alt

উপ-সম্পাদকীয়

পরিবারতন্ত্র ও পরিবারতত্ত্ব : উত্তরণের উপায়

মাহরুফ চৌধুরী

: সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোতে পরিবারতন্ত্র সুগভীর শিকড় বিস্তার করে রেখেছে, যা ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ঘটিয়ে গণতন্ত্রের চর্চাকে সংকুচিত করেছে এবং সুশাসনের পথে বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রস্তাবিত পরিবারতত্ত্বের ধারণা একটি ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ উন্মোচন করে, যেখানে রাষ্ট্রকে বৃহত্তর পরিবার হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। এই ধারণাটি আমাদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়পরায়ণ এবং কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি হতে পারে। আগের দুটি নিবন্ধে আমরা দেখিয়েছি যে পরিবারতত্ত্ব শুধু তত্ত্বগত আদর্শ নয়, বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে তা একটি বাস্তবিক পথ প্রদর্শন করতে পারে। তবে এই ধারণাকে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং কার্যকর উদ্যোগ, যা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ‘দেশ ও দশের কল্যাণে দায় ও দরদের’ সমাজ প্রতিষ্ঠায় আমাদের জন্য পরিবারতন্ত্র থেকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় উত্তরণের সুযোগ সৃষ্টি করবে। এখানে আমরা পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় নিয়ে আলোচনা করব, যা বর্তমান সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোয় পরিবারতন্ত্রের প্রভাববলয় থেকে উত্তরণে আমাদের সহায়তা করতে পারে।

১. রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বৈষম্যমূলক কাঠামোর অবসান ঘটানো অত্যন্ত জরুরি। দেশে বিদ্যমান পরিবারতন্ত্রের প্রভাবে ক্ষমতা কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তি, পরিবার, দল বা গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, যা একটি বৈষম্যমূলক সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোর জন্ম দেয়। এই কাঠামো ভাঙার মাধ্যমে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব, যেখানে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত সহজ হবে। এই লক্ষ্য অর্জনে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতার কেন্দ্রিকরণ রোধে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং নেতৃত্ব নির্বাচনে যোগ্যতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিবেশ তৈরি করা

অপরিহার্য। এতে করে নতুন এবং মেধাবী নেতৃত্ব উঠে আসার পথ প্রশস্ত হবে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ধনী-গরিব বৈষম্য কমাতে সমতাভিত্তিক করনীতি প্রণয়ন, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সম্প্রসারণ এবং আর্থিক ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষত, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। সামাজিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে সামাজিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গ্রামীণ এবং শহুরে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ কর্মসূচি চালু করা প্রয়োজন, যা তাদের উন্নয়নের মূলধারায় নিয়ে আসবে। আর এই উদ্যোগগুলো একত্রে বৈষম্যমূলক কাঠামোর অবসান ঘটিয়ে একটি সমতাভিত্তিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ন্যায়পরায়ণ সমাজ গড়ে তোলার পথকে সুগম করবে।

২. গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সংহতি স্থাপন আজ সময়ের দাবি। পরিবারতন্ত্রের আধিপত্য শুধু

ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেতৃত্বকেই প্রাধান্য দেয় না, এটি দলীয়, সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় গণতান্ত্রিক চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করে রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে সংকীর্ণ করে তোলে। এ কারণে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে শক্তিশালী করার জন্য রাজনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামোয় ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক কাঠামো ও ব্যবস্থাপনায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালানো হবে রাষ্ট্রসংস্কার প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই প্রক্রিয়া অনুসরণের মাধ্যমে নেতৃত্বের উত্তরাধিকারভিত্তিক ব্যবস্থার পরিবর্তে স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেতৃত্ব নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। দলের সদস্যদের মতামতকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে এবং দলীয় কর্মীদের সৃজনশীল চিন্তাভাবনার প্রতি সম্মান জানিয়ে নতুন নেতৃত্বের বিকাশে সমর্থন দেয়া অপরিহার্য।

নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাও টেকসই গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি ও নিশ্চত করার জন্য অপরিহার্য। এজন্য নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং স্বচ্ছ করতে হবে।

