জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস
দুর্গাপুজো শুরু হয়ে গেছে। সনাতনী বিশ্বাস মতে দেবী এসেছেন দোলায়। আর ফিরে যাবেন ঘোড়ায় চড়ে। যার ফলাফল হলো- দেশজুড়ে মহামারী, হানাহানি আর অস্থিরতা। কেমন যেন মিলে যাচ্ছে আমাদের নিকট অতীতের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে।
এটা আর কিছুই না। প্রাচীনকালের উপমহাদেশীয় প-িতেরা সময় ও পরিবেশ বিবেচনা করে কিছু প্রতীকের মাধ্যমে সমসাময়িক প্রেক্ষাপট এভাবেই জনসমক্ষে উপস্থাপন করতেন। কারণ সে সময় লেখালিখির পদ্ধতি এবং সামগ্রী ছিল না বা থাকলেও এত সহজলোভ্য ছিল না। আর তারা এগুলো ওভাবে করতেন বলেই আজ আমরা শিল্প-সাহিত্য-অঙ্ক-কম্পিউটার, সিমুলেশন-মডেলিংয়ের ধাপ মাড়িয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে পা রাখতে পেরেছি। তাই পুজোকে অবৈজ্ঞানিক-অযৌক্তিক বলে দূরে ঠেলে দিলে আমাদের পূর্ব-পুরুষদের অসম্মান করা হয়। আর এই পুজো তো এমনি-এমনি আসেনি। এখন দেখা যাক পুজোর বিবর্তনটা কিভাবে হয়েছে।
বেঁচে থাকার ন্যূনতম প্রয়োজনে মানুষকে প্রকৃতির কাছে হাত পাততে হয়। প্রকৃতি কখনও বৈরী কখনও বা অনুকূল আচরণ করে থাকে। তাই বৈরী প্রকৃতির অনুকম্পা লাভ বা অনুকূল প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের তাগিদে মানুষের মধ্যে বিশেষ কিছু চেতনাবোধ তৈরি হয়। আর সেখান থেকেই সম্ভবত ধর্মচর্চার শুরু। শুরুতে অনাদির আদি পরমেশ্বরের চিন্তা কারও মাথায় থাকার কথা নয়। চাহিদা অনুযায়ী বিশেষ কোনো শক্তির প্রার্থনা করা মানে একজন দেবতা তৈরি করে নেওয়া হতো। সেখান থেকেই কৃষির উদ্ভাবক মেসোপোটেমিয়ানদের (প্রাচীন ইরাক বা ফার্টাইল ক্রিসেন্ট) বহু দেবী-দেবতায় বিশ্বাস করা শুরু। যেমন কৃষি ও রোগ নিরাময়ের যে দেবী ছিলেন তার নাম নিনুর্তা। পানির দেবতা এঙ্কি, বাতাসের দেবতা এনিল। বৃষ্টি ও বজ্রপাতের দেবতা ইশকুর। তাদের স্বর্গের দেবতার নাম আনু। সব মিলিয়ে মোট দেব-দেবীর সংখ্যা ছিল ৩০০০-এর ওপর। দেবদেবীদের আবার একজন রাজা ছিলেন মারদুক। এদের প্রত্যেককেই কোনো না কোনো শক্তির প্রতীক হিসেবে দেখা হতো এবং মূর্তি গড়ে পুজো করা হতো।
এ ধরনের দেব-দেবীদের পুজো করা শুধু যে মেসোপেটামিয়ানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ধীরে ধীরে প্রাচীন এশিয়া, ইউরোপ এমনকি উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার বহু অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রাচীন মিসরীয়রা অনেক দেব-দেবীকে বিশ্বাস করতো। তাদের মধ্যে আইসিশ নামে একজন খুবই প্রভাবশালী দেবী ছিলেন। গ্রিক ও রোমানদের কাছে তিনি সময় ও প্রয়োজন বুঝে মিনার্ভা, ডায়ানা, ভেনাস প্রভৃতি নামে পূজিত হতেন। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসী রেড-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে শক্তির আধার হিসেবে পূজিত বিভিন্ন দেব-দেবীর সন্ধান পাওয়া যায়।
