alt

উপ-সম্পাদকীয়

তরুণ সমাজ ও প্রযুক্তি নির্ভরতা : সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

মতিউর রহমান

: বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪

প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবনে এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছে, যেখানে ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে আমাদের দৈনন্দিন জীবন গভীরভাবে জড়িয়ে গেছে। এই পরিবর্তনের প্রধান অংশীদার হলো তরুণ সমাজ। তরুণ প্রজন্ম প্রযুক্তি নির্ভরতার দিকে এতটাই ঝুঁকে পড়েছে যে, তা তাদের সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন এবং মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে।

সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তনের ধরন এবং প্রযুক্তির সঙ্গে মনের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন উঠে আসছে। এসব বিষয়ের গভীরে গেলে বোঝা যায় কিভাবে প্রযুক্তি তরুণদের জীবনকে প্রভাবিত করছে এবং এর ফলাফল কী হতে পারে। একসময় সামাজিক সম্পর্কের মূল ভিত্তি ছিল সরাসরি মুখোমুখি যোগাযোগ এবং পারস্পরিক আস্থা। গ্রাম কিংবা শহরে, সব ক্ষেত্রেই মানুষ একে অপরের সঙ্গে সরাসরি দেখা করে, কথা বলে এবং সামাজিক মেলামেশার মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে তুলত; কিন্তু আজকের দিনে, প্রযুক্তিনির্ভর সমাজে এসব সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটেছে। তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ আজ সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, টিকটকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে তারা তাদের জীবনের বিভিন্ন অংশ শেয়ার করে এবং সেখান থেকেই সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে ওঠে। এই পরিবর্তনের ফলে বাস্তব জগতে সম্পর্কের গুণগতমান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন অনেকে।

তরুণ সমাজে প্রযুক্তি নির্ভরতার ফলে সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন আরও জটিল হয়ে উঠেছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে উঠলেও সেগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষণস্থায়ী এবং অগভীর। বাস্তব জীবনের মেলামেশার বদলে ভার্চুয়াল সম্পর্কগুলোতে প্রায়শই মিথ্যাচার, অতিরঞ্জন এবং ভুল বোঝাবুঝির আশঙ্কা থাকে। এর ফলে বন্ধুত্ব, প্রেম বা অন্যান্য ধরনের সম্পর্ক টেকসই হয় না, বরং একসময় ভেঙে যায়। প্রযুক্তির মাধ্যমে সহজে যোগাযোগ করা গেলেও সেই যোগাযোগের গভীরতা অনেক সময় অনুপস্থিত থাকে। তরুণরা দ্রুত মেসেজ, ইমোজি কিংবা ভিডিও কলে কথা বললেও সরাসরি মেলামেশার অভাবে সম্পর্কের আস্থা এবং আন্তরিকতা গড়ে উঠতে সময় লাগে না। এ ধরনের সম্পর্কগুলোতে মনের গভীরে থাকা অনুভূতি প্রকাশের সুযোগ কম থাকে, যা তরুণদের মধ্যে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি করে।

এই প্রযুক্তি নির্ভরতার একটি বড় প্রভাব হলো তরুণদের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার ওপর। গবেষণা বলছে, সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহার তরুণদের মধ্যে উদ্বেগ, বিষণœতা এবং আত্মবিশ্বাসের সংকট সৃষ্টি করতে পারে। ভার্চুয়াল জগতে অন্যদের জীবন দেখে তরুণরা নিজেদের জীবনের সঙ্গে তুলনা করে হতাশা বোধ করতে শুরু করে। বিশেষ করে যারা নিজেদের জীবনের কোনো এক অংশে সফল নয় বলে মনে করে, তারা প্রায়ই নিজেকে অন্যদের তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ বা অবহেলিত ভাবতে শুরু করে। এই ধরনের ভাবনা তরুণদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বাড়ায়।

ভার্চুয়াল জগতে জনপ্রিয়তা পাওয়ার আকাক্সক্ষা থেকে অনেক তরুণ নিজেদের আসল পরিচয় লুকিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিরঞ্জিত জীবন প্রদর্শন করতে শুরু করে। এর ফলে তারা নিজেদের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা বোধ করতে পারে এবং সত্যিকার জীবনে সম্পর্কের মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়। সামাজিক সম্পর্কের এই পরিবর্তনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হলো তরুণ সমাজের যোগাযোগের দক্ষতার ওপর। প্রযুক্তির মাধ্যমে দ্রুত মেসেজ পাঠানো এবং অনলাইনে কথা বলার সহজলভ্যতায় তরুণরা মুখোমুখি সংলাপ বা প্রতিক্রিয়া দেওয়ার ক্ষমতা কমিয়ে ফেলেছে। শারীরিক উপস্থিতিতে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একে অপরের সঙ্গে মেলামেশা করার দক্ষতা হ্রাস পাচ্ছে। এটি দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক মেলামেশার মানকে হ্রাস করতে পারে এবং তরুণদের একাকিত্বের অনুভূতি বাড়িয়ে তুলতে পারে।

