কামরুজ্জামান
পানির অপর নাম জীবন। আর জীবনের জন্য সুপেয় পানির বিকল্প নেই। বাংলাদেশের ভূমিরূপের বৈচিত্র্যময় প্ল্যাইস্টোসিন চত্বরের ভূমিরূপ হলো গাজীপুর জেলার ভূমি। গাজীপুর অঞ্চলে সুপেয় পানির একমাত্র উৎস হচ্ছেÑ ভূগর্ভস্থ পানি। আগের দিনে পুকুর, কুয়া ও ইদারা খননের মাধ্যমে খাবার পানি সংগ্রহ করা হতো। এরপর এলো টিউবওয়েল বা চাপকল। একটা সময় পর্যন্ত টিউবওয়েলের মাধ্যমে মাটির নিচ থেকে পানি তোলা হতো। কুয়া এবং ইঁদারা বিশ ফুট থেকে ত্রিশ ফুট গভীর খনন করলেই সুপেয় পানি পাওয়া যেত। এরপর আশির দশকে যখন টিউবওয়েল এলো তখন ৪০ থেকে ৫০ ফুট গভীরে পাইপ পাঠালেই পানি উঠত। নব্বইয়ের দশকের দিকে আমরা দেখেছি বর্ষাকালে অনেক বাড়ির টিউবওয়েলের কল দিয়ে এমনিতেই পানি বের হয়ে আসত। কুয়া, ইঁদারা ও টিউবওয়েলের পানি খাওয়া থেকে শুরু করে গোসল ও রান্নাবান্নাসহ দৈনন্দিন সব কাজে ব্যবহার করা হতো।
গাজীপুর অঞ্চলে এখন কুয়া এবং ইঁদারা নেই বললেই চলে। টিউবওয়েল যদিও কদাচিৎ দেখা যায় কিন্তু পানি আর তোলা যায় না। টিউবওয়েলে যে গভীরতায় পাইপ পাঠানো হয়েছে তাতে আর পানির লেয়ার না থাকায় পানি ওঠানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সব টিউবওয়েল অকেজো হয়ে পড়ে আছে।
গাজীপুরের পাঁচটি উপজেলার প্রায় সবকটিতেই এখন বাসাবাড়ি, কৃষি জমিতে পানির উৎস হিসাবে ব্যবহার করা হয় বিদ্যুৎচালিত মোটর। এবং ২০০০ সালের দিকে এই অঞ্চলে যখন বিদ্যুৎচালিত পানির মোটর বসানো শুরু হয় তখন মাত্র ৭০ থেকে ৮০ ফুট খনন করেই পানির স্তর পাওয়া যেত। এখন ৪০০ ফুট বা তার অধিক গভীরে যেতে হয় পানির স্তর পাওয়ার জন্য। আরও ভয়ংকর তথ্য হচ্ছেÑ প্রতি বছর প্রায় ১০ ফুট নিচে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর।
প্রাকৃতিক জলাশয়ের পানি একসময় ব্যবহার করা যেত এখন যায় না। গাজীপুর এলাকার নদী খাল ও প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো পনের-বিশ বছর আগেও দূষণমুক্ত ছিল। কিন্তু বর্তমানে শিল্পের তরল বর্জ্য এবং আবাসিক তরল ও কঠিন বর্জ্যরে কারণে সব ধরনের প্রাকৃতিক জলাশয়ের পানি দূষিত হয়ে পড়েছে। ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। যার জন্য সব কাজে ব্যবহারের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ অনেক বেড়েছে।
গাজীপুর বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল। রাজধানী ঢাকার কাছে অবস্থিত হওয়ায় এবং ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই বিভিন্ন রকমের অর্থনৈতিক কর্মকা-ের কেন্দ্রবিন্দু এখন গাজীপুর। সারা বাংলাদেশের মধ্যে গাজীপুর জেলায় শিল্প কারখানার সবচেয়ে বেশি গড়ে উঠেছে। তৈরি পোশাক শিল্পসহ অন্যান্য শিল্প কারখানার মিলে প্রায় ছয় হাজার শিল্প কারখানার রয়েছে গাজীপুরে। এসব শিল্প কারখানা চালাতে প্রচুর পানি লাগে। এই পানির সবটুকুই উত্তোলন করা হয় ভূগর্ভস্থ থেকে। গাজীপুর অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমে আসার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম এবং প্রধান কারণ হচ্ছে শিল্প কারখানা।
