মাহরুফ চৌধুরী
ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের একটা বহুল উদ্ধৃত উক্তি হলোÑ ‘আমি তোমার কথার সঙ্গে বিন্দুমাত্র একমত না হতে পারি, কিন্তু তোমার কথা বলার অধিকার রক্ষার জন্য আমি জীবন দেবো।’ একজন মুক্তমনা নৈতিক মানুষ সেটাই করবে। তাই তার এই উক্তিকে অঙ্গীকার করেই আজকের এই লেখার অবতারণা।
প্রকৃতপক্ষে একটি দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তখনই নিশ্চিত হয় যখন সেখানে ক্ষমতাসীনেরা বিরুদ্ধ মতকে অবদমিত না করে। বর্তমান অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারে সাম্প্রতিক কর্মকা-ে গণবিপ্লবের চেতনা ‘বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত’ গণমুখী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন ক্রমশই ফিকে হয়ে যাচ্ছে; যা আমাদের অনেকেরই মনে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার জন্ম দিচ্ছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে ছাত্রলীগের মতো একটি ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত মুক্তচিন্তার মানুষদের মধ্যে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এমন একটি সিদ্ধান্ত অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারকে স্বৈরাচারী মনোভাবাপন্ন হিসেবে উপস্থাপন করছে, যেখানে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো পরমতসহিষ্ণুতা তথা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মতাদর্শের বৈচিত্র্য এবং জনগণের স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক দল বা সংগঠন নির্বাচনের অধিকার; কিন্তু ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার এসব নীতির চরম লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে মনে করি।
ছাত্রলীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ বর্তমান অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের একটি স্বৈরাচারী মনোভাবের বহির্প্রকাশ। ছাত্রলীগ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে এটি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র একটি দলের ওপর নিষেধাজ্ঞা নয়; এটি সংগঠনটির সমর্থকদের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর আঘাত। অপরাধমূলক কাজের দায় যারা করেছে তাদের, সংগঠনের নয়।
ছাত্রলীগ দল হিসেবে কোন অপরাধ করেনি; বরং ব্যক্তিবিশেষ সেই দলের ব্যানারে থেকে বিভিন্ন অনৈতিক ও অবৈধ কর্মকা-ের মাধ্যমে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে। এক্ষেত্রে অপরাধী ব্যক্তিদের প্রচলিত আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া যুক্তিসঙ্গত হতে পারে, তবে পুরো ছাত্রসংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করা স্বৈরাচারী পদক্ষেপ বলে প্রতীয়মান হয়। এটি জাতীয় রাজনীতির গণতান্ত্রিক কাঠামোকে দুর্বল করে তুলবে এবং প্রতিটি ব্যক্তি বা সংগঠনের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকারে হস্তক্ষেপের নামান্তর।
গণতান্ত্রিক পন্থায় রাজনৈতিক সংগঠন বা দলের সংস্কার প্রয়াসই হবে নিষেধাজ্ঞা আরোপের চেয়ে কার্যকর পন্থা। যদি সংগঠনের মধ্যে অব্যবস্থাপনা বা অনাচার ধরা পড়ে, তবে সেটির সংস্কারের জন্য প্রশাসনিকভাবে চাপ প্রয়োগ করা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সংগঠনটির পুনর্বিন্যাস করাই হবে বাস্তবসম্মত উপায়। একদিকে ছাত্রসংগঠনের ভেতর গণতান্ত্রিক কাঠামো শক্তিশালী করার মাধ্যমে পরিবর্তন আনা যেতে পারে, যা তরুণ সমাজকে গণতন্ত্রমুখী করতে সহায়ক হবে। অপরদিকে তা রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক আবহ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে; কিন্তু সরকার যদি বিশেষ কোন দল বা ছাত্রসংগঠনকেই নিষিদ্ধ করে দেয়, তবে তা দেশের নাগরিকদের ব্যক্তিস্বাধীনতা, মতপ্রকাশ ও রাজনীতি করার অধিকার ক্ষুণ্ণ করার শামিল। গণতন্ত্রমুখী সমাজেই কেবল শিক্ষিত তরুণরা মুক্তবুদ্ধি, সহনশীলতা ও আদর্শিক রাজনীতির চর্চায় সম্পৃক্ত হয়ে সমাজকে এগিয়ে নিতে পারে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত সমাজে ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি সংশয় তৈরি করে। শুধু ব্যক্তি বা কিছু সদস্যের অপরাধের জন্য সংগঠনকে দোষারোপ না করে বরং অপরাধীদের শাস্তি দিয়ে দলকে সংশোধনের সুযোগ দেয়া উচিত। পরিবর্তিত পরিস্থিতে রাষ্ট্রের বর্তমান নীতিনির্ধারকদের উচিত রাজনৈতিক দল বা সংগঠনগুলোর জন্যে সংস্কারের সুযোগ সৃষ্টি করা এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রেখে সব দল বা মতের লোকজনদের তাদের পছন্দের রাজনীতি দল করার অধিকারকে সমুন্নত রাখা।
রাজনৈতিক আদর্শের লড়াই নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে নয়, উচ্চতর বিকল্প আদর্শের মাধ্যমেই করতে হবে; যাতে জনগণ সহজেই ভালো ও খারাপের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারে। প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক আদর্শের ক্ষেত্রে সঠিক পথ হচ্ছে এক আদর্শের মোকাবেলায় উচ্চতর বিকল্প আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা। যখন একটি আদর্শে ভুল বা দুর্বলতা দেখা যায়, তখন সেটা নিঃশেষ করতে নিষেধাজ্ঞার প্রয়োগ নয়; বরং বিকল্প আদর্শ প্রচারের মাধ্যমেই তাকে মোকাবেলা করতে হবে। একজন মানুষ যখন দেখবে তার রাজনৈতিক সংগঠনের নীতি বা কার্যকলাপ খারাপ বা অকেজো, তখন সে যদি উচ্চতর আদর্শের অন্য সংগঠন পায়, অতি সহজেই সেটায় যোগদান করবে। ফলে অতি সহজেই খারাপ সংগঠনটি ভালো দলটির কাছে আদর্শিকভাবে পরাজিত হবে।
মনে রাখতে হবে যে, কোন আদর্শিক সংগঠনকে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে নিষ্ক্রিয় করা যায় না, কিংবা নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে কোন রাজনৈতিক আদর্শকে স্থায়ীভাবে দমন করা যায় না; বরং সেই আদর্শ আরও ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করতে থাকে। তাছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কেউ তার মতাদর্শ প্রকাশ করতে চাইলে, তাকে সেই স্বাধীনতা প্রদান করাটাই প্রকৃত গণতন্ত্রের পরিচায়ক। গণতান্ত্রিক পরিবেশে কেবল ভালো আদর্শই অন্যায়কে পরাস্ত করতে পারে। রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমেই যদি বিরোধীদের কণ্ঠ রুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়, তবে তা সঠিক গণতন্ত্রের পথে বাধা তৈরি করবে। তাই দায় ও দরদের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তির রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষাই ‘বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত’ রাষ্ট্র বিনির্মাণের মূল চাবিকাঠি।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতিটি নাগরিকের রয়েছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক দল নির্বাচনের অধিকার। আপনি, আমি এবং আমাদের চারপাশের মানুষদের খেয়ালখুশি মতো রাজনৈতিক দল নির্বাচন করার অধিকার রয়েছে; কিন্তু যদি এ অধিকার খর্ব করা হয় এবং মানুষকে নির্দিষ্ট কিছু আদর্শের প্রতি আনুগত্য প্রকাশে বাধ্য করা হয়, তাহলে সেটি স্বৈরাচারের লক্ষণ।
একটি রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের ‘বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত’ রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্নে গুড়েবালিই বলা চলে। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী রাষ্ট্র বা তার সরকার কখনো স্বৈরাচারী পথে এগোতে পারে না। যখন একটি ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তখন এ পরিস্থিতিতে জনগণের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে: আমাদের অন্তর্র্বতীকালীন সরকার কি আসলেই ‘বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত’ রাষ্ট্র গঠনের পথ পরিহার করে পূর্ববর্তী সরকারের মতোই স্বৈরাচারী পথে এগোচ্ছে না? একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারমুক্ত রাষ্ট্র গঠনের অঙ্গীকার শুধুমাত্র মুখে মুখে আওড়ালেই চলবে না, বরং সেটি সরকারকে তার নীতিগত অবস্থান এবং কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে দেশের প্রত্যেকটি মানুষের মানবিক, নাগরিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারকে সমুন্নত রাখা। ব্যক্তি বিশেষের অপরাধের জন্য কোন দল, সংগঠন বা আদর্শকে দোষারোপ করা এবং পুরো একটি দল বা সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা একটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্রের জন্য ক্ষতিকর দৃষ্টান্ত। তাই নিষেধাজ্ঞা নয়, সংগঠনগুলোকে গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা জরুরি।
নাগরিকদের জন্যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের ভূমিকা অপরিসীম। স্বৈরাচারী মনোভাব এবং অবদমনমূলক পদক্ষেপ নেয়া রাজনৈতিক পরিম-লে নাগরিকদের মধ্যে ভয় ও সংশয়ের জন্ম দেয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গণহারে সংগঠনের সবাইকে শাস্তি না দেয়ার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো দল বা ব্যক্তিকে ভুল পথ থেকে সঠিক পথে ফেরানো। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি সবার শ্রদ্ধাশীল হওয়ার চর্চা বাড়ানো। আমাদের উচিত অবক্ষয়িত সমাজকে সামগ্রিকভাবে গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা এবং মতের পার্থক্যকে সম্মান করতে শেখানো। রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে রক্ষার চেষ্টা কখনোই সফল হয় না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কর্তব্য হলো সংগঠনগুলোর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া এবং তাদের রাজনৈতিক অধিকার চর্চার সুযোগ তৈরি করা। একমাত্র গণতান্ত্রিক পরিবেশেই শিক্ষিত ও সচেতন জনগণই সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে, যা সমাজ ও রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়নে সহায়ক।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ‘বৈষম্যহীন এবং স্বৈরাচারমুক্ত’ বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন আমাদের সবার। এ স্বপ্ন কেবল তখনই সফল হবে যখন আমরা প্রতিটি মানুষের সব ধরনের অধিকারকে গুরুত্ব দেবো এবং অন্যের ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবো।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রথম শর্তই হল পরমতসহিষ্ণুতা। ছাত্রলীগকে সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত অনেককেই একটি অস্থায়ী স্বস্তি দিতে পারে, তবে তা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের পথ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। যদি সত্যিই ‘বৈষম্যহীন এবং স্বৈরাচারমুক্ত’ রাষ্ট্র গড়ার ইচ্ছা থাকে, তবে আমাদের উচিত এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সমানভাবে সকলের রাজনৈতিক অধিকারকে নিশ্চিত করা। গণতান্ত্রিক এবং সুশৃঙ্খল সমাজ গড়ে তোলার জন্য অপরাধীদের শাস্তি প্রদানের পাশাপাশি সংগঠনগুলোকে গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ দেয়া গুরুত্বপূর্ণ। তাই, একটি ‘বৈষম্যহীন এবং স্বৈরাচারমুক্ত’ রাষ্ট্র গড়া স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে আমাদের উচিত হবে সবার রাজনৈতিক অধিকারকে নিশ্চিত করা এবং সর্বাবস্থায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমের স্বপ্নকে বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকা।
[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]
মাহরুফ চৌধুরী
শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪
ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের একটা বহুল উদ্ধৃত উক্তি হলোÑ ‘আমি তোমার কথার সঙ্গে বিন্দুমাত্র একমত না হতে পারি, কিন্তু তোমার কথা বলার অধিকার রক্ষার জন্য আমি জীবন দেবো।’ একজন মুক্তমনা নৈতিক মানুষ সেটাই করবে। তাই তার এই উক্তিকে অঙ্গীকার করেই আজকের এই লেখার অবতারণা।
প্রকৃতপক্ষে একটি দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তখনই নিশ্চিত হয় যখন সেখানে ক্ষমতাসীনেরা বিরুদ্ধ মতকে অবদমিত না করে। বর্তমান অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারে সাম্প্রতিক কর্মকা-ে গণবিপ্লবের চেতনা ‘বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত’ গণমুখী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন ক্রমশই ফিকে হয়ে যাচ্ছে; যা আমাদের অনেকেরই মনে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার জন্ম দিচ্ছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে ছাত্রলীগের মতো একটি ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত মুক্তচিন্তার মানুষদের মধ্যে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এমন একটি সিদ্ধান্ত অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারকে স্বৈরাচারী মনোভাবাপন্ন হিসেবে উপস্থাপন করছে, যেখানে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো পরমতসহিষ্ণুতা তথা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মতাদর্শের বৈচিত্র্য এবং জনগণের স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক দল বা সংগঠন নির্বাচনের অধিকার; কিন্তু ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার এসব নীতির চরম লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে মনে করি।
ছাত্রলীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ বর্তমান অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের একটি স্বৈরাচারী মনোভাবের বহির্প্রকাশ। ছাত্রলীগ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে এটি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র একটি দলের ওপর নিষেধাজ্ঞা নয়; এটি সংগঠনটির সমর্থকদের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর আঘাত। অপরাধমূলক কাজের দায় যারা করেছে তাদের, সংগঠনের নয়।
ছাত্রলীগ দল হিসেবে কোন অপরাধ করেনি; বরং ব্যক্তিবিশেষ সেই দলের ব্যানারে থেকে বিভিন্ন অনৈতিক ও অবৈধ কর্মকা-ের মাধ্যমে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে। এক্ষেত্রে অপরাধী ব্যক্তিদের প্রচলিত আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া যুক্তিসঙ্গত হতে পারে, তবে পুরো ছাত্রসংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করা স্বৈরাচারী পদক্ষেপ বলে প্রতীয়মান হয়। এটি জাতীয় রাজনীতির গণতান্ত্রিক কাঠামোকে দুর্বল করে তুলবে এবং প্রতিটি ব্যক্তি বা সংগঠনের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকারে হস্তক্ষেপের নামান্তর।
গণতান্ত্রিক পন্থায় রাজনৈতিক সংগঠন বা দলের সংস্কার প্রয়াসই হবে নিষেধাজ্ঞা আরোপের চেয়ে কার্যকর পন্থা। যদি সংগঠনের মধ্যে অব্যবস্থাপনা বা অনাচার ধরা পড়ে, তবে সেটির সংস্কারের জন্য প্রশাসনিকভাবে চাপ প্রয়োগ করা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সংগঠনটির পুনর্বিন্যাস করাই হবে বাস্তবসম্মত উপায়। একদিকে ছাত্রসংগঠনের ভেতর গণতান্ত্রিক কাঠামো শক্তিশালী করার মাধ্যমে পরিবর্তন আনা যেতে পারে, যা তরুণ সমাজকে গণতন্ত্রমুখী করতে সহায়ক হবে। অপরদিকে তা রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক আবহ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে; কিন্তু সরকার যদি বিশেষ কোন দল বা ছাত্রসংগঠনকেই নিষিদ্ধ করে দেয়, তবে তা দেশের নাগরিকদের ব্যক্তিস্বাধীনতা, মতপ্রকাশ ও রাজনীতি করার অধিকার ক্ষুণ্ণ করার শামিল। গণতন্ত্রমুখী সমাজেই কেবল শিক্ষিত তরুণরা মুক্তবুদ্ধি, সহনশীলতা ও আদর্শিক রাজনীতির চর্চায় সম্পৃক্ত হয়ে সমাজকে এগিয়ে নিতে পারে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত সমাজে ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি সংশয় তৈরি করে। শুধু ব্যক্তি বা কিছু সদস্যের অপরাধের জন্য সংগঠনকে দোষারোপ না করে বরং অপরাধীদের শাস্তি দিয়ে দলকে সংশোধনের সুযোগ দেয়া উচিত। পরিবর্তিত পরিস্থিতে রাষ্ট্রের বর্তমান নীতিনির্ধারকদের উচিত রাজনৈতিক দল বা সংগঠনগুলোর জন্যে সংস্কারের সুযোগ সৃষ্টি করা এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রেখে সব দল বা মতের লোকজনদের তাদের পছন্দের রাজনীতি দল করার অধিকারকে সমুন্নত রাখা।
রাজনৈতিক আদর্শের লড়াই নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে নয়, উচ্চতর বিকল্প আদর্শের মাধ্যমেই করতে হবে; যাতে জনগণ সহজেই ভালো ও খারাপের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারে। প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক আদর্শের ক্ষেত্রে সঠিক পথ হচ্ছে এক আদর্শের মোকাবেলায় উচ্চতর বিকল্প আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা। যখন একটি আদর্শে ভুল বা দুর্বলতা দেখা যায়, তখন সেটা নিঃশেষ করতে নিষেধাজ্ঞার প্রয়োগ নয়; বরং বিকল্প আদর্শ প্রচারের মাধ্যমেই তাকে মোকাবেলা করতে হবে। একজন মানুষ যখন দেখবে তার রাজনৈতিক সংগঠনের নীতি বা কার্যকলাপ খারাপ বা অকেজো, তখন সে যদি উচ্চতর আদর্শের অন্য সংগঠন পায়, অতি সহজেই সেটায় যোগদান করবে। ফলে অতি সহজেই খারাপ সংগঠনটি ভালো দলটির কাছে আদর্শিকভাবে পরাজিত হবে।
মনে রাখতে হবে যে, কোন আদর্শিক সংগঠনকে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে নিষ্ক্রিয় করা যায় না, কিংবা নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে কোন রাজনৈতিক আদর্শকে স্থায়ীভাবে দমন করা যায় না; বরং সেই আদর্শ আরও ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করতে থাকে। তাছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কেউ তার মতাদর্শ প্রকাশ করতে চাইলে, তাকে সেই স্বাধীনতা প্রদান করাটাই প্রকৃত গণতন্ত্রের পরিচায়ক। গণতান্ত্রিক পরিবেশে কেবল ভালো আদর্শই অন্যায়কে পরাস্ত করতে পারে। রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমেই যদি বিরোধীদের কণ্ঠ রুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়, তবে তা সঠিক গণতন্ত্রের পথে বাধা তৈরি করবে। তাই দায় ও দরদের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তির রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষাই ‘বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত’ রাষ্ট্র বিনির্মাণের মূল চাবিকাঠি।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতিটি নাগরিকের রয়েছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক দল নির্বাচনের অধিকার। আপনি, আমি এবং আমাদের চারপাশের মানুষদের খেয়ালখুশি মতো রাজনৈতিক দল নির্বাচন করার অধিকার রয়েছে; কিন্তু যদি এ অধিকার খর্ব করা হয় এবং মানুষকে নির্দিষ্ট কিছু আদর্শের প্রতি আনুগত্য প্রকাশে বাধ্য করা হয়, তাহলে সেটি স্বৈরাচারের লক্ষণ।
