহাস করা হচ্ছে, এই গামছা দিয়েই তিনি এক দীঘির সমপরিমাণ চোখের পানি মোছেন। ট্রলের প্রধান কারণ তার প্রদর্শিত গামছাটি প্রায় নতুন, ব্যবহৃত পুরনো গামছা বলে প্রতিপন্ন হয়নি। অন্যদিকে বাংলাদেশকে নিয়ে, বাংলাদেশের কোন লেখক দ্বারা, মৌলিক সুরে রচিত নয় বিধায় এলডিপির প্রেসিডেন্ট বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমেদও জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের কথায় সুর মিলিয়েছেন। জাতীয় সংসদেও একবার জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের প্রস্তাব উঠেছিল।

জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দেশজুড়ে লাখো কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জাতীয় সংগীত গেয়ে অনেকে প্রতিবাদ করছেন, কেউ কেউ রাস্তায় নেমে জাতীয় সংগীতের সুর তুলছেন। শুধু জাতীয় সংগীত নয়, জাতীয় পতাকা পরিবর্তনের কথাও অনেকে বলছেন। তাই বোধহয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে বিভিন্ন রকমের পতাকা নিয়ে বিভিন্ন লোকজন নিজেদের ভিন্ন মতাদর্শের কথা প্রচার করে গেছেন। ছাত্রদের তখন একটিই লক্ষ্য, সরকারের পতন, ভিন্ন মতাদর্শের লোকদের ভিন্ন পতাকার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন করার অবকাশ ছাত্রদের হাতে তখন ছিল না। অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘদিন চুপ ছিল, পরবর্তীতে তাদের বোধোদয় হয় এবং জাতীয় সংগীত বদলানোর কোন পরিকল্পনা বা অভিপ্রায় নেই মর্মে অন্তর্বর্তী সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়। জাতীয় সংগীতের পক্ষে জনগণের জাগরণ দেখে জামায়াতে ইসলামও ঘোষণা দেয় যে, জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের অভিমত আবদুল্লাহিল আমান আযমীর নিজস্ব, এই অভিমতের সঙ্গে তাদের দলের কোন সম্পর্ক নেই।

বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর ১৯৭৬ সালে সহরোওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত ইসলামি জলসায় দাবি উঠেছিল, ‘তোয়াব ভাই, তোয়াব ভাই, চাঁন-তারা পতাকা চাই!’ এই তোয়াব ভাই ছিলেন জিয়াউর রহমানের ডেপুটি, বিমান বাহিনীর প্রধান এম জি তোয়াব এবং তিনি ছিলেন সেই ইসলামি জলসার প্রধান অতিথি। ইসলামি জলসার আয়োজন করেছিলেন জামায়েতে ইসলামের নেতারা এবং জলসার সভাপতি ছিলেন দেলোয়ার হোসেন সাঈদী। জলসায় উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তান ও লিবিয়ার রাষ্ট্রদূত। সেই জলসায় উত্থাপিত দাবি ছিল, দেশকে শুধু ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ করলেই হবে না, পরিবর্তন করতে হবে জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত এবং সংবিধান, আর ধ্বংস করতে হবে শহীদ মিনার। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জামায়াত সমর্থক শিক্ষক দৈনিক ইনকিলাবে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের পক্ষে কলাম লিখে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটান। তবে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সব সময় জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত বদলানোর বিপক্ষে ছিলেন।

