জিয়াউদ্দীন আহমেদ
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। রাশিয়া তাকে ও তার পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছে। সিরিয়ার বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মাত্র ১১ দিনের ঝটিকা অভিযানে রাজধানী দামেস্ক দখল আসে এবং আসাদ দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। সিরিয়ার সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে হায়াত তাহরির আল-শামের হাতে ৬১ বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত বাথ পার্টির শাসনের অবসান হলো। ১৯৭১ সাল থেকে বার্থ পার্টির বাশার আল-আসাদ ও তার বাবা হাফিজ আল-আসাদ সিরিয়া শাসন করেছেন। ২০০০ সালে হাফিজ আল-আসাদের মৃত্যুর পর তার ছেলে বাশার আল-আসাদ ক্ষমতায় আরোহণ করেন।
দামেস্কের দখল নেয়ার পর মোহাম্মদ আল-বশিরকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু দেশ রাশিয়া এবং ইরান। রাশিয়া কয়েক বছর ধরে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত; অন্যদিকে ইরানসহ তাদের সমর্থিত দুই সশস্ত্র গোষ্ঠী গাজার হামাস ও লেবাননের হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের হামলায় পর্যদস্ত। অথচ কিছুদিন আগে বাশার আল-আসাদের পক্ষে হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা সুন্নি বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। ইসরায়েলের বিমান হামলার পর ইরানও আগের মতো মানসিকভাবে চাঙ্গা নয়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং আসাদের সেনারা যুদ্ধ ক্ষেত্র ত্যাগ করায় অতি সহজে সুন্নি বিদ্রোহী গোষ্ঠী বিজয় সম্ভব হয়।
কর্মসংস্থানের তীব্র সংকট ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ২০১১ সালে শুরু হওয়া শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ কিছুদিনের মধ্যে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পদত্যাগের দাবিতে পর্যবসিত হয়। ২০১১ সালের শেষদিকে বিক্ষুব্ধ জনতা এবং দল ত্যাগী সৈন্যরা মিলে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করে। বিদ্রোহীদের অধিকাংশ সুন্নি মুসলমান, আর আসাদ সরকারের অধিকাংশ ব্যক্তি শিয়া মুসলমান। সিরিয়ার মোট জনসংখ্যার ৭৪ শতাংশ সুন্নি, ১২ শতাংশ শিয়া এবং ১০ শতাংশ খ্রিস্টান। এই গৃহযুদ্ধে তাই শিয়া-সুন্নির সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বও ছিল। সৌদি আরবসহ বিভিন্ন সুন্নি অধ্যুষিত দেশগুলোও বিদ্রোহীদের সমর্থন দিয়ে আরব লীগ থেকে সিরিয়ার সদস্যপদ বাতিল করেছিল। ইরান শিয়া ধর্মাবলম্বী বাশার আল-আসাদ সরকারকে স্বাভাবিক কারণেই সমর্থন করেছে।
বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী একই ধর্মাবলম্বী লোকদের মধ্যে একটা নৈকট্য পৃথিবীর সর্বত্র পরিলক্ষিত হয়। মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৮ শতাংশ তুর্কি সাইপ্রিয়ট সুন্নি মুসলমানদের রক্ষা করতে গিয়ে তুরস্ক ১৯৭৪ সালে সাইপ্রাস আক্রমণ করে এবং সাইপ্রাসের উত্তর অংশ দখল করে এলাকাটিকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়। আজ পর্যন্ত তুরস্ক ছাড়া পৃথিবীর আর কোন দেশ তুর্কি সাইপ্রিয়টকে স্বীকৃতি দেয়নি। তুরস্কের দখলের পর সাইপ্রাইসের বিভিন্ন এলাকা থেকে মুসলমানেরা উত্তর অংশে হিজরত করে, আর গ্রিক সাইপ্রিয়টেরা উত্তর থেকে দক্ষিণে চলে যায়। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগের সময় বাংলা এবং পাঞ্জাব থেকেও এমন একটা হিজরত হয়েছিল।
একই যুক্তি দেখিয়ে রাশিয়াও ইউক্রেনের দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, জাপোরিশা এবং ক্রিমিয়া অঞ্চল দখল করে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে; এসব অঞ্চলে বসবাসরত লোকজন জাতিগতভাবে রাশিয়ান। জাতিগত এবং ধর্মীয় বিভাজনের কারণে সিরিয়াও নানা ভাগে বিভক্ত; ২০১৮ সাল থেকেই বাশার আল-আসাদ, কুর্দি বাহিনী এবং ইসলামপন্থী বিদ্রোহীরা বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সিরিয়া শাসন করে আসছে।
মধ্যপ্রাচ্যে ইরানই একমাত্র দেশ, যারা ইসরায়েলের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করতো। লেবাননের সশস্ত্র হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য সিরিয়ার ভূখ-ের ব্যবহার ইরানের জন্য অপরিহার্য ছিল। ইরানের কাছে লেবাননের হিজবুল্লাহ ও অন্যান্য আঞ্চলিক সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সহায়তা পৌঁছানোর জন্য সিরিয়া ছিল গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ রুট। হিজুল্লাহকে অস্ত্র সরবরাহ করা ইরানের পক্ষে এখন আর সম্ভব নাও হতে পারে। সাম্প্রতিক ইসরায়েলি অভিযানে হিজবুল্লাহর মজুতে থাকা ক্ষেপণাস্ত্রের ৮০ শতাংশই ধ্বংস হয়ে গেছে। ইরান যে অপ্রতিরোধ্য নয়, বরং একটি দুর্বল রাষ্ট্র তাও প্রতিপন্ন হয়েছে ইরানে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক বিমান হামলায়। বর্তমানে যারা সিরিয়ার ক্ষমতায় এসেছে তাদের বিরুদ্ধে ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ কিছুদিন আগেও বাশার আল-আসাদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করেছে। পরবর্তীতে হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় সিরিয়ার বিদ্রোহী সুন্নীরা তার সুযোগ নিয়েছে। আমেরিকা, ইউরোপ, সৌদি আরবসহ বহু দেশের সহায়তায় সুন্নী বিদ্রোহীরা ২০১৫ সনে জয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল, তখন রুশ সামরিক শক্তির হস্তক্ষেপে বাশার আল-আসাদের পতন ঠেকানো সম্ভব হয়েছিল। এবারও পতনের পূর্ব মুহূর্তে রাশিয়া বিমান হামলা শুরু করেছিল, কিন্তু সিরিয়ার সেনারা যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকায় রাশিয়ার বিমান হামলাও বাশার আল-আসাদকে আর রক্ষা করতে পারেনি।
প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ২০১৩ সালে হঠাৎ আবির্ভূত বিশ্বের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ জঙ্গি সংগঠন আইএস বা ইসলামিক স্টেটকেও মোকাবিলা করতে হয়েছে। আইএস উগ্র মুসলমানদের মধ্যে এত বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছিল যে, মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলো ছাড়াও যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইউরোপীয় অন্য দেশ থেকেও আইএস-এ অনেক তরুণ যোগ দিয়েছিল, অনেক তরুণী আইএস যোদ্ধাদের স্ত্রী হওয়ার জন্য বিলাসবহুল জীবন পরিত্যাগ করে সিরিয়ার আইএসদের যুদ্ধ ক্যাম্পে উপস্থিত হয়েছিল।
