মাহতাব হোসাইন মাজেদ
অটিজম শব্দটি গ্রিক শব্দ থেকে আগত, যার অর্থ আত্ম বা নিজ থেকে এসেছে। শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন সুইস মনোবিজ্ঞানী চিকিৎসক অয়গেন বয়লার। অটিজম শিশুর মানসিক সমস্যাকে বোঝানো হয়। অটিজম কোনো রোগ নয়। এটি স্নায়ু বিকাশজনিত সমস্যার একটি বিস্তৃত রূপ বা অটিজ স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার নামে পরিচিত। এখানে স্নায়ু শব্দটি স্নায়ুতন্ত্র বা মস্তিষ্কের সাথে স্নায়ুর সম্পর্ক বোঝায়। অটিজম উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেরও একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা।
এক গবেষণায় জানা গেছে, গ্রামের তুলনায় শহরে অটিস্টিক শিশু জন্মের হার বেশি। গ্রামে প্রতি ১০ হাজারে ১৪ জন এবং শহর এলাকায় প্রতি ১০ হাজারে ২৫ শিশু অটিজম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। মেয়ে শিশুর চাইতে ছেলে শিশুর মধ্যে অটিজমে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় আড়াই গুণ বেশি। এছাড়াও দেশে ১৬ থেকে ৩০ মাস বয়সি শিশুদের মধ্যে অটিজম বিস্তারের হার প্রতি ১০ হাজারে ১৭ জন। গ্রামের চেয়ে শহরে অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা বেড়েছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মতে, দেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির মধ্যে ২ দশমিক ৮৭ শতাংশ অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। তবে ধারণানুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় দেড় লাখের মতো অটিজম আক্রান্ত মানুষ রয়েছে। প্রতি বছর তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে আরও প্রায় ১ হাজার ৫০০ শিশু।
অটিজম মূলত মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশের প্রতিবন্ধকতাজনিত একটি মানসিক রোগ। এটি মানুষের হরমোনজনিত সমস্যার বহিঃপ্রকাশ। এটির প্রতীকী রং নীল। অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্য যেমন আলাদা; তেমনি তাদের প্রতিভাও ভিন্ন। কেউ হয়তো ভালো ছবি আঁকতে পারছে, কেউ বা নিজের কাজগুলো গুছিয়ে করতে পারে। এসবই অটিজমে আক্রান্ত শিশুর সাফল্য বলে খুশি থাকতে হবে। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর জন্য কেবল মাকে নয়, বাবাকেও সময় ও সহযোগিতা করতে হবে। জিমনেসিয়াম, সুইমিং পুলে সপ্তাহে অন্তত একদিন বিশেষ শিশুদের জন্য সুযোগ রাখা প্রয়োজন। বিশেষ শিশুদের অভিভাবকদের অবশ্যই কাউন্সিলিং দরকার। কারণ এই শিশুদের অভিভাবকরা ভালো থাকলে তাদের সন্তানটিও ভালো থাকবে। আর অটিজম শিশুদের এমন একটি মানসিক রোগ যাতে তারা কথা, কাজ-কর্ম বা খেলাধুলা ইত্যাদির মাধ্যমে অন্য শিশুদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে পারে না। শুধু শিশু নয়, বড়দের সঙ্গেও তারা সম্পর্ক গড়তে পারে না।
মোটকথা তারা সামাজিকতা আয়ত্ত করতে পারে না। সারাক্ষণ নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সদাসর্বদা কল্পনার এক অবাস্তব জগতে ডুবে থাকে তারা। নানা রকমের কাল্পনিক শব্দ শোনে, কাল্পনিক দৃশ্য দেখে। কিছু বিষয়কে তারা খুবই পছন্দ করে এবং দিনরাত সেগুলো নিয়েই পড়ে থাকে। আবার কিছু বিষয়কে তারা ভয় পায়, সহ্য করতে পারে না। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের বিচার-বুদ্ধির কোন উন্নতি হয় না। ডাক্তারি ভাষায় এদেরকে বলা হয় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু বা কোন একটি বিষয়ে অত্যধিক ঝোঁকসম্পন্ন শিশু।
