alt

উপ-সম্পাদকীয়

শিক্ষার একটি স্থায়ী কমিশন সময়ের দাবি

মাহরুফ চৌধুরী

: রোববার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

গত ৮ সেপ্টেম্বর তারিখে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে তার দ্বিতীয় ভাষণে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে ৬টি সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। আমরা খুবই অবাক হয়েছি যে, শিক্ষার মতো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাতকে এ ঘোষণায় উপেক্ষা করা হয়েছে। অথচ রাষ্ট্রব্যবস্থা ও কাঠামোর রূপান্তরের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে শিক্ষা খাতকে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা ছিল। একদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একটি স্থায়ী শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠনের মাধ্যমেই কেবল দেশের শিক্ষাখাতের নানা চ্যালেঞ্জ ও সমস্যাগুলো অতিক্রম করে ধ্বংসপ্রায় শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা সম্ভব। অপরদিকে সামাজিক আবর্তন, বিবর্তন ও পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্রসংস্কারের মূল নিয়ামক হলো শিক্ষা। তাই শিক্ষার বিনির্মাণ ছাড়া রাষ্ট্রসংস্কারের জন্যে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতি রূপান্তর অসম্ভব। যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থার পতন ঘটেছে, সেই শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ন্যায়সঙ্গত অধিকার নিশ্চিত করা ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্যে সরকারের উচিত ছিল প্রথম ধাপেই ঘোষিত কমিশনগুলোর সঙ্গে শিক্ষার জন্যেও একটি স্থায়ী কমিশন গঠন করার ঘোষণা দেয়া। কোন কারণে সেটা করা হয়নি তা আমাদের বোধগম্য নয়; বর্তমান সরকারের নীতি নির্ধারকরাই ভালো জানেন।

সরকার ইতোমধ্যে অধিকাংশ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগসহ অন্যান্য শূন্য পদে যোগ্যদের নিয়ে আসা অব্যাহত রেখেছে। অধঃপতনের ধারাবাহিকতায় নানা অন্যায়, অনাচার আর অবিচারে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা প্রায় ধ্বংসের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে। এ বিষয়ে কারো সন্দেহ আছে বলে মনে হয় না। এই রুগ্ন শিক্ষাব্যবস্থাকে সুস্থ করে তুলতে শিক্ষার জন্যে একটি স্থায়ী কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য এবং নানা মহল থেকে দ্রুত একটি শিক্ষা কমিশন গঠনের জন্যে জোরালো দাবিও ওঠেছে। এই কাক্সিক্ষত কমিশনটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন, শিক্ষার মানোন্নয়ন, এবং শিক্ষাব্যবস্থায় সমতায় স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। নানা ধাপে বিভিন্ন মেয়াদি সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ এবং উদারপন্থি মনোভাব ও বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে এই কমিশন শিক্ষার্থীদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে কাজ করে যাবে। শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি স্থায়ী কমিশন কেবল শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নই করবে না, বরং শিক্ষাখাতে নীতিমালা নির্ধারণ ও প্রয়োগেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা-গবেষণার দিকনির্দেশনা প্রদানসহ নানা বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। এই নিবন্ধে আমরা আলোচনা করব কেন শিক্ষার জন্যে একটি স্থায়ী কমিশন গঠন অপরিহার্য এবং এটি কীভাবে শিক্ষাব্যবস্থার স্থায়িত্ব ও অগ্রগতি নিশ্চিত করতে পারে।

