alt

উপ-সম্পাদকীয়

ব্রি: কিছু প্রশ্ন, কিছু উত্তর

জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস

: শনিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৪

ব্রি ১ অক্টোবর ২০২৪ পঞ্চান্ন বছরে পা রাখল। তবে এটা পঞ্চান্ন না হয়ে পঁয়ষট্টি হতে পারত। কারণ ধান নিয়ে জোরদার গবেষণার প্রয়োজনে সরকারের বরাবরে প্রথম প্রকল্প জমা দেয়া হয় ১৯৫৫ সালে। প্রকল্পটি জমা দিয়েছিলেন ড. এ আলীম। সেটা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং পরিমার্জন-পরিবর্ধনের পর ঋঅঙ, ফোর্ড ফাউন্ডেশন এবং আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ইরি) সুপারিশক্রমে ১৯৬৫-৬৬ অর্থবছরে ঊধংঃ চধশরংঃধহ অপপবষবৎধঃবফ জরপব জবংবধৎপয (ঊচঅজজ) প্রকল্প নামে অনুমোদিত হয়। অতঃপর সাভারের দুগ্ধ-খামারের ২৫ একর জায়গা ভাড়া নিয়ে আধুনিক ধান গবেষণার যাত্রা শুরু। তখন সম্বল ছিল ফোর্ড ফাউন্ডেশনের ৩০ লাখ টাকা আর আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) থেকে পাওয়া ধানের ৩০০ কৌলিক সারি। সাভারে জমি ভাড়া নেয়ার কারণ হলো ঢাকায় অবস্থিত কৃষি-গবেষণার মূল জায়গাটা (মনিপুরী ফার্ম) সরকার অধিগ্রহণ করে নেয়।

সাভারের কার্যক্রম শুরুর দিনটি ছিল ২৬ মার্চ। অতঃপর ২৬ এপ্রিল থেকে ২৬ মের মধ্যে চারা রোপণ করা হয়। একই সাথে কুমিল্লায় অবস্থিত ঊধংঃ চধশরংঃধহ অপধফবসু ড়ভ জঁৎধষ উবাবষড়ঢ়সবহঃ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও ঊধংঃ চধশরংঃধহ ডধঃবৎ ধহফ চড়বিৎ উবাবষড়ঢ়সবহঃ অঁঃযড়ৎরঃু (ডঅচউঅ)-এদের কাছেও এক সেট করে বীজ পাঠানো হয়। তারা সবাই নিজেদের তো করে আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমে এগুলোর মাঠ পরীক্ষা সম্পন্ন করে। ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর ইরি থেকে অবমুক্তকৃত ওজ৮ জাতটি এই সব কৌলিক সারিগুলোর মধ্যে ছিল। ওজ৮ সে সময়ে আউশ, আমন এবং বোরো তিন মৌসুমেই দেশে প্রচলিত স্থানীয় উন্নত জাতগুলোর চেয়ে তিন-চার গুণ বেশি ফলন দেয়। তাই আর বেশি চিন্তাভাবনা না করে ১৯৬৭ সালে কৃষক পর্যায়ে আবাদের জন্য জাতটি অনুমোদন দেয়া হয়। সেই হিসেবে ধান-গবেষণার জন্মদিন হওয়া উচিত ছিল ১৯৬৬ সালের ২৬ মার্চ। কারণ ধান-গবেষণা কার্যক্রমে নিয়োজিত প্রকল্পটি তখনও স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা পায়নি।

ধান গবেষণার প্রাথমিক পর্যায়ের এই আশাব্যঞ্জক ফলাফলের কারণে ঊচঅজজ প্রকল্পের ১৯৬৮ সালে অর্থ বরাদ্দ ১ কোটি ৮০ লাখ টাকায় উন্নীত করা হয় এবং ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরে কৃষি-গবেষণার (এখন যেটা বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট) জন্য বরাদ্দকৃত ৬৪০ একর জমি থেকে দুই ধাপে ১৬৫ একর জমি দেয়া হয়। একই সঙ্গে প্রকল্পটি কোম্পানি আইনে নিবন্ধিত করে ইড়ধৎফ ড়ভ এড়াবৎহবৎং-এর আওতায় ন্যস্ত করে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দেয়া হয়। নাম দেয়া হয় ঊধংঃ চধশরংঃধহ জরপব জবংবধৎপয ওহংঃরঃঁঃব। সেদিন ছিল ১৯৭০ সালের ১ অক্টোবর। এই দিনটিই ব্রির জন্মদিন হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত।

ব্রির বর্তমান প্রেক্ষাপট সম্পর্কে দেশের সবাই মোটামুটি অবগত। আটটি হাইব্রিড ধানের জাতসহ উদ্ভাবিত জাতের সংখ্যা ১১৫। ধান বা কৃষিবিষয়ক উদ্ভাবিত প্রযুক্তির সংখ্যা দুই শতাধিক। দেশে এখন ভাতের অভাব নেই। তারপরেও সমালোচনা আছে। যেমন এতগুলো ধানের জাত উদ্ভাবন করার পরও মাঠে তো মাত্র কয়েকটা জাত দেখা যায়। ব্রি এখনও তিরিশ বছর আগে উদ্ভাবিত ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান২৯ বা বিআর১১ এর বলয় থেকে বের হতে পারেনি। পরিবেশবাদিরাও মুখিয়ে আছেন। কারণ উফশী ধানের আবাদে দেশের পানি ও পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মাটির উর্বরতা কমে গেছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। বালাই নাশকের ব্যবহার ক্রমাগত বাড়ছে। তাদের আরেকটি বিশেষ অভিযোগ হলো দেশের চাষিরা দিনে দিনে বিদেশি কোম্পানির কাছে নিজেদের বীজের অধিকার হারাচ্ছে।

১৯৭০ সাল থেকে ব্রি দেশের প্রধান ফসল ধান নিয়ে কাজ করছে। ধান একটি রাজনৈতিক ফসল। তাই ধান নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা হওয়া স্বাভাবিক। সব সমালোচনার জবাব এখানে দেয়ার সুযোগ নেই। তারপরেও বলছি। সত্তর দশকের শুরুতে দেশে চালের উৎপাদন ছিল আজকের তুলনায় চারভাগের এক ভাগ। জনসংখ্যা ছিল সাত কোটি। আজকের তুলনায় অর্ধেক। দেশে উফশী ধানের প্রযুক্তি না আসলে মোট উৎপাদন আগের পর্যায়ে থাকত। বা কমে যেতে পারত। কিন্তু জনসংখ্যা-বৃদ্ধি খুব একটা থেমে থাকত বলে মনে হয় না। তাহলে এই বাড়তি মানুষদের খাদ্য চাহিদা পূরণ হতো কীভাবে? পরিবেশবাদীরা অবশ্য বলে থাকেন প্রকৃতির সক্ষমতার কোনো শেষ নেই। একথা আমিও বিশ্বাস করি। তাই বলে কি শত-শত বছর ধরে ব্যবহৃত জাতগুলো আমাদের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হতো? তারা লৌকিক-কৃষির গাল-গল্প করে বেড়ান। সবগুলো দেশি ধানের জাতগুলোর ফলনক্ষমতা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখান। আর নিজেদের আওতায় উৎপাদিত কিছু ফসলের ভালো গুণাগুণ পুঁজি করে বেশিমূল্যে তাদের পণ্য বিক্রি করে থাকেন। অথচ এগুলো দেশের সাধারণ জনগণের কোনো উপকারে আসে না। উপকারভোগী হলো সেই উপরতলার তথাকথিত স্বাস্থ্যসচেতন কিছু ভদ্রজনেরা।

উল্টোদিকে; উদ্ভাবিত ধানের জাতগুলো আজকাল আগের জাতগুলো থেকে তিন থেকে চারগুণ ফলন বেশি দেয় বলেই দেশের মানুষ দুটো ভাত খেতে পারছে। আর এই সব জাতগুলো কিন্তু প্রকৃতির সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েই উদ্ভাবিত। উদ্বেগের বিষয় হলো কৃষিবিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে ধানের জাতগুলোই শুধু কৃষকদের নজরে আসে সহযোগী প্রযুক্তিগুলো নয়। তারা ধান রোপণ করে নিজেদের মতো করে পরিচর্যা করেন। ফলে সার এবং পানির পাশাপাশি বালাই নাশকেরও প্রচুর অপচয় ও অপব্যবহার হয়ে থাকে। এখানে কৃষিবিজ্ঞানীদের চেয়ে মাঠপর্যায়ে যারা আছেন তাদের দায়িত্ব বেশি। তারা একটু খেয়াল করলে এমনটি হওয়ার কথা নয়। আর জাত যত বেশি উদ্ভাবিত হচ্ছে ততই ভালো মনে করতে হবে।

কারণ এখনকার উদ্ভাবিত জাতগুলোর শুধু ফলনই বেশি নয় স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বৈরী পরিবেশে মানানসই। কিছু কিছু জাত সমসাময়িক রোগবালাই প্রতিরোধে সক্ষম। তবে এই সব জাতগুলো যে বছরের পর বছর ধরে বৈরী পরিবেশে টিকে থাকবে বা বালাই সহনশীল থাকবে এমন নয়। কারণ পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে কীট-পতঙ্গ এবং রোগ জীবাণুগুলো নিজেদেরকে দ্রুত খাপ-খাইয়ে নিতে সক্ষম। তাছাড়া মাত্রারিক্ত বালাই নাশক প্রয়োগের ফলেও অধিকাংশ বালাই যেমন রোগবালাই, কীটপতঙ্গ এমনকি আগাছা পর্যন্ত সহনশীল হয়ে পড়ে। তখন সেগুলোকে আর দমন করা যায় না। এসব কারণেই জাত বৈচিত্র্যের দরকার আছে। আর একটি জাত যতই জনপ্রিয় হোক না কোন পাঁচ-সাত বছরের বেশি মাঠে থাকা উচিত নয়। তাই এসব বিষয়ে আমাদেরকে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে; বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে পরিবেশের উপর বৈরী প্রভাব কমে আসবে।

সার ও পানি ব্যবহারের ব্যাপারে একই কথা প্রযোজ্য। আমরা অনেকেই জানি যে মাটিতে প্রয়োগের ৭০ থেকে ৮০ ভাগই ইউরিয়া সারের অপচয় হয়। ইউরিয়া সারের অপপ্রয়োগ বা ধানের জমি সব সময়ের জন্য জলাবদ্ধ থাকলে জমিতে বেশি করে মিথেন উৎপন্ন হয়। এই মিথেন বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য দায়ী। অথচ একটু সচেতন হলে বা সেচের পানি ব্যবহারের ব্যাপারে সচেতন হলে আমরা মিথেন উদ্গিরণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারি। মাটির স্বাস্থ্য বজায় রাখতে পারি। এজন্য চাষি এবং সম্প্রসারণ কর্মীদের মধ্যে আরও বোঝাপড়ার দরকার আছে। আমার বিশ্বাস সাম্প্রতিক কালের স্মার্ট-যোগাযোগ ব্যবস্থা এখানে একটা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।

অতএব উফশী জাত ও প্রযুক্তি নিয়ে যে সমালোচনা হয় তার বেশিরভাগই প্রযুক্তির অপপ্রয়োগের কারণে। তবে উদ্ভাবিত জাত বা প্রযুক্তির যে দুর্বলতা নেই তা কিন্তু আমি অস্বীকার করি নে। সেটা অনেক সময় মাঠ পর্যায়ে না গেলে উদঘাটন করা যায় না। এমন হলে অভিযুক্ত জাত বা প্রযুক্তিকে পরিমার্জনের প্রয়োজনে আবার গবেষণাগাওে ফিরিয়ে আনার কাজ কিন্তু চলমান। তাই প্রযুক্তি অবশ্যই জেনে বুঝে ব্যবহার করতে হবে। যেমন অষুধ খাওয়ার আগে চিকিৎসকের কাছ থেকে অষুধের নিয়ম কানুন বুঝে নিতে হয়। ব্রি এখন মেধা ও মননে যথেষ্ট সমৃদ্ধ। তার গবেষণা সক্ষমতা আগের থেকে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই আগের অভিজ্ঞতাগুলোকে কাজে লাগিয়ে যথাযথ নেতৃত্ব সাপেক্ষে ব্রি এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে পা রাখবে এই কামনা।

[লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট; সাবেক নির্বাহী পরিচালক, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন ]

একাকিত্ব ও মানসিক অশান্তি

বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজ

ক্রেতা ঠকে গেলে তার আইনগত প্রতিকার

ঢাকার যানজট : কিছু প্রস্তাব

রম্যগদ্য : দারিদ্র্য যাবে জাদুঘরে

গার্মেন্টস খাতে সংকট

সরকারি হাসপাতালের টয়লেট ব্যবস্থাপনায় করুণ দশা

ডেঙ্গু থেকে বাঁচার উপায় কী

শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার বাড়াতে

বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির দুর্বলতা

ইরানের কেন কৌশলগত পরিবর্তন

শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন একে অন্যের পরিপূরক

রামু ট্র্যাজেডির এক যুগ

প্রত্যাশিত শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাবিত রূপরেখা

ব্যাংক খাতের সংস্কার

শিক্ষার একটি স্থায়ী কমিশন সময়ের দাবি

ছবি

ক্ষমতা এখন ‘মব’-এর হাতে

উচ্চ ফলনশীল বারি মসুর-৮

শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে বামপন্থির উত্থান

আমন ধানে আগাম ফুল আসার কারণ

উচ্চ ফলনশীল বারি মসুর-৮

কী হবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনীতি

রম্যগদ্য : ‘বল করে দুর্বল...’

মধ্যপ্রাচ্যে প্রযুক্তিগত যুদ্ধ

বন্যাপরবর্তী কৃষি উৎপাদনে সময়োপযোগী সহায়তা প্রদান

গুণগত উন্নয়নই সমাজের প্রকৃত উন্নতির চাবিকাঠি

বিশেষ শিশু ও বিশেষ শিক্ষালয়

বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস

সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার অধিকার

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি

প্রসঙ্গ : আনসার বাহিনী

শান্তির সংস্কৃতি : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

মব লিঞ্চিং আইনের শাসনের পরিপন্থি

মব জাস্টিসের মতো বর্বরতা বন্ধ হোক

বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে রাজনীতি

জাতীয় সংগীত নিয়ে বিতর্ক

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ব্রি: কিছু প্রশ্ন, কিছু উত্তর

জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস

শনিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৪

ব্রি ১ অক্টোবর ২০২৪ পঞ্চান্ন বছরে পা রাখল। তবে এটা পঞ্চান্ন না হয়ে পঁয়ষট্টি হতে পারত। কারণ ধান নিয়ে জোরদার গবেষণার প্রয়োজনে সরকারের বরাবরে প্রথম প্রকল্প জমা দেয়া হয় ১৯৫৫ সালে। প্রকল্পটি জমা দিয়েছিলেন ড. এ আলীম। সেটা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং পরিমার্জন-পরিবর্ধনের পর ঋঅঙ, ফোর্ড ফাউন্ডেশন এবং আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ইরি) সুপারিশক্রমে ১৯৬৫-৬৬ অর্থবছরে ঊধংঃ চধশরংঃধহ অপপবষবৎধঃবফ জরপব জবংবধৎপয (ঊচঅজজ) প্রকল্প নামে অনুমোদিত হয়। অতঃপর সাভারের দুগ্ধ-খামারের ২৫ একর জায়গা ভাড়া নিয়ে আধুনিক ধান গবেষণার যাত্রা শুরু। তখন সম্বল ছিল ফোর্ড ফাউন্ডেশনের ৩০ লাখ টাকা আর আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) থেকে পাওয়া ধানের ৩০০ কৌলিক সারি। সাভারে জমি ভাড়া নেয়ার কারণ হলো ঢাকায় অবস্থিত কৃষি-গবেষণার মূল জায়গাটা (মনিপুরী ফার্ম) সরকার অধিগ্রহণ করে নেয়।

সাভারের কার্যক্রম শুরুর দিনটি ছিল ২৬ মার্চ। অতঃপর ২৬ এপ্রিল থেকে ২৬ মের মধ্যে চারা রোপণ করা হয়। একই সাথে কুমিল্লায় অবস্থিত ঊধংঃ চধশরংঃধহ অপধফবসু ড়ভ জঁৎধষ উবাবষড়ঢ়সবহঃ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও ঊধংঃ চধশরংঃধহ ডধঃবৎ ধহফ চড়বিৎ উবাবষড়ঢ়সবহঃ অঁঃযড়ৎরঃু (ডঅচউঅ)-এদের কাছেও এক সেট করে বীজ পাঠানো হয়। তারা সবাই নিজেদের তো করে আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমে এগুলোর মাঠ পরীক্ষা সম্পন্ন করে। ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর ইরি থেকে অবমুক্তকৃত ওজ৮ জাতটি এই সব কৌলিক সারিগুলোর মধ্যে ছিল। ওজ৮ সে সময়ে আউশ, আমন এবং বোরো তিন মৌসুমেই দেশে প্রচলিত স্থানীয় উন্নত জাতগুলোর চেয়ে তিন-চার গুণ বেশি ফলন দেয়। তাই আর বেশি চিন্তাভাবনা না করে ১৯৬৭ সালে কৃষক পর্যায়ে আবাদের জন্য জাতটি অনুমোদন দেয়া হয়। সেই হিসেবে ধান-গবেষণার জন্মদিন হওয়া উচিত ছিল ১৯৬৬ সালের ২৬ মার্চ। কারণ ধান-গবেষণা কার্যক্রমে নিয়োজিত প্রকল্পটি তখনও স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা পায়নি।

ধান গবেষণার প্রাথমিক পর্যায়ের এই আশাব্যঞ্জক ফলাফলের কারণে ঊচঅজজ প্রকল্পের ১৯৬৮ সালে অর্থ বরাদ্দ ১ কোটি ৮০ লাখ টাকায় উন্নীত করা হয় এবং ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরে কৃষি-গবেষণার (এখন যেটা বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট) জন্য বরাদ্দকৃত ৬৪০ একর জমি থেকে দুই ধাপে ১৬৫ একর জমি দেয়া হয়। একই সঙ্গে প্রকল্পটি কোম্পানি আইনে নিবন্ধিত করে ইড়ধৎফ ড়ভ এড়াবৎহবৎং-এর আওতায় ন্যস্ত করে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দেয়া হয়। নাম দেয়া হয় ঊধংঃ চধশরংঃধহ জরপব জবংবধৎপয ওহংঃরঃঁঃব। সেদিন ছিল ১৯৭০ সালের ১ অক্টোবর। এই দিনটিই ব্রির জন্মদিন হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত।

ব্রির বর্তমান প্রেক্ষাপট সম্পর্কে দেশের সবাই মোটামুটি অবগত। আটটি হাইব্রিড ধানের জাতসহ উদ্ভাবিত জাতের সংখ্যা ১১৫। ধান বা কৃষিবিষয়ক উদ্ভাবিত প্রযুক্তির সংখ্যা দুই শতাধিক। দেশে এখন ভাতের অভাব নেই। তারপরেও সমালোচনা আছে। যেমন এতগুলো ধানের জাত উদ্ভাবন করার পরও মাঠে তো মাত্র কয়েকটা জাত দেখা যায়। ব্রি এখনও তিরিশ বছর আগে উদ্ভাবিত ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান২৯ বা বিআর১১ এর বলয় থেকে বের হতে পারেনি। পরিবেশবাদিরাও মুখিয়ে আছেন। কারণ উফশী ধানের আবাদে দেশের পানি ও পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মাটির উর্বরতা কমে গেছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। বালাই নাশকের ব্যবহার ক্রমাগত বাড়ছে। তাদের আরেকটি বিশেষ অভিযোগ হলো দেশের চাষিরা দিনে দিনে বিদেশি কোম্পানির কাছে নিজেদের বীজের অধিকার হারাচ্ছে।

১৯৭০ সাল থেকে ব্রি দেশের প্রধান ফসল ধান নিয়ে কাজ করছে। ধান একটি রাজনৈতিক ফসল। তাই ধান নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা হওয়া স্বাভাবিক। সব সমালোচনার জবাব এখানে দেয়ার সুযোগ নেই। তারপরেও বলছি। সত্তর দশকের শুরুতে দেশে চালের উৎপাদন ছিল আজকের তুলনায় চারভাগের এক ভাগ। জনসংখ্যা ছিল সাত কোটি। আজকের তুলনায় অর্ধেক। দেশে উফশী ধানের প্রযুক্তি না আসলে মোট উৎপাদন আগের পর্যায়ে থাকত। বা কমে যেতে পারত। কিন্তু জনসংখ্যা-বৃদ্ধি খুব একটা থেমে থাকত বলে মনে হয় না। তাহলে এই বাড়তি মানুষদের খাদ্য চাহিদা পূরণ হতো কীভাবে? পরিবেশবাদীরা অবশ্য বলে থাকেন প্রকৃতির সক্ষমতার কোনো শেষ নেই। একথা আমিও বিশ্বাস করি। তাই বলে কি শত-শত বছর ধরে ব্যবহৃত জাতগুলো আমাদের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হতো? তারা লৌকিক-কৃষির গাল-গল্প করে বেড়ান। সবগুলো দেশি ধানের জাতগুলোর ফলনক্ষমতা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখান। আর নিজেদের আওতায় উৎপাদিত কিছু ফসলের ভালো গুণাগুণ পুঁজি করে বেশিমূল্যে তাদের পণ্য বিক্রি করে থাকেন। অথচ এগুলো দেশের সাধারণ জনগণের কোনো উপকারে আসে না। উপকারভোগী হলো সেই উপরতলার তথাকথিত স্বাস্থ্যসচেতন কিছু ভদ্রজনেরা।

উল্টোদিকে; উদ্ভাবিত ধানের জাতগুলো আজকাল আগের জাতগুলো থেকে তিন থেকে চারগুণ ফলন বেশি দেয় বলেই দেশের মানুষ দুটো ভাত খেতে পারছে। আর এই সব জাতগুলো কিন্তু প্রকৃতির সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েই উদ্ভাবিত। উদ্বেগের বিষয় হলো কৃষিবিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে ধানের জাতগুলোই শুধু কৃষকদের নজরে আসে সহযোগী প্রযুক্তিগুলো নয়। তারা ধান রোপণ করে নিজেদের মতো করে পরিচর্যা করেন। ফলে সার এবং পানির পাশাপাশি বালাই নাশকেরও প্রচুর অপচয় ও অপব্যবহার হয়ে থাকে। এখানে কৃষিবিজ্ঞানীদের চেয়ে মাঠপর্যায়ে যারা আছেন তাদের দায়িত্ব বেশি। তারা একটু খেয়াল করলে এমনটি হওয়ার কথা নয়। আর জাত যত বেশি উদ্ভাবিত হচ্ছে ততই ভালো মনে করতে হবে।

কারণ এখনকার উদ্ভাবিত জাতগুলোর শুধু ফলনই বেশি নয় স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বৈরী পরিবেশে মানানসই। কিছু কিছু জাত সমসাময়িক রোগবালাই প্রতিরোধে সক্ষম। তবে এই সব জাতগুলো যে বছরের পর বছর ধরে বৈরী পরিবেশে টিকে থাকবে বা বালাই সহনশীল থাকবে এমন নয়। কারণ পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে কীট-পতঙ্গ এবং রোগ জীবাণুগুলো নিজেদেরকে দ্রুত খাপ-খাইয়ে নিতে সক্ষম। তাছাড়া মাত্রারিক্ত বালাই নাশক প্রয়োগের ফলেও অধিকাংশ বালাই যেমন রোগবালাই, কীটপতঙ্গ এমনকি আগাছা পর্যন্ত সহনশীল হয়ে পড়ে। তখন সেগুলোকে আর দমন করা যায় না। এসব কারণেই জাত বৈচিত্র্যের দরকার আছে। আর একটি জাত যতই জনপ্রিয় হোক না কোন পাঁচ-সাত বছরের বেশি মাঠে থাকা উচিত নয়। তাই এসব বিষয়ে আমাদেরকে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে; বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে পরিবেশের উপর বৈরী প্রভাব কমে আসবে।

সার ও পানি ব্যবহারের ব্যাপারে একই কথা প্রযোজ্য। আমরা অনেকেই জানি যে মাটিতে প্রয়োগের ৭০ থেকে ৮০ ভাগই ইউরিয়া সারের অপচয় হয়। ইউরিয়া সারের অপপ্রয়োগ বা ধানের জমি সব সময়ের জন্য জলাবদ্ধ থাকলে জমিতে বেশি করে মিথেন উৎপন্ন হয়। এই মিথেন বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য দায়ী। অথচ একটু সচেতন হলে বা সেচের পানি ব্যবহারের ব্যাপারে সচেতন হলে আমরা মিথেন উদ্গিরণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারি। মাটির স্বাস্থ্য বজায় রাখতে পারি। এজন্য চাষি এবং সম্প্রসারণ কর্মীদের মধ্যে আরও বোঝাপড়ার দরকার আছে। আমার বিশ্বাস সাম্প্রতিক কালের স্মার্ট-যোগাযোগ ব্যবস্থা এখানে একটা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।

অতএব উফশী জাত ও প্রযুক্তি নিয়ে যে সমালোচনা হয় তার বেশিরভাগই প্রযুক্তির অপপ্রয়োগের কারণে। তবে উদ্ভাবিত জাত বা প্রযুক্তির যে দুর্বলতা নেই তা কিন্তু আমি অস্বীকার করি নে। সেটা অনেক সময় মাঠ পর্যায়ে না গেলে উদঘাটন করা যায় না। এমন হলে অভিযুক্ত জাত বা প্রযুক্তিকে পরিমার্জনের প্রয়োজনে আবার গবেষণাগাওে ফিরিয়ে আনার কাজ কিন্তু চলমান। তাই প্রযুক্তি অবশ্যই জেনে বুঝে ব্যবহার করতে হবে। যেমন অষুধ খাওয়ার আগে চিকিৎসকের কাছ থেকে অষুধের নিয়ম কানুন বুঝে নিতে হয়। ব্রি এখন মেধা ও মননে যথেষ্ট সমৃদ্ধ। তার গবেষণা সক্ষমতা আগের থেকে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই আগের অভিজ্ঞতাগুলোকে কাজে লাগিয়ে যথাযথ নেতৃত্ব সাপেক্ষে ব্রি এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে পা রাখবে এই কামনা।

[লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট; সাবেক নির্বাহী পরিচালক, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন ]

back to top