alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

সরকারি হাসপাতালের টয়লেট ব্যবস্থাপনায় করুণ দশা

দিদারে আলম মুহসিন

: বৃহস্পতিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৪

আপনি কি কখনও দেশের কোন সরকারি হাসপাতালে রোগী হিসেবে গেছেন? আউটডোরে? কিংবা ইন-প্যাশেন্ট হিসেবে? নিদেনপক্ষে একজন ভিজিটর হিসেবে ওখানে যাবার অভিজ্ঞতা আপনার হয়ে থাকবে। একজন রোগী হিসেবে যদি আপনি কোন সরকারি হাসপাতালে জেনারেল বেডে ভর্তি হয়ে থাকেন কিংবা তার এটেনডেন্ট হিসেবে ওখানে অবস্থান করেন, তাহলে নিশ্চয়ই আপনাকে ওখানকার টয়লেটগুলো ব্যবহার করতে হয়েছে। এক্ষেত্রে, কিছু অপ্রত্যাশিত ব্যতিক্রম বাদ দিলে আপনার খুব কষ্টকর একটি অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে।

দেশের বিপুলসংখ্যক নিম্নআয়ের মানুষের চিকিৎসার জন্য শেষ আশ্রয় এই সরকারি হাসপাতালগুলো। বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোর বিপুল ব্যয়ের তুলনায় সরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা সেবা একরকম ফ্রি। থাকা-খাওয়ার জন্যেও আপনার তেমন কোন খরচ লাগছে না। তবে আপনাকে হয়তো হাসপাতাল যোগান দিতে না পারলে বাহির থেকে ওষুধ কেনা লাগতে পারে। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যেও চার্জ দিতে হতে পারে, তবে তা বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর তুলনায় অনেক কম। এছাড়া আপনি যদি দেশের কোন বড় হাসপাতালেইন-প্যাশেন্ট হিসেবে ভর্তি হয়ে থাকেন, তাহলে দেশের সেরা ডাক্তারদের সেবা পাচ্ছেন। তারা প্রতিদিন এক থেকে দুবার রাউন্ডে এসে আপনাকে দেখে যাবেন। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ওরাই কিংবা তাদের সমকক্ষ পর্যায়ের কেউ হয়তো আপনার চিকিৎসা প্রদান করতেন। তবে হ্যাঁ এটা ঠিক যে, বেসরকারি হাসপাতালসমূহের মতো আপনার নিজস্ব পছন্দের কোন চিকিৎসককে ওখানে আপনি চিকিৎসা দেয়ার জন্য পাবেন না।

এত কিছুর পরেও যদি না আপনি কোন কেবিন বরাদ্দ পেয়ে থাকেন, বরং একজন ইন-প্যাশেন্ট হিসেবে জেনারেল বেডে আপনার স্থান হয়, তাহলে ২৪ ঘণ্টা যেতে না যেতেই আপনার মনে হবে, কবে আল্লাহ এখান থেকে আপনাকে বের করে নিয়ে যাবেন। আপনার দেখাশোনার জন্য যদি কেউ সাথে থাকেন তারও একই অনুভূতি হবে। কিন্তু কেন? না চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট কোন অব্যবস্থাপনা বা ঘাটতির জন্যে নয়। ¯্রফে টয়লেটসমূহের করুণ অবস্থার জন্যে। আপনি টয়লেট ব্যবহার করতে গিয়ে হয়তো দেখবেন, দুর্গন্ধের জন্য ঢোকাই যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাবে, টয়লেট ব্যবহার করার পর যে ফ্লাশ করবেন সেই জো নেই। সেগুলো নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। কোথাও হয়তো দেখবেন, টয়লেটের ফ্লোরে নোংরা পানি জমে আছে। কোথাও বা পানির কলগুলো ঠিক মতো কাজ করছে না। টয়লেট টিস্যু বা হাত ধোয়ার জন্য সাবানের কোন ব্যবস্থা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে আপনি পেয়ে থাকলে আপনিনিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবতে পারেন। এই দুরবস্থা দেখে আপনার শঙ্কা হতে পারে, এখান থেকে আপনাকে নতুন কোন রোগ বাঁধিয়ে ফিরতে হয় কিনা।

