মাহরুফ চৌধুরী
স্বাধীনতা পূর্ব থেকেই ছাত্ররাজনীতি দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আগের দুটো লেখায় তুলে ধরা হয়েছে যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ছাত্ররাজনীতির চর্চা অনেক ক্ষেত্রে সহিংসতা, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের জন্ম দিয়েছে, যা শিক্ষার মান এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতির নানা অপকর্মের ফলে অনেকেই ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ বা সীমিত করার দাবি তুলছেন। ছাত্ররাজনীতি নয়, দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হোক। দেশের বর্তমান পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে ও রাষ্ট্রীয় সংস্কার প্রয়াসের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে নিচে
উল্লেখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে : ১. দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড় ছাত্রসংগঠনগুলোর কর্মকা- সীমিত করতে জরুরি ভিত্তিতে প্রাতিষ্ঠানিক নীতিমালা প্রণয়ন কিংবা বিদ্যমান নীতিমালার সংস্কার অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিককালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যা ইতিবাচক উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তবে এই প্রয়াসগুলোকে আরও বিস্তৃত পরিসরে বাস্তবায়ন করার প্রয়োজন আছে যাতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি শান্তি পূর্ণ, শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ বজায় থাকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত শিক্ষার্থীদের মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান করা, যা তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনী দক্ষতার বিকাশে সহায়ক হবে।
পেশিশক্তির প্রদর্শনী নয়; বরং এমন একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যা শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট করবে এবং তাদের জ্ঞানার্জনে মনোযোগী হতে সহায়তা করবে। এজন্য শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার প্রয়োজন, যাতে জ্ঞান লাভ ও দক্ষতা অর্জনের প্রতি শিক্ষার্থীদের মনোযোগ নিবদ্ধ থাকে।
এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য ক্লাসরুমে গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষার্থীদের একাডেমিক দক্ষতা এবং জ্ঞান অর্জনে মনোযোগী করতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করলে তারা শিক্ষার্থীদের মেধা ও দক্ষতা উন্নয়নে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন। শিক্ষার মান উন্নয়নে শিক্ষক প্রশিক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন, যেমন শিক্ষার অবকাঠামো উন্নয়ন, পাঠ্যসূচির আধুনিকীকরণ, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং গবেষণার সুযোগ সম্প্রসারণ। সরকারি পদক্ষেপের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব উদ্যোগও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব উদ্যোগের সম্মিলিত প্রয়াসেই শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব, যা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ সাফল্য এবং দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ২. শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা বর্তমান পরিস্থিতিতে অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। দেশের জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে ছাত্ররাজনীতি সঙ্গত কারণেই গভীরভাবে যুক্ত। কারণ ঐতিহাসিকভাবে নানা গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন ও সংগ্রামে শিক্ষার্থীরা তথা যুবসমাজ প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব দিয়েছে এবং দেশের আপমর জনসাধারণও তাদের পাশে দাঁড়িয়ে এক অপ্রতিরোধ্য গণশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু আজকের দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, দেশের রাজনৈতিক দলগুলো শিক্ষার্থীদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে, যার ফলে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে শিক্ষাঙ্গনে পেশিশক্তির প্রদর্শনী বেড়েছে। এর ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাভাবিক শিক্ষা পরিবেশ অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে, যা শিক্ষার্থীদের শিক্ষার প্রতি মনোযোগে বিঘœ ঘটায়। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দলীয় ব্যানারে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাইরের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মুক্ত রেখে শিক্ষাঙ্গনে একটি সুস্থ, সুষ্ঠু ও উন্নয়নমুখী পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
এ লক্ষ্যে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রসংসদগুলোকে সক্রিয় করতে হবে এবং এগুলোকে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে। ছাত্রসংসদগুলোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং নিজেদের মতামত প্রকাশের সুযোগ পাবে, যা তাদের সামাজিক সচেতনতা ও নেতৃত্বের গুণাবলীর বিকাশে সহায়ক হবে। প্রয়োজনে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ের বাইরে রাখতে একটি স্বাধীন পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা যেতে পারে, যা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ রক্ষা ও শিক্ষার মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। এভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রকৃত শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে শিক্ষার্থীরা তাদের মূল লক্ষ্য তথা একাডেমিক উৎকর্ষতা ও সমাজের উন্নয়নমুখী অগ্রযাত্রায় অংশগ্রহণ সম্পর্কে মনোযোগী হতে পারবে। ৩. উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ক্যাম্পাসে একটি শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ পড়াশোনার পরিবেশ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষার্থীরা যাতে নিরবচ্ছিন্নভাবে অধ্যয়নে মনোযোগী হতে পারে এবং তাদের শিক্ষা জীবনকে ইতিবাচকভাবে বিকশিত করতে পারে, তার জন্য ক্যাম্পাসে সহিংসতা ও সংঘর্ষ বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য। এই লক্ষ্যে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে এবং সম্ভাব্য সহিংসতার ঘটনাগুলো প্রতিরোধে আরও সতর্ক হতে হবে। পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশের মতো, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিজস্ব ক্যাম্পাস পুলিশের ব্যবস্থা রাখার বিষয়টি বিবেচনায় আনা যেতে পারে, যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তার প্রতি বিশেষ নজর দেবে এবং ক্যাম্পাসে কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলে তা দ্রুত ও কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে পারবে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আশপাশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও আরও সক্রিয় ও তৎপর হতে হবে। এতে করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেকোনো ধরনের সংঘর্ষের ঘটনার ক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হবে এবং ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ বিঘিœত হওয়ার আগেই তা নিয়ন্ত্রণে আসবে।
তবে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বাহিনী বা ক্যাম্পাস পুলিশের ওপরই নির্ভরশীল থাকা উচিত নয়।
শিক্ষার্থীদের নিজেদেরও ক্যাম্পাসের শান্তি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রলোভনের পথে না গিয়ে নৈতিকতা, মূল্যবোধ এবং সামষ্টিক কল্যাণে মনোযোগী হতে হবে। ক্যাম্পাসে অশান্তি ও সংঘাতমূলক কাজ থেকে বিরত থাকতে শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে বিশেষ কর্মশালা, সেমিনার বা বিভিন্ন ধরনের প্রোগ্রামের আয়োজন করা যেতে পারে, যা তাদেরকে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, অন্যের প্রতি সহনশীল, অন্যের সঙ্গে সহাবস্থানসহ দেশের সুনাগরিক হিসেবে নিজস্ব দায়িত্বশীলতার প্রতি আগ্রহী করবে। শান্তিপূর্ণ ক্যাম্পাস নিশ্চিত করার জন্য সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন, যাতে শিক্ষার সঠিক পরিবেশে শিক্ষার্থীরা তাদের সর্বোচ্চ সাফল্য অর্জন করতে পারে এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। ৪. প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিম-লে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্রসংগঠনগুলোর বিকল্প হিসেবে সৃজনশীল ও উদ্যমী শিক্ষার্থীদের জন্য শিল্প-সংস্কৃতি ও সামাজিক উন্নয়নমূলক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা এখন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। পূর্বে এক লেখায় আমরা এই বিষয়ে আলোচনা করেছিলাম যে, ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রূপরেখা কেমন হওয়া উচিত।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বের গুণাবলী, সামাজিক সচেতনতা এবং সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন কিছু বিকল্প প্লাটফর্ম। বিতর্ক ক্লাব, সাংস্কৃতিক সংগঠন, পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন, সামাজিক সেবা
ক্লাব, গবেষণা ও উদ্ভাবনী ক্লাব, এবং অন্যান্য সৃজনশীল প্লাটফর্মগুলো প্রতিষ্ঠা করা হলে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মননশীলতা ও নেতৃত্বের গুণাবলী বিকাশের সুযোগ পাবে। এসব সংগঠন শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমন্বয়ের ক্ষমতা, সৃজনশীল চিন্তাভাবনা এবং সমাজের প্রতি দায়িত্বশীলতার অনুভূতি জাগিয়ে তুলবে।
এছাড়া, শিক্ষার্থীদের এই ধরনের সংগঠনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অর্জনের পাশাপাশি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন করা যাবে।
এ ধরনের প্লাটফর্মগুলো শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত করতে এবং দেশের উন্নয়নে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে একটি শক্তিশালী ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। ৫. শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে শিক্ষা ব্যবস্থায় কার্যকর আইনগত সংস্কার অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে, ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সহিংসতা বন্ধ এবং অপরাধ দমনে কঠোর আইন প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যারা সহিংসতা, ভীতি প্রদর্শন বা অন্য কোনো অনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত হবে, তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষাঙ্গনে সহিংসতা বা অপরাধের দায় সহজে যাতে এড়িয়ে যাওয়া না যায়, সেজন্য এমন আইন থাকা উচিত যা শিক্ষার পরিবেশকে সবধরনের উগ্র রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখবে। পাশাপাশি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনৈতিক কর্মকা- সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করার জন্য নতুন ও কার্যকর আইন প্রণয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই আইনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের ব্যানারে যে কোনো ধরনের মিছিল, মিটিং বা প্রচারণা বন্ধ করা হবে, যা শিক্ষার্থীদের একাডেমিক চর্চায় মনোযোগী হতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
আইনগত এই সংস্কারের মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনে একটি সুস্থ, শান্তিপূর্ণ এবং একাডেমিক পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে একাডেমিক উৎকর্ষতার পাশাপাশি নৈতিকতার বোধও তৈরি করবে।
এই উদ্যোগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রকৃত শিক্ষার কেন্দ্রে পরিণত করবে, যেখানে শুধু জ্ঞানচর্চা ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটবে, কোন রকমের রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নয়। শিক্ষাঙ্গনে এমন পরিবেশ গড়ে উঠলে, শিক্ষার্থীরা তাদের প্রকৃত লক্ষ্য একাডেমিক ও সামাজিক উৎকর্ষতার প্রতি মনোনিবেশ করতে পারবে, যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি জ্ঞানীয় অর্থনীতির প্রাগ্রসর, সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করবে। ৬. শতধা বিভক্ত সংকটাপন্ন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ছাত্ররাজনীতির নেতিবাচক দিকগুলো তাদেরকে বোঝানো এবং সেসব থেকে তাদের দূরে রাখতে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের উদ্যোগ সফল করতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রভাবের প্রকৃতি, এর নেতিবাচক প্রভাব এবং তাদের নিজস্ব ভবিষ্যতের জন্য এটি কতটা ক্ষতিকর হতে পারে এসব বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের বোঝানো দরকার যে, ভবিষ্যতের কা-ারি হিসেবে তাদের মূল লক্ষ্য হলো একাডেমিক উৎকর্ষতা অর্জন করা, যাতে তারা পরবর্তীতে ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে সফলতার শিখরে পৌঁছাতে পারে এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনের অগ্রদূত হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে।
বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাজনীতি সম্পর্কিত সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের একাডেমিক এবং সামাজিক কার্যক্রমে পরিপূর্ণভাবে আত্মনিয়োগের গুরুত্ব সম্পর্কে অভিহিতকরণ কার্যক্রম চালু রাখতে হবে। শিক্ষার্থীদের বোঝানো উচিত যে একাডেমিক সাফল্যের পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্ববোধের বিকাশ তাদের প্রকৃত আত্মিক, মানসিক ও সামষ্টিক উন্নতির জন্য অপরিহার্য। বিভিন্ন কর্মশালা, সেমিনার, আলোচনাসভা এবং বিতর্কের আয়োজনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একাডেমিক জ্ঞানার্জন ও দক্ষতা উন্নয়নের প্রতি অনুরাগ এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা তৈরির চেষ্টা করা যেতে পারে।
আলোচিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা যখন রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হবে, তখন তা তাদের ব্যক্তিগত উন্নতির পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। একটি সচেতন ও দায়িত্বশীল শিক্ষার্থীসমাজ গড়ে তুলতে পারলে ভবিষ্যতে শিক্ষাঙ্গনে সুশৃঙ্খল, সহনশীল এবং গঠনমূলক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা সহজ হবে। তবে, শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক প্রভাব হ্রাস এবং শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দল, প্রশাসন (রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক দুটোই) এবং শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত উদ্যোগ।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, শিক্ষার পরিবেশ উন্নত করা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মানোন্নয়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। কিন্তু এর জন্য সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক সদ্বিচ্ছা তৈরির পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং সঠিক নীতিমালা গ্রহণ অপরিহার্য। শিক্ষাঙ্গনকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার উদ্যোগ আমাদের শিক্ষার্থীদের মেধা, সৃজনশীলতা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হবে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি শক্তিশালী, উদ্ভাবনী ও জ্ঞানসমৃদ্ধ জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করবে। আলোচিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে একটি নিরাপদ শিক্ষার পরিবেশ তৈরি হবে, যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের ছাত্রজীবনের আসল লক্ষ্য জ্ঞান লাভ ও দক্ষতা উৎকর্ষতা অর্জন ও সমাজে গঠনমূলক ভূমিকা পালনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ জীবনের জন্যে প্রস্তুতি নিতে পারবে।
[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য ]
মাহরুফ চৌধুরী
শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪
স্বাধীনতা পূর্ব থেকেই ছাত্ররাজনীতি দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আগের দুটো লেখায় তুলে ধরা হয়েছে যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ছাত্ররাজনীতির চর্চা অনেক ক্ষেত্রে সহিংসতা, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের জন্ম দিয়েছে, যা শিক্ষার মান এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতির নানা অপকর্মের ফলে অনেকেই ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ বা সীমিত করার দাবি তুলছেন। ছাত্ররাজনীতি নয়, দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হোক। দেশের বর্তমান পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে ও রাষ্ট্রীয় সংস্কার প্রয়াসের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে নিচে
উল্লেখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে : ১. দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড় ছাত্রসংগঠনগুলোর কর্মকা- সীমিত করতে জরুরি ভিত্তিতে প্রাতিষ্ঠানিক নীতিমালা প্রণয়ন কিংবা বিদ্যমান নীতিমালার সংস্কার অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিককালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যা ইতিবাচক উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তবে এই প্রয়াসগুলোকে আরও বিস্তৃত পরিসরে বাস্তবায়ন করার প্রয়োজন আছে যাতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি শান্তি পূর্ণ, শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ বজায় থাকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত শিক্ষার্থীদের মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান করা, যা তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনী দক্ষতার বিকাশে সহায়ক হবে।
পেশিশক্তির প্রদর্শনী নয়; বরং এমন একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যা শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট করবে এবং তাদের জ্ঞানার্জনে মনোযোগী হতে সহায়তা করবে। এজন্য শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার প্রয়োজন, যাতে জ্ঞান লাভ ও দক্ষতা অর্জনের প্রতি শিক্ষার্থীদের মনোযোগ নিবদ্ধ থাকে।
এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য ক্লাসরুমে গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষার্থীদের একাডেমিক দক্ষতা এবং জ্ঞান অর্জনে মনোযোগী করতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করলে তারা শিক্ষার্থীদের মেধা ও দক্ষতা উন্নয়নে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন। শিক্ষার মান উন্নয়নে শিক্ষক প্রশিক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন, যেমন শিক্ষার অবকাঠামো উন্নয়ন, পাঠ্যসূচির আধুনিকীকরণ, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং গবেষণার সুযোগ সম্প্রসারণ। সরকারি পদক্ষেপের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব উদ্যোগও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব উদ্যোগের সম্মিলিত প্রয়াসেই শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব, যা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ সাফল্য এবং দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ২. শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা বর্তমান পরিস্থিতিতে অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। দেশের জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে ছাত্ররাজনীতি সঙ্গত কারণেই গভীরভাবে যুক্ত। কারণ ঐতিহাসিকভাবে নানা গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন ও সংগ্রামে শিক্ষার্থীরা তথা যুবসমাজ প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব দিয়েছে এবং দেশের আপমর জনসাধারণও তাদের পাশে দাঁড়িয়ে এক অপ্রতিরোধ্য গণশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু আজকের দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, দেশের রাজনৈতিক দলগুলো শিক্ষার্থীদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে, যার ফলে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে শিক্ষাঙ্গনে পেশিশক্তির প্রদর্শনী বেড়েছে। এর ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাভাবিক শিক্ষা পরিবেশ অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে, যা শিক্ষার্থীদের শিক্ষার প্রতি মনোযোগে বিঘœ ঘটায়। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দলীয় ব্যানারে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাইরের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মুক্ত রেখে শিক্ষাঙ্গনে একটি সুস্থ, সুষ্ঠু ও উন্নয়নমুখী পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
এ লক্ষ্যে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রসংসদগুলোকে সক্রিয় করতে হবে এবং এগুলোকে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে। ছাত্রসংসদগুলোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং নিজেদের মতামত প্রকাশের সুযোগ পাবে, যা তাদের সামাজিক সচেতনতা ও নেতৃত্বের গুণাবলীর বিকাশে সহায়ক হবে। প্রয়োজনে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ের বাইরে রাখতে একটি স্বাধীন পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা যেতে পারে, যা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ রক্ষা ও শিক্ষার মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। এভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রকৃত শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে শিক্ষার্থীরা তাদের মূল লক্ষ্য তথা একাডেমিক উৎকর্ষতা ও সমাজের উন্নয়নমুখী অগ্রযাত্রায় অংশগ্রহণ সম্পর্কে মনোযোগী হতে পারবে। ৩. উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ক্যাম্পাসে একটি শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ পড়াশোনার পরিবেশ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষার্থীরা যাতে নিরবচ্ছিন্নভাবে অধ্যয়নে মনোযোগী হতে পারে এবং তাদের শিক্ষা জীবনকে ইতিবাচকভাবে বিকশিত করতে পারে, তার জন্য ক্যাম্পাসে সহিংসতা ও সংঘর্ষ বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য। এই লক্ষ্যে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে এবং সম্ভাব্য সহিংসতার ঘটনাগুলো প্রতিরোধে আরও সতর্ক হতে হবে। পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশের মতো, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিজস্ব ক্যাম্পাস পুলিশের ব্যবস্থা রাখার বিষয়টি বিবেচনায় আনা যেতে পারে, যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তার প্রতি বিশেষ নজর দেবে এবং ক্যাম্পাসে কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলে তা দ্রুত ও কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে পারবে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আশপাশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও আরও সক্রিয় ও তৎপর হতে হবে। এতে করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেকোনো ধরনের সংঘর্ষের ঘটনার ক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হবে এবং ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ বিঘিœত হওয়ার আগেই তা নিয়ন্ত্রণে আসবে।
তবে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বাহিনী বা ক্যাম্পাস পুলিশের ওপরই নির্ভরশীল থাকা উচিত নয়।
শিক্ষার্থীদের নিজেদেরও ক্যাম্পাসের শান্তি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রলোভনের পথে না গিয়ে নৈতিকতা, মূল্যবোধ এবং সামষ্টিক কল্যাণে মনোযোগী হতে হবে। ক্যাম্পাসে অশান্তি ও সংঘাতমূলক কাজ থেকে বিরত থাকতে শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে বিশেষ কর্মশালা, সেমিনার বা বিভিন্ন ধরনের প্রোগ্রামের আয়োজন করা যেতে পারে, যা তাদেরকে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, অন্যের প্রতি সহনশীল, অন্যের সঙ্গে সহাবস্থানসহ দেশের সুনাগরিক হিসেবে নিজস্ব দায়িত্বশীলতার প্রতি আগ্রহী করবে। শান্তিপূর্ণ ক্যাম্পাস নিশ্চিত করার জন্য সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন, যাতে শিক্ষার সঠিক পরিবেশে শিক্ষার্থীরা তাদের সর্বোচ্চ সাফল্য অর্জন করতে পারে এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। ৪. প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিম-লে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্রসংগঠনগুলোর বিকল্প হিসেবে সৃজনশীল ও উদ্যমী শিক্ষার্থীদের জন্য শিল্প-সংস্কৃতি ও সামাজিক উন্নয়নমূলক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা এখন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। পূর্বে এক লেখায় আমরা এই বিষয়ে আলোচনা করেছিলাম যে, ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রূপরেখা কেমন হওয়া উচিত।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বের গুণাবলী, সামাজিক সচেতনতা এবং সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন কিছু বিকল্প প্লাটফর্ম। বিতর্ক ক্লাব, সাংস্কৃতিক সংগঠন, পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন, সামাজিক সেবা
ক্লাব, গবেষণা ও উদ্ভাবনী ক্লাব, এবং অন্যান্য সৃজনশীল প্লাটফর্মগুলো প্রতিষ্ঠা করা হলে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মননশীলতা ও নেতৃত্বের গুণাবলী বিকাশের সুযোগ পাবে। এসব সংগঠন শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমন্বয়ের ক্ষমতা, সৃজনশীল চিন্তাভাবনা এবং সমাজের প্রতি দায়িত্বশীলতার অনুভূতি জাগিয়ে তুলবে।
এছাড়া, শিক্ষার্থীদের এই ধরনের সংগঠনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অর্জনের পাশাপাশি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন করা যাবে।
এ ধরনের প্লাটফর্মগুলো শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত করতে এবং দেশের উন্নয়নে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে একটি শক্তিশালী ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। ৫. শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে শিক্ষা ব্যবস্থায় কার্যকর আইনগত সংস্কার অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে, ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সহিংসতা বন্ধ এবং অপরাধ দমনে কঠোর আইন প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যারা সহিংসতা, ভীতি প্রদর্শন বা অন্য কোনো অনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত হবে, তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষাঙ্গনে সহিংসতা বা অপরাধের দায় সহজে যাতে এড়িয়ে যাওয়া না যায়, সেজন্য এমন আইন থাকা উচিত যা শিক্ষার পরিবেশকে সবধরনের উগ্র রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখবে। পাশাপাশি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনৈতিক কর্মকা- সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করার জন্য নতুন ও কার্যকর আইন প্রণয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই আইনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের ব্যানারে যে কোনো ধরনের মিছিল, মিটিং বা প্রচারণা বন্ধ করা হবে, যা শিক্ষার্থীদের একাডেমিক চর্চায় মনোযোগী হতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
আইনগত এই সংস্কারের মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনে একটি সুস্থ, শান্তিপূর্ণ এবং একাডেমিক পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে একাডেমিক উৎকর্ষতার পাশাপাশি নৈতিকতার বোধও তৈরি করবে।
এই উদ্যোগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রকৃত শিক্ষার কেন্দ্রে পরিণত করবে, যেখানে শুধু জ্ঞানচর্চা ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটবে, কোন রকমের রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নয়। শিক্ষাঙ্গনে এমন পরিবেশ গড়ে উঠলে, শিক্ষার্থীরা তাদের প্রকৃত লক্ষ্য একাডেমিক ও সামাজিক উৎকর্ষতার প্রতি মনোনিবেশ করতে পারবে, যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি জ্ঞানীয় অর্থনীতির প্রাগ্রসর, সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করবে। ৬. শতধা বিভক্ত সংকটাপন্ন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ছাত্ররাজনীতির নেতিবাচক দিকগুলো তাদেরকে বোঝানো এবং সেসব থেকে তাদের দূরে রাখতে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের উদ্যোগ সফল করতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রভাবের প্রকৃতি, এর নেতিবাচক প্রভাব এবং তাদের নিজস্ব ভবিষ্যতের জন্য এটি কতটা ক্ষতিকর হতে পারে এসব বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের বোঝানো দরকার যে, ভবিষ্যতের কা-ারি হিসেবে তাদের মূল লক্ষ্য হলো একাডেমিক উৎকর্ষতা অর্জন করা, যাতে তারা পরবর্তীতে ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে সফলতার শিখরে পৌঁছাতে পারে এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনের অগ্রদূত হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে।
বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাজনীতি সম্পর্কিত সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের একাডেমিক এবং সামাজিক কার্যক্রমে পরিপূর্ণভাবে আত্মনিয়োগের গুরুত্ব সম্পর্কে অভিহিতকরণ কার্যক্রম চালু রাখতে হবে। শিক্ষার্থীদের বোঝানো উচিত যে একাডেমিক সাফল্যের পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্ববোধের বিকাশ তাদের প্রকৃত আত্মিক, মানসিক ও সামষ্টিক উন্নতির জন্য অপরিহার্য। বিভিন্ন কর্মশালা, সেমিনার, আলোচনাসভা এবং বিতর্কের আয়োজনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একাডেমিক জ্ঞানার্জন ও দক্ষতা উন্নয়নের প্রতি অনুরাগ এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা তৈরির চেষ্টা করা যেতে পারে।
আলোচিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা যখন রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হবে, তখন তা তাদের ব্যক্তিগত উন্নতির পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। একটি সচেতন ও দায়িত্বশীল শিক্ষার্থীসমাজ গড়ে তুলতে পারলে ভবিষ্যতে শিক্ষাঙ্গনে সুশৃঙ্খল, সহনশীল এবং গঠনমূলক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা সহজ হবে। তবে, শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক প্রভাব হ্রাস এবং শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দল, প্রশাসন (রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক দুটোই) এবং শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত উদ্যোগ।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, শিক্ষার পরিবেশ উন্নত করা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মানোন্নয়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। কিন্তু এর জন্য সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক সদ্বিচ্ছা তৈরির পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং সঠিক নীতিমালা গ্রহণ অপরিহার্য। শিক্ষাঙ্গনকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার উদ্যোগ আমাদের শিক্ষার্থীদের মেধা, সৃজনশীলতা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হবে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি শক্তিশালী, উদ্ভাবনী ও জ্ঞানসমৃদ্ধ জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করবে। আলোচিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে একটি নিরাপদ শিক্ষার পরিবেশ তৈরি হবে, যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের ছাত্রজীবনের আসল লক্ষ্য জ্ঞান লাভ ও দক্ষতা উৎকর্ষতা অর্জন ও সমাজে গঠনমূলক ভূমিকা পালনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ জীবনের জন্যে প্রস্তুতি নিতে পারবে।
[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য ]