জাতীয় সংগীত বদলানোর পক্ষে কথা বলে আযমী সহেবরা কোন অপরাধ করেননি। বাকস্বাধীনতা স্বীকার করা হলে জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা বদলানোর কথা বলার অধিকার অস্বীকার করা সমীচীন নয়। কেউ ইচ্ছে করলে বাতিল করার বিপক্ষেও যুক্তি তুলে ধরার অধিকার ভোগ করতে পারেন। মীমাংসিত বলে কিছু আঁকড়ে ধরতে চাইলে পরিবেশ পরিস্থিতি পরিবর্তনের কারণে তা ধরে রাখা সম্ভব হয় না। ইরান, আফগানিস্তানে যে আমূল পরিবর্তন এসেছে তার মধ্যে কোন নাগরিক যদি আগের মূল্যবোধ, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত অক্ষুণœ রাখতে চায় তার অবস্থান হবে পাগলা গারদে। জামায়াতে ইসলাম বা কোন ইসলামপন্থী দল বাংলাদেশের ক্ষমতায় এলে জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় সংগীতের পরিবর্তন কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। শুধু তাই নয়, ইসলামপন্থী কোন দল ক্ষমতায় এলে বাকি সব রাজনৈতিক দল হবে নিষিদ্ধ, কারণ শরিয়া আইনের সঙ্গে গণতন্ত্র সাংঘর্ষিক। শরিয়া আইন প্রবর্তিত হওয়ার পর অন্য কোন রাজনৈতিক দল মনুষ্য প্রণীত আইনকানুনের আদর্শ দিয়ে রাজনীতি করার সুযোগই পাবে না।

বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পরিবর্তনের যে সূচনা হয়েছে, সেই সূচনায় সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, বদল করার কথা নয়। অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে সংস্কারের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে কমিশন গঠন করেছে। তবে প্রকৃত গণতান্ত্রিক দেশে জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীতের চেয়ে বাকস্বাধীনতার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনেক বেশি এবং বেশি বলেই সেই সব দেশে জাতীয় ক্ষেত্রে মীমাংসিত বিষয় নিয়েও কথা বলা যায়। আমেরিকার নাগরিকরা ক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় তাদের পতাকায় আগুন দিয়েছে; পতাকায় আগুন লাগানোর বিরুদ্ধে মামলা হলে আদালত বলেছে, ক্ষুব্ধ ব্যক্তি নিজের অধীনে থাকা জাতীয় পতাকা ছিঁড়তে পারবে, আগুন লাগাতে পারবে, কিন্তু অন্যের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে পতাকার অমর্যাদা করতে পারবে না। তাই যে কোন ইস্যুতে পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক হতেই পারে, যুক্তিসঙ্গত কথা বলে জনমত গঠনের অধিকার সবার থাকা উচিত।

জাতীয় সংগীত নিয়ে অভিযোগ হচ্ছে, মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশে একজন হিন্দু কবির গান জাতীয় সংগীত হতে পারে না। একই ধারণার বশবর্তী পাকিস্তান সরকারও ১৯৬৭ সালে লিখিতভাবে নিষিদ্ধ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। পাকিস্তান সরকার চেয়েছিল ‘হিন্দু’ কবি রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করে ‘মুসলমান’ কবি ইকবালকে প্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু ইকবাল ছিলেন উর্দু ও ফারসি ভাষার কবি। এই অবস্থায় বাংলা ভাষার ‘মুসলমান’ কবি নজরুল ইসলামকেও তারা বিবেচনায় রেখেছিল, কিন্তু নজরুল ছিলেন আলেমদের ঘোষিত ‘কাফের’, আর তিনি যা লিখেছেন তাকে কাটা-ছেঁড়া না করে হুবহু মুসলমানদের জন্য গ্রহণযোগ্য করে তোলা কঠিন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরুদ্ধে ধর্মের অভিযোগ সত্য নয়, কারণ তিনি হিন্দু ছিলেন না, ছিলেন ব্রাহ্ম; ব্রাহ্মরা একেশ্বরবাদী, এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী। অন্যদিকে হিন্দুর লেখা জাতীয় সংগীত হতে পারবে না, এমন কথা বলা আইনসম্মত নয়। তাছাড়া হিন্দুদের চাল, ডাল, গম, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, ডিম, কাঁচা মরিচ খাচ্ছি, তাদের গরু দিয়ে কোরবানি দিচ্ছি, তাদের ডাক্তারের চিকিৎসা নিচ্ছি, তাদের তুলা দিয়ে সুতা বানাচ্ছি, তাদের ডিজেলে গাড়ি চালাচ্ছি, তাদের বিদ্যুতে বাংলাদেশ আলোকিত হচ্ছে, দোষ শুধু জাতীয় সংগীতের।