সাধারণভাবে এদের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হিসেবে গণ্য করা হয়। সারা জীবনই পরিবার, সমাজ এবং দেশের জন্য তারা একটি বোঝা হয়ে বেঁচে থাকে। অটিজমের নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। পরিবেশগত ও বংশগত কারণেও এই রোগ হতে পারে। সাধারণত জটিলতা, লক্ষণ অথবা তীব্রতার ওপর নির্ভর করে এর কারণগুলো বিভিন্ন হতে পারে। কী কী কারণে অটিজম হতে পারে, সেই সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে সতর্ক হলে অটিজম প্রতিরোধ সম্ভব হতে পারে।
চিকিৎসকদের মতে, ভাইরাল ইনফেকশন, গর্ভকালীন জটিলতা এবং বায়ু দূষণকারী উপাদানসমূহ স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার হওয়ার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন জীনের কারণে অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার হতে পারে। আবার কোন কোন শিশুর ক্ষেত্রে জেনেটিক ডিজঅর্ডার যেমন- রেট সিন্ড্রোম বা ফ্র্যাজাইল এক্স সিন্ড্রোমের সাথে এই রোগটি হতে পারে। কিছু জিন মস্তিষ্কের কোষসমূহের পরিবহন ব্যবস্থায় বাধা প্রদান করে এবং রোগের তীব্রতা বৃদ্ধি করে। জেনেটিক বা জিনগত সমস্যা বংশগতও হতে পারে, আবার নির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই এই রোগটি হতে পারে।
ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধকের সঙ্গে অটিজমের কোন সম্পর্ক পাওয়া যায়নি। আসুন আমরা সবাই অটিজম সম্পর্কে সচেতন হই। বিশেষ করে গর্ভাবস্থায় মায়ের প্রতি যতœবান হই। যেসব সমস্যার কারণে শিশুর অটিজমসহ অন্যান্য রোগের সৃষ্টি হতে পারে, সেসব কারণ সম্পর্কে সচেতন হই। সেই সঙ্গে পরিবার সমাজ এবং রাষ্ট্রের সর্বস্তরে অটিজম আক্রান্ত শিশুদের প্রতি সমবেদনা ও ভালোবাসা সৃষ্টি করি। তাদের সুস্থ করে তোলার মাধ্যমে দেশের সম্পদে পরিণত করি। যাতে তারাও সুস্থ হয়ে তাদের উপযোগী বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে পারে। তাহলেই একজন অটিস্টিক শিশু বা ব্যক্তি এই সুন্দর পৃথিবীতে তার বেঁচে থাকার উপলক্ষ্য পাবে।
[লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি]
মাহতাব হোসাইন মাজেদ
মঙ্গলবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৪
অটিজম শব্দটি গ্রিক শব্দ থেকে আগত, যার অর্থ আত্ম বা নিজ থেকে এসেছে। শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন সুইস মনোবিজ্ঞানী চিকিৎসক অয়গেন বয়লার। অটিজম শিশুর মানসিক সমস্যাকে বোঝানো হয়। অটিজম কোনো রোগ নয়। এটি স্নায়ু বিকাশজনিত সমস্যার একটি বিস্তৃত রূপ বা অটিজ স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার নামে পরিচিত। এখানে স্নায়ু শব্দটি স্নায়ুতন্ত্র বা মস্তিষ্কের সাথে স্নায়ুর সম্পর্ক বোঝায়। অটিজম উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেরও একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা।
এক গবেষণায় জানা গেছে, গ্রামের তুলনায় শহরে অটিস্টিক শিশু জন্মের হার বেশি। গ্রামে প্রতি ১০ হাজারে ১৪ জন এবং শহর এলাকায় প্রতি ১০ হাজারে ২৫ শিশু অটিজম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। মেয়ে শিশুর চাইতে ছেলে শিশুর মধ্যে অটিজমে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় আড়াই গুণ বেশি। এছাড়াও দেশে ১৬ থেকে ৩০ মাস বয়সি শিশুদের মধ্যে অটিজম বিস্তারের হার প্রতি ১০ হাজারে ১৭ জন। গ্রামের চেয়ে শহরে অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা বেড়েছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মতে, দেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির মধ্যে ২ দশমিক ৮৭ শতাংশ অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। তবে ধারণানুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় দেড় লাখের মতো অটিজম আক্রান্ত মানুষ রয়েছে। প্রতি বছর তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে আরও প্রায় ১ হাজার ৫০০ শিশু।
অটিজম মূলত মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশের প্রতিবন্ধকতাজনিত একটি মানসিক রোগ। এটি মানুষের হরমোনজনিত সমস্যার বহিঃপ্রকাশ। এটির প্রতীকী রং নীল। অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্য যেমন আলাদা; তেমনি তাদের প্রতিভাও ভিন্ন। কেউ হয়তো ভালো ছবি আঁকতে পারছে, কেউ বা নিজের কাজগুলো গুছিয়ে করতে পারে। এসবই অটিজমে আক্রান্ত শিশুর সাফল্য বলে খুশি থাকতে হবে। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর জন্য কেবল মাকে নয়, বাবাকেও সময় ও সহযোগিতা করতে হবে। জিমনেসিয়াম, সুইমিং পুলে সপ্তাহে অন্তত একদিন বিশেষ শিশুদের জন্য সুযোগ রাখা প্রয়োজন। বিশেষ শিশুদের অভিভাবকদের অবশ্যই কাউন্সিলিং দরকার। কারণ এই শিশুদের অভিভাবকরা ভালো থাকলে তাদের সন্তানটিও ভালো থাকবে। আর অটিজম শিশুদের এমন একটি মানসিক রোগ যাতে তারা কথা, কাজ-কর্ম বা খেলাধুলা ইত্যাদির মাধ্যমে অন্য শিশুদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে পারে না। শুধু শিশু নয়, বড়দের সঙ্গেও তারা সম্পর্ক গড়তে পারে না।
মোটকথা তারা সামাজিকতা আয়ত্ত করতে পারে না। সারাক্ষণ নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সদাসর্বদা কল্পনার এক অবাস্তব জগতে ডুবে থাকে তারা। নানা রকমের কাল্পনিক শব্দ শোনে, কাল্পনিক দৃশ্য দেখে। কিছু বিষয়কে তারা খুবই পছন্দ করে এবং দিনরাত সেগুলো নিয়েই পড়ে থাকে। আবার কিছু বিষয়কে তারা ভয় পায়, সহ্য করতে পারে না। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের বিচার-বুদ্ধির কোন উন্নতি হয় না। ডাক্তারি ভাষায় এদেরকে বলা হয় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু বা কোন একটি বিষয়ে অত্যধিক ঝোঁকসম্পন্ন শিশু।
সাধারণভাবে এদের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হিসেবে গণ্য করা হয়। সারা জীবনই পরিবার, সমাজ এবং দেশের জন্য তারা একটি বোঝা হয়ে বেঁচে থাকে। অটিজমের নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। পরিবেশগত ও বংশগত কারণেও এই রোগ হতে পারে। সাধারণত জটিলতা, লক্ষণ অথবা তীব্রতার ওপর নির্ভর করে এর কারণগুলো বিভিন্ন হতে পারে। কী কী কারণে অটিজম হতে পারে, সেই সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে সতর্ক হলে অটিজম প্রতিরোধ সম্ভব হতে পারে।
চিকিৎসকদের মতে, ভাইরাল ইনফেকশন, গর্ভকালীন জটিলতা এবং বায়ু দূষণকারী উপাদানসমূহ স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার হওয়ার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন জীনের কারণে অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার হতে পারে। আবার কোন কোন শিশুর ক্ষেত্রে জেনেটিক ডিজঅর্ডার যেমন- রেট সিন্ড্রোম বা ফ্র্যাজাইল এক্স সিন্ড্রোমের সাথে এই রোগটি হতে পারে। কিছু জিন মস্তিষ্কের কোষসমূহের পরিবহন ব্যবস্থায় বাধা প্রদান করে এবং রোগের তীব্রতা বৃদ্ধি করে। জেনেটিক বা জিনগত সমস্যা বংশগতও হতে পারে, আবার নির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই এই রোগটি হতে পারে।
ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধকের সঙ্গে অটিজমের কোন সম্পর্ক পাওয়া যায়নি। আসুন আমরা সবাই অটিজম সম্পর্কে সচেতন হই। বিশেষ করে গর্ভাবস্থায় মায়ের প্রতি যতœবান হই। যেসব সমস্যার কারণে শিশুর অটিজমসহ অন্যান্য রোগের সৃষ্টি হতে পারে, সেসব কারণ সম্পর্কে সচেতন হই। সেই সঙ্গে পরিবার সমাজ এবং রাষ্ট্রের সর্বস্তরে অটিজম আক্রান্ত শিশুদের প্রতি সমবেদনা ও ভালোবাসা সৃষ্টি করি। তাদের সুস্থ করে তোলার মাধ্যমে দেশের সম্পদে পরিণত করি। যাতে তারাও সুস্থ হয়ে তাদের উপযোগী বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে পারে। তাহলেই একজন অটিস্টিক শিশু বা ব্যক্তি এই সুন্দর পৃথিবীতে তার বেঁচে থাকার উপলক্ষ্য পাবে।
[লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি]