শতদল বড়ুয়া
বনে যদি ফুটলো কুসুম নেই কেনো সেই পাখি।/ কোন্ সুদূরের আকাশ হতে আনবো তারে ডাকি?
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ প্রশ্ন করেছেন তার এক কবিতায় বা গানে। কবিগুরুর প্রয়াণ পরবর্তী অর্ধশতাব্দীকালেরও বেশি সময় অতিবাহিত হয়ে গেলেও তার এ প্রশ্নের জবাব আমরা খুঁজে পাইনি। বাংলাদেশে বর্তমানে সেই অতীতকালের অনেক চির চেনাজানা পাখির দেখা মেলে না, এমন কি আমাদের এ দেশের আরও অগণিত পাখি ‘নেই’র মতো হারিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি অনেক প্রজাতির কুসুমও ফোটে না। ভরা বসন্ত কুসুমের মাস, এ মাসেও সেই আগের কুসুমের সমারোহ নেই। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উল্লিখিত জিজ্ঞাসার শেষাংশের জবাবে সবিনয় বলতে ইচ্ছে করে, বাংলার এসব ‘নেই’ হয়ে যাওয়া পাখিদের সুদূরতম আকাশ থেকেও কোনোদিন ফিরিয়ে আনা যাবে না। হয়তো বা সারাবিশ্বের প্রকৃতি থেকেই চিরদিনের জন্যে ওরা হারিয়ে গেছে।
বাংলাদেশের পাখি প্রজাতির এটাই সবচেয়ে খারাপ খবর। এজন্যে তথ্য-উপাত্তের প্রয়োজন না হলেও এ দেশের সাধারণ মানুষ অভিজ্ঞতার আলোকে বলে দিতে পারবে অনেক পরিচিত পাখি চোখে পড়ে না। গ্রামীণ ও আরণ্যক প্রকৃতি পরিবেশে খেটে খাওয়া অনেক মানুষের যাতায়াত রয়েছে। কারণ তারা পেটের তাগিদে গভীর বনে ঢুকে জ্বালানি কাঠসহ নানাবিধ দ্রব্য সামগ্রী সংগ্রহ করে। এমন একজন থেকে জানতে চাই চিরচেনা কয়েকটা পাখির কথা। তার সাফ জবাব বনে আগের মতো পাখির কলকাকলি নেই, নেই আমার চেনা অনেক পাখি।
আমরা এখন ভোররাতে শুনি না পাখির ডাক। ঈগল, কোকিল, কুর্গাল দেখাত ভাগ্যের ব্যাপার। কুর্গাল বাচ্চার ডাক শুনলে গা শিহরিয়ে উঠে। যেন মানব শিশু কান্না করছে। দুধসাদা জোছনা ধোয়া ফাগুন রাতে প্রেমিক প্রাণ আর জেগে ওঠে না পাপিয়ার ‘চোখ গেল’ ডাকে আর গানে। বাজ পাখিকে আর বিলে, জঙ্গলে, জলাশয়ে, বৃক্ষে দেখা যায় না। বাজপাখির অসাধারণ ক্ষমতা। এ পাখি বিষধর সাপের সঙ্গে অসম লড়াইয়ে লিপ্ত হয় দীর্ঘক্ষণ। পরিশেষে ওই সাপকে মেরে বাজপাখি উদরস্থ করে। মাছখেকো আরেক পাখি আছে এটির নাম ‘কুড়কাল’ আমাদের আঞ্চলিক ভাষায়। আমি নিজে প্রত্যক্ষ এবং এ পাখি থেকে মাছ নিয়ে ফেলেছি। পুকুরপাড়ের গাছের ঢালে বসে এক ধরনের শব্দ করে। এ শব্দের আওয়াজে মাছ একেবারে পুকুরপাড় ঘেঁষে চলে আসে। কুড়কাল গাছের ঢাল থেকে উড়ে নিচে নেমে পায়ের নখের সাহায্যে মাছ ধরে গাছে নিয়ে তারপর উদরস্থ করে। এখন এ কুড়কাল পাখি নির্বাসনে। এতো ‘নেই’ মধ্যেও বাংলাদেশ কিন্তু পাখির দেশ। নানা তথ্য উপাত্ত থেকে জানা যায় আমাদের এ দেশে ৬৫০ প্রজাতির পাখি রয়েছে। অপ্রিয় সত্যি কথা হলো-এর মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগ ‘পরিযায়ী’ বা মাইগ্রেটরি পাখি। বাকি সব পাখি আমাদের স্থানীয়।
বাংলাদেশে এখনকার সময়ের বড় পাখি হলো হাড়গিলা, আর ছোট পাখি টুনটুনি বা হামিং বার্ড জাতীয় পাখি ফুলঝুরি (টিক্ল ফ্লাওয়ার পেকার)। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও সুন্দরের শীর্ষে রয়েছে ‘প্যারাডাইস ফ্লাই ক্যাচার’ যাকে আমরা বাংলা ভাষায় বলি ‘শাহি বুলবুল’। হারিয়ে যাওয়া ও এখনকার এই বহুল প্রজাতির পাখিরা হাজার বছর ধরে বাংলাদেশের পরিবেশ তথা বনায়ন ও অরণ্য প্রকৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। প্রকৃতির হাজার রকমের অলংকার হিসেবেও উল্লিখিত পাখিগুলো ছিল নানাবিধ বর্ণে, ছন্দে, দৃশ্যময় এবং সুরে প্রাণময়।
