alt

উপ-সম্পাদকীয়

আইন পেশার জানা-অজানা কথা

গাজী তারেক আজিজ

: রোববার, ০৬ অক্টোবর ২০২৪
image

ঐতিহাসিকভাবে, আইনজীবীদের ভূমিকা প্রাচীন সভ্যতা যেমন গ্রীস এবং রোমের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। আইন পেশাকে সহজ সাবলীল ভাষায় ওকালতি হিসেবে অভিহিত করা যায়। এতে করে সাধারণ মানুষের বুঝতে সুবিধা হয়। আর আইনজীবীদের উকিল সাহেব হিসেবে সম্বোধন করা হয়। আইন পেশার পরিধি ব্যাপক। আগে এই আইন পেশাকে ‘আইন ব্যবসা’ এবং আইনজীবীদের ‘আইন ব্যবসায়ী’ বলা হতো। কালের পরিক্রমায় আইন পেশা হিসেবে সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত, এতে বিজ্ঞ আইনজীবীরাও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে থাকেন। বিশেষজ্ঞ আইনজীবীদের অভিমত হচ্ছে, যদি এটাকে ব্যবসা হিসেবে চিন্তা করা হয়, তখন কেমন একটা বাণিজ্যিক ধ্যান ধারণা সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। বিজ্ঞ আইনজীবীরা আইনকে সেবার ব্রত নিয়ে পেশা পরিচালনা করেন।

বিশ্বের সব দেশেই এই পেশা মর্যাদাবান। বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত হচ্ছে, আইনজীবী বা লইয়ার, অ্যাডভোকেট বা অধিবক্তা, ব্যারিস্টার, কনভেয়েন্সার, নোটারি পাবলিক, আর সরকারি পদ-পদবিতে সর্বোচ্চ আদালতে অ্যাটর্নি জেনারেল, নিম্ন আদালতে; পাবলিক প্রসিকিউটর। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য দেশে সলিসিটর বা পরামর্শক নামে অভিহিত করা হলেও কাজ বহুলাংশেই একইরকম। তবে বাংলাদেশে শুধু আইনি পরামর্শক খুব একটা স্বীকৃত না হলেও আইনজীবীদের বেশ কদর রয়েছে। কারণ বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চিন্তা হচ্ছে পরামর্শ এবং আইনি লড়াইয়ে যারা সাপোর্ট দিতে পারবে কেবল তাদেরই গুরুত্ব। অর্থাৎ একই সঙ্গে দুই কাজ।

আবার লইয়ার এবং অ্যাডভোকেট এর মধ্যে অনেক ভিন্নতা থাকলেও বাংলাদেশে তা একই অর্থে এবং একই কাজে ও কাজের অধিক্ষেত্ররূপে ব্যবহৃত হয়, যা বাংলা শব্দে ভিন্নতা প্রদর্শন করা গেলেও আইনগত দিক দিয়ে আলাদা করা যায় না। বিশদভাবে বলতে গেলে লইয়ার এবং অ্যাডভোকেটের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। অর্থাৎ যাকে লইয়ার বলা হচ্ছে তিনি অ্যাডভোকেট না-ও হতে পারেন। আর সব অ্যাডভোকেটই লইয়ার। তাহলে কী দাঁড়ায় বিষয়টা? এদিক

থেকে একটু ইন্টারেস্টিং বটে। অ্যাডভোকেট হতে গেলে আরো বেশকিছু ধাপ অতিক্রম করতে হয়, যেটা লইয়ার হওয়ার ক্ষেত্রে হয় না। একজন আইন ডিগ্রিধারী ব্যক্তি আইনসম্পর্কিত যে কোন কাজে নিয়োজিত হয়ে কাজ করতে পারেন। যার অর্থ দাঁড়ায় তিনিও লইয়ার অর্থাৎ আইনজীবী! এক্ষেত্রে তার আর কোন বাড়তি আনুষ্ঠানিকতার বা কারো কিংবা কোন কর্তৃপক্ষের স্বীকৃতির দরকার নেই।

যেমনÑ বিভিন্ন ব্যাংকের স্টাফ লইয়ার এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লঅফিসারদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তাদের ক্ষেত্রে বার কাউন্সিলের স্বীকৃতির প্রয়োজনীয়তা নেই। ঠিক বিপরীতে অ্যাডভোকেটদের ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক দিক সম্পন্ন করেই স্বীকৃতি অর্জন করে নিতে হয়। বাংলাদেশে একমাত্র বাংলাদেশ বার কাউন্সিল কর্তৃক প্রদত্ত সনদধারী ব্যক্তিরাই অ্যাডভোকেট হিসেবে

স্বীকৃত। তা হয় সুনির্দিষ্ট কয়েকটি ধাপের পরীক্ষা শেষে উত্তীর্ণ হওয়ার ফলে। আর তখনই কোন না কোন বারের মেম্বার হয়ে আইন পেশা পরিচালনা করেন। সেক্ষেত্রে এই পেশাজীবীদের পদবির আগে বিজ্ঞ শব্দটি অনানুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হয়। তা আইনের নজির হিসেবে স্থাপিত।

এজন্য যে কোন অ্যাডভোকেটের নাম উচ্চারণের সময় বিজ্ঞ বা লার্নেড অ্যাডভোকেট রূপে সম্বোধন করা হয়ে থাকে, যা একজন পেশাদার অ্যাডভোকেটের ক্ষেত্রে মর্যাদার।

যদিও বার কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার আগে জানা যায়, আইন পেশাজীবীদের সনদ প্রদান বা অনুমতি প্রদান করতেন একজন মুন্সেফ! আবার কোন কারণ ছাড়াই সেই সনদ কিংবা অনুমতি বাতিলের ক্ষমতাও তারই ছিল। অর্থাৎ এক্ষেত্রে যদি সেই মুন্সেফ তথা বিচারক যদি স্বেচ্ছাচারী হতেন তবে তিনি তার ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে তা বাতিল করতে পারেন।

আইন পেশায় যদি সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা, পেশাদার মনোভাব না থাকে তবে একজন সফল আইনজীবী হওয়ার পথে নানা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করা দুষ্কর হয়ে পড়ে। একজন মক্কেল মনে করে অনৈতিক সুবিধা দেয়ার নামে যদি অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করে তবে সেটা ঘুষ। আর ঘুষ বিচারাঙ্গণে মারাত্মক ব্যাধিস্বরূপ। সে বিচারক হোক কিংবা অধস্তন কোন কর্মচারী হোক সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আসুন একটা প্রচলিত কৌতুক শুনি। এক মক্কেল তৎকালীন সময়ে দেখলেন বিচারকের পেশকার তার মক্কেলের প্রতিপক্ষের নিকট থেকে কিছু পাকা কলা নিয়েছে। সেই মক্কেলের মনে হলো এতে বিচারককে প্রভাবিত করে রায় বাগিয়ে নিতে সহায়তা করবে সেই পেশকার। ভুক্তভোগী মক্কেল দৌড়ে বিচারকের সামনে গিয়ে হাজির, বিচারক কারণ জিজ্ঞেস করলে মক্কেল হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে লাগলেন, স্যার স্যার ইওর পেশকার ইটিং ঘুষ! বিচারক পাল্টা প্রশ্নে মক্কেলকে বললেন, হোয়াট ইজ ঘুষ? মক্কেলের কথা ইংরেজিভাষী বিচারক কিছুই বুঝতে না পেরে মক্কেলের সঙ্গে এসে দেখেন কলার ছড়ি। মক্কেল আবারও বলল, স্যার স্যার দিস ইজ ঘুষ! ভাষাগত এবং ভাবগত তারতম্যের কারণে বিচারক উপলব্ধি করতে সক্ষম হলেন না যে মক্কেল কী বুঝিয়েছে। উল্টো মক্কেলের কথার বিপরীতে বিচারক পেশকার থেকে কলা নিয়ে নিজে খেলেন। আর বলতে লাগলে, দিস ইজ ঘুষ! ঘুষ ফর হেলদি ফ্রুট!

এই কৌতুক বলার কারণ হচ্ছে, মক্কেলের ভাষা বুঝতে পারা। বুঝতে গেলে মনোযোগ দিয়ে শোনার দক্ষতা একটা বিরাট বিষয়। সেটা অবশ্যই গভীর মনোযোগ হতে হবে। তারপর নিজে উপলব্ধি করে পরামর্শ, সহযোগিতা করা। ক্ষেত্রবিশেষে মামলায় লড়ে বিচারককে শুনানিতে কনভিন্স করে রায় পক্ষে নেয়ার কৌশল রপ্ত করা জরুরি। সেক্ষেত্রে পেশাগত জীবনের শুরুতে একজন বিজ্ঞ সিনিয়র অ্যাডভোকেটের চেম্বারে যুক্ত থেকে কাজ শুরু করতে হয়। চেম্বারে সিনিয়র মক্কেলের সঙ্গে কীভাবে কথা বলেন। কীভাবে কথা শোনেন। কীভাবে পরামর্শ প্রদান করেন তা গভীর পর্যবেক্ষণী দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করে আয়ত্তে আনতে হবে।

এখন আধুনিক যুগ। এই সময়েও দেখা যায় আইনজীবীদের পোশাক পরিচ্ছেদ সচেতনতা অনেকাংশেই নেই বললে চলে। কারণটাও জানা জরুরি। একজন আইনজীবী বার কাউন্সিল নির্ধারিত পোশাক পরিধান করবেন। এর কোন ব্যত্যয় যাতে না ঘটে সে দিকটায় খেয়াল রাখাও জরুরি। কারণ একজন আইনজীবীকে অন্য আর দশজন সাধারণ জনগণ থেকে পোশাক এবং পোশাকি চরিত্রই পারে আলাদা করতে। তিনি পরিধান করবেন, শাদা শার্ট, কালো টাই, কালো কোট, সাদা অথবা কালো প্যান্ট, কালো জুতো আর একটা গাউন। এই গাউন একজন আইনজীবীর পেশাগত মর্যাদা অনেক বাড়িয়ে দেয়। তবে কিছু ভুল ধারণাও আছে, একজন আইনজীবীর জন্য আরো জানা জরুরি হচ্ছে অন্যদের থেকে আইনজীবীর কোটের হাতা হবে একটু শর্ট অর্থাৎ শাদা ফুল শার্টের হাতা কোটের বাহির থেকে দেখে যাবে। তার মানে কোটের হাতা

থেকে একটু বড় হবে শার্টের হাতা। আর অবশ্যই পোশাক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হতে হবে। সাধারণ মানুষ একটি সাইকোলজি মেনে চলে, সেটা হলো উকিল যদি অপরিষ্কার চলাফেরা করে মনে করতে পারে যে, এই উকিল তার পোশাকের মতোই জর্জরিত। তার মানে হচ্ছে, যে নিজে সমস্যায় ভোগে সে অন্যের সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম হবে না।

আইনজীবীদের অবশ্যই মেনে চলা উচিত আদালতেই শুধু বিশেষ পোশাক পরিধানযোগ্য। অর্থাৎ গাউন এবং নেক ব্যান্ড আদালত ছাড়া অন্যত্র পরিধান করার সুযোগ নেই। এই মর্যাদাবান পেশা সম্পর্কে বহুল প্রচলিত একটা গল্প আছে সেটা হলো, আগেকার আইনজীবীরা কখনো মক্কেল বা বিচারপ্রার্থী থেকে পরামর্শ কিংবা আইনি সহযোগিতা বাবদ কোন ফি চেয়ে নিতেন না। মক্কেল যে যার ইচ্ছে তা-ই দিয়ে যেত। আর সেটাও বিশেষ কায়দায়। গাউনের পেছনে একটা ছোট ব্যাগ যেটা গাউনের সঙ্গেই সেলাই করা থাকত, সেই ব্যাগে পুরে দিত।

কালের বিবর্তনে এখনো সেই ব্যাগ আছে তবে মুখ বন্ধ অবস্থায়। সে অবস্থার পরিবর্তিত হয়ে এখন বিজ্ঞ আইনজীবীরা ডিমান্ড করে ফি কিংবা সম্মানি নিয়ে থাকেন।

আবার আদালতের প্রতিও আইনজীবীদের অবশ্য পালনীয় কিছু কর্তব্য আছে। আদালতের কোন আদেশের বিরুদ্ধে বিরূপ কোন মন্তব্য করা যাবে না। করলে তা হবে অনুচিত এবং অনভিপ্রেত। কারণ বিজ্ঞ আইনজীবীরা আদালতে বিশেষ মর্যাদা পেয়ে থাকেন। তা হলো কোর্ট অফিসার। অর্থাৎ আইনজীবীরাও কোর্টের অংশ বলে বিবেচিত হয়ে থাকেন। ইতোপূর্বে উচ্চ আদালত এমনটাই বিভিন্ন মামলায় শুনানিকালীন মন্তব্য করেছেন। আবার এ-ও বলেছেন, বার এবং বেঞ্চ একটি পাখির দুটি পাখা, একটিকে ছাড়া অপর পাখা দিয়ে যেমন পাখি উড়তে পারে না ঠিক তদ্রুপ আইনজীবী ছাড়া বিচার অপূর্ণ থেকে যাবে। আর বেঞ্চ বলতে বিচারককে বোঝানো হয়।

কোন মক্কেলের পক্ষে মামলা লড়তে আইনজীবীরা স্বাধীন। অর্থাৎ পছন্দসই কোন মামলা না হলে তিনি গ্রহণ না করলেও কেউ বাধ্য করতে পারবে না। আর একজন আইনজীবীর চেম্বারকে আইনের প্রাথমিক নিরাপদ স্থান অর্থাৎ যদি কোন অভিযুক্ত আসামি বিজ্ঞ আইনজীবীর চেম্বারে উপস্থিত হয়ে মামলার বিষয়ে কোন পরামর্শ কিংবা সহায়তা চাইতে অবস্থান করেন, সেই বিচারপ্রার্থী যদি প্রাথমিক তদন্তে অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত মর্মে প্রমাণ থেকেও থাকে তবুও তাকে আইনজীবীর চেম্বার থেকে গ্রেপ্তার করা যাবে না মর্মেও মানা হয়ে থাকে। যদিও এর ব্যতিক্রমও দেখা যায়।

আইনজীবীরা প্রাইভেট প্রাকটিসের বাহিরে কর্পোরেট চেম্বারেও যুক্ত হতে পারেন। সর্বোপরি, আইন একটি মর্যাদাবান পেশা। দেশের সর্বোচ্চ একাডেমিক ডিগ্রি অর্জনের পর, একজন প্রবীণ অর্থাৎ আইনগতভাবে দশ বছর অতিক্রান্ত সিনিয়রের সঙ্গে অন্যূন ছয় মাস সময়সীমাতে পিউপিলেজ কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে আইন অঙ্গনে হাঁটি হাঁটি পা পা করে শুরু। স্তরভিত্তিক বিভিন্ন পরীক্ষায় সফল সমাপ্তি অন্তে পেশাগত সনদ পেয়ে অ্যাডভোকেট হয়ে পেশাজীবন শুরু করলেও

বিভিন্ন চড়াইউৎরাই পেরিয়ে একজন দক্ষ ও সফল আইনজীবী হয়ে দেশের বিচারপ্রার্থী সাধারণ জনগণকে সেবা দিয়েই নিজেকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেই আমৃত্যু পেশা পরিচালনা করেন তিনি একজন বিজ্ঞ অ্যাডভোকেট।

[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]

জামাই মেলা : উৎসব, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির রঙিন চিত্রপট

