এম এ হোসাইন
বাংলাদেশের আটকে পড়া পাকিস্তানি বিহারি সম্প্রদায়ের দুর্দশা দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের একটি করুণ অধ্যায়, যা এখনও সমাধানহীন। এই অবহেলিত মানুষÑ যারা ৬৬টি জরাজীর্ণ ক্যাম্পে অমানবিক অবস্থায় জীবনযাপন করছেÑ বহু দশক ধরে উপেক্ষিত, রাজনৈতিক অপব্যবহার এবং কাঠামোগত বৈষম্যের শিকার। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে ওআইসির মতো সংস্থাগুলো একসময় সহায়তা প্রদান করলেও, সেই প্রচেষ্টা থেমে গেছে। ফলে প্রায় ৫ লাখ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিহীন মানুষ চরমভাবে অবহেলার মধ্যে আটকা পড়ে আছে। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তাদের ইতিহাস গভীরভাবে জড়িত, যা আজও বাংলাদেশিদের হৃদয়ে দীর্ঘ ছায়া ফেলে রেখেছে। এ বিষয়ে সমাধান বা সহানুভূতির অভাব তাদের দুর্ভোগকে আরও গভীর করে তুলেছে।
বিহারিরা মূলত বিহার, পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আগত উর্দুভাষী অভিবাসী, যারা ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) চলে আসেন। তারা নিজেদের পাকিস্তানি রাষ্ট্রের সঙ্গে একীভূত করেছিলেন, কারণ তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই পরিচয় তাদের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এবং অন্যান্য সংঘর্ষের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে তাদের দেখা যায় এবং অনেক বিহারি বাঙালিদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। পাকিস্তানের প্রতি তাদের আনুগত্য নবগঠিত স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কাছ থেকে তাদের সর্বজন বিচ্ছিন্ন করে তোলে।
যুদ্ধের পর, বিহারিরা চরম প্রতিশোধ ও সমাজচ্যুতির শিকার হন। বাংলাদেশ সরকার তাদের শত্রু হিসেবে দেখত, আর পাকিস্তানÑ যাদের তারা সমর্থন করেছিলÑ তারা বিহারিদের প্রতি দায়িত্বহীন আচরণ করে। ফলে অর্ধ কোটি মানুষ রাষ্ট্রহীনতার এক দুঃসহ অবস্থায় আটকে পড়ে, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ উভয় দেশের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হয়। এই অবহেলা তাদের ভাগ্যকে একটি বিচ্ছিন্ন এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে দৃঢ়ভাবে স্থির করে দেয়, যারা সমাজে সম্পূর্ণরূপে একীভূত হতে অক্ষম।
যুদ্ধের পর বিহারিদের পাকিস্তানে পুনর্বাসনের জন্য কিছু প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল। তবে এই উদ্যোগগুলো খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। প্রথমদিকে কয়েকটি ফ্লাইট কিছু পরিবারকে পাকিস্তানে নিয়ে গেলেও, রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের পরিবর্তনের কারণে সেই কর্মসূচি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। পাকিস্তানের পরপর সরকারগুলো তাদের প্রতি নৈতিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়। এই বিহারিরা এমন একটি সম্প্রদায়, যারা সব সময় পাকিস্তান সরকারের প্রতি অবিচল আনুগত্য দেখিয়েছিল।
উল্লেখযোগ্যভাবে, ১৯৮৮ সালে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যা যথাযথ তহবিল সংগ্রহ সাপেক্ষে কার্যকরের কথা ছিল। তবে আগের ও পরের অনেক প্রতিশ্রুতির মতোই এটি কখনো বাস্তবায়িত হয়নি। বিশ্ব মুসলিম লীগের মতো সংস্থাগুলোর আর্থিক সহায়তা থাকা সত্ত্বেও বিহারিদের পুনর্বাসন এখনও একটি সুদূর স্বপ্ন রয়ে গেছে। আজও এই মানুষগুলো বিচ্ছিন্ন জরাজীর্ণ এলাকার মধ্যে বন্দী হয়ে আছে। এটা শুধু রাজনৈতিক উদাসীনতারই প্রতিফলন।
১৯৭২ সালে বেন হুইটেকারের মাইনরিটিজ গ্রুপ রিপোর্ট-এ উল্লেখ করা হয়েছিল, ‘পাকিস্তানিদের অবশ্যই তাদের নৈতিক দায়িত্ব পালন করা উচিত এবং অন্তত তাদের সেই সমস্ত বিহারিদের গ্রহণ করা উচিত, যাদের প্রতি আনুগত্যই আজ তাদের এই দুর্দশার কারণ।’ কয়েক দশক পরেও এই কথাগুলো আজ আরও সত্য প্রতীয়মান হয়, কারণ পাকিস্তানের এই নৈতিক ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে নীরবতা এখনও অটুট রয়েছে।
বাংলাদেশে বিহারিদের বর্তমান বসবাসের অবস্থা ভয়াবহ। ঢাকাসহ ১৩টি জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা বস্তিগুলো অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে জর্জরিত, অস্বাস্থ্যকর এবং সব মৌলিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বিহারিদের একাধিক প্রজন্ম এই ক্যাম্পগুলোতে বেড়ে উঠেছে, দারিদ্র, বেকারত্ব এবং সামাজিক বঞ্চনার এক অবিরাম চক্রের সঙ্গে।
রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিহীন এই মানুষগুলো এখনও বাংলাদেশের মূলধারার সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন রয়ে গেছে। অনেকেই বাংলা ভাষা বলতে পারেন না এবং তাদের সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত পরিচয় তাদের আলাদা করে রেখেছে। ফলে, একীভূত হওয়া একটি দুরূহ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও কিছু তরুণ প্রজন্ম অভিযোজনের চেষ্টা করছে, তবুও ঐতিহাসিক শত্রুতার গভীর ক্ষত এখনো রয়ে গেছে। অনেক বাংলাদেশির দৃষ্টিতে, বিহারিরা এখনও ১৯৭১ সালের সংঘাতের প্রেক্ষাপটেই বিবেচিত হয়।
বিহারি সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক পক্ষপাতিত্বের এই দুর্বলতা তাদের শোষণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। বছরের পর বছর ধরে এই ক্যাম্পগুলো অবৈধ কার্যকলাপের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে, যার মধ্যে মাদক এবং মানবপাচার অন্তর্ভুক্ত। তবে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, কিছু স্বার্থান্বেষী মহল বিহারি সম্প্রদায়ের হতাশাকে ব্যবহার করে বাংলাদেশ এবং অঞ্চলিক অস্থিরতা ছড়ানোর চেষ্টা করেছে।
প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছে যে, বিহারিদের প্রান্তিক অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে কিছু মহল চরমপন্থী মতাদর্শ এবং রাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব উসকে দিচ্ছে। এই অপব্যবহারের ফলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে এবং আঞ্চলিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। যুগের পর যুগ ধরে অবহেলা, শোষণ এবং পুনর্বাসনের সুযোগের অভাবই এই সম্প্রদায়ের মধ্যে চরমপন্থী মনোভাবের উত্থান ঘটছে।
বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের সমস্যা একটি বৈশ্বিক সহানুভূতিশীল ও সচেতন প্রতিক্রিয়া দাবি করে। অস্বস্তিকর সত্যগুলোকে উপেক্ষা করে বা ঐতিহাসিক বিশ্বাসঘাতকতাকে ধামাচাপা দিয়ে কোনো সমাধান সম্ভব নয়, বরং বিহারিদের দুর্দশাকে প্রকাশ্যে স্বীকার করে তাদের অভিযোগ নিরসনে একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালানোর প্রয়োজন।