গাজীপুরে গড়ে ওঠা শিল্প কারখানারগুলো তাদের প্রয়োজনীয় পানি ভূগর্ভস্থ থেকে উত্তোলন করে। প্রতিটি শিল্প কারখানার প্রচুর পরিমাণ পানির প্রয়োজন পড়ে। বিশেষ করে পোশাক শিল্প কারখানা। এক হিসাবমতে গাজীপুরে পোশাক শিল্প কারখানার রয়েছে প্রায় চার হাজারের মতো। এসব শিল্প কারখানায় ডাইং, নিটিং, ও ইটিপি চালাতে প্রচুর পরিমাণ পানির প্রয়োজন পড়ে। এই পানির সব উত্তোলন করা হয় ভূগর্ভস্থ থেকে। শিল্প কারখানায় কর্মরত শ্রমজীবী মানুষের দৈনন্দিন কাজে যে পানি ব্যবহার করা হয় তাও আহরণ করা হয় ভূগর্ভস্থ থেকে। বর্তমানে সেলু টিউবওয়েল, গভীর নলকূপ ও বিদ্যুৎচালিত মোটর দিয়ে অস্বাভাবিকভাবে ভূ-অভ্যন্তর থেকে পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। এইভাবে কলকারখানায় পানি উত্তোলনের কারণে ভূগর্ভের পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে।
ভূ-অভ্যন্তরে যারা নলকূপ স্থাপন করে তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়Ñ গাজীপুর জেলার গাজীপুর সদর, টঙ্গী, শ্রীপুর পৌর এলাকা, কালিয়াকৈর পৌরসভা, কালীগঞ্জ উপজেলা সদর অঞ্চলে ভূগর্ভের পানির স্তর প্রতি বছর ৫ থেকে ১০ ফুট নিচে নেমে যাচ্ছে। এর প্রমাণও মিলছে। বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত পানির মোটরগুলোর ভূগর্ভের পাইপ প্রতি বছরই ১০ - ২০ ফুট করে জোড়া দিয়ে গভীরে নিতে হচ্ছে। অন্যথায় কাক্সিক্ষত পানি পাওয়া যায় না। এছাড়া ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমে যাওয়ার কারণ হচ্ছেÑ অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ এবং বাসাবাড়িতে অতিরিক্ত পানির ব্যবহার।
গাজীপুরে জনসংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আবাসন। গাজীপুরে বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৩৪,০৩৯১২ জন। এর সঙ্গে বসবাস করে অভিগমিত জনসংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। ভাসমান জনসংখ্যাসহ সব মিলিয়ে গাজীপুরে বর্তমানে প্রায় ৮০ লাখ লোকের বসবাস। বিশাল এই জনসংখ্যার পানির চাহিদা মিটানোর একমাত্র উৎস হচ্ছে গ্রাউন্ড ওয়াটার বা ভূগর্ভস্থ পানি। বাসাবাড়ির নিত্য প্রয়োজনীয় কাজ যেমনÑ গোসল, ওজু, বাথরুম, হাতমুখ ধোয়া, দাঁতমাজাসহ নানা কাজে পানির অস্বাভাবিক ব্যবহার হয়। নির্মাণ শিল্পের প্রয়োজনেও প্রচুর পানি লাগে। সব মিলিয়ে বিশাল জনসংখ্যার চাহিদা পূরণে ব্যবহৃত হচ্ছে ভূগর্ভের পানি। আর পানির এই লাগামহীন ব্যবহারের কারণে নিচে নামছে পানির স্তর।
বর্তমানে কৃষি জমিতে একমাত্র ভূগর্ভস্থ পানিই ব্যবহার করা হয়। আগে কৃষি জমিতে ফসল উৎপাদনের জন্য বৃষ্টির পানি এবং প্রাকৃতিক জলাশয় নদী খালের পানি ব্যবহার করা হতো। নদী, খাল ও প্রাকৃতিক জলাশয়ের পানি শিল্পের তরল বর্জ্য এবং আবাসিক বর্জ্যরে কারণে দূষিত হয়ে পড়েছে। প্রাকৃতিক জলাশয়ের পানি একেবারেই ব্যবহার করা যায় না। ব্যবহার করলেও ফসল উৎপাদন হয় না। তাই বাধ্য হয়ে আমাদের কৃষকরা বিদ্যুৎচালিত মোটরের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ব্যবহার করছে ভূগর্ভস্থ পানি। ফলে নিচে নামছে পানির স্তর।