বাংলাদেশে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষাপরিকল্পনা

গ্রহণ এবং কার্যকর শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও তা দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন। সেজন্যে একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পয়েছে। এই স্থায়ী কমিশনটি মূলত শিক্ষাক্ষেত্রে অব্যাহত গবেষণা, পরিকল্পনা এবং নীতিনির্ধারণে কাজ করবে। এর মাধ্যমে শিক্ষার নানাদিক পর্যবেক্ষণ এবং শিক্ষা খাতে দিক-নির্দেশনায় সমন্বয় সাধন করা সম্ভব হবে। শিক্ষার ব্যবস্থাপনায় গতিশীলতা আনয়নে এবং শিক্ষার মানোন্নয়নে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কিছু অন্তর্র্বর্তীকালীন সিদ্ধান্তসহ স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে একটি স্থায়ী কমিশন গঠন অপরিহার্য। এই ধরনের একটি শিক্ষা কমিশন একদিক যেমন শিক্ষার ক্ষেত্রে নানা রকমের সমস্যার সমাধানে অর্থবহ দিকনির্দেশনা দেবে এবং অপরদিকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে একটি টেকসই ও ক্রম-উন্নয়নশীল জীবনমুখী যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তবে এই কমিশন গঠনের সময় এর কার্যকারিতা ও সদস্য নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে যাতে এটি সব ধরনের রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকতে পারে। তাছাড়া এই কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগ্য শিক্ষার নানা বিষয়ে বিশেষজ্ঞদেরকেই নিয়োগ দিতে হবে যাতে শিক্ষা খাতের কাক্সিক্ষত উন্নয়নে তারা সার্বিক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। কেবল শিক্ষা খাতের একটি স্থায়ী কমিশনই স্বতন্ত্রভাবে গবেষণার ভিত্তিতে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে দেশের সার্বিক কল্যাণে উপযোগী নীতিমালা নির্ধারণ করতে পারে। এটি এমনভাবে গঠন করতে হবে যাতে রাজনৈতিক চাপের বাইরে থেকে স্বাধীনভাবে এটি দীর্ঘমেয়াদি, বাস্তবসম্মত এবং যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন করতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশের শিক্ষা খাতের বিভিন্ন স্তরে সংখ্যাগত তথা পরিমাণগত কিছু উন্নতি সাধিত হলেও এখনো শিক্ষার গুণগতমান উন্নয়নে অনেক সমস্যা বিদ্যমান। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হলো, যেগুলো হবে প্রস্তাবিত স্থায়ী শিক্ষা কমিশনের কর্মপরিধির আওতাধীন। ১. পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জীবনমুখী যুগোপযোগী শিক্ষানীতি নির্ধারণ ও জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে সেই শিক্ষানীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে উদ্ভূত অসঙ্গতিগুলো দূর করা। অতীতে বাংলাদেশের শিক্ষানীতির পরিবর্তন ঘটেছে প্রায়ই রাজনৈতিক কারণে, যার ফলে শিক্ষার দীর্ঘমেয়াদি ও ধারাবাহিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, উন্নয়ন একটি অব্যাহত প্রক্রিয়া। ধারাবাহিকতা রক্ষা না করা গেলে উন্নয়ন টেকসই হবে না। আর বারবার নীতিমালা পরিবর্তনের ফলে অর্থ, সময় ও শ্রমের যেমন অপচয় হয়, তেমনি তার প্রভাব পড়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের উপরেও। অতীতে জাতীয় স্বার্থে অদূরদর্শী অবিবেচনাপ্রসূত, অথচ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রনোদিত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থসিদ্ধির জন্যে গৃহীত নীতিমালার জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা হয়ে পড়েছে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার গিনিপিগ। বর্তমান অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের শিক্ষাসংস্কারের কৌশলে এমন অবস্থা থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে হবে। ২. শিক্ষার অব্যাহত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করা। শিক্ষার জন্যে কাক্সিক্ষত এই স্থায়ী কমিশনের মূল উদ্দেশ্য হবে শিক্ষা খাতের অব্যাহত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা। একটি স্থায়ী কমিশন গঠনের ফলে শিক্ষার নানাক্ষেত্রে ধাপে ধাপে পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে, যা তাৎক্ষণিক সমস্যাগুলো সমাধানের পাশাপাশি ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। শিক্ষার দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রথমত, প্রাথমিক শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করা জরুরি। প্রাথমিক শিক্ষা হলো আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মূলভিত্তি। এই স্তরে শিক্ষার মানোন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করা হলে ভবিষ্যতের জন্যে প্রস্তুত একটি শক্তিশালী প্রজন্ম গড়ে তোলা সম্ভব হবে। দ্বিতীয়ত, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিস্তার ও মানোন্নয়ন অত্যাবশ্যক। বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশকে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে। সেজন্যে দেশের মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্থায়ী কমিশনের মাধ্যমে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার উন্নয়নে পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরি। তৃতীয়ত, সবার জন্য জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি ও ডিজিটাল শিক্ষার বিস্তার করা আবশ্যক। বর্তমান যুগে প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন অসম্ভব। একুশ শতকে প্রযুক্তি নির্ভর জীবন ও জীবিকার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে প্রস্তাবিত স্থায়ী শিক্ষা কমিশন ডিজিটাল শিক্ষার প্রচার ও

