গাজী তারেক আজিজ
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচনায় উঠে আসে ‘মব জাস্টিস’ শব্দদ্বয়; যা পত্রিকার পাতা খুললে কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি আলোচনার উদ্রেক করে। ‘মব জাস্টিস’কে কেউ কেউ ‘মব কিলিং’ বলেও অভিহিত করেছেন। যাকে বিশদভাবে বলতে গেলে বলা চলে ‘গণপিটুনিতে হত্যা’। সেই হত্যা যখন লাগাতার ঘটে চলে তখন বলা হয় হত্যাকা-। এই হত্যাকা-ও বিনাবিচারে হয় অথবা বিচারবহির্ভূত হয়ে থাকে। এ হত্যাকা-সমূহের পক্ষে-বিপক্ষে নানা মুনির নানা মত বেশ লক্ষণীয়। তবে কেউই বিচারবহির্ভূত হত্যার সমর্থন করে না। স্বাভাবিক বোধবুদ্ধিসম্পন্ন কেউ তো নয়ই।
গত ৫ আগস্ট অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে প্রতিপক্ষের হামলায় মব জাস্টিস বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। ধারাবাহিক এসব হত্যাকা- যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখনই মিডিয়া সরগরম হয়। আর এই মব জাস্টিস শব্দদ্বয়কে এখন আর মব জাস্টিস বলতে নারাজ সচেতন মহল।
ক্রমেই মব জাস্টিসকে মব কিলিং হিসেবে অভিহিত করা শুরু হতে থাকে। যদিও শাব্দিক পরিবর্তন হলেও অর্থ পরিবর্তিত হয়ে সুস্পষ্ট হয় গণপিটুনিতে হত্যা। সেক্ষেত্রে মব কিলিংকে মব লিঞ্চিং বলা হয়ে থাকে। আমরা সাধারণত কিলিং শব্দের আভিধানিক অর্থ জানলেও লিঞ্চিং শব্দের আভিধানিক অর্থ অনুযায়ী চর্চা না করার ফলে মব লিঞ্চিং শব্দগুলো জানা হয় না।
কিলিং আর লিঞ্চিং অনেকটা একই অর্থ বহন করে। আর জাস্টিস শব্দটি থাকায় সাধারণ মানুষজন কিছুটা বিভ্রমে পড়ে যায়। কারণ আমরা জাস্টিস বলতে বুঝি বিচারক । পরিশব্দ হিসেবে বুঝি বিচার। তাহলে কি দাঁড়ায়? মব জাস্টিস বলতে জনতার বিচার। এই জনতার বিচারই বা কী? আর কী কারণে বা এত আলোচিত? জনতা কি বিচার করতে পারে? সেই ক্ষমতা কি কোন আইন কিংবা দেশের সংবিধান কাউকে দিয়েছে? কোন একক ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীকে? এর সোজাসাপ্টা উত্তর হলো না।
যদি কোন ব্যক্তি আইনের চোখে অপরাধী হয়েও থাকে। মানুষ বা কোন উত্তেজিত জনতা যদি অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে হত্যাকা- ঘটায় সেটা অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় প্রমাণসাপেক্ষ হলেও এখন প্রমাণ করা অত কঠিন কিছু নয়। যে কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মব জাস্টিস বা মব লিঞ্চিং বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা থেকে দেশব্যাপী ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ ঢাবির সেই মানসিক অসুস্থ তফাজ্জল হত্যার পর মিডিয়া খবর ফলাও প্রচার এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারের ফলে সারাদেশ কেঁপে কেঁপে ওঠে। এও সম্ভব কতিপয় সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের দ্বারা। যার মৃত্যুতে মানুষ নড়েচড়ে বসেছে। সর্বস্তরে দাবি উঠেছে এ উত্তেজিত জনতার হামলা নয়। এটা স্পষ্টত হত্যাকা-! যাকে বলে ঠান্ডা মাথায় খুন।
হত্যাকা-ের শিকার তফাজ্জলের অপরাধ ছিল মামুলি চুরির অভিযোগ। তারপরের ঘটনা বিশ্বের সবার জানা। তফাজ্জলের নিকটাত্মীয়ের নিকট ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগও ওঠে। তাহলে আমরা কি ভেবে নেব, অভ্যুত্থান পরবর্তী সকল হত্যাকা-ই মব কিলিং বা মব লিঞ্চিং? এক্ষেত্রে কথিত মব অর্থাৎ যে বা যারা হত্যার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত তাদেরকে খুনি হিসেবে অভিযুক্ত করতে আইনজ্ঞ হতে হয় না। সাধারণ বিবেচনায়ই যথেষ্ট। ঢাবিতে তফাজ্জল হত্যার শিকার ব্যক্তিদের ধরে সাধারণ ছাত্ররাই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে সোপর্দ করেছে। একটি বিষয় বেশ ভাববার অবকাশ থেকে যায়, যদি সেই সময়ও উক্ত প্রাথমিকভাবে দৃশ্যমান হত্যাকারীও কারো না কারো সাথে ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে ঠিক তখনই মব লিঞ্চিং তথা বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হতো তাহলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকতো? ঠিক এভাবেই হত্যার আর বদলা নিতে নিতে দাঙ্গায় রূপ নিত। সেই আশঙ্কা কি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া যায়?
আবার কেউ কেউ ইতোপূর্বেও এমনতর হত্যাকা-ের জন্য বিচার দাবি করেছেন। রাস্তায় নেমেছেন। মানববন্ধন করেছেন। আন্দোলন করেছেন। কিন্তু তফাজ্জল তার পরিবারের সবাইকে আগেই হারিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন ঠিকই। বিষয়টি এভাবে ভাবুন তো? রাষ্ট্র বা কতিপয় মব-এর কাছে আপনি নিতান্তই সংখ্যা হলেও নিজ পরিবারের কাছে ছিলেন পৃথিবীতুল্য। সেক্ষেত্রে তফাজ্জলের চলে যাওয়া মানেই পরিবার পরিজনহীন পৃথিবীতে অসহায় একাকীত্বের চেয়ে চলে যাওয়াই উত্তম! তাই বলে এভাবে? না, কোনভাবেই এমন মৃত্যু কাম্য হতে পারে না। পারে না বলেই, পরিবার পরিজনহীন এক তফাজ্জলের জন্যই কেঁদেছে দেশ! দেশের আপামর মানুষ!
যাদের ন্যূনতম মনুষ্যত্ব আছে। একটা বিষয় আমরা কেউই বুঝতে চাই না, রাজা যায় রাজা আসে। ক্ষমতার পালাবদলের ফলে নেতা ও নেতৃত্ব পরিবর্তন হয় ঠিকই, কিন্তু সে অর্থে জনগণের ভাগ্যের কি পরিবর্তন হয়? আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারাই কেন দাবার গুটিতে পরিণত হব? আমরা কেউই ক্ষমতার অংশীদার তো নয়ই, উল্টো রোষানলে পড়ে জীবন বিপর্যস্ত হয়। তবে বিশ্বের অনেক দেশেই এমনটা হয়েছে বলেও জানা যায়।
গত ১৯ সেপ্টেম্বর তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে বিচারককে গুলি করে হত্যা করে। কেন্টাকি রাজ্যে লেচার কাউন্টির আদালত ভবনে একাধিকবার গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ঘটনাস্থলেই মারা যান বিচারক কেভিন মুলিনস। বৃহস্পতিবার বিচারকের সঙ্গে আদালতের মধ্যেই তর্কাতর্কির একপর্যায়ে তাকে গুলি করা হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ। খুনি শেরিফকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। আর খুনির বিরুদ্ধে ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার অর্থাৎ, পূর্বপরিকল্পিত ও ইচ্ছাকৃত হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
আসুন জেনে নেয়া যাক মব কী? আর লিঞ্চিং কী? মব (সড়ন) শব্দের অর্থ বলা যায় উত্তাল জনতা বা হুজুগে জনতা। লিঞ্চিং (ষুহপযরহম) অর্থ হলো বিচারবহির্ভূত হত্যা। মব লিঞ্চিং দ্বারা বোঝায় উত্তাল বা হুজুগে জনতার দ্বারা কারও বিচারবহির্ভূত হত্যা। মব জাস্টিস দ্বারা উত্তাল বা হুজুগে জনতার দ্বারা নির্ধারিত হওয়া বিচারকে বোঝায়। মব লিঞ্চিংয়ের ব্যাপারটা এখন আমরা প্রায়ই শুনি। পাকিস্তানে ব্লাসফেমির অপরাধে মাশাল খানকে মব লিঞ্চিং এর মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছিল। সাথে গোমাংশ থাকার সন্দেহে বা গোহত্যার জন্য ভারতে মব লিঞ্চিংয়ের মাধ্যমে মানুষকে হত্যা করা হয় হরহামেশাই।
অবশ্য মব ক্ষেপলেই যে সবসময় লিঞ্চিং বা হত্যা হবে তা বলা যায় না। অনেক সময় শুধু গণপিটুনি দেয়া হয় বা ভাংচুর করা হয়। মবরাই সব করে। এগুলোর প্রতি মানুষের প্রতিক্রিয়া বিভিন্নরকমভাবে দেখা যায়। ধর্ষক, চোর, অপরাধীদের গণপিটুনি দেয়াতে, বা অনেক সময় লিঞ্চিং করাতে অনেকে সমর্থন জানান, এক্ষেত্রে এসব মব জাস্টিসে সমর্থন অনেক বেশি দেখা যায়।
আবার দেখা যায়, কতকগুলো ব্যক্তি যখন সড়ক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে জমায়েত হয় তখন তা জনতায় রূপ নেয়। এ অবস্থায় দেখা যায় অনেকে মোটর গাড়ির চালককে ঘেরাও করে জটলা করেছে, কেউ তাকে লক্ষ্য করে অশ্লীল মন্তব্য ও গালাগাল করছে, কেউবা মারমুখী হয়ে তার দিকে ছুটে যাচ্ছে। আবার কেউবা দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে পাঠানোর তোড়জোড় করছে। এমন সময় ঘটনাস্থলে পুলিশ হস্তক্ষেপ করতে এলে মারমুখো জনতার অনেকেই সুর সুর করে কেটে পড়ে। এই হলো জনতা। জনতা অতিরিক্ত উচ্ছৃঙ্খল ও মারমুখী হয়ে ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হলে তাকে দাঙ্গাকারী জনতা (সড়ন) বলে।