একটি রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের ‘বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত’ রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্নে গুড়েবালিই বলা চলে। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী রাষ্ট্র বা তার সরকার কখনো স্বৈরাচারী পথে এগোতে পারে না। যখন একটি ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তখন এ পরিস্থিতিতে জনগণের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে: আমাদের অন্তর্র্বতীকালীন সরকার কি আসলেই ‘বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত’ রাষ্ট্র গঠনের পথ পরিহার করে পূর্ববর্তী সরকারের মতোই স্বৈরাচারী পথে এগোচ্ছে না? একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারমুক্ত রাষ্ট্র গঠনের অঙ্গীকার শুধুমাত্র মুখে মুখে আওড়ালেই চলবে না, বরং সেটি সরকারকে তার নীতিগত অবস্থান এবং কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে দেশের প্রত্যেকটি মানুষের মানবিক, নাগরিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারকে সমুন্নত রাখা। ব্যক্তি বিশেষের অপরাধের জন্য কোন দল, সংগঠন বা আদর্শকে দোষারোপ করা এবং পুরো একটি দল বা সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা একটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্রের জন্য ক্ষতিকর দৃষ্টান্ত। তাই নিষেধাজ্ঞা নয়, সংগঠনগুলোকে গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা জরুরি।
নাগরিকদের জন্যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের ভূমিকা অপরিসীম। স্বৈরাচারী মনোভাব এবং অবদমনমূলক পদক্ষেপ নেয়া রাজনৈতিক পরিম-লে নাগরিকদের মধ্যে ভয় ও সংশয়ের জন্ম দেয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গণহারে সংগঠনের সবাইকে শাস্তি না দেয়ার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো দল বা ব্যক্তিকে ভুল পথ থেকে সঠিক পথে ফেরানো। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি সবার শ্রদ্ধাশীল হওয়ার চর্চা বাড়ানো। আমাদের উচিত অবক্ষয়িত সমাজকে সামগ্রিকভাবে গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা এবং মতের পার্থক্যকে সম্মান করতে শেখানো। রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে রক্ষার চেষ্টা কখনোই সফল হয় না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কর্তব্য হলো সংগঠনগুলোর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া এবং তাদের রাজনৈতিক অধিকার চর্চার সুযোগ তৈরি করা। একমাত্র গণতান্ত্রিক পরিবেশেই শিক্ষিত ও সচেতন জনগণই সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে, যা সমাজ ও রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়নে সহায়ক।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ‘বৈষম্যহীন এবং স্বৈরাচারমুক্ত’ বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন আমাদের সবার। এ স্বপ্ন কেবল তখনই সফল হবে যখন আমরা প্রতিটি মানুষের সব ধরনের অধিকারকে গুরুত্ব দেবো এবং অন্যের ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবো।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রথম শর্তই হল পরমতসহিষ্ণুতা। ছাত্রলীগকে সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত অনেককেই একটি অস্থায়ী স্বস্তি দিতে পারে, তবে তা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের পথ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। যদি সত্যিই ‘বৈষম্যহীন এবং স্বৈরাচারমুক্ত’ রাষ্ট্র গড়ার ইচ্ছা থাকে, তবে আমাদের উচিত এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সমানভাবে সকলের রাজনৈতিক অধিকারকে নিশ্চিত করা। গণতান্ত্রিক এবং সুশৃঙ্খল সমাজ গড়ে তোলার জন্য অপরাধীদের শাস্তি প্রদানের পাশাপাশি সংগঠনগুলোকে গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ দেয়া গুরুত্বপূর্ণ। তাই, একটি ‘বৈষম্যহীন এবং স্বৈরাচারমুক্ত’ রাষ্ট্র গড়া স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে আমাদের উচিত হবে সবার রাজনৈতিক অধিকারকে নিশ্চিত করা এবং সর্বাবস্থায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমের স্বপ্নকে বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকা।
[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]