alt

উপ-সম্পাদকীয়

শিক্ষা খাতে দলীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব

মাহরুফ চৌধুরী

: শনিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৪

শিক্ষা খাত একটি দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার সম্পূরক তথা শিক্ষা যেমন হবে সে অনুসারেই রাষ্ট্রব্যবস্থা ও নাগরিকদের চরিত্র গড়ে ওঠবে। অপরদিকে শিক্ষা ও রাষ্ট্র একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। কারণ শিক্ষা দেশের শাসক ও নাগরিক তৈরির পাশাপাশি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের প্রধান চালিকা শক্তি। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বিগত কয়েক দশক ধরে ক্রমান্বয়ে অবনতির চরমে পৌঁছে গেছে। এর পেছনে অনেক কারণ থাকলেও অন্যতম কারণ হলো শিক্ষার রাজনীতিকীকরণ। দলীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাবে বাংলাদেশের শিক্ষা খাত আজ তাই গভীর সংকটের মুখোমুখি। শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত জ্ঞান, দক্ষতা ও সৃজনশীলতা বিকাশের সুযোগকে সবার জন্য অবারিত করে জাতি গঠনে অনন্য ভূমিকা রাখা। অথচ শাসকশ্রেণীর অদূরদর্শিতা ও শ্রেণীস্বার্থে দলীয় রাজনীতির ছত্রছায়ায় দলীয়করণ ও ব্যাপক দুর্নীতির মাধ্যমে সেখানে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশকে বিঘিœত করে শিক্ষার মানের ক্রমাগত অবনতি ঘটানো হয়েছে। রাজনৈতিক স্বার্থে ক্ষমতাসীনদের হস্তক্ষেপের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনায় দেখা দিয়েছে অনিয়ম ও সুশাসনের অভাব এবং বিঘিœত হয়েছে সুষ্ঠু একাডেমিক পরিবেশ। রাজনীতির অপ্রত্যাশিত নেতিবাচক প্রভাব শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যকে যেমন বিঘিœত করেছে, তেমনি অবনতি ঘটিয়েছে শিক্ষার গুণগতমানের এবং নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ। বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে রাজনীতিকীকরণের ইতিহাস নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতা-উত্তরকালে শিক্ষাঙ্গনে এবং শিক্ষার সরকারি প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় রাজনীতিকীকরণের মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দলীয় রাজনীতির প্রভাব তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে, যেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তথা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলীয় রাজনীতির প্রভাব ও সবকিছু দলীয়করণের মাধ্যমে সেগুলো পরিণত হয়েছে সরকারি দলের লাঠিয়াল বাহিনীর কলোনিতে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, শিক্ষক ও প্রশাসন থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত রাজনীতির দিকনির্দেশনায় পরিচালিত হয়েছে, যার ফলে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ব্যাহত হয়েছে। শিক্ষা খাতের এ ধরনের রাজনীতিকীকরণ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তিকে দুর্বল ও জঞ্জালপূর্ণ করে তুলেছে। শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রাজনীতিকীরণের প্রতিকার এবং প্রতিরোধে আমাদের সবার আগে শিক্ষা খাতকে দলীয়করণ করার প্রেক্ষাপট ও তার প্রত্যক্ষ প্রভাব নিয়ে আলোচনা করতে হবে। আমাদের সবারই জানা যে, ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তান আমল থেকেই প্রত্যক্ষভাবে এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় রাজনীতিকিকরণের প্রক্রিয়ার শুরু। তারই ধারাবাহিকতায় বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্র ও শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার পাশাপাশি সক্রিয় ভূমিকা পালন শিক্ষা খাতের জন্যে একটি জটিল সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দলীয় রাজনীতির ছত্রছায়ায় শ্রেণীস্বার্থে ক্ষমতার অপব্যবহারের এই অশুভ প্রভাব শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং এটি নানাভাবে সিদ্ধান্তগ্রহণ ও বাস্তবায়নে অনিয়ম এবং স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে শিক্ষার সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক পরিবেশকে বিঘিœত করার মধ্য দিয়ে শিক্ষার গুণগতমানের ওপরও প্রবল নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। নিচে দলীয়করণের ফলে শিক্ষা খাত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এর বিশেষ নেতিবাচক প্রভাবগুলো তুলে ধরা হলো:

১. নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা বা ক্ষমতায় যাওয়াই শিক্ষা খাতে দলীয়করণের প্রধান উদ্দেশ্য। সাম্প্রতিক সময়ে দলীয়করণের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তাই আমরা দেখতে পাই যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে নানাভাবে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, কলেজের অধ্যক্ষ, স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো হয়েছে। ফলে জনবল নিয়োগে অনেক যোগ্য ব্যক্তি বাদ পড়ছেন, নিয়োগ পেয়েছে দলীয় লোকজন যাদের অনেক নিয়োগ করা পদের জন্য বা যে কাজের জন্য তাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল সে কাজের জন্য অযোগ্য ছিল। ফলে তারা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় কিংবা তাদের কাজের আনজাম দিতে অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। আরো লক্ষণীয় যে, রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে, ফলে উপেক্ষিত হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা প্রাণশক্তি শিক্ষকরা ও যাদের জন্য শিক্ষার সব আয়োজন সেই শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার প্রকৃত মান বজায় রাখা বা উন্নত করার প্রচেষ্টার পরিবর্তে শিক্ষার নামে দলীয় আদর্শ প্রচার ও দলীয় স্বার্থে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বিকৃত করার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়েছে। দলীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ফলে শিক্ষক ও প্রশাসনের মধ্যে দলীয় রাজনীতির চর্চার বেড়ে যাওয়ায় শিক্ষকদের নিয়োগ, পদোন্নতি এবং প্রশাসনিক দায়িত্বে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রভাব খাটানো হয়েছে। সরকার পরিচালনাকারী দলের সরাসরি হস্তক্ষেপ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ও গুণগতমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক কারণে অযোগ্য ব্যক্তিদের উচ্চপদে বসানো হচ্ছে, যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসন ও শিক্ষাদানের পরিবেশকে দুর্বল করে তুলেছে।

২. দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সবত্রই দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের প্রায় সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির ইতিহাস রয়েছে, যা আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা যদি অধিকার আদায়ে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় না হতো তাহলে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা উপমহাদেশ ছাড়ত না ও দেশভাগ হতো না, ৫২ সালে ভাষা আন্দোলন হতো না, কিংবা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ হতো না, আর ২০২৪ সালে এসে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান হতো না। বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি রাজনীতি না হয়, তাহলে আর কোথাও প্রকৃত অর্থে রাজনীতি হবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, শিক্ষাঙ্গন হলো রাজনীতি চর্চা ও শেখার জায়গা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রসংস্কারের অংশ হিসেবে আমাদের প্রয়োজন ন্যায়ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুক্তমন তৈরি ও মুক্তবুদ্ধির চর্চার জন্যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করা। সেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মানবিক, গণতান্ত্রিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বর্তমানে ছাত্ররাজনীতি অনেকক্ষেত্রেই সহিংসতা, হিংসা-বিদ্বেষ, এবং ক্ষমতার লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে। এতে করে একদিকে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বিঘিœত হচ্ছে, অপরদিকে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পরিবর্তে দলগুলোর নেতাদের তাঁবেদারিসহ নানা রাজনৈতিক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েছে এবং পড়াশোনা ও নিজেকে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করার পরিবর্তে তাদের জীবনের মূল্যবান সময় অপচয় করছে রাজনৈতিক দলগুলোর পতাকাবাহী হিসেবে ।

৩. শিক্ষকদেরকে নানাভাবে জাতীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা শিক্ষাব্যবস্থাপনা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য এক অভিশাপ হিসেবে দেখা দিয়েছে। দলীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করায় শিক্ষকরা পড়ানো ও গবেষণার পরিবর্তে নিজ নিজ দলের তাঁবেদারিতে অধিক সময় ব্যায় করেছে। বিগত কয়েক দশকে শিক্ষকদের সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ফলে তাদের পেশাগত উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে এবং সামগ্রিকভাবে তা শিক্ষার পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় দলীয় ব্যক্তিদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ, পদোন্নতি, এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা শিক্ষার মানকেই কেবল ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও করে তুলেছে অকার্যকর ও দুর্নীতির আখড়া। শিক্ষকরা যখন কোন রাজনৈতিক দলের স্বার্থের প্রতি অনুগত হয়ে কাজ করেন, তখন তারা শিক্ষার্থীদের প্রকৃত কল্যাণে কাজ করার চেয়ে ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থে কাজ করাকে প্রাধান্য দেন। ফলে একাডেমিক বা পেশাগত জীবনে যেমন তাদের কোন উন্নতি হয়নি, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে তারা কোন অবদান রাখতে সক্ষম হয়নি।

৪. শিক্ষাব্যবস্থায় দলীয়করণের ফলে শিক্ষা খাতে নীতিনির্ধারণে রাজনৈতিক স্বার্থের প্রভাব অনিবার্য হয়ে উঠেছে। শিক্ষার নীতিমালা প্রণয়ন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় দল বা গোষ্ঠীর রাজনৈতিক স্বার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে পড়েছে। তাই দেখা গিয়েছে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কোন বিচার-বিবেচনা ছাড়াই শিক্ষা খাতে নীতিমালা পরিবর্তন হচ্ছে, যার ফলে শিক্ষার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে পারছে না। ব্যাহত হয়েছে শিক্ষার অব্যাহত উন্নয়নের ধারাবাহিতা রক্ষা করা। মনে রাখতে হবে, হঠাৎ কিছু হয় না। সবকিছুরই ধারাবাহিকতা থাকে এবং সেটাকে অক্ষুণœ রেখেই ইতিহাস ও উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে হবে। শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের জন্য কার্যকরী ও স্থায়ী নীতিমালা গড়ে তোলা জরুরি হলেও রাজনৈতিক চাপে তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। শিক্ষার উন্নয়নে আয়োজিত কর্মকা-ের ধারাবাহিকতা রক্ষা না করার ফলে শিক্ষার মৌলিক প্রশাসনিক কাঠামো ও ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং শিক্ষার্থীরা আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে আত্মবিকাশ ও জাতিকে সেবা করার জন্য সঠিকভাবে শিক্ষালাভ করতে পারছে না।

৫. শিক্ষায় ব্যাপক রাজনীতিকীকরণের কারণে সামগ্রিকভাবে শিক্ষার গুণগতমানের অবনতির ফলে শিক্ষার্থীদের মানসিক ও পেশাগত উন্নয়নে নানা ধরনের বাধা তৈরি হয়েছে। শিক্ষার মানের অবনতি শিক্ষার্থীদের শুধু একাডেমিক কৃতিত্বকেই প্রভাবিত করছে না, বরং তাদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে কাক্সিক্ষত অগ্রগতিতেও বাধা সৃষ্টি করছে। অনেক শিক্ষার্থী সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে ও মানসম্পন্ন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে হতাশায় ভুগছে। যথাযথ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাবে তাদের ক্যারিয়ার গঠনে বিভিন্ন রকমের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। উন্নত বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক উচ্চশিক্ষার জন্যও শিক্ষার্থীরা নিজেদের উপযুক্তভাবে গড়ে তুলতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।

৬. শিক্ষাখাতে দলীয়করণের আরেকটি উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রভাব হলো দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা। অবৈধ উপায়ে টাকা বানাতে আমরা দেখেছি নানা রকমের বাণিজ্যের চালচিত্র। যেমন, নিয়োগ-বাণিজ্য, ভর্তি-বাণিজ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁসের বাণিজ্য। আর সেই একই কারণে আমরা এটাও দেখেছি যে শিক্ষার গুণমান উন্নয়নের জন্যে প্রকল্প গ্রহণ না করে, সংখ্যাগত ও অবকাঠামোগত উন্নয়নেই বেশি পরিমাণ অর্থ বরাদ্ধ করতে। যার ফলে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিতে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারি অর্থের ভাগ-বাটোয়ারা কিংবা তছরুফের হরিলুটে নির্বিঘেœ অংশ নিয়েছে। ফলে দলীয় রাজনীতির ছত্রছায়ায় উন্নয়নের নামে দুর্বৃত্তায়নের হলিখেলায় মেতে উঠেছে শাসক দলের নেতাকর্মীরা। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান-উত্তর রাষ্ট্রসংস্কারের প্রত্যাশাকে যদি আমরা বাস্তব করে তুলতে চাই, তবে আমাদের শিক্ষা সংস্কারকে অগ্রাধিকার যেমন দিতে হবে, তেমনি শিক্ষাব্যবস্থা গণমুখী কল্যাণকর রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিপূরক হিসেবে ‘বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত’ করতে প্রথম যে কাজটি করতে হবে, সেটা হলো শিক্ষা খাতকে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করা। আমরা রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো ও প্রশাসনযন্ত্রের সংস্কারে যে কথা বলছি, সেটা করতে হলে আমাদের প্রথমেই সুস্পষ্ট করে রাষ্ট্র, সরকার, জনপ্রশাসন, রাজনৈতিক দল, দলের নেতা ও তার পরিবারÑ এসবের সীমা-পরিসীমাকে এঁকে দিতে হবে। যারাই সেই সীমা-পরিসীমা লঙ্ঘন করবে বা করার চেষ্টা করবে তাদের জন্যে আইন করে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আর সেটা নিশ্চিত করার গেলেই কেবল রাষ্ট্রীয় আদর্শ ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ নিশ্চিত করতে ‘বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচামুক্ত’ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাঠামো তৈরির স্বপ্ন পূরণ হবে। তাই অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা শিক্ষা খাতে দলীয়করণের মাধ্যমে যেসব দুর্নীতি, অন্যায় ও অবিচার হয়েছে সেগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে প্রচলিত আইনে জড়িতদের শাস্তির ব্যবস্থা করা যাতে করে ভবিষ্যতে কেউ দলীয় রাজনীতির ছত্রছায়ায় সেসব করতে আর সাহস না পায়। আর সেটাই হবে শিক্ষা খাতের রাজনীতিকীকরণ নিরুৎসাহিত করার প্রথম পদক্ষেপ।

[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]

স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবার গুরুত্ব

ঢাকার বাতাস বিষাক্ত কেন

চরের কৃষি ও কৃষকের জীবন

নিম্ন আয়ের মানুষ ভালো নাই

সবার আগে নিজেকে পরিবর্তন করা দরকার

পুলিশ কবে পুলিশ হবে

জীবন ফিরে আসুক বাংলার নদীগুলোতে

কান্দন সরেন হত্যা ও ভূমি বিরোধ কি এড়ানো যেত না

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র: রাষ্ট্র বিনির্মাণে সমস্যা কোথায়?

মানবাধিকার দিবস : মানুষের অধিকার নিয়ে কেন এত কথা?

আমলাতান্ত্রিক স্বচ্ছতা : সংস্কারের পথে নাকি পুনরাবৃত্তি?

খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কিছু কথা

ছবি

বেগম রোকেয়া : নারী জাগরণের অগ্রদূত

দুর্নীতির সর্বগ্রাসী বিস্তার বন্ধ করতে হবে

মা তোর বদনখানি মলিন হলে

ব্যবসায়ী নেতৃত্বশূন্য ই-ক্যাব

মূল্যস্ফীতির হিসাব নির্ণয়ে নতুন পদ্ধতির প্রাসঙ্গিকতা

মানুষ অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতা চায়

সবার উপরে মানুষ সত্য

এইচএসসিতে ইংরেজিতে ফল বিপর্যয় কেন, করণীয় কী

ছবি

নিরাপদ এবং সুষম পরিবেশের পরিকল্পনা

ফার্মেসি শিক্ষা ও পেশার সংস্কার প্রয়োজন

মশার কয়েলের প্রভাব : জনস্বাস্থ্যের অদৃশ্য হুমকি

“আইনুন কাইনুন সর্বনেশে...”

কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধকতার ঝুঁকি ও করণীয়

এই সর্বনাশের দায় কার?

জ্ঞানই শক্তি

বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস : জোর দিতে হবে প্রতিরোধে

ঋণ ব্যবস্থা : তেলা মাথায় ঢালো তেল, ন্যাড়া মাথায় ভাঙো বেল

বিচারকের ওপর হামলা কেন

বৈশ্বিক নিষ্ক্রিয়তার কবলে রোহিঙ্গা ইস্যু

আন্তর্জাতিক দাসপ্রথা বিলোপ দিবস

বৈষম্য ঘোচাতে চাই একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়

রাজনীতির মূল লক্ষ্য জনকল্যাণ

সমস্যার সূতিকাগার

ছবি

বাংলাদেশে আলু চাষে আধুনিক উৎপাদন পদ্ধতি

tab

উপ-সম্পাদকীয়

শিক্ষা খাতে দলীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব

মাহরুফ চৌধুরী

শনিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৪

শিক্ষা খাত একটি দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার সম্পূরক তথা শিক্ষা যেমন হবে সে অনুসারেই রাষ্ট্রব্যবস্থা ও নাগরিকদের চরিত্র গড়ে ওঠবে। অপরদিকে শিক্ষা ও রাষ্ট্র একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। কারণ শিক্ষা দেশের শাসক ও নাগরিক তৈরির পাশাপাশি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের প্রধান চালিকা শক্তি। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বিগত কয়েক দশক ধরে ক্রমান্বয়ে অবনতির চরমে পৌঁছে গেছে। এর পেছনে অনেক কারণ থাকলেও অন্যতম কারণ হলো শিক্ষার রাজনীতিকীকরণ। দলীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাবে বাংলাদেশের শিক্ষা খাত আজ তাই গভীর সংকটের মুখোমুখি। শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত জ্ঞান, দক্ষতা ও সৃজনশীলতা বিকাশের সুযোগকে সবার জন্য অবারিত করে জাতি গঠনে অনন্য ভূমিকা রাখা। অথচ শাসকশ্রেণীর অদূরদর্শিতা ও শ্রেণীস্বার্থে দলীয় রাজনীতির ছত্রছায়ায় দলীয়করণ ও ব্যাপক দুর্নীতির মাধ্যমে সেখানে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশকে বিঘিœত করে শিক্ষার মানের ক্রমাগত অবনতি ঘটানো হয়েছে। রাজনৈতিক স্বার্থে ক্ষমতাসীনদের হস্তক্ষেপের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনায় দেখা দিয়েছে অনিয়ম ও সুশাসনের অভাব এবং বিঘিœত হয়েছে সুষ্ঠু একাডেমিক পরিবেশ। রাজনীতির অপ্রত্যাশিত নেতিবাচক প্রভাব শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যকে যেমন বিঘিœত করেছে, তেমনি অবনতি ঘটিয়েছে শিক্ষার গুণগতমানের এবং নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ। বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে রাজনীতিকীকরণের ইতিহাস নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতা-উত্তরকালে শিক্ষাঙ্গনে এবং শিক্ষার সরকারি প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় রাজনীতিকীকরণের মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দলীয় রাজনীতির প্রভাব তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে, যেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তথা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলীয় রাজনীতির প্রভাব ও সবকিছু দলীয়করণের মাধ্যমে সেগুলো পরিণত হয়েছে সরকারি দলের লাঠিয়াল বাহিনীর কলোনিতে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, শিক্ষক ও প্রশাসন থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত রাজনীতির দিকনির্দেশনায় পরিচালিত হয়েছে, যার ফলে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ব্যাহত হয়েছে। শিক্ষা খাতের এ ধরনের রাজনীতিকীকরণ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তিকে দুর্বল ও জঞ্জালপূর্ণ করে তুলেছে। শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রাজনীতিকীরণের প্রতিকার এবং প্রতিরোধে আমাদের সবার আগে শিক্ষা খাতকে দলীয়করণ করার প্রেক্ষাপট ও তার প্রত্যক্ষ প্রভাব নিয়ে আলোচনা করতে হবে। আমাদের সবারই জানা যে, ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তান আমল থেকেই প্রত্যক্ষভাবে এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় রাজনীতিকিকরণের প্রক্রিয়ার শুরু। তারই ধারাবাহিকতায় বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্র ও শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার পাশাপাশি সক্রিয় ভূমিকা পালন শিক্ষা খাতের জন্যে একটি জটিল সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দলীয় রাজনীতির ছত্রছায়ায় শ্রেণীস্বার্থে ক্ষমতার অপব্যবহারের এই অশুভ প্রভাব শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং এটি নানাভাবে সিদ্ধান্তগ্রহণ ও বাস্তবায়নে অনিয়ম এবং স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে শিক্ষার সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক পরিবেশকে বিঘিœত করার মধ্য দিয়ে শিক্ষার গুণগতমানের ওপরও প্রবল নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। নিচে দলীয়করণের ফলে শিক্ষা খাত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এর বিশেষ নেতিবাচক প্রভাবগুলো তুলে ধরা হলো:

১. নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা বা ক্ষমতায় যাওয়াই শিক্ষা খাতে দলীয়করণের প্রধান উদ্দেশ্য। সাম্প্রতিক সময়ে দলীয়করণের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তাই আমরা দেখতে পাই যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে নানাভাবে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, কলেজের অধ্যক্ষ, স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো হয়েছে। ফলে জনবল নিয়োগে অনেক যোগ্য ব্যক্তি বাদ পড়ছেন, নিয়োগ পেয়েছে দলীয় লোকজন যাদের অনেক নিয়োগ করা পদের জন্য বা যে কাজের জন্য তাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল সে কাজের জন্য অযোগ্য ছিল। ফলে তারা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় কিংবা তাদের কাজের আনজাম দিতে অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। আরো লক্ষণীয় যে, রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে, ফলে উপেক্ষিত হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা প্রাণশক্তি শিক্ষকরা ও যাদের জন্য শিক্ষার সব আয়োজন সেই শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার প্রকৃত মান বজায় রাখা বা উন্নত করার প্রচেষ্টার পরিবর্তে শিক্ষার নামে দলীয় আদর্শ প্রচার ও দলীয় স্বার্থে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বিকৃত করার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়েছে। দলীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ফলে শিক্ষক ও প্রশাসনের মধ্যে দলীয় রাজনীতির চর্চার বেড়ে যাওয়ায় শিক্ষকদের নিয়োগ, পদোন্নতি এবং প্রশাসনিক দায়িত্বে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রভাব খাটানো হয়েছে। সরকার পরিচালনাকারী দলের সরাসরি হস্তক্ষেপ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ও গুণগতমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক কারণে অযোগ্য ব্যক্তিদের উচ্চপদে বসানো হচ্ছে, যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসন ও শিক্ষাদানের পরিবেশকে দুর্বল করে তুলেছে।

২. দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সবত্রই দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের প্রায় সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির ইতিহাস রয়েছে, যা আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা যদি অধিকার আদায়ে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় না হতো তাহলে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা উপমহাদেশ ছাড়ত না ও দেশভাগ হতো না, ৫২ সালে ভাষা আন্দোলন হতো না, কিংবা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ হতো না, আর ২০২৪ সালে এসে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান হতো না। বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি রাজনীতি না হয়, তাহলে আর কোথাও প্রকৃত অর্থে রাজনীতি হবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, শিক্ষাঙ্গন হলো রাজনীতি চর্চা ও শেখার জায়গা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রসংস্কারের অংশ হিসেবে আমাদের প্রয়োজন ন্যায়ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুক্তমন তৈরি ও মুক্তবুদ্ধির চর্চার জন্যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করা। সেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মানবিক, গণতান্ত্রিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বর্তমানে ছাত্ররাজনীতি অনেকক্ষেত্রেই সহিংসতা, হিংসা-বিদ্বেষ, এবং ক্ষমতার লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে। এতে করে একদিকে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বিঘিœত হচ্ছে, অপরদিকে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পরিবর্তে দলগুলোর নেতাদের তাঁবেদারিসহ নানা রাজনৈতিক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েছে এবং পড়াশোনা ও নিজেকে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করার পরিবর্তে তাদের জীবনের মূল্যবান সময় অপচয় করছে রাজনৈতিক দলগুলোর পতাকাবাহী হিসেবে ।

৩. শিক্ষকদেরকে নানাভাবে জাতীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা শিক্ষাব্যবস্থাপনা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য এক অভিশাপ হিসেবে দেখা দিয়েছে। দলীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করায় শিক্ষকরা পড়ানো ও গবেষণার পরিবর্তে নিজ নিজ দলের তাঁবেদারিতে অধিক সময় ব্যায় করেছে। বিগত কয়েক দশকে শিক্ষকদের সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ফলে তাদের পেশাগত উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে এবং সামগ্রিকভাবে তা শিক্ষার পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় দলীয় ব্যক্তিদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ, পদোন্নতি, এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা শিক্ষার মানকেই কেবল ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও করে তুলেছে অকার্যকর ও দুর্নীতির আখড়া। শিক্ষকরা যখন কোন রাজনৈতিক দলের স্বার্থের প্রতি অনুগত হয়ে কাজ করেন, তখন তারা শিক্ষার্থীদের প্রকৃত কল্যাণে কাজ করার চেয়ে ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থে কাজ করাকে প্রাধান্য দেন। ফলে একাডেমিক বা পেশাগত জীবনে যেমন তাদের কোন উন্নতি হয়নি, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে তারা কোন অবদান রাখতে সক্ষম হয়নি।

৪. শিক্ষাব্যবস্থায় দলীয়করণের ফলে শিক্ষা খাতে নীতিনির্ধারণে রাজনৈতিক স্বার্থের প্রভাব অনিবার্য হয়ে উঠেছে। শিক্ষার নীতিমালা প্রণয়ন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় দল বা গোষ্ঠীর রাজনৈতিক স্বার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে পড়েছে। তাই দেখা গিয়েছে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কোন বিচার-বিবেচনা ছাড়াই শিক্ষা খাতে নীতিমালা পরিবর্তন হচ্ছে, যার ফলে শিক্ষার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে পারছে না। ব্যাহত হয়েছে শিক্ষার অব্যাহত উন্নয়নের ধারাবাহিতা রক্ষা করা। মনে রাখতে হবে, হঠাৎ কিছু হয় না। সবকিছুরই ধারাবাহিকতা থাকে এবং সেটাকে অক্ষুণœ রেখেই ইতিহাস ও উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে হবে। শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের জন্য কার্যকরী ও স্থায়ী নীতিমালা গড়ে তোলা জরুরি হলেও রাজনৈতিক চাপে তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। শিক্ষার উন্নয়নে আয়োজিত কর্মকা-ের ধারাবাহিকতা রক্ষা না করার ফলে শিক্ষার মৌলিক প্রশাসনিক কাঠামো ও ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং শিক্ষার্থীরা আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে আত্মবিকাশ ও জাতিকে সেবা করার জন্য সঠিকভাবে শিক্ষালাভ করতে পারছে না।

৫. শিক্ষায় ব্যাপক রাজনীতিকীকরণের কারণে সামগ্রিকভাবে শিক্ষার গুণগতমানের অবনতির ফলে শিক্ষার্থীদের মানসিক ও পেশাগত উন্নয়নে নানা ধরনের বাধা তৈরি হয়েছে। শিক্ষার মানের অবনতি শিক্ষার্থীদের শুধু একাডেমিক কৃতিত্বকেই প্রভাবিত করছে না, বরং তাদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে কাক্সিক্ষত অগ্রগতিতেও বাধা সৃষ্টি করছে। অনেক শিক্ষার্থী সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে ও মানসম্পন্ন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে হতাশায় ভুগছে। যথাযথ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাবে তাদের ক্যারিয়ার গঠনে বিভিন্ন রকমের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। উন্নত বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক উচ্চশিক্ষার জন্যও শিক্ষার্থীরা নিজেদের উপযুক্তভাবে গড়ে তুলতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।

৬. শিক্ষাখাতে দলীয়করণের আরেকটি উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রভাব হলো দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা। অবৈধ উপায়ে টাকা বানাতে আমরা দেখেছি নানা রকমের বাণিজ্যের চালচিত্র। যেমন, নিয়োগ-বাণিজ্য, ভর্তি-বাণিজ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁসের বাণিজ্য। আর সেই একই কারণে আমরা এটাও দেখেছি যে শিক্ষার গুণমান উন্নয়নের জন্যে প্রকল্প গ্রহণ না করে, সংখ্যাগত ও অবকাঠামোগত উন্নয়নেই বেশি পরিমাণ অর্থ বরাদ্ধ করতে। যার ফলে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিতে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারি অর্থের ভাগ-বাটোয়ারা কিংবা তছরুফের হরিলুটে নির্বিঘেœ অংশ নিয়েছে। ফলে দলীয় রাজনীতির ছত্রছায়ায় উন্নয়নের নামে দুর্বৃত্তায়নের হলিখেলায় মেতে উঠেছে শাসক দলের নেতাকর্মীরা। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান-উত্তর রাষ্ট্রসংস্কারের প্রত্যাশাকে যদি আমরা বাস্তব করে তুলতে চাই, তবে আমাদের শিক্ষা সংস্কারকে অগ্রাধিকার যেমন দিতে হবে, তেমনি শিক্ষাব্যবস্থা গণমুখী কল্যাণকর রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিপূরক হিসেবে ‘বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত’ করতে প্রথম যে কাজটি করতে হবে, সেটা হলো শিক্ষা খাতকে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করা। আমরা রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো ও প্রশাসনযন্ত্রের সংস্কারে যে কথা বলছি, সেটা করতে হলে আমাদের প্রথমেই সুস্পষ্ট করে রাষ্ট্র, সরকার, জনপ্রশাসন, রাজনৈতিক দল, দলের নেতা ও তার পরিবারÑ এসবের সীমা-পরিসীমাকে এঁকে দিতে হবে। যারাই সেই সীমা-পরিসীমা লঙ্ঘন করবে বা করার চেষ্টা করবে তাদের জন্যে আইন করে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আর সেটা নিশ্চিত করার গেলেই কেবল রাষ্ট্রীয় আদর্শ ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ নিশ্চিত করতে ‘বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচামুক্ত’ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাঠামো তৈরির স্বপ্ন পূরণ হবে। তাই অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা শিক্ষা খাতে দলীয়করণের মাধ্যমে যেসব দুর্নীতি, অন্যায় ও অবিচার হয়েছে সেগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে প্রচলিত আইনে জড়িতদের শাস্তির ব্যবস্থা করা যাতে করে ভবিষ্যতে কেউ দলীয় রাজনীতির ছত্রছায়ায় সেসব করতে আর সাহস না পায়। আর সেটাই হবে শিক্ষা খাতের রাজনীতিকীকরণ নিরুৎসাহিত করার প্রথম পদক্ষেপ।

[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]

back to top