মাহরুফ চৌধুরী
রাষ্ট্রকে পরিবারের সঙ্গে তুলনা করা কিংবা পরিবার হিসেবে ভাবার ধারণাটি আমাদের ‘দায় ও দরদের সমাজ’ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি শক্তিশালী অনুপ্রেরণা হতে পারে। পরিবারের ন্যায় রাষ্ট্রও যদি একটি মানবিক, সহযোগিতামূলক এবং কল্যাণমুখী কাঠামোতে রূপান্তরিত হয়, তাহলে সমাজে ন্যায়বিচার এবং সমতার ভিত্তি স্থাপন করা সম্ভব। তবে এ পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে পরিবারতন্ত্রের আধিপত্য, যা আমাদের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে।
রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে পরিবারের মতো ‘ভালোবাসা ও নিরাপত্তার বলয়’ সৃষ্টি করার ধারণা প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতন্ত্রের চর্চা এবং সমাজের সর্বস্তরে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দৃঢ় অঙ্গীকার। পরিবারতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ দূর করার মাধ্যমে সুশাসন ও পরমতসহিষ্ণুতাকে রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশে পরিণত করতে হবে। একমাত্র তখনই আমরা এমন একটি স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব, যেখানে রাষ্ট্রীয় আদর্শ বৈচিত্র্যের মাঝে ঐকের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটবে। এটি একটি নৈতিক এবং সামাজিক প্রতিজ্ঞা, যা আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণকে শুধু ত্বরান্বিতই করবে না, বরং দেশের প্রত্যেক নাগরিককের মর্যাদা ও অধিকার সুনিশ্চিত করার পথে এগিয়ে নেবে।
পরিবারতন্ত্র আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে রেখেছে। এটি ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ঘটিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন ও নেতৃত্বের বহুমুখিতাকে বাধাগ্রস্ত করে, যা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিকাশে একটি বড় বাধা। রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে পরিবারতন্ত্র প্রশাসনযন্ত্রে ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে রাষ্ট্রের সবাই স্তরে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসমতা বাড়িয়ে তুলছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান রাষ্ট্রকে একটি মানবিক ও সহযোগিতামূলক কাঠামো হিসেবে গড়ে তোলার যে ধারণা দিয়েছেন, তা পরিবারতন্ত্রের এই নেতিবাচক প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠনের আহ্বান জানায়।
ঐতিহাসিকভাবে, উপমহাদেশের ঔপনিবেশিক শাসনকাল এবং পরবর্তীতে পূর্ববাংলার রাজনৈতিক বাস্তবতায় পূর্ব পাকিস্তানের সৃষ্টি, এই ভূখ-ে পরিবারতন্ত্রের শিকড় শক্তিশালী করার সুযোগ সৃষ্টি করে। পাকিস্তানি শাসনামলে রাষ্ট্রযন্ত্রে বাইশ পরিবারের আধিপত্য এর জ্বলন্ত উদাহরণ। রাজতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রের হাত ধরে গড়ে ওঠা পরিবারতন্ত্র জমিদারি প্রথা এবং সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মনোস্তাত্ত্বিক ও আর্থসামাজিক উত্তরাধিকার বহন করে। আজকের বাংলাদেশে পরিবারতন্ত্রের শিকড় সেই সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা এবং ঔপনিবেশিক শাসনের উত্তরাধিকার থেকেই লালিত ও পালিত হচ্ছে। এর ফলে নেতৃত্বের স্বচ্ছতা ও গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব দেখা দেয়, যা ন্যায়বিচার এবং সাম্যের পথে বড় বাধা। এই পরিবারতান্ত্রিক প্রভাব দূর করে সুশাসন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং নেতৃত্বের বহুমুখিতা প্রতিষ্ঠা না করলে, রাষ্ট্রের কাক্সিক্ষত মানবিক ও কল্যাণমুখী কাঠামোতে উত্তরণ সম্ভব নয়।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে রাজনৈতিক আদর্শের সূচনা হয়েছিল, তা তার মৃত্যুর পর ক্রমে পারিবারিক রাজনীতির রূপ নেয়। তার ঐতিহাসিক নেতৃত্ব দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গভীর প্রভাব ফেললেও পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবের পরিবারের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন ধরে দলের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন, যা দলের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে।
জাতীয়তাবাদী দলের ক্ষেত্রেও একই চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর খালেদা জিয়া দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে তারেক রহমান তার উত্তরাধিকার হিসেবে দলের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখেন। এই দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের ওপর পরিবারতন্ত্রের ছায়া দেশের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করেছে। পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু থাকে ব্যক্তি ও পরিবারের প্রভাব, যেখানে আদর্শ, নীতি এবং যোগ্যতার চেয়ে বংশগত পরিচয় ও নেতার অনুকম্পা অধিকতর গুরুত্ব পায়। এই প্রবণতা শুধু রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে সংকীর্ণই করেনি, বরং তরুণ প্রজন্মের সম্ভাবনাময় নেতৃত্বের বিকাশে প্রতিবন্ধকতাও সৃষ্টি করেছে। ফলে রাজনীতিতে অংশগ্রহণকারী নতুন নেতৃত্বের সংখ্যা কমে আসছে এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুফল পেতে শুধু কথার ফুলঝুরি বা হম্বিতম্বি নয়, প্রয়োজন সমস্যাগুলোর কার্যকর সমাধান। বিদ্যমান সমস্যাগুলোর প্রতি বাস্তবভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে হবে, যাতে সেগুলো থেকে স্থায়ীভাবে উত্তরণ সম্ভব হয়। এখন প্রশ্ন হলোÑ এই কাক্সিক্ষত পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব? সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে আগের পর্বের বিশ্লেষণে দেখানো হয়েছে যে, ক্ষমতার বৈষম্য, প্রতীকী পুঁজি এবং পৃষ্ঠপোষকতার কাঠামোকে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলো কৌশলে ব্যবহার করে পরিবারতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখে। এই কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসা ছাড়া রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
পরিবারতন্ত্রের এই প্রভাব দূর করতে হলে প্রয়োজন গণসচেতনতার উদ্বোধন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের গভীর চর্চা এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্বের মাঝে সৃজনশীল ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ। জনগণকে বোঝাতে হবে যে, ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি নয়, বরং সামগ্রিক তথা সামষ্ঠিক কল্যাণকেন্দ্রিক নেতৃত্বই একটি সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের ভিত্তি। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির উন্মেষ ঘটাতে হলে সুশিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে সুনাগরিক ও দেশপ্রেমিক শাসক তৈরি, নাগরিক অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং তরুণদের নেতৃত্বে আসার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এছাড়া, রাজনৈতিক নেতৃত্বে সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে দলীয় কাঠামোতে স্বচ্ছতা এবং যোগ্যতাভিত্তিক নেতৃত্ব বেছে নেয়ার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে। দলগুলোকে এমন একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, যেখানে বৈচিত্র্যময় চিন্তাধারা এবং উদ্ভাবনী নীতির প্রয়োগ সম্ভব হয়। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও ধারাবাহিক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই শুধু আমরা এই কাঠামো থেকে বেরিয় এসে একটি সুশৃঙ্খল, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং গণতান্ত্রিক সমাজ গঠন করতে সক্ষম হব।
স্বাধীনতার পর থেকে ক্রমশ গড়ে ওঠা পরিবারতন্ত্রের গভীর শিকড় সহজেই উপড়ে ফেলা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন ধৈর্য, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং কঠোর পরিশ্রম। আমাদের মনে রাখতে হবে, বিবর্তনের ধারা সমাজ পরিবর্তন একটি সময়সাপেক্ষ বিষয়। রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার যন্ত্রের বিদ্যমান সমস্যাগুলোর রাতারাতি সমাধান খোঁজার চেষ্টা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দীর্ঘ সময় ধরে বেড়ে ওঠা জঞ্জালগুলো নিমিষেই কেটে ছাপ করা যাবে না। তাই ক্ষমতার বৈষম্য কমিয়ে আনার প্রক্রিয়া হতে হবে ধারাবাহিক এবং সুনির্দিষ্ট। সুবিধাভোগিরা অবশ্যই বাধা হয়ে দাঁড়াবে, কারণ এই বৈষম্যই পরিবারতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার প্রধান চালিকাশক্তি।
পরিবারতন্ত্রের অবসান ঘটাতে, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতীকী পুঁজির অপব্যবহার রোধে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। নেতাদের ব্যক্তিগত ইমেজ বা পারিবারিক পরিচয়ের ভিত্তিতে জনসমর্থন অর্জনের যে সুবিধা তারা ভোগ করেন, তা সম্পর্কে জনগণকে জনশিক্ষা, গণমাধ্যম এবং সচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে অবহিত করতে হবে। সচেতন ও সমালোচনামুখর জনগোষ্ঠী দলীয় অন্ধত্ব বা ‘দলকানা’ মানসিকতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। এছাড়া দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সুব্যবস্থাপনার পরিবেশের অভাব দূর করা অপরিহার্য। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অনুশীলন নিশ্চিত করতে হবে এবং সেই প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতার উপর নজরদারি চালাতে হবে। এ কাজটি করার জন্যে একটি স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান গঠন করা যেতে পারে যেটা দলগুলোর ব্যবস্থাপনা ও কর্মকান্ডের উপর নজরদারি করবে এবং এর হাতে ক্ষমতা থাকবে রাজনৈতিক দলের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ কিংবা দলের নিবন্ধ বাতিলের সুপারিশ করার। ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণকে নিরুৎসাহিত করতে স্থানীয় সরকার এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি, কারণ এই দুর্বলতাই কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার মূল কারণ। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা, জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, এবং সুশাসনের চর্চার মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটানো সম্ভব। শুধু এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদি এবং কার্যকর উদ্যোগই পরিবারতন্ত্রের প্রভাবকে খর্ব করে একটি গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক, এবং সুশাসনভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় উত্তরণে সহায়ক হতে পারে।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুফল পেতে রাষ্ট্রসংস্কারের জন্য পরিবারতত্ত্বকে শুধু একটি ধারণা হিসেবে নয়, বাস্তবতায় রূপ দিতে হবে। মুহাম্মদ ইউনূসের পরিবারতত্ত্ব থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে রাষ্ট্রকে এমন একটি কাঠামোতে রূপান্তরিত করতে হবে, যেখানে প্রতিটি নাগরিকের মর্যাদা, অধিকার এবং সুযোগ নিশ্চিত হয়। এ কাঠামো শুধু মানবিকতা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে গড়ে উঠবে না, বরং সমতা ও ন্যায়বিচারকেও প্রাধান্য দেবে। পরিবারতন্ত্রের অবসান ঘটানো শুধু রাজনীতির জন্যই নয়, সামগ্রিকভাবে সমাজের জন্যও অপরিহার্য। এটি অর্জনের জন্য গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ অপরিহার্য। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সামাজিক এবং রাজনৈতিক স্তরে সুদৃঢ় করতে হবে, যাতে নেতৃত্বে সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন, এবং অংশগ্রহণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি স্থান পায়।
এভাবে পরিবারতন্ত্রের পরিবর্তে পরিবারতত্ত্বের আলোকে গড়ে তুলতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রকাঠামো। এই কাঠামো ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সবার জন্য সুযোগের ন্যায্যতা সৃষ্টি করবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে পুনর্গঠনের মাধ্যমে একটি সমতাভিত্তিক ও মানবিক রাষ্ট্র গঠন সম্ভব, যা একটি সমৃদ্ধ এবং প্রগতিশীল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]
মাহরুফ চৌধুরী
বৃহস্পতিবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
রাষ্ট্রকে পরিবারের সঙ্গে তুলনা করা কিংবা পরিবার হিসেবে ভাবার ধারণাটি আমাদের ‘দায় ও দরদের সমাজ’ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি শক্তিশালী অনুপ্রেরণা হতে পারে। পরিবারের ন্যায় রাষ্ট্রও যদি একটি মানবিক, সহযোগিতামূলক এবং কল্যাণমুখী কাঠামোতে রূপান্তরিত হয়, তাহলে সমাজে ন্যায়বিচার এবং সমতার ভিত্তি স্থাপন করা সম্ভব। তবে এ পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে পরিবারতন্ত্রের আধিপত্য, যা আমাদের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে।
রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে পরিবারের মতো ‘ভালোবাসা ও নিরাপত্তার বলয়’ সৃষ্টি করার ধারণা প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতন্ত্রের চর্চা এবং সমাজের সর্বস্তরে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দৃঢ় অঙ্গীকার। পরিবারতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ দূর করার মাধ্যমে সুশাসন ও পরমতসহিষ্ণুতাকে রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশে পরিণত করতে হবে। একমাত্র তখনই আমরা এমন একটি স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব, যেখানে রাষ্ট্রীয় আদর্শ বৈচিত্র্যের মাঝে ঐকের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটবে। এটি একটি নৈতিক এবং সামাজিক প্রতিজ্ঞা, যা আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণকে শুধু ত্বরান্বিতই করবে না, বরং দেশের প্রত্যেক নাগরিককের মর্যাদা ও অধিকার সুনিশ্চিত করার পথে এগিয়ে নেবে।
পরিবারতন্ত্র আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে রেখেছে। এটি ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ঘটিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন ও নেতৃত্বের বহুমুখিতাকে বাধাগ্রস্ত করে, যা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিকাশে একটি বড় বাধা। রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে পরিবারতন্ত্র প্রশাসনযন্ত্রে ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে রাষ্ট্রের সবাই স্তরে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসমতা বাড়িয়ে তুলছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান রাষ্ট্রকে একটি মানবিক ও সহযোগিতামূলক কাঠামো হিসেবে গড়ে তোলার যে ধারণা দিয়েছেন, তা পরিবারতন্ত্রের এই নেতিবাচক প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠনের আহ্বান জানায়।
ঐতিহাসিকভাবে, উপমহাদেশের ঔপনিবেশিক শাসনকাল এবং পরবর্তীতে পূর্ববাংলার রাজনৈতিক বাস্তবতায় পূর্ব পাকিস্তানের সৃষ্টি, এই ভূখ-ে পরিবারতন্ত্রের শিকড় শক্তিশালী করার সুযোগ সৃষ্টি করে। পাকিস্তানি শাসনামলে রাষ্ট্রযন্ত্রে বাইশ পরিবারের আধিপত্য এর জ্বলন্ত উদাহরণ। রাজতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রের হাত ধরে গড়ে ওঠা পরিবারতন্ত্র জমিদারি প্রথা এবং সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মনোস্তাত্ত্বিক ও আর্থসামাজিক উত্তরাধিকার বহন করে। আজকের বাংলাদেশে পরিবারতন্ত্রের শিকড় সেই সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা এবং ঔপনিবেশিক শাসনের উত্তরাধিকার থেকেই লালিত ও পালিত হচ্ছে। এর ফলে নেতৃত্বের স্বচ্ছতা ও গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব দেখা দেয়, যা ন্যায়বিচার এবং সাম্যের পথে বড় বাধা। এই পরিবারতান্ত্রিক প্রভাব দূর করে সুশাসন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং নেতৃত্বের বহুমুখিতা প্রতিষ্ঠা না করলে, রাষ্ট্রের কাক্সিক্ষত মানবিক ও কল্যাণমুখী কাঠামোতে উত্তরণ সম্ভব নয়।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে রাজনৈতিক আদর্শের সূচনা হয়েছিল, তা তার মৃত্যুর পর ক্রমে পারিবারিক রাজনীতির রূপ নেয়। তার ঐতিহাসিক নেতৃত্ব দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গভীর প্রভাব ফেললেও পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবের পরিবারের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন ধরে দলের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন, যা দলের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে।
জাতীয়তাবাদী দলের ক্ষেত্রেও একই চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর খালেদা জিয়া দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে তারেক রহমান তার উত্তরাধিকার হিসেবে দলের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখেন। এই দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের ওপর পরিবারতন্ত্রের ছায়া দেশের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করেছে। পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু থাকে ব্যক্তি ও পরিবারের প্রভাব, যেখানে আদর্শ, নীতি এবং যোগ্যতার চেয়ে বংশগত পরিচয় ও নেতার অনুকম্পা অধিকতর গুরুত্ব পায়। এই প্রবণতা শুধু রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে সংকীর্ণই করেনি, বরং তরুণ প্রজন্মের সম্ভাবনাময় নেতৃত্বের বিকাশে প্রতিবন্ধকতাও সৃষ্টি করেছে। ফলে রাজনীতিতে অংশগ্রহণকারী নতুন নেতৃত্বের সংখ্যা কমে আসছে এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুফল পেতে শুধু কথার ফুলঝুরি বা হম্বিতম্বি নয়, প্রয়োজন সমস্যাগুলোর কার্যকর সমাধান। বিদ্যমান সমস্যাগুলোর প্রতি বাস্তবভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে হবে, যাতে সেগুলো থেকে স্থায়ীভাবে উত্তরণ সম্ভব হয়। এখন প্রশ্ন হলোÑ এই কাক্সিক্ষত পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব? সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে আগের পর্বের বিশ্লেষণে দেখানো হয়েছে যে, ক্ষমতার বৈষম্য, প্রতীকী পুঁজি এবং পৃষ্ঠপোষকতার কাঠামোকে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলো কৌশলে ব্যবহার করে পরিবারতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখে। এই কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসা ছাড়া রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
পরিবারতন্ত্রের এই প্রভাব দূর করতে হলে প্রয়োজন গণসচেতনতার উদ্বোধন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের গভীর চর্চা এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্বের মাঝে সৃজনশীল ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ। জনগণকে বোঝাতে হবে যে, ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি নয়, বরং সামগ্রিক তথা সামষ্ঠিক কল্যাণকেন্দ্রিক নেতৃত্বই একটি সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের ভিত্তি। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির উন্মেষ ঘটাতে হলে সুশিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে সুনাগরিক ও দেশপ্রেমিক শাসক তৈরি, নাগরিক অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং তরুণদের নেতৃত্বে আসার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এছাড়া, রাজনৈতিক নেতৃত্বে সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে দলীয় কাঠামোতে স্বচ্ছতা এবং যোগ্যতাভিত্তিক নেতৃত্ব বেছে নেয়ার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে। দলগুলোকে এমন একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, যেখানে বৈচিত্র্যময় চিন্তাধারা এবং উদ্ভাবনী নীতির প্রয়োগ সম্ভব হয়। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও ধারাবাহিক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই শুধু আমরা এই কাঠামো থেকে বেরিয় এসে একটি সুশৃঙ্খল, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং গণতান্ত্রিক সমাজ গঠন করতে সক্ষম হব।
স্বাধীনতার পর থেকে ক্রমশ গড়ে ওঠা পরিবারতন্ত্রের গভীর শিকড় সহজেই উপড়ে ফেলা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন ধৈর্য, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং কঠোর পরিশ্রম। আমাদের মনে রাখতে হবে, বিবর্তনের ধারা সমাজ পরিবর্তন একটি সময়সাপেক্ষ বিষয়। রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার যন্ত্রের বিদ্যমান সমস্যাগুলোর রাতারাতি সমাধান খোঁজার চেষ্টা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দীর্ঘ সময় ধরে বেড়ে ওঠা জঞ্জালগুলো নিমিষেই কেটে ছাপ করা যাবে না। তাই ক্ষমতার বৈষম্য কমিয়ে আনার প্রক্রিয়া হতে হবে ধারাবাহিক এবং সুনির্দিষ্ট। সুবিধাভোগিরা অবশ্যই বাধা হয়ে দাঁড়াবে, কারণ এই বৈষম্যই পরিবারতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার প্রধান চালিকাশক্তি।
পরিবারতন্ত্রের অবসান ঘটাতে, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতীকী পুঁজির অপব্যবহার রোধে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। নেতাদের ব্যক্তিগত ইমেজ বা পারিবারিক পরিচয়ের ভিত্তিতে জনসমর্থন অর্জনের যে সুবিধা তারা ভোগ করেন, তা সম্পর্কে জনগণকে জনশিক্ষা, গণমাধ্যম এবং সচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে অবহিত করতে হবে। সচেতন ও সমালোচনামুখর জনগোষ্ঠী দলীয় অন্ধত্ব বা ‘দলকানা’ মানসিকতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। এছাড়া দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সুব্যবস্থাপনার পরিবেশের অভাব দূর করা অপরিহার্য। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অনুশীলন নিশ্চিত করতে হবে এবং সেই প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতার উপর নজরদারি চালাতে হবে। এ কাজটি করার জন্যে একটি স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান গঠন করা যেতে পারে যেটা দলগুলোর ব্যবস্থাপনা ও কর্মকান্ডের উপর নজরদারি করবে এবং এর হাতে ক্ষমতা থাকবে রাজনৈতিক দলের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ কিংবা দলের নিবন্ধ বাতিলের সুপারিশ করার। ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণকে নিরুৎসাহিত করতে স্থানীয় সরকার এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি, কারণ এই দুর্বলতাই কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার মূল কারণ। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা, জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, এবং সুশাসনের চর্চার মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটানো সম্ভব। শুধু এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদি এবং কার্যকর উদ্যোগই পরিবারতন্ত্রের প্রভাবকে খর্ব করে একটি গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক, এবং সুশাসনভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় উত্তরণে সহায়ক হতে পারে।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুফল পেতে রাষ্ট্রসংস্কারের জন্য পরিবারতত্ত্বকে শুধু একটি ধারণা হিসেবে নয়, বাস্তবতায় রূপ দিতে হবে। মুহাম্মদ ইউনূসের পরিবারতত্ত্ব থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে রাষ্ট্রকে এমন একটি কাঠামোতে রূপান্তরিত করতে হবে, যেখানে প্রতিটি নাগরিকের মর্যাদা, অধিকার এবং সুযোগ নিশ্চিত হয়। এ কাঠামো শুধু মানবিকতা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে গড়ে উঠবে না, বরং সমতা ও ন্যায়বিচারকেও প্রাধান্য দেবে। পরিবারতন্ত্রের অবসান ঘটানো শুধু রাজনীতির জন্যই নয়, সামগ্রিকভাবে সমাজের জন্যও অপরিহার্য। এটি অর্জনের জন্য গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ অপরিহার্য। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সামাজিক এবং রাজনৈতিক স্তরে সুদৃঢ় করতে হবে, যাতে নেতৃত্বে সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন, এবং অংশগ্রহণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি স্থান পায়।
এভাবে পরিবারতন্ত্রের পরিবর্তে পরিবারতত্ত্বের আলোকে গড়ে তুলতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রকাঠামো। এই কাঠামো ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সবার জন্য সুযোগের ন্যায্যতা সৃষ্টি করবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে পুনর্গঠনের মাধ্যমে একটি সমতাভিত্তিক ও মানবিক রাষ্ট্র গঠন সম্ভব, যা একটি সমৃদ্ধ এবং প্রগতিশীল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]