এক্ষেত্রে একটা ঘটনা থেকে জেনে নিতে পারি, রুবিন স্ট্যাসি ফ্লোরিডার ফোর্ট লডারডেলে ১৯৩৫ সালের ১৯ জুলাই রুবিন স্টেসির মৃতদেহ একটি গাছে ঝুলছে। একজন শ্বেতাঙ্গ মহিলার উপর হামলার অভিযোগে জনতা তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছিল। যখনই অনানুষ্ঠানিকভাবে সংগঠিত গোষ্ঠী আইনি প্রক্রিয়ার পরিপূরক বা প্রতিস্থাপন করার চেষ্টা করেছে বা যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক ন্যায়বিচার এখনও বিদ্যমান ছিল না সেখানে শূন্যতা পূরণ করার চেষ্টা করেছে এমন পরিস্থিতিতে অনেক দেশে সতর্কতামূলক ন্যায়বিচার অনুশীলন করা হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি সাধারণত গণহত্যার ঘটনা ঘটায়।সভ্য সমাজের অংশ হিসেবে আমাদের অবশ্যই তা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়া উচিৎ বলেও মনে করি।
ব্লাসফেমির কারণে, গোহত্যার কারণে, গরুর মাংস বহন করার কারণে, পাবলিক প্লেসে চুমু দেওয়ার কারণে, কোন মেয়ে ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করার কারণে (হ্যাঁ, ঢাকায় এটাও হয়েছে) গণপিটুনি দেয়া ও মব লিঞ্চিং করার ব্যাপারটা প্রায়ই খবরের কাগজের শিরোনাম হয় পাতায় পাতায়। তখন দেখা যায় অনেকেই জনতার বিচারকে ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকে স্বাগত জানাতেও দেখা গেছে। এটা মানুষকে সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে হয়তো; কিন্তু দীর্ঘ চিন্তার ফলশ্রুতিতে কোনভাবেই এমনটা কাম্য হতে পারে না। কারণ এই মব কিলিং বা মব লিঞ্চিং আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণে বাধার কারণে সভ্য সমাজ পরিচালনার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। কারণটাও স্পষ্ট, আমরা সাধারণত নিজের ওপর ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহ দিয়েই বিচার করে থাকি; যা সর্বজনীন না হওয়াটা স্বাভাবিক।
উদাহরণ হিসেবে আমাদের দেশের একটি জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া কথাই ধরা যাক, প্রায়শই কিছু লোক ঝগড়াবিবাদে লিপ্ত হয়ে ট্যাঁটা, বল্লম দিয়ে গ্রামে গ্রামে কিংবা গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে বংশ পরম্পরায় দীর্ঘদিন ধরে বিবাদ বিসম্বাদে লিপ্ত হয়। সেখানেও মবদের দ্বারা লিঞ্চিংয়ের মতো ঘটনা ঘটাতে দেখা যায়। নিয়মিত না হলেও দেশের প্রায় সকল জায়গায়ই এ ধরনের ঘটনা ঘটতে এবং ইচ্ছাকৃত ঘটাতে দেখা যায়। আর এসব বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলেই দেখা যায় প্রতিপক্ষের সাথে। যদিও বাংলাদেশের সকল পর্যায়ের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকেও এর বিরুদ্ধে শান্তির পক্ষে বক্তব্য কিংবা বিবৃতি কেবলই মিডিয়া সর্বস্ব বলেও শোনা যাচ্ছে, তৃণমূলে তার কোনই ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে না বললেই চলে। আবার দীর্ঘমেয়াদি শত্রুতার জেরে প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে যেমন আসামি করা হচ্ছে। আসামি শ্রেণীভুক্ত করা হচ্ছে নিরীহদেরও। ঘটনার সাথে সম্পৃক্ততা না থাকা সত্ত্বেও আসামি করা হচ্ছে সাধারণ জনতাকে। যারা কোন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুবিধাভোগী তো নয়ই, উল্টো গায়ের ঘাম ঝরিয়ে পেটের অন্ন জোগান দিতে হয়, নিজের এবং পরিবারের। অনাকাক্সিক্ষত যে কোন পরিস্থিতিতে তাদের কর্মে ব্যাঘাত ঘটার ফলে তারা অসহায় দিনাতিপাত করে।
বেশ আলোচনায় এসেছে মামলা নিয়ে বাণিজ্যের। তাহলে কি দাঁড়ালো? ভবিষ্যতে এ হীন কর্মকা-ের জন্য আবারও এমনতর পরিস্থিতি অর্থাৎ মব লিঞ্চিং তৈরির পথ সুগম করে দেয়া নয়? এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কারা কাজ করবে? দায়িত্ব কাদের ওপর বর্তাবে? কেউ না কেউ দায়িত্ব নিয়ে উদার মানবিক হয়ে দৃষ্টিভঙ্গি না বদলালে, চলতেই থাকবে মব লিঞ্চিং বা বিচারবহির্ভূত হত্যা। অথবা ফাস্ট ডিগ্রি মার্ডারের মতো ঘটনা। একটা ঘটনা আরেকটা ঘটনার পরিক্রমা তৈরি করে।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, মানুষের আবেগ প্রবণতা, বিচারশক্তিহীনতা, দায়িত্ববোধের অবনতি, ক্ষমতাবোধ, অনামিত্ব বোধের কারণে এমনটা হয়ে থাকে। অনেক সময় মানুষ পরিস্থিতিগত কারণেও নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে লিঞ্চিংয়ের মতো ঘটনা ঘটায়। যেমন- ঘটনা যখন এমন হয় একজন লোক জনসমক্ষে কখনোই নাচে না। কিন্তু একটা গানের তালে তালে ঠিকই নেচে ওঠে। আবার কেউ একটা অনুষ্ঠানে গেল আর সবাই যখন নাচতে থাকে, তখন তাকে টেনে নিয়ে এলে সে তখন আর নিজের মধ্যে থাকে না। অন্যদের চেয়েও বেশি নেচে গেয়ে মাতোয়ারা করে তোলে। যেটা আবেগের বহিঃপ্রকাশ বলেও মনে করা হয়ে থাকে। আবার কোথাও এমনও হয়, অতীতের কোন ঘটনা মনে যদি নাড়া দিয়ে যায়। যেখানে সে ব্যক্তি মনে করে থাকতে পারে, তার এরূপ আচরণ সেদিন করলে এমন পরিস্থিতি হতো না। যেমন একজন লোকের একটা মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করে। আদালতে সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে অভিযুক্ত আসামি বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খালাস পেয়ে যায়। ভুক্তভোগী পরিবারের কোন ব্যক্তির সামনে কোন ধর্ষণের অভিযুক্ত ব্যক্তি পড়লে সে ব্যক্তিও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সাথে থাকা মবদের সাথে যুক্ত হয়ে লিঞ্চিং করে থাকে। অতিমাত্রায় নিজের অস্তিত্ব কিংবা ক্ষমতা জানান দিতেও ব্যক্তি বা ব্যক্তি বিশেষের প্রতি লিঞ্চিং ঘটায়। যেটা ফাস্ট ডিগ্রি মার্ডার ও হয়ে থাকে। যেটা যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে বিচারকের সাথে করা পুলিশ সদস্যের আচরণে স্পষ্ট হয়।
পরিশেষে বলতে গেলে বলতে হয়, মানুষ সভ্য হয়ে বন্য আচরণ করতে থাকলে পর্যায়ক্রমে এসব ঘটনা প্রবাহ বাড়তে থাকবে। সব সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষই এর শিকার হয় না, উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে কেউ যে কোন সময় মব জাস্টিস, মব কিলিং, মব লিঞ্চিং ফাস্ট ডিগ্রি মার্ডার কিংবা বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার হয়ে যেতে পারে। তাই মানুষের উচিৎ নিজেদের আবেগ নিয়ন্ত্রণে রেখে কাজ করা। এসব বিচারবহির্ভূত হত্যা আইন বিরুদ্ধ কাজ। যেখানে সর্বোতভাবে আইনে স্বীকৃত হয় যে, নয়জন অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাক, একজন নিরপরাধ ব্যক্তির যাতে শাস্তি না হয়। যেখানে সব ধর্মের মর্মবাণী হচ্ছেÑ জীব হত্যা মহাপাপ।
[লেখক : আইনজীবী, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]
গাজী তারেক আজিজ
সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচনায় উঠে আসে ‘মব জাস্টিস’ শব্দদ্বয়; যা পত্রিকার পাতা খুললে কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি আলোচনার উদ্রেক করে। ‘মব জাস্টিস’কে কেউ কেউ ‘মব কিলিং’ বলেও অভিহিত করেছেন। যাকে বিশদভাবে বলতে গেলে বলা চলে ‘গণপিটুনিতে হত্যা’। সেই হত্যা যখন লাগাতার ঘটে চলে তখন বলা হয় হত্যাকা-। এই হত্যাকা-ও বিনাবিচারে হয় অথবা বিচারবহির্ভূত হয়ে থাকে। এ হত্যাকা-সমূহের পক্ষে-বিপক্ষে নানা মুনির নানা মত বেশ লক্ষণীয়। তবে কেউই বিচারবহির্ভূত হত্যার সমর্থন করে না। স্বাভাবিক বোধবুদ্ধিসম্পন্ন কেউ তো নয়ই।
গত ৫ আগস্ট অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে প্রতিপক্ষের হামলায় মব জাস্টিস বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। ধারাবাহিক এসব হত্যাকা- যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখনই মিডিয়া সরগরম হয়। আর এই মব জাস্টিস শব্দদ্বয়কে এখন আর মব জাস্টিস বলতে নারাজ সচেতন মহল।
ক্রমেই মব জাস্টিসকে মব কিলিং হিসেবে অভিহিত করা শুরু হতে থাকে। যদিও শাব্দিক পরিবর্তন হলেও অর্থ পরিবর্তিত হয়ে সুস্পষ্ট হয় গণপিটুনিতে হত্যা। সেক্ষেত্রে মব কিলিংকে মব লিঞ্চিং বলা হয়ে থাকে। আমরা সাধারণত কিলিং শব্দের আভিধানিক অর্থ জানলেও লিঞ্চিং শব্দের আভিধানিক অর্থ অনুযায়ী চর্চা না করার ফলে মব লিঞ্চিং শব্দগুলো জানা হয় না।
কিলিং আর লিঞ্চিং অনেকটা একই অর্থ বহন করে। আর জাস্টিস শব্দটি থাকায় সাধারণ মানুষজন কিছুটা বিভ্রমে পড়ে যায়। কারণ আমরা জাস্টিস বলতে বুঝি বিচারক । পরিশব্দ হিসেবে বুঝি বিচার। তাহলে কি দাঁড়ায়? মব জাস্টিস বলতে জনতার বিচার। এই জনতার বিচারই বা কী? আর কী কারণে বা এত আলোচিত? জনতা কি বিচার করতে পারে? সেই ক্ষমতা কি কোন আইন কিংবা দেশের সংবিধান কাউকে দিয়েছে? কোন একক ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীকে? এর সোজাসাপ্টা উত্তর হলো না।
যদি কোন ব্যক্তি আইনের চোখে অপরাধী হয়েও থাকে। মানুষ বা কোন উত্তেজিত জনতা যদি অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে হত্যাকা- ঘটায় সেটা অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় প্রমাণসাপেক্ষ হলেও এখন প্রমাণ করা অত কঠিন কিছু নয়। যে কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মব জাস্টিস বা মব লিঞ্চিং বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা থেকে দেশব্যাপী ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ ঢাবির সেই মানসিক অসুস্থ তফাজ্জল হত্যার পর মিডিয়া খবর ফলাও প্রচার এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারের ফলে সারাদেশ কেঁপে কেঁপে ওঠে। এও সম্ভব কতিপয় সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের দ্বারা। যার মৃত্যুতে মানুষ নড়েচড়ে বসেছে। সর্বস্তরে দাবি উঠেছে এ উত্তেজিত জনতার হামলা নয়। এটা স্পষ্টত হত্যাকা-! যাকে বলে ঠান্ডা মাথায় খুন।
হত্যাকা-ের শিকার তফাজ্জলের অপরাধ ছিল মামুলি চুরির অভিযোগ। তারপরের ঘটনা বিশ্বের সবার জানা। তফাজ্জলের নিকটাত্মীয়ের নিকট ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগও ওঠে। তাহলে আমরা কি ভেবে নেব, অভ্যুত্থান পরবর্তী সকল হত্যাকা-ই মব কিলিং বা মব লিঞ্চিং? এক্ষেত্রে কথিত মব অর্থাৎ যে বা যারা হত্যার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত তাদেরকে খুনি হিসেবে অভিযুক্ত করতে আইনজ্ঞ হতে হয় না। সাধারণ বিবেচনায়ই যথেষ্ট। ঢাবিতে তফাজ্জল হত্যার শিকার ব্যক্তিদের ধরে সাধারণ ছাত্ররাই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে সোপর্দ করেছে। একটি বিষয় বেশ ভাববার অবকাশ থেকে যায়, যদি সেই সময়ও উক্ত প্রাথমিকভাবে দৃশ্যমান হত্যাকারীও কারো না কারো সাথে ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে ঠিক তখনই মব লিঞ্চিং তথা বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হতো তাহলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকতো? ঠিক এভাবেই হত্যার আর বদলা নিতে নিতে দাঙ্গায় রূপ নিত। সেই আশঙ্কা কি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া যায়?
আবার কেউ কেউ ইতোপূর্বেও এমনতর হত্যাকা-ের জন্য বিচার দাবি করেছেন। রাস্তায় নেমেছেন। মানববন্ধন করেছেন। আন্দোলন করেছেন। কিন্তু তফাজ্জল তার পরিবারের সবাইকে আগেই হারিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন ঠিকই। বিষয়টি এভাবে ভাবুন তো? রাষ্ট্র বা কতিপয় মব-এর কাছে আপনি নিতান্তই সংখ্যা হলেও নিজ পরিবারের কাছে ছিলেন পৃথিবীতুল্য। সেক্ষেত্রে তফাজ্জলের চলে যাওয়া মানেই পরিবার পরিজনহীন পৃথিবীতে অসহায় একাকীত্বের চেয়ে চলে যাওয়াই উত্তম! তাই বলে এভাবে? না, কোনভাবেই এমন মৃত্যু কাম্য হতে পারে না। পারে না বলেই, পরিবার পরিজনহীন এক তফাজ্জলের জন্যই কেঁদেছে দেশ! দেশের আপামর মানুষ!
যাদের ন্যূনতম মনুষ্যত্ব আছে। একটা বিষয় আমরা কেউই বুঝতে চাই না, রাজা যায় রাজা আসে। ক্ষমতার পালাবদলের ফলে নেতা ও নেতৃত্ব পরিবর্তন হয় ঠিকই, কিন্তু সে অর্থে জনগণের ভাগ্যের কি পরিবর্তন হয়? আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারাই কেন দাবার গুটিতে পরিণত হব? আমরা কেউই ক্ষমতার অংশীদার তো নয়ই, উল্টো রোষানলে পড়ে জীবন বিপর্যস্ত হয়। তবে বিশ্বের অনেক দেশেই এমনটা হয়েছে বলেও জানা যায়।
গত ১৯ সেপ্টেম্বর তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে বিচারককে গুলি করে হত্যা করে। কেন্টাকি রাজ্যে লেচার কাউন্টির আদালত ভবনে একাধিকবার গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ঘটনাস্থলেই মারা যান বিচারক কেভিন মুলিনস। বৃহস্পতিবার বিচারকের সঙ্গে আদালতের মধ্যেই তর্কাতর্কির একপর্যায়ে তাকে গুলি করা হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ। খুনি শেরিফকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। আর খুনির বিরুদ্ধে ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার অর্থাৎ, পূর্বপরিকল্পিত ও ইচ্ছাকৃত হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
আসুন জেনে নেয়া যাক মব কী? আর লিঞ্চিং কী? মব (সড়ন) শব্দের অর্থ বলা যায় উত্তাল জনতা বা হুজুগে জনতা। লিঞ্চিং (ষুহপযরহম) অর্থ হলো বিচারবহির্ভূত হত্যা। মব লিঞ্চিং দ্বারা বোঝায় উত্তাল বা হুজুগে জনতার দ্বারা কারও বিচারবহির্ভূত হত্যা। মব জাস্টিস দ্বারা উত্তাল বা হুজুগে জনতার দ্বারা নির্ধারিত হওয়া বিচারকে বোঝায়। মব লিঞ্চিংয়ের ব্যাপারটা এখন আমরা প্রায়ই শুনি। পাকিস্তানে ব্লাসফেমির অপরাধে মাশাল খানকে মব লিঞ্চিং এর মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছিল। সাথে গোমাংশ থাকার সন্দেহে বা গোহত্যার জন্য ভারতে মব লিঞ্চিংয়ের মাধ্যমে মানুষকে হত্যা করা হয় হরহামেশাই।
অবশ্য মব ক্ষেপলেই যে সবসময় লিঞ্চিং বা হত্যা হবে তা বলা যায় না। অনেক সময় শুধু গণপিটুনি দেয়া হয় বা ভাংচুর করা হয়। মবরাই সব করে। এগুলোর প্রতি মানুষের প্রতিক্রিয়া বিভিন্নরকমভাবে দেখা যায়। ধর্ষক, চোর, অপরাধীদের গণপিটুনি দেয়াতে, বা অনেক সময় লিঞ্চিং করাতে অনেকে সমর্থন জানান, এক্ষেত্রে এসব মব জাস্টিসে সমর্থন অনেক বেশি দেখা যায়।
আবার দেখা যায়, কতকগুলো ব্যক্তি যখন সড়ক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে জমায়েত হয় তখন তা জনতায় রূপ নেয়। এ অবস্থায় দেখা যায় অনেকে মোটর গাড়ির চালককে ঘেরাও করে জটলা করেছে, কেউ তাকে লক্ষ্য করে অশ্লীল মন্তব্য ও গালাগাল করছে, কেউবা মারমুখী হয়ে তার দিকে ছুটে যাচ্ছে। আবার কেউবা দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে পাঠানোর তোড়জোড় করছে। এমন সময় ঘটনাস্থলে পুলিশ হস্তক্ষেপ করতে এলে মারমুখো জনতার অনেকেই সুর সুর করে কেটে পড়ে। এই হলো জনতা। জনতা অতিরিক্ত উচ্ছৃঙ্খল ও মারমুখী হয়ে ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হলে তাকে দাঙ্গাকারী জনতা (সড়ন) বলে।
এক্ষেত্রে একটা ঘটনা থেকে জেনে নিতে পারি, রুবিন স্ট্যাসি ফ্লোরিডার ফোর্ট লডারডেলে ১৯৩৫ সালের ১৯ জুলাই রুবিন স্টেসির মৃতদেহ একটি গাছে ঝুলছে। একজন শ্বেতাঙ্গ মহিলার উপর হামলার অভিযোগে জনতা তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছিল। যখনই অনানুষ্ঠানিকভাবে সংগঠিত গোষ্ঠী আইনি প্রক্রিয়ার পরিপূরক বা প্রতিস্থাপন করার চেষ্টা করেছে বা যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক ন্যায়বিচার এখনও বিদ্যমান ছিল না সেখানে শূন্যতা পূরণ করার চেষ্টা করেছে এমন পরিস্থিতিতে অনেক দেশে সতর্কতামূলক ন্যায়বিচার অনুশীলন করা হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি সাধারণত গণহত্যার ঘটনা ঘটায়।সভ্য সমাজের অংশ হিসেবে আমাদের অবশ্যই তা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়া উচিৎ বলেও মনে করি।
ব্লাসফেমির কারণে, গোহত্যার কারণে, গরুর মাংস বহন করার কারণে, পাবলিক প্লেসে চুমু দেওয়ার কারণে, কোন মেয়ে ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করার কারণে (হ্যাঁ, ঢাকায় এটাও হয়েছে) গণপিটুনি দেয়া ও মব লিঞ্চিং করার ব্যাপারটা প্রায়ই খবরের কাগজের শিরোনাম হয় পাতায় পাতায়। তখন দেখা যায় অনেকেই জনতার বিচারকে ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকে স্বাগত জানাতেও দেখা গেছে। এটা মানুষকে সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে হয়তো; কিন্তু দীর্ঘ চিন্তার ফলশ্রুতিতে কোনভাবেই এমনটা কাম্য হতে পারে না। কারণ এই মব কিলিং বা মব লিঞ্চিং আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণে বাধার কারণে সভ্য সমাজ পরিচালনার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। কারণটাও স্পষ্ট, আমরা সাধারণত নিজের ওপর ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহ দিয়েই বিচার করে থাকি; যা সর্বজনীন না হওয়াটা স্বাভাবিক।
উদাহরণ হিসেবে আমাদের দেশের একটি জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া কথাই ধরা যাক, প্রায়শই কিছু লোক ঝগড়াবিবাদে লিপ্ত হয়ে ট্যাঁটা, বল্লম দিয়ে গ্রামে গ্রামে কিংবা গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে বংশ পরম্পরায় দীর্ঘদিন ধরে বিবাদ বিসম্বাদে লিপ্ত হয়। সেখানেও মবদের দ্বারা লিঞ্চিংয়ের মতো ঘটনা ঘটাতে দেখা যায়। নিয়মিত না হলেও দেশের প্রায় সকল জায়গায়ই এ ধরনের ঘটনা ঘটতে এবং ইচ্ছাকৃত ঘটাতে দেখা যায়। আর এসব বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলেই দেখা যায় প্রতিপক্ষের সাথে। যদিও বাংলাদেশের সকল পর্যায়ের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকেও এর বিরুদ্ধে শান্তির পক্ষে বক্তব্য কিংবা বিবৃতি কেবলই মিডিয়া সর্বস্ব বলেও শোনা যাচ্ছে, তৃণমূলে তার কোনই ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে না বললেই চলে। আবার দীর্ঘমেয়াদি শত্রুতার জেরে প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে যেমন আসামি করা হচ্ছে। আসামি শ্রেণীভুক্ত করা হচ্ছে নিরীহদেরও। ঘটনার সাথে সম্পৃক্ততা না থাকা সত্ত্বেও আসামি করা হচ্ছে সাধারণ জনতাকে। যারা কোন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুবিধাভোগী তো নয়ই, উল্টো গায়ের ঘাম ঝরিয়ে পেটের অন্ন জোগান দিতে হয়, নিজের এবং পরিবারের। অনাকাক্সিক্ষত যে কোন পরিস্থিতিতে তাদের কর্মে ব্যাঘাত ঘটার ফলে তারা অসহায় দিনাতিপাত করে।
বেশ আলোচনায় এসেছে মামলা নিয়ে বাণিজ্যের। তাহলে কি দাঁড়ালো? ভবিষ্যতে এ হীন কর্মকা-ের জন্য আবারও এমনতর পরিস্থিতি অর্থাৎ মব লিঞ্চিং তৈরির পথ সুগম করে দেয়া নয়? এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কারা কাজ করবে? দায়িত্ব কাদের ওপর বর্তাবে? কেউ না কেউ দায়িত্ব নিয়ে উদার মানবিক হয়ে দৃষ্টিভঙ্গি না বদলালে, চলতেই থাকবে মব লিঞ্চিং বা বিচারবহির্ভূত হত্যা। অথবা ফাস্ট ডিগ্রি মার্ডারের মতো ঘটনা। একটা ঘটনা আরেকটা ঘটনার পরিক্রমা তৈরি করে।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, মানুষের আবেগ প্রবণতা, বিচারশক্তিহীনতা, দায়িত্ববোধের অবনতি, ক্ষমতাবোধ, অনামিত্ব বোধের কারণে এমনটা হয়ে থাকে। অনেক সময় মানুষ পরিস্থিতিগত কারণেও নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে লিঞ্চিংয়ের মতো ঘটনা ঘটায়। যেমন- ঘটনা যখন এমন হয় একজন লোক জনসমক্ষে কখনোই নাচে না। কিন্তু একটা গানের তালে তালে ঠিকই নেচে ওঠে। আবার কেউ একটা অনুষ্ঠানে গেল আর সবাই যখন নাচতে থাকে, তখন তাকে টেনে নিয়ে এলে সে তখন আর নিজের মধ্যে থাকে না। অন্যদের চেয়েও বেশি নেচে গেয়ে মাতোয়ারা করে তোলে। যেটা আবেগের বহিঃপ্রকাশ বলেও মনে করা হয়ে থাকে। আবার কোথাও এমনও হয়, অতীতের কোন ঘটনা মনে যদি নাড়া দিয়ে যায়। যেখানে সে ব্যক্তি মনে করে থাকতে পারে, তার এরূপ আচরণ সেদিন করলে এমন পরিস্থিতি হতো না। যেমন একজন লোকের একটা মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করে। আদালতে সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে অভিযুক্ত আসামি বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খালাস পেয়ে যায়। ভুক্তভোগী পরিবারের কোন ব্যক্তির সামনে কোন ধর্ষণের অভিযুক্ত ব্যক্তি পড়লে সে ব্যক্তিও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সাথে থাকা মবদের সাথে যুক্ত হয়ে লিঞ্চিং করে থাকে। অতিমাত্রায় নিজের অস্তিত্ব কিংবা ক্ষমতা জানান দিতেও ব্যক্তি বা ব্যক্তি বিশেষের প্রতি লিঞ্চিং ঘটায়। যেটা ফাস্ট ডিগ্রি মার্ডার ও হয়ে থাকে। যেটা যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে বিচারকের সাথে করা পুলিশ সদস্যের আচরণে স্পষ্ট হয়।
পরিশেষে বলতে গেলে বলতে হয়, মানুষ সভ্য হয়ে বন্য আচরণ করতে থাকলে পর্যায়ক্রমে এসব ঘটনা প্রবাহ বাড়তে থাকবে। সব সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষই এর শিকার হয় না, উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে কেউ যে কোন সময় মব জাস্টিস, মব কিলিং, মব লিঞ্চিং ফাস্ট ডিগ্রি মার্ডার কিংবা বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার হয়ে যেতে পারে। তাই মানুষের উচিৎ নিজেদের আবেগ নিয়ন্ত্রণে রেখে কাজ করা। এসব বিচারবহির্ভূত হত্যা আইন বিরুদ্ধ কাজ। যেখানে সর্বোতভাবে আইনে স্বীকৃত হয় যে, নয়জন অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাক, একজন নিরপরাধ ব্যক্তির যাতে শাস্তি না হয়। যেখানে সব ধর্মের মর্মবাণী হচ্ছেÑ জীব হত্যা মহাপাপ।
[লেখক : আইনজীবী, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]