সময়মতো বৃষ্টিপাত না হওয়াও ভূ-অভ্যন্তরের পানির স্তর নিচে নামার একটি কারণ। ভূপৃষ্ঠে যে বৃষ্টিপাত হয় তার একটি অংশ চুয়ানো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভূ-অভ্যন্তরে প্রবেশ করে পানির স্তরকে ঠিক রাখে। কিন্তু বর্তমান সময়ে সারা বাংলাদেশেই বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম হয়। আবার গাজীপুরে পরিবেশ দূষণের কারণে জমিতে কঠিন পদার্থ বিশেষ করে পলিথিন স্তরে স্তরে পড়ে থাকার কারণে পানির চুয়ানো প্রক্রিয়ার কাজ ব্যহত হয়। ফলে ভূ-অভ্যন্তর থেকে যে পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হয় সেটা পূরণ হয় না।
ভূগর্ভস্থ পানি অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যায়, এতে প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য ক্ষত হয়। প্রত্যক্ষভাবে যে সমস্যা সৃষ্টি হয় তা হলোÑ পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নেমে যাওয়ার ফলে পানি তোলার ব্যয় বেড়ে যায় এবং পানির প্রাপ্যতা অনেক কমে যায় , এমনকি ভূগর্ভস্থ পানিতে দূষণের ঝুঁকিও দেখা দিতে পারে। মাটির নিচ থেকে এভাবে অতিরিক্ত পানি তোলা চলতে থাকলে ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ে। আমাদের গাজীপুর অঞ্চলে ইতোমধ্যে এর প্রভাব দেখা দিয়েছে। এখন ভূগর্ভ থেকে পানি উত্তোলনের খরচ অনেক বেড়ে গেছে। পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ঢাকা শহরের মতো গাজীপুরেও সুপেয় পানির সংকট দেখা দেবে।
সেজন্য ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে ভূ-উপরিস্থিত বিভিন্ন উৎস থেকে পানি ব্যবহারের ওপর জোর দেয়া জরুরি। শিল্প কারখানায় বিকল্প উৎস থেকে পানি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। আর এ লক্ষ্যে গাজীপুরের নদী-খাল-বিল ও অন্যান্য প্রাকৃতিক জলাশয় দূষণমুক্ত করে শিল্প কারখানায় ব্যবহারের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বর্ষায় বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। শিল্প কারখানা ব্যাপকভাবে এই কাজটি করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। এই ক্ষেত্রে কারখানাগুলোর ছাদে বড় রিজার্ভ ট্যাংকি তৈরি করা যেতে পারে। অথবা মাটির নিচে রিজার্ভ ট্যাংকি তৈরি করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। নদী, খাল ও প্রাকৃতিক জলাশয়ের পানি কারখানায় ব্যবহারের জন্য পাইপলাইন সংযোগ করে পাম্পের সাহায্য নেয়া যেতে পারে।
প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষরোপণ করতে হবে। বনায়ন বৃদ্ধি করা গেলে পরিবেশ ঠা-া ও শীতল থাকবে। সময়মতো বৃষ্টিও পাওয়া যাবে।
বাসাবাড়িতে পানি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সবারই সচেতন হওয়া প্রয়োজন। আমাদের একটা স্বভাব হচ্ছে এক জগ বা এক বোতল পানি ভরার জন্য আমরা বিদ্যুৎ মোটর ব্যবহার করি। অনেক সময় দেখা যায় এক লিটার পানির বোতল ভরতে গিয়ে পাঁচ লিটার পানি অপচয় করা হয়। হাতমুখ ধুতে গিয়ে বেসিনের কল ছেড়ে দিয়ে আমরা অন্য কাজ করি। ব্রাশ করতে গিয়ে পানির কল ছেড়ে রাখি। পানি পড়ছে তো পড়ছেই। যদিও বিষয়গুলো ছোট কিন্তু লাখ লাখ মানুষ যখন কাজটি করে তখন আর ছোট থাকে না। পানির অপচয়টা মারাত্মক আকার ধারণ করে।
বিশ্বের বহু অঞ্চলে সুপেয় পানির মারাত্মক অভাব রয়েছে। এক লিটার পানির জন্য মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিয়ে সংগ্রহ করতে হয়। আমাদের ঢাকা শহরেও অনেক জায়গায় লাইন ধরে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়। পানির অভাবে বাসাবাড়ির রান্নাবান্না বন্ধ করে রাখতে হয়। গাজীপুরে সুপেয় পানির অভাব শুরু হয়নি কিন্তু ইতোমধ্যে উত্তোলন খরচ বেড়ে গেছে এবং ভূ-অভ্যন্তরে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে নানা রকমের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
গাজীপুর অঞ্চলে ভূ-অভ্যন্তরের পানির স্তর ঠিক রাখার জন্য শিল্প কারখানায় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। বাসাবাড়িতে পানি ব্যবহারে সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। রাজনৈতিক নেতাদের এ বিষয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। প্রশাসনের তদারকি বাড়াতে হবে। পানির অপচয় রোধে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। মোটকথা সবার সচেতনতাই পারে পানির অপচয় রোধ করতে এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্থিতিশীল রাখতে।
[লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, গাজীপুর]
কামরুজ্জামান
শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪
পানির অপর নাম জীবন। আর জীবনের জন্য সুপেয় পানির বিকল্প নেই। বাংলাদেশের ভূমিরূপের বৈচিত্র্যময় প্ল্যাইস্টোসিন চত্বরের ভূমিরূপ হলো গাজীপুর জেলার ভূমি। গাজীপুর অঞ্চলে সুপেয় পানির একমাত্র উৎস হচ্ছেÑ ভূগর্ভস্থ পানি। আগের দিনে পুকুর, কুয়া ও ইদারা খননের মাধ্যমে খাবার পানি সংগ্রহ করা হতো। এরপর এলো টিউবওয়েল বা চাপকল। একটা সময় পর্যন্ত টিউবওয়েলের মাধ্যমে মাটির নিচ থেকে পানি তোলা হতো। কুয়া এবং ইঁদারা বিশ ফুট থেকে ত্রিশ ফুট গভীর খনন করলেই সুপেয় পানি পাওয়া যেত। এরপর আশির দশকে যখন টিউবওয়েল এলো তখন ৪০ থেকে ৫০ ফুট গভীরে পাইপ পাঠালেই পানি উঠত। নব্বইয়ের দশকের দিকে আমরা দেখেছি বর্ষাকালে অনেক বাড়ির টিউবওয়েলের কল দিয়ে এমনিতেই পানি বের হয়ে আসত। কুয়া, ইঁদারা ও টিউবওয়েলের পানি খাওয়া থেকে শুরু করে গোসল ও রান্নাবান্নাসহ দৈনন্দিন সব কাজে ব্যবহার করা হতো।
গাজীপুর অঞ্চলে এখন কুয়া এবং ইঁদারা নেই বললেই চলে। টিউবওয়েল যদিও কদাচিৎ দেখা যায় কিন্তু পানি আর তোলা যায় না। টিউবওয়েলে যে গভীরতায় পাইপ পাঠানো হয়েছে তাতে আর পানির লেয়ার না থাকায় পানি ওঠানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সব টিউবওয়েল অকেজো হয়ে পড়ে আছে।
গাজীপুরের পাঁচটি উপজেলার প্রায় সবকটিতেই এখন বাসাবাড়ি, কৃষি জমিতে পানির উৎস হিসাবে ব্যবহার করা হয় বিদ্যুৎচালিত মোটর। এবং ২০০০ সালের দিকে এই অঞ্চলে যখন বিদ্যুৎচালিত পানির মোটর বসানো শুরু হয় তখন মাত্র ৭০ থেকে ৮০ ফুট খনন করেই পানির স্তর পাওয়া যেত। এখন ৪০০ ফুট বা তার অধিক গভীরে যেতে হয় পানির স্তর পাওয়ার জন্য। আরও ভয়ংকর তথ্য হচ্ছেÑ প্রতি বছর প্রায় ১০ ফুট নিচে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর।
প্রাকৃতিক জলাশয়ের পানি একসময় ব্যবহার করা যেত এখন যায় না। গাজীপুর এলাকার নদী খাল ও প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো পনের-বিশ বছর আগেও দূষণমুক্ত ছিল। কিন্তু বর্তমানে শিল্পের তরল বর্জ্য এবং আবাসিক তরল ও কঠিন বর্জ্যরে কারণে সব ধরনের প্রাকৃতিক জলাশয়ের পানি দূষিত হয়ে পড়েছে। ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। যার জন্য সব কাজে ব্যবহারের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ অনেক বেড়েছে।
গাজীপুর বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল। রাজধানী ঢাকার কাছে অবস্থিত হওয়ায় এবং ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই বিভিন্ন রকমের অর্থনৈতিক কর্মকা-ের কেন্দ্রবিন্দু এখন গাজীপুর। সারা বাংলাদেশের মধ্যে গাজীপুর জেলায় শিল্প কারখানার সবচেয়ে বেশি গড়ে উঠেছে। তৈরি পোশাক শিল্পসহ অন্যান্য শিল্প কারখানার মিলে প্রায় ছয় হাজার শিল্প কারখানার রয়েছে গাজীপুরে। এসব শিল্প কারখানা চালাতে প্রচুর পানি লাগে। এই পানির সবটুকুই উত্তোলন করা হয় ভূগর্ভস্থ থেকে। গাজীপুর অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমে আসার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম এবং প্রধান কারণ হচ্ছে শিল্প কারখানা।
গাজীপুরে গড়ে ওঠা শিল্প কারখানারগুলো তাদের প্রয়োজনীয় পানি ভূগর্ভস্থ থেকে উত্তোলন করে। প্রতিটি শিল্প কারখানার প্রচুর পরিমাণ পানির প্রয়োজন পড়ে। বিশেষ করে পোশাক শিল্প কারখানা। এক হিসাবমতে গাজীপুরে পোশাক শিল্প কারখানার রয়েছে প্রায় চার হাজারের মতো। এসব শিল্প কারখানায় ডাইং, নিটিং, ও ইটিপি চালাতে প্রচুর পরিমাণ পানির প্রয়োজন পড়ে। এই পানির সব উত্তোলন করা হয় ভূগর্ভস্থ থেকে। শিল্প কারখানায় কর্মরত শ্রমজীবী মানুষের দৈনন্দিন কাজে যে পানি ব্যবহার করা হয় তাও আহরণ করা হয় ভূগর্ভস্থ থেকে। বর্তমানে সেলু টিউবওয়েল, গভীর নলকূপ ও বিদ্যুৎচালিত মোটর দিয়ে অস্বাভাবিকভাবে ভূ-অভ্যন্তর থেকে পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। এইভাবে কলকারখানায় পানি উত্তোলনের কারণে ভূগর্ভের পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে।
ভূ-অভ্যন্তরে যারা নলকূপ স্থাপন করে তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়Ñ গাজীপুর জেলার গাজীপুর সদর, টঙ্গী, শ্রীপুর পৌর এলাকা, কালিয়াকৈর পৌরসভা, কালীগঞ্জ উপজেলা সদর অঞ্চলে ভূগর্ভের পানির স্তর প্রতি বছর ৫ থেকে ১০ ফুট নিচে নেমে যাচ্ছে। এর প্রমাণও মিলছে। বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত পানির মোটরগুলোর ভূগর্ভের পাইপ প্রতি বছরই ১০ - ২০ ফুট করে জোড়া দিয়ে গভীরে নিতে হচ্ছে। অন্যথায় কাক্সিক্ষত পানি পাওয়া যায় না। এছাড়া ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমে যাওয়ার কারণ হচ্ছেÑ অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ এবং বাসাবাড়িতে অতিরিক্ত পানির ব্যবহার।
গাজীপুরে জনসংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আবাসন। গাজীপুরে বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৩৪,০৩৯১২ জন। এর সঙ্গে বসবাস করে অভিগমিত জনসংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। ভাসমান জনসংখ্যাসহ সব মিলিয়ে গাজীপুরে বর্তমানে প্রায় ৮০ লাখ লোকের বসবাস। বিশাল এই জনসংখ্যার পানির চাহিদা মিটানোর একমাত্র উৎস হচ্ছে গ্রাউন্ড ওয়াটার বা ভূগর্ভস্থ পানি। বাসাবাড়ির নিত্য প্রয়োজনীয় কাজ যেমনÑ গোসল, ওজু, বাথরুম, হাতমুখ ধোয়া, দাঁতমাজাসহ নানা কাজে পানির অস্বাভাবিক ব্যবহার হয়। নির্মাণ শিল্পের প্রয়োজনেও প্রচুর পানি লাগে। সব মিলিয়ে বিশাল জনসংখ্যার চাহিদা পূরণে ব্যবহৃত হচ্ছে ভূগর্ভের পানি। আর পানির এই লাগামহীন ব্যবহারের কারণে নিচে নামছে পানির স্তর।
বর্তমানে কৃষি জমিতে একমাত্র ভূগর্ভস্থ পানিই ব্যবহার করা হয়। আগে কৃষি জমিতে ফসল উৎপাদনের জন্য বৃষ্টির পানি এবং প্রাকৃতিক জলাশয় নদী খালের পানি ব্যবহার করা হতো। নদী, খাল ও প্রাকৃতিক জলাশয়ের পানি শিল্পের তরল বর্জ্য এবং আবাসিক বর্জ্যরে কারণে দূষিত হয়ে পড়েছে। প্রাকৃতিক জলাশয়ের পানি একেবারেই ব্যবহার করা যায় না। ব্যবহার করলেও ফসল উৎপাদন হয় না। তাই বাধ্য হয়ে আমাদের কৃষকরা বিদ্যুৎচালিত মোটরের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ব্যবহার করছে ভূগর্ভস্থ পানি। ফলে নিচে নামছে পানির স্তর।
সময়মতো বৃষ্টিপাত না হওয়াও ভূ-অভ্যন্তরের পানির স্তর নিচে নামার একটি কারণ। ভূপৃষ্ঠে যে বৃষ্টিপাত হয় তার একটি অংশ চুয়ানো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভূ-অভ্যন্তরে প্রবেশ করে পানির স্তরকে ঠিক রাখে। কিন্তু বর্তমান সময়ে সারা বাংলাদেশেই বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম হয়। আবার গাজীপুরে পরিবেশ দূষণের কারণে জমিতে কঠিন পদার্থ বিশেষ করে পলিথিন স্তরে স্তরে পড়ে থাকার কারণে পানির চুয়ানো প্রক্রিয়ার কাজ ব্যহত হয়। ফলে ভূ-অভ্যন্তর থেকে যে পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হয় সেটা পূরণ হয় না।
ভূগর্ভস্থ পানি অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যায়, এতে প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য ক্ষত হয়। প্রত্যক্ষভাবে যে সমস্যা সৃষ্টি হয় তা হলোÑ পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নেমে যাওয়ার ফলে পানি তোলার ব্যয় বেড়ে যায় এবং পানির প্রাপ্যতা অনেক কমে যায় , এমনকি ভূগর্ভস্থ পানিতে দূষণের ঝুঁকিও দেখা দিতে পারে। মাটির নিচ থেকে এভাবে অতিরিক্ত পানি তোলা চলতে থাকলে ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ে। আমাদের গাজীপুর অঞ্চলে ইতোমধ্যে এর প্রভাব দেখা দিয়েছে। এখন ভূগর্ভ থেকে পানি উত্তোলনের খরচ অনেক বেড়ে গেছে। পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ঢাকা শহরের মতো গাজীপুরেও সুপেয় পানির সংকট দেখা দেবে।
সেজন্য ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে ভূ-উপরিস্থিত বিভিন্ন উৎস থেকে পানি ব্যবহারের ওপর জোর দেয়া জরুরি। শিল্প কারখানায় বিকল্প উৎস থেকে পানি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। আর এ লক্ষ্যে গাজীপুরের নদী-খাল-বিল ও অন্যান্য প্রাকৃতিক জলাশয় দূষণমুক্ত করে শিল্প কারখানায় ব্যবহারের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বর্ষায় বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। শিল্প কারখানা ব্যাপকভাবে এই কাজটি করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। এই ক্ষেত্রে কারখানাগুলোর ছাদে বড় রিজার্ভ ট্যাংকি তৈরি করা যেতে পারে। অথবা মাটির নিচে রিজার্ভ ট্যাংকি তৈরি করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। নদী, খাল ও প্রাকৃতিক জলাশয়ের পানি কারখানায় ব্যবহারের জন্য পাইপলাইন সংযোগ করে পাম্পের সাহায্য নেয়া যেতে পারে।
প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষরোপণ করতে হবে। বনায়ন বৃদ্ধি করা গেলে পরিবেশ ঠা-া ও শীতল থাকবে। সময়মতো বৃষ্টিও পাওয়া যাবে।
বাসাবাড়িতে পানি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সবারই সচেতন হওয়া প্রয়োজন। আমাদের একটা স্বভাব হচ্ছে এক জগ বা এক বোতল পানি ভরার জন্য আমরা বিদ্যুৎ মোটর ব্যবহার করি। অনেক সময় দেখা যায় এক লিটার পানির বোতল ভরতে গিয়ে পাঁচ লিটার পানি অপচয় করা হয়। হাতমুখ ধুতে গিয়ে বেসিনের কল ছেড়ে দিয়ে আমরা অন্য কাজ করি। ব্রাশ করতে গিয়ে পানির কল ছেড়ে রাখি। পানি পড়ছে তো পড়ছেই। যদিও বিষয়গুলো ছোট কিন্তু লাখ লাখ মানুষ যখন কাজটি করে তখন আর ছোট থাকে না। পানির অপচয়টা মারাত্মক আকার ধারণ করে।
বিশ্বের বহু অঞ্চলে সুপেয় পানির মারাত্মক অভাব রয়েছে। এক লিটার পানির জন্য মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিয়ে সংগ্রহ করতে হয়। আমাদের ঢাকা শহরেও অনেক জায়গায় লাইন ধরে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়। পানির অভাবে বাসাবাড়ির রান্নাবান্না বন্ধ করে রাখতে হয়। গাজীপুরে সুপেয় পানির অভাব শুরু হয়নি কিন্তু ইতোমধ্যে উত্তোলন খরচ বেড়ে গেছে এবং ভূ-অভ্যন্তরে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে নানা রকমের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
গাজীপুর অঞ্চলে ভূ-অভ্যন্তরের পানির স্তর ঠিক রাখার জন্য শিল্প কারখানায় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। বাসাবাড়িতে পানি ব্যবহারে সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। রাজনৈতিক নেতাদের এ বিষয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। প্রশাসনের তদারকি বাড়াতে হবে। পানির অপচয় রোধে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। মোটকথা সবার সচেতনতাই পারে পানির অপচয় রোধ করতে এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্থিতিশীল রাখতে।
[লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, গাজীপুর]