ইরাক ও সিরিয়ায় সুন্নিদের বঞ্চনাকে পুঁজি করে আইএসের বিস্তার ঘটতে থাকে এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে তারা সিরিয়া ও ইরাকের বিরাট এলাকা দখল করে নিতে সমর্থ হয়। আমেরিকা, ইউরোপ এবং রাশিয়ার বিমান হামলা না হলে সমগ্র সিরিয়া এবং ইরাক দখল করতে তাদের আর বেশি দিন লাগত না। পশ্চিমা হামলার মুখে দৃঢ়তা দেখিয়ে তারা দীর্ঘদিন টিকেও ছিল। আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি দেশের বিমান হামলায় আইএস শেষ পর্যন্ত পরাজয় বরণ করে এবং সিরিয়ার মরুভূমিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। বাশার আল-আসাদের পতনের পর তারা আবার সক্রিয় হয়ে ওঠেছে। তবে আইএসের পুনরুত্থান রোধে যুক্তরাষ্ট্র আইএসদের অবস্থানে বিমান হামলা চালাচ্ছে।
তেরো বছরের গৃহযুদ্ধে সিরিয়া বর্তমানে বিপর্যস্ত। বিদ্রোহী সুন্নিদের বিজয়ের পর আরেকটি নতুন বিপর্যয় নেমে এসেছে। বাশার আল-আসাদের পতনের পর সিরিয়াজুড়ে পাঁচ শতাধিক হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। সিরিয়ার নৌবহর সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ২০টি স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে সিরিয়ার অত্যাধুনিক অস্ত্রভা-ারও। শুধু অস্ত্রভা-ার নয়, সিরিয়ান আর্মির অবশিষ্ট শক্তি ধ্বংস করতে ইসরায়েল বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। সিরিয়াকে সামরিকভাবে কার্যত পঙ্গু করে দেয়া হচ্ছে। বিজয়ী বিদ্রোহীরা যাতে আসাদ সরকারের রেখে যাওয়া অস্ত্র ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য এই বিমান হামলা। বাশার আল-আসাদের পতনের পর সিরিয়ার বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে পারষ্পরিক সংঘাত শুরু হলে সিরিয়ার বৈচিত্র্যময় ও বিভাজিত জনসংখ্যা জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির শিকার হতে পারে। হায়াত তাহরির আল-শামস গোষ্ঠী ক্ষমতা দখল করলেও দেশটির বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে পরস্পর শত্রুভাবাপন্ন গোষ্ঠীগুলো। জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো রাজি না হলে গৃহযুদ্ধ চলতেই থাকবে। বছরের পর বছর ধরে চলা যুদ্ধে সিরিয়ায় মানবিক সংকট ভয়াবহ। বাস্তুচ্যুত লক্ষ লক্ষ সিরিয়ান আশ্রয় নিয়েছে লেবানন, জর্ডান, তুরস্ক, জার্মানিসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে। দেশটির অর্থনীতি ও অবকাঠামো পঙ্গু হয়ে গেছে, লাখ লাখ মানুষ চরম দুর্দশায় মানবেতর জীবনযাপন করছে।
ভারতের সঙ্গে সমমর্যাদা লাভের সাম্প্রতিক মনস্তাত্ত্বিক সংগ্রামে আমরা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও অস্তিত্ব নিয়ে বেশ উচ্চকিত; কিন্তু লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফি, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন এবং পানামার নরিয়েগা স্বৈরশাসক হলেও তাদের দেশপ্রেম ছিল অকৃত্রিম, দেশের অস্তিত্ব রক্ষায় তারা সবাই নিজেদের প্রাণ বিলিয়ে দিয়ে গেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল ব্যতীত অন্য কোন দেশের সার্বভৌমত্ব আছে বলে মনে হয় না। ইসরায়েলই একমাত্র দেশ এবং বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যিনি বলতে পারেন, ‘আমরা যা চাই, তা-ই করব’।
আমেরিকা এবং ইউরোপের শর্তহীন সমর্থনে অবশিষ্ট পৃথিবী অসহায় হয়ে ইসরায়েলের হাতে মুসলমানদের করুণ মৃত্যু ও পরাজয়ের দৃশ্য দেখে যাচ্ছে। গাদ্দাফিকে এত নৃশংসভাব হত্যা করা হয়েছে যে, সেই হত্যার দৃশ্য ভিডিওতে অবলোকন করেই পুতিন সিরিয়ার বাশার আল-আসাদকে সরিয়ে নিতে অনুপ্রাণিত হন।
১৯৭১ সাল থেকে হাফেজ আল-আসাদ এবং তার ছেলে বাশার আল-আসাদ একনাগাড়ে সিরিয়া শাসন করেছেন। পিতা-পুত্র দুইজনই ঘোর ইসরায়েলবিরোধী ছিলেন। ইসরায়েল ব্যতীত মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় প্রতিটি দেশ রাজা-বাদশাহ, স্বৈরশাসক বা সামরিক শাসক দ্বারা শাসিত, গণতন্ত্রের লেশমাত্রও কোন দেশে নেই। একমাত্র গণতান্ত্রিক দেশ ইসরায়েল। ইসরায়েলের অভ্যন্তরে শতভাগ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বিরাজমান, কিন্তু দেশটির বাইরের চরিত্র ফ্যাসিস্ট। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলেও কোন শাসক যে ফ্যাসিস্ট হতে পারে তার বড় প্রমাণ ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতন ঘটিয়ে ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের নেতৃত্বাধীন জোট ‘অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স’ অকেজো করে দিয়েছে। অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স হলো ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস, হেজবুল্লাহ, হুতি বিদ্রোহী ও ইরাকি শিয়া মিলিশিয়াদের একটি নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্কের হামাস প্রায় নিশ্চিহ্ন, শিয়া মিলিশিয়া ও হিজবুল্লাহ পর্যদস্ত; এখন আছে শুধু হুতি। মধ্যপ্রাচ্যের রূপ বদলে দেয়ার ইসরায়েলি পরিকল্পনার সর্বশেষ বাস্তবায়ন হচ্ছে বাশার আল-আসাদের পতন। ইসরায়েলকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়া সর্বশেষ স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদেরও পতন হলো।
বাশার আল-আসাদের পতনে শুধু ইসরায়েল নিরাপদ হয়নি, নিরাপদ বোধ করছে তুরস্ক, সৌদি আরব, মিসর, জর্ডানসহ সব রাজা-বাদশাহর দেশ। তাই বাশার আল-আসাদের পতনে অনেকের মতো ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলতে পারলাম না বলে দুঃখিত।
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক]
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। রাশিয়া তাকে ও তার পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছে। সিরিয়ার বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মাত্র ১১ দিনের ঝটিকা অভিযানে রাজধানী দামেস্ক দখল আসে এবং আসাদ দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। সিরিয়ার সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে হায়াত তাহরির আল-শামের হাতে ৬১ বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত বাথ পার্টির শাসনের অবসান হলো। ১৯৭১ সাল থেকে বার্থ পার্টির বাশার আল-আসাদ ও তার বাবা হাফিজ আল-আসাদ সিরিয়া শাসন করেছেন। ২০০০ সালে হাফিজ আল-আসাদের মৃত্যুর পর তার ছেলে বাশার আল-আসাদ ক্ষমতায় আরোহণ করেন।
দামেস্কের দখল নেয়ার পর মোহাম্মদ আল-বশিরকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু দেশ রাশিয়া এবং ইরান। রাশিয়া কয়েক বছর ধরে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত; অন্যদিকে ইরানসহ তাদের সমর্থিত দুই সশস্ত্র গোষ্ঠী গাজার হামাস ও লেবাননের হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের হামলায় পর্যদস্ত। অথচ কিছুদিন আগে বাশার আল-আসাদের পক্ষে হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা সুন্নি বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। ইসরায়েলের বিমান হামলার পর ইরানও আগের মতো মানসিকভাবে চাঙ্গা নয়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং আসাদের সেনারা যুদ্ধ ক্ষেত্র ত্যাগ করায় অতি সহজে সুন্নি বিদ্রোহী গোষ্ঠী বিজয় সম্ভব হয়।
কর্মসংস্থানের তীব্র সংকট ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ২০১১ সালে শুরু হওয়া শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ কিছুদিনের মধ্যে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পদত্যাগের দাবিতে পর্যবসিত হয়। ২০১১ সালের শেষদিকে বিক্ষুব্ধ জনতা এবং দল ত্যাগী সৈন্যরা মিলে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করে। বিদ্রোহীদের অধিকাংশ সুন্নি মুসলমান, আর আসাদ সরকারের অধিকাংশ ব্যক্তি শিয়া মুসলমান। সিরিয়ার মোট জনসংখ্যার ৭৪ শতাংশ সুন্নি, ১২ শতাংশ শিয়া এবং ১০ শতাংশ খ্রিস্টান। এই গৃহযুদ্ধে তাই শিয়া-সুন্নির সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বও ছিল। সৌদি আরবসহ বিভিন্ন সুন্নি অধ্যুষিত দেশগুলোও বিদ্রোহীদের সমর্থন দিয়ে আরব লীগ থেকে সিরিয়ার সদস্যপদ বাতিল করেছিল। ইরান শিয়া ধর্মাবলম্বী বাশার আল-আসাদ সরকারকে স্বাভাবিক কারণেই সমর্থন করেছে।
বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী একই ধর্মাবলম্বী লোকদের মধ্যে একটা নৈকট্য পৃথিবীর সর্বত্র পরিলক্ষিত হয়। মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৮ শতাংশ তুর্কি সাইপ্রিয়ট সুন্নি মুসলমানদের রক্ষা করতে গিয়ে তুরস্ক ১৯৭৪ সালে সাইপ্রাস আক্রমণ করে এবং সাইপ্রাসের উত্তর অংশ দখল করে এলাকাটিকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়। আজ পর্যন্ত তুরস্ক ছাড়া পৃথিবীর আর কোন দেশ তুর্কি সাইপ্রিয়টকে স্বীকৃতি দেয়নি। তুরস্কের দখলের পর সাইপ্রাইসের বিভিন্ন এলাকা থেকে মুসলমানেরা উত্তর অংশে হিজরত করে, আর গ্রিক সাইপ্রিয়টেরা উত্তর থেকে দক্ষিণে চলে যায়। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগের সময় বাংলা এবং পাঞ্জাব থেকেও এমন একটা হিজরত হয়েছিল।
একই যুক্তি দেখিয়ে রাশিয়াও ইউক্রেনের দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, জাপোরিশা এবং ক্রিমিয়া অঞ্চল দখল করে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে; এসব অঞ্চলে বসবাসরত লোকজন জাতিগতভাবে রাশিয়ান। জাতিগত এবং ধর্মীয় বিভাজনের কারণে সিরিয়াও নানা ভাগে বিভক্ত; ২০১৮ সাল থেকেই বাশার আল-আসাদ, কুর্দি বাহিনী এবং ইসলামপন্থী বিদ্রোহীরা বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সিরিয়া শাসন করে আসছে।
মধ্যপ্রাচ্যে ইরানই একমাত্র দেশ, যারা ইসরায়েলের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করতো। লেবাননের সশস্ত্র হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য সিরিয়ার ভূখ-ের ব্যবহার ইরানের জন্য অপরিহার্য ছিল। ইরানের কাছে লেবাননের হিজবুল্লাহ ও অন্যান্য আঞ্চলিক সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সহায়তা পৌঁছানোর জন্য সিরিয়া ছিল গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ রুট। হিজুল্লাহকে অস্ত্র সরবরাহ করা ইরানের পক্ষে এখন আর সম্ভব নাও হতে পারে। সাম্প্রতিক ইসরায়েলি অভিযানে হিজবুল্লাহর মজুতে থাকা ক্ষেপণাস্ত্রের ৮০ শতাংশই ধ্বংস হয়ে গেছে। ইরান যে অপ্রতিরোধ্য নয়, বরং একটি দুর্বল রাষ্ট্র তাও প্রতিপন্ন হয়েছে ইরানে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক বিমান হামলায়। বর্তমানে যারা সিরিয়ার ক্ষমতায় এসেছে তাদের বিরুদ্ধে ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ কিছুদিন আগেও বাশার আল-আসাদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করেছে। পরবর্তীতে হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় সিরিয়ার বিদ্রোহী সুন্নীরা তার সুযোগ নিয়েছে। আমেরিকা, ইউরোপ, সৌদি আরবসহ বহু দেশের সহায়তায় সুন্নী বিদ্রোহীরা ২০১৫ সনে জয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল, তখন রুশ সামরিক শক্তির হস্তক্ষেপে বাশার আল-আসাদের পতন ঠেকানো সম্ভব হয়েছিল। এবারও পতনের পূর্ব মুহূর্তে রাশিয়া বিমান হামলা শুরু করেছিল, কিন্তু সিরিয়ার সেনারা যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকায় রাশিয়ার বিমান হামলাও বাশার আল-আসাদকে আর রক্ষা করতে পারেনি।
প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ২০১৩ সালে হঠাৎ আবির্ভূত বিশ্বের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ জঙ্গি সংগঠন আইএস বা ইসলামিক স্টেটকেও মোকাবিলা করতে হয়েছে। আইএস উগ্র মুসলমানদের মধ্যে এত বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছিল যে, মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলো ছাড়াও যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইউরোপীয় অন্য দেশ থেকেও আইএস-এ অনেক তরুণ যোগ দিয়েছিল, অনেক তরুণী আইএস যোদ্ধাদের স্ত্রী হওয়ার জন্য বিলাসবহুল জীবন পরিত্যাগ করে সিরিয়ার আইএসদের যুদ্ধ ক্যাম্পে উপস্থিত হয়েছিল।
ইরাক ও সিরিয়ায় সুন্নিদের বঞ্চনাকে পুঁজি করে আইএসের বিস্তার ঘটতে থাকে এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে তারা সিরিয়া ও ইরাকের বিরাট এলাকা দখল করে নিতে সমর্থ হয়। আমেরিকা, ইউরোপ এবং রাশিয়ার বিমান হামলা না হলে সমগ্র সিরিয়া এবং ইরাক দখল করতে তাদের আর বেশি দিন লাগত না। পশ্চিমা হামলার মুখে দৃঢ়তা দেখিয়ে তারা দীর্ঘদিন টিকেও ছিল। আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি দেশের বিমান হামলায় আইএস শেষ পর্যন্ত পরাজয় বরণ করে এবং সিরিয়ার মরুভূমিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। বাশার আল-আসাদের পতনের পর তারা আবার সক্রিয় হয়ে ওঠেছে। তবে আইএসের পুনরুত্থান রোধে যুক্তরাষ্ট্র আইএসদের অবস্থানে বিমান হামলা চালাচ্ছে।
তেরো বছরের গৃহযুদ্ধে সিরিয়া বর্তমানে বিপর্যস্ত। বিদ্রোহী সুন্নিদের বিজয়ের পর আরেকটি নতুন বিপর্যয় নেমে এসেছে। বাশার আল-আসাদের পতনের পর সিরিয়াজুড়ে পাঁচ শতাধিক হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। সিরিয়ার নৌবহর সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ২০টি স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে সিরিয়ার অত্যাধুনিক অস্ত্রভা-ারও। শুধু অস্ত্রভা-ার নয়, সিরিয়ান আর্মির অবশিষ্ট শক্তি ধ্বংস করতে ইসরায়েল বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। সিরিয়াকে সামরিকভাবে কার্যত পঙ্গু করে দেয়া হচ্ছে। বিজয়ী বিদ্রোহীরা যাতে আসাদ সরকারের রেখে যাওয়া অস্ত্র ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য এই বিমান হামলা। বাশার আল-আসাদের পতনের পর সিরিয়ার বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে পারষ্পরিক সংঘাত শুরু হলে সিরিয়ার বৈচিত্র্যময় ও বিভাজিত জনসংখ্যা জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির শিকার হতে পারে। হায়াত তাহরির আল-শামস গোষ্ঠী ক্ষমতা দখল করলেও দেশটির বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে পরস্পর শত্রুভাবাপন্ন গোষ্ঠীগুলো। জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো রাজি না হলে গৃহযুদ্ধ চলতেই থাকবে। বছরের পর বছর ধরে চলা যুদ্ধে সিরিয়ায় মানবিক সংকট ভয়াবহ। বাস্তুচ্যুত লক্ষ লক্ষ সিরিয়ান আশ্রয় নিয়েছে লেবানন, জর্ডান, তুরস্ক, জার্মানিসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে। দেশটির অর্থনীতি ও অবকাঠামো পঙ্গু হয়ে গেছে, লাখ লাখ মানুষ চরম দুর্দশায় মানবেতর জীবনযাপন করছে।
ভারতের সঙ্গে সমমর্যাদা লাভের সাম্প্রতিক মনস্তাত্ত্বিক সংগ্রামে আমরা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও অস্তিত্ব নিয়ে বেশ উচ্চকিত; কিন্তু লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফি, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন এবং পানামার নরিয়েগা স্বৈরশাসক হলেও তাদের দেশপ্রেম ছিল অকৃত্রিম, দেশের অস্তিত্ব রক্ষায় তারা সবাই নিজেদের প্রাণ বিলিয়ে দিয়ে গেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল ব্যতীত অন্য কোন দেশের সার্বভৌমত্ব আছে বলে মনে হয় না। ইসরায়েলই একমাত্র দেশ এবং বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যিনি বলতে পারেন, ‘আমরা যা চাই, তা-ই করব’।
আমেরিকা এবং ইউরোপের শর্তহীন সমর্থনে অবশিষ্ট পৃথিবী অসহায় হয়ে ইসরায়েলের হাতে মুসলমানদের করুণ মৃত্যু ও পরাজয়ের দৃশ্য দেখে যাচ্ছে। গাদ্দাফিকে এত নৃশংসভাব হত্যা করা হয়েছে যে, সেই হত্যার দৃশ্য ভিডিওতে অবলোকন করেই পুতিন সিরিয়ার বাশার আল-আসাদকে সরিয়ে নিতে অনুপ্রাণিত হন।
১৯৭১ সাল থেকে হাফেজ আল-আসাদ এবং তার ছেলে বাশার আল-আসাদ একনাগাড়ে সিরিয়া শাসন করেছেন। পিতা-পুত্র দুইজনই ঘোর ইসরায়েলবিরোধী ছিলেন। ইসরায়েল ব্যতীত মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় প্রতিটি দেশ রাজা-বাদশাহ, স্বৈরশাসক বা সামরিক শাসক দ্বারা শাসিত, গণতন্ত্রের লেশমাত্রও কোন দেশে নেই। একমাত্র গণতান্ত্রিক দেশ ইসরায়েল। ইসরায়েলের অভ্যন্তরে শতভাগ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বিরাজমান, কিন্তু দেশটির বাইরের চরিত্র ফ্যাসিস্ট। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলেও কোন শাসক যে ফ্যাসিস্ট হতে পারে তার বড় প্রমাণ ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতন ঘটিয়ে ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের নেতৃত্বাধীন জোট ‘অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স’ অকেজো করে দিয়েছে। অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স হলো ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস, হেজবুল্লাহ, হুতি বিদ্রোহী ও ইরাকি শিয়া মিলিশিয়াদের একটি নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্কের হামাস প্রায় নিশ্চিহ্ন, শিয়া মিলিশিয়া ও হিজবুল্লাহ পর্যদস্ত; এখন আছে শুধু হুতি। মধ্যপ্রাচ্যের রূপ বদলে দেয়ার ইসরায়েলি পরিকল্পনার সর্বশেষ বাস্তবায়ন হচ্ছে বাশার আল-আসাদের পতন। ইসরায়েলকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়া সর্বশেষ স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদেরও পতন হলো।
বাশার আল-আসাদের পতনে শুধু ইসরায়েল নিরাপদ হয়নি, নিরাপদ বোধ করছে তুরস্ক, সৌদি আরব, মিসর, জর্ডানসহ সব রাজা-বাদশাহর দেশ। তাই বাশার আল-আসাদের পতনে অনেকের মতো ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলতে পারলাম না বলে দুঃখিত।
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক]