আকমল হোসেন
১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফলকে উপেক্ষা করে পূর্ব পাকিস্তানের সব স্তরের মানুষের ওপর বর্বরোচিত হামলা, পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও আদর্শগত অস্তিত্ব বাঙালি মুসলমানদের মন থেকে বিলুপ্ত হতে থাকে। ফলে ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ডাকে সাধারণ সব স্তরের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রমনা মানুষের মনে সশস্ত্র সংগ্রামের বিষয়টা নৈতিক মর্থন লাভ করে। আর যারা পাকিস্তানী খান সেনাদের দ্বারা আক্রান্ত বা বিশেষ আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়, তারা কালবিলম্ব না করে ছড়িয়ে পড়ে প্রতিশোধ-সংগ্রামে।
২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণার ১০ দিনের মধ্যেই প্রতিরোধ সংগ্রামে একই লক্ষ্যাভিমুখে তিনটি স্বতন্ত্র ধারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
প্রথম ধারা : বুদ্ধিকে বুদ্ধি দিয়ে আর অস্ত্রকে অস্ত্র দিয়েই মোকাবিলা করতে হয়, যদিও নীতিবাক্যে আমরা জেনেছি অসির চেয়ে মসি বড় (অস্ত্রের চেয়ে কলম বড়)। লক্ষ্যে পৌঁছাতে এছাড়া বিকল্প পথই বা কি? প্রথম ধারাটি ছিল অস্ত্রে সজ্জিত জোয়ানরা। এরা হলো- পাকিস্তান সরকারে কর্মরত বিভিন্ন সশস্ত্র বিভাগের সদস্যরা। পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইপিআরের সেনা ও অফিসারদের নিয়ে গঠিত। তবে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সবাই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে পারেনি অথবা দেয়নি। পাকিস্তানি সরকার অনেককে নিরস্ত্র করেছে, অনেককে বন্দি করেছে, অনেকেই আবার নিজ থেকেই পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করেছিল তবে, বিদ্রোহ ও প্রতিরোধ যুদ্ধে ইপিআর এর অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক সংখ্যায় এবং স্বতঃস্ফুর্তভাবে। যেমন ছিলো পুলিশের অংশগ্রহণ। স্বাধীনতার জন্য মুজিবের পক্ষে মেজর জিয়ার ঘোষণা এবং বেতার যোগাযোগের কারণে বিদ্রোহ এবং প্রতিরোধ সংগ্রামকে সংহত করতে সক্ষম করেছিল। যদিও পূর্ব থেকে এদের মধ্যে যুদ্ধের রাজনৈতিক উপাদান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা ছিলনা। তারপর বিদ্রোহ ঘোষণার পর পাকিস্তানী বাহিনী সীমান্ত পর্যন্ত এদের এমনভাবে তাড়িয়ে নিয়ে যায় যে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এরপরও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত হামলা প্রতিরোধে প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই ১১ হাজার ইপিআর পাকিস্তানবিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধে শামিল হয়। দিল্লিতে যখন তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক পরিকল্পনা শুরু করেন, সেই সময় অর্থাৎ ৪ এপ্রিল ১৯৭১ সিলেট জেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানে ইপিআর এবং বিদ্রোহী ইউনিটগুলোর কমান্ডাররা একত্রিত হয়ে প্রতিরোধ সংগ্রামের সমস্যা ও সমাধান বিষয়ে আলোচনা করেন। এদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ইপিআরের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী, লে. কর্নেল আব্দুর রব, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর শফিউল্লাহ, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর নূরুল ইসলাম, মেজর মমিন চৌধুরী প্রমুখ।
রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সমঝোতার পূর্বেই তাদের মতো করে সম্মিলিত মুক্তিফৌজ গঠন করেন এবং কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীকে তা পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। এ সংক্রান্ত তথ্য ভারতীয় নিরাপত্তা এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে তাজউদ্দীন আহমদের কাছে পৌঁছায়। পরবর্তীকালে এ ধারার সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমদ এর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা
প্রবাসী সরকারের আলোচনা হয় এবং এই ধারাটি প্রবাসী সরকারের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে প্রবাসী সরকারের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
দ্বিতীয় ধারা : এটি রাজনৈতিক চিন্তাপ্রসূত একটি ধারা, যে ধারাটি মুক্তিযুদ্ধ থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে আলোচিত এবং সমালোচিত। অগণতান্ত্রিকতা, পরিবারতন্ত্রসহ অনেকগুলো উপাদান এ ধারার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। এই ধারাটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন যুবলীগের ৪ জন নেতা, শেখ মুজিবর রহমানের ভাগ্নে ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমেদ ও আব্দুর রাজ্জাক।
৬ দফা এবং ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এরা নেতৃত্বের সামনে চলে আসেন। শেখ মুজিবের আস্থাভাজন বলে এদের প্রতি আওয়ামীলীগের যুব কর্মীদের উপর একটা ভালো প্রভাব ছিল। সীমান্ত অতিক্রম করার পর এই চার নেতা দাবী করে যে, সশস্ত্র বাহিনীর ট্রেনিং এবং মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন ও পরিচালনার জন্য শেখ মুজিব শুধুমাত্র তাদের ৪ জনের ওপরই দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। তারা এটাও দাবি করে যে, শেখ মুজিব ভারত সরকারকে এ মর্মে আগেই জানিয়েছিলেন। যদিও এর সত্যতা নিরূপণের কোন উপায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। ৪ নেতার ঐ দাবি মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
একপর্যায়ে প্রবাসী সরকার ও ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের অজ্ঞাতেই শুধু ইন্দিরা গান্ধীর কনসার্নে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা জেনারেল ওবানের তত্ত্বাবধানে এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মুজিব বাহিনী গঠন করে। যে বাহিনীর কার্যকলাপ স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিভক্ত করে ফেলতে উদ্যত হয়। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে দিল্লিতে অবস্থানকালে তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীনতা যুদ্ধের মূলনীতি সম্বলিত বক্তব্য প্রস্তুত করেন ড. রেহমান সোবহান ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের সহায়তায় যা ১০ এপ্রিল শিলিগুড়ির এক অনিয়মিত বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচার করা হয়। পরে সেটা আকাশবাণীর নিয়মিত কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। এঘটনার পূর্বে ৮ এপ্রিল তাজউদ্দিন আহমদ কলকাতার ভবানীপুরের রাজেন্দ্র রোডে এক বাড়িতে শিক্ষক নেতা কামরুজ্জামানসহ আওয়ামী লীগ নেতা ও যুব নেতাদের সঙ্গে আলোচনার পর ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকে স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট ও মন্ত্রিসভার ওপর আলোকপাত করেন। সব বিষয়ে একমত হলে তাজউদ্দীনের প্রধানমন্ত্রী হওয়া এবং বেতার ভাষণ প্রদান সংক্রান্ত বিষয়ে আপত্তি তোলেন শেখ মুজিবের ভাগ্নে ফজলুল হক মণি। ফজলুল হক মনি বেতারে তাজউদ্দিনের বেতার ভাষণ বন্ধে আওয়ামী লীগ ও যুব নেতাদের গণস্বাক্ষর নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নিকট এক আবেদন পাঠান। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ফজলুল হক মণি ও মুজিব বাহিনীর এ ভূমিকা অব্যাহত ছিল। মুক্তিযুদ্ধে মূল নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করবেন , শেখ মনিসহ ৪ ছাত্র নেতা, এ সম্পর্কিত শেখ মুজিবের চিঠি সম্পর্কে ৫ ডিসেম্বর ২০০৮, দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকায় সিডনি থেকে লিখেছেন জনাব আকিদুল ইসলাম। তার চিঠি ভাষ্য মোতাবেক-
৯ মার্চ ১৯৭১ সালে শেখ মুজিব তার বন্ধু ভারতীয় বিধানসভার সদস্য সমর গুহকে লিখেছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সহায়তা প্রসঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীকে প্রভাবিত করার জন্য। শেখ মণির হাত দিয়ে ঐ চিঠি পাঠালেও তিনি সেটা সমর গুহকে না দিয়ে কাছে রেখে দেন।
‘মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে শেখ মণি ঐ চিঠি ইন্দিরা গান্ধীকে দেখিয়ে দাবি করেন তিনিই শেখ মুজিবের উত্তরাধিকারী এবং শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব তাকেই (শেখ মণি) দেয়া হয়েছে। তাদের দাবি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সিরাজুল আলম খান, শেখ মণি, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ রাজনৈতিক কাঠামোর দায়িত্ব পালন করবেন। এই ৪ নেতা পরবর্তিতে তাজউদ্দিনের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বিভিন্নভাবে চ্যালেঞ্জ করেছেন। এরাই মুক্তি সংগ্রামে আওয়ামী রাজনীতির বাইরে বাম প্রগতিশীলদের মুক্তিযুদ্ধে যেতে এবং মুক্তিবাহিনীতে অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতাই শুধু করেনি বন্ধ পর্যন্ত করেছিল। পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা বামমনা ডিপি ধরের মাধ্যমে ন্যাপ-কমিউনিস্টপার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে গঠিত গেরিলা বাহিনীর নামে যুদ্ধে অংশ গ্রহনের সুযোগ পায়। মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম কমিটি গঠন করতে হয়েছিল।
এই মুজিববাহিনী বিভিন্ন জায়গায় প্রবাসী সরকার পরিচালিত মুক্তিযোদ্ধাদের (এফ.এফ) এবং বামপন্থি মুক্তিযোদ্ধা গেরিলাদের উপর হামলা করে মুজিব বাহিনীতে জোরপূর্বক অন্তর্ভুক্ত করেছে, কেউ অনিচ্ছা প্রকাশ করলে তার অস্ত্র কেড়ে নেয়া হতো। মুজিব বাহিনীতে অন্তর্ভূক্তির জন্য সর্বাধিনায়ক হিসেবে শেখ মুজিবর রহমান এবং তার অনুপস্থিতিতে শেখ ফজলুল হক মণির প্রতি আনুগত্যের অঙ্গিকার করে শপথনামা পাঠ করানো হতো। এ সবাই বিষয়গুলো আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে বিভিন্ন সেক্টর থেকে তাজউদ্দিনকে জানানো হয়। এ সময় দিল্লি সফরকালে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন, পিএন হাকসার, এবং ‘র’ এর প্রধান রামনাথ কাউকে অবহিত করেন। যুব নেতাদের বিভিন্ন দাবির প্রেক্ষাপটে তাজউদ্দীনকে না জানিয়ে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম ঐ ৪ নেতাকে যুবকদের সংগ্রহের দায়িত্ব প্রদান করেন। প্রবাসী মন্ত্রিসভা থেকে এই তরুণ নেতাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট গঠনের দাবি তখনও অব্যাহত ছিল। ৪ অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের এহেন কাজে সেনা প্রধান কর্ণেল ওসমানীও সংশয় প্রকাশ করেন। দেরাদুনে প্রশিক্ষিত মুজিব বাহিনীর উপর প্রবাসী সরকারের কোন কর্তৃত্ব ছিল না।
তৃতীয় ধারা : মহান মুক্তি সংগ্রামে প্রতিরোধ যুদ্ধের ৩য় ধারাটিই মুক্তিযুদ্ধের মূলধারায় পরিণত হয়। যদিও এই ধারাটি প্রথম ধারার মত অভাবিত ছিল সূচনা লগ্নে। এই ধারাটি না ছিল যুব ধারার মত অধিকার পাওয়ার উত্তরাধিকার, পাকিস্তান আক্রমনের সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র আওয়ামী নেতৃত্ব দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। প্রধান নেতার কারাবরণ, এরপর ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৩য় ধারার সৃষ্টি। তাজউদ্দীন আহমদ, আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এবং শেখ মুজিবের দু-দশকের ঘনিষ্ট সহকর্মী। দেশপ্রেম আর আত্মত্যাগের মধ্যে নানা ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের কাজটি সফলভাবে সমাধান করেছিলেন। যদিও তার পুরস্কার তিনি তার দল থেকে সেভাবে পাননি। এত বড় একটা কার্যক্রম তাজউদ্দীন আহমদ কিভাবে সম্পাদন করেছিলেন সেটা শেখ মুজিব কোনদিন জানতে চাননি, আবার তাজউদ্দিন আহমদ শেখ মুজিবকে বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু মুজিব শোনার সময় পাননি। তাজউদ্দীন আহমদের ছোট মেয়ে লেখিকা সিমিন হোসেন রিমি এক সমাবেশে বলেছিলেন, ‘মুজিব আঙ্কেল আমার বাবার মেধাকে মূল্যায়ন করেননি। এ কথা সত্য যে, মুজিব আঙ্কেল কোন দিন সেটা বোঝারও চেষ্টা করেননি। তার (মুজিব) অনুপস্থিতিতে কত বাধা বিপত্তির মধ্য দিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধকে সংঘবদ্ধ করেছিলেন। যুদ্ধকালীন সময়ে তার উপর যেমন আন্তর্জাতিক চাপ ছিল তেমনি আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেও এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী নেতাদের চাপ ছিল। শেখ মুজিব দেশে ফিরে আসার পর আমার বাবার এ কাজের স্বীকৃতি তো দেনই নাই বরং তাকে উপেক্ষা করেছেন।
মুক্তিসংগ্রামে বিরত্বপূর্ণ অবদান রাখার পরও এক সময় তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী সর্বশেষ দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকেও দূরে থাকতে হয়েছে।
[লেখক : যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি]
আকমল হোসেন
শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪
১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফলকে উপেক্ষা করে পূর্ব পাকিস্তানের সব স্তরের মানুষের ওপর বর্বরোচিত হামলা, পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও আদর্শগত অস্তিত্ব বাঙালি মুসলমানদের মন থেকে বিলুপ্ত হতে থাকে। ফলে ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ডাকে সাধারণ সব স্তরের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রমনা মানুষের মনে সশস্ত্র সংগ্রামের বিষয়টা নৈতিক মর্থন লাভ করে। আর যারা পাকিস্তানী খান সেনাদের দ্বারা আক্রান্ত বা বিশেষ আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়, তারা কালবিলম্ব না করে ছড়িয়ে পড়ে প্রতিশোধ-সংগ্রামে।
২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণার ১০ দিনের মধ্যেই প্রতিরোধ সংগ্রামে একই লক্ষ্যাভিমুখে তিনটি স্বতন্ত্র ধারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
প্রথম ধারা : বুদ্ধিকে বুদ্ধি দিয়ে আর অস্ত্রকে অস্ত্র দিয়েই মোকাবিলা করতে হয়, যদিও নীতিবাক্যে আমরা জেনেছি অসির চেয়ে মসি বড় (অস্ত্রের চেয়ে কলম বড়)। লক্ষ্যে পৌঁছাতে এছাড়া বিকল্প পথই বা কি? প্রথম ধারাটি ছিল অস্ত্রে সজ্জিত জোয়ানরা। এরা হলো- পাকিস্তান সরকারে কর্মরত বিভিন্ন সশস্ত্র বিভাগের সদস্যরা। পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইপিআরের সেনা ও অফিসারদের নিয়ে গঠিত। তবে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সবাই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে পারেনি অথবা দেয়নি। পাকিস্তানি সরকার অনেককে নিরস্ত্র করেছে, অনেককে বন্দি করেছে, অনেকেই আবার নিজ থেকেই পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করেছিল তবে, বিদ্রোহ ও প্রতিরোধ যুদ্ধে ইপিআর এর অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক সংখ্যায় এবং স্বতঃস্ফুর্তভাবে। যেমন ছিলো পুলিশের অংশগ্রহণ। স্বাধীনতার জন্য মুজিবের পক্ষে মেজর জিয়ার ঘোষণা এবং বেতার যোগাযোগের কারণে বিদ্রোহ এবং প্রতিরোধ সংগ্রামকে সংহত করতে সক্ষম করেছিল। যদিও পূর্ব থেকে এদের মধ্যে যুদ্ধের রাজনৈতিক উপাদান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা ছিলনা। তারপর বিদ্রোহ ঘোষণার পর পাকিস্তানী বাহিনী সীমান্ত পর্যন্ত এদের এমনভাবে তাড়িয়ে নিয়ে যায় যে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এরপরও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত হামলা প্রতিরোধে প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই ১১ হাজার ইপিআর পাকিস্তানবিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধে শামিল হয়। দিল্লিতে যখন তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক পরিকল্পনা শুরু করেন, সেই সময় অর্থাৎ ৪ এপ্রিল ১৯৭১ সিলেট জেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানে ইপিআর এবং বিদ্রোহী ইউনিটগুলোর কমান্ডাররা একত্রিত হয়ে প্রতিরোধ সংগ্রামের সমস্যা ও সমাধান বিষয়ে আলোচনা করেন। এদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ইপিআরের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী, লে. কর্নেল আব্দুর রব, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর শফিউল্লাহ, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর নূরুল ইসলাম, মেজর মমিন চৌধুরী প্রমুখ।
রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সমঝোতার পূর্বেই তাদের মতো করে সম্মিলিত মুক্তিফৌজ গঠন করেন এবং কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীকে তা পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। এ সংক্রান্ত তথ্য ভারতীয় নিরাপত্তা এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে তাজউদ্দীন আহমদের কাছে পৌঁছায়। পরবর্তীকালে এ ধারার সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমদ এর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা
প্রবাসী সরকারের আলোচনা হয় এবং এই ধারাটি প্রবাসী সরকারের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে প্রবাসী সরকারের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
দ্বিতীয় ধারা : এটি রাজনৈতিক চিন্তাপ্রসূত একটি ধারা, যে ধারাটি মুক্তিযুদ্ধ থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে আলোচিত এবং সমালোচিত। অগণতান্ত্রিকতা, পরিবারতন্ত্রসহ অনেকগুলো উপাদান এ ধারার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। এই ধারাটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন যুবলীগের ৪ জন নেতা, শেখ মুজিবর রহমানের ভাগ্নে ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমেদ ও আব্দুর রাজ্জাক।
৬ দফা এবং ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এরা নেতৃত্বের সামনে চলে আসেন। শেখ মুজিবের আস্থাভাজন বলে এদের প্রতি আওয়ামীলীগের যুব কর্মীদের উপর একটা ভালো প্রভাব ছিল। সীমান্ত অতিক্রম করার পর এই চার নেতা দাবী করে যে, সশস্ত্র বাহিনীর ট্রেনিং এবং মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন ও পরিচালনার জন্য শেখ মুজিব শুধুমাত্র তাদের ৪ জনের ওপরই দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। তারা এটাও দাবি করে যে, শেখ মুজিব ভারত সরকারকে এ মর্মে আগেই জানিয়েছিলেন। যদিও এর সত্যতা নিরূপণের কোন উপায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। ৪ নেতার ঐ দাবি মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
একপর্যায়ে প্রবাসী সরকার ও ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের অজ্ঞাতেই শুধু ইন্দিরা গান্ধীর কনসার্নে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা জেনারেল ওবানের তত্ত্বাবধানে এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মুজিব বাহিনী গঠন করে। যে বাহিনীর কার্যকলাপ স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিভক্ত করে ফেলতে উদ্যত হয়। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে দিল্লিতে অবস্থানকালে তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীনতা যুদ্ধের মূলনীতি সম্বলিত বক্তব্য প্রস্তুত করেন ড. রেহমান সোবহান ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের সহায়তায় যা ১০ এপ্রিল শিলিগুড়ির এক অনিয়মিত বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচার করা হয়। পরে সেটা আকাশবাণীর নিয়মিত কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। এঘটনার পূর্বে ৮ এপ্রিল তাজউদ্দিন আহমদ কলকাতার ভবানীপুরের রাজেন্দ্র রোডে এক বাড়িতে শিক্ষক নেতা কামরুজ্জামানসহ আওয়ামী লীগ নেতা ও যুব নেতাদের সঙ্গে আলোচনার পর ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকে স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট ও মন্ত্রিসভার ওপর আলোকপাত করেন। সব বিষয়ে একমত হলে তাজউদ্দীনের প্রধানমন্ত্রী হওয়া এবং বেতার ভাষণ প্রদান সংক্রান্ত বিষয়ে আপত্তি তোলেন শেখ মুজিবের ভাগ্নে ফজলুল হক মণি। ফজলুল হক মনি বেতারে তাজউদ্দিনের বেতার ভাষণ বন্ধে আওয়ামী লীগ ও যুব নেতাদের গণস্বাক্ষর নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নিকট এক আবেদন পাঠান। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ফজলুল হক মণি ও মুজিব বাহিনীর এ ভূমিকা অব্যাহত ছিল। মুক্তিযুদ্ধে মূল নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করবেন , শেখ মনিসহ ৪ ছাত্র নেতা, এ সম্পর্কিত শেখ মুজিবের চিঠি সম্পর্কে ৫ ডিসেম্বর ২০০৮, দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকায় সিডনি থেকে লিখেছেন জনাব আকিদুল ইসলাম। তার চিঠি ভাষ্য মোতাবেক-
৯ মার্চ ১৯৭১ সালে শেখ মুজিব তার বন্ধু ভারতীয় বিধানসভার সদস্য সমর গুহকে লিখেছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সহায়তা প্রসঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীকে প্রভাবিত করার জন্য। শেখ মণির হাত দিয়ে ঐ চিঠি পাঠালেও তিনি সেটা সমর গুহকে না দিয়ে কাছে রেখে দেন।
‘মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে শেখ মণি ঐ চিঠি ইন্দিরা গান্ধীকে দেখিয়ে দাবি করেন তিনিই শেখ মুজিবের উত্তরাধিকারী এবং শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব তাকেই (শেখ মণি) দেয়া হয়েছে। তাদের দাবি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সিরাজুল আলম খান, শেখ মণি, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ রাজনৈতিক কাঠামোর দায়িত্ব পালন করবেন। এই ৪ নেতা পরবর্তিতে তাজউদ্দিনের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বিভিন্নভাবে চ্যালেঞ্জ করেছেন। এরাই মুক্তি সংগ্রামে আওয়ামী রাজনীতির বাইরে বাম প্রগতিশীলদের মুক্তিযুদ্ধে যেতে এবং মুক্তিবাহিনীতে অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতাই শুধু করেনি বন্ধ পর্যন্ত করেছিল। পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা বামমনা ডিপি ধরের মাধ্যমে ন্যাপ-কমিউনিস্টপার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে গঠিত গেরিলা বাহিনীর নামে যুদ্ধে অংশ গ্রহনের সুযোগ পায়। মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম কমিটি গঠন করতে হয়েছিল।
এই মুজিববাহিনী বিভিন্ন জায়গায় প্রবাসী সরকার পরিচালিত মুক্তিযোদ্ধাদের (এফ.এফ) এবং বামপন্থি মুক্তিযোদ্ধা গেরিলাদের উপর হামলা করে মুজিব বাহিনীতে জোরপূর্বক অন্তর্ভুক্ত করেছে, কেউ অনিচ্ছা প্রকাশ করলে তার অস্ত্র কেড়ে নেয়া হতো। মুজিব বাহিনীতে অন্তর্ভূক্তির জন্য সর্বাধিনায়ক হিসেবে শেখ মুজিবর রহমান এবং তার অনুপস্থিতিতে শেখ ফজলুল হক মণির প্রতি আনুগত্যের অঙ্গিকার করে শপথনামা পাঠ করানো হতো। এ সবাই বিষয়গুলো আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে বিভিন্ন সেক্টর থেকে তাজউদ্দিনকে জানানো হয়। এ সময় দিল্লি সফরকালে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন, পিএন হাকসার, এবং ‘র’ এর প্রধান রামনাথ কাউকে অবহিত করেন। যুব নেতাদের বিভিন্ন দাবির প্রেক্ষাপটে তাজউদ্দীনকে না জানিয়ে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম ঐ ৪ নেতাকে যুবকদের সংগ্রহের দায়িত্ব প্রদান করেন। প্রবাসী মন্ত্রিসভা থেকে এই তরুণ নেতাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট গঠনের দাবি তখনও অব্যাহত ছিল। ৪ অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের এহেন কাজে সেনা প্রধান কর্ণেল ওসমানীও সংশয় প্রকাশ করেন। দেরাদুনে প্রশিক্ষিত মুজিব বাহিনীর উপর প্রবাসী সরকারের কোন কর্তৃত্ব ছিল না।
তৃতীয় ধারা : মহান মুক্তি সংগ্রামে প্রতিরোধ যুদ্ধের ৩য় ধারাটিই মুক্তিযুদ্ধের মূলধারায় পরিণত হয়। যদিও এই ধারাটি প্রথম ধারার মত অভাবিত ছিল সূচনা লগ্নে। এই ধারাটি না ছিল যুব ধারার মত অধিকার পাওয়ার উত্তরাধিকার, পাকিস্তান আক্রমনের সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র আওয়ামী নেতৃত্ব দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। প্রধান নেতার কারাবরণ, এরপর ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৩য় ধারার সৃষ্টি। তাজউদ্দীন আহমদ, আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এবং শেখ মুজিবের দু-দশকের ঘনিষ্ট সহকর্মী। দেশপ্রেম আর আত্মত্যাগের মধ্যে নানা ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের কাজটি সফলভাবে সমাধান করেছিলেন। যদিও তার পুরস্কার তিনি তার দল থেকে সেভাবে পাননি। এত বড় একটা কার্যক্রম তাজউদ্দীন আহমদ কিভাবে সম্পাদন করেছিলেন সেটা শেখ মুজিব কোনদিন জানতে চাননি, আবার তাজউদ্দিন আহমদ শেখ মুজিবকে বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু মুজিব শোনার সময় পাননি। তাজউদ্দীন আহমদের ছোট মেয়ে লেখিকা সিমিন হোসেন রিমি এক সমাবেশে বলেছিলেন, ‘মুজিব আঙ্কেল আমার বাবার মেধাকে মূল্যায়ন করেননি। এ কথা সত্য যে, মুজিব আঙ্কেল কোন দিন সেটা বোঝারও চেষ্টা করেননি। তার (মুজিব) অনুপস্থিতিতে কত বাধা বিপত্তির মধ্য দিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধকে সংঘবদ্ধ করেছিলেন। যুদ্ধকালীন সময়ে তার উপর যেমন আন্তর্জাতিক চাপ ছিল তেমনি আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেও এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী নেতাদের চাপ ছিল। শেখ মুজিব দেশে ফিরে আসার পর আমার বাবার এ কাজের স্বীকৃতি তো দেনই নাই বরং তাকে উপেক্ষা করেছেন।
মুক্তিসংগ্রামে বিরত্বপূর্ণ অবদান রাখার পরও এক সময় তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী সর্বশেষ দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকেও দূরে থাকতে হয়েছে।
[লেখক : যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি]