রেজাউল করিম খোকন
বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তির অমিত সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু কীভাবে এটাকে কাজে লাগানো সম্ভব? নবায়নযোগ্য শক্তিই আদিকাল থেকে ব্যবহৃত জ্বালানি এবং মূল জ্বালানি। বরং জীবাশ্ম জ্বালানি ক্ষণিকের ও বিকল্প জ্বালানি। বিশ্বব্যাপী ও দেশে জীবাশ্ম জ্বালানি ফুরিয়ে যাচ্ছে। সবুজ ও জলবায়ু সহিষ্ণুতাকে আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনার কেন্দ্রে স্থান দিতে হবে।
কয়লা ও এলএনজি আমদানি হ্রাস করতে হবে এবং এসব জ্বালানিভিত্তিক প্রকল্প থেকে সরে আসতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানসমূহকে পুনর্বিন্যাস করে নবায়নযোগ্য শক্তিমুখী করতে হবে। নবায়নযোগ্য শক্তি প্রসারে ইডকল, বিভিন্ন দেশের, বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে। জনগণকে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করার জন্য নেট মিটারিং, ফিড-ইন-ট্যারিফ ও কার্বন ক্রেডিটের মতো প্রণোদনা দিতে হবে। সর্বোপরি জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উত্তরণের একটি সময়সূচি নির্ধারণ করতে হবে এবং বছরওয়ারি জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতা হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। এ জন্য বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য শক্তির সম্ভাবনাগুলোর একটি বাস্তবভিত্তিক প্রাক্কলন দাঁড় করাতে হবে এবং তার ভিত্তিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির পৃষ্ঠপোষক, ধারক ও বাহকদের রাহুমুক্ত হয়ে ওপরের কাজগুলো করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের স্বার্থেই তা করতে হবে।
টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) তৈরি ‘ন্যাশনাল সোলার এনার্জি রোডম্যাপ ২০২১-৪১’ অনুযায়ী, ২০৪১ সালের মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের সুবিধা সম্প্রসারণের মাধ্যমে ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে বাংলাদেশ। স্রেডার মতে, নদীতীরবর্তী এবং পরিত্যক্ত জমির যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে সৌরবিদ্যুতের সক্ষমতা ৩০ হাজার মেগাওয়াটেও উন্নীত করার বাস্তবতা রয়েছে। টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) ও ইউএনডিপির তত্ত্বাবধানে তৈরি ‘ন্যাশনাল সোলার এনার্জি রোডম্যাপ ২০২১-৪১’-এর মতে, জমির স্বল্পতা সত্ত্বেও সৌর বিদ্যুতায়নের মধ্যমানের কৌশলে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ২০ হাজার মেগাওয়াট সবুজ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।
অন্যদিকে নদী অববাহিকা উন্নয়নের ৫ শতাংশ ভূমি, শিল্পাঞ্চলের রুফটপসহ অপরাপর অব্যবহৃত ভূমি নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের সৌর মডেলে এই সক্ষমতা ৩০ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছানো সম্ভব। জ্বালানি আমদানির নির্ভরতা থেকে বেরোতে হলে সরকারকে ‘ন্যাশনাল সোলার এনার্জি রোডম্যাপ ২০২১-৪১’কে আলোতে আনতে হবে। এবং তা দুর্নীতিমুক্তভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। বিদ্যুতের মাস্টারপ্ল্যান পিএসএমপি-২০১৬-এর মতে, ২০২১ সালের মধ্যেই নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ মোট সক্ষমতার অন্তত ১০ শতাংশ হওয়ার কথা ছিল। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট এসডিজি-৭ মতে, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মোট ব্যবহৃত বিদ্যুতের ১২ শতাংশ নবায়নযোগ্য করার শর্ত আছে। বাংলাদেশ এলডিসি উত্তরণের প্রার্থী বিধায় নিম্নমধ্য আয়ের দেশের ব্যবহৃত বিদ্যুতের ১৭ শতাংশ নবায়নযোগ্য রাখার শর্তটাই মানা সুবিবেচনাপ্রসূত।
সৌরবিদ্যুতের প্রসঙ্গ উঠলেই জমির স্বল্পতার আলাপ উঠিয়ে আধুনিক বিশ্বের উদ্ভাবনী ইউজ কেইসগুলোকে গুরুত্বহীন করা হয়। বাংলাদেশের সৌর দীপনক্ষমতা বৈশ্বিক গড় মানের চেয়ে বেশ ভালো। ইএসএমএপি অনুসারে, দেশের বাৎসরিক ফটোভোল্টায়িক সৌরশক্তিমান ১ হাজার ৪০০ কিলোওয়াট পাওয়ারের বেশি। ভাসানচর, চরফ্যাশন, ভোলা, মনপুরা, বরিশাল, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোতে খরুচে সঞ্চালনের বিকল্প হিসেবে সৌর-বায়ুবিদ্যুতের সমন্বয়ে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন ও কমিউনিটি গ্রিডের টেকসই ও সাশ্রয়ী মডেল দ্বারা করানো সম্ভব। এ অঞ্চলে সৌর এবং বায়ুশক্তির পটেনশিয়াল দেশের অপরাপর অঞ্চলের চেয়ে ভালো প্রমাণিত। স্থানীয়ভাবে বিতরণকৃত বিকেন্দ্রীভূত সরবরাহের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত একটি জ্বালানিব্যবস্থা জলবায়ু পরিবর্তনের ঘনঘন ঝুঁকি ও ধাক্কার বিপরীতে অনেক বেশি অনুকূল এবং স্থিতিশীল।
সৌরবিদ্যুতের জমি সমস্যার বিষয়টি সত্য, তবে বিকল্প সমাধান আছে বিধায় সেগুলোকে কাজে লাগানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা অনুপস্থিত। সৌরশক্তির স্টোরেজ সক্ষমতা বাড়াতে মানসম্পন্ন সাশ্রয়ী স্থানীয় ব্যাটারি উৎপাদন ও আমদানি নিশ্চিত করা চাই, দরকার উচ্চমান ও সাশ্রয়ী সোলার-প্যানেল, কনভারটার ও ডিসি সামগ্রীর নিশ্চয়তা। ভবিষ্যতে মাঝারি ও বৃহৎ পরিসরের বিদ্যুৎ স্টোরেজ নিয়েও ভাবতে হবে। লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিই একমাত্র সৌর-স্টোরেজ বিকল্প নয়, আছে ফ্লো-ব্যাটারি, আয়ন-সল্ট-ওয়াটার ব্যাটারি, গ্রাভিটি স্টোরেজ ইত্যাদি। আছে ইলেকট্রোলাইসিসভিত্তিক হাইড্রোজেন সঞ্চয় ও পরিবহন বিকল্প।
