বাবুল রবিদাস
অবহেলিত শোষিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের পক্ষে যে কজন মহামানব ইতোপূর্বে বাণী দিয়েছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ‘লালন ফকির।’ তখনকার সমসাময়িক সমাজ ছিল জাত-পাত আর শ্রেণীবৈষম্যের করাল আঘাতে জর্জরিত। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, দাম্ভিক, বর্ণবৈষম্য, অস্পৃশ্য, অপবিত্র বলে মনে করত। এ সমস্যা এতই প্রকট ছিল যে, এক গোত্রের মানুষ অন্য গোত্রের মানুষের ছায়া মাড়ালে ব্রাহ্মণরা অপবিত্র হয়ে যেত। ফলে সামজে উঁচু-নিচু প্রথার সৃষ্টি হয়েছিল। সমাজ কর্তৃক আরওপিত মানুষের শ্রেণীবিভাজন বা অস্পৃশ্যতাকে ‘লালন ফকির’ কখনোই স্বীকার করেননি, বরং বর্ণবৈষম্য, অস্পৃশ্য, ভেদাভেদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। ব্রাহ্মণ কর্তৃক রচিত স্বার্থান্বেষী মহলের বিভাজিত ও বিখ-িত সমাজের শ্রেণীবিন্যাস বা শ্রেণীবৈষম্যকে অস্বীকার করে ‘লালন ফকির’ তাঁর গানে বলেনÑ ‘জাত গেল, জাত গেল বলে একি আজব কারখানা,/ সত্য পথে কেউ নয় রাজি সবি দেখি তা না না না।’
মানুষের বিভাজন সমাজের অজ্ঞতার ফসল। সব মানুষকে তো একজনই সৃষ্টি করেছেন। তাহলে মানুষ পৃথক করার কে? গ্রন্থের দোহাই দিয়ে ছত্রিশ জাতিতে প্রবর্তন করা হয়েছে তা মূলত অপব্যাখ্যার ফসল। হিন্দু সমাজে পেশাভিত্তিতে নানা বিভাজন তৈরি করা হয়েছে। মানুষে মানুষে বিশ্বাসের বৈষম্য কথা সঠিক নয়। সব মানুষই সমান অধিকার প্রাপ্য বটে। যে সমাজে মানুষ যত অজ্ঞ সে সমাজে সামাজিক বৈষম্য ও সামাজিক শ্রেণী শোষণ তত বেশি। তাই লালন ফকির সমাজের অজ্ঞতা, অনগ্রসর, পিছিয়ে পড়া, ব্রাত্যজন এবং দলিত-বঞ্চিত মানুষের জাগিয়ে তুলতে গিয়ে প্রতাপশালী ও স্বার্থান্নেষী মহলের প্রতি কুঠারাঘাত করে প্রচলিত বিভাজন সম্পর্কে কড়া ভাষায় সমালোচনা করেন। লালন ফকিরের গানেই ব্রাত্যজন, মজদুর, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, আদিবাসী, দলিত-বঞ্চিত, অন্ত্যজ, পিছিয়ে পড়া মানুষরা ঘুম থেকে জেগে ওঠে নতুন ভাবে। লালন ফকির বলেনÑ ‘ভক্তের দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই,/ হিন্দু কি যবন জাতির বিচার নাই’
লালন ফকির কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও গোঁড়ামির মূলে কুঠারাঘাত করেছেন। সমাজের শ্রেণীবিভাজনের ইট-প্রাচীরের দেয়াল ভেঙে করেছেন খান খান। তিনি সংস্কারবাদী হয়ে বলেনÑ মানুষ এক। কেউ ছোট নয় বা কেউ বড় নয়।
লালন ফকির কখনো তিনি হিন্দু বা মুসলিম বলে পরিচয় দেননি। তিনি জাত-পাত বা বিশ্বাসের গন্ডির ওপরে উঠে নিজেকে ‘মানুষ’ বলে পরিচয় দিতে বেশি পছন্দ করতেন। তাঁর জাত-পাত নিজে জীবদ্দশায় যেমন, তার মৃত্যুর পরও তেমনি মানুষের কৌতূহল অশেষ। লালন ফকির বলেনÑ ‘সব লোকে কয় লালন ফকির হিন্দু না যবন,/ লালন বলে আমার আমি না জানি সন্ধান। তাঁর কাছে মানুষের সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের চেয়ে অখ- মানব সত্তার পরিচয়ই ছিল বড়। তাঁর কাছে সব মানুষের বড় পরিচয় হচ্ছে তার কর্মে। কারণ কাজই প্রার্থনা, এক্ষেত্রে জাতি, বর্ণ, বিশ্বাস বা জাত-পাতের পরিচয় অনাবশ্যক। জাতিভেদ, শোষণ, নিপীড়ন বঞ্চনা তা সমাজে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলেছে এবং এই জাতিভেদ প্রথার জাঁতাকলে পড়ে সমাজের নি¤œ স্তরের অনগ্রসর মানুষ তথা অনগ্রসর মানুষ অর্থাৎ অনার্য জাতি মানুষে পরিণত হতে পারেনি। সমাজ তাদের ওপর নিষ্ঠুর শোষণ চালিয়ে সবসময় দলিত-বঞ্চিতদের দমিয়ে রাখতে চেয়েছে। সমাজে এই শোষণ নিপীড়নকে স্বর্গীয় গ্রন্থের অনুশাসনের অঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে শাসক শ্রেণী। জাতিভেদ প্রথার এই নিদারুণ শোষণকে আরও উৎসাহিত করে জাতিভেদ প্রথাকে যার মাধ্যমে একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে মনুসংহিতায়। শূদ্র জাতির মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। আর্য জাতিরা অনার্যদের গোলাম বা দাসে পরিণত করেছে। শোষিত, বঞ্চিত, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, দলিত সমাজের নিচু তলার মানুষরা এর বিরুদ্ধে উচ্চ কণ্ঠে প্রতিবাদ করতে পারেনি। সমাজ কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া এই সামাজিক শোষণ আর্যদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে মেনে নিতে নতজানু হয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছে। তাই লালন ফকির এইসব আজন্ম নতজানু মানুষদের জাগিয়ে তোলার জন্য সমাজ কর্তৃক আরোপিত ‘জাতির’ বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠে ‘জাতিকে’ অস্বীকার করে জাতিভেদ প্রথার অসারতা প্রমাণ করার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। লালন ফকিরের মতে পৃথিবীর সব মানুষ যেহেতু একদ- জরায়ু হতে সৃষ্ট, সেহেতু সবার পরিচয় একটাই আর সেটি হলো ‘মানুষ’।
[লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট]
বাবুল রবিদাস
বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪
অবহেলিত শোষিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের পক্ষে যে কজন মহামানব ইতোপূর্বে বাণী দিয়েছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ‘লালন ফকির।’ তখনকার সমসাময়িক সমাজ ছিল জাত-পাত আর শ্রেণীবৈষম্যের করাল আঘাতে জর্জরিত। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, দাম্ভিক, বর্ণবৈষম্য, অস্পৃশ্য, অপবিত্র বলে মনে করত। এ সমস্যা এতই প্রকট ছিল যে, এক গোত্রের মানুষ অন্য গোত্রের মানুষের ছায়া মাড়ালে ব্রাহ্মণরা অপবিত্র হয়ে যেত। ফলে সামজে উঁচু-নিচু প্রথার সৃষ্টি হয়েছিল। সমাজ কর্তৃক আরওপিত মানুষের শ্রেণীবিভাজন বা অস্পৃশ্যতাকে ‘লালন ফকির’ কখনোই স্বীকার করেননি, বরং বর্ণবৈষম্য, অস্পৃশ্য, ভেদাভেদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। ব্রাহ্মণ কর্তৃক রচিত স্বার্থান্বেষী মহলের বিভাজিত ও বিখ-িত সমাজের শ্রেণীবিন্যাস বা শ্রেণীবৈষম্যকে অস্বীকার করে ‘লালন ফকির’ তাঁর গানে বলেনÑ ‘জাত গেল, জাত গেল বলে একি আজব কারখানা,/ সত্য পথে কেউ নয় রাজি সবি দেখি তা না না না।’
মানুষের বিভাজন সমাজের অজ্ঞতার ফসল। সব মানুষকে তো একজনই সৃষ্টি করেছেন। তাহলে মানুষ পৃথক করার কে? গ্রন্থের দোহাই দিয়ে ছত্রিশ জাতিতে প্রবর্তন করা হয়েছে তা মূলত অপব্যাখ্যার ফসল। হিন্দু সমাজে পেশাভিত্তিতে নানা বিভাজন তৈরি করা হয়েছে। মানুষে মানুষে বিশ্বাসের বৈষম্য কথা সঠিক নয়। সব মানুষই সমান অধিকার প্রাপ্য বটে। যে সমাজে মানুষ যত অজ্ঞ সে সমাজে সামাজিক বৈষম্য ও সামাজিক শ্রেণী শোষণ তত বেশি। তাই লালন ফকির সমাজের অজ্ঞতা, অনগ্রসর, পিছিয়ে পড়া, ব্রাত্যজন এবং দলিত-বঞ্চিত মানুষের জাগিয়ে তুলতে গিয়ে প্রতাপশালী ও স্বার্থান্নেষী মহলের প্রতি কুঠারাঘাত করে প্রচলিত বিভাজন সম্পর্কে কড়া ভাষায় সমালোচনা করেন। লালন ফকিরের গানেই ব্রাত্যজন, মজদুর, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, আদিবাসী, দলিত-বঞ্চিত, অন্ত্যজ, পিছিয়ে পড়া মানুষরা ঘুম থেকে জেগে ওঠে নতুন ভাবে। লালন ফকির বলেনÑ ‘ভক্তের দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই,/ হিন্দু কি যবন জাতির বিচার নাই’
লালন ফকির কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও গোঁড়ামির মূলে কুঠারাঘাত করেছেন। সমাজের শ্রেণীবিভাজনের ইট-প্রাচীরের দেয়াল ভেঙে করেছেন খান খান। তিনি সংস্কারবাদী হয়ে বলেনÑ মানুষ এক। কেউ ছোট নয় বা কেউ বড় নয়।
লালন ফকির কখনো তিনি হিন্দু বা মুসলিম বলে পরিচয় দেননি। তিনি জাত-পাত বা বিশ্বাসের গন্ডির ওপরে উঠে নিজেকে ‘মানুষ’ বলে পরিচয় দিতে বেশি পছন্দ করতেন। তাঁর জাত-পাত নিজে জীবদ্দশায় যেমন, তার মৃত্যুর পরও তেমনি মানুষের কৌতূহল অশেষ। লালন ফকির বলেনÑ ‘সব লোকে কয় লালন ফকির হিন্দু না যবন,/ লালন বলে আমার আমি না জানি সন্ধান। তাঁর কাছে মানুষের সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের চেয়ে অখ- মানব সত্তার পরিচয়ই ছিল বড়। তাঁর কাছে সব মানুষের বড় পরিচয় হচ্ছে তার কর্মে। কারণ কাজই প্রার্থনা, এক্ষেত্রে জাতি, বর্ণ, বিশ্বাস বা জাত-পাতের পরিচয় অনাবশ্যক। জাতিভেদ, শোষণ, নিপীড়ন বঞ্চনা তা সমাজে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলেছে এবং এই জাতিভেদ প্রথার জাঁতাকলে পড়ে সমাজের নি¤œ স্তরের অনগ্রসর মানুষ তথা অনগ্রসর মানুষ অর্থাৎ অনার্য জাতি মানুষে পরিণত হতে পারেনি। সমাজ তাদের ওপর নিষ্ঠুর শোষণ চালিয়ে সবসময় দলিত-বঞ্চিতদের দমিয়ে রাখতে চেয়েছে। সমাজে এই শোষণ নিপীড়নকে স্বর্গীয় গ্রন্থের অনুশাসনের অঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে শাসক শ্রেণী। জাতিভেদ প্রথার এই নিদারুণ শোষণকে আরও উৎসাহিত করে জাতিভেদ প্রথাকে যার মাধ্যমে একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে মনুসংহিতায়। শূদ্র জাতির মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। আর্য জাতিরা অনার্যদের গোলাম বা দাসে পরিণত করেছে। শোষিত, বঞ্চিত, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, দলিত সমাজের নিচু তলার মানুষরা এর বিরুদ্ধে উচ্চ কণ্ঠে প্রতিবাদ করতে পারেনি। সমাজ কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া এই সামাজিক শোষণ আর্যদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে মেনে নিতে নতজানু হয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছে। তাই লালন ফকির এইসব আজন্ম নতজানু মানুষদের জাগিয়ে তোলার জন্য সমাজ কর্তৃক আরোপিত ‘জাতির’ বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠে ‘জাতিকে’ অস্বীকার করে জাতিভেদ প্রথার অসারতা প্রমাণ করার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। লালন ফকিরের মতে পৃথিবীর সব মানুষ যেহেতু একদ- জরায়ু হতে সৃষ্ট, সেহেতু সবার পরিচয় একটাই আর সেটি হলো ‘মানুষ’।
[লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট]