সামিউর রহমান
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুজন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে স্বল্প মেয়াদে ৬টি প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। তা হলোÑ
(০১) তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে মূল সড়কে ধীরগতির যানবাহন রিকশা চলাচল বন্ধকরণ। (০২) ঢাকায় চলাচলকারী সব বাসকে একটি কোম্পানির অধীনে ন্যস্তকরণ। (০৩) ট্র্যাফিক ব্যবস্থা চালুকরণ ও গণঅভ্যুত্থানের আগে যেভাবে ট্রাফিক পুলিশ কাজ করত, তারা যেন সেভাবে কাজ শুরু করে। (০৪) শহরের মোড়গুলোর ৫০-১০০ মিটারের মধ্যে বাস, প্রাইভেট কার, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ কোন বাহন যাতে থামতে বা পার্ক করতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করা। (০৫) বাস থামার নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া যাত্রী ওঠানামা করতে না দেয়া ও (০৬) কোন বাস পাশাপাশি দাঁড়াতে পারবে না, একটার পেছনে আরেকটা দাঁড়াতে হবে এবং ভ্রাম্যমাণ ট্রাফিক পর্যবেক্ষক দল গঠন করা।
এছাড়াও দীর্ঘমেয়াদি দুটি প্রস্তাবও তুলে ধরা হয়েছে। (ক) আরও দুটি মেট্রোরেল স্থাপন করা ও (খ) বাস চলাচলের জন্য বর্তমান সড়কে বিভাজক তৈরি করে আলাদা লেনের ব্যবস্থা করা।
উপরোক্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন হলে যানবাহনের গড় গতিবেগ কতটুকু বৃদ্ধি পাবে, তা কিন্তু প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়
নাই। যতটুকু জানা যায় বর্তমানে ঢাকায় যানবাহনের গড় গতিবেগ ঘন্টায় ৫ কিমি.-৭ কিমি. পর্যন্ত। বুয়েটের এআরআইয়ের গবষেণা প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৭ সালে ঢাকার সড়কে যানবাহনের গড় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার।
এখন যানজটের কারণে ঢাকায় দৈনিক ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, যার আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১৩৯ কোটি টাকা। এ হিসাবে বছর শেষে যানজটে ক্ষতির পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকা। এখন প্রশ্ন হলো ঢাকায় যানবাহনের গড় গতিবেগ ঘণ্টায় কত কিলোমিটার হলে আমাদের এই আর্থিক ক্ষতি রোধ করা সম্ভব এবং তা সঠিক কর্মপন্থা নিরূপণেও সহায়ক হবে। সঠিক কর্মপন্থা নিরূপণ করা না গেলে শুধু সময় ও অর্থ অপচয় হবে। কাজের কাজ কিছুই হবে না। বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে এই স্বল্প মেয়াদের ছয়টি প্রস্তাব নিয়ে একটু আলোকপাত করা যাক। (০১) মূল সড়কে ধীরগতির যানবাহন রিকশার চলাচল বন্ধকরণ। এই উদ্যোগটি মন্দ নয়। তবে রিকশা চলাচল বন্ধ হলে যানবাহনের গড় গতিবেগ ঘণ্টায় কত কিলোমিটারে উন্নতি হবে তা জানা যায়নি। এক তথ্যমতে এই শহরে রোজ ৫ লাখ রিকশা চলাচল করে। বর্তমানে এর সংখ্যা আরও বেশি।