আমাদের মমতাময়ী এই বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি পাখির নিরাপদস্থল ছিল সিলেটের নেত্রকোনার হাওর অঞ্চলসহ সারাদেশের স্বাদু পানির জলাভূমি। সিলেটের রেইন ফরেস্ট, টেকনাফের বনাঞ্চল, মধুপুর ভাওয়ালের শালবন, রিডল্যান্ড ফরেস্ট, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ, বৃহত্তর ময়মনসিংহের গারো পাহাড় অঞ্চলসহ প্রভৃতিও বহু বিচিত্র রকমের পাখির বাসের নির্ভরযোগ্য হিসেবে বহুল পরিচিত। এসব পাখি ও আবাসস্থল নিয়ে বাংলাদেশের প্রকৃতি সংরক্ষণ কমিটি নামে বেসরকারি সংস্থা পাখিদের বিভিন্ন প্রজাতি ও আবাস সংরক্ষণে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সোসাইটি, প্রকৃতি সংরক্ষণ আন্দোলন, বাংলাদেশ পক্ষী ক্লাব, নটর ডেম প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ ক্লাব, মুন্সীগঞ্জ প্রকৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্র প্রভৃতি সংগঠনও পাখিদের সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপে সক্রিয় রয়েছে বলে জানা গেছে।
আমরা সবাই জানি, আমাদের এ দেশে পাখি দেখার উৎকৃষ্ট জায়গা সিলেটের শ্রীমঙ্গল। শ্রীমঙ্গল এলাকায় প্রায় পনেরশ বর্গমিটার পরিমাপের মধ্যে দুইশ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে বলে বিজ্ঞমহলের ভাষ্য। দেশের সাধারণ জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা প্রকৃতিবিহার বা ইকো-ট্যুরিজমের একটা বিশেষ আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে সিলেটের এ এলাকাকে গড়ে তোলা হোক। বিজ্ঞামহলের অভিমতও তাই। কারণ বাংলাদেশের ঐতিহ্য ধীরগতিতে হারিয়ে যাচ্ছে। ঐতিহ্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা না গেলে আগামী প্রজন্মের কাছে আমরা দায়ী থাকব।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ]
শতদল বড়ুয়া
বৃহস্পতিবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
বনে যদি ফুটলো কুসুম নেই কেনো সেই পাখি।/ কোন্ সুদূরের আকাশ হতে আনবো তারে ডাকি?
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ প্রশ্ন করেছেন তার এক কবিতায় বা গানে। কবিগুরুর প্রয়াণ পরবর্তী অর্ধশতাব্দীকালেরও বেশি সময় অতিবাহিত হয়ে গেলেও তার এ প্রশ্নের জবাব আমরা খুঁজে পাইনি। বাংলাদেশে বর্তমানে সেই অতীতকালের অনেক চির চেনাজানা পাখির দেখা মেলে না, এমন কি আমাদের এ দেশের আরও অগণিত পাখি ‘নেই’র মতো হারিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি অনেক প্রজাতির কুসুমও ফোটে না। ভরা বসন্ত কুসুমের মাস, এ মাসেও সেই আগের কুসুমের সমারোহ নেই। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উল্লিখিত জিজ্ঞাসার শেষাংশের জবাবে সবিনয় বলতে ইচ্ছে করে, বাংলার এসব ‘নেই’ হয়ে যাওয়া পাখিদের সুদূরতম আকাশ থেকেও কোনোদিন ফিরিয়ে আনা যাবে না। হয়তো বা সারাবিশ্বের প্রকৃতি থেকেই চিরদিনের জন্যে ওরা হারিয়ে গেছে।
বাংলাদেশের পাখি প্রজাতির এটাই সবচেয়ে খারাপ খবর। এজন্যে তথ্য-উপাত্তের প্রয়োজন না হলেও এ দেশের সাধারণ মানুষ অভিজ্ঞতার আলোকে বলে দিতে পারবে অনেক পরিচিত পাখি চোখে পড়ে না। গ্রামীণ ও আরণ্যক প্রকৃতি পরিবেশে খেটে খাওয়া অনেক মানুষের যাতায়াত রয়েছে। কারণ তারা পেটের তাগিদে গভীর বনে ঢুকে জ্বালানি কাঠসহ নানাবিধ দ্রব্য সামগ্রী সংগ্রহ করে। এমন একজন থেকে জানতে চাই চিরচেনা কয়েকটা পাখির কথা। তার সাফ জবাব বনে আগের মতো পাখির কলকাকলি নেই, নেই আমার চেনা অনেক পাখি।
আমরা এখন ভোররাতে শুনি না পাখির ডাক। ঈগল, কোকিল, কুর্গাল দেখাত ভাগ্যের ব্যাপার। কুর্গাল বাচ্চার ডাক শুনলে গা শিহরিয়ে উঠে। যেন মানব শিশু কান্না করছে। দুধসাদা জোছনা ধোয়া ফাগুন রাতে প্রেমিক প্রাণ আর জেগে ওঠে না পাপিয়ার ‘চোখ গেল’ ডাকে আর গানে। বাজ পাখিকে আর বিলে, জঙ্গলে, জলাশয়ে, বৃক্ষে দেখা যায় না। বাজপাখির অসাধারণ ক্ষমতা। এ পাখি বিষধর সাপের সঙ্গে অসম লড়াইয়ে লিপ্ত হয় দীর্ঘক্ষণ। পরিশেষে ওই সাপকে মেরে বাজপাখি উদরস্থ করে। মাছখেকো আরেক পাখি আছে এটির নাম ‘কুড়কাল’ আমাদের আঞ্চলিক ভাষায়। আমি নিজে প্রত্যক্ষ এবং এ পাখি থেকে মাছ নিয়ে ফেলেছি। পুকুরপাড়ের গাছের ঢালে বসে এক ধরনের শব্দ করে। এ শব্দের আওয়াজে মাছ একেবারে পুকুরপাড় ঘেঁষে চলে আসে। কুড়কাল গাছের ঢাল থেকে উড়ে নিচে নেমে পায়ের নখের সাহায্যে মাছ ধরে গাছে নিয়ে তারপর উদরস্থ করে। এখন এ কুড়কাল পাখি নির্বাসনে। এতো ‘নেই’ মধ্যেও বাংলাদেশ কিন্তু পাখির দেশ। নানা তথ্য উপাত্ত থেকে জানা যায় আমাদের এ দেশে ৬৫০ প্রজাতির পাখি রয়েছে। অপ্রিয় সত্যি কথা হলো-এর মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগ ‘পরিযায়ী’ বা মাইগ্রেটরি পাখি। বাকি সব পাখি আমাদের স্থানীয়।
বাংলাদেশে এখনকার সময়ের বড় পাখি হলো হাড়গিলা, আর ছোট পাখি টুনটুনি বা হামিং বার্ড জাতীয় পাখি ফুলঝুরি (টিক্ল ফ্লাওয়ার পেকার)। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও সুন্দরের শীর্ষে রয়েছে ‘প্যারাডাইস ফ্লাই ক্যাচার’ যাকে আমরা বাংলা ভাষায় বলি ‘শাহি বুলবুল’। হারিয়ে যাওয়া ও এখনকার এই বহুল প্রজাতির পাখিরা হাজার বছর ধরে বাংলাদেশের পরিবেশ তথা বনায়ন ও অরণ্য প্রকৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। প্রকৃতির হাজার রকমের অলংকার হিসেবেও উল্লিখিত পাখিগুলো ছিল নানাবিধ বর্ণে, ছন্দে, দৃশ্যময় এবং সুরে প্রাণময়।
আমাদের মমতাময়ী এই বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি পাখির নিরাপদস্থল ছিল সিলেটের নেত্রকোনার হাওর অঞ্চলসহ সারাদেশের স্বাদু পানির জলাভূমি। সিলেটের রেইন ফরেস্ট, টেকনাফের বনাঞ্চল, মধুপুর ভাওয়ালের শালবন, রিডল্যান্ড ফরেস্ট, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ, বৃহত্তর ময়মনসিংহের গারো পাহাড় অঞ্চলসহ প্রভৃতিও বহু বিচিত্র রকমের পাখির বাসের নির্ভরযোগ্য হিসেবে বহুল পরিচিত। এসব পাখি ও আবাসস্থল নিয়ে বাংলাদেশের প্রকৃতি সংরক্ষণ কমিটি নামে বেসরকারি সংস্থা পাখিদের বিভিন্ন প্রজাতি ও আবাস সংরক্ষণে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সোসাইটি, প্রকৃতি সংরক্ষণ আন্দোলন, বাংলাদেশ পক্ষী ক্লাব, নটর ডেম প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ ক্লাব, মুন্সীগঞ্জ প্রকৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্র প্রভৃতি সংগঠনও পাখিদের সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপে সক্রিয় রয়েছে বলে জানা গেছে।
আমরা সবাই জানি, আমাদের এ দেশে পাখি দেখার উৎকৃষ্ট জায়গা সিলেটের শ্রীমঙ্গল। শ্রীমঙ্গল এলাকায় প্রায় পনেরশ বর্গমিটার পরিমাপের মধ্যে দুইশ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে বলে বিজ্ঞমহলের ভাষ্য। দেশের সাধারণ জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা প্রকৃতিবিহার বা ইকো-ট্যুরিজমের একটা বিশেষ আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে সিলেটের এ এলাকাকে গড়ে তোলা হোক। বিজ্ঞামহলের অভিমতও তাই। কারণ বাংলাদেশের ঐতিহ্য ধীরগতিতে হারিয়ে যাচ্ছে। ঐতিহ্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা না গেলে আগামী প্রজন্মের কাছে আমরা দায়ী থাকব।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ]