শেখর ভট্টাচার্য
চোখ বুজে থাকলে ঘাস ফড়িংয়ের পেছনে দৌড়ানোর ছবি দেখতে পাই। পাখা মেলা প্রজাপতির মোলায়েম ডানার স্পর্শ সুখ এখনও অনুভব করি। লজ্জাবতীর পাতাকে ছুঁইয়ে লজ্জা ভাঙানোর ব্যাখ্যাতীত এক নেশা এখনও তাড়িত করে। শৈশব, কৈশোরকে কী ফেরানো যায়? যায় না। ফেরানো না গেলে কী হবে। মনের গহীনে রূপকথার গল্পের রাক্ষসপুরীতে যেরকম সিন্দুক থাকে আমার মনের ভেতরে এরকম একটি সিন্দুক আছে। সে সিন্দুক রাক্ষস খোক্কসের নয়, নিতান্ত স্মৃতিকাতর একজন মানুষের। সেখানে সঞ্চিত আছে ঘুড়ি ওড়ানোর নাটাই, লাল, নীল ঘুড়ি, গুলাইল আর রয়েল গুলিসহ কতকিছু। মাঝে মাঝে এসব সঞ্চিত ধন সিন্দুক থেকে বেরিয়ে আসে, এসব নিয়ে ভাবায়। আনন্দ বেদনার স্মৃতিকে উসকে দেয়। স্মৃতির সঙ্গে আনন্দ থাকে, থাকে মধুর বেদনাও। রোমান্টিক যুগের কবি পারসি বাইশি শেলীর কবিতার পঙ্ক্তির মতো আমাদের জীবনের মধুরতম সংগীত সেটি, যা বেদনার বার্তা থেকে উৎসারিত হয়। ইংরেজিতে বললে অনেকেরই সহজে বোধগম্য হবে ‘আওয়ার সুইটেস্ট সংস আর দোজ, দ্যাট টেল অব সেডেস্ট থট।’ আমার কাছে শেলীর এই পঙ্ক্তির ভাবার্থ অনেকটা চিরকালীন সত্যের মতো।
ভোরের কুয়াশা ভেদ করে দিনটি যখন উজ্জ্বলতর হয়ে উঠতো তখন ম্রীয়মান সাদা চাঁদকে মনে হতো ঘুড়ি। আহা, ঘুড়ি। জেগে থাকলে, ঘুমুলে, ঘুম ভাঙলে মন এবং চোখের আকাশে উড়ে বেড়ায় পরম আনন্দে। ঘুড়ি ওড়ানো, ঘুড়ি আকাশে ভোকাট্টা হলে ঘুড়ির পেছনে দৌড়। দৌড়োতে দৌড়োতে কোথায় যাচ্ছি জানি না। এরকম দৌড়ে বোধ হয় শহর, নগর পৃথিবীর প্রান্তকে ছোঁয়া যায়।
ঝকঝকে স্বচ্ছ জলের দিঘির পারে ছিল তখনকার ছোট্ট শহর সিলেটে আমাদের বাসা। পৌরসভার ভেতরে ষাটের দশকে এটি একটি নিখাদ গ্রাম। যে দিঘির কথা বলছি এটিতে অসংখ্য মানুষ স্নান করত, একারণে দীঘিতে পদ্ম ফুল ফোটার অবকাশ বা পরিবেশ ছিল না। দিঘির পারে পুরনো শান বাঁধানো ঘাট। ঘাটের উপর উঁচু একটি বেদী। সে বেদীতে বসে ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কত গল্প। কয়েকজনের একটি দল আসছে তাদের স্নান, আড্ডা শেষ হলে আর একটি দল। জোৎস্না প্লাবিত পূর্ণিমা সন্ধ্যা কিংবা ভর আমাবস্যার ঘুটঘুটে রাত, এখানে টুকরো টুকরো গল্প চলতেই থাকে। রবীন্দ্রনাথের ঘাটের কথার গল্পের মতো দিঘিটি কত সুখ-দুঃখের সাক্ষী হয়ে শত শত বছরকে ধারণ করে আছে।
স্মৃতির গলি দিয়ে তরতর করে পেছনে ফেরাতে আমার বড় আনন্দ। পেছনে নাকি ভূতেরা হাঁটে। স্মৃতিকাতর মানুষেরাও হাঁটে। এই হাঁটা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো কী না জানি না, তারপরও এ নেশা ছাড়াতে চাইনা কিংবা পারি না। হেমন্তের মিঠে রোদে বাসার কাছে বিস্তীর্ণ সোনালি ফসলের মাঠ। শহরের শেষ প্রান্তে বাসা। এরপরেই ফসলের মাঠ, কাশবন, আর ছোট বড় ছড়া।
সিলেটের বাইরের মানুষ ছড়ার সৌন্দর্য কতোটুকু দেখেছেন বা অনুভব করতে পারেন তা আমি জানি না। আমার কাছে নদীর থেকেও প্রিয় ছড়া। ছড়ায় মূলত নেমে আসে পাহাড়ি জল। বড় বড় পাথরের ভেতরে পরিশ্রুত হতে হতে এগিয়ে যায়। এগিয়ে যাওয়ার পথে অন্য জলকেও ধারণ করে। কী স্বচ্ছ জল যেন আয়নার স্বচ্ছতাকে ধারণ করে। ছড়ার প্রশস্ত নদীর মতো নয়, অনেকটা খালের মতো বলা যায়। সবচেয়ে সুন্দর ছড়া দেখেছি চা-বাগানের ভেতরে। দুই পারে অসংখ্য বুনো গাছ। ছোট ছোট বুনো গাছের সাথে ছড়ার মিতালি। সেই বুনো গাছের বন্ধু প্রজাপতি, ফড়িং আর ‘অফিস টাইম ফুল’। গোলাপি রঙের ছোট ছোট ‘অফিস টাইম ফুল’। সিলেট শহরে এই ফুলগুলোকে সবাই অফিস টাইম ফুল বলত, নামকরণের ইতিহাস জানি না তবে নামের পেছনের কী যুক্তি আছে সেটি জানি। ফুলগুলো সকাল ১০টায় ঠিক অফিস টাইমে ফুটত আর সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে যেত। এ কারণেই অফিস টাইম, ‘অফিস টাইম’। বর্ষাকালে ছড়ার বক্ষ স্ফীত হয়ে উঠত। তখন স্বচ্ছ জলের ঢেউয়ের সৌন্দর্য পাগল করে তুলত আমাদের মনকে। সিলেটের মানুষের জীবনে ছড়া এক বিশেষ অনুষঙ্গ ছিলো। কেনো ছিল তার বহুমাত্রিক কারণ আছে। এর একটি প্রধান কারণ হলো, ছড়া প্রকৃতির নিষ্কাশনের একটি মাধ্যম। পাহাড়, টিলা থেকে যাত্রা শুরু করে গ্রাম, শহরের সকল জলকে নিয়ে ছড়া নদীতে মিশে যেত। এতে করে প্রকৃতির ব্যবস্থাপনায় জলগুলো নিষ্কাষিত হয়ে গ্রামীন এবং শহরের জনপদগুলোকে জলাবদ্ধতা, অকাল বন্যা থেকে রক্ষা করত। সাম্প্রতিক কালে দেখেছি, রাজনৈতিক অঙ্গনের ‘তারকা’ দুর্বৃত্তরা নদীর মতো ছড়া গুলোকেও গলধঃকরণ করেছেন। দুদিনের বৃষ্টিতে তাই সিলেট শহর এখন নৌকার মতো ভাসতে থাকে। এ যেন ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’। যাক ধান ভানতে আর শিবের গীত গাওয়ার আর ইচ্ছে নেই। ফিরে আসি স্মৃতির শাড়ির পাট ভেঙে পাঠকের সঙ্গে কিছু ভাগ করে নেয়ার পরম প্রচেষ্টাতে।
আমাদের বাসার পাশেই সাগরদিঘি। এই দিঘির জলে আকাশের ছায়া। সে ছায়ারা আমাকে আপ্লুত করে তুলত। ছায়া দেখে দেখে মন হারিয়ে যেত, কোথায় জানি না কোন সুদূরে। আকাশে পাখি ওড়ে, কোন কোন পাখি আকাশকে ধরতে চায়। বিশেষ করে জীবনানন্দ দাশের সোনালী ডানার চিল। গাছ পালা, পাখি, আকাশ যেন দিঘির জলে স্নান করতে চায়। আহা, সে দৃশ্য দেখার অনুভূতি না বলাই থাক। কিছু কিছু অনুভূতি না বলা বাণীর মতো হৃদয়ে ধারণ করতে হয়। দিঘির জলে প্রকৃতির ছায়ার নান্দনিকতা মনের কোণে সঞ্চিত থাকাই ভালো।
আহা সময়! কত দ্রুত চলে যাচ্ছে। আমাদের সময় হলে বলতাম এক্সপ্রেস ট্রেনের মতো। এখনকার ছেলেমেয়েরা বলবে সুপারসনিক বিমান কিংবা রকেটের মতো। একালের ছেলেমেয়েরা কি সময় করে আকাশের দিকে তাকায়? ফুল, পাখি, নদী তাদের কেমন টানে? জানি না। তাদের সময় কাটানোর রুটিন বড় অদ্ভুত। তাই জিজ্ঞেস করা হয়নি। জিজ্ঞেস করলে প্রকৌশল এবং বিজ্ঞানের অনেক কথা তারা বলবে যার উত্তর আমার, আমাদের জানা নেই। তবে বিজ্ঞানকে ভালোবেসে সময় করে প্রকৃতির সান্নিধ্যে যাওয়া খুব কঠিন কাজ নয়। আমাদের তরুণদের জ্যোৎস্নার ঢেউয়ে প্লাবিত আকশের দিকে তাকাতে হবে, আমাদের ছোট ছোট শিশুদেরকে শুধু বইয়ের পাতায় নয়, আকাশের দিকে তাকিয়ে সুস্পষ্টভাবে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলতে হবে এই হলো সপ্তর্ষি এই হলো ধ্রুব তারা। আমাদের অভিভাবকরা চাঁদনি রাতে উঠোনে বসিয়ে এককালে আমাদের শিখিয়েছিলেন। তাদের কাছ থেকে পাওয়া কোন শিক্ষাই বৃথা যায়নি। অনানুষ্ঠানিক এরকম শিক্ষা যে কত আনন্দদায়ক জীবনের অপরাহ্নে এসে তা এখন খুব ভালো বুঝতে পারি। আমরা প্রকৃতির শিক্ষা, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, প্রকৃতি প্রতি সন্তানদের ভালোবাসা জাগাতে ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের সোনার মানুষদের কয়েকটি গান ছাড়া তারা কি খুব ভালো ভাবে চেনে? লালন, হাসন, রাধারমন, শাহ করিমের গান ছাড়া তাদের জীবনদর্শন আমরা তাদের কতটুকু জানতে দিয়েছি। সময় যে দ্রুত অস্থির হয়ে উঠেছে, মূল্যবোধ যে তলানিতে এসে ঠেকেছে এর জন্য আমরা যারা অভিভাবক আছি, আমাদের দায় কী এড়ানো যাবে।
বাংলাদেশে এখন হেমন্ত। হেমন্তের সম্ভাবনাময় দিনে আমার মনে বড় হাহাকার। শৈশবের জন্য, কৈশোরের জন্য। ইচ্ছে হয় ঝাপিয়ে পড়ি সিলেটের কাজলশাহের সেই টলটলে দিঘিতে। সেখানে ঝাঁপ দিলে শৈশবকে খুঁজে পাওয়া যাবে। আমার বিশ্বাস কিছুটা হলেও পাওয়া যাবে।
পেছনে যেতে চাই, শুধু প্রকৃতির জন্য নয় আমাদের শৈশবের সেই সব মানুষের মুখগুলো দেখার জন্য। স্নেহ ভালোবাসা ঝরনা ধারার মতো ঠিকরে বেরিয়ে আসত তাদের চোখ মুখ, দেহভঙ্গি থেকে। সেই সোনার মানুষেরা কোথায়? এই অস্থির সময়ে সেসব ভালোবাসায় পরিপূর্ণ সোনার মানুষদের খুঁজে পেতে চাই। হয়তো পাব আবার না-ও পেতে পারি? সন্দেহ, ভয় সব কিছু মানুষকে নিয়ে। আমরা সঠিকভাবে মানুষকে ভজন করতে পারি না। মানুষকে যারা ভজন করতেন তাদেরকেও আমরা দূরে সরিয়ে দিচ্ছি নানা অজুহাতে। ফকির লালন শাহ, ঠিকই মানুষ খুঁজে পেতেন। তিনি উদাত্ত কণ্ঠে বলতেন, ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি/ও মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’। শ্রদ্ধা, ভক্তি দূরে সরে গেছে, তাই সোনার মানুষেরাও হারিয়ে যাচ্ছেন ক্রমাগত।
[লেখক: প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]
শেখর ভট্টাচার্য
মঙ্গলবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৪
চোখ বুজে থাকলে ঘাস ফড়িংয়ের পেছনে দৌড়ানোর ছবি দেখতে পাই। পাখা মেলা প্রজাপতির মোলায়েম ডানার স্পর্শ সুখ এখনও অনুভব করি। লজ্জাবতীর পাতাকে ছুঁইয়ে লজ্জা ভাঙানোর ব্যাখ্যাতীত এক নেশা এখনও তাড়িত করে। শৈশব, কৈশোরকে কী ফেরানো যায়? যায় না। ফেরানো না গেলে কী হবে। মনের গহীনে রূপকথার গল্পের রাক্ষসপুরীতে যেরকম সিন্দুক থাকে আমার মনের ভেতরে এরকম একটি সিন্দুক আছে। সে সিন্দুক রাক্ষস খোক্কসের নয়, নিতান্ত স্মৃতিকাতর একজন মানুষের। সেখানে সঞ্চিত আছে ঘুড়ি ওড়ানোর নাটাই, লাল, নীল ঘুড়ি, গুলাইল আর রয়েল গুলিসহ কতকিছু। মাঝে মাঝে এসব সঞ্চিত ধন সিন্দুক থেকে বেরিয়ে আসে, এসব নিয়ে ভাবায়। আনন্দ বেদনার স্মৃতিকে উসকে দেয়। স্মৃতির সঙ্গে আনন্দ থাকে, থাকে মধুর বেদনাও। রোমান্টিক যুগের কবি পারসি বাইশি শেলীর কবিতার পঙ্ক্তির মতো আমাদের জীবনের মধুরতম সংগীত সেটি, যা বেদনার বার্তা থেকে উৎসারিত হয়। ইংরেজিতে বললে অনেকেরই সহজে বোধগম্য হবে ‘আওয়ার সুইটেস্ট সংস আর দোজ, দ্যাট টেল অব সেডেস্ট থট।’ আমার কাছে শেলীর এই পঙ্ক্তির ভাবার্থ অনেকটা চিরকালীন সত্যের মতো।
ভোরের কুয়াশা ভেদ করে দিনটি যখন উজ্জ্বলতর হয়ে উঠতো তখন ম্রীয়মান সাদা চাঁদকে মনে হতো ঘুড়ি। আহা, ঘুড়ি। জেগে থাকলে, ঘুমুলে, ঘুম ভাঙলে মন এবং চোখের আকাশে উড়ে বেড়ায় পরম আনন্দে। ঘুড়ি ওড়ানো, ঘুড়ি আকাশে ভোকাট্টা হলে ঘুড়ির পেছনে দৌড়। দৌড়োতে দৌড়োতে কোথায় যাচ্ছি জানি না। এরকম দৌড়ে বোধ হয় শহর, নগর পৃথিবীর প্রান্তকে ছোঁয়া যায়।
ঝকঝকে স্বচ্ছ জলের দিঘির পারে ছিল তখনকার ছোট্ট শহর সিলেটে আমাদের বাসা। পৌরসভার ভেতরে ষাটের দশকে এটি একটি নিখাদ গ্রাম। যে দিঘির কথা বলছি এটিতে অসংখ্য মানুষ স্নান করত, একারণে দীঘিতে পদ্ম ফুল ফোটার অবকাশ বা পরিবেশ ছিল না। দিঘির পারে পুরনো শান বাঁধানো ঘাট। ঘাটের উপর উঁচু একটি বেদী। সে বেদীতে বসে ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কত গল্প। কয়েকজনের একটি দল আসছে তাদের স্নান, আড্ডা শেষ হলে আর একটি দল। জোৎস্না প্লাবিত পূর্ণিমা সন্ধ্যা কিংবা ভর আমাবস্যার ঘুটঘুটে রাত, এখানে টুকরো টুকরো গল্প চলতেই থাকে। রবীন্দ্রনাথের ঘাটের কথার গল্পের মতো দিঘিটি কত সুখ-দুঃখের সাক্ষী হয়ে শত শত বছরকে ধারণ করে আছে।
স্মৃতির গলি দিয়ে তরতর করে পেছনে ফেরাতে আমার বড় আনন্দ। পেছনে নাকি ভূতেরা হাঁটে। স্মৃতিকাতর মানুষেরাও হাঁটে। এই হাঁটা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো কী না জানি না, তারপরও এ নেশা ছাড়াতে চাইনা কিংবা পারি না। হেমন্তের মিঠে রোদে বাসার কাছে বিস্তীর্ণ সোনালি ফসলের মাঠ। শহরের শেষ প্রান্তে বাসা। এরপরেই ফসলের মাঠ, কাশবন, আর ছোট বড় ছড়া।
সিলেটের বাইরের মানুষ ছড়ার সৌন্দর্য কতোটুকু দেখেছেন বা অনুভব করতে পারেন তা আমি জানি না। আমার কাছে নদীর থেকেও প্রিয় ছড়া। ছড়ায় মূলত নেমে আসে পাহাড়ি জল। বড় বড় পাথরের ভেতরে পরিশ্রুত হতে হতে এগিয়ে যায়। এগিয়ে যাওয়ার পথে অন্য জলকেও ধারণ করে। কী স্বচ্ছ জল যেন আয়নার স্বচ্ছতাকে ধারণ করে। ছড়ার প্রশস্ত নদীর মতো নয়, অনেকটা খালের মতো বলা যায়। সবচেয়ে সুন্দর ছড়া দেখেছি চা-বাগানের ভেতরে। দুই পারে অসংখ্য বুনো গাছ। ছোট ছোট বুনো গাছের সাথে ছড়ার মিতালি। সেই বুনো গাছের বন্ধু প্রজাপতি, ফড়িং আর ‘অফিস টাইম ফুল’। গোলাপি রঙের ছোট ছোট ‘অফিস টাইম ফুল’। সিলেট শহরে এই ফুলগুলোকে সবাই অফিস টাইম ফুল বলত, নামকরণের ইতিহাস জানি না তবে নামের পেছনের কী যুক্তি আছে সেটি জানি। ফুলগুলো সকাল ১০টায় ঠিক অফিস টাইমে ফুটত আর সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে যেত। এ কারণেই অফিস টাইম, ‘অফিস টাইম’। বর্ষাকালে ছড়ার বক্ষ স্ফীত হয়ে উঠত। তখন স্বচ্ছ জলের ঢেউয়ের সৌন্দর্য পাগল করে তুলত আমাদের মনকে। সিলেটের মানুষের জীবনে ছড়া এক বিশেষ অনুষঙ্গ ছিলো। কেনো ছিল তার বহুমাত্রিক কারণ আছে। এর একটি প্রধান কারণ হলো, ছড়া প্রকৃতির নিষ্কাশনের একটি মাধ্যম। পাহাড়, টিলা থেকে যাত্রা শুরু করে গ্রাম, শহরের সকল জলকে নিয়ে ছড়া নদীতে মিশে যেত। এতে করে প্রকৃতির ব্যবস্থাপনায় জলগুলো নিষ্কাষিত হয়ে গ্রামীন এবং শহরের জনপদগুলোকে জলাবদ্ধতা, অকাল বন্যা থেকে রক্ষা করত। সাম্প্রতিক কালে দেখেছি, রাজনৈতিক অঙ্গনের ‘তারকা’ দুর্বৃত্তরা নদীর মতো ছড়া গুলোকেও গলধঃকরণ করেছেন। দুদিনের বৃষ্টিতে তাই সিলেট শহর এখন নৌকার মতো ভাসতে থাকে। এ যেন ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’। যাক ধান ভানতে আর শিবের গীত গাওয়ার আর ইচ্ছে নেই। ফিরে আসি স্মৃতির শাড়ির পাট ভেঙে পাঠকের সঙ্গে কিছু ভাগ করে নেয়ার পরম প্রচেষ্টাতে।
আমাদের বাসার পাশেই সাগরদিঘি। এই দিঘির জলে আকাশের ছায়া। সে ছায়ারা আমাকে আপ্লুত করে তুলত। ছায়া দেখে দেখে মন হারিয়ে যেত, কোথায় জানি না কোন সুদূরে। আকাশে পাখি ওড়ে, কোন কোন পাখি আকাশকে ধরতে চায়। বিশেষ করে জীবনানন্দ দাশের সোনালী ডানার চিল। গাছ পালা, পাখি, আকাশ যেন দিঘির জলে স্নান করতে চায়। আহা, সে দৃশ্য দেখার অনুভূতি না বলাই থাক। কিছু কিছু অনুভূতি না বলা বাণীর মতো হৃদয়ে ধারণ করতে হয়। দিঘির জলে প্রকৃতির ছায়ার নান্দনিকতা মনের কোণে সঞ্চিত থাকাই ভালো।
আহা সময়! কত দ্রুত চলে যাচ্ছে। আমাদের সময় হলে বলতাম এক্সপ্রেস ট্রেনের মতো। এখনকার ছেলেমেয়েরা বলবে সুপারসনিক বিমান কিংবা রকেটের মতো। একালের ছেলেমেয়েরা কি সময় করে আকাশের দিকে তাকায়? ফুল, পাখি, নদী তাদের কেমন টানে? জানি না। তাদের সময় কাটানোর রুটিন বড় অদ্ভুত। তাই জিজ্ঞেস করা হয়নি। জিজ্ঞেস করলে প্রকৌশল এবং বিজ্ঞানের অনেক কথা তারা বলবে যার উত্তর আমার, আমাদের জানা নেই। তবে বিজ্ঞানকে ভালোবেসে সময় করে প্রকৃতির সান্নিধ্যে যাওয়া খুব কঠিন কাজ নয়। আমাদের তরুণদের জ্যোৎস্নার ঢেউয়ে প্লাবিত আকশের দিকে তাকাতে হবে, আমাদের ছোট ছোট শিশুদেরকে শুধু বইয়ের পাতায় নয়, আকাশের দিকে তাকিয়ে সুস্পষ্টভাবে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলতে হবে এই হলো সপ্তর্ষি এই হলো ধ্রুব তারা। আমাদের অভিভাবকরা চাঁদনি রাতে উঠোনে বসিয়ে এককালে আমাদের শিখিয়েছিলেন। তাদের কাছ থেকে পাওয়া কোন শিক্ষাই বৃথা যায়নি। অনানুষ্ঠানিক এরকম শিক্ষা যে কত আনন্দদায়ক জীবনের অপরাহ্নে এসে তা এখন খুব ভালো বুঝতে পারি। আমরা প্রকৃতির শিক্ষা, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, প্রকৃতি প্রতি সন্তানদের ভালোবাসা জাগাতে ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের সোনার মানুষদের কয়েকটি গান ছাড়া তারা কি খুব ভালো ভাবে চেনে? লালন, হাসন, রাধারমন, শাহ করিমের গান ছাড়া তাদের জীবনদর্শন আমরা তাদের কতটুকু জানতে দিয়েছি। সময় যে দ্রুত অস্থির হয়ে উঠেছে, মূল্যবোধ যে তলানিতে এসে ঠেকেছে এর জন্য আমরা যারা অভিভাবক আছি, আমাদের দায় কী এড়ানো যাবে।
বাংলাদেশে এখন হেমন্ত। হেমন্তের সম্ভাবনাময় দিনে আমার মনে বড় হাহাকার। শৈশবের জন্য, কৈশোরের জন্য। ইচ্ছে হয় ঝাপিয়ে পড়ি সিলেটের কাজলশাহের সেই টলটলে দিঘিতে। সেখানে ঝাঁপ দিলে শৈশবকে খুঁজে পাওয়া যাবে। আমার বিশ্বাস কিছুটা হলেও পাওয়া যাবে।
পেছনে যেতে চাই, শুধু প্রকৃতির জন্য নয় আমাদের শৈশবের সেই সব মানুষের মুখগুলো দেখার জন্য। স্নেহ ভালোবাসা ঝরনা ধারার মতো ঠিকরে বেরিয়ে আসত তাদের চোখ মুখ, দেহভঙ্গি থেকে। সেই সোনার মানুষেরা কোথায়? এই অস্থির সময়ে সেসব ভালোবাসায় পরিপূর্ণ সোনার মানুষদের খুঁজে পেতে চাই। হয়তো পাব আবার না-ও পেতে পারি? সন্দেহ, ভয় সব কিছু মানুষকে নিয়ে। আমরা সঠিকভাবে মানুষকে ভজন করতে পারি না। মানুষকে যারা ভজন করতেন তাদেরকেও আমরা দূরে সরিয়ে দিচ্ছি নানা অজুহাতে। ফকির লালন শাহ, ঠিকই মানুষ খুঁজে পেতেন। তিনি উদাত্ত কণ্ঠে বলতেন, ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি/ও মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’। শ্রদ্ধা, ভক্তি দূরে সরে গেছে, তাই সোনার মানুষেরাও হারিয়ে যাচ্ছেন ক্রমাগত।
[লেখক: প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]