alt

opinion » post-editorial

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে দৃঢ় পদক্ষেপ প্রয়োজন

মাহতাব হোসাইন মাজেদ

: শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪

বর্তমানে বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এক গভীর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে প্রধান পত্রিকাগুলো পর্যন্ত এ বিষয়টি নিয়েই আলোচনা চলছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ক্রমাগত বেড়ে চলেছে, যা সাধারণ মানুষকে বিপাকে ফেলেছে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন, অথচ সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না।

বিশ্ববাজারে কিছু পণ্যের দাম কমলেও, বাংলাদেশে তা বেড়েই চলেছে। ফলে নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত মানুষজনের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে কৃষক, শ্রমিক, ও দিনমজুরদের জন্য এই মূল্যবৃদ্ধি ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অভাবে মানুষের মধ্যে অপুষ্টি, অনাহার, এবং বিভিন্ন রোগবালাই দেখা দিচ্ছে।

দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় কারণে-অকারণে। কোনো একটি অজুহাত পেলেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়া হয়। আর বিশ্ববাজারে সম্প্রতি দ্রব্যমূল্যের দাম কমলেও বাংলাদেশে কমা তো দূরে থাকুক রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত সবাই ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। এতে সবচেয়ে বিপদে পড়ছে সাধারণ কৃষক, শ্রমিক এবং দিন-আনি-দিন-খাই রোজগারের মানুষজন। নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অভাবে মানুষের জীবনে নেমে এসেছে অনাহার, অপুষ্টিসহ নানা প্রকার জটিল ব্যাধির প্রকোপ। ফলে সার্বিকভাবে এর প্রভাব পড়ে কোনো একটি দেশের জাতীয় ভাবমূর্তিতে। আর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন অন্তর্র্বর্তী সরকার নানা খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু দ্রব্যমূল্য কমিয়ে মানুষকে স্বস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে পদক্ষেপ কম।

সুদের হার বৃদ্ধি করে বাজারে টাকার সরবরাহ কমানো হয়েছে, যা মূল্যস্ফীতি কমাতে সহায়ক হলেও, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে ততটা কার্যকর প্রমাণিত হয়নি। কারণ, এই ধরনের পণ্যের চাহিদা সবসময় থাকে, ফলে টাকার সরবরাহ কমলেও চাহিদা কমে না। এ কারণে দ্রব্যমূল্যের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ প্রয়োজন।

আওয়ামী লীগ সরকার কিছু কিছু ক্ষেত্রে পণ্যের দাম বেঁধে দেয়ার কৌশল নিয়েছিল; কিন্তু তা কাজে আসেনি। এখনো কাজে আসছে না। বাজারে কোনো জিনিসের দাম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই। যে যার মতো দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। ৮০-১০০ টাকার নিচে তরকারি (সবজি) কেনা যায় না।

নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে, তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখনও ১০ শতাংশের ওপরে। বিশেষ করে চাল, ডাল, তেল, ডিম, মাংসসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম আকাশচুম্বী। ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে আসছে, ডলারের দাম বাড়ছে, এবং এর প্রভাব দেশের বাজারে দৃশ্যমান। তাছাড়া, জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং পানির দাম বৃদ্ধির প্রভাবও শিল্পপণ্যের উৎপাদন খরচে প্রভাব ফেলেছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ও পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও, তা তেমন কার্যকর হয়নি। তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) মূল্য নিয়ন্ত্রণ করলেও, বাস্তবে সিলিন্ডারের দাম বেড়ে চলেছে। বাজারে কোনো জিনিসের দাম নিয়ন্ত্রণে নেই, ব্যবসায়ীরা নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব। প্রথমত, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর শুল্ক এবং কর কমানো দরকার। চাল, চিনি, ভোজ্যতেল, ডিমের শুল্ক কমিয়ে সরবরাহ বাড়ানো যেতে পারে। এর ফলে বাজারে পণ্যের দাম কমবে। দ্বিতীয়ত, ডলারের দামের ভিত্তিতে শুল্ক নির্ধারণের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা উচিত।

চাল আমদানি করলে দেশীয় বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়বে, ফলে চালের দাম কমানোর সুযোগ তৈরি হবে। এছাড়া, পোলট্রি খাদ্য আমদানির প্রক্রিয়া সহজ করা উচিত, যাতে ডিম এবং মুরগির দামও কমে আসে। ডিজেলের ওপর শুল্ক কমিয়ে পরিবহন খরচ কমানো হলে, পণ্যের দামও কমবে। সরবরাহ ব্যবস্থার সংস্কার, বাজারে মনিটরিং বৃদ্ধি, এবং বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমানোও প্রয়োজন।

নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর কিছু পদক্ষেপ নেয়া হলেও, তা পর্যাপ্ত নয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পেঁয়াজ এবং আলুর শুল্ক কমিয়েছে, যার ফলে এই দুই পণ্যের দাম কিছুটা কমেছে। তবে, সামগ্রিকভাবে নিত্যপণ্যের দাম কমাতে আরও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বর্তমানে বেশ জটিল। জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে, ফলে জীবনযাত্রার মান নিম্নমুখী। এই সংকট সমাধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বৃদ্ধি সঠিক পদক্ষেপ হলেও, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সাশ্রয়ীভাবে চলার জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানোর জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ জরুরি।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আরও কার্যকর পরিকল্পনা এবং বাজার তদারকি একান্ত প্রয়োজন। জনগণের স্বার্থ রক্ষায় সরকারকে অবশ্যই বাজারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

মূল্যস্ফীতি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হারে লাগাম তুলে নিয়ে বাজারে টাকার সরবরাহ কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এর ফলে সুদের হার বেড়েছে। মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে একটা জায়গায় স্থিতিশীল হয়েছে। কিন্তু সুদের হার ও ডলারের দামের কারণে নিত্যপণ্যের ব্যবসায়ীদের খরচ বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর গত আগস্টে দায়িত্ব নেয়ার পর মূল্যস্ফীতি কমাতে সুদের হারে নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেয়ার কৌশল বাস্তবায়ন শুরু করেন। এর ফলে সুদের হার বেড়েছে। ডলারের দাম ১২০ টাকার আশপাশে মোটামুটি স্থির হয়েছে। গত মাসে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমে ১০ শতাংশের কিছুটা কম হয়েছে। যদিও খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখনো ১০ শতাংশের ওপরে। মানে হলো, গত বছরের সেপ্টেম্বরে যে খাদ্য কিনতে মানুষকে ১০০ টাকা ব্যয় করতে হতো, তা কিনতে এখন ১১০ টাকার বেশি লাগছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ৫০০টির বেশি পণ্য ও সেবার মূল্য বিবেচনায় নিয়ে মূল্যস্ফীতির হিসাব করে। তবে স্বল্প আয়ের পরিবারে চাপ পড়ে কিছু নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে। এসব পণ্যের দাম আগে থেকেই বাড়তি। মূল্যস্ফীতি অনুযায়ী মানুষের মজুরিও বাড়ছে না। বিবিএস বলছে, সেপ্টেম্বরে প্রায় ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতির বিপরীতে মজুরি বেড়েছে ৮ শতাংশের মতো। মানে হলো, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আরও কমেছে।

বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, সুদের হারে লাগাম তুলে নেয়ার পদক্ষেপ ঠিকই আছে। তাতে বাজারে টাকার সরবরাহ কমবে। পণ্যের চাহিদা কমবে। মূল্যস্ফীতি কমার সম্ভাবনাও আছে। কিন্তু অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে এই নীতি ততটা কার্যকর নয়। কারণ, সেসব পণ্যের চাহিদা সব সময়ই থাকে। বাজারে টাকার সরবরাহের ওপর ওই সব পণ্যের চাহিদা, জোগান ও দাম ততটা নির্ভর করে না। এসব পণ্যের দাম কমাতে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ দরকার।

প্রতিটি দেশের সরকারই নিজের দেশে দ্রব্যের দাম যাতে সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে না চলে যায় তার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। আমাদের দেশেও ভোক্তা অধিকার আইনসহ অন্যান্য আইনগুলো কার্যকর করা দরকার। এ ক্ষেত্রে অসাধু ও অধিক মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কঠোর হাতে দমন করা, বাজারে মনিটরিং বাড়ানো, ভ্রাম্যমাণ আদালতের নিয়মিত অভিযান পরিচালনা, বাজারে দোকানের সামনে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য তালিকা টাঙিয়ে রাখতে হবে। সর্বোপরি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে বর্ধিত দামের ওপর সরকারি ভর্তুকি প্রদান করা একান্ত প্রয়োজন। আর এই মুহূর্তে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের একটি অগ্রাধিকার কার্যক্রম হওয়া উচিত ।

[ লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি ]

চা-জনগোষ্ঠীর দণ্ডপূজা ও উপেক্ষিত অধিকার

মেরিটোক্রেসি: সমাজ ও রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা

রম্যগদ্য: হাতের মুঠোয় বিশ্ব

শারদীয় পূজার দিনলিপি

ঋণের জন্য আত্মহত্যা, ঋণ নিয়েই চল্লিশা

জাকসু নির্বাচন ও হট্টগোল: আমাদের জন্য শিক্ষণীয় কী?

নরসুন্দর পেশার গুরুত্ব ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন

বিভাগভিত্তিক এমপিআর নির্বাচন পদ্ধতি

প্ল্যাটফর্ম সমাজে বাংলাদেশ: জ্ঞানের ভবিষ্যৎ কার হাতে?

আনন্দবেদনার হাসপাতাল: সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ছবি

ভিন্ন ধরনের নির্বাচন, ভিন্ন ধরনের ফল

বেসরকারি খাতে সিআইবি’র যাত্রা: ঋণ ব্যবস্থার নতুন দিগন্ত

স্বাস্থ্যসেবায় মানবিকতা প্রতিষ্ঠা হোক

ছবি

নেপালে সরকার পতন ও বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ

ডাকসু নির্বাচন ও সংস্কারপ্রয়াস: রাজনৈতিক চিন্তার নতুন দিগন্ত

নির্বাচন কি সব সমস্যার সমাধান

জিতিয়া উৎসব

ছবি

অলির পর নেপাল কোন পথে?

রম্যগদ্য: “মরেও বাঁচবি নারে পাগলা...”

অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শ্রীপুর পৌরসভা

ভূরিভোজ, উচ্ছেদ এবং আদিবাসী পাহাড়িয়া

অনলাইন সংস্কৃতিতে হাস্যরসের সমাজবিজ্ঞান

মামলাজট নিরসনে দেওয়ানি কার্যবিধির সংস্কার

বাস্তব মস্কো বনাম বিভ্রান্ত ইউরোপ

ছাত্রসংসদ নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতির গতিপ্রকৃতি

সড়ক দুর্ঘটনা: কারও মৃত্যু সাধারণ, কারও মৃত্যু বিশেষ

ঐকমত্য ছাড়াও কিছু সংস্কার সম্ভব

আবার বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম : সংকটে সাধারণ মানুষ

ডায়াবেটিস রোগীর সেবা ও জনসচেতনতা

ভিন্ন ধরনের ডাকসু নির্বাচন

ডাকসু নির্বাচন : পেছনে ফেলে আসি

প্রসঙ্গ : এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ

“কোপা চাটিগাঁ...”

ই-কমার্স হতে পারে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন

ভারত-চীনের নতুন সমীকরণ

সাইবার যুগে মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা

tab

opinion » post-editorial

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে দৃঢ় পদক্ষেপ প্রয়োজন

মাহতাব হোসাইন মাজেদ

শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪

বর্তমানে বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এক গভীর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে প্রধান পত্রিকাগুলো পর্যন্ত এ বিষয়টি নিয়েই আলোচনা চলছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ক্রমাগত বেড়ে চলেছে, যা সাধারণ মানুষকে বিপাকে ফেলেছে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন, অথচ সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না।

বিশ্ববাজারে কিছু পণ্যের দাম কমলেও, বাংলাদেশে তা বেড়েই চলেছে। ফলে নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত মানুষজনের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে কৃষক, শ্রমিক, ও দিনমজুরদের জন্য এই মূল্যবৃদ্ধি ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অভাবে মানুষের মধ্যে অপুষ্টি, অনাহার, এবং বিভিন্ন রোগবালাই দেখা দিচ্ছে।

দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় কারণে-অকারণে। কোনো একটি অজুহাত পেলেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়া হয়। আর বিশ্ববাজারে সম্প্রতি দ্রব্যমূল্যের দাম কমলেও বাংলাদেশে কমা তো দূরে থাকুক রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত সবাই ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। এতে সবচেয়ে বিপদে পড়ছে সাধারণ কৃষক, শ্রমিক এবং দিন-আনি-দিন-খাই রোজগারের মানুষজন। নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অভাবে মানুষের জীবনে নেমে এসেছে অনাহার, অপুষ্টিসহ নানা প্রকার জটিল ব্যাধির প্রকোপ। ফলে সার্বিকভাবে এর প্রভাব পড়ে কোনো একটি দেশের জাতীয় ভাবমূর্তিতে। আর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন অন্তর্র্বর্তী সরকার নানা খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু দ্রব্যমূল্য কমিয়ে মানুষকে স্বস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে পদক্ষেপ কম।

সুদের হার বৃদ্ধি করে বাজারে টাকার সরবরাহ কমানো হয়েছে, যা মূল্যস্ফীতি কমাতে সহায়ক হলেও, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে ততটা কার্যকর প্রমাণিত হয়নি। কারণ, এই ধরনের পণ্যের চাহিদা সবসময় থাকে, ফলে টাকার সরবরাহ কমলেও চাহিদা কমে না। এ কারণে দ্রব্যমূল্যের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ প্রয়োজন।

আওয়ামী লীগ সরকার কিছু কিছু ক্ষেত্রে পণ্যের দাম বেঁধে দেয়ার কৌশল নিয়েছিল; কিন্তু তা কাজে আসেনি। এখনো কাজে আসছে না। বাজারে কোনো জিনিসের দাম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই। যে যার মতো দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। ৮০-১০০ টাকার নিচে তরকারি (সবজি) কেনা যায় না।

নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে, তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখনও ১০ শতাংশের ওপরে। বিশেষ করে চাল, ডাল, তেল, ডিম, মাংসসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম আকাশচুম্বী। ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে আসছে, ডলারের দাম বাড়ছে, এবং এর প্রভাব দেশের বাজারে দৃশ্যমান। তাছাড়া, জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং পানির দাম বৃদ্ধির প্রভাবও শিল্পপণ্যের উৎপাদন খরচে প্রভাব ফেলেছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ও পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও, তা তেমন কার্যকর হয়নি। তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) মূল্য নিয়ন্ত্রণ করলেও, বাস্তবে সিলিন্ডারের দাম বেড়ে চলেছে। বাজারে কোনো জিনিসের দাম নিয়ন্ত্রণে নেই, ব্যবসায়ীরা নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব। প্রথমত, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর শুল্ক এবং কর কমানো দরকার। চাল, চিনি, ভোজ্যতেল, ডিমের শুল্ক কমিয়ে সরবরাহ বাড়ানো যেতে পারে। এর ফলে বাজারে পণ্যের দাম কমবে। দ্বিতীয়ত, ডলারের দামের ভিত্তিতে শুল্ক নির্ধারণের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা উচিত।

চাল আমদানি করলে দেশীয় বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়বে, ফলে চালের দাম কমানোর সুযোগ তৈরি হবে। এছাড়া, পোলট্রি খাদ্য আমদানির প্রক্রিয়া সহজ করা উচিত, যাতে ডিম এবং মুরগির দামও কমে আসে। ডিজেলের ওপর শুল্ক কমিয়ে পরিবহন খরচ কমানো হলে, পণ্যের দামও কমবে। সরবরাহ ব্যবস্থার সংস্কার, বাজারে মনিটরিং বৃদ্ধি, এবং বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমানোও প্রয়োজন।

নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর কিছু পদক্ষেপ নেয়া হলেও, তা পর্যাপ্ত নয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পেঁয়াজ এবং আলুর শুল্ক কমিয়েছে, যার ফলে এই দুই পণ্যের দাম কিছুটা কমেছে। তবে, সামগ্রিকভাবে নিত্যপণ্যের দাম কমাতে আরও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বর্তমানে বেশ জটিল। জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে, ফলে জীবনযাত্রার মান নিম্নমুখী। এই সংকট সমাধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বৃদ্ধি সঠিক পদক্ষেপ হলেও, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সাশ্রয়ীভাবে চলার জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানোর জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ জরুরি।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আরও কার্যকর পরিকল্পনা এবং বাজার তদারকি একান্ত প্রয়োজন। জনগণের স্বার্থ রক্ষায় সরকারকে অবশ্যই বাজারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

মূল্যস্ফীতি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হারে লাগাম তুলে নিয়ে বাজারে টাকার সরবরাহ কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এর ফলে সুদের হার বেড়েছে। মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে একটা জায়গায় স্থিতিশীল হয়েছে। কিন্তু সুদের হার ও ডলারের দামের কারণে নিত্যপণ্যের ব্যবসায়ীদের খরচ বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর গত আগস্টে দায়িত্ব নেয়ার পর মূল্যস্ফীতি কমাতে সুদের হারে নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেয়ার কৌশল বাস্তবায়ন শুরু করেন। এর ফলে সুদের হার বেড়েছে। ডলারের দাম ১২০ টাকার আশপাশে মোটামুটি স্থির হয়েছে। গত মাসে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমে ১০ শতাংশের কিছুটা কম হয়েছে। যদিও খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখনো ১০ শতাংশের ওপরে। মানে হলো, গত বছরের সেপ্টেম্বরে যে খাদ্য কিনতে মানুষকে ১০০ টাকা ব্যয় করতে হতো, তা কিনতে এখন ১১০ টাকার বেশি লাগছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ৫০০টির বেশি পণ্য ও সেবার মূল্য বিবেচনায় নিয়ে মূল্যস্ফীতির হিসাব করে। তবে স্বল্প আয়ের পরিবারে চাপ পড়ে কিছু নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে। এসব পণ্যের দাম আগে থেকেই বাড়তি। মূল্যস্ফীতি অনুযায়ী মানুষের মজুরিও বাড়ছে না। বিবিএস বলছে, সেপ্টেম্বরে প্রায় ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতির বিপরীতে মজুরি বেড়েছে ৮ শতাংশের মতো। মানে হলো, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আরও কমেছে।

বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, সুদের হারে লাগাম তুলে নেয়ার পদক্ষেপ ঠিকই আছে। তাতে বাজারে টাকার সরবরাহ কমবে। পণ্যের চাহিদা কমবে। মূল্যস্ফীতি কমার সম্ভাবনাও আছে। কিন্তু অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে এই নীতি ততটা কার্যকর নয়। কারণ, সেসব পণ্যের চাহিদা সব সময়ই থাকে। বাজারে টাকার সরবরাহের ওপর ওই সব পণ্যের চাহিদা, জোগান ও দাম ততটা নির্ভর করে না। এসব পণ্যের দাম কমাতে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ দরকার।

প্রতিটি দেশের সরকারই নিজের দেশে দ্রব্যের দাম যাতে সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে না চলে যায় তার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। আমাদের দেশেও ভোক্তা অধিকার আইনসহ অন্যান্য আইনগুলো কার্যকর করা দরকার। এ ক্ষেত্রে অসাধু ও অধিক মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কঠোর হাতে দমন করা, বাজারে মনিটরিং বাড়ানো, ভ্রাম্যমাণ আদালতের নিয়মিত অভিযান পরিচালনা, বাজারে দোকানের সামনে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য তালিকা টাঙিয়ে রাখতে হবে। সর্বোপরি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে বর্ধিত দামের ওপর সরকারি ভর্তুকি প্রদান করা একান্ত প্রয়োজন। আর এই মুহূর্তে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের একটি অগ্রাধিকার কার্যক্রম হওয়া উচিত ।

[ লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি ]

back to top