আশার কথা যে সরকার এই কাজে হাত দিয়েছে। এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানটিকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে জনগণের কাছে তার নির্ভরযোগ্যতা অক্ষত থাকে এবং দলীয় বা ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে। স্বাধীন ও সুষ্ঠু নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা গেলে জনগণের ক্ষমতায়নের পথ সুগম হবে। এটি শুধু রাজনৈতিক নেতাদের নির্বাচনের ক্ষেত্রে নয়, বরং জনগণকে তাদের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব করার জন্য সঠিক নেতৃত্ব বেছে নিতে সক্ষম করে তুলবে। আশা করা যায়, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার এই সংহতিই পরিবারতন্ত্র থেকে মুক্তি এবং সুশাসনের পথে একটি বড় পদক্ষেপ হয়ে উঠবে।

৩. পারিবারিক শিক্ষা, জনশিক্ষা এবং গণশিক্ষার সমন্বয়ের মাধ্যমে গণসচেতনতার প্রসার সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন বিবর্তন এবং রূপান্তরে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। পরিবারতন্ত্রের গভীর প্রভাব কমানোর জন্য শিক্ষার প্রসার এবং সচেতনতার বৃদ্ধি অত্যন্ত

অপরিহার্য। পারিবারিক শিক্ষার বিশেষ ভূমিকাকে আলিঙ্গন করতে হবে। পরিবার হলো ব্যক্তিমানুষের জীবনে প্রথম শিক্ষাঙ্গন। সেখান থেকেই মানুষের ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ, নৈতিকতা এবং মানবিক মূল্যবোধ শেখা শুরু হয়। তাই পরিবারে গণতান্ত্রিক আচরণ, ন্যায্যতা এবং সহমর্মিতার পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবে। পাশাপাশি সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গুরুত্বকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, এবং সামাজিক সমতা নিয়ে বিশেষ পাঠ্যক্রম প্রবর্তন করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা, অংশীদারত্ব এবং দায়িত্ববোধ জাগ্রত হবে। উদাহরণস্বরূপ, নাগরিক দায়িত্ব, নেতৃত্বের গুণাবলি, এবং মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলোকে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। তাছাড়া অনানুষ্ঠানিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার বিস্তারে গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

গণমাধ্যম সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম। টেলিভিশন, রেডিও, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং সংবাদপত্রের মাধ্যমে নেতৃত্বের যোগ্যতা, দায়িত্বশীলতা, এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের গুরুত্ব তুলে ধরা যেতে পারে। গণমাধ্যমগুলো রাষ্ট্র, সরকার, ক্ষমতাসীন দল, জনপ্রশাসন যে পরস্পর থেকে পৃথক এবং এদের সীমা-পরিসীমা যে ভিন্ন সে সম্পর্কে জনশিক্ষার আয়োজনটা সুচারুরূপে

আনজাম দিতে পারে। সচেতনতা বৃদ্ধির এমন কার্যক্রম সাধারণ জনগণকে দায়িত্বশীল, অধিকারসচেতন এবং সমালোচনামুখর নাগরিক হতে সাহায্য করবে। এই জনশিক্ষার পদ্ধতিগত উন্নয়ন এবং গণমাধ্যমের সক্রিয় ভূমিকা নাগরিকদের মধ্যে পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করবে এবং সুশাসনের জন্য একটি দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করবে।

৪. বর্তমান পরিস্থিতিতে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। পরিবারতন্ত্রের কেন্দ্রীভূত প্রভাব কমিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ একটি কার্যকর উপায়। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হলে এটিকে স্বায়ত্তশাসিত এবং কার্যকর করে তুলতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করা জরুরি। স্থানীয় পর্যায়ে যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি আরও শক্তিশালী হবে। রাজনীতি এবং প্রশাসনের ক্ষমতা শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে সীমাবদ্ধ না রেখে, স্থানীয় প্রশাসন এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করতে হবে। এতে জনগণের সমস্যাগুলো স্থানীয়ভাবে সমাধান করার পথ সুগম হবে এবং কেন্দ্রীয় প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে। স্থানীয় সরকারের কার্যক্রমে জনগণের অংশগ্রহণ বাড়াতে হলে প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি এবং উপযুক্ত সুযোগ সৃষ্টি। এটি ক্ষমতার প্রকৃত মালিকানা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। স্থানীয় সরকার ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ শুধু সুশাসনকে ত্বরান্বিত করবে না, বরং পরিবারতন্ত্রের প্রভাব কমিয়ে একটি গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতেও সহায়তা করবে।

৫. নাগরিক মূল্যবোধের উন্নয়ন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কৃতির চর্চা উৎসাহিত করা একটি সমৃদ্ধ এবং ন্যায়পরায়ণ সমাজ গঠনের জন্য অপরিহার্য। পরিবারতন্ত্রের নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে সমাজে এমন একটি সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে যেখানে সবার জন্য সমান সুযোগ এবং মর্যাদা নিশ্চিত হয়।

সমাজে অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিমালা চালু করে বিভিন্ন সম্প্রদায়, মত, এবং দলের লোকজনের অধিকার সুরক্ষিত করতে হবে। সামাজিক বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি পরিবেশ তৈরি করা আবশ্যক, যেখানে প্রতিটি নাগরিকের মতামত এবং অবদান সমান গুরুত্ব পাবে। সুনাগরিক ও সুশাসক তৈরিতে পারিবারিক এবং সামাজিক শিক্ষার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দায়িত্বশীল নাগরিক এবং সৃজনশীল নেতৃত্ব গড়ে তোলার জন্য নৈতিক মূল্যবোধ, মানবিকতা, এবং গণতান্ত্রিক চর্চাকে পরিবার থেকেই লালন করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীল চিন্তাভাবনার বিকাশে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংগঠনগুলোতে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। এজন্য একটি স্বাধীন তদারকি সংস্থার কার্যক্রম চালু করা যেতে পারে, যা দলগুলোর সাংগঠনিক নীতিমালা এবং কার্যক্রমের ওপর নজর রাখবে। এই সংস্থা শুধু দুর্নীতি প্রতিরোধই করবে না, বরং কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে। নাগরিক মূল্যবোধ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কৃতির চর্চা উৎসাহিত করার মাধ্যমে একটি অংশগ্রহণমূলক এবং দায়িত্বশীল সমাজ তৈরি করা সম্ভব। এ প্রক্রিয়াটি পরিবারতন্ত্রের প্রভাব হ্রাস করে একটি গণতান্ত্রিক এবং ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনে সহায়তা করবে।

পরিবারতন্ত্র থেকে উত্তরণ কোনো সহজ বা দ্রুত অর্জনযোগ্য কাজ নয়, কারণ এটি আমাদের সমাজব্যবস্থা ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার গভীরে প্রোথিত। একটি চলমান কাঠামো ভেঙে আরেকটি সমতাভিত্তিক ও গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে প্রয়োজন ধৈর্য, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টা। জনগণের সচেতন অংশগ্রহণ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা, এবং নেতৃত্বের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে পরিবারতন্ত্রের প্রভাব ধীরে ধীরে হ্রাস করা সম্ভব। আর সেটা করা গেলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পরিবারতত্ত্ব একটি মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের ক্ষেত্রে শক্তিশালী অনুপ্রেরণা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এই তত্ত্বের মাধ্যমে আমরা এমন একটি সমাজ কল্পনা করতে পারি, যেখানে প্রতিটি নাগরিকের অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত হবে এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠা পাবে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার, প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি এবং নাগরিকদের সচেতনতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিতে হবে। জনগণ, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং প্রশাসনের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে রাষ্ট্রবিনির্মাণে ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ন্যায়ভিত্তিক কাঠামো গড়ে তুলতে, যা ভবিষ্যতের জন্য একটি সমৃদ্ধ, সুশৃঙ্খল এবং প্রগতিশীল বাংলাদেশ নির্মাণের ভিত্তি স্থাপন করবে।

[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভূমিকা

প্রগতিতে অগ্রগতি

উপেক্ষিত উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীরা

সরিষার তেল গবেষণায় সাফল্য

সিরিয়ায় রাজনৈতিক পালাবদল : কার লাভ, কার ক্ষতি?

অতীত থেকে মুক্তি এবং ইতিবাচক জীবনযাপন

মুক্তি সংগ্রামে তিনটি ধারা

বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকা কেন পিছিয়ে

শুধু নিচেই নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর

উপেক্ষিত আটকে পড়া পাকিস্তানিরা

রম্যগদ্য : সিন্দাবাদের বুড়ো ও আমরা

নেই কেনো সেই পাখি

বায়ুদূষণ থেকে মুক্তি কোন পথে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : রাষ্ট্র সংস্কারের দুর্গম পথ

পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র

বিজয়ের প্রেরণা

মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার পুনর্বীক্ষণ

সিদরাত জেবিনের মৃত্যু অথবা প্রশ্নহীন বায়ুদূষণ

বিজয়ের গৌরব ও সম্ভাবনাময় তরুণ সমাজ

ছবি

মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের অবদান

ছবি

বিজয় সংগ্রামের সূচনার সন্ধানে

মানসম্মত কনটেন্ট ও টিআরপির দ্বৈরথ

জিকা ভাইরাস রোধে প্রয়োজন সচেতনতা

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবার গুরুত্ব

ঢাকার বাতাস বিষাক্ত কেন

চরের কৃষি ও কৃষকের জীবন

নিম্ন আয়ের মানুষ ভালো নাই

সবার আগে নিজেকে পরিবর্তন করা দরকার

পুলিশ কবে পুলিশ হবে

জীবন ফিরে আসুক বাংলার নদীগুলোতে

কান্দন সরেন হত্যা ও ভূমি বিরোধ কি এড়ানো যেত না

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র: রাষ্ট্র বিনির্মাণে সমস্যা কোথায়?

মানবাধিকার দিবস : মানুষের অধিকার নিয়ে কেন এত কথা?

আমলাতান্ত্রিক স্বচ্ছতা : সংস্কারের পথে নাকি পুনরাবৃত্তি?

খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কিছু কথা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

পরিবারতন্ত্র ও পরিবারতত্ত্ব : উত্তরণের উপায়

মাহরুফ চৌধুরী

সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোতে পরিবারতন্ত্র সুগভীর শিকড় বিস্তার করে রেখেছে, যা ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ঘটিয়ে গণতন্ত্রের চর্চাকে সংকুচিত করেছে এবং সুশাসনের পথে বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রস্তাবিত পরিবারতত্ত্বের ধারণা একটি ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ উন্মোচন করে, যেখানে রাষ্ট্রকে বৃহত্তর পরিবার হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। এই ধারণাটি আমাদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়পরায়ণ এবং কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি হতে পারে। আগের দুটি নিবন্ধে আমরা দেখিয়েছি যে পরিবারতত্ত্ব শুধু তত্ত্বগত আদর্শ নয়, বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে তা একটি বাস্তবিক পথ প্রদর্শন করতে পারে। তবে এই ধারণাকে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং কার্যকর উদ্যোগ, যা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ‘দেশ ও দশের কল্যাণে দায় ও দরদের’ সমাজ প্রতিষ্ঠায় আমাদের জন্য পরিবারতন্ত্র থেকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় উত্তরণের সুযোগ সৃষ্টি করবে। এখানে আমরা পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় নিয়ে আলোচনা করব, যা বর্তমান সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোয় পরিবারতন্ত্রের প্রভাববলয় থেকে উত্তরণে আমাদের সহায়তা করতে পারে।

১. রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বৈষম্যমূলক কাঠামোর অবসান ঘটানো অত্যন্ত জরুরি। দেশে বিদ্যমান পরিবারতন্ত্রের প্রভাবে ক্ষমতা কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তি, পরিবার, দল বা গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, যা একটি বৈষম্যমূলক সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোর জন্ম দেয়। এই কাঠামো ভাঙার মাধ্যমে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব, যেখানে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত সহজ হবে। এই লক্ষ্য অর্জনে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতার কেন্দ্রিকরণ রোধে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং নেতৃত্ব নির্বাচনে যোগ্যতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিবেশ তৈরি করা

অপরিহার্য। এতে করে নতুন এবং মেধাবী নেতৃত্ব উঠে আসার পথ প্রশস্ত হবে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ধনী-গরিব বৈষম্য কমাতে সমতাভিত্তিক করনীতি প্রণয়ন, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সম্প্রসারণ এবং আর্থিক ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষত, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। সামাজিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে সামাজিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গ্রামীণ এবং শহুরে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ কর্মসূচি চালু করা প্রয়োজন, যা তাদের উন্নয়নের মূলধারায় নিয়ে আসবে। আর এই উদ্যোগগুলো একত্রে বৈষম্যমূলক কাঠামোর অবসান ঘটিয়ে একটি সমতাভিত্তিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ন্যায়পরায়ণ সমাজ গড়ে তোলার পথকে সুগম করবে।

২. গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সংহতি স্থাপন আজ সময়ের দাবি। পরিবারতন্ত্রের আধিপত্য শুধু

ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেতৃত্বকেই প্রাধান্য দেয় না, এটি দলীয়, সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় গণতান্ত্রিক চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করে রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে সংকীর্ণ করে তোলে। এ কারণে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে শক্তিশালী করার জন্য রাজনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামোয় ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক কাঠামো ও ব্যবস্থাপনায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালানো হবে রাষ্ট্রসংস্কার প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই প্রক্রিয়া অনুসরণের মাধ্যমে নেতৃত্বের উত্তরাধিকারভিত্তিক ব্যবস্থার পরিবর্তে স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেতৃত্ব নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। দলের সদস্যদের মতামতকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে এবং দলীয় কর্মীদের সৃজনশীল চিন্তাভাবনার প্রতি সম্মান জানিয়ে নতুন নেতৃত্বের বিকাশে সমর্থন দেয়া অপরিহার্য।

নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাও টেকসই গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি ও নিশ্চত করার জন্য অপরিহার্য। এজন্য নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং স্বচ্ছ করতে হবে।

আশার কথা যে সরকার এই কাজে হাত দিয়েছে। এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানটিকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে জনগণের কাছে তার নির্ভরযোগ্যতা অক্ষত থাকে এবং দলীয় বা ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে। স্বাধীন ও সুষ্ঠু নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা গেলে জনগণের ক্ষমতায়নের পথ সুগম হবে। এটি শুধু রাজনৈতিক নেতাদের নির্বাচনের ক্ষেত্রে নয়, বরং জনগণকে তাদের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব করার জন্য সঠিক নেতৃত্ব বেছে নিতে সক্ষম করে তুলবে। আশা করা যায়, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার এই সংহতিই পরিবারতন্ত্র থেকে মুক্তি এবং সুশাসনের পথে একটি বড় পদক্ষেপ হয়ে উঠবে।

৩. পারিবারিক শিক্ষা, জনশিক্ষা এবং গণশিক্ষার সমন্বয়ের মাধ্যমে গণসচেতনতার প্রসার সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন বিবর্তন এবং রূপান্তরে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। পরিবারতন্ত্রের গভীর প্রভাব কমানোর জন্য শিক্ষার প্রসার এবং সচেতনতার বৃদ্ধি অত্যন্ত

অপরিহার্য। পারিবারিক শিক্ষার বিশেষ ভূমিকাকে আলিঙ্গন করতে হবে। পরিবার হলো ব্যক্তিমানুষের জীবনে প্রথম শিক্ষাঙ্গন। সেখান থেকেই মানুষের ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ, নৈতিকতা এবং মানবিক মূল্যবোধ শেখা শুরু হয়। তাই পরিবারে গণতান্ত্রিক আচরণ, ন্যায্যতা এবং সহমর্মিতার পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবে। পাশাপাশি সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গুরুত্বকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, এবং সামাজিক সমতা নিয়ে বিশেষ পাঠ্যক্রম প্রবর্তন করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা, অংশীদারত্ব এবং দায়িত্ববোধ জাগ্রত হবে। উদাহরণস্বরূপ, নাগরিক দায়িত্ব, নেতৃত্বের গুণাবলি, এবং মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলোকে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। তাছাড়া অনানুষ্ঠানিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার বিস্তারে গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

গণমাধ্যম সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম। টেলিভিশন, রেডিও, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং সংবাদপত্রের মাধ্যমে নেতৃত্বের যোগ্যতা, দায়িত্বশীলতা, এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের গুরুত্ব তুলে ধরা যেতে পারে। গণমাধ্যমগুলো রাষ্ট্র, সরকার, ক্ষমতাসীন দল, জনপ্রশাসন যে পরস্পর থেকে পৃথক এবং এদের সীমা-পরিসীমা যে ভিন্ন সে সম্পর্কে জনশিক্ষার আয়োজনটা সুচারুরূপে

আনজাম দিতে পারে। সচেতনতা বৃদ্ধির এমন কার্যক্রম সাধারণ জনগণকে দায়িত্বশীল, অধিকারসচেতন এবং সমালোচনামুখর নাগরিক হতে সাহায্য করবে। এই জনশিক্ষার পদ্ধতিগত উন্নয়ন এবং গণমাধ্যমের সক্রিয় ভূমিকা নাগরিকদের মধ্যে পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করবে এবং সুশাসনের জন্য একটি দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করবে।