বিষয়টিকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ দেখা গেছে, নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পাবলিক টয়লেট; যা অনেক লোক একসঙ্গে ব্যবহার করে থাকে, সেখান থেকে জন-জনান্তিকে নানাবিধ রোগ ছড়াতে পারে। পাবলিক টয়লেটের মাধ্যমে সচরাচর যেসব রোগ বা জীবাণু ছড়াতে পারে তার মধ্যে রয়েছেÑ ই-কোলাই, স্যালমোনেলা, নরোভাইরাস, এমআরএসএ, হেপাটাইটিস এ, ইনফ্লুয়েঞ্জা, এমনকি কমন কোল্ড। কিছু ক্ষেত্রে এসব রোগের কারণে আপনার তীব্র পেটব্যথা, জ্বর ও শারীরিক অবসাদ দেখা দিতে পারে। আবার কিছু ক্ষেত্রে গলা ও ত্বকের সমস্যা দেখা যায়। কখনও কখনও রোগের উপসর্গ সপ্তাহ খানেক স্থায়ী হতে পারে। কিছু বিরল ক্ষেত্রে এসব রোগের কোন কোনটির কারণেআপনারজীবন সংশয় হতে পারে। খুব গুরুতর নয় এমন ক্ষেত্রেও আক্রান্ত ব্যক্তি অফিস মিস করার মতো যথেষ্ট অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন।

সাধারণভাবে মনে করা হয়ে থাকে, বেশিরভাগ বাথরুমের জীবাণু টয়লেটের সিটে থাকে। কিন্তু বাস্তবতা হলোÑ টয়লেটের মেঝে ও অধিক স্পর্শ লাগে এমন পৃষ্ঠসমূহ যেমন ধরুন সিন্ক, কলের হাতল, হ্যান্ড ড্রয়ার, লাইটের সুইচ, দরজার নবÑ এসবে অনেক বেশি সংখ্যায় জীবাণুর উপস্থিতি থাকে। আমেরিকান সংবাদ মাধ্যম এবিসি নিউজের এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পাবলিক টয়লেটের মেঝেতে প্রতি ইঞ্চিতে প্রায় ২০ লক্ষ ব্যাকটেরিয়া থাকে। কাজেই আপনি যদি কোন কিছু স্পর্শ নাও করেন, আপনার জুতার তলায় করেও আপনি জীবাণু বহন করে নিয়ে যেতে পারেন। শুধু তাই নয়, মহিলাদের হ্যান্ডব্যাগ যদি টয়লেটের মেঝেতে বা সিনেকর কাউন্টারে রাখা হয়ে থাকে, তাহলে সেটার সাথেও জীবাণু বাহিত হতে পারে। এ কারণে আপনার সাথে থাকা জিনিসপত্র ঝুলিয়ে রাখার জন্য দরজায় বা দেয়ালে যে অন্তত একটি হুক থাকা দরকার সেটা কেন জানি অনেকের মাথায় আসতে চায় না।

এখন আপনি যদি টয়লেটের জীবাণু বহন করছে এমন কোন দূষিত বস্তু বা পৃষ্ঠ স্পর্শ করেন, পরে ঠিক মতো হাত না ধুয়ে ওই হাত ব্যবহার করে খাবার প্রস্তুত বা গ্রহণ করেন, তাহলে হাতে থাকা জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হতে পারেন। এ ধরনের খাবার অন্য কেউ গ্রহণ করলে তিনিও সংক্রমিত হতে পারেন। অপরিচ্ছন্ন টয়লেট ফ্লাশ করার সময় চারিদিকের বাতাসে ছড়িয়ে পড়া জলকণা নিঃশ্বাসের সাথে গ্রহণ করলেও আপনি তাতে থাকা জীবাণুতে সংক্রমিত হতে পারেন। কাজেই বুঝা যাচ্ছে, পাবলিক টয়লেট নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, এর মেঝে, দরজা ইত্যাদি নিয়মিত বিরতিতে জীবাণু মুক্ত করা এবং টয়লেটের বাতাস দূষণমুক্ত রাখা টয়লেট বাহিত রোগ-ব্যাধি ছড়িয়ে পড়া রোধ করার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাসপাতালের মতো জায়গায় এর গুরুত্ব সমধিক, কারণ এখানে নানা রকমের রোগ ব্যাধি নিয়ে অসংখ্য মানুষ এসে থাকেন।

দেশের সরকারি হাসপাতালসমূহের টয়লেট ব্যবস্থাপনার যে করুণ চিত্র আমরা উপরে তুলে ধরেছি তা থেকে বেরিয়ে আসা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা এই আলোচনা থেকে সহজেই অনুমেয়। টয়লেট ব্যবস্থাপনার করুণ দশার একটি কারণ হতে পারে, এসব হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার চেয়েও অনেক বেশি রোগী ভর্তি হয়ে থাকেন। হতে পারে টয়লেটসমূহ যতসংখ্যক লোক ব্যবহার করে তার তুলনায় ক্লিনিং স্টাফ সংখ্যায় অপ্রতুল। ঢিলেঢালা প্রশাসন এবং অপর্যাপ্ত নজরদারিও কারণ হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে। প্রশ্ন হলোÑ দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে যদি একটা ছিমছাম ও পরিচ্ছন্ন স্যানিটেশন সিস্টেম মেইনটেন করা যায়, তাহলে সরকারি হাসপাতালসমূহে করা যাবে না কেন?

দেশে যানবাহনের ব্যস্ত রুটসমূহ যেমন ধরুন- ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে বিপুলসংখ্যক যাত্রীর রিফ্রেশমেন্টের জন্য মাঝপথে যানবাহনসমূহ যাত্রাবিরতি করে থাকে। সেখানে এই বিপুলসংখ্যক যানবাহনে যাতায়াতকারী যাত্রীদের প্রায় সবাই বিরতিকালীন রেস্টুরেন্টের টয়লেট ফ্যাসিলিটিজ ব্যবহার করে থাকেন। আপনি কদাচিৎ দেখবেন, এগুলো ঠিকমতো পরিষ্কার করা হচ্ছে না। হজের সময় লক্ষ লক্ষ হাজি কাবা শরীফ ও মসজিদে নববীর টয়লেট ফ্যাসিলিটিজ ব্যবহার করে থাকেন। এগুলোর ক্লিনিংয়ের ক্ষেত্রে কোন রকম অব্যবস্থাপনার অভিযোগ আপনি কদাচিৎ পাবেন। তাহলে আমাদের দেশের সরকারি হাসপাতালসমূহের টয়লেট ফ্যাসিলিটিজ- যেগুলো বড় জোর দৈনিক কয়েকশ’ থেকে কয়েক হাজার লোক ব্যবহার করে থাকেন- যথাযথভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এত কঠিন হবে কেন? ক্লিনারদের সংখ্যা অপ্রতুল হলে তাদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। স্থায়ীভাবে ক্লিনারদের সংখ্যা বাড়ানো না গেলে প্রয়োজনে খ-কালীন ক্লিনার নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। এটার জন্য বাজেট সংকট হবার কথা নয়। আর যদি হয়েও থাকে, উন্নত স্যানিটেশন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে রোগীরা আলাদা চার্জ জোগাতে সানন্দে রাজি হবেন বলে আমার বিশ্বাস। শুধু জরাজীর্ণ টয়লেট ব্যবস্থাপনার কারণে দেশের সরকারি হাসপাতালসমূহ উন্নত চিকিৎসা সেবা দিয়েও যে মারাত্মক ইমেজ সংকটে আছে সে বিষয়টি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনায় যারা আছেন তারা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন ততই মঙ্গল।

[লেখক : অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]

ছবি

শিশুখাদ্যের নিরাপত্তা: জাতির ভবিষ্যৎ সুরক্ষার প্রথম শর্ত

ছবি

ফিনল্যান্ড কেন সুখী দেশ

ছবি

কৃষকের সংকট ও অর্থনীতির ভবিষ্যৎ

আলু চাষের আধুনিক প্রযুক্তি

ই-বর্জ্য: নীরব বিষে দগ্ধ আমাদের ভবিষ্যৎ

ঢাকার জনপরিসর: আর্ভিং গফম্যানের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

আলু চাষের আধুনিক প্রযুক্তি

কলি ফুটিতে চাহে ফোটে না!

কৃষিতে স্মার্ট প্রযুক্তি

রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানে লোকালাইজেশন অপরিহার্য

আইসিইউ থেকে বাড়ি ফেরা ও খাদের কিনারায় থাকা দেশ

বিচারবহির্ভূত হত্যার দায় কার?

ছবি

ট্রাম্পের ভেনেজুয়েলা কৌশল

অযৌক্তিক দাবি: পেশাগত নৈতিকতার সংকট ও জনপ্রশাসন

সড়ক দুর্ঘটনা এখন জাতীয় সংকট

কেন বাড়ছে দারিদ্র্য?

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনর্জন্ম

লবণাক্ততায় ডুবছে উপকূল

বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন ও বাস্তবতা

সড়ক দুর্ঘটনার সমাজতত্ত্ব: আইন প্রয়োগের ব্যর্থতা ও কাঠামোর চক্রাকার পুনরুৎপাদন

ছবি

অস্থির সময় ও অস্থির সমাজের পাঁচালি

ভারতে বামপন্থার পুনর্জাগরণ: ব্যাধি ও প্রতিকার

চিপনির্ভরতা কাটিয়ে চীনের উত্থান

একতার বাতাসে উড়ুক দক্ষিণ এশিয়ার পতাকা

ছবি

স্মরণ: শহীদ ডা. মিলন ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থার সংগ্রাম

মনে পুরানো দিনের কথা আসে, মনে আসে, ফিরে আসে...

রাসায়নিক দূষণ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি

আছদগঞ্জের শুটকি : অতীতের গৌরব, বর্তমানের দুঃসময়

নবান্নের আনন্দ ও আমনের ফলন

‘প্রশ্ন কোরো না, প্রশ্ন সর্বনাশী’

ভূমিকম্প, অর্থনৈতিক চাপ এবং অনিশ্চয়তা: মানসিকতার নতুন অর্থনীতি

নবম পে স্কেল ও এর আর্থসামাজিক প্রভাব

মৃত্যুদণ্ড, তারপর...

জমির ভুয়া দলিল কীভাবে বাতিল করবেন?

জুলাই সনদ আদিবাসীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি

ব্যাংকের দুরবস্থা থামানো যাচ্ছে না কেন

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

সরকারি হাসপাতালের টয়লেট ব্যবস্থাপনায় করুণ দশা

দিদারে আলম মুহসিন

বৃহস্পতিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৪

আপনি কি কখনও দেশের কোন সরকারি হাসপাতালে রোগী হিসেবে গেছেন? আউটডোরে? কিংবা ইন-প্যাশেন্ট হিসেবে? নিদেনপক্ষে একজন ভিজিটর হিসেবে ওখানে যাবার অভিজ্ঞতা আপনার হয়ে থাকবে। একজন রোগী হিসেবে যদি আপনি কোন সরকারি হাসপাতালে জেনারেল বেডে ভর্তি হয়ে থাকেন কিংবা তার এটেনডেন্ট হিসেবে ওখানে অবস্থান করেন, তাহলে নিশ্চয়ই আপনাকে ওখানকার টয়লেটগুলো ব্যবহার করতে হয়েছে। এক্ষেত্রে, কিছু অপ্রত্যাশিত ব্যতিক্রম বাদ দিলে আপনার খুব কষ্টকর একটি অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে।

দেশের বিপুলসংখ্যক নিম্নআয়ের মানুষের চিকিৎসার জন্য শেষ আশ্রয় এই সরকারি হাসপাতালগুলো। বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোর বিপুল ব্যয়ের তুলনায় সরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা সেবা একরকম ফ্রি। থাকা-খাওয়ার জন্যেও আপনার তেমন কোন খরচ লাগছে না। তবে আপনাকে হয়তো হাসপাতাল যোগান দিতে না পারলে বাহির থেকে ওষুধ কেনা লাগতে পারে। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যেও চার্জ দিতে হতে পারে, তবে তা বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর তুলনায় অনেক কম। এছাড়া আপনি যদি দেশের কোন বড় হাসপাতালেইন-প্যাশেন্ট হিসেবে ভর্তি হয়ে থাকেন, তাহলে দেশের সেরা ডাক্তারদের সেবা পাচ্ছেন। তারা প্রতিদিন এক থেকে দুবার রাউন্ডে এসে আপনাকে দেখে যাবেন। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ওরাই কিংবা তাদের সমকক্ষ পর্যায়ের কেউ হয়তো আপনার চিকিৎসা প্রদান করতেন। তবে হ্যাঁ এটা ঠিক যে, বেসরকারি হাসপাতালসমূহের মতো আপনার নিজস্ব পছন্দের কোন চিকিৎসককে ওখানে আপনি চিকিৎসা দেয়ার জন্য পাবেন না।

এত কিছুর পরেও যদি না আপনি কোন কেবিন বরাদ্দ পেয়ে থাকেন, বরং একজন ইন-প্যাশেন্ট হিসেবে জেনারেল বেডে আপনার স্থান হয়, তাহলে ২৪ ঘণ্টা যেতে না যেতেই আপনার মনে হবে, কবে আল্লাহ এখান থেকে আপনাকে বের করে নিয়ে যাবেন। আপনার দেখাশোনার জন্য যদি কেউ সাথে থাকেন তারও একই অনুভূতি হবে। কিন্তু কেন? না চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট কোন অব্যবস্থাপনা বা ঘাটতির জন্যে নয়। ¯্রফে টয়লেটসমূহের করুণ অবস্থার জন্যে। আপনি টয়লেট ব্যবহার করতে গিয়ে হয়তো দেখবেন, দুর্গন্ধের জন্য ঢোকাই যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাবে, টয়লেট ব্যবহার করার পর যে ফ্লাশ করবেন সেই জো নেই। সেগুলো নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। কোথাও হয়তো দেখবেন, টয়লেটের ফ্লোরে নোংরা পানি জমে আছে। কোথাও বা পানির কলগুলো ঠিক মতো কাজ করছে না। টয়লেট টিস্যু বা হাত ধোয়ার জন্য সাবানের কোন ব্যবস্থা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে আপনি পেয়ে থাকলে আপনিনিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবতে পারেন। এই দুরবস্থা দেখে আপনার শঙ্কা হতে পারে, এখান থেকে আপনাকে নতুন কোন রোগ বাঁধিয়ে ফিরতে হয় কিনা।

বিষয়টিকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ দেখা গেছে, নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পাবলিক টয়লেট; যা অনেক লোক একসঙ্গে ব্যবহার করে থাকে, সেখান থেকে জন-জনান্তিকে নানাবিধ রোগ ছড়াতে পারে। পাবলিক টয়লেটের মাধ্যমে সচরাচর যেসব রোগ বা জীবাণু ছড়াতে পারে তার মধ্যে রয়েছেÑ ই-কোলাই, স্যালমোনেলা, নরোভাইরাস, এমআরএসএ, হেপাটাইটিস এ, ইনফ্লুয়েঞ্জা, এমনকি কমন কোল্ড। কিছু ক্ষেত্রে এসব রোগের কারণে আপনার তীব্র পেটব্যথা, জ্বর ও শারীরিক অবসাদ দেখা দিতে পারে। আবার কিছু ক্ষেত্রে গলা ও ত্বকের সমস্যা দেখা যায়। কখনও কখনও রোগের উপসর্গ সপ্তাহ খানেক স্থায়ী হতে পারে। কিছু বিরল ক্ষেত্রে এসব রোগের কোন কোনটির কারণেআপনারজীবন সংশয় হতে পারে। খুব গুরুতর নয় এমন ক্ষেত্রেও আক্রান্ত ব্যক্তি অফিস মিস করার মতো যথেষ্ট অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন।

সাধারণভাবে মনে করা হয়ে থাকে, বেশিরভাগ বাথরুমের জীবাণু টয়লেটের সিটে থাকে। কিন্তু বাস্তবতা হলোÑ টয়লেটের মেঝে ও অধিক স্পর্শ লাগে এমন পৃষ্ঠসমূহ যেমন ধরুন সিন্ক, কলের হাতল, হ্যান্ড ড্রয়ার, লাইটের সুইচ, দরজার নবÑ এসবে অনেক বেশি সংখ্যায় জীবাণুর উপস্থিতি থাকে। আমেরিকান সংবাদ মাধ্যম এবিসি নিউজের এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পাবলিক টয়লেটের মেঝেতে প্রতি ইঞ্চিতে প্রায় ২০ লক্ষ ব্যাকটেরিয়া থাকে। কাজেই আপনি যদি কোন কিছু স্পর্শ নাও করেন, আপনার জুতার তলায় করেও আপনি জীবাণু বহন করে নিয়ে যেতে পারেন। শুধু তাই নয়, মহিলাদের হ্যান্ডব্যাগ যদি টয়লেটের মেঝেতে বা সিনেকর কাউন্টারে রাখা হয়ে থাকে, তাহলে সেটার সাথেও জীবাণু বাহিত হতে পারে। এ কারণে আপনার সাথে থাকা জিনিসপত্র ঝুলিয়ে রাখার জন্য দরজায় বা দেয়ালে যে অন্তত একটি হুক থাকা দরকার সেটা কেন জানি অনেকের মাথায় আসতে চায় না।

এখন আপনি যদি টয়লেটের জীবাণু বহন করছে এমন কোন দূষিত বস্তু বা পৃষ্ঠ স্পর্শ করেন, পরে ঠিক মতো হাত না ধুয়ে ওই হাত ব্যবহার করে খাবার প্রস্তুত বা গ্রহণ করেন, তাহলে হাতে থাকা জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হতে পারেন। এ ধরনের খাবার অন্য কেউ গ্রহণ করলে তিনিও সংক্রমিত হতে পারেন। অপরিচ্ছন্ন টয়লেট ফ্লাশ করার সময় চারিদিকের বাতাসে ছড়িয়ে পড়া জলকণা নিঃশ্বাসের সাথে গ্রহণ করলেও আপনি তাতে থাকা জীবাণুতে সংক্রমিত হতে পারেন। কাজেই বুঝা যাচ্ছে, পাবলিক টয়লেট নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, এর মেঝে, দরজা ইত্যাদি নিয়মিত বিরতিতে জীবাণু মুক্ত করা এবং টয়লেটের বাতাস দূষণমুক্ত রাখা টয়লেট বাহিত রোগ-ব্যাধি ছড়িয়ে পড়া রোধ করার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাসপাতালের মতো জায়গায় এর গুরুত্ব সমধিক, কারণ এখানে নানা রকমের রোগ ব্যাধি নিয়ে অসংখ্য মানুষ এসে থাকেন।

দেশের সরকারি হাসপাতালসমূহের টয়লেট ব্যবস্থাপনার যে করুণ চিত্র আমরা উপরে তুলে ধরেছি তা থেকে বেরিয়ে আসা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা এই আলোচনা থেকে সহজেই অনুমেয়। টয়লেট ব্যবস্থাপনার করুণ দশার একটি কারণ হতে পারে, এসব হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার চেয়েও অনেক বেশি রোগী ভর্তি হয়ে থাকেন। হতে পারে টয়লেটসমূহ যতসংখ্যক লোক ব্যবহার করে তার তুলনায় ক্লিনিং স্টাফ সংখ্যায় অপ্রতুল। ঢিলেঢালা প্রশাসন এবং অপর্যাপ্ত নজরদারিও কারণ হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে। প্রশ্ন হলোÑ দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে যদি একটা ছিমছাম ও পরিচ্ছন্ন স্যানিটেশন সিস্টেম মেইনটেন করা যায়, তাহলে সরকারি হাসপাতালসমূহে করা যাবে না কেন?

দেশে যানবাহনের ব্যস্ত রুটসমূহ যেমন ধরুন- ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে বিপুলসংখ্যক যাত্রীর রিফ্রেশমেন্টের জন্য মাঝপথে যানবাহনসমূহ যাত্রাবিরতি করে থাকে। সেখানে এই বিপুলসংখ্যক যানবাহনে যাতায়াতকারী যাত্রীদের প্রায় সবাই বিরতিকালীন রেস্টুরেন্টের টয়লেট ফ্যাসিলিটিজ ব্যবহার করে থাকেন। আপনি কদাচিৎ দেখবেন, এগুলো ঠিকমতো পরিষ্কার করা হচ্ছে না। হজের সময় লক্ষ লক্ষ হাজি কাবা শরীফ ও মসজিদে নববীর টয়লেট ফ্যাসিলিটিজ ব্যবহার করে থাকেন। এগুলোর ক্লিনিংয়ের ক্ষেত্রে কোন রকম অব্যবস্থাপনার অভিযোগ আপনি কদাচিৎ পাবেন। তাহলে আমাদের দেশের সরকারি হাসপাতালসমূহের টয়লেট ফ্যাসিলিটিজ- যেগুলো বড় জোর দৈনিক কয়েকশ’ থেকে কয়েক হাজার লোক ব্যবহার করে থাকেন- যথাযথভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এত কঠিন হবে কেন? ক্লিনারদের সংখ্যা অপ্রতুল হলে তাদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। স্থায়ীভাবে ক্লিনারদের সংখ্যা বাড়ানো না গেলে প্রয়োজনে খ-কালীন ক্লিনার নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। এটার জন্য বাজেট সংকট হবার কথা নয়। আর যদি হয়েও থাকে, উন্নত স্যানিটেশন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে রোগীরা আলাদা চার্জ জোগাতে সানন্দে রাজি হবেন বলে আমার বিশ্বাস। শুধু জরাজীর্ণ টয়লেট ব্যবস্থাপনার কারণে দেশের সরকারি হাসপাতালসমূহ উন্নত চিকিৎসা সেবা দিয়েও যে মারাত্মক ইমেজ সংকটে আছে সে বিষয়টি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনায় যারা আছেন তারা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন ততই মঙ্গল।

[লেখক : অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]

back to top