প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ৩. শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়ন ও শিক্ষার নানাক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা। শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করতে শিক্ষাব্যবস্থার নানাক্ষেত্রে নিয়মিত মূল্যায়নের প্রয়োজন। স্থায়ী কমিশন এই মূল্যায়নের দায়িত্ব পালন করতে পারে, যেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা, শিক্ষকদের দক্ষতা এবং শিক্ষার্থীদের ফলাফল পর্যবেক্ষণ করা হবে। আর বিভিন্ন শিক্ষাধারার (যেমন- সাধারণ শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা, বিদেশি শিক্ষাক্রমে শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা প্রভৃতি) মাঝে বিদ্যমান বৈষম্যগুলো দূর করতে প্রয়োজনীয় নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় নানা কারণে মানসম্পন্ন শিক্ষার অভাব ও শিক্ষার মানের বৈষম্য প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে গ্রাম ও শহরের শিক্ষার মানের মধ্যে বিশাল ব্যবধান রয়েছে। গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা প্রায়শই মানসম্পন্ন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। মানসম্মত শিক্ষার অধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে জাতীয় প্রয়োজনে মানের সমতার প্রতিষ্ঠা জরুরি হয়ে ওঠেছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে শহর ও গ্রামের ব্যবধান ঘোচাতে প্রয়োজন শিক্ষার সুযোগ-সুবিধার সমতা বিধান করা অত্যাবশ্যক। শিক্ষা কমিশন বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে এবং সেগুলোর বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনে নতুন নীতিমালা তৈরি অব্যাহত রাখবে। ৪. শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও অব্যাহত পেশাগত মানোন্নয়নের জন্যে সুযোগ সৃষ্টি করা। একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রাণ ভোমরা হলো সেদেশের শিক্ষক সমাজ। তাই শিক্ষকদের উন্নয়ন ও সন্তুষ্টি সাধন না করে কোন দেশের শিক্ষার মানোন্নয়ন অসম্ভব। শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়নে ভবিষ্যতে যারা শিক্ষক হতে চান, তাদেরকে প্রস্তুত করতে হবে। আর যারা শিক্ষক হয়েছেন কিন্তু শিক্ষক হিসেবে কাজ করার শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই কিংবা পেশাগত উৎকর্ষের প্রশিক্ষণ নেই, তাদের জন্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। শিক্ষকতা পেশায় যোগদানের পরেও অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকেরা পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ বা অব্যাহত পেশাগত উন্নয়নের সুযোগ পান না, যা শিক্ষার গুণগতমানকে নেতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলে। তাই শিক্ষার গুণগতমান উন্নয়নে শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও শিক্ষকদের অব্যাহত পেশাগত উন্নয়নের নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্যে শিক্ষা কমিশন কাজ করে যাবে। ৫. শিক্ষার নানাক্ষেত্রে অব্যাহত গবেষণা ও উদ্ভাবনার সুযোগ নিশ্চিত করা। শিক্ষা ও উন্নয়ন অনেকাংশে গবেষণা ও নিত্য-নতুন উদ্ভাবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই গবেষণা ব্যতীত শিক্ষার উন্নয়ন অকল্পনীয়। একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন শিক্ষা খাতে গবেষণা ও উদ্ভাবনের দিক-নির্দেশক হিসেবে কাজ করতে পারে। এটি একদিকে শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন নতুন পদ্ধতি ও প্রযুক্তির ব্যবহারকে উৎসাহিত করবে, যা শিক্ষার্থীদের নতুন জ্ঞানের জগতে প্রবেশ করতে সাহায্য করবে। অপরদিকে শিখন-শেখানোর প্রক্রিয়ায় অধিক ফলপ্রসূ কার্যপন্থা উদ্ভাবন ও প্রয়োগকে উৎসাহিত করবে। শিক্ষা খাতে একটি স্থায়ী কমিশন গঠিত হলে নানান সমস্যার যেমন দ্রুত ও গ্রহণযোগ্য সমাধান করা যাবে, তেমনি রাষ্ট্রীয় দর্শন, উদ্দেশ্য ও আদর্শের উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’কে অঙ্গীকার করে একটি কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। তাছাড়া নানা সমস্যার, বিশেষ করে শিক্ষার অর্থায়ন সমস্যা, শিক্ষার মানের অসমতা এবং শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মানসিক স্বাস্থ্যসহ নানা সমস্যা সমাধানের পন্থা বের করা। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করা প্রায়ই চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে। একটি স্থায়ী কমিশন শিক্ষার বাজেট ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা করতে পারে এবং অর্থায়নের সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করতে পারে। কমিশন অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করতে পারবে, যা শিক্ষার মান সমানভাবে উন্নত করতে সহায়ক হবে। বর্তমান সমাজে শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বড় একটি বিষয়। স্থায়ী কমিশন এই সমস্যা সমাধানে নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে এবং শিক্ষার্থীদের জন্যে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা কেন্দ্র গড়ে তুলতে সহায়তা করতে পারে। যদিও স্থায়ী কমিশন গঠন করার অনেক সুবিধা রয়েছে, বর্তমানে এমন একটি কমিশন গঠনে কিছু সমস্যাও তৈরি হতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সম্ভাব্য সমস্যাগুলো হলো মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও অর্থায়ন সমস্যা। শিক্ষাক্ষেত্রে একটি স্থায়ী কমিশনের কার্যাবলী সম্পর্কে জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। যদি মানুষ কমিশনের কার্যকারিতা সম্পর্কে অবগত না হয়, তবে এর সঠিক প্রয়োগ সম্ভব হবে না। যদি এ কমিশন স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে না পারে, তবে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের আশঙ্কা সবসময় থেকেই যায়। সঠিকভাবে কমিশনকে কার্যকর করতে হলে এটি সম্পূর্ণ স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ হতে হবে এবং রাষ্ট্র ও জনগণের কাছে এর পেশাগত ও নৈতিক দায়বদ্ধতা থাকতে হবে। স্থায়ী কমিশন পরিচালনার জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত অর্থায়ন। এই অর্থায়ন সংগ্রহ করা এবং সঠিকভাবে ব্যবহার করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। আমরা আশা করছি, সার্বিক বিবেচনায় নতুন বাংলাদেশের জন্যে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে তার অধীনে দ্রুত একটি নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন এবং তার আলোকে নতুন শিক্ষাক্রম উন্নয়ন করে একটি বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথকে সুগম করবে।

[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]

বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য বয়সবৈষম্য দূর করুন

আসন্ন বোরো উৎপাদন ও কিছু শঙ্কা

ছবি

আইন পেশার জানা-অজানা কথা

ছবি

ব্যাংক খাতের সংকট

একাকিত্ব ও মানসিক অশান্তি

বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজ

ব্রি: কিছু প্রশ্ন, কিছু উত্তর

ক্রেতা ঠকে গেলে তার আইনগত প্রতিকার

ঢাকার যানজট : কিছু প্রস্তাব

রম্যগদ্য : দারিদ্র্য যাবে জাদুঘরে

গার্মেন্টস খাতে সংকট

সরকারি হাসপাতালের টয়লেট ব্যবস্থাপনায় করুণ দশা

ডেঙ্গু থেকে বাঁচার উপায় কী

শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার বাড়াতে

বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির দুর্বলতা

ইরানের কেন কৌশলগত পরিবর্তন

শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন একে অন্যের পরিপূরক

রামু ট্র্যাজেডির এক যুগ

প্রত্যাশিত শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাবিত রূপরেখা

ব্যাংক খাতের সংস্কার

ছবি

ক্ষমতা এখন ‘মব’-এর হাতে

উচ্চ ফলনশীল বারি মসুর-৮

শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে বামপন্থির উত্থান

আমন ধানে আগাম ফুল আসার কারণ

উচ্চ ফলনশীল বারি মসুর-৮

কী হবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনীতি

রম্যগদ্য : ‘বল করে দুর্বল...’

মধ্যপ্রাচ্যে প্রযুক্তিগত যুদ্ধ

বন্যাপরবর্তী কৃষি উৎপাদনে সময়োপযোগী সহায়তা প্রদান

গুণগত উন্নয়নই সমাজের প্রকৃত উন্নতির চাবিকাঠি

বিশেষ শিশু ও বিশেষ শিক্ষালয়

বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস

সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার অধিকার

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি

প্রসঙ্গ : আনসার বাহিনী

শান্তির সংস্কৃতি : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

শিক্ষার একটি স্থায়ী কমিশন সময়ের দাবি

মাহরুফ চৌধুরী

রোববার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

গত ৮ সেপ্টেম্বর তারিখে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে তার দ্বিতীয় ভাষণে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে ৬টি সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। আমরা খুবই অবাক হয়েছি যে, শিক্ষার মতো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাতকে এ ঘোষণায় উপেক্ষা করা হয়েছে। অথচ রাষ্ট্রব্যবস্থা ও কাঠামোর রূপান্তরের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে শিক্ষা খাতকে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা ছিল। একদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একটি স্থায়ী শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠনের মাধ্যমেই কেবল দেশের শিক্ষাখাতের নানা চ্যালেঞ্জ ও সমস্যাগুলো অতিক্রম করে ধ্বংসপ্রায় শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা সম্ভব। অপরদিকে সামাজিক আবর্তন, বিবর্তন ও পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্রসংস্কারের মূল নিয়ামক হলো শিক্ষা। তাই শিক্ষার বিনির্মাণ ছাড়া রাষ্ট্রসংস্কারের জন্যে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতি রূপান্তর অসম্ভব। যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থার পতন ঘটেছে, সেই শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ন্যায়সঙ্গত অধিকার নিশ্চিত করা ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্যে সরকারের উচিত ছিল প্রথম ধাপেই ঘোষিত কমিশনগুলোর সঙ্গে শিক্ষার জন্যেও একটি স্থায়ী কমিশন গঠন করার ঘোষণা দেয়া। কোন কারণে সেটা করা হয়নি তা আমাদের বোধগম্য নয়; বর্তমান সরকারের নীতি নির্ধারকরাই ভালো জানেন।

সরকার ইতোমধ্যে অধিকাংশ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগসহ অন্যান্য শূন্য পদে যোগ্যদের নিয়ে আসা অব্যাহত রেখেছে। অধঃপতনের ধারাবাহিকতায় নানা অন্যায়, অনাচার আর অবিচারে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা প্রায় ধ্বংসের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে। এ বিষয়ে কারো সন্দেহ আছে বলে মনে হয় না। এই রুগ্ন শিক্ষাব্যবস্থাকে সুস্থ করে তুলতে শিক্ষার জন্যে একটি স্থায়ী কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য এবং নানা মহল থেকে দ্রুত একটি শিক্ষা কমিশন গঠনের জন্যে জোরালো দাবিও ওঠেছে। এই কাক্সিক্ষত কমিশনটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন, শিক্ষার মানোন্নয়ন, এবং শিক্ষাব্যবস্থায় সমতায় স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। নানা ধাপে বিভিন্ন মেয়াদি সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ এবং উদারপন্থি মনোভাব ও বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে এই কমিশন শিক্ষার্থীদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে কাজ করে যাবে। শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি স্থায়ী কমিশন কেবল শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নই করবে না, বরং শিক্ষাখাতে নীতিমালা নির্ধারণ ও প্রয়োগেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা-গবেষণার দিকনির্দেশনা প্রদানসহ নানা বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। এই নিবন্ধে আমরা আলোচনা করব কেন শিক্ষার জন্যে একটি স্থায়ী কমিশন গঠন অপরিহার্য এবং এটি কীভাবে শিক্ষাব্যবস্থার স্থায়িত্ব ও অগ্রগতি নিশ্চিত করতে পারে।

বাংলাদেশে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষাপরিকল্পনা

গ্রহণ এবং কার্যকর শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও তা দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন। সেজন্যে একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পয়েছে। এই স্থায়ী কমিশনটি মূলত শিক্ষাক্ষেত্রে অব্যাহত গবেষণা, পরিকল্পনা এবং নীতিনির্ধারণে কাজ করবে। এর মাধ্যমে শিক্ষার নানাদিক পর্যবেক্ষণ এবং শিক্ষা খাতে দিক-নির্দেশনায় সমন্বয় সাধন করা সম্ভব হবে। শিক্ষার ব্যবস্থাপনায় গতিশীলতা আনয়নে এবং শিক্ষার মানোন্নয়নে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কিছু অন্তর্র্বর্তীকালীন সিদ্ধান্তসহ স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে একটি স্থায়ী কমিশন গঠন অপরিহার্য। এই ধরনের একটি শিক্ষা কমিশন একদিক যেমন শিক্ষার ক্ষেত্রে নানা রকমের সমস্যার সমাধানে অর্থবহ দিকনির্দেশনা দেবে এবং অপরদিকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে একটি টেকসই ও ক্রম-উন্নয়নশীল জীবনমুখী যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তবে এই কমিশন গঠনের সময় এর কার্যকারিতা ও সদস্য নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে যাতে এটি সব ধরনের রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকতে পারে। তাছাড়া এই কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগ্য শিক্ষার নানা বিষয়ে বিশেষজ্ঞদেরকেই নিয়োগ দিতে হবে যাতে শিক্ষা খাতের কাক্সিক্ষত উন্নয়নে তারা সার্বিক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। কেবল শিক্ষা খাতের একটি স্থায়ী কমিশনই স্বতন্ত্রভাবে গবেষণার ভিত্তিতে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে দেশের সার্বিক কল্যাণে উপযোগী নীতিমালা নির্ধারণ করতে পারে। এটি এমনভাবে গঠন করতে হবে যাতে রাজনৈতিক চাপের বাইরে থেকে স্বাধীনভাবে এটি দীর্ঘমেয়াদি, বাস্তবসম্মত এবং যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন করতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশের শিক্ষা খাতের বিভিন্ন স্তরে সংখ্যাগত তথা পরিমাণগত কিছু উন্নতি সাধিত হলেও এখনো শিক্ষার গুণগতমান উন্নয়নে অনেক সমস্যা বিদ্যমান। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হলো, যেগুলো হবে প্রস্তাবিত স্থায়ী শিক্ষা কমিশনের কর্মপরিধির আওতাধীন। ১. পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জীবনমুখী যুগোপযোগী শিক্ষানীতি নির্ধারণ ও জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে সেই শিক্ষানীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে উদ্ভূত অসঙ্গতিগুলো দূর করা। অতীতে বাংলাদেশের শিক্ষানীতির পরিবর্তন ঘটেছে প্রায়ই রাজনৈতিক কারণে, যার ফলে শিক্ষার দীর্ঘমেয়াদি ও ধারাবাহিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, উন্নয়ন একটি অব্যাহত প্রক্রিয়া। ধারাবাহিকতা রক্ষা না করা গেলে উন্নয়ন টেকসই হবে না। আর বারবার নীতিমালা পরিবর্তনের ফলে অর্থ, সময় ও শ্রমের যেমন অপচয় হয়, তেমনি তার প্রভাব পড়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের উপরেও। অতীতে জাতীয় স্বার্থে অদূরদর্শী অবিবেচনাপ্রসূত, অথচ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রনোদিত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থসিদ্ধির জন্যে গৃহীত নীতিমালার জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা হয়ে পড়েছে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার গিনিপিগ। বর্তমান অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের শিক্ষাসংস্কারের কৌশলে এমন অবস্থা থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে হবে। ২. শিক্ষার অব্যাহত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করা। শিক্ষার জন্যে কাক্সিক্ষত এই স্থায়ী কমিশনের মূল উদ্দেশ্য হবে শিক্ষা খাতের অব্যাহত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা। একটি স্থায়ী কমিশন গঠনের ফলে শিক্ষার নানাক্ষেত্রে ধাপে ধাপে পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে, যা তাৎক্ষণিক সমস্যাগুলো সমাধানের পাশাপাশি ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। শিক্ষার দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রথমত, প্রাথমিক শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করা জরুরি। প্রাথমিক শিক্ষা হলো আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মূলভিত্তি। এই স্তরে শিক্ষার মানোন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করা হলে ভবিষ্যতের জন্যে প্রস্তুত একটি শক্তিশালী প্রজন্ম গড়ে তোলা সম্ভব হবে। দ্বিতীয়ত, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিস্তার ও মানোন্নয়ন অত্যাবশ্যক। বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশকে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে। সেজন্যে দেশের মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্থায়ী কমিশনের মাধ্যমে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার উন্নয়নে পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরি। তৃতীয়ত, সবার জন্য জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি ও ডিজিটাল শিক্ষার বিস্তার করা আবশ্যক। বর্তমান যুগে প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন অসম্ভব। একুশ শতকে প্রযুক্তি নির্ভর জীবন ও জীবিকার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে প্রস্তাবিত স্থায়ী শিক্ষা কমিশন ডিজিটাল শিক্ষার প্রচার ও

প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ৩. শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়ন ও শিক্ষার নানাক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা। শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করতে শিক্ষাব্যবস্থার নানাক্ষেত্রে নিয়মিত মূল্যায়নের প্রয়োজন। স্থায়ী কমিশন এই মূল্যায়নের দায়িত্ব পালন করতে পারে, যেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা, শিক্ষকদের দক্ষতা এবং শিক্ষার্থীদের ফলাফল পর্যবেক্ষণ করা হবে। আর বিভিন্ন শিক্ষাধারার (যেমন- সাধারণ শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা, বিদেশি শিক্ষাক্রমে শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা প্রভৃতি) মাঝে বিদ্যমান বৈষম্যগুলো দূর করতে প্রয়োজনীয় নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় নানা কারণে মানসম্পন্ন শিক্ষার অভাব ও শিক্ষার মানের বৈষম্য প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে গ্রাম ও শহরের শিক্ষার মানের মধ্যে বিশাল ব্যবধান রয়েছে। গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা প্রায়শই মানসম্পন্ন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। মানসম্মত শিক্ষার অধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে জাতীয় প্রয়োজনে মানের সমতার প্রতিষ্ঠা জরুরি হয়ে ওঠেছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে শহর ও গ্রামের ব্যবধান ঘোচাতে প্রয়োজন শিক্ষার সুযোগ-সুবিধার সমতা বিধান করা অত্যাবশ্যক। শিক্ষা কমিশন বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে এবং সেগুলোর বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনে নতুন নীতিমালা তৈরি অব্যাহত রাখবে। ৪. শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও অব্যাহত পেশাগত মানোন্নয়নের জন্যে সুযোগ সৃষ্টি করা। একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রাণ ভোমরা হলো সেদেশের শিক্ষক সমাজ। তাই শিক্ষকদের উন্নয়ন ও সন্তুষ্টি সাধন না করে কোন দেশের শিক্ষার মানোন্নয়ন অসম্ভব। শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়নে ভবিষ্যতে যারা শিক্ষক হতে চান, তাদেরকে প্রস্তুত করতে হবে। আর যারা শিক্ষক হয়েছেন কিন্তু শিক্ষক হিসেবে কাজ করার শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই কিংবা পেশাগত উৎকর্ষের প্রশিক্ষণ নেই, তাদের জন্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। শিক্ষকতা পেশায় যোগদানের পরেও অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকেরা পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ বা অব্যাহত পেশাগত উন্নয়নের সুযোগ পান না, যা শিক্ষার গুণগতমানকে নেতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলে। তাই শিক্ষার গুণগতমান উন্নয়নে শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও শিক্ষকদের অব্যাহত পেশাগত উন্নয়নের নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্যে শিক্ষা কমিশন কাজ করে যাবে। ৫. শিক্ষার নানাক্ষেত্রে অব্যাহত গবেষণা ও উদ্ভাবনার সুযোগ নিশ্চিত করা। শিক্ষা ও উন্নয়ন অনেকাংশে গবেষণা ও নিত্য-নতুন উদ্ভাবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই গবেষণা ব্যতীত শিক্ষার উন্নয়ন অকল্পনীয়। একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন শিক্ষা খাতে গবেষণা ও উদ্ভাবনের দিক-নির্দেশক হিসেবে কাজ করতে পারে। এটি একদিকে শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন নতুন পদ্ধতি ও প্রযুক্তির ব্যবহারকে উৎসাহিত করবে, যা শিক্ষার্থীদের নতুন জ্ঞানের জগতে প্রবেশ করতে সাহায্য করবে। অপরদিকে শিখন-শেখানোর প্রক্রিয়ায় অধিক ফলপ্রসূ কার্যপন্থা উদ্ভাবন ও প্রয়োগকে উৎসাহিত করবে। শিক্ষা খাতে একটি স্থায়ী কমিশন গঠিত হলে নানান সমস্যার যেমন দ্রুত ও গ্রহণযোগ্য সমাধান করা যাবে, তেমনি রাষ্ট্রীয় দর্শন, উদ্দেশ্য ও আদর্শের উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’কে অঙ্গীকার করে একটি কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। তাছাড়া নানা সমস্যার, বিশেষ করে শিক্ষার অর্থায়ন সমস্যা, শিক্ষার মানের অসমতা এবং শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মানসিক স্বাস্থ্যসহ নানা সমস্যা সমাধানের পন্থা বের করা। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করা প্রায়ই চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে। একটি স্থায়ী কমিশন শিক্ষার বাজেট ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা করতে পারে এবং অর্থায়নের সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করতে পারে। কমিশন অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করতে পারবে, যা শিক্ষার মান সমানভাবে উন্নত করতে সহায়ক হবে। বর্তমান সমাজে শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বড় একটি বিষয়। স্থায়ী কমিশন এই সমস্যা সমাধানে নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে এবং শিক্ষার্থীদের জন্যে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা কেন্দ্র গড়ে তুলতে সহায়তা করতে পারে। যদিও স্থায়ী কমিশন গঠন করার অনেক সুবিধা রয়েছে, বর্তমানে এমন একটি কমিশন গঠনে কিছু সমস্যাও তৈরি হতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সম্ভাব্য সমস্যাগুলো হলো মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও অর্থায়ন সমস্যা। শিক্ষাক্ষেত্রে একটি স্থায়ী কমিশনের কার্যাবলী সম্পর্কে জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। যদি মানুষ কমিশনের কার্যকারিতা সম্পর্কে অবগত না হয়, তবে এর সঠিক প্রয়োগ সম্ভব হবে না। যদি এ কমিশন স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে না পারে, তবে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের আশঙ্কা সবসময় থেকেই যায়। সঠিকভাবে কমিশনকে কার্যকর করতে হলে এটি সম্পূর্ণ স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ হতে হবে এবং রাষ্ট্র ও জনগণের কাছে এর পেশাগত ও নৈতিক দায়বদ্ধতা থাকতে হবে। স্থায়ী কমিশন পরিচালনার জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত অর্থায়ন। এই অর্থায়ন সংগ্রহ করা এবং সঠিকভাবে ব্যবহার করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। আমরা আশা করছি, সার্বিক বিবেচনায় নতুন বাংলাদেশের জন্যে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে তার অধীনে দ্রুত একটি নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন এবং তার আলোকে নতুন শিক্ষাক্রম উন্নয়ন করে একটি বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথকে সুগম করবে।

[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]

back to top