প্রশ্ন হলো রিকশা চলাচল বন্ধ হওয়ার কারণে যে কয়েক লাখ রিকশাচালক বেকার হয়ে যাবে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে কি? (০২) ঢাকায় চলাচলকারী সব বাসকে একটি কোম্পানির অধীনে ন্যস্তকরণ : দিল্লির মতো করে ঢাকায় চলাচলকারী সব বাসকে একটি কোম্পানির অধীনে ন্যস্ত করার অর্থ হলো একক ব্যক্তি বা একটি গোষ্ঠীর কাছে সম্পূর্ণরূপে পরিবহণ পরিচালনার ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এর ফলে ফ্যাসিবাদী শক্তির পুনরুত্থান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মনে রাখতে হবে দিল্লি আর ঢাকা এক নয়। (০৩) ট্র্যাফিক ব্যবস্থা চালুকরণ ও গণঅভ্যুত্থানের আগে যেভাবে ট্রাফিক পুলিশ কাজ করত, তারা যেন সেভাবে কাজ শুরু করে: ট্রাফিক পুলিশ আগে যেভাবে কাজ করত তখন কি যানজট ছিল না? আর ডিজিটাল ট্রাফিক
ব্যবস্থা চালু হলে যানযট নিরসনে কতটুকু কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে তা কিন্তু প্রশ্ন রয়েই যায়। (০৪) শহরের মোড়গুলোর ৫০-১০০ মিটারের মধ্যে বাস, প্রাইভেট কার, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ কোন যানবাহন যাতে থামতে বা পার্ক করতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করা: এটিও একটি ভালো সিদ্ধান্ত। ৫০-১০০ মিটারের পর সে পরিমাণ জায়গা থাকতে হবে যেখানে গাড়ি পার্কিং করা যেতে পারে। ঢাকা শহরের কিছু কিছু মোড়ে সম্ভব হলেও সব মোড়ে সম্ভব নাও হতে পারে। (০৫) বাস থামার নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া যাত্রী ওঠানামা করতে না দেয়া : ভালো একটি সিদ্ধান্ত। কিন্তু পালনে কতটুকু কার্যকরী হবে তা ভাবনার বিষয়। যদি একসঙ্গে ৫-৬টি বা ততোধিক বাস এসে দাঁড়ায় এবং যদি একটি বাসের দৈর্ঘ্য (ক্ট) ৪০
ফুট হয় তবে ৬ টি বাসের দৈর্ঘ্য (৪০দ্ধ৬) = ২৪০ ফুট+আরও ১০ ফুট মোট ২৫০ ফুট বা আরও বেশি জায়গার প্রয়োজন হবে। সে পরিমাণ নির্দিষ্ট জায়গা পাওয়া গেলে তবেই সম্ভব। (০৬) কোন বাস পাশাপাশি দাঁড়াতে পারবে না, একটার পেছনে আরেকটা দাঁড়াতে হবে এবং ভ্রাম্যমাণ ট্রাফিক পর্যবেক্ষক দল গঠন করা : অবশ্যই শৃঙ্খলা ফিরে আসার বিষয়ে কার্যকরী সিদ্ধান্ত। এখানেও একই সমস্যা রয়েছে। যদি একসঙ্গে ৫-৬টি বা ততোধিক বাস এসে দাঁড়ায় এবং সে পরিমান নির্দিষ্ট জায়গা পাওয়া গেলে তবেই সম্ভব। ০২ নং হতে ০৬ নং প্রস্তাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, যানযট নিরসনে চলাচলকৃত যানবাহনের শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়েই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যদিও এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা বা রাস্তা পাওয়া না পাওয়া। একটি শহরে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু রাখার জন্য অন্তত ২৫ শতাংশ রাস্তা প্রয়োজন হয়। ঢাকায় রাস্তা আছে ৯ শতাংশ। আমাদের সমস্যা হচ্ছে প্রয়োজনের তুলনায় রাস্তার পরিমাণ অতি সামান্য এবং গাড়ির সংখ্যা অত্যাধিক। বাংলাদেশ সড়ক পরবিহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, ২০১১ থেকে ২০২১ সময়ে রাজধানীতে মোটরসাইকলে বেড়ে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭ লাখ। একই সময়ে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৮০৯টি। একই সময়ে ডাবল ও সিঙ্গেল কেবিন পিকআপ বেড়েছে প্রায় ছয়গুণ। বাস-মিনিবাসের সংখ্যা ৪৭ হাজার ৪৮৪টি। পরিসংখ্যানে দেখা যায় দিনে দিনে গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন প্রস্তাবিত দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তাব দুটি নিয়ে আলোকপাত করা যাক।
(ক) প্রস্তাবিত দুটি মেট্রেরেল নির্মাণ করলে নির্দিষ্ট কিছু মানুষের নির্দিষ্ট কিছু কাজের জন্য সুবিধা হবে। কিন্তু জনসংখ্যার বৃদ্ধির এই শহরে যানজট নিরসন সম্ভব হবে কি? (খ) যেখানে মাত্র ৯ শতাংশ রাস্তা বিদ্যমান সেখানে শুধু বাস চলাচলের জন্য বিভাজক তৈরি করলে অন্যান্য বাহনগুলো কিভাবে যানজটমুক্তভাবে চলাচল করবে? একটু ভাববার প্রয়োজন রয়েছে। আমরা যদি মূল সমস্যা চিহ্নিত এবং সে মতে সমাধান না করি সত্যিকার অর্থে কোন সুফল বয়ে আসবে না। এখন প্রশ্ন হলো কেন গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে ? উত্তর : এই শহরে দিনে দিনে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থাৎ মানুষের সংখ্যা কমে গেলে গাড়ির সংখ্যাও কমে যাবে। গাড়ির সংখ্যা কমে গেলে যানজটও কমে যাবে। প্রয়োজন পড়বে না নতুন করে রাস্তা প্রশস্ত বা নতুন রাস্তা তৈরিকরণের কাজ, প্রয়োজন পড়বে না ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল নির্মাণকরণ।
এতক্ষণে বুঝতে পারলাম, আমাদের মূল ও প্রধান সমস্যা হচ্ছে ‘জনসংখ্যা’।
এখন প্রশ্ন-১ : কেন জনসংখ্যা ঢাকায় বৃদ্ধি পাচ্ছে ? প্রশ্ন-২ : কিভাবে এই জনসংখ্যা কমানো যাবে ? এই দুটি প্রশ্নের সমাধান করতে পারলেই সত্যিকার অর্থে যানজট কমানো বা সহনীয় পর্যায়ে আনা সম্ভব হবে এবং দেশের অর্থনীতিতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে। এর বাইরে কোন সমাধানই টেকসই সুফল বয়ে আনবে না। হয়তো সাময়িক এবং সামান্য কিছু ফল দিতে পারে। এখন প্রশ্ন-১ : কেন ঢাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে? উত্তর : বাংলাদেশের মধ্যে ঢাকাই হচ্ছে সব ধরনের নাগরিক সেবা প্রাপ্তির একক কেন্দ্রস্থল এবং সব ক্ষমতার উৎসই বিদ্যমান এই শহরে। বিকল্প এমন কোন শহর গড়ে উঠে নাই, যেখানে সব ধরনের নাগরিক সেবা সহজেই পাওয়া যায়।
তাই ঢাকা দিনে দিনে ‘ফ্যাসিস্ট সিটি’তে রূপান্তরিত হয়েছে। ঢাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার প্রধান কারনগুলোÑ (ক) কর্মসংস্থান, (খ) চিকিৎসা, (গ) শিক্ষা, (ঘ) ব্যবসা-বাণিজ্য, (ঙ) প্রশাসনিক কাজকর্ম, (চ) বিচার প্রাপ্তিসহ অন্যান্য নাগরিক সেবা গ্রহণের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় ঢাকা শহরে দিনে দিনে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্রশ্ন-২ : কিভাবে এই জনসংখ্যা কমানো যাবে? উত্তর : উপরোক্ত নাগরিক সুবিধাগুলো দেশের অন্যান্য শহরে ছড়িয়ে দিলে ঢাকামুখী যে জনস্র্রোত তা থামানো বা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে এবং ঢাকা শহর অনেকটাই ফাঁকা হয়ে যাবে। এরফলে যানজট রোধ হবে বা সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে, রাজধানী ঢাকাকে কেমন শহর হিসেবে দেখতে চাই। এটা কি শুধু প্রশাসনিক শহর হবে, না কি প্রশাসনিক কাম বাণিজ্যিক শহর হবে? বিশ্বের অনেক দেশের রাজধানী শহরে শুধু প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালিত হয়। যদি ঢাকাকে শুধু প্রশাসনিক শহরে রূপান্তরিত করা যায় তাহলে থাকবে না কোন শিল্প, কলকারখানা, থাকবে না কোন ব্যবসা-বাণিজ্য, হবে না কোন নাগরিক সুবিধার একক কেন্দ্রস্থল।
করণীয় : সব তৈরি পোশাক শিল্প, ভারী, মাঝারি, ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের কলকারখানা এই ঢাকা হতে পর্যায়ক্রমে স্থানান্তরিত করতে হবে। বিশেষ করে পোর্ট সিটি চট্রগ্রাম, মোংলা পোর্ট ও পায়রা বন্দরকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সব ব্যবসা, বাণিজ্যের কার্যক্রম বাণিজ্যিক রাজধানী চট্রগ্রামে স্থানান্তরিত করতে হবে।
সব বিভাগীয় শহরে আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন অত্যাধুনিক হাসপাতাল নির্মাণ করতে হবে। যেন চিকিৎসার জন্য ঢাকামুখী হতে না হয়।
প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণ করে নাগরিক সেবাগুলো জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে।
সব বিভাগীয় শহরে একটি করে উচ্চ আদালত স্থাপন করতে হবে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মান সম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে।
তবেই ঢাকাকে বাঁচানো সম্ভব এবং ঢাকা ফিরে পাবে তার হৃত গৌরব।
[লেখক : প্রকৌশলী, গণপূর্ত রক্ষণাবেক্ষণ সার্কেল, গণপূর্ত অধিদপ্তর]
সামিউর রহমান
শনিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৪
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুজন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে স্বল্প মেয়াদে ৬টি প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। তা হলোÑ
(০১) তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে মূল সড়কে ধীরগতির যানবাহন রিকশা চলাচল বন্ধকরণ। (০২) ঢাকায় চলাচলকারী সব বাসকে একটি কোম্পানির অধীনে ন্যস্তকরণ। (০৩) ট্র্যাফিক ব্যবস্থা চালুকরণ ও গণঅভ্যুত্থানের আগে যেভাবে ট্রাফিক পুলিশ কাজ করত, তারা যেন সেভাবে কাজ শুরু করে। (০৪) শহরের মোড়গুলোর ৫০-১০০ মিটারের মধ্যে বাস, প্রাইভেট কার, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ কোন বাহন যাতে থামতে বা পার্ক করতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করা। (০৫) বাস থামার নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া যাত্রী ওঠানামা করতে না দেয়া ও (০৬) কোন বাস পাশাপাশি দাঁড়াতে পারবে না, একটার পেছনে আরেকটা দাঁড়াতে হবে এবং ভ্রাম্যমাণ ট্রাফিক পর্যবেক্ষক দল গঠন করা।
এছাড়াও দীর্ঘমেয়াদি দুটি প্রস্তাবও তুলে ধরা হয়েছে। (ক) আরও দুটি মেট্রোরেল স্থাপন করা ও (খ) বাস চলাচলের জন্য বর্তমান সড়কে বিভাজক তৈরি করে আলাদা লেনের ব্যবস্থা করা।
উপরোক্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন হলে যানবাহনের গড় গতিবেগ কতটুকু বৃদ্ধি পাবে, তা কিন্তু প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়
নাই। যতটুকু জানা যায় বর্তমানে ঢাকায় যানবাহনের গড় গতিবেগ ঘন্টায় ৫ কিমি.-৭ কিমি. পর্যন্ত। বুয়েটের এআরআইয়ের গবষেণা প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৭ সালে ঢাকার সড়কে যানবাহনের গড় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার।
এখন যানজটের কারণে ঢাকায় দৈনিক ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, যার আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১৩৯ কোটি টাকা। এ হিসাবে বছর শেষে যানজটে ক্ষতির পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকা। এখন প্রশ্ন হলো ঢাকায় যানবাহনের গড় গতিবেগ ঘণ্টায় কত কিলোমিটার হলে আমাদের এই আর্থিক ক্ষতি রোধ করা সম্ভব এবং তা সঠিক কর্মপন্থা নিরূপণেও সহায়ক হবে। সঠিক কর্মপন্থা নিরূপণ করা না গেলে শুধু সময় ও অর্থ অপচয় হবে। কাজের কাজ কিছুই হবে না। বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে এই স্বল্প মেয়াদের ছয়টি প্রস্তাব নিয়ে একটু আলোকপাত করা যাক। (০১) মূল সড়কে ধীরগতির যানবাহন রিকশার চলাচল বন্ধকরণ। এই উদ্যোগটি মন্দ নয়। তবে রিকশা চলাচল বন্ধ হলে যানবাহনের গড় গতিবেগ ঘণ্টায় কত কিলোমিটারে উন্নতি হবে তা জানা যায়নি। এক তথ্যমতে এই শহরে রোজ ৫ লাখ রিকশা চলাচল করে। বর্তমানে এর সংখ্যা আরও বেশি।
প্রশ্ন হলো রিকশা চলাচল বন্ধ হওয়ার কারণে যে কয়েক লাখ রিকশাচালক বেকার হয়ে যাবে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে কি? (০২) ঢাকায় চলাচলকারী সব বাসকে একটি কোম্পানির অধীনে ন্যস্তকরণ : দিল্লির মতো করে ঢাকায় চলাচলকারী সব বাসকে একটি কোম্পানির অধীনে ন্যস্ত করার অর্থ হলো একক ব্যক্তি বা একটি গোষ্ঠীর কাছে সম্পূর্ণরূপে পরিবহণ পরিচালনার ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এর ফলে ফ্যাসিবাদী শক্তির পুনরুত্থান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মনে রাখতে হবে দিল্লি আর ঢাকা এক নয়। (০৩) ট্র্যাফিক ব্যবস্থা চালুকরণ ও গণঅভ্যুত্থানের আগে যেভাবে ট্রাফিক পুলিশ কাজ করত, তারা যেন সেভাবে কাজ শুরু করে: ট্রাফিক পুলিশ আগে যেভাবে কাজ করত তখন কি যানজট ছিল না? আর ডিজিটাল ট্রাফিক
ব্যবস্থা চালু হলে যানযট নিরসনে কতটুকু কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে তা কিন্তু প্রশ্ন রয়েই যায়। (০৪) শহরের মোড়গুলোর ৫০-১০০ মিটারের মধ্যে বাস, প্রাইভেট কার, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ কোন যানবাহন যাতে থামতে বা পার্ক করতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করা: এটিও একটি ভালো সিদ্ধান্ত। ৫০-১০০ মিটারের পর সে পরিমাণ জায়গা থাকতে হবে যেখানে গাড়ি পার্কিং করা যেতে পারে। ঢাকা শহরের কিছু কিছু মোড়ে সম্ভব হলেও সব মোড়ে সম্ভব নাও হতে পারে। (০৫) বাস থামার নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া যাত্রী ওঠানামা করতে না দেয়া : ভালো একটি সিদ্ধান্ত। কিন্তু পালনে কতটুকু কার্যকরী হবে তা ভাবনার বিষয়। যদি একসঙ্গে ৫-৬টি বা ততোধিক বাস এসে দাঁড়ায় এবং যদি একটি বাসের দৈর্ঘ্য (ক্ট) ৪০
ফুট হয় তবে ৬ টি বাসের দৈর্ঘ্য (৪০দ্ধ৬) = ২৪০ ফুট+আরও ১০ ফুট মোট ২৫০ ফুট বা আরও বেশি জায়গার প্রয়োজন হবে। সে পরিমাণ নির্দিষ্ট জায়গা পাওয়া গেলে তবেই সম্ভব। (০৬) কোন বাস পাশাপাশি দাঁড়াতে পারবে না, একটার পেছনে আরেকটা দাঁড়াতে হবে এবং ভ্রাম্যমাণ ট্রাফিক পর্যবেক্ষক দল গঠন করা : অবশ্যই শৃঙ্খলা ফিরে আসার বিষয়ে কার্যকরী সিদ্ধান্ত। এখানেও একই সমস্যা রয়েছে। যদি একসঙ্গে ৫-৬টি বা ততোধিক বাস এসে দাঁড়ায় এবং সে পরিমান নির্দিষ্ট জায়গা পাওয়া গেলে তবেই সম্ভব। ০২ নং হতে ০৬ নং প্রস্তাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, যানযট নিরসনে চলাচলকৃত যানবাহনের শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়েই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যদিও এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা বা রাস্তা পাওয়া না পাওয়া। একটি শহরে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু রাখার জন্য অন্তত ২৫ শতাংশ রাস্তা প্রয়োজন হয়। ঢাকায় রাস্তা আছে ৯ শতাংশ। আমাদের সমস্যা হচ্ছে প্রয়োজনের তুলনায় রাস্তার পরিমাণ অতি সামান্য এবং গাড়ির সংখ্যা অত্যাধিক। বাংলাদেশ সড়ক পরবিহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, ২০১১ থেকে ২০২১ সময়ে রাজধানীতে মোটরসাইকলে বেড়ে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭ লাখ। একই সময়ে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৮০৯টি। একই সময়ে ডাবল ও সিঙ্গেল কেবিন পিকআপ বেড়েছে প্রায় ছয়গুণ। বাস-মিনিবাসের সংখ্যা ৪৭ হাজার ৪৮৪টি। পরিসংখ্যানে দেখা যায় দিনে দিনে গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন প্রস্তাবিত দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তাব দুটি নিয়ে আলোকপাত করা যাক।
(ক) প্রস্তাবিত দুটি মেট্রেরেল নির্মাণ করলে নির্দিষ্ট কিছু মানুষের নির্দিষ্ট কিছু কাজের জন্য সুবিধা হবে। কিন্তু জনসংখ্যার বৃদ্ধির এই শহরে যানজট নিরসন সম্ভব হবে কি? (খ) যেখানে মাত্র ৯ শতাংশ রাস্তা বিদ্যমান সেখানে শুধু বাস চলাচলের জন্য বিভাজক তৈরি করলে অন্যান্য বাহনগুলো কিভাবে যানজটমুক্তভাবে চলাচল করবে? একটু ভাববার প্রয়োজন রয়েছে। আমরা যদি মূল সমস্যা চিহ্নিত এবং সে মতে সমাধান না করি সত্যিকার অর্থে কোন সুফল বয়ে আসবে না। এখন প্রশ্ন হলো কেন গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে ? উত্তর : এই শহরে দিনে দিনে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থাৎ মানুষের সংখ্যা কমে গেলে গাড়ির সংখ্যাও কমে যাবে। গাড়ির সংখ্যা কমে গেলে যানজটও কমে যাবে। প্রয়োজন পড়বে না নতুন করে রাস্তা প্রশস্ত বা নতুন রাস্তা তৈরিকরণের কাজ, প্রয়োজন পড়বে না ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল নির্মাণকরণ।
এতক্ষণে বুঝতে পারলাম, আমাদের মূল ও প্রধান সমস্যা হচ্ছে ‘জনসংখ্যা’।
