মৃদুল কান্তি ধর
পোশাক শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, যা বর্তমানে ক্রমবর্ধমান সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং যার প্রভাব হতে পারে সুদূরপ্রসারী। অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং বাহ্যিক প্রভাব একত্রিত হয়ে শিল্পটিকে ক্রমান্বয়ে একটি আশঙ্কাজনক অবস্থানে ফেলেছে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের অস্থিরতা ভিয়েতনাম এবং ভারতের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য সুযোগ তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশের অথনৈতিক আয়ের প্রধান এই সেক্টরটিকে রক্ষা করতে এখন থেকেই জরুরি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। বিশাল বাজার, সস্তা শ্রম এবং সুবিধাজনক বাণিজ্য চুক্তির কারণে বহু বছর ধরে বৈশ্বিক পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান রয়েছে। বর্তমানে রেডিমেড গার্মেন্ট (আরএমজি) সেক্টরে দেশের প্রায় ৪.৫ মিলিয়ন লোক নিযুক্ত রয়েছে এবং দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০% এর বেশি আয়ের উৎস এই পোশাক শিল্প (সূত্র: রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো)। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী রপ্তানি আদেশ হ্রাস, শ্রম অসন্তোষ বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক গতিশীলতার পরিবর্তনের একটি হতাশাজনক চিত্র উপস্থাপিত হচ্ছে যা দেশের এই শিল্পে আধিপত্যের মর্যাদাকে বিপন্ন করছে। সম্প্রতি ইকোনমিক টাইমস দাবি করেছে যে, সেপ্টেম্বরে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ ভারতের থেকে পিছিয়ে পড়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে বৈশ্বিক পোশাক বাজারে ভারতে পোশাক রপ্তানি ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে থেকে ১৭.৩% বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের এই ক্রয় আদেশ বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশে পোশাক শিল্পে সাম্প্রতিক অস্থিরতা মূলত দায়ী। গ্রাহকরা সর্বদাই নির্ভরযোগ্য একই সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহকারীর সন্ধান করেন। গত কয়েক মাস ধরে চলমান দেশের এই সেক্টরে অস্থিরতার সুযোগ নিচ্ছেন ভারতীয় ও ভিয়েতনামের উৎপাদকরা ফলে গত সেপ্টেম্বরে ইইউতে বাংলাদেশের রপ্তানি কমেছে ৩.৫৩%।
সংকটের জন্য দায়ী ফ্যাক্টর সমূহ : সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বারবার শ্রমিক বিক্ষোভ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার দ্বারা বেষ্টিত হয়েছে। জানা গেছে, চলমান অস্থিরতার ফলে বাংলাদেশ এই খাত থেকে ইতোমধ্যেই ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রাজস্ব হারিয়েছে। ঘন ঘন ধর্মঘট এবং মজুরি দাবির কারণে উৎপাদন বিলম্ব একটি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার কারণে ক্রেতারা অন্য দেশের নির্ভরযোগ্য এবং ধারাবাহিক সরবরাহকারীদের কাছে স্থানান্তরিত হওয়ার দিকে ঝুঁকছে। ফলে বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে নতুন চুক্তির জন্য আলোচনা কঠিন হয়ে উঠেছে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে।
প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি : বাংলাদেশের অস্থিরতার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে এশিয়ার অন্য দেশগুলো। গত মাসে দ্য ইকোনমিক টাইমস-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুসারে ভারতীয় পোশাক রপ্তানিকারকদের রপ্তানি আদেশ ১০-২০% বৃদ্ধি পেয়েছে। উপরন্তু বৈশ্বিক চাহিদা অধিকতর বৈচিত্র্যময় এবং উচ্চ মূল্যের পোশাকের দিকে ক্রমশ ঝুঁকে যাওয়ার ফলে বাংলাদেশের স্বল্পমূল্যের পোশাকের অবস্থান সংবেদনশীল করে তুলেছে। অক্টোবরে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, ভিয়েতনাম এবং ভারত নিজেদের উচ্চমানের পোশাক উৎপাদনকারী হিসেবে অবস্থান করার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাজারে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে।
অর্থনৈতিক চাপ এবং মুদ্রাস্ফীতি : বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি এবং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। পোশাক রপ্তানিকারক দেশগুলোতে, বিশেষ করে ইউরোপের ভোক্তারা তাদের ফ্যাশন ব্যয় হ্রাস করার ফলে বাংলাদেশি পোশাকের চাহিদা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ইইউ্#৩৯;র মোট আমদানি ৬১.৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ৫৯.৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমেছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পোশাক আমদানিতে ৩.৬৩% হ্রাসের ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি ৩.৫৩% কমেছে। মুদ্রাস্ফীতির কারণে স্থানীয় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এ দেশের উৎপাদকদের জন্য তাদের দাম প্রতিযোগিতামূলক রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।
গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনে পরিবর্তন :
বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ব্যবস্থায় করোনা মহামারী-সম্পর্কিত বাধার ফলে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা এখন বিকল্প শক্তিশালী সরবরাহ চ্যানেলের সন্ধান করছে। গত মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দ্য ইকোনমিক টাইমস দাবি করেছে যে বাংলাদেশে পোশাক শিল্পে অস্থিরতা অব্যাহত থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক বাজারে ভারত এই খাতে গতি পেয়েছে। ভারতের টেক্সটাইল শিল্প ২০৩০ সালের মধ্যে ৩৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৃদ্ধি পাবে এবং ৩.৫ কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গ্রাহকরা তাদের সোর্সিং প্রসারিত করার কারণে বাংলাদেশ পছন্দের শীর্ষ একটি সরবরাহকারী হিসেবে তার মর্যাদা হারাতে পারে। সম্ভাব্য পরিণতি পোশাক শিল্পে এই অস্থিরতা বাংলাদেশের জন্য গুরুতর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলতে পারে। গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত স্বল্প আয়ের লাখ লাখ শ্রমিকের অনেকেই নারী। একটি বর্ধিত শিল্প মন্দার ফলে অধিকসংখ্যক শ্রমিকের চাকরি হারানোর আশঙ্কা থাকে যা সামাজিক অস্থিরতা বাড়িয়ে তুলতে পারে। অধিকন্তু, পোশাক রপ্তানি কমে যাওয়ার কারণে দুর্বল হতে পারে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ব্যাহত করবে। ক্রমাগত অস্থিতিশীলতা এই খাতে আন্তর্জাতিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের একটি উল্লেখযোগ্য উৎস নতুন বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করতে পারে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের চ্যালেঞ্জগুলো বিশ্বব্যাপী পোশাক বাজারের জন্য একটি সতর্কতা হিসেবে দেখা উচিত। বাংলাদেশের মতো প্রথাগত স্বল্প মূল্যের সরবরাহকারীদের অবশ্যই এই অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে নতুবা প্রতিযোগিতামূলক বাজারে পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকিতে পড়তে হবে কারণ সরবরাহ চেইনগুলো ধারাবাহিকভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে একই সঙ্গে পোশাক উৎপাদন সম্পর্কে নৈতিক ও পরিবেশ সচেতনা গ্রাহকদের মাঝে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের বর্তমান অস্থিরতা ভিয়েতনাম এবং ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোকে সল্প মেয়াদে উপকৃত করলেও এটি বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলে গুরুতর ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, যা বিশ্বব্যাপী পোশাকের দাম এবং প্রাপ্যতাকে প্রভাবিত করবে। তাই বৈশ্বিক পোশাক বাজারে ভারসাম্য বজায় রাখা একাই সঙ্গে বাংলাদেশের সর্বোত্তম স্বার্থের জন্য দেশে পোশাক শিল্পের অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলোর সমাধান গুরুত্বপূর্ণ। পোশাক শিল্পের নিম্নমুখী প্রবণতা ঠেকাতে বাংলাদেশকে অবশ্যই এই খাতকে স্থিতিশীল করতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, কোম্পানি এবং কর্মচারীদের মধ্যে ফলপ্রসূ আলোচনা প্রয়োজন। ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা এবং কর্ম পরিবেশের উন্নতি এই খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং উৎপাদন ব্যাঘাত কমাতে সহায়তা করবে। দ্বিতীয়ত, মান শৃঙ্খলকে (ভ্যালু চেইন) এগিয়ে নিতে দেশকে তার পণ্যের অফারকে অধিকতর বৈচিত্র্যময় করতে হবে। প্রযুক্তি এবং প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ দেশটিকে স্বল্প মূল্যের মৌলিক পোশাক প্রস্তুতকারক থেকে উচ্চ মূল্যের আইটেমগুলোর প্রতিযোগিতামূলক প্রস্তুতকারক হতে সাহায্য করতে পারে। এটি বৈশ্বিক চাহিদার পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে এবং এই শিল্পে বাংলাদেশকে আরও টেকসই ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
তৃতীয়ত, সরকারি সহায়তা বৃদ্ধি করতে হবে। আন্ত র্জাতিক ক্রেতাদের বাংলাদেশ থেকে সোর্সিং রাখতে উৎসাহিত করার জন্য সরকারকে অবশ্যই রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল করার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাণিজ্য নীতির পুনর্মূল্যায়ন আন্তর্জাতিক বাজার ও ব্র্যান্ডের প্রতি বাংলাদেশের আবেদন বাড়াবে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে বর্তমান সংকট কীভাবে মোকাবিলা করবে তার ওপর। বর্তমানে এই সেক্টর একটি টার্নিং পয়েন্টে রয়েছে। এই শিল্পকে দীর্ঘস্থায়ী পতনের সম্মুখীন হওয়া থেকে রোধ করতে এবং লাখ লাখ মানুষের জীবিকা সুরক্ষার জন্য অবিলম্বে মধ্যস্থতামূলক সংস্কার এবং কৌশলগত পরিবর্তন প্রয়োজন।
[লেখক : একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে কাস্টমার সার্ভিস এক্সিকিউটিভ হিসেবে কর্মরত]
মৃদুল কান্তি ধর
শনিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৪
পোশাক শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, যা বর্তমানে ক্রমবর্ধমান সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং যার প্রভাব হতে পারে সুদূরপ্রসারী। অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং বাহ্যিক প্রভাব একত্রিত হয়ে শিল্পটিকে ক্রমান্বয়ে একটি আশঙ্কাজনক অবস্থানে ফেলেছে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের অস্থিরতা ভিয়েতনাম এবং ভারতের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য সুযোগ তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশের অথনৈতিক আয়ের প্রধান এই সেক্টরটিকে রক্ষা করতে এখন থেকেই জরুরি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। বিশাল বাজার, সস্তা শ্রম এবং সুবিধাজনক বাণিজ্য চুক্তির কারণে বহু বছর ধরে বৈশ্বিক পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান রয়েছে। বর্তমানে রেডিমেড গার্মেন্ট (আরএমজি) সেক্টরে দেশের প্রায় ৪.৫ মিলিয়ন লোক নিযুক্ত রয়েছে এবং দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০% এর বেশি আয়ের উৎস এই পোশাক শিল্প (সূত্র: রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো)। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী রপ্তানি আদেশ হ্রাস, শ্রম অসন্তোষ বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক গতিশীলতার পরিবর্তনের একটি হতাশাজনক চিত্র উপস্থাপিত হচ্ছে যা দেশের এই শিল্পে আধিপত্যের মর্যাদাকে বিপন্ন করছে। সম্প্রতি ইকোনমিক টাইমস দাবি করেছে যে, সেপ্টেম্বরে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ ভারতের থেকে পিছিয়ে পড়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে বৈশ্বিক পোশাক বাজারে ভারতে পোশাক রপ্তানি ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে থেকে ১৭.৩% বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের এই ক্রয় আদেশ বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশে পোশাক শিল্পে সাম্প্রতিক অস্থিরতা মূলত দায়ী। গ্রাহকরা সর্বদাই নির্ভরযোগ্য একই সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহকারীর সন্ধান করেন। গত কয়েক মাস ধরে চলমান দেশের এই সেক্টরে অস্থিরতার সুযোগ নিচ্ছেন ভারতীয় ও ভিয়েতনামের উৎপাদকরা ফলে গত সেপ্টেম্বরে ইইউতে বাংলাদেশের রপ্তানি কমেছে ৩.৫৩%।
সংকটের জন্য দায়ী ফ্যাক্টর সমূহ : সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বারবার শ্রমিক বিক্ষোভ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার দ্বারা বেষ্টিত হয়েছে। জানা গেছে, চলমান অস্থিরতার ফলে বাংলাদেশ এই খাত থেকে ইতোমধ্যেই ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রাজস্ব হারিয়েছে। ঘন ঘন ধর্মঘট এবং মজুরি দাবির কারণে উৎপাদন বিলম্ব একটি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার কারণে ক্রেতারা অন্য দেশের নির্ভরযোগ্য এবং ধারাবাহিক সরবরাহকারীদের কাছে স্থানান্তরিত হওয়ার দিকে ঝুঁকছে। ফলে বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে নতুন চুক্তির জন্য আলোচনা কঠিন হয়ে উঠেছে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে।
প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি : বাংলাদেশের অস্থিরতার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে এশিয়ার অন্য দেশগুলো। গত মাসে দ্য ইকোনমিক টাইমস-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুসারে ভারতীয় পোশাক রপ্তানিকারকদের রপ্তানি আদেশ ১০-২০% বৃদ্ধি পেয়েছে। উপরন্তু বৈশ্বিক চাহিদা অধিকতর বৈচিত্র্যময় এবং উচ্চ মূল্যের পোশাকের দিকে ক্রমশ ঝুঁকে যাওয়ার ফলে বাংলাদেশের স্বল্পমূল্যের পোশাকের অবস্থান সংবেদনশীল করে তুলেছে। অক্টোবরে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, ভিয়েতনাম এবং ভারত নিজেদের উচ্চমানের পোশাক উৎপাদনকারী হিসেবে অবস্থান করার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাজারে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে।
অর্থনৈতিক চাপ এবং মুদ্রাস্ফীতি : বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি এবং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। পোশাক রপ্তানিকারক দেশগুলোতে, বিশেষ করে ইউরোপের ভোক্তারা তাদের ফ্যাশন ব্যয় হ্রাস করার ফলে বাংলাদেশি পোশাকের চাহিদা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ইইউ্#৩৯;র মোট আমদানি ৬১.৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ৫৯.৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমেছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পোশাক আমদানিতে ৩.৬৩% হ্রাসের ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি ৩.৫৩% কমেছে। মুদ্রাস্ফীতির কারণে স্থানীয় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এ দেশের উৎপাদকদের জন্য তাদের দাম প্রতিযোগিতামূলক রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।
গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনে পরিবর্তন :
বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ব্যবস্থায় করোনা মহামারী-সম্পর্কিত বাধার ফলে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা এখন বিকল্প শক্তিশালী সরবরাহ চ্যানেলের সন্ধান করছে। গত মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দ্য ইকোনমিক টাইমস দাবি করেছে যে বাংলাদেশে পোশাক শিল্পে অস্থিরতা অব্যাহত থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক বাজারে ভারত এই খাতে গতি পেয়েছে। ভারতের টেক্সটাইল শিল্প ২০৩০ সালের মধ্যে ৩৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৃদ্ধি পাবে এবং ৩.৫ কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গ্রাহকরা তাদের সোর্সিং প্রসারিত করার কারণে বাংলাদেশ পছন্দের শীর্ষ একটি সরবরাহকারী হিসেবে তার মর্যাদা হারাতে পারে। সম্ভাব্য পরিণতি পোশাক শিল্পে এই অস্থিরতা বাংলাদেশের জন্য গুরুতর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলতে পারে। গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত স্বল্প আয়ের লাখ লাখ শ্রমিকের অনেকেই নারী। একটি বর্ধিত শিল্প মন্দার ফলে অধিকসংখ্যক শ্রমিকের চাকরি হারানোর আশঙ্কা থাকে যা সামাজিক অস্থিরতা বাড়িয়ে তুলতে পারে। অধিকন্তু, পোশাক রপ্তানি কমে যাওয়ার কারণে দুর্বল হতে পারে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ব্যাহত করবে। ক্রমাগত অস্থিতিশীলতা এই খাতে আন্তর্জাতিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের একটি উল্লেখযোগ্য উৎস নতুন বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করতে পারে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের চ্যালেঞ্জগুলো বিশ্বব্যাপী পোশাক বাজারের জন্য একটি সতর্কতা হিসেবে দেখা উচিত। বাংলাদেশের মতো প্রথাগত স্বল্প মূল্যের সরবরাহকারীদের অবশ্যই এই অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে নতুবা প্রতিযোগিতামূলক বাজারে পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকিতে পড়তে হবে কারণ সরবরাহ চেইনগুলো ধারাবাহিকভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে একই সঙ্গে পোশাক উৎপাদন সম্পর্কে নৈতিক ও পরিবেশ সচেতনা গ্রাহকদের মাঝে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের বর্তমান অস্থিরতা ভিয়েতনাম এবং ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোকে সল্প মেয়াদে উপকৃত করলেও এটি বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলে গুরুতর ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, যা বিশ্বব্যাপী পোশাকের দাম এবং প্রাপ্যতাকে প্রভাবিত করবে। তাই বৈশ্বিক পোশাক বাজারে ভারসাম্য বজায় রাখা একাই সঙ্গে বাংলাদেশের সর্বোত্তম স্বার্থের জন্য দেশে পোশাক শিল্পের অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলোর সমাধান গুরুত্বপূর্ণ। পোশাক শিল্পের নিম্নমুখী প্রবণতা ঠেকাতে বাংলাদেশকে অবশ্যই এই খাতকে স্থিতিশীল করতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, কোম্পানি এবং কর্মচারীদের মধ্যে ফলপ্রসূ আলোচনা প্রয়োজন। ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা এবং কর্ম পরিবেশের উন্নতি এই খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং উৎপাদন ব্যাঘাত কমাতে সহায়তা করবে। দ্বিতীয়ত, মান শৃঙ্খলকে (ভ্যালু চেইন) এগিয়ে নিতে দেশকে তার পণ্যের অফারকে অধিকতর বৈচিত্র্যময় করতে হবে। প্রযুক্তি এবং প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ দেশটিকে স্বল্প মূল্যের মৌলিক পোশাক প্রস্তুতকারক থেকে উচ্চ মূল্যের আইটেমগুলোর প্রতিযোগিতামূলক প্রস্তুতকারক হতে সাহায্য করতে পারে। এটি বৈশ্বিক চাহিদার পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে এবং এই শিল্পে বাংলাদেশকে আরও টেকসই ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
তৃতীয়ত, সরকারি সহায়তা বৃদ্ধি করতে হবে। আন্ত র্জাতিক ক্রেতাদের বাংলাদেশ থেকে সোর্সিং রাখতে উৎসাহিত করার জন্য সরকারকে অবশ্যই রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল করার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাণিজ্য নীতির পুনর্মূল্যায়ন আন্তর্জাতিক বাজার ও ব্র্যান্ডের প্রতি বাংলাদেশের আবেদন বাড়াবে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে বর্তমান সংকট কীভাবে মোকাবিলা করবে তার ওপর। বর্তমানে এই সেক্টর একটি টার্নিং পয়েন্টে রয়েছে। এই শিল্পকে দীর্ঘস্থায়ী পতনের সম্মুখীন হওয়া থেকে রোধ করতে এবং লাখ লাখ মানুষের জীবিকা সুরক্ষার জন্য অবিলম্বে মধ্যস্থতামূলক সংস্কার এবং কৌশলগত পরিবর্তন প্রয়োজন।
[লেখক : একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে কাস্টমার সার্ভিস এক্সিকিউটিভ হিসেবে কর্মরত]