alt

উপ-সম্পাদকীয়

বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে রাজনীতি

মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন

: রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

এবারের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম প্রধান দাবি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ ঘোষণা। অনেকেই লেজুঙবৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। দেশে ছাত্র জনতার গণআন্দোলনের সাফল্যের পর এই দাবি বাস্তবায়নের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী অন্যতম প্রধান সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির পক্ষে তাদের দাবি জোরালো করতে সারাদেশে তাদের সব কমিটির কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু ছাত্রের হাতে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন লোকের হত্যাকা-ের প্রেক্ষাপটে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্র-শিক্ষক নির্বিশেষে সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এ দেশের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে ছাত্র আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর মধ্যে ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থান অন্যতম। সর্বসাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দেশের ওপর দীর্ঘ দেড় দশক ধরে চেপে বসা স্বৈরশাসকের তখতে তাউসকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে এমন এক নজির স্থাপন করেছে যা এদেশ তো বটেই, বিশ্ব ইতিহাসেই এক বিরল ঘটনা। অনেকেই এটাকে এখনও এক অবিশ্বাস্য স্বপ্ন রূপে বিবেচনা করে থাকবেন।

এত কিছুর পরও স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে মোটাদাগে ছাত্ররাজনীতি, বিশেষ করে শিক্ষাঙ্গনে আধিপত্য বিস্তারকারী প্রধাণ ছাত্রসংগঠনের রাজনীতি, নানা বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে দেখা গেছে, সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। তাদের তেমন কোন গঠনমূলক কার্যক্রম নেই। সরকারি দল ও সরকার মনোনীত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করাই তাদের মূল কাজ। বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপর অযাচিত প্রভাব বিস্তার করে তারা নিয়মিতভাবে নির্বিবাদে হলে হলে সিট বাণিজ্য, ডাইনিং-ক্যান্টিনে ফাউ খাওয়া, ক্যাম্পাস ও আশপাশের দোকানপাট থেকে বখরা আদায়, ঠিকাদারদের নিকট থেকে চাঁদা আদায়-এসব দুর্বৃত্তপনা চালিয়ে যায়। সাধারণ ছাত্রছাত্রী এবং অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের নিকট ক্ষমতা দেখানো ও তাদের শারীরিক-মানসিক ভাবে হেনস্তা করা তাদের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ। স্বাধীনতা উত্তরকালে এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে। দেখা যাবে, এগুলোর বেশিরভাগের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন কিংবা কোথাও কোথাও ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তারকারী অন্য কোন প্রধান ছাত্রসংগঠন জড়িত। এভাবে ছাত্র রাজনীতি, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের তৎপরতা, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো ছাত্রছাত্রীদের কাছে হয়ে উঠেছে এক দুঃস্বপ্নের নাম এবং একারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি আজ এক গণদাবিতে পরিণত হয়েছে।

অন্যদিকে, এদেশের বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে ছাত্র রাজনীতি যে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে তা স্মরণকরে অনেকেই ছাত্র রাজনীতি বহাল রাখা প্রয়োজন বলে অভিমত দিয়ে যাচ্ছেন। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, একটি সমাজে ছাত্ররাই হয়ে থাকে সবচেয়ে প্রতিবাদী অংশ। তারা যে কোন অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে যেভাবে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারে সেটা সাধারণ জনতার পক্ষে সম্ভবপর হয় না। তাছাড়া, ছাত্রদের মধ্যে সব সময় দেশ ও সমাজের জন্য কিছু করার আকাক্সক্ষা কাজ করে। তারুণ্যের এই শক্তিকে ঠিকমতো কাজে লাগানো গেলে সমাজে অনেক কল্যাণধর্মী কাজ সম্পাদন সহজ ও সম্ভবপর হয়। বলাই বাহুল্য, তাদেরকে এভাবে কাজে লাগাতে হলে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার বিকল্প নেই। প্রশ্ন হল, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে তাদের দেশ ও সমাজের প্রয়োজনে এ ধরণের কল্যাণধর্মী ও গঠনমূলক কাজে অংশগ্রহণের পথও বন্ধ করে দিচ্ছেন না তো? আরও প্রশ্ন আছে। শিক্ষাঙ্গনে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাড়াও আরও অনেক ছাত্র সংগঠন কাজ করে থাকে। সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের অপতৎপরতা ও অপরাধ মূলক কাজকর্মের দায়-দায়িত্ব তারা নেবে কেন? দেখা যাবে, সরকারি দল কোন ছাত্র সংগঠনকে পৃষ্ঠপোষকতা না দিলে অনেক সমস্যা এমনিতেই নাই হয়ে যাবে। কিন্তু এক্ষেত্রে নতুন যে সমস্যা দেখা দিতে পারে তা হলো, সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের অনুপস্থিতিতে অন্যান্য ছাত্র সংগঠনসমূহ বিভিন্ন ইস্যুতে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উপর একতরফা চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া, আপনি এককভাবে একটি মাত্র ছাত্র সংগঠনের তৎপরতা বন্ধের কথা বলতে পারেন না। কাজেই, হয় আপনাকে সব ছাত্র সংগঠনের তৎপরতা বন্ধ করে দিতে হবে, নতুবা এমন একটি বন্দোবস্তে যেতে হবে যেন ছাত্র সংগঠনগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড় হিসেবে কাজ না করে এবং তাদের কাছ থেকে বিশেষ ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা না পায়।

এবারে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে শিক্ষক রাজনীতির প্রসঙ্গে আসা যাক। আমার জানামতে, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণে আইনি কোন বাধা নেই। কিন্তু এখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা যা করছেন তা হলো, বিভিন্ন সেক্টরে রাজনৈতিক দলগুলোর যে পেশাভিত্তিক শাখা রয়েছে সেরকম এক একটি শাখা হিসেবে ভূমিকা রাখা। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দেশের রাজনীতিতে থিঙ্কট্যাঙ্ক হিসেবে ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের এখানে রাজনীতিতে জড়িত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অনেকেই মূলতঃ দলীয় কর্মীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন। তাদের কর্মকা-ের মূল লক্ষ্য থাকে রাজনৈতিক যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে বিভিন্ন পদ-পদবি বাগানো। অন্য যে সমস্যাটি দেখা দেয় তা হলো, শিক্ষাঙ্গনে সমমনা শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে এক ধরনের নেক্সাস গড়ে উঠে। এরা একে অপরকে বিভিন্ন ইস্যুতে সাপোর্ট দেয়।

কোন সংগঠন, বিশেষ করে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের সদস্যরা, যখন নানাবিধ অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে তখন সরকার সমর্থক শিক্ষকদের অনেকেই তাদের নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে অনেকটা অন্ধ সমর্থন দিয়ে যান। তাছাড়া, এদের একটি অন্যতম কাজ হয়ে থাকে কিছু পদ-পদবি বা সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সব কাজে নিঃশর্ত সমর্থন জুগিয়ে যাওয়া। সব মিলিয়ে দেখা যাবে, শিক্ষক রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তেমন কোন কল্যাণ বয়ে আনছে না। এসব কারণে ছাত্র রাজনীতির পাশাপাশি শিক্ষক রাজনীতি বন্ধেও জোরালো দাবি উঠেছে।

বিশ্বের ইতিহাস-ঐতিহ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, যেসব দেশ ও জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে গেছে তারাই বিশ্বের নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। আধুনিক বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই হলো জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মূল প্রাঙ্গণ। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি ও বজায় রাখার কোন বিকল্প নেই। বিদ্যার্থীরা যেন নির্বিঘেœ জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলার জন্য নিজেদের যথোপযুক্ত রূপে গড়ে তুলতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকরা রাজনীতি করবেন কিনা কিংবা কতটুকু, কী আঙ্গিকে করবেন সেটা নিয়ে আলোচনা হতেই পারে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিদ্যা চর্চার অঙ্গনের পরিবর্তে রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে পরিণত হবে- সেটা কিছুতেই কাম্য হতে পারে না।

[লেখক : অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]

ছবি

ক্ষমতা এখন ‘মব’-এর হাতে

উচ্চ ফলনশীল বারি মসুর-৮

শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে বামপন্থির উত্থান

আমন ধানে আগাম ফুল আসার কারণ

উচ্চ ফলনশীল বারি মসুর-৮

কী হবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনীতি

রম্যগদ্য : ‘বল করে দুর্বল...’

মধ্যপ্রাচ্যে প্রযুক্তিগত যুদ্ধ

বন্যাপরবর্তী কৃষি উৎপাদনে সময়োপযোগী সহায়তা প্রদান

গুণগত উন্নয়নই সমাজের প্রকৃত উন্নতির চাবিকাঠি

বিশেষ শিশু ও বিশেষ শিক্ষালয়

বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস

সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার অধিকার

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি

প্রসঙ্গ : আনসার বাহিনী

শান্তির সংস্কৃতি : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

মব লিঞ্চিং আইনের শাসনের পরিপন্থি

মব জাস্টিসের মতো বর্বরতা বন্ধ হোক

জাতীয় সংগীত নিয়ে বিতর্ক

জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে বিতর্ক

ভূমি অধিগ্রহণে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হলে কী করবেন?

ছবি

নিবেদিত প্রাণ এক কৃষিবিজ্ঞানী

জনমনে স্বস্তি ফিরুক

দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার সুযোগ

মাদকের বিরুদ্ধে লড়তে হবে

রম্যগদ্য : আমার আসল আব্বা গো, তুমি কোই

মানুষের পর কারা হবে বিশ্বজয়ী

স্বাস্থ্য খাতে ফার্মাসিস্টদের অবদান

টেকসই রাষ্ট্রীয় সংস্কারে শিক্ষা ব্যবস্থার অব্যাহত বিনির্মাণের বিকল্প নাই

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সামাজিক অর্থায়নের ভূমিকা

বিশ্ব নরসুন্দর দিবস

মধু পূর্ণিমা ও প্রাসঙ্গিক কথা

‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়ন জলে ভাসি’

ছয়টি কমিশন গঠিত হলো কিন্তু শিক্ষা কোথায়?

বৃষ্টি হলেই নগরে জলাবদ্ধতা

‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়ন জলে ভাসি’

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে রাজনীতি

মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন

রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

এবারের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম প্রধান দাবি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ ঘোষণা। অনেকেই লেজুঙবৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। দেশে ছাত্র জনতার গণআন্দোলনের সাফল্যের পর এই দাবি বাস্তবায়নের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী অন্যতম প্রধান সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির পক্ষে তাদের দাবি জোরালো করতে সারাদেশে তাদের সব কমিটির কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু ছাত্রের হাতে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন লোকের হত্যাকা-ের প্রেক্ষাপটে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্র-শিক্ষক নির্বিশেষে সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এ দেশের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে ছাত্র আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর মধ্যে ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থান অন্যতম। সর্বসাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দেশের ওপর দীর্ঘ দেড় দশক ধরে চেপে বসা স্বৈরশাসকের তখতে তাউসকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে এমন এক নজির স্থাপন করেছে যা এদেশ তো বটেই, বিশ্ব ইতিহাসেই এক বিরল ঘটনা। অনেকেই এটাকে এখনও এক অবিশ্বাস্য স্বপ্ন রূপে বিবেচনা করে থাকবেন।

এত কিছুর পরও স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে মোটাদাগে ছাত্ররাজনীতি, বিশেষ করে শিক্ষাঙ্গনে আধিপত্য বিস্তারকারী প্রধাণ ছাত্রসংগঠনের রাজনীতি, নানা বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে দেখা গেছে, সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। তাদের তেমন কোন গঠনমূলক কার্যক্রম নেই। সরকারি দল ও সরকার মনোনীত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করাই তাদের মূল কাজ। বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপর অযাচিত প্রভাব বিস্তার করে তারা নিয়মিতভাবে নির্বিবাদে হলে হলে সিট বাণিজ্য, ডাইনিং-ক্যান্টিনে ফাউ খাওয়া, ক্যাম্পাস ও আশপাশের দোকানপাট থেকে বখরা আদায়, ঠিকাদারদের নিকট থেকে চাঁদা আদায়-এসব দুর্বৃত্তপনা চালিয়ে যায়। সাধারণ ছাত্রছাত্রী এবং অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের নিকট ক্ষমতা দেখানো ও তাদের শারীরিক-মানসিক ভাবে হেনস্তা করা তাদের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ। স্বাধীনতা উত্তরকালে এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে। দেখা যাবে, এগুলোর বেশিরভাগের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন কিংবা কোথাও কোথাও ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তারকারী অন্য কোন প্রধান ছাত্রসংগঠন জড়িত। এভাবে ছাত্র রাজনীতি, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের তৎপরতা, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো ছাত্রছাত্রীদের কাছে হয়ে উঠেছে এক দুঃস্বপ্নের নাম এবং একারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি আজ এক গণদাবিতে পরিণত হয়েছে।

অন্যদিকে, এদেশের বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে ছাত্র রাজনীতি যে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে তা স্মরণকরে অনেকেই ছাত্র রাজনীতি বহাল রাখা প্রয়োজন বলে অভিমত দিয়ে যাচ্ছেন। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, একটি সমাজে ছাত্ররাই হয়ে থাকে সবচেয়ে প্রতিবাদী অংশ। তারা যে কোন অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে যেভাবে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারে সেটা সাধারণ জনতার পক্ষে সম্ভবপর হয় না। তাছাড়া, ছাত্রদের মধ্যে সব সময় দেশ ও সমাজের জন্য কিছু করার আকাক্সক্ষা কাজ করে। তারুণ্যের এই শক্তিকে ঠিকমতো কাজে লাগানো গেলে সমাজে অনেক কল্যাণধর্মী কাজ সম্পাদন সহজ ও সম্ভবপর হয়। বলাই বাহুল্য, তাদেরকে এভাবে কাজে লাগাতে হলে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার বিকল্প নেই। প্রশ্ন হল, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে তাদের দেশ ও সমাজের প্রয়োজনে এ ধরণের কল্যাণধর্মী ও গঠনমূলক কাজে অংশগ্রহণের পথও বন্ধ করে দিচ্ছেন না তো? আরও প্রশ্ন আছে। শিক্ষাঙ্গনে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাড়াও আরও অনেক ছাত্র সংগঠন কাজ করে থাকে। সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের অপতৎপরতা ও অপরাধ মূলক কাজকর্মের দায়-দায়িত্ব তারা নেবে কেন? দেখা যাবে, সরকারি দল কোন ছাত্র সংগঠনকে পৃষ্ঠপোষকতা না দিলে অনেক সমস্যা এমনিতেই নাই হয়ে যাবে। কিন্তু এক্ষেত্রে নতুন যে সমস্যা দেখা দিতে পারে তা হলো, সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের অনুপস্থিতিতে অন্যান্য ছাত্র সংগঠনসমূহ বিভিন্ন ইস্যুতে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উপর একতরফা চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া, আপনি এককভাবে একটি মাত্র ছাত্র সংগঠনের তৎপরতা বন্ধের কথা বলতে পারেন না। কাজেই, হয় আপনাকে সব ছাত্র সংগঠনের তৎপরতা বন্ধ করে দিতে হবে, নতুবা এমন একটি বন্দোবস্তে যেতে হবে যেন ছাত্র সংগঠনগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড় হিসেবে কাজ না করে এবং তাদের কাছ থেকে বিশেষ ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা না পায়।

এবারে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে শিক্ষক রাজনীতির প্রসঙ্গে আসা যাক। আমার জানামতে, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণে আইনি কোন বাধা নেই। কিন্তু এখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা যা করছেন তা হলো, বিভিন্ন সেক্টরে রাজনৈতিক দলগুলোর যে পেশাভিত্তিক শাখা রয়েছে সেরকম এক একটি শাখা হিসেবে ভূমিকা রাখা। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দেশের রাজনীতিতে থিঙ্কট্যাঙ্ক হিসেবে ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের এখানে রাজনীতিতে জড়িত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অনেকেই মূলতঃ দলীয় কর্মীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন। তাদের কর্মকা-ের মূল লক্ষ্য থাকে রাজনৈতিক যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে বিভিন্ন পদ-পদবি বাগানো। অন্য যে সমস্যাটি দেখা দেয় তা হলো, শিক্ষাঙ্গনে সমমনা শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে এক ধরনের নেক্সাস গড়ে উঠে। এরা একে অপরকে বিভিন্ন ইস্যুতে সাপোর্ট দেয়।

কোন সংগঠন, বিশেষ করে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের সদস্যরা, যখন নানাবিধ অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে তখন সরকার সমর্থক শিক্ষকদের অনেকেই তাদের নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে অনেকটা অন্ধ সমর্থন দিয়ে যান। তাছাড়া, এদের একটি অন্যতম কাজ হয়ে থাকে কিছু পদ-পদবি বা সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সব কাজে নিঃশর্ত সমর্থন জুগিয়ে যাওয়া। সব মিলিয়ে দেখা যাবে, শিক্ষক রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তেমন কোন কল্যাণ বয়ে আনছে না। এসব কারণে ছাত্র রাজনীতির পাশাপাশি শিক্ষক রাজনীতি বন্ধেও জোরালো দাবি উঠেছে।

বিশ্বের ইতিহাস-ঐতিহ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, যেসব দেশ ও জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে গেছে তারাই বিশ্বের নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। আধুনিক বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই হলো জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মূল প্রাঙ্গণ। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি ও বজায় রাখার কোন বিকল্প নেই। বিদ্যার্থীরা যেন নির্বিঘেœ জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলার জন্য নিজেদের যথোপযুক্ত রূপে গড়ে তুলতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকরা রাজনীতি করবেন কিনা কিংবা কতটুকু, কী আঙ্গিকে করবেন সেটা নিয়ে আলোচনা হতেই পারে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিদ্যা চর্চার অঙ্গনের পরিবর্তে রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে পরিণত হবে- সেটা কিছুতেই কাম্য হতে পারে না।

[লেখক : অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]

back to top