এখন প্রশ্ন-১ : কেন জনসংখ্যা ঢাকায় বৃদ্ধি পাচ্ছে ? প্রশ্ন-২ : কিভাবে এই জনসংখ্যা কমানো যাবে ? এই দুটি প্রশ্নের সমাধান করতে পারলেই সত্যিকার অর্থে যানজট কমানো বা সহনীয় পর্যায়ে আনা সম্ভব হবে এবং দেশের অর্থনীতিতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে। এর বাইরে কোন সমাধানই টেকসই সুফল বয়ে আনবে না। হয়তো সাময়িক এবং সামান্য কিছু ফল দিতে পারে। এখন প্রশ্ন-১ : কেন ঢাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে? উত্তর : বাংলাদেশের মধ্যে ঢাকাই হচ্ছে সব ধরনের নাগরিক সেবা প্রাপ্তির একক কেন্দ্রস্থল এবং সব ক্ষমতার উৎসই বিদ্যমান এই শহরে। বিকল্প এমন কোন শহর গড়ে উঠে নাই, যেখানে সব ধরনের নাগরিক সেবা সহজেই পাওয়া যায়।
তাই ঢাকা দিনে দিনে ‘ফ্যাসিস্ট সিটি’তে রূপান্তরিত হয়েছে। ঢাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার প্রধান কারনগুলোÑ (ক) কর্মসংস্থান, (খ) চিকিৎসা, (গ) শিক্ষা, (ঘ) ব্যবসা-বাণিজ্য, (ঙ) প্রশাসনিক কাজকর্ম, (চ) বিচার প্রাপ্তিসহ অন্যান্য নাগরিক সেবা গ্রহণের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় ঢাকা শহরে দিনে দিনে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্রশ্ন-২ : কিভাবে এই জনসংখ্যা কমানো যাবে? উত্তর : উপরোক্ত নাগরিক সুবিধাগুলো দেশের অন্যান্য শহরে ছড়িয়ে দিলে ঢাকামুখী যে জনস্র্রোত তা থামানো বা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে এবং ঢাকা শহর অনেকটাই ফাঁকা হয়ে যাবে। এরফলে যানজট রোধ হবে বা সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে, রাজধানী ঢাকাকে কেমন শহর হিসেবে দেখতে চাই। এটা কি শুধু প্রশাসনিক শহর হবে, না কি প্রশাসনিক কাম বাণিজ্যিক শহর হবে? বিশ্বের অনেক দেশের রাজধানী শহরে শুধু প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালিত হয়। যদি ঢাকাকে শুধু প্রশাসনিক শহরে রূপান্তরিত করা যায় তাহলে থাকবে না কোন শিল্প, কলকারখানা, থাকবে না কোন ব্যবসা-বাণিজ্য, হবে না কোন নাগরিক সুবিধার একক কেন্দ্রস্থল।
করণীয় : সব তৈরি পোশাক শিল্প, ভারী, মাঝারি, ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের কলকারখানা এই ঢাকা হতে পর্যায়ক্রমে স্থানান্তরিত করতে হবে। বিশেষ করে পোর্ট সিটি চট্রগ্রাম, মোংলা পোর্ট ও পায়রা বন্দরকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সব ব্যবসা, বাণিজ্যের কার্যক্রম বাণিজ্যিক রাজধানী চট্রগ্রামে স্থানান্তরিত করতে হবে।
সব বিভাগীয় শহরে আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন অত্যাধুনিক হাসপাতাল নির্মাণ করতে হবে। যেন চিকিৎসার জন্য ঢাকামুখী হতে না হয়।
প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণ করে নাগরিক সেবাগুলো জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে।
সব বিভাগীয় শহরে একটি করে উচ্চ আদালত স্থাপন করতে হবে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মান সম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে।
তবেই ঢাকাকে বাঁচানো সম্ভব এবং ঢাকা ফিরে পাবে তার হৃত গৌরব।
[লেখক : প্রকৌশলী, গণপূর্ত রক্ষণাবেক্ষণ সার্কেল, গণপূর্ত অধিদপ্তর]