প্রযুক্তি নির্ভরতার কারণে তরুণ সমাজের আরেকটি মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব হলো তাদের সময় ব্যবস্থাপনার ওপর। স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেটের প্রলোভনে তরুণরা প্রায়শই তাদের সময়ের বড় একটি অংশ অনলাইনে ব্যয় করে, যা তাদের পড়াশোনা, কাজ কিংবা বাস্তব জীবনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। প্রযুক্তির মাধ্যমে তরুণরা সময়মতো বিভিন্ন তথ্য পেতে পারে এবং নিজেদের কাজ সম্পন্ন করতে পারে, তবে এই নির্ভরতার ফলে তারা কার্যক্রমের প্রতি গুরুত্ব কমিয়ে ফেলে। শিক্ষাজীবনে মনোযোগের অভাব, কাজের দক্ষতা হ্রাস এবং সামগ্রিকভাবে জীবনের প্রতি উদাসীনতা তৈরি হয়। এর ফলে ভবিষ্যতে পেশাগত জীবনে তাদের সফলতা এবং জীবনের স্থায়িত্ব সংকটে পড়তে পারে। তবে প্রযুক্তি নির্ভরতা সব ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে তা নয়। তরুণ সমাজের মধ্যে প্রযুক্তির মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের প্রবণতা বাড়ছে, যা তাদের দক্ষতা এবং শিক্ষার মান উন্নত করতে সহায়ক হচ্ছে। অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফর্ম, ই-বুক এবং ভিডিও টিউটোরিয়ালের মাধ্যমে তরুণরা যে কোনো সময় এবং যেকোনো স্থান থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারছে। এটি তাদের জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে সহায়ক হচ্ছে। তাছাড়া প্রযুক্তির মাধ্যমে তরুণরা তাদের সৃজনশীলতা প্রকাশ করতে পারছে, যা তাদের সামাজিক মেলামেশার নতুন দিক খুলে দিচ্ছে।

বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তরুণরা তাদের শিল্পকর্ম, লেখালেখি বা অন্য কোনো সৃজনশীল প্রচেষ্টা প্রকাশ করতে পারছে, যা তাদের পরিচিতি বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন দক্ষতা অর্জনের সুযোগও দিচ্ছে। তবে এই সব সুবিধার পাশাপাশি তরুণদের প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে পরিমিতি বোধ থাকা অত্যন্ত জরুরি। ভার্চুয়াল জগতে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করে তারা বাস্তব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো উপেক্ষা করতে শুরু করে। সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখা, মনের গভীরে থাকা অনুভূতিগুলো প্রকাশ করা এবং নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি সচেতন থাকা তাদের জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত সুবিধাগুলো গ্রহণ করতে হলে তরুণদের বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলোর গুরুত্বকেও সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। তরুণ সমাজের প্রযুক্তি নির্ভরতা সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন এবং মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তরুণদের জন্য এটি একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে, তবে এর সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে তারা জীবনের সমস্ত দিকগুলোতে সাফল্য অর্জন করতে পারবে। প্রযুক্তি নির্ভরতার ক্ষেত্রে তরুণ সমাজকে সচেতন থাকতে হবে, যাতে তারা ভার্চুয়াল এবং বাস্তব জীবনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হয় এবং সামাজিক সম্পর্কের গুরুত্বকে অবহেলা না করে।

[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

ধর্মীয় স্বাধীনতা ও কঠিন চীবরদান

ছবি

দুর্গাপূজার মর্মবাণী

মানুষ মূল্যস্ফীতি থেকে রক্ষা পাবে কীভাবে

গুজব ও মিথ্যা তথ্য : সমাজের এক ভয়াবহ ব্যাধি

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে দৃঢ় পদক্ষেপ প্রয়োজন

পুরাতত্ত্বের ধারায় সনাতনী সমাজের দুর্গাপূজা

জীবন-মৃত্যু কী?

নাসা : বিজ্ঞানের পীঠস্থান

শিক্ষা সংস্কারে প্রথাগত চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে

সাংঘাতিক ভাই, সাংঘাতিক...

প্রযুক্তির মায়াজালে বন্দি মানুষ

ছবি

এসএম সুলতান : সংস্কৃতি সত্তার সত্যপাঠ

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস

বগুড়ার তাঁতপল্লী

অটিজম কোনো রোগ নয়

জনপ্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্যার সম্বোধন কি আইনসম্মত

দুর্বল ব্যাংকগুলোকে কতদিন সহায়তা দেয়া হবে?

বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য বয়সবৈষম্য দূর করুন

আসন্ন বোরো উৎপাদন ও কিছু শঙ্কা

ছবি

আইন পেশার জানা-অজানা কথা

ছবি

ব্যাংক খাতের সংকট

একাকিত্ব ও মানসিক অশান্তি

বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজ

ব্রি: কিছু প্রশ্ন, কিছু উত্তর

ক্রেতা ঠকে গেলে তার আইনগত প্রতিকার

ঢাকার যানজট : কিছু প্রস্তাব

রম্যগদ্য : দারিদ্র্য যাবে জাদুঘরে

গার্মেন্টস খাতে সংকট

সরকারি হাসপাতালের টয়লেট ব্যবস্থাপনায় করুণ দশা

ডেঙ্গু থেকে বাঁচার উপায় কী

শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার বাড়াতে

বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির দুর্বলতা

ইরানের কেন কৌশলগত পরিবর্তন

শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন একে অন্যের পরিপূরক

রামু ট্র্যাজেডির এক যুগ

প্রত্যাশিত শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাবিত রূপরেখা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

তরুণ সমাজ ও প্রযুক্তি নির্ভরতা : সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

মতিউর রহমান

বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪

প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবনে এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছে, যেখানে ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে আমাদের দৈনন্দিন জীবন গভীরভাবে জড়িয়ে গেছে। এই পরিবর্তনের প্রধান অংশীদার হলো তরুণ সমাজ। তরুণ প্রজন্ম প্রযুক্তি নির্ভরতার দিকে এতটাই ঝুঁকে পড়েছে যে, তা তাদের সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন এবং মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে।

সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তনের ধরন এবং প্রযুক্তির সঙ্গে মনের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন উঠে আসছে। এসব বিষয়ের গভীরে গেলে বোঝা যায় কিভাবে প্রযুক্তি তরুণদের জীবনকে প্রভাবিত করছে এবং এর ফলাফল কী হতে পারে। একসময় সামাজিক সম্পর্কের মূল ভিত্তি ছিল সরাসরি মুখোমুখি যোগাযোগ এবং পারস্পরিক আস্থা। গ্রাম কিংবা শহরে, সব ক্ষেত্রেই মানুষ একে অপরের সঙ্গে সরাসরি দেখা করে, কথা বলে এবং সামাজিক মেলামেশার মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে তুলত; কিন্তু আজকের দিনে, প্রযুক্তিনির্ভর সমাজে এসব সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটেছে। তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ আজ সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, টিকটকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে তারা তাদের জীবনের বিভিন্ন অংশ শেয়ার করে এবং সেখান থেকেই সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে ওঠে। এই পরিবর্তনের ফলে বাস্তব জগতে সম্পর্কের গুণগতমান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন অনেকে।

তরুণ সমাজে প্রযুক্তি নির্ভরতার ফলে সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন আরও জটিল হয়ে উঠেছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে উঠলেও সেগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষণস্থায়ী এবং অগভীর। বাস্তব জীবনের মেলামেশার বদলে ভার্চুয়াল সম্পর্কগুলোতে প্রায়শই মিথ্যাচার, অতিরঞ্জন এবং ভুল বোঝাবুঝির আশঙ্কা থাকে। এর ফলে বন্ধুত্ব, প্রেম বা অন্যান্য ধরনের সম্পর্ক টেকসই হয় না, বরং একসময় ভেঙে যায়। প্রযুক্তির মাধ্যমে সহজে যোগাযোগ করা গেলেও সেই যোগাযোগের গভীরতা অনেক সময় অনুপস্থিত থাকে। তরুণরা দ্রুত মেসেজ, ইমোজি কিংবা ভিডিও কলে কথা বললেও সরাসরি মেলামেশার অভাবে সম্পর্কের আস্থা এবং আন্তরিকতা গড়ে উঠতে সময় লাগে না। এ ধরনের সম্পর্কগুলোতে মনের গভীরে থাকা অনুভূতি প্রকাশের সুযোগ কম থাকে, যা তরুণদের মধ্যে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি করে।

এই প্রযুক্তি নির্ভরতার একটি বড় প্রভাব হলো তরুণদের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার ওপর। গবেষণা বলছে, সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহার তরুণদের মধ্যে উদ্বেগ, বিষণœতা এবং আত্মবিশ্বাসের সংকট সৃষ্টি করতে পারে। ভার্চুয়াল জগতে অন্যদের জীবন দেখে তরুণরা নিজেদের জীবনের সঙ্গে তুলনা করে হতাশা বোধ করতে শুরু করে। বিশেষ করে যারা নিজেদের জীবনের কোনো এক অংশে সফল নয় বলে মনে করে, তারা প্রায়ই নিজেকে অন্যদের তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ বা অবহেলিত ভাবতে শুরু করে। এই ধরনের ভাবনা তরুণদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বাড়ায়।

ভার্চুয়াল জগতে জনপ্রিয়তা পাওয়ার আকাক্সক্ষা থেকে অনেক তরুণ নিজেদের আসল পরিচয় লুকিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিরঞ্জিত জীবন প্রদর্শন করতে শুরু করে। এর ফলে তারা নিজেদের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা বোধ করতে পারে এবং সত্যিকার জীবনে সম্পর্কের মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়। সামাজিক সম্পর্কের এই পরিবর্তনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হলো তরুণ সমাজের যোগাযোগের দক্ষতার ওপর। প্রযুক্তির মাধ্যমে দ্রুত মেসেজ পাঠানো এবং অনলাইনে কথা বলার সহজলভ্যতায় তরুণরা মুখোমুখি সংলাপ বা প্রতিক্রিয়া দেওয়ার ক্ষমতা কমিয়ে ফেলেছে। শারীরিক উপস্থিতিতে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একে অপরের সঙ্গে মেলামেশা করার দক্ষতা হ্রাস পাচ্ছে। এটি দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক মেলামেশার মানকে হ্রাস করতে পারে এবং তরুণদের একাকিত্বের অনুভূতি বাড়িয়ে তুলতে পারে।

প্রযুক্তি নির্ভরতার কারণে তরুণ সমাজের আরেকটি মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব হলো তাদের সময় ব্যবস্থাপনার ওপর। স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেটের প্রলোভনে তরুণরা প্রায়শই তাদের সময়ের বড় একটি অংশ অনলাইনে ব্যয় করে, যা তাদের পড়াশোনা, কাজ কিংবা বাস্তব জীবনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। প্রযুক্তির মাধ্যমে তরুণরা সময়মতো বিভিন্ন তথ্য পেতে পারে এবং নিজেদের কাজ সম্পন্ন করতে পারে, তবে এই নির্ভরতার ফলে তারা কার্যক্রমের প্রতি গুরুত্ব কমিয়ে ফেলে। শিক্ষাজীবনে মনোযোগের অভাব, কাজের দক্ষতা হ্রাস এবং সামগ্রিকভাবে জীবনের প্রতি উদাসীনতা তৈরি হয়। এর ফলে ভবিষ্যতে পেশাগত জীবনে তাদের সফলতা এবং জীবনের স্থায়িত্ব সংকটে পড়তে পারে। তবে প্রযুক্তি নির্ভরতা সব ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে তা নয়। তরুণ সমাজের মধ্যে প্রযুক্তির মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের প্রবণতা বাড়ছে, যা তাদের দক্ষতা এবং শিক্ষার মান উন্নত করতে সহায়ক হচ্ছে। অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফর্ম, ই-বুক এবং ভিডিও টিউটোরিয়ালের মাধ্যমে তরুণরা যে কোনো সময় এবং যেকোনো স্থান থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারছে। এটি তাদের জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে সহায়ক হচ্ছে। তাছাড়া প্রযুক্তির মাধ্যমে তরুণরা তাদের সৃজনশীলতা প্রকাশ করতে পারছে, যা তাদের সামাজিক মেলামেশার নতুন দিক খুলে দিচ্ছে।

বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তরুণরা তাদের শিল্পকর্ম, লেখালেখি বা অন্য কোনো সৃজনশীল প্রচেষ্টা প্রকাশ করতে পারছে, যা তাদের পরিচিতি বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন দক্ষতা অর্জনের সুযোগও দিচ্ছে। তবে এই সব সুবিধার পাশাপাশি তরুণদের প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে পরিমিতি বোধ থাকা অত্যন্ত জরুরি। ভার্চুয়াল জগতে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করে তারা বাস্তব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো উপেক্ষা করতে শুরু করে। সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখা, মনের গভীরে থাকা অনুভূতিগুলো প্রকাশ করা এবং নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি সচেতন থাকা তাদের জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত সুবিধাগুলো গ্রহণ করতে হলে তরুণদের বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলোর গুরুত্বকেও সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। তরুণ সমাজের প্রযুক্তি নির্ভরতা সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন এবং মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তরুণদের জন্য এটি একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে, তবে এর সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে তারা জীবনের সমস্ত দিকগুলোতে সাফল্য অর্জন করতে পারবে। প্রযুক্তি নির্ভরতার ক্ষেত্রে তরুণ সমাজকে সচেতন থাকতে হবে, যাতে তারা ভার্চুয়াল এবং বাস্তব জীবনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হয় এবং সামাজিক সম্পর্কের গুরুত্বকে অবহেলা না করে।

[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

back to top