alt

উপ-সম্পাদকীয়

গুণগত উন্নয়নই সমাজের প্রকৃত উন্নতির চাবিকাঠি

রহমান মৃধা

: বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন যেন এক ধরনের অসীম ব্যস্ততার জালে আবদ্ধ। কাজের পরিমাণ বাড়াতে গিয়ে আমরা প্রায়ই ভুলে যাই গুণগতমানের দিকে নজর দিতে। শিক্ষা খাত থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কাজ, রাজনীতি কিংবা ব্যক্তিগত জীবনের ছোটখাটো সিদ্ধান্ত- সবখানেই যেন ‘ভলিউম’ বাড়ানোর চেষ্টা, অথচ ‘কোয়ালিটি’ বাড়ানোর কোনো প্রচেষ্টা নেই। এটাই আমাদের জীবনের এক অন্যতম বড় সমস্যা।

আমরা প্রতিদিনের জীবনযাপনে কাজের পরিমাণ বাড়াতে ব্যস্ত, কিন্তু সেই কাজের গুণগতমান কতটা উন্নত হচ্ছে, সেটা নিয়ে কি আমরা ভাবি? শিক্ষা, রাজনীতি বা ব্যক্তিগত জীবন- সবক্ষেত্রেই ভলিউম বাড়ানোর প্রচেষ্টার বদলে গুণগত উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন।

শিক্ষা খাত : মানহীন শিক্ষার দুষ্টচক্র

শিক্ষার ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো আমরা হরহামেশাই দেখতে পাই। আমাদের দেশে শিক্ষার্থীরা সারাদিন বইয়ের পাতা ওল্টাতে থাকে, ক্লাস, কোচিং, প্রাইভেটÑ এসব নিয়ে দিনের পর দিন ব্যস্ত থাকে; কিন্তু তারা আসলে কতটুকু শিখছে? মুখস্থবিদ্যা বা ‘রট লার্নিং’-এর ফাঁদে পড়ে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলোর সমাধান করতে সক্ষম হচ্ছে না।

এই শিক্ষা পদ্ধতির কারণেই অনেকে সৃজনশীল চিন্তাধারার বিকাশ ঘটাতে পারে না। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশে পাবলিক পরীক্ষার সিলেবাসের চাপ এবং প্রতিযোগিতামূলক ফলাফল ব্যবস্থা বলা যায়।

শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা কী শিখছি, আর কেন শিখছি, সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। আজকের শিক্ষাব্যবস্থা কি প্রকৃতপক্ষে আমাদের জ্ঞানী করছে, নাকি মুখস্থবিদ্যার মাধ্যমে শুধুই পরীক্ষার খাতায় ভালো নম্বর তুলে দিচ্ছে? শিক্ষার্থীরা অধিকাংশ সময় পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতে গিয়ে বইয়ের পৃষ্ঠা মুখস্থ করে, কিন্তু যখন সেই জ্ঞান বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে হয়, তখন অসহায় হয়ে পড়ে।

প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো সিলেক্টিভভাবে শিখুন এবং গুগল বা অন্যান্য প্রযুক্তির সাহায্যে বাকি তথ্য সংগ্রহ করুনÑ এটাই হতে পারে আধুনিক শিক্ষার উপায়। শিক্ষা মানে শুধু পড়াশোনা নয়, বরং শেখার পদ্ধতি জানা এবং ম্যানেজ করা।

রাজনৈতিক দুর্নীতি : ক্ষমতার অপব্যবহার

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুর্নীতির প্রভাব যেন আরেকটি বিষফোঁড়া। প্রতিনিয়ত আমরা শুনি, ক্ষমতাসীন কোনো নেতা যখন ক্ষমতা থেকে সরে যায়, তখন তার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের করা হয়। আবার যখন সেই নেতা ক্ষমতায় ফিরে আসে, তখন সব মামলা বাতিল হয়। এর উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, বিগত সময়ে ক্ষমতায় থাকা বিভিন্ন নেতার বিরুদ্ধে দায়ের করা শত শত মামলার কাহিনী।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল ঘটলেই কেন শত শত মামলা জমা পড়ে? অপরাধের বিচার কি শুধু ক্ষমতার বাইরে থাকলেই হয়, নাকি ন্যায়বিচার সবসময়ই প্রাপ্য হওয়া উচিত?

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন একটি মামলাই যথেষ্ট নয়? কেন আমাদের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া এত জটিল এবং সময়সাপেক্ষ? যদি সঠিকভাবে বিচারব্যবস্থা পরিচালিত হতো, তবে একটি মামলাই যথেষ্ট হতো ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় যদি অপরাধ করা হয়, তখনই বিচার হওয়া উচিত। অন্যথায় ক্ষমতা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মামলা দায়েরের সংস্কৃতি শুধু ভলিউম বাড়ায়, আর রাষ্ট্রের অর্থ, সময়, এবং সম্পদের অপচয় হয়।

ব্যক্তিগত জীবন : অপচয় বন্ধ করুন, সুষ্ঠু পরিকল্পনা করুন

আমাদের ব্যক্তিগত জীবনেও আমরা একই ভুল করি। ক্রেডিট কার্ড, নগদ টাকা, ক্রমাগত কেনাকাটাÑ এসবের মধ্যে আমরা প্রায়শই অহেতুক জটিলতা তৈরি করি। উদাহরণ হিসেবে- কেন আপনাকে বারবার নতুন পোশাক কিনতে হবে? একবার পরে যদি তা আর ব্যবহার না করেন, তবে সেটা কেনার বদলে ভাড়া নিতে পারেন।

ব্যক্তিগত জীবনেও আমরা অহেতুক খরচের বোঝা বাড়াই। যেটা ভাড়া নিয়ে ব্যবহার করা সম্ভব, সেটা কেনার দরকার কি? পরিকল্পিত জীবনযাপন শুধু আপনার খরচই কমাবে না, মানসিক চাপও হ্রাস করবে।

বিশ্বের অনেক দেশেই এখন মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য ভাড়া করে ব্যবহার করছে, তারপর তা অন্যদের ব্যবহারের জন্য ফেরত দিচ্ছে। এই ধরনের পদ্ধতি শুধু আপনার ব্যক্তিগত অর্থ সাশ্রয় করে না, বরং সামগ্রিকভাবে সামাজিক সম্পদের ব্যবহারেও একটি ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। আমাদের প্রতিদিনের জীবনেও এই ধরনের পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেয়া উচিত। এমনটা সম্ভব না? সম্ভব করার জন্যই কাজ করতে হবে।

রাজনৈতিক নির্দেশনা ও প্রশাসনিক পচন : শেখ হাসিনার শাসনামল

শেখ হাসিনার শাসনামলে ঘটে যাওয়া বহু ঘটনা সরাসরি তার নির্দেশনার ফলাফল হিসেবে দেখা যায়। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, শত শত শিক্ষার্থীর হত্যাকা-ের জন্য দায় কার? কোনো নির্দিষ্ট নির্দেশনার ভিত্তিতে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে কিনা, তা নিয়েও জনমনে প্রশ্ন ওঠে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য একটিমাত্র মামলাই যথেষ্ট, যদি তা সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়। অথচ অহেতুক শত শত মামলা দায়ের করে রাষ্ট্রের সম্পদ ও সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছু হয় না। এ ধরনের বিচারিক প্রক্রিয়া প্রশাসনের পচনকে আরও গভীর করে এবং জনগণের আস্থাকে ভেঙে দেয়। প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচার যদি নিশ্চিত করা যেত, তবে এমন অবস্থা এড়ানো সম্ভব হতো।

বিচারব্যবস্থা ও প্রশাসন : ঘুষের ফাঁদ থেকে মুক্তি

বিচার ব্যবস্থার ধীরগতি এবং প্রশাসনের দুর্নীতিও আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি। প্রশাসনিক কাজগুলোতে এখন এত বেশি ঘুষ লেনদেন চলছে যে, কাজ না করার জন্য সময়ের অভাবের অজুহাত দেয়া হচ্ছে, কিন্তু ঘুষ দিলে কাজ হচ্ছে। একটা ফাইল দিনের পর দিন পড়ে থাকে, যতক্ষণ না ঘুষের অর্থ হাতে আসে।

দুর্নীতি ও ঘুষ শুধুমাত্র বিচারপ্রক্রিয়াকেই ধীরগতির করে না, বরং সাধারণ মানুষকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। কিভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব, সেটাই এখন সময়ের দাবি।

এ ধরনের পরিস্থিতিতে দেশের সাধারণ মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সাধারণ মানুষ একটি জমির মালিকানা পেতে বা কোনো প্রশাসনিক সেবা পেতে প্রশাসনের কাছে গেলে ঘুষ দিতে বাধ্য হয়। আর যারা ঘুষ দিতে পারে না, তাদের কাজ আটকে থাকে। এটা শুধু ‘পচা বাংলাদেশ’-এর চিত্র। এমন একটা বাংলাদেশ যা মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের চেতনার সঙ্গে মিলে না।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা : দায়িত্ব ও ন্যায়বিচারের প্রয়োজন

আমরা আমাদের দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের দামে স্বাধীনতা পেয়েছি। এই দেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হওয়া উচিত সেই স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষা করা। দুর্নীতি, অন্যায় এবং নৈতিক অবক্ষয়কে প্রশ্রয় দিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। তাই জাতি হিসেবে আমাদের উচিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং প্রতিটি স্তরে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।

স্বাধীনতার আদর্শকে ধরে রাখতে হলে আমাদের নিজেদের দায়িত্বের কথা ভুললে চলবে না। মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেই চেতনায় দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতেই হবে।

মুক্তিযুদ্ধের যে আদর্শ নিয়ে আমরা লড়াই করেছিলাম, সেই আদর্শ এখনও আমাদের পথপ্রদর্শক হতে পারে। আমাদের বিচারব্যবস্থা এবং প্রশাসনকেও সেই আদর্শ মেনে চলতে হবে। একটি দেশ শুধুমাত্র তখনই প্রকৃতভাবে এগিয়ে যেতে পারে, যখন তার বিচারব্যবস্থা সঠিক এবং তার প্রশাসন দুর্নীতিমুক্ত থাকে।

পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা

আমাদের প্রতিটি খাতে এবং জীবনের প্রতিটি স্তরে ‘ভলিউম’ বাড়ানোর চেষ্টা না করে ‘কোয়ালিটি’ বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। দুর্নীতি, ঘুষ এবং অযৌক্তিক অপচয় বন্ধ করতে হবে। শিক্ষায় মানসম্পন্ন জ্ঞানচর্চা, বিচারব্যবস্থায় ন্যায়বিচার এবং প্রশাসনে স্বচ্ছতাÑ এসব যদি নিশ্চিত করতে পারি, তবে আমাদের দেশ সত্যিকার অর্থে উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে।

আমাদের প্রতিটি স্তরে গুণগতমান বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। শিক্ষা, প্রশাসন, বিচারÑ সবখানেই কোয়ালিটি বাড়াতে পারলে আমরা একটা উন্নত ও সুশৃঙ্খল সমাজ গড়ে তুলতে পারবো।

এটাই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্যÑ আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং জাতীয় জীবনে গুণগতমান বৃদ্ধির জন্য সচেতন প্রচেষ্টা চালানো। কারণ জাতির উন্নতি শুধু সংখ্যার নয়, গুণগতমানের ওপর নির্ভর করে।

[লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন]

বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য বয়সবৈষম্য দূর করুন

আসন্ন বোরো উৎপাদন ও কিছু শঙ্কা

ছবি

আইন পেশার জানা-অজানা কথা

ছবি

ব্যাংক খাতের সংকট

একাকিত্ব ও মানসিক অশান্তি

বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজ

ব্রি: কিছু প্রশ্ন, কিছু উত্তর

ক্রেতা ঠকে গেলে তার আইনগত প্রতিকার

ঢাকার যানজট : কিছু প্রস্তাব

রম্যগদ্য : দারিদ্র্য যাবে জাদুঘরে

গার্মেন্টস খাতে সংকট

সরকারি হাসপাতালের টয়লেট ব্যবস্থাপনায় করুণ দশা

ডেঙ্গু থেকে বাঁচার উপায় কী

শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার বাড়াতে

বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির দুর্বলতা

ইরানের কেন কৌশলগত পরিবর্তন

শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন একে অন্যের পরিপূরক

রামু ট্র্যাজেডির এক যুগ

প্রত্যাশিত শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাবিত রূপরেখা

ব্যাংক খাতের সংস্কার

শিক্ষার একটি স্থায়ী কমিশন সময়ের দাবি

ছবি

ক্ষমতা এখন ‘মব’-এর হাতে

উচ্চ ফলনশীল বারি মসুর-৮

শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে বামপন্থির উত্থান

আমন ধানে আগাম ফুল আসার কারণ

উচ্চ ফলনশীল বারি মসুর-৮

কী হবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনীতি

রম্যগদ্য : ‘বল করে দুর্বল...’

মধ্যপ্রাচ্যে প্রযুক্তিগত যুদ্ধ

বন্যাপরবর্তী কৃষি উৎপাদনে সময়োপযোগী সহায়তা প্রদান

বিশেষ শিশু ও বিশেষ শিক্ষালয়

বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস

সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার অধিকার

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি

প্রসঙ্গ : আনসার বাহিনী

শান্তির সংস্কৃতি : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

গুণগত উন্নয়নই সমাজের প্রকৃত উন্নতির চাবিকাঠি

রহমান মৃধা

বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন যেন এক ধরনের অসীম ব্যস্ততার জালে আবদ্ধ। কাজের পরিমাণ বাড়াতে গিয়ে আমরা প্রায়ই ভুলে যাই গুণগতমানের দিকে নজর দিতে। শিক্ষা খাত থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কাজ, রাজনীতি কিংবা ব্যক্তিগত জীবনের ছোটখাটো সিদ্ধান্ত- সবখানেই যেন ‘ভলিউম’ বাড়ানোর চেষ্টা, অথচ ‘কোয়ালিটি’ বাড়ানোর কোনো প্রচেষ্টা নেই। এটাই আমাদের জীবনের এক অন্যতম বড় সমস্যা।

আমরা প্রতিদিনের জীবনযাপনে কাজের পরিমাণ বাড়াতে ব্যস্ত, কিন্তু সেই কাজের গুণগতমান কতটা উন্নত হচ্ছে, সেটা নিয়ে কি আমরা ভাবি? শিক্ষা, রাজনীতি বা ব্যক্তিগত জীবন- সবক্ষেত্রেই ভলিউম বাড়ানোর প্রচেষ্টার বদলে গুণগত উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন।

শিক্ষা খাত : মানহীন শিক্ষার দুষ্টচক্র

শিক্ষার ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো আমরা হরহামেশাই দেখতে পাই। আমাদের দেশে শিক্ষার্থীরা সারাদিন বইয়ের পাতা ওল্টাতে থাকে, ক্লাস, কোচিং, প্রাইভেটÑ এসব নিয়ে দিনের পর দিন ব্যস্ত থাকে; কিন্তু তারা আসলে কতটুকু শিখছে? মুখস্থবিদ্যা বা ‘রট লার্নিং’-এর ফাঁদে পড়ে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলোর সমাধান করতে সক্ষম হচ্ছে না।

এই শিক্ষা পদ্ধতির কারণেই অনেকে সৃজনশীল চিন্তাধারার বিকাশ ঘটাতে পারে না। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশে পাবলিক পরীক্ষার সিলেবাসের চাপ এবং প্রতিযোগিতামূলক ফলাফল ব্যবস্থা বলা যায়।

শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা কী শিখছি, আর কেন শিখছি, সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। আজকের শিক্ষাব্যবস্থা কি প্রকৃতপক্ষে আমাদের জ্ঞানী করছে, নাকি মুখস্থবিদ্যার মাধ্যমে শুধুই পরীক্ষার খাতায় ভালো নম্বর তুলে দিচ্ছে? শিক্ষার্থীরা অধিকাংশ সময় পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতে গিয়ে বইয়ের পৃষ্ঠা মুখস্থ করে, কিন্তু যখন সেই জ্ঞান বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে হয়, তখন অসহায় হয়ে পড়ে।

প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো সিলেক্টিভভাবে শিখুন এবং গুগল বা অন্যান্য প্রযুক্তির সাহায্যে বাকি তথ্য সংগ্রহ করুনÑ এটাই হতে পারে আধুনিক শিক্ষার উপায়। শিক্ষা মানে শুধু পড়াশোনা নয়, বরং শেখার পদ্ধতি জানা এবং ম্যানেজ করা।

রাজনৈতিক দুর্নীতি : ক্ষমতার অপব্যবহার

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুর্নীতির প্রভাব যেন আরেকটি বিষফোঁড়া। প্রতিনিয়ত আমরা শুনি, ক্ষমতাসীন কোনো নেতা যখন ক্ষমতা থেকে সরে যায়, তখন তার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের করা হয়। আবার যখন সেই নেতা ক্ষমতায় ফিরে আসে, তখন সব মামলা বাতিল হয়। এর উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, বিগত সময়ে ক্ষমতায় থাকা বিভিন্ন নেতার বিরুদ্ধে দায়ের করা শত শত মামলার কাহিনী।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল ঘটলেই কেন শত শত মামলা জমা পড়ে? অপরাধের বিচার কি শুধু ক্ষমতার বাইরে থাকলেই হয়, নাকি ন্যায়বিচার সবসময়ই প্রাপ্য হওয়া উচিত?

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন একটি মামলাই যথেষ্ট নয়? কেন আমাদের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া এত জটিল এবং সময়সাপেক্ষ? যদি সঠিকভাবে বিচারব্যবস্থা পরিচালিত হতো, তবে একটি মামলাই যথেষ্ট হতো ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় যদি অপরাধ করা হয়, তখনই বিচার হওয়া উচিত। অন্যথায় ক্ষমতা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মামলা দায়েরের সংস্কৃতি শুধু ভলিউম বাড়ায়, আর রাষ্ট্রের অর্থ, সময়, এবং সম্পদের অপচয় হয়।

ব্যক্তিগত জীবন : অপচয় বন্ধ করুন, সুষ্ঠু পরিকল্পনা করুন

আমাদের ব্যক্তিগত জীবনেও আমরা একই ভুল করি। ক্রেডিট কার্ড, নগদ টাকা, ক্রমাগত কেনাকাটাÑ এসবের মধ্যে আমরা প্রায়শই অহেতুক জটিলতা তৈরি করি। উদাহরণ হিসেবে- কেন আপনাকে বারবার নতুন পোশাক কিনতে হবে? একবার পরে যদি তা আর ব্যবহার না করেন, তবে সেটা কেনার বদলে ভাড়া নিতে পারেন।

ব্যক্তিগত জীবনেও আমরা অহেতুক খরচের বোঝা বাড়াই। যেটা ভাড়া নিয়ে ব্যবহার করা সম্ভব, সেটা কেনার দরকার কি? পরিকল্পিত জীবনযাপন শুধু আপনার খরচই কমাবে না, মানসিক চাপও হ্রাস করবে।

বিশ্বের অনেক দেশেই এখন মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য ভাড়া করে ব্যবহার করছে, তারপর তা অন্যদের ব্যবহারের জন্য ফেরত দিচ্ছে। এই ধরনের পদ্ধতি শুধু আপনার ব্যক্তিগত অর্থ সাশ্রয় করে না, বরং সামগ্রিকভাবে সামাজিক সম্পদের ব্যবহারেও একটি ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। আমাদের প্রতিদিনের জীবনেও এই ধরনের পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেয়া উচিত। এমনটা সম্ভব না? সম্ভব করার জন্যই কাজ করতে হবে।

রাজনৈতিক নির্দেশনা ও প্রশাসনিক পচন : শেখ হাসিনার শাসনামল

শেখ হাসিনার শাসনামলে ঘটে যাওয়া বহু ঘটনা সরাসরি তার নির্দেশনার ফলাফল হিসেবে দেখা যায়। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, শত শত শিক্ষার্থীর হত্যাকা-ের জন্য দায় কার? কোনো নির্দিষ্ট নির্দেশনার ভিত্তিতে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে কিনা, তা নিয়েও জনমনে প্রশ্ন ওঠে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য একটিমাত্র মামলাই যথেষ্ট, যদি তা সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়। অথচ অহেতুক শত শত মামলা দায়ের করে রাষ্ট্রের সম্পদ ও সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছু হয় না। এ ধরনের বিচারিক প্রক্রিয়া প্রশাসনের পচনকে আরও গভীর করে এবং জনগণের আস্থাকে ভেঙে দেয়। প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচার যদি নিশ্চিত করা যেত, তবে এমন অবস্থা এড়ানো সম্ভব হতো।

বিচারব্যবস্থা ও প্রশাসন : ঘুষের ফাঁদ থেকে মুক্তি

বিচার ব্যবস্থার ধীরগতি এবং প্রশাসনের দুর্নীতিও আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি। প্রশাসনিক কাজগুলোতে এখন এত বেশি ঘুষ লেনদেন চলছে যে, কাজ না করার জন্য সময়ের অভাবের অজুহাত দেয়া হচ্ছে, কিন্তু ঘুষ দিলে কাজ হচ্ছে। একটা ফাইল দিনের পর দিন পড়ে থাকে, যতক্ষণ না ঘুষের অর্থ হাতে আসে।

দুর্নীতি ও ঘুষ শুধুমাত্র বিচারপ্রক্রিয়াকেই ধীরগতির করে না, বরং সাধারণ মানুষকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। কিভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব, সেটাই এখন সময়ের দাবি।

এ ধরনের পরিস্থিতিতে দেশের সাধারণ মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সাধারণ মানুষ একটি জমির মালিকানা পেতে বা কোনো প্রশাসনিক সেবা পেতে প্রশাসনের কাছে গেলে ঘুষ দিতে বাধ্য হয়। আর যারা ঘুষ দিতে পারে না, তাদের কাজ আটকে থাকে। এটা শুধু ‘পচা বাংলাদেশ’-এর চিত্র। এমন একটা বাংলাদেশ যা মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের চেতনার সঙ্গে মিলে না।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা : দায়িত্ব ও ন্যায়বিচারের প্রয়োজন

আমরা আমাদের দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের দামে স্বাধীনতা পেয়েছি। এই দেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হওয়া উচিত সেই স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষা করা। দুর্নীতি, অন্যায় এবং নৈতিক অবক্ষয়কে প্রশ্রয় দিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। তাই জাতি হিসেবে আমাদের উচিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং প্রতিটি স্তরে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।

স্বাধীনতার আদর্শকে ধরে রাখতে হলে আমাদের নিজেদের দায়িত্বের কথা ভুললে চলবে না। মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেই চেতনায় দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতেই হবে।

মুক্তিযুদ্ধের যে আদর্শ নিয়ে আমরা লড়াই করেছিলাম, সেই আদর্শ এখনও আমাদের পথপ্রদর্শক হতে পারে। আমাদের বিচারব্যবস্থা এবং প্রশাসনকেও সেই আদর্শ মেনে চলতে হবে। একটি দেশ শুধুমাত্র তখনই প্রকৃতভাবে এগিয়ে যেতে পারে, যখন তার বিচারব্যবস্থা সঠিক এবং তার প্রশাসন দুর্নীতিমুক্ত থাকে।

পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা

আমাদের প্রতিটি খাতে এবং জীবনের প্রতিটি স্তরে ‘ভলিউম’ বাড়ানোর চেষ্টা না করে ‘কোয়ালিটি’ বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। দুর্নীতি, ঘুষ এবং অযৌক্তিক অপচয় বন্ধ করতে হবে। শিক্ষায় মানসম্পন্ন জ্ঞানচর্চা, বিচারব্যবস্থায় ন্যায়বিচার এবং প্রশাসনে স্বচ্ছতাÑ এসব যদি নিশ্চিত করতে পারি, তবে আমাদের দেশ সত্যিকার অর্থে উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে।

আমাদের প্রতিটি স্তরে গুণগতমান বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। শিক্ষা, প্রশাসন, বিচারÑ সবখানেই কোয়ালিটি বাড়াতে পারলে আমরা একটা উন্নত ও সুশৃঙ্খল সমাজ গড়ে তুলতে পারবো।

এটাই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্যÑ আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং জাতীয় জীবনে গুণগতমান বৃদ্ধির জন্য সচেতন প্রচেষ্টা চালানো। কারণ জাতির উন্নতি শুধু সংখ্যার নয়, গুণগতমানের ওপর নির্ভর করে।

[লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন]

back to top