জিয়াউদ্দীন আহমেদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির’ কিছুদিন আগে প্রকাশ্যে তাদের অস্তিত্ব ঘোষণা করেছে। কোটা বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আবু সাদিক কায়েম যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি তা কেউ তার ঘোষণা দেয়ার আগে ঘুনাক্ষরেও জানত না। সভাপতির পরিচয় প্রকাশের পর ছাত্রলীগের পদধারী এস এম ফরহাদের পরিচয়ও উন্মোচিত হলো, তিনি ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সেক্রেটারি জেনারেল।
সারাদেশে নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে ছাত্রশিবিরের ছাত্র-ছাত্রীরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী সেজে মিছিল করেছে, ‘জয় বাংলা’ সেøাগান দিয়েছে, জাতীয় পতাকা মাথায় বেঁধেছে, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে আবেগায়িত হয়েছে, পেটানোর জন্য ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবির খুঁজে বেড়িয়েছে। হেমলেট মাথায় দিয়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকা-ে অংশগ্রহণের অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে উঠছে। ঘটনা সত্য হলে, ছাত্রলীগের ইমেজ ধ্বংস করার জন্য এর চেয়ে উত্তম কৌশল আর দ্বিতীয়টি হতে পারে না।
আমরা জানি, ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের আস্তানার খবর দিয়েছে সাদ্দাম হোসেনের ঘনিষ্ঠজন। পশ্চিমবঙ্গের নক্সাল নেতা চারু মজুমদারকে ধরার জন্য সরকারের গোয়েন্দারা নক্সালে নাম লিখিয়েছিল। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদও এভাবে কাজ করে থাকে। মোসাদের নিয়োজিত হিজবুল্লাহর সদস্যদের বিশ্বাসঘাতকতায় একে একে সব নেতাকে হত্যার পর এখন হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতা হতে কেউ আর আগ্রহী হচ্ছেন না। চরমপন্থী রাজনৈতিক নেতারাও ছদ্মনাম, ছদ্মবেশ ধারণ করে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে ফাঁকি দিয়ে থাকেন। একাত্তরে স্বাধীনতার পরপর মোহাম্মদ তোয়াহার জীবনের ঝুঁকি বেড়ে গেলে বঙ্গবন্ধু তাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। কেবল ছাত্রলীগ বা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়করা নয়, সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্নাও জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক দাবা খেলায় ধরাশায়ী; তিনি এখন বলছেন, ‘আমি যদি বুঝতাম, আমি জামায়াত-শিবিরের খপ্পরে পড়েছি তাহলে এদের আইনজীবী থাকতাম না’।
রাজনীতির আধুনিক কলাকৌশল রপ্ত করেই শিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগকে ধরাশায়ী করেছে। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন শিবিরের কর্মতৎপরতা কারো চোখেই ধরা পড়েনি। ছদ্মবেশে তারা বিচক্ষণতার সঙ্গে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। যদি জানাজানি হয়ে যেত, সমন্বয়করা জামায়াত বা হিযবুত তাহরীর কর্মী তাহলে অভ্যুত্থানে জনসমর্থন ও নেতৃত্বে বিভেদ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। বিএনপির লোকজন ভেবেছে তারাই লিডে, বামেরা ভেবেছে তারাই নেতৃত্বে। আন্দোলনে নিহত অনেকের জামায়াত-শিবির সংশ্লিষ্টতা প্রকাশ্যে আসার পর আন্দোলনে সক্রিয় থাকা দলনিরপেক্ষ সমন্বয়ক ও ছাত্ররা এখন কিছুটা বিব্রত। কারণ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফর্মটি অরাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল, আওয়ামী লীগ শত চেষ্টা করেও জামায়াত-শিবির বা হিজবুত তাহরীরের সংশ্লিষ্টতা জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারেনি। তখন আওয়ামী লীগের কোন নেতার কথায় কেউ গুরুত্ব দেয়নি, তারা তাদের সব বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছিল।
ছাত্রশিবির অবশ্য বাধ্য হয়ে ছাত্রলীগে নাম লিখিয়েছিল, কারণ তাদের প্রকাশ্যে রাজনীতি করার অধিকার ছিল না। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর ছাত্র-শিক্ষকের সব সংগঠন একাট্টা হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের রাজনীতি বন্ধ করেছিল। ১৯৮৯ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনপির অঙ্গসংঠন ছাত্রদলের একজন নেতাকে হত্যার জন্য ছাত্রশিবিরকে দায়ী করে সেখানেও ছাত্রশিবিরের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। একসময় শিবির দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের বিরোধী পক্ষের বহু ছাত্রের রগ কেটে দিয়েছে; তখন তাদের ‘রগকাটা শিবির’ বলা হতো। তবে ছাত্রশিবির যেমন রগ কেটেছে, তেমনি ছাত্রলীগ এবং ছাত্রদলও বিরোধী পক্ষের ছাত্রদের নিপীড়ন করেছে। যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের ছাত্র সংগঠন বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ আমলে বুয়েটের ছাত্র আবরার ফারহাদকে ছাত্রলীগের ছাত্ররা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে, ছাত্রলীগের বেপরোয়া কর্মকা-ে ক্ষুব্ধ হয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। বিএনপির ছাত্রদলের সন্ত্রাসী কর্মকা-ে অতিষ্ঠ হয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াও ২০০১ সালে ছাত্রদলের কার্যক্রম স্থগিত করে দিয়েছিলেন। হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদও জাতীয় পার্টির অঙ্গসংগঠন জাতীয় ছাত্র সমাজ নিষিদ্ধ করেছিলেন।
ইসলামী ছাত্রশিবির ক্যাডারভিত্তিক ছাত্র সংগঠন। ১৯৭১ সনে জামায়াতের ছাত্র সংগঠনের নাম ছিল ইসলামী ছাত্রসংঘ। তারা মুক্তিযুদ্ধের শুধু বিরোধিতা করেনি, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্তও ছিল। জামায়াত এবং ছাত্রসংঘের সরাসরি অংশগ্রহণ ও তদারকিতে সৃষ্টি হয় রাজাকার, আল-শামস, আল-বদরÑ যারা মুক্তিযুদ্ধকালীন নয় মাস সারাদেশে ব্যাপক হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট চালিয়েছে, বিজয়ের আগ মুহূর্তে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। মুক্তিযুদ্ধে এমনতর ভূমিকার কারণে জামায়াতে ইসলামকে নিষিদ্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রসংঘও নিষিদ্ধ হয়। জিয়াউর রহমানের আমলে তারা আবার রাজনীতি করার সুযোগ পেয়ে ছাত্রসংঘের নতুন নামকরণ করে ছাত্রশিবির। ২০২৪ সালে এসে কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দিশাহারা আওয়ামী লীগ সরকার তড়িঘড়ি করে আবার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে। পতনোন্মুখ সরকারের এমন সিদ্ধান্তে জামায়াতে ইসলাম ছিল নির্বিকার ও নির্লিপ্ত, তাদের কোন প্রতিক্রিয়াই ছিল না। তারা নিশ্চিত ছিল আওয়ামী লীগের পতন হবেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের রাজনীতি বন্ধ থাকায় ছাত্রলীগের চেয়ে বিএনপির ছাত্রদল বেশি বেনিফিট পেয়েছে। এজন্যই ২০০১ সালে জামায়াতে ইসলাম বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক হওয়া সত্ত্বেও ছাত্রদল ছাত্রশিবিরকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ দেয়নি। শিবিরের প্রতি বিএনপির ছাত্রদলের অবস্থান এখনো আগের মতোই আছে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে এক বৈঠকে ছাত্রশিবিরের অংশ নেয়ায় বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল নিন্দা জানিয়েছে। ছাত্রদল জানে, শিবির ছাত্রলীগের ভেতরে অবস্থান করলেও তারা কখনো ছাত্রলীগের শুভাকাক্সক্ষী হবে না, তাদের প্রকাশ্যে রাজনীতি না থাকলে ডাকসু নির্বাচনে তারা ছাত্রদলকেই ভোট দেবে। জাতীয় রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামের অবস্থানও একই; আওয়ামী লীগকে ঠেকানোর জন্য তাদের বিএনপিকে সমর্থন করতেই হয়। তাই জামায়াতে ইসলাম বা শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে লাভ হয় বিএনপির।
বিএনপি যত শীঘ্রই সম্ভব নির্বাচন চায়, কিন্তু জামায়াত চায় না। আওয়ামী লীগের আমলে জামায়াত ছিল বেশি নিগৃহিত, নির্বাচনের জন্য তাদের তাৎক্ষণিক প্রস্তুতি নেই, গুছিয়ে নিতে তাদের সময় প্রয়োজন। কিন্তু বিএনপি তাদের মাঠকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, চাঁদাবাজির মাঠ দখলে দলের বদনাম হচ্ছে। এই অবস্থায় বদনাম চরম পর্যায়ে পৌঁছার আগেই বিএনপি নির্বাচন চায়।
জামায়াত এককভাবে নির্বাচন করার চিন্তা-ভাবনা করছে। কিন্তু তারা এখনো দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন করার জন্য বৈধ নয়। তাদের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তে ২০০৮ সনের পর তারা আর দলীয়ভাবে নির্বাচন করতে পারেনি। নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা করলেও হাইকোর্ট ২০১৩ সালে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ‘অবৈধ ও বাতিল’ ঘোষণা করে রায় দেয় এবং সর্বোচ্চ আদালতেও হাইকোর্টের ওই রায় বহাল থাকে।
এতদসত্বেও জামায়াতে নির্ভার, কোন হতাশা নেই। সর্বোচ্চ আদালতের রায় রিভিউ করার সুযোগ থাকলে তাদের নিবন্ধন ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। অন্যদিকে সংবিধান পুনর্লিখনে গঠনতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক শর্তের বিলোপও হতে পারে। তাই তারা ক্ষমতায় গিয়ে মদিনা সনদের ভিত্তিতে দেশ শাসন করার আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। কিন্তু ইসলাম ধর্ম গণতন্ত্র মানে না, আইন প্রণয়নে জনপ্রতিনিধিদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা স্বীকার করে না, জনগণ যে সব ক্ষমতার উৎস তা-ও নাকচ করে। অন্যদিকে ইসলামে বহুদলীয় গণতন্ত্রও নেই। জামায়াত বা ইসলামপন্থী কোন দল ক্ষমতায় এলে বাকি সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হওয়ার কথা। তাহলে কি জামায়াতে ইসলাম ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ছাত্রশিবিরের মতো ‘নাজায়েজ গণতন্ত্রে’ কৌশলী ছদ্মবেশী রাজনীতি করছে?
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক]
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
শনিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৪
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির’ কিছুদিন আগে প্রকাশ্যে তাদের অস্তিত্ব ঘোষণা করেছে। কোটা বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আবু সাদিক কায়েম যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি তা কেউ তার ঘোষণা দেয়ার আগে ঘুনাক্ষরেও জানত না। সভাপতির পরিচয় প্রকাশের পর ছাত্রলীগের পদধারী এস এম ফরহাদের পরিচয়ও উন্মোচিত হলো, তিনি ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সেক্রেটারি জেনারেল।
সারাদেশে নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে ছাত্রশিবিরের ছাত্র-ছাত্রীরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী সেজে মিছিল করেছে, ‘জয় বাংলা’ সেøাগান দিয়েছে, জাতীয় পতাকা মাথায় বেঁধেছে, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে আবেগায়িত হয়েছে, পেটানোর জন্য ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবির খুঁজে বেড়িয়েছে। হেমলেট মাথায় দিয়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকা-ে অংশগ্রহণের অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে উঠছে। ঘটনা সত্য হলে, ছাত্রলীগের ইমেজ ধ্বংস করার জন্য এর চেয়ে উত্তম কৌশল আর দ্বিতীয়টি হতে পারে না।
আমরা জানি, ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের আস্তানার খবর দিয়েছে সাদ্দাম হোসেনের ঘনিষ্ঠজন। পশ্চিমবঙ্গের নক্সাল নেতা চারু মজুমদারকে ধরার জন্য সরকারের গোয়েন্দারা নক্সালে নাম লিখিয়েছিল। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদও এভাবে কাজ করে থাকে। মোসাদের নিয়োজিত হিজবুল্লাহর সদস্যদের বিশ্বাসঘাতকতায় একে একে সব নেতাকে হত্যার পর এখন হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতা হতে কেউ আর আগ্রহী হচ্ছেন না। চরমপন্থী রাজনৈতিক নেতারাও ছদ্মনাম, ছদ্মবেশ ধারণ করে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে ফাঁকি দিয়ে থাকেন। একাত্তরে স্বাধীনতার পরপর মোহাম্মদ তোয়াহার জীবনের ঝুঁকি বেড়ে গেলে বঙ্গবন্ধু তাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। কেবল ছাত্রলীগ বা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়করা নয়, সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্নাও জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক দাবা খেলায় ধরাশায়ী; তিনি এখন বলছেন, ‘আমি যদি বুঝতাম, আমি জামায়াত-শিবিরের খপ্পরে পড়েছি তাহলে এদের আইনজীবী থাকতাম না’।
রাজনীতির আধুনিক কলাকৌশল রপ্ত করেই শিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগকে ধরাশায়ী করেছে। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন শিবিরের কর্মতৎপরতা কারো চোখেই ধরা পড়েনি। ছদ্মবেশে তারা বিচক্ষণতার সঙ্গে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। যদি জানাজানি হয়ে যেত, সমন্বয়করা জামায়াত বা হিযবুত তাহরীর কর্মী তাহলে অভ্যুত্থানে জনসমর্থন ও নেতৃত্বে বিভেদ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। বিএনপির লোকজন ভেবেছে তারাই লিডে, বামেরা ভেবেছে তারাই নেতৃত্বে। আন্দোলনে নিহত অনেকের জামায়াত-শিবির সংশ্লিষ্টতা প্রকাশ্যে আসার পর আন্দোলনে সক্রিয় থাকা দলনিরপেক্ষ সমন্বয়ক ও ছাত্ররা এখন কিছুটা বিব্রত। কারণ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফর্মটি অরাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল, আওয়ামী লীগ শত চেষ্টা করেও জামায়াত-শিবির বা হিজবুত তাহরীরের সংশ্লিষ্টতা জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারেনি। তখন আওয়ামী লীগের কোন নেতার কথায় কেউ গুরুত্ব দেয়নি, তারা তাদের সব বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছিল।
ছাত্রশিবির অবশ্য বাধ্য হয়ে ছাত্রলীগে নাম লিখিয়েছিল, কারণ তাদের প্রকাশ্যে রাজনীতি করার অধিকার ছিল না। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর ছাত্র-শিক্ষকের সব সংগঠন একাট্টা হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের রাজনীতি বন্ধ করেছিল। ১৯৮৯ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনপির অঙ্গসংঠন ছাত্রদলের একজন নেতাকে হত্যার জন্য ছাত্রশিবিরকে দায়ী করে সেখানেও ছাত্রশিবিরের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। একসময় শিবির দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের বিরোধী পক্ষের বহু ছাত্রের রগ কেটে দিয়েছে; তখন তাদের ‘রগকাটা শিবির’ বলা হতো। তবে ছাত্রশিবির যেমন রগ কেটেছে, তেমনি ছাত্রলীগ এবং ছাত্রদলও বিরোধী পক্ষের ছাত্রদের নিপীড়ন করেছে। যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের ছাত্র সংগঠন বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ আমলে বুয়েটের ছাত্র আবরার ফারহাদকে ছাত্রলীগের ছাত্ররা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে, ছাত্রলীগের বেপরোয়া কর্মকা-ে ক্ষুব্ধ হয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। বিএনপির ছাত্রদলের সন্ত্রাসী কর্মকা-ে অতিষ্ঠ হয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াও ২০০১ সালে ছাত্রদলের কার্যক্রম স্থগিত করে দিয়েছিলেন। হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদও জাতীয় পার্টির অঙ্গসংগঠন জাতীয় ছাত্র সমাজ নিষিদ্ধ করেছিলেন।
ইসলামী ছাত্রশিবির ক্যাডারভিত্তিক ছাত্র সংগঠন। ১৯৭১ সনে জামায়াতের ছাত্র সংগঠনের নাম ছিল ইসলামী ছাত্রসংঘ। তারা মুক্তিযুদ্ধের শুধু বিরোধিতা করেনি, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্তও ছিল। জামায়াত এবং ছাত্রসংঘের সরাসরি অংশগ্রহণ ও তদারকিতে সৃষ্টি হয় রাজাকার, আল-শামস, আল-বদরÑ যারা মুক্তিযুদ্ধকালীন নয় মাস সারাদেশে ব্যাপক হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট চালিয়েছে, বিজয়ের আগ মুহূর্তে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। মুক্তিযুদ্ধে এমনতর ভূমিকার কারণে জামায়াতে ইসলামকে নিষিদ্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রসংঘও নিষিদ্ধ হয়। জিয়াউর রহমানের আমলে তারা আবার রাজনীতি করার সুযোগ পেয়ে ছাত্রসংঘের নতুন নামকরণ করে ছাত্রশিবির। ২০২৪ সালে এসে কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দিশাহারা আওয়ামী লীগ সরকার তড়িঘড়ি করে আবার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে। পতনোন্মুখ সরকারের এমন সিদ্ধান্তে জামায়াতে ইসলাম ছিল নির্বিকার ও নির্লিপ্ত, তাদের কোন প্রতিক্রিয়াই ছিল না। তারা নিশ্চিত ছিল আওয়ামী লীগের পতন হবেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের রাজনীতি বন্ধ থাকায় ছাত্রলীগের চেয়ে বিএনপির ছাত্রদল বেশি বেনিফিট পেয়েছে। এজন্যই ২০০১ সালে জামায়াতে ইসলাম বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক হওয়া সত্ত্বেও ছাত্রদল ছাত্রশিবিরকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ দেয়নি। শিবিরের প্রতি বিএনপির ছাত্রদলের অবস্থান এখনো আগের মতোই আছে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে এক বৈঠকে ছাত্রশিবিরের অংশ নেয়ায় বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল নিন্দা জানিয়েছে। ছাত্রদল জানে, শিবির ছাত্রলীগের ভেতরে অবস্থান করলেও তারা কখনো ছাত্রলীগের শুভাকাক্সক্ষী হবে না, তাদের প্রকাশ্যে রাজনীতি না থাকলে ডাকসু নির্বাচনে তারা ছাত্রদলকেই ভোট দেবে। জাতীয় রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামের অবস্থানও একই; আওয়ামী লীগকে ঠেকানোর জন্য তাদের বিএনপিকে সমর্থন করতেই হয়। তাই জামায়াতে ইসলাম বা শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে লাভ হয় বিএনপির।
বিএনপি যত শীঘ্রই সম্ভব নির্বাচন চায়, কিন্তু জামায়াত চায় না। আওয়ামী লীগের আমলে জামায়াত ছিল বেশি নিগৃহিত, নির্বাচনের জন্য তাদের তাৎক্ষণিক প্রস্তুতি নেই, গুছিয়ে নিতে তাদের সময় প্রয়োজন। কিন্তু বিএনপি তাদের মাঠকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, চাঁদাবাজির মাঠ দখলে দলের বদনাম হচ্ছে। এই অবস্থায় বদনাম চরম পর্যায়ে পৌঁছার আগেই বিএনপি নির্বাচন চায়।
জামায়াত এককভাবে নির্বাচন করার চিন্তা-ভাবনা করছে। কিন্তু তারা এখনো দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন করার জন্য বৈধ নয়। তাদের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তে ২০০৮ সনের পর তারা আর দলীয়ভাবে নির্বাচন করতে পারেনি। নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা করলেও হাইকোর্ট ২০১৩ সালে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ‘অবৈধ ও বাতিল’ ঘোষণা করে রায় দেয় এবং সর্বোচ্চ আদালতেও হাইকোর্টের ওই রায় বহাল থাকে।
এতদসত্বেও জামায়াতে নির্ভার, কোন হতাশা নেই। সর্বোচ্চ আদালতের রায় রিভিউ করার সুযোগ থাকলে তাদের নিবন্ধন ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। অন্যদিকে সংবিধান পুনর্লিখনে গঠনতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক শর্তের বিলোপও হতে পারে। তাই তারা ক্ষমতায় গিয়ে মদিনা সনদের ভিত্তিতে দেশ শাসন করার আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। কিন্তু ইসলাম ধর্ম গণতন্ত্র মানে না, আইন প্রণয়নে জনপ্রতিনিধিদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা স্বীকার করে না, জনগণ যে সব ক্ষমতার উৎস তা-ও নাকচ করে। অন্যদিকে ইসলামে বহুদলীয় গণতন্ত্রও নেই। জামায়াত বা ইসলামপন্থী কোন দল ক্ষমতায় এলে বাকি সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হওয়ার কথা। তাহলে কি জামায়াতে ইসলাম ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ছাত্রশিবিরের মতো ‘নাজায়েজ গণতন্ত্রে’ কৌশলী ছদ্মবেশী রাজনীতি করছে?
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক]