এম মনির উদ্দিন
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট (ব্রি) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে আর্ন্তজাতিক ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট (ইরি) ১৯৬৭ সালে বাংলাদেশে প্রথম উচ্চ ফলনশীল আধুনিক ধানের জাত আইআর-৮ প্রবর্তন করে এবং এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের কৃষিতে আধুনিক কৃষির চর্চা শুরু হয়। বিশেষ করে, স্বাধীনতার পর দেশে বিএডিসি আধুনিক ধান চাষের সুবিধার্থে ধানের জমিতে পানি সেচ সহজলভ্য করার জন্য ভু-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের জন্য গভীর নলকূপ স্থাপন করে এবং এর সাথে সাথে দেশে আইআর-৮ আধুনিক জাতের ধানের চাষ বাড়তে থাকে, যা বাংলাদেশকে খাদ্য ঘাটতির দেশ থেকে আজকের খাদ্য নিরাপত্তার দেশে পরিণত করার এক মাইলফলক হিসেবে কাজ করে।
দেশের সনাতনী কৃষির পরিবর্তে জমিতে সার, বালাইনাশক, পানিসেচ ব্যবহারের মাধ্যমে আইআর-৮ জাতটি হেক্টরে ফলন দেয় ৮-৯.৫ টন। আধুনিক কৃষির ছোয়ায় কৃষকদের মাঝে প্রানচাঞ্চ্যলতা ফিরে আসতে থাকে এবং প্রথমদিকে জমির উর্বরতা মান ভালো থাকায় মোটা জাতের আরআই-৮ ধানের ব্যাপক ফলনে বাজ্ঞালীর ভাতভিত্তিক খাদ্যাভাসের সহজীকরণ হতে থাকে। এই জাতটি দীর্ঘদিন কৃষকের জমিতে ভালো ফলন দিতে সক্ষম হয় তবে ১৯৯০ এর শুরুর দিক থেকে জাতটি রোগ পোকার প্রতি সংবেদনশীল হতে থাকে যার কারণে ফলনও কমতে থাকে।
ইতোমধ্যে দেশে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট (ব্রি) কাজ শুরু করে এবং বেশ কয়েকটি আধুনিক ধানের জাত উদ্ভাবন করে, যা অঞ্চল ও মৌসুমভিত্তিক ক্রমান্বয়ে মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারিত হতে থাকে। তবে ফলন কম হলেও কৃষক আইআর-৮ এর চাষ ছাড়তে চায়না। এমন অবস্থায় ধানের বিকল্প জাতের মাধ্যমে দেশের খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর প্রত্যয় নিয়ে ব্রি দেশের সব এলাকার জন্য চাষ উপযোগী দুইটি ধানের জাত ব্রি ধান ২৮ এবং ব্রি ধান ২৯ ১৯৯৪ সালে অবমুক্ত করে এবং এই দুইটি ধানের জাত পরবর্তীতে দেশের ধানের উৎপাদন বাড়াতে নতুন মাইলফলক হিসেবে কাজ করে। তবে এই জাত দুইটি মাঠপর্যায়ে খুব সহজে সম্প্রসারণ করা সম্ভব হয়নি। কারণ আইআর-৮ যখন বিঘায় ১০-১২ মন ফলন দিচ্ছে তখনো কৃষক বিকল্প কোন জাত ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছিলো না। অর্থাৎ কৃষকেরা দীর্ঘদিন ধরে চাষ করার ফলে আইআর-৮ এর মোহ থেকে বের হয়ে আসতে পারছিলোনা। এভাবে দেশে ২০০০ সালের পরেও আইআর-৮ এর চাষ অব্যাহত ছিলো।
পরবর্তী সময়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নিবিড় প্রদর্শনী স্থাপনসহ বিভিন্ন সচেতনতামুলক কার্যক্রমের ফলে ধীরে ধীরে ব্রি ধান ২৮ এবং ব্রি ধান ২৯ এর সম্প্রসারণ হতে থাকে এবং ২০১৮ সাল পর্যন্ত কৃষকেরা অন্যান্য আরো উচ্চ ফলনশীল অনেক জাত ব্রি থেকে বের হলেও মূলত ব্রি ধান ২৮ এবং ব্রি ধান ২৯ এর চাষ অব্যাহত রাখে। কয়েক বছর ধরেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় কৃষকেরা ব্রি ধান ২৮ চাষ করে বিড়ম্বনায় পড়ে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে বোরো মৌসুমে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ব্রি ধান ২৮ জাতটি ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হওয়ায় কৃষকেরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইতোমধ্যে জাতটি ব্লাস্ট রোগে অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হওয়ার কারনে কৃষি বিভাগ এর চাষ নিষিদ্ধ করেছে এবং কৃষকেরাও বিকল্প জাত চাষ শুরু করছে।
ব্রি ধান ২৯ এর ফলন হেক্টরে ১০ টন পর্যন্ত কৃষকের জমিতে পাওয়া গেছে এবং দেশের বোরো ধানের অধিকাংশ এলাকা এক সময় ব্রি ধান ২৯ চাষের আওতায় চলে আসে। সম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের জনপ্রিয় এই ব্রি ধান ২৯ জাতটিও ব্লাস্ট রোগের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে পড়ে এবং বর্তমানে এই জাতটির চাষেও একটি বড় ধরনের ঝটুকি রয়েছে। কারণ ব্রি ধান ২৯ জাতটি যদি আবহাওয়াজনিত কারণে আংশিকভাবেও ব্লাস্ট রোগের শিকার হয় তাহলে বোরো মৌসুমের মোট ধানের উৎপাদনে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলবে। ব্রি বিগত দিনগুলোতে গবেষণা চালিয়ে জলবায়ুর পরিবর্তন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে জলবায়ুবান্ধব উচ্চ ফলনশীল এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ বেশ কয়েকটি ধানের জাত অবমুক্ত করেছে বোরো মৌসুমে চাষ করার জন্য। পক্ষান্তরে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ব্রি ধান ২৮ এবং ব্রি ধান ২৯ এর পরিবর্তে কৃষকদের উচ্চ ফলনশীল নতুন জাতগুলো চাষাবাদের জন্য উদ্বুদ্ধ করছে। তবে কৃষক ওই আইআর-৮ এর মতো ব্রি ধান ২৮ ও ব্রি ধান ২৯ এর মায়ায় পড়ে রয়েছে।
দেশের প্রধান খাদ্য ফসল ধানের ৩টি মৌসুম যেমন বোরো, আমন, আউশ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফলন আসে বোরো মৌসুম থেকে। বোরো মৌসুম থেকে আরো বেশি ধানের উৎপাদন নিয়ে আসা সম্ভব এবং এটি দেশের ক্রমবর্ধমান মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটাতে আবশ্যক। তবে এর জন্য সঠিক জাত নির্বাচন একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্তমানে ব্রি কর্তৃক অবমুক্ত হওয়া উচ্চ ফলনশীল বোরো জাতের মধ্যে ব্রি ধান ৭৪, ব্রি ধান ৮৯, ব্রি ধান ৯০, ব্রি ধান ৯২, ব্রি ধান ১০০, ব্রি ধান ১০২, ব্রি ধান ১০৪, ব্রি ধান ১০৫, ব্রি ধান ১০৭, ব্রি ধান ১০৮ এবং বিনা ধান ২৫ উল্লেখযোগ্য।
ইতোমধ্যে জলবায়ুর পরিবর্তন দেশের কৃষি উৎপাদন বিশেষ করে ধানের ফলনে প্রভাব ফেলেছে। গত বোরো মৌসুমে মার্চ-এপ্রিলে তাপমাত্রা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৪০-৪৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে উঠানামা করেছে, যা আমাদের গতানুগতিক বোরো ধানের জাতগুলোর ফুল ফোটার সময়ে অতিরিক্ত তাপমাত্রা ফলনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতেই পারে। সেই সঙ্গে তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে আশঙ্কা বেড়ে যায় ব্লাস্ট রোগের, যার আক্রমণের শিকার হতে পারে ব্রি ধান ২৮ এবং ব্রি ধান ২৯।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, বেশ কয়েকটি প্রাইভেট বীজ বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ব্রি ধান ২৮ এবং ব্রি ধান ২৯ এর বীজ বিক্রয়ের জন্য ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছে। কোন একটি বীজ বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান যে, ব্রি ধান ২৯ এখনো দেশের মেগা ভ্যারাইটি এবং বোরো মৌসুমে ব্রি ধান ২৯ এর চাষের এলাকা বেশি। তাদের মতে, ব্রি ধান ২৯-কে টেক্কা দেয়ার মতো এখনো সেইরকম কোন জাত বের হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির মতে, ব্রি ধান ২৯ এখনো ব্রি ধান ৫৮, ব্রি ধান ৮৯, ব্রি ধান ৯২, ব্রি ধান ১০২ থেকে বিঘায় ২-৩ মন ফলন বেশি দেয়। দেশের উত্তরাঞ্চল বিশেষ করে ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুরে ব্রি ধান ২৯ এর বীজ ১০০০ কেজি বিক্রয় হলে অন্যান্য জাতের বীজ নাকি বিক্রয় হয় ৫০ কেজি।
এখন বিবেচ্য বিষয় হলো যে, ব্রি ধান ২৯ নিঃসন্দেহে একটি ভালো ধানের জাত যার ফলনও বেশ সন্তোষজনক। তবে ব্রি ধান ২৮ এবং ব্রি ধান ২৯ অবশ্যই ব্লাস্ট রোগের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং যদি ব্লাস্ট রোগের বড় ধরনের কোন বিপর্যয় হয় তাহলে বোরো উৎপাদনে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটবে এই ব্রি ধান ২৮ এবং ব্রি ধান ২৯ চাষের কারনে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ব্রি ধান ২৮ এবং ব্রি ধান ২৯ এর চাষ কমিয়ে যেখানে নতুন জাতগুলো প্রবর্তনের চেষ্টা করছে সেখানে প্রাইভেট বীজ প্রতিষ্ঠানগুলো কিভাবে অপরিকল্পিতভাবে ব্রি ধান ২৮ এবং ব্রি ধান ২৯ এর বীজ বিক্রয় করে চলছে তা বোধগম্য নয় এবং এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানের কোন মনিটরিং আদৌ আছে কিনা সন্দেহ।
চলতি আমন মৌসুমে দেশের পূর্বাঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলে বন্যার কারণে আমনের ফলন কিছুটা কমে যেতে পারে যা উত্তরণের জন্য আসন্ন বোরো মৌসুমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল মিলে বোরোর আওতায় জমির পরিমাণ বাড়ানোর জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যসূত্রে জানা যায়, আগামী বোরো চাষের আওতায় জমির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে প্রায় ৫১ লাখ হেক্টর; যা অর্জিত হলে দেশের বোরো ধানের উৎপাদন অনেকাংশে বেড়ে যাবে যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় অত্যন্ত সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়।
আরো জানা যায়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আগামী বোরো মৌসুমে ৩০ লাখ বিঘার জন্য প্রণোদনার আওতায় কৃষকের মাঝে বীজ ও সার বিনামূল্যে বিতরণ করবে। প্রণোদনার আওতায় বিতরণকৃত বোরো ধানের জাতগুলো হবে ব্রি ধান ৬৭, জিংক সমৃদ্ধ ব্রি ধান ৭৪, ব্রি ধান ৮৮, ব্রি ধান ৮৯ এবং ব্রি ধান ৯২।
বোরো মৌসুমে চাষের জন্য কৃষক পর্যায়ে মানসম্পন্ন বীজ ব্যবহারের মাত্রা বেড়েছে। কারণ বীজের মোট চাহিদা প্রায় ১.৫ লাখ টন, যার মধ্যে বিএডিসি ৫০ হাজার টনের উপরে সরবরাহ করছে এবং প্রাইভেট সেক্টরও সমপরিমাণ বীজ সরবরাহ করছে। কৃষক পর্যায়েও কিছু মানসম্পন্ন বীজ সংরক্ষণ ও ব্যবহার হচ্ছে; যা নিঃসন্দেহে উৎপাদনে ভালো প্রভাব ফেলবে। যে কোন একটি ধানের উন্নত জাত থেকে ভালো ফলন পাওয়ার জন্য তা অবমুক্ত হওয়ার ৫ বছরের মধ্যে মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণ করতে হবে এবং মাঠ পর্যায়ে চাষের জন্য ১০ বছর রাখা সঠিক হবে। তারপর জাতটি বিভিন্ন কারণে তার গুণাগুণ হারাতে থাকায় ফলন ভালো দিতে সক্ষম হবে না বিধায় নতুন জাত পুনরায় সম্প্রসারণ কতে হবে। কিন্তু ব্রি ধান ২৮ এবং ব্রি ধান ২৯ অবমুক্ত হওয়ার পর এখন তার বয়স হয়েছে প্রায় ৩০ বছর, যা এখনো মাঠে আছে। এটি বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য নিশ্চয়ই একটি হুমকি।
বিএডিসি ব্রি ধান ২৮ এর বীজ আসন্ন বোরো মৌসুমে সরবরাহ করার কথা না থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি ব্রি ধান ২৮ এর বীজ সরবরাহ করছে। ব্রি ধান ২৯ এর বীজ উৎপাদনে বিএডিসি’র সকল বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে এবারো দ্বিতীয় অবস্থানে (১৩,২৭০ টন)। অথচ দেশের খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে কৃষকের মাঠে কমপক্ষে ৪-৫ ধানের জাতের প্রাধান্য থাকা উচিত যেখানে দেশের বোরো মৌসুমে বর্তমানে ৩০ বছরের পুরনো ব্রি ধান ২৯ এর প্রাধান্য বিরাজ করছে। পলিসি পর্যায়ে যারা এ সকল বিষয় বিবেচনায় নিয়ে কাজ করার কথা তারা কতটুকু দায়িত্ব পালন করছেন জানিনা। তবে আগামী দিনগুলোতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি আরো বেশি গুরুত্ব দিয়ে কৃষকের মাঠে সঠিক সময়ে সঠিক জাতটি যাতে পৌঁছে দেয়া যায় তার জন্য সচেতন হবেন বলে আশা করছি।
[লেখক : এগ্রোনমিস্ট অ্যান্ড কনসালট্যান্ট. গেইন বাংলাদেশ]
এম মনির উদ্দিন
সোমবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৪
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট (ব্রি) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে আর্ন্তজাতিক ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট (ইরি) ১৯৬৭ সালে বাংলাদেশে প্রথম উচ্চ ফলনশীল আধুনিক ধানের জাত আইআর-৮ প্রবর্তন করে এবং এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের কৃষিতে আধুনিক কৃষির চর্চা শুরু হয়। বিশেষ করে, স্বাধীনতার পর দেশে বিএডিসি আধুনিক ধান চাষের সুবিধার্থে ধানের জমিতে পানি সেচ সহজলভ্য করার জন্য ভু-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের জন্য গভীর নলকূপ স্থাপন করে এবং এর সাথে সাথে দেশে আইআর-৮ আধুনিক জাতের ধানের চাষ বাড়তে থাকে, যা বাংলাদেশকে খাদ্য ঘাটতির দেশ থেকে আজকের খাদ্য নিরাপত্তার দেশে পরিণত করার এক মাইলফলক হিসেবে কাজ করে।
দেশের সনাতনী কৃষির পরিবর্তে জমিতে সার, বালাইনাশক, পানিসেচ ব্যবহারের মাধ্যমে আইআর-৮ জাতটি হেক্টরে ফলন দেয় ৮-৯.৫ টন। আধুনিক কৃষির ছোয়ায় কৃষকদের মাঝে প্রানচাঞ্চ্যলতা ফিরে আসতে থাকে এবং প্রথমদিকে জমির উর্বরতা মান ভালো থাকায় মোটা জাতের আরআই-৮ ধানের ব্যাপক ফলনে বাজ্ঞালীর ভাতভিত্তিক খাদ্যাভাসের সহজীকরণ হতে থাকে। এই জাতটি দীর্ঘদিন কৃষকের জমিতে ভালো ফলন দিতে সক্ষম হয় তবে ১৯৯০ এর শুরুর দিক থেকে জাতটি রোগ পোকার প্রতি সংবেদনশীল হতে থাকে যার কারণে ফলনও কমতে থাকে।
ইতোমধ্যে দেশে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট (ব্রি) কাজ শুরু করে এবং বেশ কয়েকটি আধুনিক ধানের জাত উদ্ভাবন করে, যা অঞ্চল ও মৌসুমভিত্তিক ক্রমান্বয়ে মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারিত হতে থাকে। তবে ফলন কম হলেও কৃষক আইআর-৮ এর চাষ ছাড়তে চায়না। এমন অবস্থায় ধানের বিকল্প জাতের মাধ্যমে দেশের খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর প্রত্যয় নিয়ে ব্রি দেশের সব এলাকার জন্য চাষ উপযোগী দুইটি ধানের জাত ব্রি ধান ২৮ এবং ব্রি ধান ২৯ ১৯৯৪ সালে অবমুক্ত করে এবং এই দুইটি ধানের জাত পরবর্তীতে দেশের ধানের উৎপাদন বাড়াতে নতুন মাইলফলক হিসেবে কাজ করে। তবে এই জাত দুইটি মাঠপর্যায়ে খুব সহজে সম্প্রসারণ করা সম্ভব হয়নি। কারণ আইআর-৮ যখন বিঘায় ১০-১২ মন ফলন দিচ্ছে তখনো কৃষক বিকল্প কোন জাত ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছিলো না। অর্থাৎ কৃষকেরা দীর্ঘদিন ধরে চাষ করার ফলে আইআর-৮ এর মোহ থেকে বের হয়ে আসতে পারছিলোনা। এভাবে দেশে ২০০০ সালের পরেও আইআর-৮ এর চাষ অব্যাহত ছিলো।
পরবর্তী সময়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নিবিড় প্রদর্শনী স্থাপনসহ বিভিন্ন সচেতনতামুলক কার্যক্রমের ফলে ধীরে ধীরে ব্রি ধান ২৮ এবং ব্রি ধান ২৯ এর সম্প্রসারণ হতে থাকে এবং ২০১৮ সাল পর্যন্ত কৃষকেরা অন্যান্য আরো উচ্চ ফলনশীল অনেক জাত ব্রি থেকে বের হলেও মূলত ব্রি ধান ২৮ এবং ব্রি ধান ২৯ এর চাষ অব্যাহত রাখে। কয়েক বছর ধরেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় কৃষকেরা ব্রি ধান ২৮ চাষ করে বিড়ম্বনায় পড়ে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে বোরো মৌসুমে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ব্রি ধান ২৮ জাতটি ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হওয়ায় কৃষকেরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইতোমধ্যে জাতটি ব্লাস্ট রোগে অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হওয়ার কারনে কৃষি বিভাগ এর চাষ নিষিদ্ধ করেছে এবং কৃষকেরাও বিকল্প জাত চাষ শুরু করছে।
ব্রি ধান ২৯ এর ফলন হেক্টরে ১০ টন পর্যন্ত কৃষকের জমিতে পাওয়া গেছে এবং দেশের বোরো ধানের অধিকাংশ এলাকা এক সময় ব্রি ধান ২৯ চাষের আওতায় চলে আসে। সম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের জনপ্রিয় এই ব্রি ধান ২৯ জাতটিও ব্লাস্ট রোগের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে পড়ে এবং বর্তমানে এই জাতটির চাষেও একটি বড় ধরনের ঝটুকি রয়েছে। কারণ ব্রি ধান ২৯ জাতটি যদি আবহাওয়াজনিত কারণে আংশিকভাবেও ব্লাস্ট রোগের শিকার হয় তাহলে বোরো মৌসুমের মোট ধানের উৎপাদনে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলবে। ব্রি বিগত দিনগুলোতে গবেষণা চালিয়ে জলবায়ুর পরিবর্তন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে জলবায়ুবান্ধব উচ্চ ফলনশীল এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ বেশ কয়েকটি ধানের জাত অবমুক্ত করেছে বোরো মৌসুমে চাষ করার জন্য। পক্ষান্তরে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ব্রি ধান ২৮ এবং ব্রি ধান ২৯ এর পরিবর্তে কৃষকদের উচ্চ ফলনশীল নতুন জাতগুলো চাষাবাদের জন্য উদ্বুদ্ধ করছে। তবে কৃষক ওই আইআর-৮ এর মতো ব্রি ধান ২৮ ও ব্রি ধান ২৯ এর মায়ায় পড়ে রয়েছে।
দেশের প্রধান খাদ্য ফসল ধানের ৩টি মৌসুম যেমন বোরো, আমন, আউশ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফলন আসে বোরো মৌসুম থেকে। বোরো মৌসুম থেকে আরো বেশি ধানের উৎপাদন নিয়ে আসা সম্ভব এবং এটি দেশের ক্রমবর্ধমান মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটাতে আবশ্যক। তবে এর জন্য সঠিক জাত নির্বাচন একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্তমানে ব্রি কর্তৃক অবমুক্ত হওয়া উচ্চ ফলনশীল বোরো জাতের মধ্যে ব্রি ধান ৭৪, ব্রি ধান ৮৯, ব্রি ধান ৯০, ব্রি ধান ৯২, ব্রি ধান ১০০, ব্রি ধান ১০২, ব্রি ধান ১০৪, ব্রি ধান ১০৫, ব্রি ধান ১০৭, ব্রি ধান ১০৮ এবং বিনা ধান ২৫ উল্লেখযোগ্য।
ইতোমধ্যে জলবায়ুর পরিবর্তন দেশের কৃষি উৎপাদন বিশেষ করে ধানের ফলনে প্রভাব ফেলেছে। গত বোরো মৌসুমে মার্চ-এপ্রিলে তাপমাত্রা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৪০-৪৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে উঠানামা করেছে, যা আমাদের গতানুগতিক বোরো ধানের জাতগুলোর ফুল ফোটার সময়ে অতিরিক্ত তাপমাত্রা ফলনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতেই পারে। সেই সঙ্গে তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে আশঙ্কা বেড়ে যায় ব্লাস্ট রোগের, যার আক্রমণের শিকার হতে পারে ব্রি ধান ২৮ এবং ব্রি ধান ২৯।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, বেশ কয়েকটি প্রাইভেট বীজ বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ব্রি ধান ২৮ এবং ব্রি ধান ২৯ এর বীজ বিক্রয়ের জন্য ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছে। কোন একটি বীজ বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান যে, ব্রি ধান ২৯ এখনো দেশের মেগা ভ্যারাইটি এবং বোরো মৌসুমে ব্রি ধান ২৯ এর চাষের এলাকা বেশি। তাদের মতে, ব্রি ধান ২৯-কে টেক্কা দেয়ার মতো এখনো সেইরকম কোন জাত বের হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির মতে, ব্রি ধান ২৯ এখনো ব্রি ধান ৫৮, ব্রি ধান ৮৯, ব্রি ধান ৯২, ব্রি ধান ১০২ থেকে বিঘায় ২-৩ মন ফলন বেশি দেয়। দেশের উত্তরাঞ্চল বিশেষ করে ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুরে ব্রি ধান ২৯ এর বীজ ১০০০ কেজি বিক্রয় হলে অন্যান্য জাতের বীজ নাকি বিক্রয় হয় ৫০ কেজি।
এখন বিবেচ্য বিষয় হলো যে, ব্রি ধান ২৯ নিঃসন্দেহে একটি ভালো ধানের জাত যার ফলনও বেশ সন্তোষজনক। তবে ব্রি ধান ২৮ এবং ব্রি ধান ২৯ অবশ্যই ব্লাস্ট রোগের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং যদি ব্লাস্ট রোগের বড় ধরনের কোন বিপর্যয় হয় তাহলে বোরো উৎপাদনে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটবে এই ব্রি ধান ২৮ এবং ব্রি ধান ২৯ চাষের কারনে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ব্রি ধান ২৮ এবং ব্রি ধান ২৯ এর চাষ কমিয়ে যেখানে নতুন জাতগুলো প্রবর্তনের চেষ্টা করছে সেখানে প্রাইভেট বীজ প্রতিষ্ঠানগুলো কিভাবে অপরিকল্পিতভাবে ব্রি ধান ২৮ এবং ব্রি ধান ২৯ এর বীজ বিক্রয় করে চলছে তা বোধগম্য নয় এবং এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানের কোন মনিটরিং আদৌ আছে কিনা সন্দেহ।
চলতি আমন মৌসুমে দেশের পূর্বাঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলে বন্যার কারণে আমনের ফলন কিছুটা কমে যেতে পারে যা উত্তরণের জন্য আসন্ন বোরো মৌসুমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল মিলে বোরোর আওতায় জমির পরিমাণ বাড়ানোর জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যসূত্রে জানা যায়, আগামী বোরো চাষের আওতায় জমির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে প্রায় ৫১ লাখ হেক্টর; যা অর্জিত হলে দেশের বোরো ধানের উৎপাদন অনেকাংশে বেড়ে যাবে যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় অত্যন্ত সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়।
আরো জানা যায়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আগামী বোরো মৌসুমে ৩০ লাখ বিঘার জন্য প্রণোদনার আওতায় কৃষকের মাঝে বীজ ও সার বিনামূল্যে বিতরণ করবে। প্রণোদনার আওতায় বিতরণকৃত বোরো ধানের জাতগুলো হবে ব্রি ধান ৬৭, জিংক সমৃদ্ধ ব্রি ধান ৭৪, ব্রি ধান ৮৮, ব্রি ধান ৮৯ এবং ব্রি ধান ৯২।
বোরো মৌসুমে চাষের জন্য কৃষক পর্যায়ে মানসম্পন্ন বীজ ব্যবহারের মাত্রা বেড়েছে। কারণ বীজের মোট চাহিদা প্রায় ১.৫ লাখ টন, যার মধ্যে বিএডিসি ৫০ হাজার টনের উপরে সরবরাহ করছে এবং প্রাইভেট সেক্টরও সমপরিমাণ বীজ সরবরাহ করছে। কৃষক পর্যায়েও কিছু মানসম্পন্ন বীজ সংরক্ষণ ও ব্যবহার হচ্ছে; যা নিঃসন্দেহে উৎপাদনে ভালো প্রভাব ফেলবে। যে কোন একটি ধানের উন্নত জাত থেকে ভালো ফলন পাওয়ার জন্য তা অবমুক্ত হওয়ার ৫ বছরের মধ্যে মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণ করতে হবে এবং মাঠ পর্যায়ে চাষের জন্য ১০ বছর রাখা সঠিক হবে। তারপর জাতটি বিভিন্ন কারণে তার গুণাগুণ হারাতে থাকায় ফলন ভালো দিতে সক্ষম হবে না বিধায় নতুন জাত পুনরায় সম্প্রসারণ কতে হবে। কিন্তু ব্রি ধান ২৮ এবং ব্রি ধান ২৯ অবমুক্ত হওয়ার পর এখন তার বয়স হয়েছে প্রায় ৩০ বছর, যা এখনো মাঠে আছে। এটি বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য নিশ্চয়ই একটি হুমকি।
বিএডিসি ব্রি ধান ২৮ এর বীজ আসন্ন বোরো মৌসুমে সরবরাহ করার কথা না থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি ব্রি ধান ২৮ এর বীজ সরবরাহ করছে। ব্রি ধান ২৯ এর বীজ উৎপাদনে বিএডিসি’র সকল বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে এবারো দ্বিতীয় অবস্থানে (১৩,২৭০ টন)। অথচ দেশের খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে কৃষকের মাঠে কমপক্ষে ৪-৫ ধানের জাতের প্রাধান্য থাকা উচিত যেখানে দেশের বোরো মৌসুমে বর্তমানে ৩০ বছরের পুরনো ব্রি ধান ২৯ এর প্রাধান্য বিরাজ করছে। পলিসি পর্যায়ে যারা এ সকল বিষয় বিবেচনায় নিয়ে কাজ করার কথা তারা কতটুকু দায়িত্ব পালন করছেন জানিনা। তবে আগামী দিনগুলোতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি আরো বেশি গুরুত্ব দিয়ে কৃষকের মাঠে সঠিক সময়ে সঠিক জাতটি যাতে পৌঁছে দেয়া যায় তার জন্য সচেতন হবেন বলে আশা করছি।
[লেখক : এগ্রোনমিস্ট অ্যান্ড কনসালট্যান্ট. গেইন বাংলাদেশ]