রাকিবুল ইসলাম
তাঁতশিল্পের ইতিহাসে বগুড়ার শাওইল বাজার দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। উত্তরবঙ্গের এই তাঁতীগোষ্ঠী আজও ধরে রেখেছে তাদের ঐতিহ্যবাহী তাঁত সংস্কৃতি। বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলার নশরৎপুর ইউনিয়নের ছোট্ট একটি গ্রাম শাওইল, যেখানে কয়েক দশক ধরে তাঁতী শ্রেণীর মানুষের বসবাস। এই গ্রামের তাঁত শিল্পের বিকাশ ঘটেছে কয়েক প্রজন্ম ধরে, যা এক বিশাল তাঁতপল্লীতে পরিণত হয়েছে।
ঢাকা, গাজীপুর, সাভার এবং নারায়ণগঞ্জের পোশাক কারখানাগুলো থেকে আসা বাতিলকৃত ঝুট কাপড় শাওইল বাজারে এনে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। কাপড় থেকে হস্তচালিত যন্ত্রে সুতা কেটে ওয়েল্ডিং, ববিন করা এবং এরপর সুতা রং করা হয়। প্রক্রিয়াজাতকৃত এই সুতা কিনতে রাজধানী ঢাকাসহ চট্টগ্রাম, রংপুর, নরসিংদী, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ, জয়পুরহাট, বান্দরবান, খাগড়াছড়িসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা আসেন।
শাওইলের স্থানীয় তাঁতীরা বাজার থেকে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সুতা সংগ্রহ করে। সুতাগুলো দিয়ে তাঁতীরা বড় চাদর, কম্বল, লুঙ্গি, গামছা, তোয়ালেসহ বিভিন্ন ধরনের শীতবস্ত্র তৈরি করেন। প্রতিটি পরিবারের সদস্যরা এ কাজে জড়িত, যার ফলে তারা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে সংসারের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনছেন।
তাঁতের খটখট শব্দ আর সুতার বুননে মিশে আছে শাওইলের মানুষের স্বপ্ন। অনেকের নিজস্ব তাঁত রয়েছে, আবার কেউ অন্যের তাঁতে কাজ করছেন। প্রতিটি বাড়িতে ১ থেকে ৫টি তাঁত রয়েছে, যেগুলোর কোনোটি বৈদ্যুতিক, আবার কোনোটি সম্পূর্ণ হাতে তৈরি বাঁশ-কাঠের তাঁত।
উন্নতমানের চাদর তৈরি হওয়ায় এই চাদর দেশের গ-ি পেরিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। শাওইলের তাঁত শিল্প প্রচারবিহীন এবং সরকারি-বেসরকারি সহায়তা ছাড়াই গড়ে উঠেছে। চাদর তৈরির পাশাপাশি এখানে শীতবস্ত্র তৈরির মেশিন, সুতা, রং, তাঁত যন্ত্রপাতি ও লাটাইয়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
শাওইল হাটের সূচনা হয়েছিল মাত্র পাঁচটি দোকান নিয়ে কিন্তু বর্তমানে সেখানে প্রায় আড়াই হাজার দোকান রয়েছে। অনেকেই বংশ পরম্পরায়, আবার কেউ নতুন করে ব্যবসা শুরু করছেন।
শাওইল ছাড়াও দত্তবাড়িয়া, কোমারপুর, মঙ্গলপুর, বিনাহালীসহ আশপাশের শতাধিক গ্রামের চিত্র একইরকম। আশপাশের প্রায় ৮ হাজার তাঁতী পরিবার এবং লক্ষাধিক মানুষ তাঁত শিল্পের ওপর নির্ভরশীল।
শাওইল বাজারে ১০ হাজারের বেশি শ্রমিক সুতা বাছাই, ফেটি তৈরি এবং সুতা সাজানোর কাজ করছেন। পুরুষ শ্রমিকরা দৈনিক ৩০০ টাকা এবং মহিলা শ্রমিকরা ১৫০ থেকে ২০০ টাকা মজুরি পান।
শাওইল বাজারে প্রতি শীতকালে ২০ লাখ কম্বল, এক কোটি চাদর, ৫০ লাখ গামছা ও তোয়ালে তৈরি হয়। পাইকারিতে চাদর ১০০ থেকে ১০০০ টাকা, কম্বল ১০০ থেকে ৩০০ টাকা এবং গামছা ৫০ থেকে ১০০ টাকা দরে বিক্রি হয়।
বাজারটি দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখলেও এখানকার ব্যবসায়ীরা সরকারি সাহায্য থেকে বঞ্চিত। এখানে সরকারি কোনো ব্যাংক নেই এবং বেসরকারি ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিংও পর্যাপ্ত নয়। তাছাড়া বাজারে পুলিশ বক্স বা ছাউনি না থাকায় ক্রেতা-বিক্রেতারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
সরকারের উচিত শাওইল বাজারের উন্নয়নে উদ্যোগ নেয়া, তাঁত শিল্প রক্ষায় প্রকল্প চালু করা এবং এখানে তৈরি চাদর সরকারিভাবে বিদেশে রপ্তানির ব্যবস্থা করা।
[লেখক : সংস্কৃতিকর্মী]
রাকিবুল ইসলাম
বুধবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৪
তাঁতশিল্পের ইতিহাসে বগুড়ার শাওইল বাজার দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। উত্তরবঙ্গের এই তাঁতীগোষ্ঠী আজও ধরে রেখেছে তাদের ঐতিহ্যবাহী তাঁত সংস্কৃতি। বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলার নশরৎপুর ইউনিয়নের ছোট্ট একটি গ্রাম শাওইল, যেখানে কয়েক দশক ধরে তাঁতী শ্রেণীর মানুষের বসবাস। এই গ্রামের তাঁত শিল্পের বিকাশ ঘটেছে কয়েক প্রজন্ম ধরে, যা এক বিশাল তাঁতপল্লীতে পরিণত হয়েছে।
ঢাকা, গাজীপুর, সাভার এবং নারায়ণগঞ্জের পোশাক কারখানাগুলো থেকে আসা বাতিলকৃত ঝুট কাপড় শাওইল বাজারে এনে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। কাপড় থেকে হস্তচালিত যন্ত্রে সুতা কেটে ওয়েল্ডিং, ববিন করা এবং এরপর সুতা রং করা হয়। প্রক্রিয়াজাতকৃত এই সুতা কিনতে রাজধানী ঢাকাসহ চট্টগ্রাম, রংপুর, নরসিংদী, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ, জয়পুরহাট, বান্দরবান, খাগড়াছড়িসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা আসেন।
শাওইলের স্থানীয় তাঁতীরা বাজার থেকে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সুতা সংগ্রহ করে। সুতাগুলো দিয়ে তাঁতীরা বড় চাদর, কম্বল, লুঙ্গি, গামছা, তোয়ালেসহ বিভিন্ন ধরনের শীতবস্ত্র তৈরি করেন। প্রতিটি পরিবারের সদস্যরা এ কাজে জড়িত, যার ফলে তারা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে সংসারের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনছেন।
তাঁতের খটখট শব্দ আর সুতার বুননে মিশে আছে শাওইলের মানুষের স্বপ্ন। অনেকের নিজস্ব তাঁত রয়েছে, আবার কেউ অন্যের তাঁতে কাজ করছেন। প্রতিটি বাড়িতে ১ থেকে ৫টি তাঁত রয়েছে, যেগুলোর কোনোটি বৈদ্যুতিক, আবার কোনোটি সম্পূর্ণ হাতে তৈরি বাঁশ-কাঠের তাঁত।
উন্নতমানের চাদর তৈরি হওয়ায় এই চাদর দেশের গ-ি পেরিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। শাওইলের তাঁত শিল্প প্রচারবিহীন এবং সরকারি-বেসরকারি সহায়তা ছাড়াই গড়ে উঠেছে। চাদর তৈরির পাশাপাশি এখানে শীতবস্ত্র তৈরির মেশিন, সুতা, রং, তাঁত যন্ত্রপাতি ও লাটাইয়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
শাওইল হাটের সূচনা হয়েছিল মাত্র পাঁচটি দোকান নিয়ে কিন্তু বর্তমানে সেখানে প্রায় আড়াই হাজার দোকান রয়েছে। অনেকেই বংশ পরম্পরায়, আবার কেউ নতুন করে ব্যবসা শুরু করছেন।
শাওইল ছাড়াও দত্তবাড়িয়া, কোমারপুর, মঙ্গলপুর, বিনাহালীসহ আশপাশের শতাধিক গ্রামের চিত্র একইরকম। আশপাশের প্রায় ৮ হাজার তাঁতী পরিবার এবং লক্ষাধিক মানুষ তাঁত শিল্পের ওপর নির্ভরশীল।
শাওইল বাজারে ১০ হাজারের বেশি শ্রমিক সুতা বাছাই, ফেটি তৈরি এবং সুতা সাজানোর কাজ করছেন। পুরুষ শ্রমিকরা দৈনিক ৩০০ টাকা এবং মহিলা শ্রমিকরা ১৫০ থেকে ২০০ টাকা মজুরি পান।
শাওইল বাজারে প্রতি শীতকালে ২০ লাখ কম্বল, এক কোটি চাদর, ৫০ লাখ গামছা ও তোয়ালে তৈরি হয়। পাইকারিতে চাদর ১০০ থেকে ১০০০ টাকা, কম্বল ১০০ থেকে ৩০০ টাকা এবং গামছা ৫০ থেকে ১০০ টাকা দরে বিক্রি হয়।
বাজারটি দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখলেও এখানকার ব্যবসায়ীরা সরকারি সাহায্য থেকে বঞ্চিত। এখানে সরকারি কোনো ব্যাংক নেই এবং বেসরকারি ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিংও পর্যাপ্ত নয়। তাছাড়া বাজারে পুলিশ বক্স বা ছাউনি না থাকায় ক্রেতা-বিক্রেতারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
সরকারের উচিত শাওইল বাজারের উন্নয়নে উদ্যোগ নেয়া, তাঁত শিল্প রক্ষায় প্রকল্প চালু করা এবং এখানে তৈরি চাদর সরকারিভাবে বিদেশে রপ্তানির ব্যবস্থা করা।
[লেখক : সংস্কৃতিকর্মী]