alt

উপ-সম্পাদকীয়

রাষ্ট্র সংস্কার ও আদিবাসী

মিথুশিলাক মুরমু

: বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে। ৭ অক্টোবর জারি হওয়া প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে- ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার জনপ্রতিনিধিত্বশীল ও কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও জনগণের ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্যে দেশের বিদ্যমান সংবিধান পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করিয়া সংবিধান সংস্কারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সুপারিশসহ প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদনক্রমে সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করা হলো।’

প্রত্যেকটি সংস্কার কমিটিতেই বিশেষজ্ঞগণের পাশাপাশি শিক্ষার্থী প্রতিনিধিকে কমিশনের সদস্য করা হয়েছে। আমরা আদিবাসীরা আশা করেছিলাম, কমিটিগুলোতে কোনো না কোনো আদিবাসী কিংবা অনগ্রসর ব্যক্তিকে সম্পৃক্ত করে সংস্কারে উদ্যোগী হলে অনগ্রসর, পিছিয়ে পড়া, প্রান্তিক, আদিবাসীদের স্বার্থটি রক্ষিত হতো। উপরের দিক থেকে নিচের স্তরের মানুষের চাওয়া-পাওয়া, অভাব-অভিযোগ কিংবা রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশার বিষয়গুলো সঠিকভাবে প্রতীয়মান হয় না; প্রয়োজন প্রান্তিক ও আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব।

আদিবাসীদের কথাগুলো শোনার জন্য আন্তরিকতা থাকা দরকার। ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহ কিংবা দেশের জন্য যে কোনো আন্দোলনে আদিবাসীরাও অংশ নিয়েছিল। গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলোতে আদিবাসীদের সরব উপস্থিতি থাকার পরও রাষ্ট্রীয় সংস্কারে আদিবাসীদের উপেক্ষা আমাদের হতাশ করেছে।

রাষ্ট্র পরিচালনার মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে সংবিধান। সদ্য স্বাধীন দেশে ৩৪ জন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি অল্প ও দ্রুত সময়ের মধ্যে সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকারী সংবিধান প্রণীতদের মধ্যে এখনও চারজন জীবিত রয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তর পেরিয়ে ৭২ সালের ১১ এপ্রিল সংবিধান রচনার দায়িত্ব পেয়েছিল কমিটি। পাকিস্তানের বৈষম্যের বেড়াজালকে ছিন্ন করতে আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অংশগ্রহণ ও জীবন উৎসর্গ অবিস্মরণীয়। কমিটির ৩৪ জনের অধিকাংশ আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা থেকে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। কোনো এক সময় সংবিধান কমিটি নিভৃতে পর্যবেক্ষণের জন্য টাঙ্গাইলের দোখলা রাজবাড়ীতে অবস্থান করেছিলেন। দোখলার অদূরেই রয়েছে গারো, হাজং আদিবাসী। তারপরও সংবিধানে আদিবাসীদের ঠাঁই হয়নি, স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। দীর্ঘ বছর পর পঞ্চদশ সংশোধনীতে ২৩(ক)-তে সংযোজন করা হলোÑ ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন’। ১৮-২০ ডিসেম্বর ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে আদিবাসী গোল টেবিল বৈঠকে সংবিধান কমিটির প্রধান ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন, ‘সংবিধানে জাতিসত্তাসমূহের স্বীকৃতি না থাকাটা বিরাট একটি ত্রুটি।’ তিনি আরও বলেন, ‘যদি এখন আবার সংবিধান লেখার দায়িত্ব দেয়া হয় তবে তা অবশ্যই অন্যভাবে লিখতাম।’

সদ্য গঠিত কমিটি আদিবাসী ও প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কে কতোটুকু ওয়াকিবহাল রয়েছেন, এটি নিয়েও আমাদের যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রাণের দাবি আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির। আদিবাসীদের নিয়ে শব্দের বির্তক থাকলেও সমতল থেকে পাহাড় সর্বত্রের আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবেই স্বীকৃতির দাবি প্রাণিধানযোগ্য। দেশের নাগরিক হিসেবে আদিবাসী-অন্ত্যজরা সর্বাংশে অবহেলিত ও বৈষম্যের শিকার। খোলা চোখেই ধরা পড়েÑ হোটেল, সেলুন, রেস্তোরাঁ, ধর্মীয় স্থলে প্রবেশাধিকার সীমিত। ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে ভোগান্তি পোহাতে হয়। স্থানীয় সরকার, কমিটি, ফোরামে প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণ চোখে পড়ে না। নির্বাচনকেন্দ্রিক ও অন্যান্য সহিংসতার শিকার হতে হয়। শিক্ষা, চাকরি ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রবেশাধিকার সীমিত। সরকারি বিভিন্ন সেবা ও তথ্যের ক্ষেত্রে অভিগম্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হতে হয়।

আইনে স্পষ্ট বর্ণিত রয়েছেÑ আদিবাসীদের সম্পত্তি বিক্রয়ে অবশ্যই এডিসি রাজস্ব-এর পূর্বানুমতি দরকার। পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে মৌখিকসূত্রে নিয়েছে বলে ক্ষমতাবানরা দাবি এবং এখনো ভোগ দখল করে চলেছে। আদিবাসীদের দলিল-দস্তাবেজ থাকার পরও তাদের পক্ষে কেউ-ই বলার লোক থাকে না। জায়গা-জমি কিংবা বসতভিটা সম্পর্কে আদিবাসী অধ্যুষিত জেলা আদালতগুলোতে অসংখ্য মামলা যুগের পর যুগ চলমান রয়েছে। আদিবাসীরা অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল হওয়ায় মামলা লড়তে পারেন না। ন্যায়বিচার যেন আদিবাসীদের কাছে সোনার হরিণ। আদিবাসীরা একদিকে আইনের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে, অপরদিকে স্থানচ্যুত হয়ে যাযাবর জনগোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছে।

নির্বাচন ব্যবস্থায় আদিবাসীদের অংশ বাড়াতে জনপ্রতিনিধিমূলক সংরক্ষিত আসন আবশ্যক। স্থানীয় পর্যায় থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন পদ্ধতিতে সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা থাকলে দেশ গঠনে, উন্নয়নে আদিবাসীরা অবদান রাখতে সক্ষম হবে। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে যতবারই আদিবাসীদের মধ্যে থেকে নারী সংরক্ষিত আসনে প্রতিনিধিত্বের সুযোগ এসেছে; প্রতিবারই পাহাড়ি অঞ্চলের নারীরা সুযোগ পেয়েছে। এক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও সিলেট উপেক্ষিত হয়েছে।

৫ আগস্ট সরকারের পটপরিবর্তনের পরবর্তীকালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা দায়িত্ব অর্পণেও আমরা উত্তরবঙ্গের আদিবাসীরা আশায় বুক বেঁধেছিলাম, আমরা আশাহত হয়েছি। সংস্কার কমিটি গঠিত হলো, এখানেও কোনো আদিবাসীর নাম চোখে পড়েনি। এটি কী কোনো বৈষম্য নয়! আদিবাসীরা জীবনের সবটুকু উজাড় করে দেশকে দিয়েছে, দেশের শাসকগণ অনুরূপভাবে আদিবাসীদের প্রতিদান দিতে পারেনি। আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় এখনো চাপা কান্নার আওয়াজ শোনা যায়, শাসকদের এ বিষয়ে আরো সহনশীল ও মনোযোগী হওয়া দরকার।

[লেখক : কলামিস্ট]

জামাই মেলা : উৎসব, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির রঙিন চিত্রপট

হারিয়ে যাওয়া ক্লাস, কঠোর মূল্যায়ন আর প্রশ্নের জটিলতায় নুয়ে পড়া এক প্রজন্ম

বৈষম্য দূর করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলুন

চিকিৎসা যেন বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত না হয়

পথশিশু ও বাংলাদেশে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা

মেগা প্রকল্প : প্রশ্ন হওয়া উচিত স্বচ্ছতা নিয়ে

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি

স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : উপগ্রহ চিত্র ও ওয়েবসাইটের অপরিহার্যতা

ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন : আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

tab

উপ-সম্পাদকীয়

রাষ্ট্র সংস্কার ও আদিবাসী

মিথুশিলাক মুরমু

বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে। ৭ অক্টোবর জারি হওয়া প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে- ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার জনপ্রতিনিধিত্বশীল ও কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও জনগণের ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্যে দেশের বিদ্যমান সংবিধান পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করিয়া সংবিধান সংস্কারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সুপারিশসহ প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদনক্রমে সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করা হলো।’

প্রত্যেকটি সংস্কার কমিটিতেই বিশেষজ্ঞগণের পাশাপাশি শিক্ষার্থী প্রতিনিধিকে কমিশনের সদস্য করা হয়েছে। আমরা আদিবাসীরা আশা করেছিলাম, কমিটিগুলোতে কোনো না কোনো আদিবাসী কিংবা অনগ্রসর ব্যক্তিকে সম্পৃক্ত করে সংস্কারে উদ্যোগী হলে অনগ্রসর, পিছিয়ে পড়া, প্রান্তিক, আদিবাসীদের স্বার্থটি রক্ষিত হতো। উপরের দিক থেকে নিচের স্তরের মানুষের চাওয়া-পাওয়া, অভাব-অভিযোগ কিংবা রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশার বিষয়গুলো সঠিকভাবে প্রতীয়মান হয় না; প্রয়োজন প্রান্তিক ও আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব।

আদিবাসীদের কথাগুলো শোনার জন্য আন্তরিকতা থাকা দরকার। ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহ কিংবা দেশের জন্য যে কোনো আন্দোলনে আদিবাসীরাও অংশ নিয়েছিল। গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলোতে আদিবাসীদের সরব উপস্থিতি থাকার পরও রাষ্ট্রীয় সংস্কারে আদিবাসীদের উপেক্ষা আমাদের হতাশ করেছে।

রাষ্ট্র পরিচালনার মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে সংবিধান। সদ্য স্বাধীন দেশে ৩৪ জন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি অল্প ও দ্রুত সময়ের মধ্যে সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকারী সংবিধান প্রণীতদের মধ্যে এখনও চারজন জীবিত রয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তর পেরিয়ে ৭২ সালের ১১ এপ্রিল সংবিধান রচনার দায়িত্ব পেয়েছিল কমিটি। পাকিস্তানের বৈষম্যের বেড়াজালকে ছিন্ন করতে আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অংশগ্রহণ ও জীবন উৎসর্গ অবিস্মরণীয়। কমিটির ৩৪ জনের অধিকাংশ আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা থেকে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। কোনো এক সময় সংবিধান কমিটি নিভৃতে পর্যবেক্ষণের জন্য টাঙ্গাইলের দোখলা রাজবাড়ীতে অবস্থান করেছিলেন। দোখলার অদূরেই রয়েছে গারো, হাজং আদিবাসী। তারপরও সংবিধানে আদিবাসীদের ঠাঁই হয়নি, স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। দীর্ঘ বছর পর পঞ্চদশ সংশোধনীতে ২৩(ক)-তে সংযোজন করা হলোÑ ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন’। ১৮-২০ ডিসেম্বর ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে আদিবাসী গোল টেবিল বৈঠকে সংবিধান কমিটির প্রধান ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন, ‘সংবিধানে জাতিসত্তাসমূহের স্বীকৃতি না থাকাটা বিরাট একটি ত্রুটি।’ তিনি আরও বলেন, ‘যদি এখন আবার সংবিধান লেখার দায়িত্ব দেয়া হয় তবে তা অবশ্যই অন্যভাবে লিখতাম।’

সদ্য গঠিত কমিটি আদিবাসী ও প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কে কতোটুকু ওয়াকিবহাল রয়েছেন, এটি নিয়েও আমাদের যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রাণের দাবি আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির। আদিবাসীদের নিয়ে শব্দের বির্তক থাকলেও সমতল থেকে পাহাড় সর্বত্রের আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবেই স্বীকৃতির দাবি প্রাণিধানযোগ্য। দেশের নাগরিক হিসেবে আদিবাসী-অন্ত্যজরা সর্বাংশে অবহেলিত ও বৈষম্যের শিকার। খোলা চোখেই ধরা পড়েÑ হোটেল, সেলুন, রেস্তোরাঁ, ধর্মীয় স্থলে প্রবেশাধিকার সীমিত। ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে ভোগান্তি পোহাতে হয়। স্থানীয় সরকার, কমিটি, ফোরামে প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণ চোখে পড়ে না। নির্বাচনকেন্দ্রিক ও অন্যান্য সহিংসতার শিকার হতে হয়। শিক্ষা, চাকরি ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রবেশাধিকার সীমিত। সরকারি বিভিন্ন সেবা ও তথ্যের ক্ষেত্রে অভিগম্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হতে হয়।

আইনে স্পষ্ট বর্ণিত রয়েছেÑ আদিবাসীদের সম্পত্তি বিক্রয়ে অবশ্যই এডিসি রাজস্ব-এর পূর্বানুমতি দরকার। পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে মৌখিকসূত্রে নিয়েছে বলে ক্ষমতাবানরা দাবি এবং এখনো ভোগ দখল করে চলেছে। আদিবাসীদের দলিল-দস্তাবেজ থাকার পরও তাদের পক্ষে কেউ-ই বলার লোক থাকে না। জায়গা-জমি কিংবা বসতভিটা সম্পর্কে আদিবাসী অধ্যুষিত জেলা আদালতগুলোতে অসংখ্য মামলা যুগের পর যুগ চলমান রয়েছে। আদিবাসীরা অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল হওয়ায় মামলা লড়তে পারেন না। ন্যায়বিচার যেন আদিবাসীদের কাছে সোনার হরিণ। আদিবাসীরা একদিকে আইনের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে, অপরদিকে স্থানচ্যুত হয়ে যাযাবর জনগোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছে।

নির্বাচন ব্যবস্থায় আদিবাসীদের অংশ বাড়াতে জনপ্রতিনিধিমূলক সংরক্ষিত আসন আবশ্যক। স্থানীয় পর্যায় থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন পদ্ধতিতে সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা থাকলে দেশ গঠনে, উন্নয়নে আদিবাসীরা অবদান রাখতে সক্ষম হবে। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে যতবারই আদিবাসীদের মধ্যে থেকে নারী সংরক্ষিত আসনে প্রতিনিধিত্বের সুযোগ এসেছে; প্রতিবারই পাহাড়ি অঞ্চলের নারীরা সুযোগ পেয়েছে। এক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও সিলেট উপেক্ষিত হয়েছে।

৫ আগস্ট সরকারের পটপরিবর্তনের পরবর্তীকালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা দায়িত্ব অর্পণেও আমরা উত্তরবঙ্গের আদিবাসীরা আশায় বুক বেঁধেছিলাম, আমরা আশাহত হয়েছি। সংস্কার কমিটি গঠিত হলো, এখানেও কোনো আদিবাসীর নাম চোখে পড়েনি। এটি কী কোনো বৈষম্য নয়! আদিবাসীরা জীবনের সবটুকু উজাড় করে দেশকে দিয়েছে, দেশের শাসকগণ অনুরূপভাবে আদিবাসীদের প্রতিদান দিতে পারেনি। আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় এখনো চাপা কান্নার আওয়াজ শোনা যায়, শাসকদের এ বিষয়ে আরো সহনশীল ও মনোযোগী হওয়া দরকার।

[লেখক : কলামিস্ট]

back to top