সবুজ বিদ্যুৎ মিক্সে সৌর-বায়ু বর্জ্য হাইড্রোজেন জলবিদ্যুৎ ইত্যাদি কতটুকু থাকবে, তার আগাম রোডম্যাপ দরকার। ভবিষ্যৎ জ্বালানিনিরাপত্তার সমাধানে একদিকে মেধাবী ও দূরদর্শী, অন্যদিকে স্বচ্ছ সাশ্রয়ী এবং পরিবেশগত দায়বদ্ধ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন দরকার। বিদ্যুৎ বিতরণকারী ডেসা-ডেসকো-পল্লী বিদ্যুৎ এসব কোম্পানিকে সৌরবিদ্যুৎ বিক্রির অনুমতি ও অবকাঠামো সেবা দিতে হবে, বিপরীতে তারা কমিশন পাবে। ব্যক্তি নিজস্ব বিনিয়োগে উৎপাদিত সৌরবিদ্যুৎ স্টোর করবেন, অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিক্রি করবেন। এজন্য বিতরণব্যবস্থাকে স্মার্ট করতে হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চল ও দ্বীপ এলাকায় খরুচে সঞ্চালন প্রকল্পে বিদ্যুৎ না নিয়ে বরং সেখানে নবায়নযোগ্য সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনে অগ্রাধিকার ও প্রণোদনা দরকার। দরকার ব্যক্তি বিনিয়োগে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিক্রির উপযোগী কমিউনিটি গ্রিড। ক্ষুদ্র-মাঝারি সৌর বিনিয়োগের ব্যাংকঋণের মডেল দরকার, দরকার ব্যাটারি রিসাইকেল ব্যবস্থাকে পরিবেশবান্ধব করা। সবুজ বিদ্যুৎ বাড়লে, তেল-গ্যাসের চাহিদা কমে ডলার সাশ্রয়ও হবে। ভূমির স্বল্পতার বাংলাদেশে মানসম্পন্ন স্টোরেজসহ শহুরে ও গ্রামীণ ‘সোলার হোমের’ ব্যাপক বিকাশ দরকার।
কেউ কেউ হাইড্রোজেন জ্বালানির রোডম্যাপের কথা বলছে। বস্তুত হাইড্রোজেন বিদ্যুৎ উৎপাদন একদিকে খুব বেশি খরুচে, অন্যদিকে এ জন্য দরকার নতুন উৎপাদন, ট্রান্সপোর্টেশন, বিতরণ, এমনকি ব্যবহারেরও সম্পূর্ণ নতুন অবকাঠামো। উপজাত হিসেবে উৎপন্ন তাপীয় শক্তির ব্যবহারের সমন্বিত ইকোসিস্টেমও দরকার। ইকোসিস্টেম তৈরি না করলে বাংলাদেশের দুর্নীতিপ্রবণ খরচের মডেলে হাইড্রোজেন হয়ে উঠবে অসম্ভব অবাস্তব। মূলত হাইড্রোজেন জ্বালানি বাংলাদেশের বর্তমান জ্বালানিসংকটের সমাধান নয়, হ্যাঁ এটা ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা। বিশ্ব সৌর-বায়ু বিদ্যুতের পাশাপাশি হাইড্রোজেন জ্বালানিতে যাচ্ছে। মূলত, উদ্বৃত্ত অতিরিক্ত সবুজ বিদ্যুৎ ব্যবহার করেই হাইড্রোজেন তৈরি করা হচ্ছে।
জাতীয় কিংবা আঞ্চলিক গ্রিড চাহিদার অতিরিক্ত সৌরবিদ্যুৎ কিংবা বায়ুবিদ্যুৎ কিংবা বায়োমাসসহ অপরাপর নন-নিউক্লিয়ার সবুজ বিদ্যুৎ দিয়ে হাইড্রোজেন তৈরি হচ্ছে। সরবরাহকৃত সবুজ বিদ্যুতের তুলনায় চাহিদা কমÑ এসব ক্ষেত্রে দেশগুলো তাদের ব্যবহারের বাইরের অতিরিক্ত সবুজ বিদ্যুৎ দিয়ে ইলেকট্রোলাইসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পানি থেকে হাইড্রোজেন তৈরি করে, সেটা স্টোর করে, দরকারে ভিন্ন জায়গায় পরিবহন করে। জার্মানি এ প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত বিপুল তাপশক্তি অন্য কাজে ব্যবহার করে। দরকারমতো সময়ে ও স্থানে বিপরীত ইলেকট্রোলাইসিস প্রক্রিয়ায় পানির তৈরি মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন। অর্থাৎ প্রযুক্তির কৌশলে বিদ্যুৎকেও দেশ থেকে মহাদেশে পরিবহন সম্ভব। কিন্তু যেখানে সবুজ বিদ্যুৎ নেই, সেখানে বিদেশ থেকে হাইড্রোজেন আমদানি করেÑ সঞ্চালন, বিতরণ ও ব্যবহার অবকাঠামো তৈরির পর সেটা ব্যবহার করাটা দুর্নীতির খোয়াব হতে পারে। ইলেকট্রোলাইসিস পুরনো প্রযুক্তি।
কিন্তু এতে উৎপাদিত বিদ্যুতের দামের তুলনায় অনেক বেশি খরচ হয় বলে প্রযুক্তিটি বাণিজ্যিকভাবে বিকশিত হয়নি। তবে যেহেতু সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ ল্যান্ডফিল বা বায়োমাস জাত বিদ্যুৎ সস্তা হয়ে আসছে, তাই হাইড্রোজেন জ্বালানির ধারাও বিকশিত হচ্ছে। হাইড্রোজেন জ্বালানির ‘এনার্জি ইকোসিস্টেম’ শুধু বিদ্যুতে সীমাবদ্ধ নয়। উপজাত তাপশক্তির ব্যবহার এবং নবায়নযোগ্য হাইড্রোজেনের সাপ্লাই চেইনগুলোকেও এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। যেমনÑ নবায়নযোগ্য হাইড্রোজেন ও অ্যামোনিয়া শিল্প। ইউরোপীয় দেশগুলোতে বিপুল পরিমাণ বায়ুবিদ্যুতের উদ্বৃত্ত আছে, পশ্চিম আফ্রিকা মধ্যপ্রাচ্যে, যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল সৌরবিদ্যুতের উদ্বৃত্ত রয়েছে। বায়োমাস পটেনশিয়ালও রয়েছে। উদ্বৃত্ত সবুজ বিদ্যুৎ দিয়েই আগামীদিনে হাইড্রোজেন জ্বালানির রোডম্যাপ তৈরি হচ্ছে। যেহেতু বাংলাদেশের সবুজ বিদ্যুৎ উৎপাদনের হার, মোট জাতীয় উৎপাদনের মাত্র ৪ শতাংশ সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে হাইড্রোজেন জ্বালানি আমদানিভিত্তিক কোনো রোডম্যাপ আদৌ বাণিজ্যিকভাবে ফিজিবল কিনা সেটা একটা প্রশ্ন। জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতায় জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প খুঁজতে হবে। বিশ্বের বড় দেশগুলো সেটিই করছে।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]
রেজাউল করিম খোকন
মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৪
বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তির অমিত সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু কীভাবে এটাকে কাজে লাগানো সম্ভব? নবায়নযোগ্য শক্তিই আদিকাল থেকে ব্যবহৃত জ্বালানি এবং মূল জ্বালানি। বরং জীবাশ্ম জ্বালানি ক্ষণিকের ও বিকল্প জ্বালানি। বিশ্বব্যাপী ও দেশে জীবাশ্ম জ্বালানি ফুরিয়ে যাচ্ছে। সবুজ ও জলবায়ু সহিষ্ণুতাকে আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনার কেন্দ্রে স্থান দিতে হবে।
কয়লা ও এলএনজি আমদানি হ্রাস করতে হবে এবং এসব জ্বালানিভিত্তিক প্রকল্প থেকে সরে আসতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানসমূহকে পুনর্বিন্যাস করে নবায়নযোগ্য শক্তিমুখী করতে হবে। নবায়নযোগ্য শক্তি প্রসারে ইডকল, বিভিন্ন দেশের, বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে। জনগণকে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করার জন্য নেট মিটারিং, ফিড-ইন-ট্যারিফ ও কার্বন ক্রেডিটের মতো প্রণোদনা দিতে হবে। সর্বোপরি জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উত্তরণের একটি সময়সূচি নির্ধারণ করতে হবে এবং বছরওয়ারি জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতা হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। এ জন্য বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য শক্তির সম্ভাবনাগুলোর একটি বাস্তবভিত্তিক প্রাক্কলন দাঁড় করাতে হবে এবং তার ভিত্তিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির পৃষ্ঠপোষক, ধারক ও বাহকদের রাহুমুক্ত হয়ে ওপরের কাজগুলো করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের স্বার্থেই তা করতে হবে।
টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) তৈরি ‘ন্যাশনাল সোলার এনার্জি রোডম্যাপ ২০২১-৪১’ অনুযায়ী, ২০৪১ সালের মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের সুবিধা সম্প্রসারণের মাধ্যমে ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে বাংলাদেশ। স্রেডার মতে, নদীতীরবর্তী এবং পরিত্যক্ত জমির যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে সৌরবিদ্যুতের সক্ষমতা ৩০ হাজার মেগাওয়াটেও উন্নীত করার বাস্তবতা রয়েছে। টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) ও ইউএনডিপির তত্ত্বাবধানে তৈরি ‘ন্যাশনাল সোলার এনার্জি রোডম্যাপ ২০২১-৪১’-এর মতে, জমির স্বল্পতা সত্ত্বেও সৌর বিদ্যুতায়নের মধ্যমানের কৌশলে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ২০ হাজার মেগাওয়াট সবুজ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।
অন্যদিকে নদী অববাহিকা উন্নয়নের ৫ শতাংশ ভূমি, শিল্পাঞ্চলের রুফটপসহ অপরাপর অব্যবহৃত ভূমি নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের সৌর মডেলে এই সক্ষমতা ৩০ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছানো সম্ভব। জ্বালানি আমদানির নির্ভরতা থেকে বেরোতে হলে সরকারকে ‘ন্যাশনাল সোলার এনার্জি রোডম্যাপ ২০২১-৪১’কে আলোতে আনতে হবে। এবং তা দুর্নীতিমুক্তভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। বিদ্যুতের মাস্টারপ্ল্যান পিএসএমপি-২০১৬-এর মতে, ২০২১ সালের মধ্যেই নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ মোট সক্ষমতার অন্তত ১০ শতাংশ হওয়ার কথা ছিল। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট এসডিজি-৭ মতে, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মোট ব্যবহৃত বিদ্যুতের ১২ শতাংশ নবায়নযোগ্য করার শর্ত আছে। বাংলাদেশ এলডিসি উত্তরণের প্রার্থী বিধায় নিম্নমধ্য আয়ের দেশের ব্যবহৃত বিদ্যুতের ১৭ শতাংশ নবায়নযোগ্য রাখার শর্তটাই মানা সুবিবেচনাপ্রসূত।
সৌরবিদ্যুতের প্রসঙ্গ উঠলেই জমির স্বল্পতার আলাপ উঠিয়ে আধুনিক বিশ্বের উদ্ভাবনী ইউজ কেইসগুলোকে গুরুত্বহীন করা হয়। বাংলাদেশের সৌর দীপনক্ষমতা বৈশ্বিক গড় মানের চেয়ে বেশ ভালো। ইএসএমএপি অনুসারে, দেশের বাৎসরিক ফটোভোল্টায়িক সৌরশক্তিমান ১ হাজার ৪০০ কিলোওয়াট পাওয়ারের বেশি। ভাসানচর, চরফ্যাশন, ভোলা, মনপুরা, বরিশাল, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোতে খরুচে সঞ্চালনের বিকল্প হিসেবে সৌর-বায়ুবিদ্যুতের সমন্বয়ে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন ও কমিউনিটি গ্রিডের টেকসই ও সাশ্রয়ী মডেল দ্বারা করানো সম্ভব। এ অঞ্চলে সৌর এবং বায়ুশক্তির পটেনশিয়াল দেশের অপরাপর অঞ্চলের চেয়ে ভালো প্রমাণিত। স্থানীয়ভাবে বিতরণকৃত বিকেন্দ্রীভূত সরবরাহের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত একটি জ্বালানিব্যবস্থা জলবায়ু পরিবর্তনের ঘনঘন ঝুঁকি ও ধাক্কার বিপরীতে অনেক বেশি অনুকূল এবং স্থিতিশীল।
সৌরবিদ্যুতের জমি সমস্যার বিষয়টি সত্য, তবে বিকল্প সমাধান আছে বিধায় সেগুলোকে কাজে লাগানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা অনুপস্থিত। সৌরশক্তির স্টোরেজ সক্ষমতা বাড়াতে মানসম্পন্ন সাশ্রয়ী স্থানীয় ব্যাটারি উৎপাদন ও আমদানি নিশ্চিত করা চাই, দরকার উচ্চমান ও সাশ্রয়ী সোলার-প্যানেল, কনভারটার ও ডিসি সামগ্রীর নিশ্চয়তা। ভবিষ্যতে মাঝারি ও বৃহৎ পরিসরের বিদ্যুৎ স্টোরেজ নিয়েও ভাবতে হবে। লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিই একমাত্র সৌর-স্টোরেজ বিকল্প নয়, আছে ফ্লো-ব্যাটারি, আয়ন-সল্ট-ওয়াটার ব্যাটারি, গ্রাভিটি স্টোরেজ ইত্যাদি। আছে ইলেকট্রোলাইসিসভিত্তিক হাইড্রোজেন সঞ্চয় ও পরিবহন বিকল্প।
সবুজ বিদ্যুৎ মিক্সে সৌর-বায়ু বর্জ্য হাইড্রোজেন জলবিদ্যুৎ ইত্যাদি কতটুকু থাকবে, তার আগাম রোডম্যাপ দরকার। ভবিষ্যৎ জ্বালানিনিরাপত্তার সমাধানে একদিকে মেধাবী ও দূরদর্শী, অন্যদিকে স্বচ্ছ সাশ্রয়ী এবং পরিবেশগত দায়বদ্ধ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন দরকার। বিদ্যুৎ বিতরণকারী ডেসা-ডেসকো-পল্লী বিদ্যুৎ এসব কোম্পানিকে সৌরবিদ্যুৎ বিক্রির অনুমতি ও অবকাঠামো সেবা দিতে হবে, বিপরীতে তারা কমিশন পাবে। ব্যক্তি নিজস্ব বিনিয়োগে উৎপাদিত সৌরবিদ্যুৎ স্টোর করবেন, অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিক্রি করবেন। এজন্য বিতরণব্যবস্থাকে স্মার্ট করতে হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চল ও দ্বীপ এলাকায় খরুচে সঞ্চালন প্রকল্পে বিদ্যুৎ না নিয়ে বরং সেখানে নবায়নযোগ্য সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনে অগ্রাধিকার ও প্রণোদনা দরকার। দরকার ব্যক্তি বিনিয়োগে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিক্রির উপযোগী কমিউনিটি গ্রিড। ক্ষুদ্র-মাঝারি সৌর বিনিয়োগের ব্যাংকঋণের মডেল দরকার, দরকার ব্যাটারি রিসাইকেল ব্যবস্থাকে পরিবেশবান্ধব করা। সবুজ বিদ্যুৎ বাড়লে, তেল-গ্যাসের চাহিদা কমে ডলার সাশ্রয়ও হবে। ভূমির স্বল্পতার বাংলাদেশে মানসম্পন্ন স্টোরেজসহ শহুরে ও গ্রামীণ ‘সোলার হোমের’ ব্যাপক বিকাশ দরকার।
কেউ কেউ হাইড্রোজেন জ্বালানির রোডম্যাপের কথা বলছে। বস্তুত হাইড্রোজেন বিদ্যুৎ উৎপাদন একদিকে খুব বেশি খরুচে, অন্যদিকে এ জন্য দরকার নতুন উৎপাদন, ট্রান্সপোর্টেশন, বিতরণ, এমনকি ব্যবহারেরও সম্পূর্ণ নতুন অবকাঠামো। উপজাত হিসেবে উৎপন্ন তাপীয় শক্তির ব্যবহারের সমন্বিত ইকোসিস্টেমও দরকার। ইকোসিস্টেম তৈরি না করলে বাংলাদেশের দুর্নীতিপ্রবণ খরচের মডেলে হাইড্রোজেন হয়ে উঠবে অসম্ভব অবাস্তব। মূলত হাইড্রোজেন জ্বালানি বাংলাদেশের বর্তমান জ্বালানিসংকটের সমাধান নয়, হ্যাঁ এটা ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা। বিশ্ব সৌর-বায়ু বিদ্যুতের পাশাপাশি হাইড্রোজেন জ্বালানিতে যাচ্ছে। মূলত, উদ্বৃত্ত অতিরিক্ত সবুজ বিদ্যুৎ ব্যবহার করেই হাইড্রোজেন তৈরি করা হচ্ছে।
জাতীয় কিংবা আঞ্চলিক গ্রিড চাহিদার অতিরিক্ত সৌরবিদ্যুৎ কিংবা বায়ুবিদ্যুৎ কিংবা বায়োমাসসহ অপরাপর নন-নিউক্লিয়ার সবুজ বিদ্যুৎ দিয়ে হাইড্রোজেন তৈরি হচ্ছে। সরবরাহকৃত সবুজ বিদ্যুতের তুলনায় চাহিদা কমÑ এসব ক্ষেত্রে দেশগুলো তাদের ব্যবহারের বাইরের অতিরিক্ত সবুজ বিদ্যুৎ দিয়ে ইলেকট্রোলাইসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পানি থেকে হাইড্রোজেন তৈরি করে, সেটা স্টোর করে, দরকারে ভিন্ন জায়গায় পরিবহন করে। জার্মানি এ প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত বিপুল তাপশক্তি অন্য কাজে ব্যবহার করে। দরকারমতো সময়ে ও স্থানে বিপরীত ইলেকট্রোলাইসিস প্রক্রিয়ায় পানির তৈরি মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন। অর্থাৎ প্রযুক্তির কৌশলে বিদ্যুৎকেও দেশ থেকে মহাদেশে পরিবহন সম্ভব। কিন্তু যেখানে সবুজ বিদ্যুৎ নেই, সেখানে বিদেশ থেকে হাইড্রোজেন আমদানি করেÑ সঞ্চালন, বিতরণ ও ব্যবহার অবকাঠামো তৈরির পর সেটা ব্যবহার করাটা দুর্নীতির খোয়াব হতে পারে। ইলেকট্রোলাইসিস পুরনো প্রযুক্তি।
কিন্তু এতে উৎপাদিত বিদ্যুতের দামের তুলনায় অনেক বেশি খরচ হয় বলে প্রযুক্তিটি বাণিজ্যিকভাবে বিকশিত হয়নি। তবে যেহেতু সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ ল্যান্ডফিল বা বায়োমাস জাত বিদ্যুৎ সস্তা হয়ে আসছে, তাই হাইড্রোজেন জ্বালানির ধারাও বিকশিত হচ্ছে। হাইড্রোজেন জ্বালানির ‘এনার্জি ইকোসিস্টেম’ শুধু বিদ্যুতে সীমাবদ্ধ নয়। উপজাত তাপশক্তির ব্যবহার এবং নবায়নযোগ্য হাইড্রোজেনের সাপ্লাই চেইনগুলোকেও এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। যেমনÑ নবায়নযোগ্য হাইড্রোজেন ও অ্যামোনিয়া শিল্প। ইউরোপীয় দেশগুলোতে বিপুল পরিমাণ বায়ুবিদ্যুতের উদ্বৃত্ত আছে, পশ্চিম আফ্রিকা মধ্যপ্রাচ্যে, যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল সৌরবিদ্যুতের উদ্বৃত্ত রয়েছে। বায়োমাস পটেনশিয়ালও রয়েছে। উদ্বৃত্ত সবুজ বিদ্যুৎ দিয়েই আগামীদিনে হাইড্রোজেন জ্বালানির রোডম্যাপ তৈরি হচ্ছে। যেহেতু বাংলাদেশের সবুজ বিদ্যুৎ উৎপাদনের হার, মোট জাতীয় উৎপাদনের মাত্র ৪ শতাংশ সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে হাইড্রোজেন জ্বালানি আমদানিভিত্তিক কোনো রোডম্যাপ আদৌ বাণিজ্যিকভাবে ফিজিবল কিনা সেটা একটা প্রশ্ন। জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতায় জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প খুঁজতে হবে। বিশ্বের বড় দেশগুলো সেটিই করছে।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]