আরেকটি অভিযোগ হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলাদেশের লোক নন। সেই বিবেচনায় কাজী নজরুল ইসলামও বাংলাদেশের লোক নন, কিন্তু তিনি আমাদের জাতীয় কবি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম বাংলাদেশে না হলেও তার পিতৃপুরুষের আবাসভূমি এবং শ্বশুরালয় খুলনায়। অন্য বিবেচনায় রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল উভয়ই বাংলাদেশের লোক, কারণ তাদের দুজনেরই জন্ম ভারতবর্ষে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু ১৯৪১ সালে, আর নজরুল ইসলাম বাকরুদ্ধ হন ১৯৪২ সালে; তাই তারা উভয়ই ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের কবি; কোন খ-িত ভূখ-ের কবি নন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুধু পিতৃপুরুষের বাড়ি পূর্ববঙ্গে নয়, তিনি তার জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন পূর্ববঙ্গের শিলাইদহ, পতিসর ও শাহজাদপুরে। তিনি ভারতের গঙ্গায় নয়, বাংলাদেশের পদ্মা নদীর বজরায় শুয়ে, বসে, কবিতা লিখে সময় কাটিয়েছেন। তিনি ইউরোপ থেকে ট্রাক্টর, বীজ এনে পূর্ববঙ্গের কৃষকদের আধুনিক চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ করেছেন, নিজের ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ব্যারিস্টার পড়াননি, ইউরোপ থেকে প-িত করে এনেছিলেন কৃষিবিদ্যায়। রথীন্দ্রনাথকে কাজে লাগিয়েছিলেন পূর্ববঙ্গের কৃষির উন্নয়নে। তিনি পতিসরের কৃষকদের জন্য ব্যাংক করেছেন, তার নোবেল পুরস্কারের সব টাকা দিয়ে পতিসরের কৃষকদের জামানতবিহীন লোন দিয়েছেন। তাই জামানতবিহীন লোন প্রদানে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পথিকৃত হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কৃষকদের প্রদত্ত লোন তিনি শেষ পর্যন্ত আর ফেরত পাননি।

অনেকের অভিযোগ হচ্ছে, রবি ঠাকুর কুষ্টিয়ার শিলাইদহের ডাকপিয়ন গগনচন্দ্র ড্যাম বা গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে’ গানের সুর নকল করে আমাদের জাতীয় সংগীতে সুরারোপ করেছেন। কথাটি মিথ্যা নয়। রবীন্দ্রনাথ শুধু আমাদের জাতীয় সংগীতে নয়, তার অনেক গানের সুর হয়েছে পশ্চিমের গানের সুর থেকে ধার করে। লালনের গানের সুরও তার গানে রয়েছে। কিন্তু ধার করা সুর নিয়ে তিনি কখনো লুকোচুরি করেননি। যারা সুর ‘চুরি’ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অভিযুক্ত করছেন তারা হয়তো জানেন না যে, রবীন্দ্রনাথ না থাকলে গগন হরকরার নাম আমাদের জানারই কথাই ছিল না; গগন হরকরা এবং লালন বিখ্যাত হয়েছেন ঠাকুরবাড়ির হাতে। রবীন্দ্রনাথের আয়োজনে গানের বহু জলসায় গগন হরকরা তার সেই বিখ্যাত ‘আমি কোথায় পাব তারে’ গানটিই গাইতেন। গগন হরকরার জীবনের ছায়া অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন ‘ডাকঘর’ নাটকটি, নাটকের গগেন্দ্রনাথ ঠাকুর চরিত্রটি মূলত গগন হরকরা। বাংলা লোকগীতি অধ্যাপক মনসুর উদ্দিনের লেখা ‘হারামণি’র ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে’ গানের কথা ও সুরের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।’ আমি কোথায় পাব তারে’ গানটির সুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চুরি করে নয়, সর্বত্র ঢাকঢোল পিটিয়ে গগন হরকরার প্রশংসা ও শ্রদ্ধার্পণের মধ্যে দিয়ে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানে আরোপ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ গগনের নাম ও তার গানটির বিষয়ে তার ‘অ্যান ইন্ডিয়ান ফোক রিলিজিয়ন’ প্রবন্ধেও উল্লেখ করেছেন।

অনেকের মতে, দুই বাংলার মিলনের জন্য যে গান রচিত হয়েছিল তাকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত করাটা সাংঘর্ষিক। কিন্তু ভারতবর্ষ বিভাজনের সময় সোহরাওর্দীসহ অনেক মুসলিম লীগ নেতাও অখ- বাংলার দাবিদার ছিলেন। নবাব সলিমুল্লাহও বঙ্গভঙ্গের পক্ষে ছিলেন এবং এজন্য নবাবকে নামমাত্র সুদে বিপুল অঙ্কের ঋণ দেয় ইংরেজ সরকার। বঙ্গভঙ্গ রদ হয়েছিল বলেই অখ- বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন সোহরাওর্দী। জামায়াতে ইসলামও কিন্তু পাকিস্তানেরও বিরোধিতা করেছিল। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় কলকাতার দাবিদার ছিলাম আমরা, এখনো বাংলাকে ভাগ করার জন্য আমরা কংগ্রেসকে দায়ী করে থাকি, তাই বঙ্গভঙ্গ রদ করার গান জাতীয় সংগীত হতে কোন বাধা থাকার কথা নয়। অন্যদিকে গানে বঙ্গভঙ্গ নিয়ে একটি শব্দও নেই।

জাতীয় সংগীতের ‘ওগো মা’ এবং ‘তোমার আকাশ তোমার বাতাস’ নিয়ে কয়েকজন আলেম প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের মতে মা হচ্ছে হিন্দুদের ‘দুর্গা মা’ এবং ‘আকাশ, বাতাস’ সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত কেউ মালিকানা দাবি করতে পারে না। মাতৃভূমি বা জন্মভূমিকে ‘মা’ সম্বোধন করেছেন পৃথিবীর অসংখ্য লেখক, জাতীয় সংগীতে দেশাত্মবোধের যে চিত্রকল্প ফুটে ওঠেছে তাতে ‘মাতৃভূমি’ না হয়ে ‘দুর্গা মা’ হতেই পারে না। অন্যদিকে আল্লাহর জমিনকে খ--বিখ- করে পৃথিবীতে ১৯৩টি দেশ বানিয়েছি, প্রত্যেক দেশের লোক নিজের ভূখ-ের স্বার্বভৌমত্বের দাবিদার; কিন্তু মানুষ কী করে স্বার্বভৌমত্বের অধিকারী হয়? যুদ্ধ লাগলে বলে, ‘আমাদের আকাশ পথে’ বিমান চলাচল বন্ধ। রাজনৈতিক দলগুলো বলে ‘জনগণ সব ক্ষমতার উৎস’। এসব সাংঘর্ষিক কথা বলার বিরুদ্ধে কাউকে সোচ্চার হতে দেখা যায় না, শুধু জাতীয় সংগীতের ক্ষেত্রে শিরিকসহ দোষত্রুটির পাহাড়।

১৯৭১ সালে পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানের মৃত্যুর পর অতি সম্প্রতি আবার পাকিস্তানের ভূতটি বাংলাদেশের ওপর আছর করেছে। রবীন্দ্রনাথ আবার আক্রান্ত হচ্ছেন। একাত্তরে ৩০ লাখ মানুষের আত্মাহুতি ও ২ লাখ নারীর ত্যাগের বিনিময়ে ভূমিষ্ট হওয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির যে জাতীয় সংগীতটি নির্ধারিত ও নিশ্চিত হয় তার পরিবর্তন যে এই মুহূর্তে অসম্ভব তা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে।

[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক; সাবেক এমডি, টাকশাল]

back to top