শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
বাংলাদেশে মোট নাগরিকের সংখ্যানুপাতে বিভিন্ন ধর্মপালনকার ও জাতিসত্তার মানুষ রয়েছে। এই কম আনুপাতিক হারে বাংলাদেশে বসবাসরতদের মধ্যে সাঁওতাল আদিবাসী অন্যতম। যাদের বাস রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে সাঁওতাল ছাড়াও অন্যান্য আদি জনগোষ্ঠী রয়েছে। উত্তরাঞ্চলের প্রায় সব আদিবাসী নানাভাবে উপেক্ষিত। এই দুই বিভাগে সারাদেশে মোট আদিবাসীর প্রায় অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠীর বাস।
বর্তমানে আদিবাসীদের আদি ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে নানা প্রশ্নের অবতারণা হচ্ছে। কারণ রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের আদিবাসীরা খ্রিস্ট ধর্মে দিক্ষীত হচ্ছেন। এই খ্রিস্ট ধর্মে দিক্ষীতরা শুধু সাঁওতাল নন, অন্য জনগোষ্ঠীর মানুষও রয়েছেন। ব্রিটিশ শাসনামলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগ্রহে ইংরেজ সরকার ১৮১৩ সালের সনদ আইনের মাধ্যমে এদেশে প্রথম খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরণ কার্যক্রম শুরু হয়। ১৮২২ সালের হিসাবে দেখা যায় এদেশে খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০৩ জন, ১৯৪১ সালে বাংলায় খ্রিস্ট ধর্মের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১১ হাজার ৪২৬ জন, তা ১৯৬১ সালে এসে দাঁড়ায় ১ লাখ ৪৮ হাজার ৯৪৩ জনে। ১৮৮১ সালে বৃহত্তর রাজশাহী জেলায় খ্রিস্টানের সংখ্যা ছিল মাত্র ১২১ জন, ১৯৬১ সালে এসে তা দাঁড়ায় ৮ হাজার ৩০৩ জনে।
সব মানুষ নিজ ইচ্ছা যে কোন ধর্ম পালনের অধিকার রাখে। কারণ মানবাধিকার সনদানুসারে প্রতিটি মানুষ ইচ্ছা করলে ধর্ম পরির্বতন করতে পারেন। তাই ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিষয়টি এখানে উল্লেখ করা হলো এই কারণে যে, উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীরা শিক্ষাসহ নানা ধরনের নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বর্তমানে খ্রিস্টান মিশনারিগুলোতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য নানা ধরনের সেবা দিচ্ছেন। পৃথিবীতে মোটা দাগে সব ধর্মকে দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়। একটি আব্রাহামীয় আরেকটি নন-আব্রাহামীয়। মূলত নন-আব্রাহামীয় ধর্মানুসারীরাই প্রাচীন। নৃত্বাত্ত্বিকদের মতে, নন আব্রাহামীয় ধর্মপালনকারীরাই পৃথিবীর আদিবাসী। আব্রাহমীয় ধর্ম হলো তিনটিÑ ইহুদী, খ্রিস্টান, মুসলিম। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অনুপাতে আব্রাহামীয় ধর্মগুলোর মানুষের সংখ্যাই বেশি। কৃষ্টি কালচারসহ প্রকৃতির পরির্বতনশীলতায় সৃষ্ট উপদানগুলো মিশে আছে নন আব্রাহমীয় ধর্মের জনগোষ্ঠীর আচারিক অনুষ্ঠানগুলোর মাঝে। বর্তমানে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের আদিবাসীদের বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো হ্রাস পাচ্ছে। এই অঞ্চলের আদিবাসীরা মুসলিম ও অনেক ক্ষেত্রে হিন্দু ধর্মপালনকারীদের শোষণের শিকার হচ্ছেন। এরা দিনদিন ভূমিহীনে পরিণত হয়ে যাচ্ছে।
সাঁওতাল অধিবাসীরা এবং উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য আদি জনগোষ্ঠীর মানুষ দেশের রাজনৈতিক বিবেচনায় যতটুকু সুযোগ পাওয়ার কথা, সেই সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত। অথচ দেশের মোট আদিবাসীর জনসংখ্যার অনুপাতে উত্তরাঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসীরাই বেশি। তবে সাধারণ পর্যবেক্ষণে দেখা যায় পাহাড়ের আদিবাসীরা যে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন, বা সরকার বিভিন্ন সেবা প্রদানের জন্য যে ব্যবস্থা চালু রেখেছেন, সেগুলো উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীদের জন্য নেই। উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় প্রায় ২১ লাাখ আদিবাসী বাস করে। এদের মধ্যে ভোটারের সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। এই বৃহৎ ভোটার সংখ্যাটি রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ছয়টি আসনের জয় পরাজয় নির্ধারণের বড় নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে আসছে।
রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ি-তানোর) আসনে আদিবাসী ভোটারের সংখ্যা ৪৩ হাজার। নওগাঁ-১ (নিয়ামতপুর-সাপাহার-পোরশা) আসনের ভোট ভোটারের মধ্যে ৩৯ ভাগ ভোটার হলো আদিবাসী, নওগাঁ-২ (পতœীতলা-ধামুরহাট) ও নওগাঁ-৩ (মহাদেবপুর-বদলগাছি) আসনেও ৪০ হাজার করে ভোটার রয়েছেন। রংপুর বিভাগের দিনাজপুর-১ (কাহারোল-বীরগঞ্জ) মোট ভোটারের ১৮ ভাগ আদিবাসী, দিনাজপুর-৬ (বিরামপুর-হাকিমপুর- ঘোড়াঘাট-নবাবগঞ্জ) আসনের ৩৫ ভাগ ভোটার। ১৩ শতাংশ করে আদিবাসী ভোটার রয়েছেন ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা ও চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার আসনগুলোতে। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের অন্য আসনগুলোতে উল্লেখযোগসংখ্যক ভোটার রয়েছেন যারা আদিবাসী।
নিবিড়ভাবে নিরীক্ষণ করলে দেখা যায় যে, উত্তরাঞ্চলীয় আদিবাসীরা সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী না। এরা ধর্ম বা জাতি-গোষ্ঠী নিয়ে কোন সময় সমাজের ক্ষতি হয়Ñ এমন সাম্প্রদায়িক কর্মকা- করেন না। উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীরা অত্যন্ত নিরীহ শান্তিপ্রিয়। এই অঞ্চলের আদিবাসীরা পরিশ্রমী। তাই দেখা যায় এই দুই বিভাগের মূল কৃষি শ্রমিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী। দেশের বর্তমানের সিংহভাগ ধান উৎপান্ন হয় বরেন্দ্র ও উত্তরের অন্যান্য জনপদে। দেশের খাদ্য পণ্য উৎপাদনে উত্তরাঞ্চলের আদিবাসী মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীরা উৎসবপ্রিয় মানুষ তাই এরা কখনো ধর্মীয় সংঘাত বা জাতিগত সংঘাতে লিপ্ত হয় না। তবে দেশের সর্বস্তরে মানুষের অধিকার আদায়ে উত্তর জনপদের আদিবাসীরা প্রাণ দিয়েছেন। ইলামিত্রের তেভাগা আন্দোলনের সাঁওতাল আদিবাসীরা ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে লড়েছেন। সাঁওতাল বিদ্রোহে, মু-া বিদ্রোহসহ পরাধীনতার কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য শহীদ হয়েছেন অগণিত উত্তরা জনপদের আদিবাসী। রাজশাহীসহ উত্তর জনপদে আদিবাসীরা তীর-ধনুক নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে মাঠে নেমেছিলেন। অথচ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এরা নানাভাবে বঞ্চিত, উপেক্ষিত ও শোষিত এই আদিবাসীরা।
রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের আদিবাসীদের জন্য আলাদা করে কোন সরকারি সংস্থা কাজ করছে না। বিশেষ করে আদিবাসীদের ক্ষমতায়ন লক্ষ্যে স্থানীয় সরকারের তাদের সংরক্ষিত প্রতিনিধিত্ব আসন নেই। গাইবান্ধা জেলার গোবিন্ধগঞ্জের বাগদা ফার্মের আদিবাসীদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল কিন্তু সরকারিভাবে পৃথক কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, যা নেয়া হয়েছিল তা ছিল সরকারি প্রচলিত বিধি মোতাবেক। উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় নানা নিগ্রহ, নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন আদিবাসীরা। তবে এগুলোর যথাযথ প্রতিকার তারা পান না। আলফ্রেড সরেনসহ অনেক আদিবাসী হত্যার বিচার হয়নি।
উত্তরের ১৬ জেলার আদিবাসীদের ভূমিসংক্রান্ত নানা জটিলতা রয়েছে, এই ভূমি জটিলতা নিরসনের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের ন্যায় স্বাতন্ত্র আদিবাসী কমিশন গঠন করার হলে ভালো হয়। সরকারের স্থানীয় সরকারের আদিবাসীদের জন্য প্রতিনিধিত্ব কোটা সংরক্ষণ করার প্রয়োজন। বিশেষ করে রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুর ও জয়পুরহাট জেলা পরিষদে আদিবসীদের জন্য ভাইস চেয়ারম্যান পদটি সৃষ্টি করা। সৃষ্ট ভাইস চেয়ারম্যান পদটিতে শুধু আদিবাসীরা নির্বাচনে প্রতিদ্ধন্দ্বিতা করতে পারবেন। সংরক্ষিত ভাইস চেয়ারম্যান আদিবাসীদের সমস্যা নিয়ে কাজ করবে। রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ি ও তানোর উপজেলায়, নওগাঁ জেলার পতœীতলা, ধামুর হাট, মহাদেবপুর, বদলগাছি, নিয়ামতপুর, সাপাহার, পোরশা উপজেলা, দিনাজপুর জেলার কাহারোল, বীরগঞ্জ, বিরামপুর, হাকিমপুর, ঘোড়াঘাট ও নবাবগঞ্জ উপজেলা পরিষদে আদিবাসীদের জন্য ভাইস চেয়ারম্যান পদ সৃষ্টি করা। এই ভাইস চেয়ারম্যান পদটিতে সাধারণ ভাইস চেয়ারম্যানের মতো না। এই সংরক্ষিত পদ থাকবে আদিবাসীদের জন্য। আদিবাসী প্রার্থীরা এই পদে প্রতিদ্ধন্ধিতা করে নির্বাচিত হবেন। এই দুই বিভাগের স্থানীয় সরকারের আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় আইন তৈরি করা। উত্তর জনপদের সাঁওতাল আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষা ও অক্ষর রয়েছে। তাই এদের নিজস্ব ভাষায় শিক্ষা প্রদানের জন্য সরকারিভাবে বিদ্যালয় স্থাপন করা। দীর্ঘদিন, অর্থাৎ যুগ যুগ ধরে উত্তর জনপদের আদিবাসীরা শোষণ-বঞ্চনার শিকার, তাই এরা মূল ¯্রােতের সঙ্গে মিশে পড়াশোনা করে করতে গিয়ে উপেক্ষিত হয়, তাই এদের জন্য পৃথক কারিগরিসহ সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারিভাবে স্থাপন করা দরকার। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোটায় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে উত্তর জনপদের আদিবাসীরা পিছিয়ে তাই তাদের বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থায় মেধাবী করার মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের পথটি তৈরি করা।
সরকারের উচিত উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীদের দিকে বিশেষ নজর দেয়া।
[লেখক : উন্নয়নকর্মী]
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলাদেশে মোট নাগরিকের সংখ্যানুপাতে বিভিন্ন ধর্মপালনকার ও জাতিসত্তার মানুষ রয়েছে। এই কম আনুপাতিক হারে বাংলাদেশে বসবাসরতদের মধ্যে সাঁওতাল আদিবাসী অন্যতম। যাদের বাস রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে সাঁওতাল ছাড়াও অন্যান্য আদি জনগোষ্ঠী রয়েছে। উত্তরাঞ্চলের প্রায় সব আদিবাসী নানাভাবে উপেক্ষিত। এই দুই বিভাগে সারাদেশে মোট আদিবাসীর প্রায় অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠীর বাস।
বর্তমানে আদিবাসীদের আদি ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে নানা প্রশ্নের অবতারণা হচ্ছে। কারণ রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের আদিবাসীরা খ্রিস্ট ধর্মে দিক্ষীত হচ্ছেন। এই খ্রিস্ট ধর্মে দিক্ষীতরা শুধু সাঁওতাল নন, অন্য জনগোষ্ঠীর মানুষও রয়েছেন। ব্রিটিশ শাসনামলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগ্রহে ইংরেজ সরকার ১৮১৩ সালের সনদ আইনের মাধ্যমে এদেশে প্রথম খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরণ কার্যক্রম শুরু হয়। ১৮২২ সালের হিসাবে দেখা যায় এদেশে খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০৩ জন, ১৯৪১ সালে বাংলায় খ্রিস্ট ধর্মের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১১ হাজার ৪২৬ জন, তা ১৯৬১ সালে এসে দাঁড়ায় ১ লাখ ৪৮ হাজার ৯৪৩ জনে। ১৮৮১ সালে বৃহত্তর রাজশাহী জেলায় খ্রিস্টানের সংখ্যা ছিল মাত্র ১২১ জন, ১৯৬১ সালে এসে তা দাঁড়ায় ৮ হাজার ৩০৩ জনে।
সব মানুষ নিজ ইচ্ছা যে কোন ধর্ম পালনের অধিকার রাখে। কারণ মানবাধিকার সনদানুসারে প্রতিটি মানুষ ইচ্ছা করলে ধর্ম পরির্বতন করতে পারেন। তাই ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিষয়টি এখানে উল্লেখ করা হলো এই কারণে যে, উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীরা শিক্ষাসহ নানা ধরনের নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বর্তমানে খ্রিস্টান মিশনারিগুলোতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য নানা ধরনের সেবা দিচ্ছেন। পৃথিবীতে মোটা দাগে সব ধর্মকে দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়। একটি আব্রাহামীয় আরেকটি নন-আব্রাহামীয়। মূলত নন-আব্রাহামীয় ধর্মানুসারীরাই প্রাচীন। নৃত্বাত্ত্বিকদের মতে, নন আব্রাহামীয় ধর্মপালনকারীরাই পৃথিবীর আদিবাসী। আব্রাহমীয় ধর্ম হলো তিনটিÑ ইহুদী, খ্রিস্টান, মুসলিম। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অনুপাতে আব্রাহামীয় ধর্মগুলোর মানুষের সংখ্যাই বেশি। কৃষ্টি কালচারসহ প্রকৃতির পরির্বতনশীলতায় সৃষ্ট উপদানগুলো মিশে আছে নন আব্রাহমীয় ধর্মের জনগোষ্ঠীর আচারিক অনুষ্ঠানগুলোর মাঝে। বর্তমানে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের আদিবাসীদের বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো হ্রাস পাচ্ছে। এই অঞ্চলের আদিবাসীরা মুসলিম ও অনেক ক্ষেত্রে হিন্দু ধর্মপালনকারীদের শোষণের শিকার হচ্ছেন। এরা দিনদিন ভূমিহীনে পরিণত হয়ে যাচ্ছে।
সাঁওতাল অধিবাসীরা এবং উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য আদি জনগোষ্ঠীর মানুষ দেশের রাজনৈতিক বিবেচনায় যতটুকু সুযোগ পাওয়ার কথা, সেই সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত। অথচ দেশের মোট আদিবাসীর জনসংখ্যার অনুপাতে উত্তরাঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসীরাই বেশি। তবে সাধারণ পর্যবেক্ষণে দেখা যায় পাহাড়ের আদিবাসীরা যে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন, বা সরকার বিভিন্ন সেবা প্রদানের জন্য যে ব্যবস্থা চালু রেখেছেন, সেগুলো উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীদের জন্য নেই। উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় প্রায় ২১ লাাখ আদিবাসী বাস করে। এদের মধ্যে ভোটারের সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। এই বৃহৎ ভোটার সংখ্যাটি রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ছয়টি আসনের জয় পরাজয় নির্ধারণের বড় নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে আসছে।
রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ি-তানোর) আসনে আদিবাসী ভোটারের সংখ্যা ৪৩ হাজার। নওগাঁ-১ (নিয়ামতপুর-সাপাহার-পোরশা) আসনের ভোট ভোটারের মধ্যে ৩৯ ভাগ ভোটার হলো আদিবাসী, নওগাঁ-২ (পতœীতলা-ধামুরহাট) ও নওগাঁ-৩ (মহাদেবপুর-বদলগাছি) আসনেও ৪০ হাজার করে ভোটার রয়েছেন। রংপুর বিভাগের দিনাজপুর-১ (কাহারোল-বীরগঞ্জ) মোট ভোটারের ১৮ ভাগ আদিবাসী, দিনাজপুর-৬ (বিরামপুর-হাকিমপুর- ঘোড়াঘাট-নবাবগঞ্জ) আসনের ৩৫ ভাগ ভোটার। ১৩ শতাংশ করে আদিবাসী ভোটার রয়েছেন ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা ও চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার আসনগুলোতে। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের অন্য আসনগুলোতে উল্লেখযোগসংখ্যক ভোটার রয়েছেন যারা আদিবাসী।
নিবিড়ভাবে নিরীক্ষণ করলে দেখা যায় যে, উত্তরাঞ্চলীয় আদিবাসীরা সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী না। এরা ধর্ম বা জাতি-গোষ্ঠী নিয়ে কোন সময় সমাজের ক্ষতি হয়Ñ এমন সাম্প্রদায়িক কর্মকা- করেন না। উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীরা অত্যন্ত নিরীহ শান্তিপ্রিয়। এই অঞ্চলের আদিবাসীরা পরিশ্রমী। তাই দেখা যায় এই দুই বিভাগের মূল কৃষি শ্রমিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী। দেশের বর্তমানের সিংহভাগ ধান উৎপান্ন হয় বরেন্দ্র ও উত্তরের অন্যান্য জনপদে। দেশের খাদ্য পণ্য উৎপাদনে উত্তরাঞ্চলের আদিবাসী মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীরা উৎসবপ্রিয় মানুষ তাই এরা কখনো ধর্মীয় সংঘাত বা জাতিগত সংঘাতে লিপ্ত হয় না। তবে দেশের সর্বস্তরে মানুষের অধিকার আদায়ে উত্তর জনপদের আদিবাসীরা প্রাণ দিয়েছেন। ইলামিত্রের তেভাগা আন্দোলনের সাঁওতাল আদিবাসীরা ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে লড়েছেন। সাঁওতাল বিদ্রোহে, মু-া বিদ্রোহসহ পরাধীনতার কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য শহীদ হয়েছেন অগণিত উত্তরা জনপদের আদিবাসী। রাজশাহীসহ উত্তর জনপদে আদিবাসীরা তীর-ধনুক নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে মাঠে নেমেছিলেন। অথচ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এরা নানাভাবে বঞ্চিত, উপেক্ষিত ও শোষিত এই আদিবাসীরা।
রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের আদিবাসীদের জন্য আলাদা করে কোন সরকারি সংস্থা কাজ করছে না। বিশেষ করে আদিবাসীদের ক্ষমতায়ন লক্ষ্যে স্থানীয় সরকারের তাদের সংরক্ষিত প্রতিনিধিত্ব আসন নেই। গাইবান্ধা জেলার গোবিন্ধগঞ্জের বাগদা ফার্মের আদিবাসীদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল কিন্তু সরকারিভাবে পৃথক কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, যা নেয়া হয়েছিল তা ছিল সরকারি প্রচলিত বিধি মোতাবেক। উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় নানা নিগ্রহ, নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন আদিবাসীরা। তবে এগুলোর যথাযথ প্রতিকার তারা পান না। আলফ্রেড সরেনসহ অনেক আদিবাসী হত্যার বিচার হয়নি।
উত্তরের ১৬ জেলার আদিবাসীদের ভূমিসংক্রান্ত নানা জটিলতা রয়েছে, এই ভূমি জটিলতা নিরসনের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের ন্যায় স্বাতন্ত্র আদিবাসী কমিশন গঠন করার হলে ভালো হয়। সরকারের স্থানীয় সরকারের আদিবাসীদের জন্য প্রতিনিধিত্ব কোটা সংরক্ষণ করার প্রয়োজন। বিশেষ করে রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুর ও জয়পুরহাট জেলা পরিষদে আদিবসীদের জন্য ভাইস চেয়ারম্যান পদটি সৃষ্টি করা। সৃষ্ট ভাইস চেয়ারম্যান পদটিতে শুধু আদিবাসীরা নির্বাচনে প্রতিদ্ধন্দ্বিতা করতে পারবেন। সংরক্ষিত ভাইস চেয়ারম্যান আদিবাসীদের সমস্যা নিয়ে কাজ করবে। রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ি ও তানোর উপজেলায়, নওগাঁ জেলার পতœীতলা, ধামুর হাট, মহাদেবপুর, বদলগাছি, নিয়ামতপুর, সাপাহার, পোরশা উপজেলা, দিনাজপুর জেলার কাহারোল, বীরগঞ্জ, বিরামপুর, হাকিমপুর, ঘোড়াঘাট ও নবাবগঞ্জ উপজেলা পরিষদে আদিবাসীদের জন্য ভাইস চেয়ারম্যান পদ সৃষ্টি করা। এই ভাইস চেয়ারম্যান পদটিতে সাধারণ ভাইস চেয়ারম্যানের মতো না। এই সংরক্ষিত পদ থাকবে আদিবাসীদের জন্য। আদিবাসী প্রার্থীরা এই পদে প্রতিদ্ধন্ধিতা করে নির্বাচিত হবেন। এই দুই বিভাগের স্থানীয় সরকারের আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় আইন তৈরি করা। উত্তর জনপদের সাঁওতাল আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষা ও অক্ষর রয়েছে। তাই এদের নিজস্ব ভাষায় শিক্ষা প্রদানের জন্য সরকারিভাবে বিদ্যালয় স্থাপন করা। দীর্ঘদিন, অর্থাৎ যুগ যুগ ধরে উত্তর জনপদের আদিবাসীরা শোষণ-বঞ্চনার শিকার, তাই এরা মূল ¯্রােতের সঙ্গে মিশে পড়াশোনা করে করতে গিয়ে উপেক্ষিত হয়, তাই এদের জন্য পৃথক কারিগরিসহ সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারিভাবে স্থাপন করা দরকার। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোটায় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে উত্তর জনপদের আদিবাসীরা পিছিয়ে তাই তাদের বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থায় মেধাবী করার মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের পথটি তৈরি করা।
সরকারের উচিত উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীদের দিকে বিশেষ নজর দেয়া।
[লেখক : উন্নয়নকর্মী]