হারিয়ে যাওয়া ক্লাস, কঠোর মূল্যায়ন আর প্রশ্নের জটিলতায় নুয়ে পড়া এক প্রজন্ম

বৈষম্য দূর করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলুন

চিকিৎসা যেন বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত না হয়

পথশিশু ও বাংলাদেশে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা

মেগা প্রকল্প : প্রশ্ন হওয়া উচিত স্বচ্ছতা নিয়ে

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি

স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : উপগ্রহ চিত্র ও ওয়েবসাইটের অপরিহার্যতা

ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন : আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

tab

উপ-সম্পাদকীয়

আইন পেশার জানা-অজানা কথা

গাজী তারেক আজিজ

image

রোববার, ০৬ অক্টোবর ২০২৪

ঐতিহাসিকভাবে, আইনজীবীদের ভূমিকা প্রাচীন সভ্যতা যেমন গ্রীস এবং রোমের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। আইন পেশাকে সহজ সাবলীল ভাষায় ওকালতি হিসেবে অভিহিত করা যায়। এতে করে সাধারণ মানুষের বুঝতে সুবিধা হয়। আর আইনজীবীদের উকিল সাহেব হিসেবে সম্বোধন করা হয়। আইন পেশার পরিধি ব্যাপক। আগে এই আইন পেশাকে ‘আইন ব্যবসা’ এবং আইনজীবীদের ‘আইন ব্যবসায়ী’ বলা হতো। কালের পরিক্রমায় আইন পেশা হিসেবে সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত, এতে বিজ্ঞ আইনজীবীরাও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে থাকেন। বিশেষজ্ঞ আইনজীবীদের অভিমত হচ্ছে, যদি এটাকে ব্যবসা হিসেবে চিন্তা করা হয়, তখন কেমন একটা বাণিজ্যিক ধ্যান ধারণা সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। বিজ্ঞ আইনজীবীরা আইনকে সেবার ব্রত নিয়ে পেশা পরিচালনা করেন।

বিশ্বের সব দেশেই এই পেশা মর্যাদাবান। বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত হচ্ছে, আইনজীবী বা লইয়ার, অ্যাডভোকেট বা অধিবক্তা, ব্যারিস্টার, কনভেয়েন্সার, নোটারি পাবলিক, আর সরকারি পদ-পদবিতে সর্বোচ্চ আদালতে অ্যাটর্নি জেনারেল, নিম্ন আদালতে; পাবলিক প্রসিকিউটর। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য দেশে সলিসিটর বা পরামর্শক নামে অভিহিত করা হলেও কাজ বহুলাংশেই একইরকম। তবে বাংলাদেশে শুধু আইনি পরামর্শক খুব একটা স্বীকৃত না হলেও আইনজীবীদের বেশ কদর রয়েছে। কারণ বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চিন্তা হচ্ছে পরামর্শ এবং আইনি লড়াইয়ে যারা সাপোর্ট দিতে পারবে কেবল তাদেরই গুরুত্ব। অর্থাৎ একই সঙ্গে দুই কাজ।

আবার লইয়ার এবং অ্যাডভোকেট এর মধ্যে অনেক ভিন্নতা থাকলেও বাংলাদেশে তা একই অর্থে এবং একই কাজে ও কাজের অধিক্ষেত্ররূপে ব্যবহৃত হয়, যা বাংলা শব্দে ভিন্নতা প্রদর্শন করা গেলেও আইনগত দিক দিয়ে আলাদা করা যায় না। বিশদভাবে বলতে গেলে লইয়ার এবং অ্যাডভোকেটের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। অর্থাৎ যাকে লইয়ার বলা হচ্ছে তিনি অ্যাডভোকেট না-ও হতে পারেন। আর সব অ্যাডভোকেটই লইয়ার। তাহলে কী দাঁড়ায় বিষয়টা? এদিক

থেকে একটু ইন্টারেস্টিং বটে। অ্যাডভোকেট হতে গেলে আরো বেশকিছু ধাপ অতিক্রম করতে হয়, যেটা লইয়ার হওয়ার ক্ষেত্রে হয় না। একজন আইন ডিগ্রিধারী ব্যক্তি আইনসম্পর্কিত যে কোন কাজে নিয়োজিত হয়ে কাজ করতে পারেন। যার অর্থ দাঁড়ায় তিনিও লইয়ার অর্থাৎ আইনজীবী! এক্ষেত্রে তার আর কোন বাড়তি আনুষ্ঠানিকতার বা কারো কিংবা কোন কর্তৃপক্ষের স্বীকৃতির দরকার নেই।

যেমনÑ বিভিন্ন ব্যাংকের স্টাফ লইয়ার এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লঅফিসারদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তাদের ক্ষেত্রে বার কাউন্সিলের স্বীকৃতির প্রয়োজনীয়তা নেই। ঠিক বিপরীতে অ্যাডভোকেটদের ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক দিক সম্পন্ন করেই স্বীকৃতি অর্জন করে নিতে হয়। বাংলাদেশে একমাত্র বাংলাদেশ বার কাউন্সিল কর্তৃক প্রদত্ত সনদধারী ব্যক্তিরাই অ্যাডভোকেট হিসেবে

স্বীকৃত। তা হয় সুনির্দিষ্ট কয়েকটি ধাপের পরীক্ষা শেষে উত্তীর্ণ হওয়ার ফলে। আর তখনই কোন না কোন বারের মেম্বার হয়ে আইন পেশা পরিচালনা করেন। সেক্ষেত্রে এই পেশাজীবীদের পদবির আগে বিজ্ঞ শব্দটি অনানুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হয়। তা আইনের নজির হিসেবে স্থাপিত।

এজন্য যে কোন অ্যাডভোকেটের নাম উচ্চারণের সময় বিজ্ঞ বা লার্নেড অ্যাডভোকেট রূপে সম্বোধন করা হয়ে থাকে, যা একজন পেশাদার অ্যাডভোকেটের ক্ষেত্রে মর্যাদার।

যদিও বার কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার আগে জানা যায়, আইন পেশাজীবীদের সনদ প্রদান বা অনুমতি প্রদান করতেন একজন মুন্সেফ! আবার কোন কারণ ছাড়াই সেই সনদ কিংবা অনুমতি বাতিলের ক্ষমতাও তারই ছিল। অর্থাৎ এক্ষেত্রে যদি সেই মুন্সেফ তথা বিচারক যদি স্বেচ্ছাচারী হতেন তবে তিনি তার ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে তা বাতিল করতে পারেন।

আইন পেশায় যদি সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা, পেশাদার মনোভাব না থাকে তবে একজন সফল আইনজীবী হওয়ার পথে নানা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করা দুষ্কর হয়ে পড়ে। একজন মক্কেল মনে করে অনৈতিক সুবিধা দেয়ার নামে যদি অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করে তবে সেটা ঘুষ। আর ঘুষ বিচারাঙ্গণে মারাত্মক ব্যাধিস্বরূপ। সে বিচারক হোক কিংবা অধস্তন কোন কর্মচারী হোক সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আসুন একটা প্রচলিত কৌতুক শুনি। এক মক্কেল তৎকালীন সময়ে দেখলেন বিচারকের পেশকার তার মক্কেলের প্রতিপক্ষের নিকট থেকে কিছু পাকা কলা নিয়েছে। সেই মক্কেলের মনে হলো এতে বিচারককে প্রভাবিত করে রায় বাগিয়ে নিতে সহায়তা করবে সেই পেশকার। ভুক্তভোগী মক্কেল দৌড়ে বিচারকের সামনে গিয়ে হাজির, বিচারক কারণ জিজ্ঞেস করলে মক্কেল হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে লাগলেন, স্যার স্যার ইওর পেশকার ইটিং ঘুষ! বিচারক পাল্টা প্রশ্নে মক্কেলকে বললেন, হোয়াট ইজ ঘুষ? মক্কেলের কথা ইংরেজিভাষী বিচারক কিছুই বুঝতে না পেরে মক্কেলের সঙ্গে এসে দেখেন কলার ছড়ি। মক্কেল আবারও বলল, স্যার স্যার দিস ইজ ঘুষ! ভাষাগত এবং ভাবগত তারতম্যের কারণে বিচারক উপলব্ধি করতে সক্ষম হলেন না যে মক্কেল কী বুঝিয়েছে। উল্টো মক্কেলের কথার বিপরীতে বিচারক পেশকার থেকে কলা নিয়ে নিজে খেলেন। আর বলতে লাগলে, দিস ইজ ঘুষ! ঘুষ ফর হেলদি ফ্রুট!

এই কৌতুক বলার কারণ হচ্ছে, মক্কেলের ভাষা বুঝতে পারা। বুঝতে গেলে মনোযোগ দিয়ে শোনার দক্ষতা একটা বিরাট বিষয়। সেটা অবশ্যই গভীর মনোযোগ হতে হবে। তারপর নিজে উপলব্ধি করে পরামর্শ, সহযোগিতা করা। ক্ষেত্রবিশেষে মামলায় লড়ে বিচারককে শুনানিতে কনভিন্স করে রায় পক্ষে নেয়ার কৌশল রপ্ত করা জরুরি। সেক্ষেত্রে পেশাগত জীবনের শুরুতে একজন বিজ্ঞ সিনিয়র অ্যাডভোকেটের চেম্বারে যুক্ত থেকে কাজ শুরু করতে হয়। চেম্বারে সিনিয়র মক্কেলের সঙ্গে কীভাবে কথা বলেন। কীভাবে কথা শোনেন। কীভাবে পরামর্শ প্রদান করেন তা গভীর পর্যবেক্ষণী দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করে আয়ত্তে আনতে হবে।

এখন আধুনিক যুগ। এই সময়েও দেখা যায় আইনজীবীদের পোশাক পরিচ্ছেদ সচেতনতা অনেকাংশেই নেই বললে চলে। কারণটাও জানা জরুরি। একজন আইনজীবী বার কাউন্সিল নির্ধারিত পোশাক পরিধান করবেন। এর কোন ব্যত্যয় যাতে না ঘটে সে দিকটায় খেয়াল রাখাও জরুরি। কারণ একজন আইনজীবীকে অন্য আর দশজন সাধারণ জনগণ থেকে পোশাক এবং পোশাকি চরিত্রই পারে আলাদা করতে। তিনি পরিধান করবেন, শাদা শার্ট, কালো টাই, কালো কোট, সাদা অথবা কালো প্যান্ট, কালো জুতো আর একটা গাউন। এই গাউন একজন আইনজীবীর পেশাগত মর্যাদা অনেক বাড়িয়ে দেয়। তবে কিছু ভুল ধারণাও আছে, একজন আইনজীবীর জন্য আরো জানা জরুরি হচ্ছে অন্যদের থেকে আইনজীবীর কোটের হাতা হবে একটু শর্ট অর্থাৎ শাদা ফুল শার্টের হাতা কোটের বাহির থেকে দেখে যাবে। তার মানে কোটের হাতা

থেকে একটু বড় হবে শার্টের হাতা। আর অবশ্যই পোশাক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হতে হবে। সাধারণ মানুষ একটি সাইকোলজি মেনে চলে, সেটা হলো উকিল যদি অপরিষ্কার চলাফেরা করে মনে করতে পারে যে, এই উকিল তার পোশাকের মতোই জর্জরিত। তার মানে হচ্ছে, যে নিজে সমস্যায় ভোগে সে অন্যের সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম হবে না।

আইনজীবীদের অবশ্যই মেনে চলা উচিত আদালতেই শুধু বিশেষ পোশাক পরিধানযোগ্য। অর্থাৎ গাউন এবং নেক ব্যান্ড আদালত ছাড়া অন্যত্র পরিধান করার সুযোগ নেই। এই মর্যাদাবান পেশা সম্পর্কে বহুল প্রচলিত একটা গল্প আছে সেটা হলো, আগেকার আইনজীবীরা কখনো মক্কেল বা বিচারপ্রার্থী থেকে পরামর্শ কিংবা আইনি সহযোগিতা বাবদ কোন ফি চেয়ে নিতেন না। মক্কেল যে যার ইচ্ছে তা-ই দিয়ে যেত। আর সেটাও বিশেষ কায়দায়। গাউনের পেছনে একটা ছোট ব্যাগ যেটা গাউনের সঙ্গেই সেলাই করা থাকত, সেই ব্যাগে পুরে দিত।

কালের বিবর্তনে এখনো সেই ব্যাগ আছে তবে মুখ বন্ধ অবস্থায়। সে অবস্থার পরিবর্তিত হয়ে এখন বিজ্ঞ আইনজীবীরা ডিমান্ড করে ফি কিংবা সম্মানি নিয়ে থাকেন।

আবার আদালতের প্রতিও আইনজীবীদের অবশ্য পালনীয় কিছু কর্তব্য আছে। আদালতের কোন আদেশের বিরুদ্ধে বিরূপ কোন মন্তব্য করা যাবে না। করলে তা হবে অনুচিত এবং অনভিপ্রেত। কারণ বিজ্ঞ আইনজীবীরা আদালতে বিশেষ মর্যাদা পেয়ে থাকেন। তা হলো কোর্ট অফিসার। অর্থাৎ আইনজীবীরাও কোর্টের অংশ বলে বিবেচিত হয়ে থাকেন। ইতোপূর্বে উচ্চ আদালত এমনটাই বিভিন্ন মামলায় শুনানিকালীন মন্তব্য করেছেন। আবার এ-ও বলেছেন, বার এবং বেঞ্চ একটি পাখির দুটি পাখা, একটিকে ছাড়া অপর পাখা দিয়ে যেমন পাখি উড়তে পারে না ঠিক তদ্রুপ আইনজীবী ছাড়া বিচার অপূর্ণ থেকে যাবে। আর বেঞ্চ বলতে বিচারককে বোঝানো হয়।

কোন মক্কেলের পক্ষে মামলা লড়তে আইনজীবীরা স্বাধীন। অর্থাৎ পছন্দসই কোন মামলা না হলে তিনি গ্রহণ না করলেও কেউ বাধ্য করতে পারবে না। আর একজন আইনজীবীর চেম্বারকে আইনের প্রাথমিক নিরাপদ স্থান অর্থাৎ যদি কোন অভিযুক্ত আসামি বিজ্ঞ আইনজীবীর চেম্বারে উপস্থিত হয়ে মামলার বিষয়ে কোন পরামর্শ কিংবা সহায়তা চাইতে অবস্থান করেন, সেই বিচারপ্রার্থী যদি প্রাথমিক তদন্তে অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত মর্মে প্রমাণ থেকেও থাকে তবুও তাকে আইনজীবীর চেম্বার থেকে গ্রেপ্তার করা যাবে না মর্মেও মানা হয়ে থাকে। যদিও এর ব্যতিক্রমও দেখা যায়।

আইনজীবীরা প্রাইভেট প্রাকটিসের বাহিরে কর্পোরেট চেম্বারেও যুক্ত হতে পারেন। সর্বোপরি, আইন একটি মর্যাদাবান পেশা। দেশের সর্বোচ্চ একাডেমিক ডিগ্রি অর্জনের পর, একজন প্রবীণ অর্থাৎ আইনগতভাবে দশ বছর অতিক্রান্ত সিনিয়রের সঙ্গে অন্যূন ছয় মাস সময়সীমাতে পিউপিলেজ কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে আইন অঙ্গনে হাঁটি হাঁটি পা পা করে শুরু। স্তরভিত্তিক বিভিন্ন পরীক্ষায় সফল সমাপ্তি অন্তে পেশাগত সনদ পেয়ে অ্যাডভোকেট হয়ে পেশাজীবন শুরু করলেও

বিভিন্ন চড়াইউৎরাই পেরিয়ে একজন দক্ষ ও সফল আইনজীবী হয়ে দেশের বিচারপ্রার্থী সাধারণ জনগণকে সেবা দিয়েই নিজেকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেই আমৃত্যু পেশা পরিচালনা করেন তিনি একজন বিজ্ঞ অ্যাডভোকেট।

[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]

back to top