৪. বর্তমান পরিস্থিতিতে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। পরিবারতন্ত্রের কেন্দ্রীভূত প্রভাব কমিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ একটি কার্যকর উপায়। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হলে এটিকে স্বায়ত্তশাসিত এবং কার্যকর করে তুলতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করা জরুরি। স্থানীয় পর্যায়ে যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি আরও শক্তিশালী হবে। রাজনীতি এবং প্রশাসনের ক্ষমতা শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে সীমাবদ্ধ না রেখে, স্থানীয় প্রশাসন এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করতে হবে। এতে জনগণের সমস্যাগুলো স্থানীয়ভাবে সমাধান করার পথ সুগম হবে এবং কেন্দ্রীয় প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে। স্থানীয় সরকারের কার্যক্রমে জনগণের অংশগ্রহণ বাড়াতে হলে প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি এবং উপযুক্ত সুযোগ সৃষ্টি। এটি ক্ষমতার প্রকৃত মালিকানা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। স্থানীয় সরকার ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ শুধু সুশাসনকে ত্বরান্বিত করবে না, বরং পরিবারতন্ত্রের প্রভাব কমিয়ে একটি গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতেও সহায়তা করবে।

৫. নাগরিক মূল্যবোধের উন্নয়ন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কৃতির চর্চা উৎসাহিত করা একটি সমৃদ্ধ এবং ন্যায়পরায়ণ সমাজ গঠনের জন্য অপরিহার্য। পরিবারতন্ত্রের নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে সমাজে এমন একটি সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে যেখানে সবার জন্য সমান সুযোগ এবং মর্যাদা নিশ্চিত হয়।

সমাজে অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিমালা চালু করে বিভিন্ন সম্প্রদায়, মত, এবং দলের লোকজনের অধিকার সুরক্ষিত করতে হবে। সামাজিক বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি পরিবেশ তৈরি করা আবশ্যক, যেখানে প্রতিটি নাগরিকের মতামত এবং অবদান সমান গুরুত্ব পাবে। সুনাগরিক ও সুশাসক তৈরিতে পারিবারিক এবং সামাজিক শিক্ষার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দায়িত্বশীল নাগরিক এবং সৃজনশীল নেতৃত্ব গড়ে তোলার জন্য নৈতিক মূল্যবোধ, মানবিকতা, এবং গণতান্ত্রিক চর্চাকে পরিবার থেকেই লালন করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীল চিন্তাভাবনার বিকাশে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংগঠনগুলোতে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। এজন্য একটি স্বাধীন তদারকি সংস্থার কার্যক্রম চালু করা যেতে পারে, যা দলগুলোর সাংগঠনিক নীতিমালা এবং কার্যক্রমের ওপর নজর রাখবে। এই সংস্থা শুধু দুর্নীতি প্রতিরোধই করবে না, বরং কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে। নাগরিক মূল্যবোধ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কৃতির চর্চা উৎসাহিত করার মাধ্যমে একটি অংশগ্রহণমূলক এবং দায়িত্বশীল সমাজ তৈরি করা সম্ভব। এ প্রক্রিয়াটি পরিবারতন্ত্রের প্রভাব হ্রাস করে একটি গণতান্ত্রিক এবং ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনে সহায়তা করবে।

পরিবারতন্ত্র থেকে উত্তরণ কোনো সহজ বা দ্রুত অর্জনযোগ্য কাজ নয়, কারণ এটি আমাদের সমাজব্যবস্থা ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার গভীরে প্রোথিত। একটি চলমান কাঠামো ভেঙে আরেকটি সমতাভিত্তিক ও গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে প্রয়োজন ধৈর্য, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টা। জনগণের সচেতন অংশগ্রহণ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা, এবং নেতৃত্বের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে পরিবারতন্ত্রের প্রভাব ধীরে ধীরে হ্রাস করা সম্ভব। আর সেটা করা গেলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পরিবারতত্ত্ব একটি মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের ক্ষেত্রে শক্তিশালী অনুপ্রেরণা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এই তত্ত্বের মাধ্যমে আমরা এমন একটি সমাজ কল্পনা করতে পারি, যেখানে প্রতিটি নাগরিকের অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত হবে এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠা পাবে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার, প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি এবং নাগরিকদের সচেতনতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিতে হবে। জনগণ, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং প্রশাসনের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে রাষ্ট্রবিনির্মাণে ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ন্যায়ভিত্তিক কাঠামো গড়ে তুলতে, যা ভবিষ্যতের জন্য একটি সমৃদ্ধ, সুশৃঙ্খল এবং প্রগতিশীল বাংলাদেশ নির্মাণের ভিত্তি স্থাপন করবে।

[লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]

back to top