চীন, জাপান ও কোরিয়ার আদি ধর্মগুলোতে অনেক দেব-দেবী ছিলেন। জাপানি কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন- কৃষিকাজ, ব্যবসা ও উর্বরতার দেবতা ওকুনিনুশি। সুজিন পানির দেবতা। ভারতবর্ষে দ্রাবিড়দের মধ্যেই প্রথম মূর্তিপুজো বা মাতৃপুজোর শুরু। কৌলিতত্ত্ব অনুসারে দ্রাবিড় জাতি আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে মেসোপোটামিয়া থেকে আগত কৃষকদের বংশধর। নিশ্চয়ই তারা তখন অনেক দেব-দেবী বিশ্বাস করতেন। তাদেরই সমগোত্রীয় সিন্ধু উপত্যকা এবং তার আশপাশে অধিবাসীরা যে মাতৃপুজোর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন বলে অনেক প্রমাণ বিদ্যমান।
যাই হোক, মেসোপোটামিয়ানদের মতো আর্যরাও বৃষ্টি, আগুন, বাতাস বা ঝড় ইত্যাদির জন্য আলাদা আলাদা দেবতার ভক্ত ছিল। তাদের বৃষ্টির দেবতা ইন্দ্র। তিনি আবার স্বর্গের রাজাও। আগুনের দেবতা অগ্নি। ঝড়ের দেবতা মরুৎ। অন্যান্য দেবতাদের মধ্যে রুদ্র, প্রজাপতি সোম; এসব দেবতাদের নাম বেদে উল্লেখ আছে। এরা সবাই পুরুষ। তবে নারী দেবতাও যে নেই তা নয়। যেমন জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতী, ধন-ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মী, ভোরের দেবী উষা প্রমুখ।
তাদের দেবতার সংখ্যা ৩৩ কোটি বলা হলেও প্রকৃত দেবতার সংখ্যা মাত্র ৩৩। মধ্য-এশিয়া থেকে উত্তর-পশ্চিম ভারতে আগত আর্যরা মূর্তি পুজোয় বিশ্বাসী ছিলেন না বলে অনেকে মনে করেন। সেটা পুরোপুরি সঠিক নয়। কারণ মেসোপটেমিয়ানদের আবাসভূমি ‘ফার্টাইল-ক্রিসেন্ট’ থেকে তাদের আদি বাসস্থান বেশি দূরে ছিল না। যাই হোক, বিশেষজ্ঞদের মতে ঋগে¦দের দেবীসুক্ত ও রাত্রিসুক্তে নাকি শক্তিপূজার কথা জোর দিয়েই বলা আছে। যজুর্বেদ বা উপনিষদেও শক্তি পুজোর উল্লেখ আছে। সেটা যজ্ঞের আদলে বা মূর্তির আদলে যেভাবেই হোক না কেন শক্তির আরাধনা তো! আমার বিশ্বাস শুরুতে যজ্ঞোর আদলে হলেও পরে সেটা এক সময় মূর্তিপুজোয় রূপ নেয়।
ভারতবর্ষে অস্ট্রো-এশীয় মানুষের আগমন ঘটেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে এলেও এই মানুষদের আদি উৎস কিন্তু আফ্রিকাই। এসব অস্ট্রো-এশীয়রা পুরোপুরিভাবে সর্ব-প্রাণবাদী এবং প্রকৃতি পূজারি ছিলেন। এখনও অধিকাংশ বিশুদ্ধ অস্ট্রো-এশীয় জনজাতির মধ্যে এই প্রথা চালু আছে। তবে কেউ কেউ (বা কোনো কোনো সমাজ) প্রভাবিত হয়ে বৃহত্তর সমাজে প্রচলিত প্রথার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছেন। এমনকি অনেক জাতিগোষ্ঠী মিলে এক শঙ্কর জাতি হয়ে গেছেন। যেমন বাঙালি।
প্রধানত আদি-অস্ট্রেলীয়, ভোট-মঙ্গোলীয় এবং কিছুটা দ্রাবিড় জনজাতিদের মিশ্রিত পূর্বপুরুষ থেকে আজকের বাঙালি জাতির সৃষ্টি। কৌলিতাত্ত্বিক ধারায় বাঙালির ওপর আর্যরক্তের খুব বেশি প্রভাব না পড়লেও তাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ছিল প্রবল। ফলশ্রুতিতে তাই বাঙালিদের মধ্যে আর্য-অনার্য সব ধারা মিলে একাকার হয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই অনার্য শিব-দুর্গা-কালী দেব-দেবীগুলোর প্রভাব বেশি থাকলেও বাঙালিদের মধ্যে আর্য দেবতা ব্রহ্মা-বিষ্ণুর প্রভাবও কম নেই। তারপরও দুর্গাদেবী বাঙালিদের কাছে একটু বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকেন। কারণ দুর্গাকে দেখা হয় সমস্ত দেবতাদের মিলিত শক্তি মহিষাসুর মর্দিনী হিসেবে। মহিষাসুর এখানে অশুভ শক্তির প্রতীক। মার্কে-য় পুরান বা চ-ীগ্রন্থে এমনই বর্ণনা আছে। বিশ্বাস করুক আর না করুক অধিকাংশ সনাতনী পুরাণের এই বর্ণনাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে থাকেন। তবে আধুনিক চিন্তা-চেতনার ধারক বাহক সনাতনীরা মার্কে-য় পুরাণের বর্ণনাকে এক পরাবাস্তব চিত্র হিসেবে ভাবতে ভালোবাসেন। পাশাপাশি শিল্পীরাও সেভাবে বিষয়টা তুলে ধরেন। যাই হোক, সাধারণের বিশ্বাস তো বিজ্ঞান মেনে চলে না। চলে আবেগ দিয়ে; কিন্তু আমি মনে করি সাধারণের বিশ্বাসকেও মূল্যায়ন করা দরকার। অন্য কথায় চ-ীগ্রন্থকে একটি উচ্চাঙ্গের প্রাচীন সাহিত্য হিসেবে ধরে নেওয়া চলে। জীবশিক্ষার প্রয়োজনে ঋষি-কবি মার্ক-েয় এই কাহিনী-কাব্যে মহাশক্তির অবতার হিসেবে দুর্গাকে বিধৃত করেছেন। নিঃসন্দেহে তিনি একজন উঁচুমানের কবি ছিলেন। কবির কল্পনাতো কোনো বাঁধ মানে না।
যাই হোক, দুর্গাপুজো যেখান থেকে যেভাবেই আসুক না কেন সেটা কোনো বিষয় নয়। বিষয় হলো এই পুজো আজ বাঙালি সনাতনী সমাজের নিজস্ব মেগা-উৎসব। এই উৎসবের পরিধিটা যেন ধর্মীয় বিধিবিধানের বাইরে চলে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। পাশাপাশি পরিবেশের বিষয়টাও মাথায় রাখতে হবে। পুজোর সময় শব্দ-বাজি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ধূপ-ধুনো-মোমবাতি প্রজ্বালন একটু সীমার মধ্যে করলে গ্রিনহাউস গ্যাস কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে থাকবে। পুজারি ও ভক্তদের চার-পাঁচ দিন ধরে ব্যবহৃত প্রসাদের ঠোঙা, প্লাস্টিক ব্যাগ যেন পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক না হয়ে দাঁড়ায়; প্রতিমা তৈরিতে ব্যবহৃত রঙ যেন পানি ও পরিবেশের জন্য বিপদের কারণ না হয়ে যায়; সেগুলো খেয়াল রাখতে হবে। অর্থাৎ কোনোক্রমেই যেন মা দুর্গার সন্তানদের কোনো প্রকার অমঙ্গল না হয়। তাহলেই তিনি দোলায় আসুন আর ঘোড়ায় ফিরে যান; সেটা আমাদের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না।
[লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট; সাবেক নির্বাহী পরিচালক, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন]
জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস
শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪
দুর্গাপুজো শুরু হয়ে গেছে। সনাতনী বিশ্বাস মতে দেবী এসেছেন দোলায়। আর ফিরে যাবেন ঘোড়ায় চড়ে। যার ফলাফল হলো- দেশজুড়ে মহামারী, হানাহানি আর অস্থিরতা। কেমন যেন মিলে যাচ্ছে আমাদের নিকট অতীতের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে।
এটা আর কিছুই না। প্রাচীনকালের উপমহাদেশীয় প-িতেরা সময় ও পরিবেশ বিবেচনা করে কিছু প্রতীকের মাধ্যমে সমসাময়িক প্রেক্ষাপট এভাবেই জনসমক্ষে উপস্থাপন করতেন। কারণ সে সময় লেখালিখির পদ্ধতি এবং সামগ্রী ছিল না বা থাকলেও এত সহজলোভ্য ছিল না। আর তারা এগুলো ওভাবে করতেন বলেই আজ আমরা শিল্প-সাহিত্য-অঙ্ক-কম্পিউটার, সিমুলেশন-মডেলিংয়ের ধাপ মাড়িয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে পা রাখতে পেরেছি। তাই পুজোকে অবৈজ্ঞানিক-অযৌক্তিক বলে দূরে ঠেলে দিলে আমাদের পূর্ব-পুরুষদের অসম্মান করা হয়। আর এই পুজো তো এমনি-এমনি আসেনি। এখন দেখা যাক পুজোর বিবর্তনটা কিভাবে হয়েছে।
বেঁচে থাকার ন্যূনতম প্রয়োজনে মানুষকে প্রকৃতির কাছে হাত পাততে হয়। প্রকৃতি কখনও বৈরী কখনও বা অনুকূল আচরণ করে থাকে। তাই বৈরী প্রকৃতির অনুকম্পা লাভ বা অনুকূল প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের তাগিদে মানুষের মধ্যে বিশেষ কিছু চেতনাবোধ তৈরি হয়। আর সেখান থেকেই সম্ভবত ধর্মচর্চার শুরু। শুরুতে অনাদির আদি পরমেশ্বরের চিন্তা কারও মাথায় থাকার কথা নয়। চাহিদা অনুযায়ী বিশেষ কোনো শক্তির প্রার্থনা করা মানে একজন দেবতা তৈরি করে নেওয়া হতো। সেখান থেকেই কৃষির উদ্ভাবক মেসোপোটেমিয়ানদের (প্রাচীন ইরাক বা ফার্টাইল ক্রিসেন্ট) বহু দেবী-দেবতায় বিশ্বাস করা শুরু। যেমন কৃষি ও রোগ নিরাময়ের যে দেবী ছিলেন তার নাম নিনুর্তা। পানির দেবতা এঙ্কি, বাতাসের দেবতা এনিল। বৃষ্টি ও বজ্রপাতের দেবতা ইশকুর। তাদের স্বর্গের দেবতার নাম আনু। সব মিলিয়ে মোট দেব-দেবীর সংখ্যা ছিল ৩০০০-এর ওপর। দেবদেবীদের আবার একজন রাজা ছিলেন মারদুক। এদের প্রত্যেককেই কোনো না কোনো শক্তির প্রতীক হিসেবে দেখা হতো এবং মূর্তি গড়ে পুজো করা হতো।
এ ধরনের দেব-দেবীদের পুজো করা শুধু যে মেসোপেটামিয়ানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ধীরে ধীরে প্রাচীন এশিয়া, ইউরোপ এমনকি উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার বহু অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রাচীন মিসরীয়রা অনেক দেব-দেবীকে বিশ্বাস করতো। তাদের মধ্যে আইসিশ নামে একজন খুবই প্রভাবশালী দেবী ছিলেন। গ্রিক ও রোমানদের কাছে তিনি সময় ও প্রয়োজন বুঝে মিনার্ভা, ডায়ানা, ভেনাস প্রভৃতি নামে পূজিত হতেন। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসী রেড-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে শক্তির আধার হিসেবে পূজিত বিভিন্ন দেব-দেবীর সন্ধান পাওয়া যায়।
চীন, জাপান ও কোরিয়ার আদি ধর্মগুলোতে অনেক দেব-দেবী ছিলেন। জাপানি কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন- কৃষিকাজ, ব্যবসা ও উর্বরতার দেবতা ওকুনিনুশি। সুজিন পানির দেবতা। ভারতবর্ষে দ্রাবিড়দের মধ্যেই প্রথম মূর্তিপুজো বা মাতৃপুজোর শুরু। কৌলিতত্ত্ব অনুসারে দ্রাবিড় জাতি আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে মেসোপোটামিয়া থেকে আগত কৃষকদের বংশধর। নিশ্চয়ই তারা তখন অনেক দেব-দেবী বিশ্বাস করতেন। তাদেরই সমগোত্রীয় সিন্ধু উপত্যকা এবং তার আশপাশে অধিবাসীরা যে মাতৃপুজোর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন বলে অনেক প্রমাণ বিদ্যমান।
যাই হোক, মেসোপোটামিয়ানদের মতো আর্যরাও বৃষ্টি, আগুন, বাতাস বা ঝড় ইত্যাদির জন্য আলাদা আলাদা দেবতার ভক্ত ছিল। তাদের বৃষ্টির দেবতা ইন্দ্র। তিনি আবার স্বর্গের রাজাও। আগুনের দেবতা অগ্নি। ঝড়ের দেবতা মরুৎ। অন্যান্য দেবতাদের মধ্যে রুদ্র, প্রজাপতি সোম; এসব দেবতাদের নাম বেদে উল্লেখ আছে। এরা সবাই পুরুষ। তবে নারী দেবতাও যে নেই তা নয়। যেমন জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতী, ধন-ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মী, ভোরের দেবী উষা প্রমুখ।
তাদের দেবতার সংখ্যা ৩৩ কোটি বলা হলেও প্রকৃত দেবতার সংখ্যা মাত্র ৩৩। মধ্য-এশিয়া থেকে উত্তর-পশ্চিম ভারতে আগত আর্যরা মূর্তি পুজোয় বিশ্বাসী ছিলেন না বলে অনেকে মনে করেন। সেটা পুরোপুরি সঠিক নয়। কারণ মেসোপটেমিয়ানদের আবাসভূমি ‘ফার্টাইল-ক্রিসেন্ট’ থেকে তাদের আদি বাসস্থান বেশি দূরে ছিল না। যাই হোক, বিশেষজ্ঞদের মতে ঋগে¦দের দেবীসুক্ত ও রাত্রিসুক্তে নাকি শক্তিপূজার কথা জোর দিয়েই বলা আছে। যজুর্বেদ বা উপনিষদেও শক্তি পুজোর উল্লেখ আছে। সেটা যজ্ঞের আদলে বা মূর্তির আদলে যেভাবেই হোক না কেন শক্তির আরাধনা তো! আমার বিশ্বাস শুরুতে যজ্ঞোর আদলে হলেও পরে সেটা এক সময় মূর্তিপুজোয় রূপ নেয়।
ভারতবর্ষে অস্ট্রো-এশীয় মানুষের আগমন ঘটেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে এলেও এই মানুষদের আদি উৎস কিন্তু আফ্রিকাই। এসব অস্ট্রো-এশীয়রা পুরোপুরিভাবে সর্ব-প্রাণবাদী এবং প্রকৃতি পূজারি ছিলেন। এখনও অধিকাংশ বিশুদ্ধ অস্ট্রো-এশীয় জনজাতির মধ্যে এই প্রথা চালু আছে। তবে কেউ কেউ (বা কোনো কোনো সমাজ) প্রভাবিত হয়ে বৃহত্তর সমাজে প্রচলিত প্রথার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছেন। এমনকি অনেক জাতিগোষ্ঠী মিলে এক শঙ্কর জাতি হয়ে গেছেন। যেমন বাঙালি।
প্রধানত আদি-অস্ট্রেলীয়, ভোট-মঙ্গোলীয় এবং কিছুটা দ্রাবিড় জনজাতিদের মিশ্রিত পূর্বপুরুষ থেকে আজকের বাঙালি জাতির সৃষ্টি। কৌলিতাত্ত্বিক ধারায় বাঙালির ওপর আর্যরক্তের খুব বেশি প্রভাব না পড়লেও তাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ছিল প্রবল। ফলশ্রুতিতে তাই বাঙালিদের মধ্যে আর্য-অনার্য সব ধারা মিলে একাকার হয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই অনার্য শিব-দুর্গা-কালী দেব-দেবীগুলোর প্রভাব বেশি থাকলেও বাঙালিদের মধ্যে আর্য দেবতা ব্রহ্মা-বিষ্ণুর প্রভাবও কম নেই। তারপরও দুর্গাদেবী বাঙালিদের কাছে একটু বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকেন। কারণ দুর্গাকে দেখা হয় সমস্ত দেবতাদের মিলিত শক্তি মহিষাসুর মর্দিনী হিসেবে। মহিষাসুর এখানে অশুভ শক্তির প্রতীক। মার্কে-য় পুরান বা চ-ীগ্রন্থে এমনই বর্ণনা আছে। বিশ্বাস করুক আর না করুক অধিকাংশ সনাতনী পুরাণের এই বর্ণনাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে থাকেন। তবে আধুনিক চিন্তা-চেতনার ধারক বাহক সনাতনীরা মার্কে-য় পুরাণের বর্ণনাকে এক পরাবাস্তব চিত্র হিসেবে ভাবতে ভালোবাসেন। পাশাপাশি শিল্পীরাও সেভাবে বিষয়টা তুলে ধরেন। যাই হোক, সাধারণের বিশ্বাস তো বিজ্ঞান মেনে চলে না। চলে আবেগ দিয়ে; কিন্তু আমি মনে করি সাধারণের বিশ্বাসকেও মূল্যায়ন করা দরকার। অন্য কথায় চ-ীগ্রন্থকে একটি উচ্চাঙ্গের প্রাচীন সাহিত্য হিসেবে ধরে নেওয়া চলে। জীবশিক্ষার প্রয়োজনে ঋষি-কবি মার্ক-েয় এই কাহিনী-কাব্যে মহাশক্তির অবতার হিসেবে দুর্গাকে বিধৃত করেছেন। নিঃসন্দেহে তিনি একজন উঁচুমানের কবি ছিলেন। কবির কল্পনাতো কোনো বাঁধ মানে না।
যাই হোক, দুর্গাপুজো যেখান থেকে যেভাবেই আসুক না কেন সেটা কোনো বিষয় নয়। বিষয় হলো এই পুজো আজ বাঙালি সনাতনী সমাজের নিজস্ব মেগা-উৎসব। এই উৎসবের পরিধিটা যেন ধর্মীয় বিধিবিধানের বাইরে চলে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। পাশাপাশি পরিবেশের বিষয়টাও মাথায় রাখতে হবে। পুজোর সময় শব্দ-বাজি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ধূপ-ধুনো-মোমবাতি প্রজ্বালন একটু সীমার মধ্যে করলে গ্রিনহাউস গ্যাস কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে থাকবে। পুজারি ও ভক্তদের চার-পাঁচ দিন ধরে ব্যবহৃত প্রসাদের ঠোঙা, প্লাস্টিক ব্যাগ যেন পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক না হয়ে দাঁড়ায়; প্রতিমা তৈরিতে ব্যবহৃত রঙ যেন পানি ও পরিবেশের জন্য বিপদের কারণ না হয়ে যায়; সেগুলো খেয়াল রাখতে হবে। অর্থাৎ কোনোক্রমেই যেন মা দুর্গার সন্তানদের কোনো প্রকার অমঙ্গল না হয়। তাহলেই তিনি দোলায় আসুন আর ঘোড়ায় ফিরে যান; সেটা আমাদের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না।
[লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট; সাবেক নির্বাহী পরিচালক, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন]