alt

উপ-সম্পাদকীয়

জনপ্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্যার সম্বোধন কি আইনসম্মত

সিরাজ প্রামাণিক

: মঙ্গলবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৪

শুরুতেই বলে রাখি, জনগণের করের টাকায় বেতনভুক্ত ব্যক্তি কোনোভাবেই জনগণের প্রশাসক হতে পারেন না। তাই জনপ্রশাসন ও জেলা প্রশাসক শব্দদ্বয় যথাযথ নয়। সময় এসেছে এসব চিন্তা করার। ভ্রান্তনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার। কারণ, জনপ্রশাসন শব্দের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানুষকে শাসন, শোষণ ও নির্যাতনের বীজ। কাজেই আধুনিক বাংলাদেশের সেবা ব্যবস্থাপনা থেকে জনপ্রশাসন ও জেলা প্রশাসক শব্দটি বাতিলের জোর দাবি জানাচ্ছি। সরকারের পক্ষ থেকে সব সময়ই জোর দিয়ে বলা হয় স্যার, ম্যাডাম বলার কোন বিধান বা আইন নেই; বরং সেবা করাই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজ। সংবিধান অনুযায়ী, সব সময়ে জনগণের সেবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য। তাই জনগণকে ‘স্যার’ সম্বোধনে বাধ্য করা কতটা যৌক্তিক। ১৯৯৮ সালের কথা। সে বছর কুষ্টিয়াতে বেশ বন্যা হয়েছে।

খোকসার কমলাপুর গড়াই নদী তীরবর্তী কমলাপুর গ্রামগুলোর অধিকাংশ মানুষ খোকসা গার্লস হাইস্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন। সাংবাদিকতা করার সুবাদে বন্যাকবলিত মানুষের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে প্রতিবেদন তৈরিতে ব্যস্ত। এবার বক্তব্য নেয়ার পালা টিএনও মহোদয়ের। একটি টিএন্ডটি ফোন থেকে যথারীতি সালাম দিয়ে ওই টিএনওকে বলেছি মাত্র, ‘ভাই যে বিষয়ে ফোন দিয়েছি...।’ এরপর তিনি আর এগোতে দেননি আমায়। ওখানেই থামিয়ে দিয়ে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘আগে বলেন, আপনি টিএনওকে ভাই কেন বলছেন। আমি আপনার কেমন ভাই?’ এমন প্রশ্নের জন্য নিশ্চয়ই আমি তৈরি ছিলাম না। এরপর বিনয়ের সঙ্গে জানতে চেয়েছিলাম তাহলে কীভাবে সম্বোধন করব আপনাকে? ‘স্যার’ বলব কি? বিরক্ত টিএনও আমাকে জানিয়ে দেন, ‘আপনার ভাব বেশি। আপনার স্যার ডাকতে হবে না। কিন্তু কখনোই ভাই ডাকবেন না। এটা ফরমাল কোনো ডেকোরাম না।’ মহাবিপদ! ভাইও নয়, স্যারও নয়। তাহলে আমি টিএনওকে কী বলে সম্বোধন করব! ভাই বলে সম্বোধনে আমলাদের আপত্তি, বিরক্তি, অস্বস্তি, উষ্মা প্রকাশ নতুন কিছু নয়।

সম্ভবত ২০২০ সালের অক্টোবরে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ঠিক একইভাবে সাবধান করেছেন। ব্যতিক্রমও আছে। ব্যতিক্রম সেসময়ের জেলা প্রশাসক। আমি ঘটনাটি অবহিত করে বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তো সাংবাদিকদের সহকর্মীই মনে করি। আমরা তো কাউকে বলতে পারি না, আমাকে স্যার ডাকেন। এটা নিয়মের মধ্যেও পড়ে না।’ সম্বোধন নিয়ে আপত্তির মধ্যে জনগণ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ‘স্যার নাকি ভাইÑ কী বলে ডাকব জানতে চেয়ে ২০১২ সালে তথ্য অধিকার আইনে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত আবেদন করেছিলাম। তার জবাবে বলা হয়, ‘সম্বোধনসংক্রান্ত কোনো আইন বা বিধি জেলা প্রশাসকের দপ্তরে নেই।’ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ইকবাল মাহমুদ তখন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান। ‘স্যার না ভাই, নাকি অন্য কিছু’ বিতর্কের দিকে ইঙ্গিত করে দুদক কার্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা চাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা সেবাগ্রহীতা নাগরিকদের ‘স্যার’ সম্বোধন করবেন, নাগরিকরা নয়।’ আমি বেশ কিছু দেশ পেশাগত কাজে ঘুরেছি। বিদেশে সরকারি কর্মকর্তা ও মন্ত্রীদের নাম ধরে ডাকে (নাগরিকরা)।

এদেশেও এ সংস্কৃতি শুরু করে সবাইকে নাম ধরে ডাকা উচিত। এটাই আন্তর্জাতিক চর্চা। এটা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। তবেই এ সমস্যার সমাধান হবে। সাবেক জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বছরখানেক আগে বলেছিলেন, ‘আমাদের তো একটা ক্লিয়ার মেসেজ গেছে। আমি বলে দিয়েছি, স্যার বা ম্যাডাম বলার কোনো বিধান নেই। কোনো আইনে নেই যে তাকে এটা বলতে হবে। আমাদের জনগণের সঙ্গে মিশে যেতে হবে। জনগণের সঙ্গে মিশে যেতে হলে কেউ যদি ভাই বলে, রাগ করার তো কিছু নেই। আমার কাজটা হচ্ছে আপনাকে সার্ভিস দেয়া।’ তবে শেষ কথা হচ্ছে ‘সালিশ মানি, কিন্তু তাল গাছটা আমার’ মনোভাবে কোনো ছেদ বা বিরামচিহ্ন পড়েনি। ‘স্যার’ সম্বোধন আদায়ের জন্য ছোটবড়, নারী-পুরুষনির্বিশেষে আমলাদের ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠতে দেখা যায়। শুধু প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যেই নয়, দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীদের মধ্যেও এ প্রবণতা বেশি দেখা দিয়েছে। কয়েক বছর আগে সম্ভবত ২০১৪ সাল।

কুষ্টিয়া বিআরটিএ ইন্সপেক্টরকে স্যার সম্বোধন না করায় আমার এক সহকারীকে রুম থেকে বের করে দিয়েছিল। এ বিষয়ে আমি জানতে চেয়ে সরেজমিন তার অফিসে গেলে আমাকে র‌্যাব ডেকে র‌্যাবের হাতের তুলে দেয়ার হুমকি দেন। তখনকার র‌্যাবের আচরণ সম্পর্কে এখন আর না বলাটাই শ্রেয়। আমার শিরোনামের শব্দগুলো কিন্তু ব্রিটিশ শাসিত কলোনিগুলোর। ব্রিটিশরা নিজের দেশে নাম বা পদ ধরে সম্বোধনের রেওয়াজ চালু রাখলেও উপনিবেশের বাসিন্দাদের প্রভু মানে ‘স্যার’ সম্বোধন শিখিয়েছেন। কালে কালে ‘স্যারের’ শিকড়টা এমন গভীরে চলে গেছে যে এখন বড় কর্তার সব কথার উত্তর ‘স্যার’ শব্দ দিয়েই দেয়া যায়। হ্যাঁ বাচক, না বাচকÑ যাই হোক, এক ‘স্যার’ দিয়ে সেরে ফেলা যায় কথোপকথন। দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল যেমন বলেছেন, ‘ক্ষমতার অপব্যবহারের মধ্যেই দুর্বল মানুষ ক্ষমতার স্বাদ পেতে চায়।’ বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীদের জন্য একটি আচরণ বিধিমালা আছে। প্রায় ৪০ বছর আগের এই আচরণবিধি অবশ্য ২০০২ সালে ও ২০১১ সালে দুই দফায় সংশোধিত হয়েছে। এখানে মোট ৩৪টি নির্দেশনা থাকলেও দুঃখের সঙ্গে জানাতে হয় নাগরিকদের সঙ্গে আচরণ বিষয়ে আলাদা কোনো বিধি নেই। অবশ্য ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালায় নাগরিকদের সঙ্গে যে কোনো অসদাচরণ শাস্তিযোগ্য হবে, এমনটি লেখা আছে। সেখানে অসদাচরণ বলতে বোঝানো হয়েছে, অসঙ্গত আচরণ, চাকরি-শৃঙ্খলা হানিকর আচরণ কিংবা শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণকে। তবে এসবের বিস্তারিত আলোচনা সেখানে নেই। ভুলে গেলে চলবে না সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সব সময়ে জনগণের সেবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য। তাই জনগণকে ‘স্যার’ সম্বোধনে বাধ্য করার বিষয়টি কতটা ন্যায্য, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন।

[লেখক : আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্টে]

ধর্মীয় স্বাধীনতা ও কঠিন চীবরদান

ছবি

দুর্গাপূজার মর্মবাণী

মানুষ মূল্যস্ফীতি থেকে রক্ষা পাবে কীভাবে

গুজব ও মিথ্যা তথ্য : সমাজের এক ভয়াবহ ব্যাধি

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে দৃঢ় পদক্ষেপ প্রয়োজন

পুরাতত্ত্বের ধারায় সনাতনী সমাজের দুর্গাপূজা

জীবন-মৃত্যু কী?

নাসা : বিজ্ঞানের পীঠস্থান

শিক্ষা সংস্কারে প্রথাগত চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে

সাংঘাতিক ভাই, সাংঘাতিক...

প্রযুক্তির মায়াজালে বন্দি মানুষ

ছবি

এসএম সুলতান : সংস্কৃতি সত্তার সত্যপাঠ

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস

তরুণ সমাজ ও প্রযুক্তি নির্ভরতা : সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

বগুড়ার তাঁতপল্লী

অটিজম কোনো রোগ নয়

দুর্বল ব্যাংকগুলোকে কতদিন সহায়তা দেয়া হবে?

বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য বয়সবৈষম্য দূর করুন

আসন্ন বোরো উৎপাদন ও কিছু শঙ্কা

ছবি

আইন পেশার জানা-অজানা কথা

ছবি

ব্যাংক খাতের সংকট

একাকিত্ব ও মানসিক অশান্তি

বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজ

ব্রি: কিছু প্রশ্ন, কিছু উত্তর

ক্রেতা ঠকে গেলে তার আইনগত প্রতিকার

ঢাকার যানজট : কিছু প্রস্তাব

রম্যগদ্য : দারিদ্র্য যাবে জাদুঘরে

গার্মেন্টস খাতে সংকট

সরকারি হাসপাতালের টয়লেট ব্যবস্থাপনায় করুণ দশা

ডেঙ্গু থেকে বাঁচার উপায় কী

শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার বাড়াতে

বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির দুর্বলতা

ইরানের কেন কৌশলগত পরিবর্তন

শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন একে অন্যের পরিপূরক

রামু ট্র্যাজেডির এক যুগ

প্রত্যাশিত শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাবিত রূপরেখা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

জনপ্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্যার সম্বোধন কি আইনসম্মত

সিরাজ প্রামাণিক

মঙ্গলবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৪

শুরুতেই বলে রাখি, জনগণের করের টাকায় বেতনভুক্ত ব্যক্তি কোনোভাবেই জনগণের প্রশাসক হতে পারেন না। তাই জনপ্রশাসন ও জেলা প্রশাসক শব্দদ্বয় যথাযথ নয়। সময় এসেছে এসব চিন্তা করার। ভ্রান্তনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার। কারণ, জনপ্রশাসন শব্দের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানুষকে শাসন, শোষণ ও নির্যাতনের বীজ। কাজেই আধুনিক বাংলাদেশের সেবা ব্যবস্থাপনা থেকে জনপ্রশাসন ও জেলা প্রশাসক শব্দটি বাতিলের জোর দাবি জানাচ্ছি। সরকারের পক্ষ থেকে সব সময়ই জোর দিয়ে বলা হয় স্যার, ম্যাডাম বলার কোন বিধান বা আইন নেই; বরং সেবা করাই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজ। সংবিধান অনুযায়ী, সব সময়ে জনগণের সেবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য। তাই জনগণকে ‘স্যার’ সম্বোধনে বাধ্য করা কতটা যৌক্তিক। ১৯৯৮ সালের কথা। সে বছর কুষ্টিয়াতে বেশ বন্যা হয়েছে।

খোকসার কমলাপুর গড়াই নদী তীরবর্তী কমলাপুর গ্রামগুলোর অধিকাংশ মানুষ খোকসা গার্লস হাইস্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন। সাংবাদিকতা করার সুবাদে বন্যাকবলিত মানুষের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে প্রতিবেদন তৈরিতে ব্যস্ত। এবার বক্তব্য নেয়ার পালা টিএনও মহোদয়ের। একটি টিএন্ডটি ফোন থেকে যথারীতি সালাম দিয়ে ওই টিএনওকে বলেছি মাত্র, ‘ভাই যে বিষয়ে ফোন দিয়েছি...।’ এরপর তিনি আর এগোতে দেননি আমায়। ওখানেই থামিয়ে দিয়ে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘আগে বলেন, আপনি টিএনওকে ভাই কেন বলছেন। আমি আপনার কেমন ভাই?’ এমন প্রশ্নের জন্য নিশ্চয়ই আমি তৈরি ছিলাম না। এরপর বিনয়ের সঙ্গে জানতে চেয়েছিলাম তাহলে কীভাবে সম্বোধন করব আপনাকে? ‘স্যার’ বলব কি? বিরক্ত টিএনও আমাকে জানিয়ে দেন, ‘আপনার ভাব বেশি। আপনার স্যার ডাকতে হবে না। কিন্তু কখনোই ভাই ডাকবেন না। এটা ফরমাল কোনো ডেকোরাম না।’ মহাবিপদ! ভাইও নয়, স্যারও নয়। তাহলে আমি টিএনওকে কী বলে সম্বোধন করব! ভাই বলে সম্বোধনে আমলাদের আপত্তি, বিরক্তি, অস্বস্তি, উষ্মা প্রকাশ নতুন কিছু নয়।

সম্ভবত ২০২০ সালের অক্টোবরে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ঠিক একইভাবে সাবধান করেছেন। ব্যতিক্রমও আছে। ব্যতিক্রম সেসময়ের জেলা প্রশাসক। আমি ঘটনাটি অবহিত করে বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তো সাংবাদিকদের সহকর্মীই মনে করি। আমরা তো কাউকে বলতে পারি না, আমাকে স্যার ডাকেন। এটা নিয়মের মধ্যেও পড়ে না।’ সম্বোধন নিয়ে আপত্তির মধ্যে জনগণ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ‘স্যার নাকি ভাইÑ কী বলে ডাকব জানতে চেয়ে ২০১২ সালে তথ্য অধিকার আইনে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত আবেদন করেছিলাম। তার জবাবে বলা হয়, ‘সম্বোধনসংক্রান্ত কোনো আইন বা বিধি জেলা প্রশাসকের দপ্তরে নেই।’ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ইকবাল মাহমুদ তখন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান। ‘স্যার না ভাই, নাকি অন্য কিছু’ বিতর্কের দিকে ইঙ্গিত করে দুদক কার্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা চাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা সেবাগ্রহীতা নাগরিকদের ‘স্যার’ সম্বোধন করবেন, নাগরিকরা নয়।’ আমি বেশ কিছু দেশ পেশাগত কাজে ঘুরেছি। বিদেশে সরকারি কর্মকর্তা ও মন্ত্রীদের নাম ধরে ডাকে (নাগরিকরা)।

এদেশেও এ সংস্কৃতি শুরু করে সবাইকে নাম ধরে ডাকা উচিত। এটাই আন্তর্জাতিক চর্চা। এটা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। তবেই এ সমস্যার সমাধান হবে। সাবেক জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বছরখানেক আগে বলেছিলেন, ‘আমাদের তো একটা ক্লিয়ার মেসেজ গেছে। আমি বলে দিয়েছি, স্যার বা ম্যাডাম বলার কোনো বিধান নেই। কোনো আইনে নেই যে তাকে এটা বলতে হবে। আমাদের জনগণের সঙ্গে মিশে যেতে হবে। জনগণের সঙ্গে মিশে যেতে হলে কেউ যদি ভাই বলে, রাগ করার তো কিছু নেই। আমার কাজটা হচ্ছে আপনাকে সার্ভিস দেয়া।’ তবে শেষ কথা হচ্ছে ‘সালিশ মানি, কিন্তু তাল গাছটা আমার’ মনোভাবে কোনো ছেদ বা বিরামচিহ্ন পড়েনি। ‘স্যার’ সম্বোধন আদায়ের জন্য ছোটবড়, নারী-পুরুষনির্বিশেষে আমলাদের ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠতে দেখা যায়। শুধু প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যেই নয়, দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীদের মধ্যেও এ প্রবণতা বেশি দেখা দিয়েছে। কয়েক বছর আগে সম্ভবত ২০১৪ সাল।

কুষ্টিয়া বিআরটিএ ইন্সপেক্টরকে স্যার সম্বোধন না করায় আমার এক সহকারীকে রুম থেকে বের করে দিয়েছিল। এ বিষয়ে আমি জানতে চেয়ে সরেজমিন তার অফিসে গেলে আমাকে র‌্যাব ডেকে র‌্যাবের হাতের তুলে দেয়ার হুমকি দেন। তখনকার র‌্যাবের আচরণ সম্পর্কে এখন আর না বলাটাই শ্রেয়। আমার শিরোনামের শব্দগুলো কিন্তু ব্রিটিশ শাসিত কলোনিগুলোর। ব্রিটিশরা নিজের দেশে নাম বা পদ ধরে সম্বোধনের রেওয়াজ চালু রাখলেও উপনিবেশের বাসিন্দাদের প্রভু মানে ‘স্যার’ সম্বোধন শিখিয়েছেন। কালে কালে ‘স্যারের’ শিকড়টা এমন গভীরে চলে গেছে যে এখন বড় কর্তার সব কথার উত্তর ‘স্যার’ শব্দ দিয়েই দেয়া যায়। হ্যাঁ বাচক, না বাচকÑ যাই হোক, এক ‘স্যার’ দিয়ে সেরে ফেলা যায় কথোপকথন। দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল যেমন বলেছেন, ‘ক্ষমতার অপব্যবহারের মধ্যেই দুর্বল মানুষ ক্ষমতার স্বাদ পেতে চায়।’ বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীদের জন্য একটি আচরণ বিধিমালা আছে। প্রায় ৪০ বছর আগের এই আচরণবিধি অবশ্য ২০০২ সালে ও ২০১১ সালে দুই দফায় সংশোধিত হয়েছে। এখানে মোট ৩৪টি নির্দেশনা থাকলেও দুঃখের সঙ্গে জানাতে হয় নাগরিকদের সঙ্গে আচরণ বিষয়ে আলাদা কোনো বিধি নেই। অবশ্য ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালায় নাগরিকদের সঙ্গে যে কোনো অসদাচরণ শাস্তিযোগ্য হবে, এমনটি লেখা আছে। সেখানে অসদাচরণ বলতে বোঝানো হয়েছে, অসঙ্গত আচরণ, চাকরি-শৃঙ্খলা হানিকর আচরণ কিংবা শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণকে। তবে এসবের বিস্তারিত আলোচনা সেখানে নেই। ভুলে গেলে চলবে না সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সব সময়ে জনগণের সেবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য। তাই জনগণকে ‘স্যার’ সম্বোধনে বাধ্য করার বিষয়টি কতটা ন্যায্য, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন।

[লেখক : আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্টে]

back to top