পাকিস্তানের দৃষ্টিকোণ থেকে, কয়েক দশকের অবহেলার জন্য দোষ স্বীকার করে ইচ্ছুক জনসংখ্যার প্রত্যাবর্তনের একটি টেকসই পদক্ষেপ নেয়া এখন নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এই সম্প্রদায়ের প্রতি পুনর্বাসন, প্রত্যাবাসন বা যথার্থ সহায়তার মাধ্যমে একটি সমাপ্তি টানার প্রচেষ্টা দায়িত্বশীলতা এবং ন্যায়বিচারের প্রতি প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করবে। জাপানি ধারণা ‘ওমোইয়ারি’ আমাদের শেখায় যে, জ্ঞানভিত্তিক সহানুভূতি ও সম্মিলিত দায়বদ্ধতা গভীরভাবে প্রোথিত ঐতিহাসিক ক্ষত নিরসনে অপরিহার্য।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, বিহারিদের সমাজে অন্তর্ভুক্তির জন্য আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা বা ইচ্ছুক ব্যক্তিদের প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্মিলনের পথ সুগম করতে পারে। ১৯৭১ সালের ক্ষত অস্বীকারযোগ্য হলেও, বাংলাদেশের তরুণ বিহারি প্রজন্ম তাদের গৃহীত মাতৃভূমির জন্য ইতিবাচকভাবে অবদান রাখার সুযোগ পাওয়ার যোগ্য। তাদের এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা ক্ষোভ ও বঞ্চনার এক চক্রকে অব্যাহত রাখে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও বিহারি সম্প্রদায়ের দুর্দশার প্রতি নজর দিতে হবে। ওআইসির মতো সংস্থাগুলো, যারা একসময় সহায়তা দিয়েছিল, তাদের টেকসই সমাধান খুঁজে বের করার প্রতিশ্রুতি নতুন করে শুরু করা উচিত। মানবাধিকার সংগঠনগুলো, আঞ্চলিক জোট এবং বৈশ্বিক শক্তিগুলোকে অবশ্যই পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে এই মানবিক সংকট সমাধানের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
এই সমস্যা শুধু একটি রাজনৈতিক বা ঐতিহাসিক সমস্যা নয়Ñ এটি একটি মানবিক বিপর্যয় যা সহানুভূতি ও কার্যকরী পদক্ষেপের প্রয়োজন। রাষ্ট্রহীনতা, দারিদ্রতা, বঞ্চনা, মানব মর্যাদার প্রতি আঘাত, এই পরিস্থিতিগুলোকে অব্যাহত রাখতে দেয়া সম্মিলিত মানবতার ব্যর্থতা।
বিহারি সম্প্রদায়ের এই উপেক্ষিত সংগ্রাম বাংলাদেশে যুগ যুগ ধরে অবহেলিত জীবন- গোটা মানব সমাজের এক বিশ্বাসঘাতকতা, উদাসীনতা এবং শোষণের প্রতিফলন। এই বিহারি সম্প্রদায়, যারা একসময় পাকিস্তানের ওপর নির্ভর করেছিল, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর আজ সেই পাকিস্তানি সরকার কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়ে রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ে আছে। তাদের কাহিনী এক মহাযন্ত্রণার, কিন্তু একই সঙ্গে আমরা তাদের যন্ত্রণা লাঘবে কতটুকু উদ্যোগ নেয়ার চেষ্টা করেছি তাও দেখার বিষয়।
বিহারিদের দুর্দশা মোকাবিলা করা শুধু ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতার বিষয় নয়Ñ এটি অবহেলিত মানুষের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করা এবং অতীতের শিক্ষাগুলোকে এমনভাবে প্রয়োগ করা যাতে আমরা একটি অধিক সহানুভূতিশীল ও ন্যায়সঙ্গত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারি। বৈশ্বিক নেতাদের পদক্ষেপ নেয়ার এখনই সময়, তা না হলে এই অমীমাংসিত ক্ষোভগুলো আরও গভীর বিভাজন ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে গোটা দক্ষিণ এশিয়াকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
[লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক]
এম এ হোসাইন
শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলাদেশের আটকে পড়া পাকিস্তানি বিহারি সম্প্রদায়ের দুর্দশা দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের একটি করুণ অধ্যায়, যা এখনও সমাধানহীন। এই অবহেলিত মানুষÑ যারা ৬৬টি জরাজীর্ণ ক্যাম্পে অমানবিক অবস্থায় জীবনযাপন করছেÑ বহু দশক ধরে উপেক্ষিত, রাজনৈতিক অপব্যবহার এবং কাঠামোগত বৈষম্যের শিকার। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে ওআইসির মতো সংস্থাগুলো একসময় সহায়তা প্রদান করলেও, সেই প্রচেষ্টা থেমে গেছে। ফলে প্রায় ৫ লাখ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিহীন মানুষ চরমভাবে অবহেলার মধ্যে আটকা পড়ে আছে। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তাদের ইতিহাস গভীরভাবে জড়িত, যা আজও বাংলাদেশিদের হৃদয়ে দীর্ঘ ছায়া ফেলে রেখেছে। এ বিষয়ে সমাধান বা সহানুভূতির অভাব তাদের দুর্ভোগকে আরও গভীর করে তুলেছে।
বিহারিরা মূলত বিহার, পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আগত উর্দুভাষী অভিবাসী, যারা ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) চলে আসেন। তারা নিজেদের পাকিস্তানি রাষ্ট্রের সঙ্গে একীভূত করেছিলেন, কারণ তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই পরিচয় তাদের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এবং অন্যান্য সংঘর্ষের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে তাদের দেখা যায় এবং অনেক বিহারি বাঙালিদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। পাকিস্তানের প্রতি তাদের আনুগত্য নবগঠিত স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কাছ থেকে তাদের সর্বজন বিচ্ছিন্ন করে তোলে।
যুদ্ধের পর, বিহারিরা চরম প্রতিশোধ ও সমাজচ্যুতির শিকার হন। বাংলাদেশ সরকার তাদের শত্রু হিসেবে দেখত, আর পাকিস্তানÑ যাদের তারা সমর্থন করেছিলÑ তারা বিহারিদের প্রতি দায়িত্বহীন আচরণ করে। ফলে অর্ধ কোটি মানুষ রাষ্ট্রহীনতার এক দুঃসহ অবস্থায় আটকে পড়ে, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ উভয় দেশের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হয়। এই অবহেলা তাদের ভাগ্যকে একটি বিচ্ছিন্ন এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে দৃঢ়ভাবে স্থির করে দেয়, যারা সমাজে সম্পূর্ণরূপে একীভূত হতে অক্ষম।
যুদ্ধের পর বিহারিদের পাকিস্তানে পুনর্বাসনের জন্য কিছু প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল। তবে এই উদ্যোগগুলো খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। প্রথমদিকে কয়েকটি ফ্লাইট কিছু পরিবারকে পাকিস্তানে নিয়ে গেলেও, রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের পরিবর্তনের কারণে সেই কর্মসূচি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। পাকিস্তানের পরপর সরকারগুলো তাদের প্রতি নৈতিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়। এই বিহারিরা এমন একটি সম্প্রদায়, যারা সব সময় পাকিস্তান সরকারের প্রতি অবিচল আনুগত্য দেখিয়েছিল।
উল্লেখযোগ্যভাবে, ১৯৮৮ সালে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যা যথাযথ তহবিল সংগ্রহ সাপেক্ষে কার্যকরের কথা ছিল। তবে আগের ও পরের অনেক প্রতিশ্রুতির মতোই এটি কখনো বাস্তবায়িত হয়নি। বিশ্ব মুসলিম লীগের মতো সংস্থাগুলোর আর্থিক সহায়তা থাকা সত্ত্বেও বিহারিদের পুনর্বাসন এখনও একটি সুদূর স্বপ্ন রয়ে গেছে। আজও এই মানুষগুলো বিচ্ছিন্ন জরাজীর্ণ এলাকার মধ্যে বন্দী হয়ে আছে। এটা শুধু রাজনৈতিক উদাসীনতারই প্রতিফলন।
১৯৭২ সালে বেন হুইটেকারের মাইনরিটিজ গ্রুপ রিপোর্ট-এ উল্লেখ করা হয়েছিল, ‘পাকিস্তানিদের অবশ্যই তাদের নৈতিক দায়িত্ব পালন করা উচিত এবং অন্তত তাদের সেই সমস্ত বিহারিদের গ্রহণ করা উচিত, যাদের প্রতি আনুগত্যই আজ তাদের এই দুর্দশার কারণ।’ কয়েক দশক পরেও এই কথাগুলো আজ আরও সত্য প্রতীয়মান হয়, কারণ পাকিস্তানের এই নৈতিক ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে নীরবতা এখনও অটুট রয়েছে।
বাংলাদেশে বিহারিদের বর্তমান বসবাসের অবস্থা ভয়াবহ। ঢাকাসহ ১৩টি জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা বস্তিগুলো অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে জর্জরিত, অস্বাস্থ্যকর এবং সব মৌলিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বিহারিদের একাধিক প্রজন্ম এই ক্যাম্পগুলোতে বেড়ে উঠেছে, দারিদ্র, বেকারত্ব এবং সামাজিক বঞ্চনার এক অবিরাম চক্রের সঙ্গে।
রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিহীন এই মানুষগুলো এখনও বাংলাদেশের মূলধারার সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন রয়ে গেছে। অনেকেই বাংলা ভাষা বলতে পারেন না এবং তাদের সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত পরিচয় তাদের আলাদা করে রেখেছে। ফলে, একীভূত হওয়া একটি দুরূহ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও কিছু তরুণ প্রজন্ম অভিযোজনের চেষ্টা করছে, তবুও ঐতিহাসিক শত্রুতার গভীর ক্ষত এখনো রয়ে গেছে। অনেক বাংলাদেশির দৃষ্টিতে, বিহারিরা এখনও ১৯৭১ সালের সংঘাতের প্রেক্ষাপটেই বিবেচিত হয়।
বিহারি সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক পক্ষপাতিত্বের এই দুর্বলতা তাদের শোষণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। বছরের পর বছর ধরে এই ক্যাম্পগুলো অবৈধ কার্যকলাপের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে, যার মধ্যে মাদক এবং মানবপাচার অন্তর্ভুক্ত। তবে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, কিছু স্বার্থান্বেষী মহল বিহারি সম্প্রদায়ের হতাশাকে ব্যবহার করে বাংলাদেশ এবং অঞ্চলিক অস্থিরতা ছড়ানোর চেষ্টা করেছে।
প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছে যে, বিহারিদের প্রান্তিক অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে কিছু মহল চরমপন্থী মতাদর্শ এবং রাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব উসকে দিচ্ছে। এই অপব্যবহারের ফলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে এবং আঞ্চলিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। যুগের পর যুগ ধরে অবহেলা, শোষণ এবং পুনর্বাসনের সুযোগের অভাবই এই সম্প্রদায়ের মধ্যে চরমপন্থী মনোভাবের উত্থান ঘটছে।
বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের সমস্যা একটি বৈশ্বিক সহানুভূতিশীল ও সচেতন প্রতিক্রিয়া দাবি করে। অস্বস্তিকর সত্যগুলোকে উপেক্ষা করে বা ঐতিহাসিক বিশ্বাসঘাতকতাকে ধামাচাপা দিয়ে কোনো সমাধান সম্ভব নয়, বরং বিহারিদের দুর্দশাকে প্রকাশ্যে স্বীকার করে তাদের অভিযোগ নিরসনে একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালানোর প্রয়োজন।
পাকিস্তানের দৃষ্টিকোণ থেকে, কয়েক দশকের অবহেলার জন্য দোষ স্বীকার করে ইচ্ছুক জনসংখ্যার প্রত্যাবর্তনের একটি টেকসই পদক্ষেপ নেয়া এখন নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এই সম্প্রদায়ের প্রতি পুনর্বাসন, প্রত্যাবাসন বা যথার্থ সহায়তার মাধ্যমে একটি সমাপ্তি টানার প্রচেষ্টা দায়িত্বশীলতা এবং ন্যায়বিচারের প্রতি প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করবে। জাপানি ধারণা ‘ওমোইয়ারি’ আমাদের শেখায় যে, জ্ঞানভিত্তিক সহানুভূতি ও সম্মিলিত দায়বদ্ধতা গভীরভাবে প্রোথিত ঐতিহাসিক ক্ষত নিরসনে অপরিহার্য।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, বিহারিদের সমাজে অন্তর্ভুক্তির জন্য আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা বা ইচ্ছুক ব্যক্তিদের প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্মিলনের পথ সুগম করতে পারে। ১৯৭১ সালের ক্ষত অস্বীকারযোগ্য হলেও, বাংলাদেশের তরুণ বিহারি প্রজন্ম তাদের গৃহীত মাতৃভূমির জন্য ইতিবাচকভাবে অবদান রাখার সুযোগ পাওয়ার যোগ্য। তাদের এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা ক্ষোভ ও বঞ্চনার এক চক্রকে অব্যাহত রাখে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও বিহারি সম্প্রদায়ের দুর্দশার প্রতি নজর দিতে হবে। ওআইসির মতো সংস্থাগুলো, যারা একসময় সহায়তা দিয়েছিল, তাদের টেকসই সমাধান খুঁজে বের করার প্রতিশ্রুতি নতুন করে শুরু করা উচিত। মানবাধিকার সংগঠনগুলো, আঞ্চলিক জোট এবং বৈশ্বিক শক্তিগুলোকে অবশ্যই পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে এই মানবিক সংকট সমাধানের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
এই সমস্যা শুধু একটি রাজনৈতিক বা ঐতিহাসিক সমস্যা নয়Ñ এটি একটি মানবিক বিপর্যয় যা সহানুভূতি ও কার্যকরী পদক্ষেপের প্রয়োজন। রাষ্ট্রহীনতা, দারিদ্রতা, বঞ্চনা, মানব মর্যাদার প্রতি আঘাত, এই পরিস্থিতিগুলোকে অব্যাহত রাখতে দেয়া সম্মিলিত মানবতার ব্যর্থতা।
বিহারি সম্প্রদায়ের এই উপেক্ষিত সংগ্রাম বাংলাদেশে যুগ যুগ ধরে অবহেলিত জীবন- গোটা মানব সমাজের এক বিশ্বাসঘাতকতা, উদাসীনতা এবং শোষণের প্রতিফলন। এই বিহারি সম্প্রদায়, যারা একসময় পাকিস্তানের ওপর নির্ভর করেছিল, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর আজ সেই পাকিস্তানি সরকার কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়ে রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ে আছে। তাদের কাহিনী এক মহাযন্ত্রণার, কিন্তু একই সঙ্গে আমরা তাদের যন্ত্রণা লাঘবে কতটুকু উদ্যোগ নেয়ার চেষ্টা করেছি তাও দেখার বিষয়।
বিহারিদের দুর্দশা মোকাবিলা করা শুধু ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতার বিষয় নয়Ñ এটি অবহেলিত মানুষের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করা এবং অতীতের শিক্ষাগুলোকে এমনভাবে প্রয়োগ করা যাতে আমরা একটি অধিক সহানুভূতিশীল ও ন্যায়সঙ্গত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারি। বৈশ্বিক নেতাদের পদক্ষেপ নেয়ার এখনই সময়, তা না হলে এই অমীমাংসিত ক্ষোভগুলো আরও গভীর বিভাজন ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে গোটা দক্ষিণ এশিয়াকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
[লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক]