গাজী তারেক আজিজ
সময়টা প্রতিনিয়ত উৎকর্ষিত হয় সময়ের হাত ধরে। মানবসন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর আলাদা সংকটে রূপ নেয় যদি সেই সন্তানটি হয় কন্যাশিশু। আর তার বিপরীতে সবারই প্রত্যাশা থাকে ঘর আলো করে আসবে পুত্র সন্তান। বংশকুল রক্ষায় একমাত্র উত্তরাধিকার হিসেবে বিবেচ্য হয় পুত্রধন বংশের প্রদীপ। পিতা-মাতা বৃদ্ধ বয়েসে কামাই-রোজগার করে দুবেলা দুমুঠো অন্ন তুলে দেবে সবাই কামনা করে এমনটি। যদিও উত্তরোত্তর এরূপ ধ্যান-ধারণা
পরিবর্তিত হয়ে কন্যাসন্তানও পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম বা সহায়ক ব্যক্তি হিসেবে প্রায়শই ভূমিকা রাখে কিংবা রাখার ঐকান্তিক ইচ্ছা পোষণ করে। আর তা শুধু নিয়তি নির্ধারিত বললে ভুল হবে।
নারী অধিকারের স্বপ্নদ্রষ্টা মহীয়সী নারী কিংবদন্তি বেগম রোকেয়া ও সুফিয়া কামালের আমলে পথ যতটা না মসৃণ ছিল এখন এই ডিজিটাল যুগে নারী আর নারী রূপে বিবেচিত না হয়ে দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে একজন দক্ষ ও যোগ্য কর্মী হিসেবে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখে। আর এক্ষেত্রে তা হয়ে থাকে পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায়। পরিবারে পিতা-ভ্রাতা, স্বামী-সন্তানের উৎসাহ-উদ্দীপনা ব্যতিরেকে কোনভাবেই নারী নিজেকে এগিয়ে নিতে সচেষ্ট হয় না। নারী গৃহে শোভাবর্ধনকারী শো-পিস হিসেবে কিংবা সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে কাজ করবে এরূপ মান্ধাতা আমলের একরোখা ও গোঁড়া মনোভাব থেকে সবাইকে সরে আসতে হবে। প্রথম বয়সে পিতার উৎসাহে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, শিক্ষা-চিকিৎসা কিংবা মাঠপর্যায়ের কোন পদ-পদবি কিংবা রাজনীতিক, আইনজীবী তথা বিমানের পাইলট হিসেবেও নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পূর্ণমাত্রায় সক্ষমতা অর্জন একান্তই একাগ্রতার বিষয়। নারীর কল্পনার জগত এত বেশি সমৃদ্ধ যে, বেশকিছু নারী মনোনিবেশ করেছেন সাহিত্য সাধনায়। বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার পাতায় তাদের লেখনীতেই স্পষ্ট হয় যে, তাদের আবেগ-অনুভূতিকে ভিন্নমাত্রায় প্রকাশের সক্ষমতা একান্তই নারীকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিই নয়। আর এক্ষেত্রে সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন অগ্রগণ্য। গোয়েন্দা কাহিনীর লেখক রোমেনা আফাজ কিশোর বয়েসের পাঠকদের কাছে খুবই জনপ্রিয় তার লেখনী গুণে। ভাস্কর্য শিল্পেও নারীর মোহিনী ছোঁয়া লেগেছে। ক্রীড়া ক্ষেত্রে নারীর বহুমুখিতা চমৎকারভাবেই লক্ষ্যণীয় হয়। কি ব্যাডমিন্টন, দাবা, ক্রিকেট, ফুটবল ও টেনিস নৈপুণ্যে সর্বক্ষেত্রে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম। পাশাপাশি নিজেকে সৎ নির্ভীক যোগ্য ও সফলতম হিসেবে তুলে ধরতে পারে অনন্য উচ্চতায়।
স্কুলে শিক্ষকতায় নারী, শৈল্য-হোমিও-হেকিমি-দন্ত-মেডিসিন-সার্জারিসহ সেবিকা হিসেবেও সফল। আইন-বিজ্ঞানে বৈপ্লবিক উন্নতি সাধন চোখে পড়ার মতো অগ্রগতি। বর্তমান সময়ে গাড়ি চালনায় পারদর্শিতা উল্লেখ করার মতো। আর রাজনীতিতে যুগান্তকারী উন্নয়ন সাধিত হয়েছে বহুকাল আগে। এ সময়ে বাংলাদেশ নারী প্রগতিতে
পথিকৃতের ভূমিকায় শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। এবং নারীর ক্ষমতায়নে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশ এখন চালকের আসনে, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। একজন লোককেও যুক্তি খ-ন করে এর বিপরীতে অবস্থান নেয়ার ইচ্ছা পোষণ করতে দেখা যায় না এটুকু বিনা বাক্য ব্যয়ে বলা যায়Ñ নারীর ইচ্ছাশক্তি এতই প্রবল যে পুরুষের সমকক্ষ দাবি নয় ক্ষেত্রবিশেষে সুউচ্চ অবস্থায় আসীন করে রেখেছে নিজেকে।
একই ব্যক্তিসত্তা অথচ ভিন্ন ভিন্ন রূপ ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা, কন্যা-জায়া-জননী এর বাইরে পরম প্রেমময়ী প্রেয়সীর ভূমিকা ছাড়াও যুদ্ধের ময়দানে সৈনিকবেশে অস্ত্র হাতে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে প্রবল পরাক্রমশালী শত্রুর মোকাবিলায় পরাস্ত করে বিজয় অর্জন দেশ মাতৃকার গৌরব বহুলাংশে বর্ধিত করে। সাংবাদিকতায় নারী আরও বহুদা চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে কখনও কুণ্ঠাবোধ না করে ইতিহাস ঐতিহ্যের গৌরবময় অংশীদার হওয়া কর্মে ব্যাপক উদ্দীপনা জোগায়। বিনোদন জগতেও নারীর অবাধ বিচরণ সমাজে বৃহদাকার বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পুরোমাত্রায় সচেষ্ট। ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠানে ও বিচারক হিসেবেও সাফল্যের অংশীদার। কর্মক্ষেত্রে সুষ্ঠু ও নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে পুরুষের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি যথেষ্ট সহায়ক বিবেচিত হয়। এর উল্টো চিত্রও হয়তো পরিলক্ষিত হয়। তথাপিও তাহা ছাপিয়ে ইতিবাচকভাবেই নিরন্তর সফলতার পেছনে ছুটে চলা নারী সার্বজনীন সমাজ সংগঠকের ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হতে শেখে। বাংলাদেশসহ বহুবিধ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেত্রী স্পিকারসহ পুলিশ বিভাগেও নারীকে সংসারধর্ম সামলে নিয়ে জীবন-জীবিকার তাগিদে কাজ করে যেতে হয়। শ্রমিক হিসেবেও শিল্প-কারখানায় কলের চাকা ঘুরিয়ে দেশের উন্নয়নের চাকা গতিশীল রাখা ও বিদেশে কাজ করে উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠিয়ে রেমিট্যান্সের মাধ্যমে দেশের সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে, যা অত্যন্ত গৌরবের।
পিতার অবর্তমানে মাতার ভূমিকার কথা হরহামেশাই শোনা যায়। অল্প বয়সে বৈধব্য বরণ করার পর অকূল-পাথারে ভাসা পরিবারে মাতা শুধু মাতাই নয়, পিতার ভূমিকায় আসীন হয়ে কাম-বাসনাকে পরিত্যাগ করে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে জীবন পার করে দেয়া নারীকে আমরা সংগ্রামী নারী সর্বোপরি মহীয়সী নারী হিসেবে আখ্যা দিলেও কম হয়ে যায়। দাম্পত্য জীবনে পুত্রসন্তানের অবর্তমানে কন্যাসন্তানকে সামাজিক নিয়মে বিয়ে দেয়ার পর শেষ বয়সে পিতা-মাতার দেখভাল করার কেউ থাকে না। আর্থিক অবস্থাসম্পন্ন হলে ভৃত্যের সহযোগিতায় বা বৃদ্ধাশ্রমই শেষ ভরসা। তবে অনেক সময় কন্যার বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ির সহমর্মিতায় কন্যা তার পিতৃপরিবারের ভালো-মন্দের খোঁজ খবর নেয়া ও সহায়তা করতে পারে। আবার পুত্রসন্তান থাকলে পুত্রবধূ হিসেবে যখন অন্য
পরিবারের একটি মেয়ে স্বামী গৃহে আসে শ্বশুরবাড়ির লোকজন নিজ পরিবারের আদলে গড়ে নেয় সুখ-দুঃখের ভাগিদার হলে অনেকাংশেই কষ্ট লাঘব হয়। আর এ শিক্ষা নারী প্রাপ্ত হয় পরিবার থেকে। দুর্দিনে নারী দুর্জয়ীর ভূমিকায় ইস্পাতের কঠিন দৃঢ়তায় আগলে রাখে পরিবারকে। জীবন সংগ্রামের সাহসী ও সফলদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবেও এখন সম্মানিত করা হচ্ছে। বেসরকারি উদ্যোগেও সম্মাননা প্রদান করা হয়। নারী প্রগতির ক্ষেত্র প্রসারিত করে জীবনে সফলকাম হয়ে সমাজে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয় পুরুষ। নারী ব্যবসায়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে সফল উদ্যোক্তার পাশাপাশি নিজ উদ্যোগে কর্মক্ষেত্র তৈরি করে অপরাপর নারীদেরও কর্মে উদ্দীপ্ত করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে ব্যাপকভাবে। নারী অধিকার নিয়ে ব্যানার বা টকশো সর্বস্ব বক্তৃতাবাজি বাদ দিয়ে প্রকৃতই নারীর মন-মননের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করে যেতে হবে। নারী প্রেরণার একচ্ছত্র আধার, নারীকে বাদ দিয়ে উন্নয়ন চিন্তা অমূলক। নারীকে বাদ দিয়ে জীবন-সংসার প্রকৃতির বিরুদ্ধে কাজ।
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাই নারীকে প্রগতির পথে এগিয়ে রাখে নিরঙ্কুশ। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে নারীকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ভোগবাদী সমাজটাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে নারী কারো দয়া বা করুণায় নয়, নিজের যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠা পেতে বদ্ধপরিকর। পরিবারে এবং মানসিকতায় নারীর মতামতকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এবং গুরুত্ব দিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে এগিয়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত এবং পিছিয়ে পড়ার পথ অনেকাংশে সংকুচিত হবে। সর্বোপরি, নারীকে নারী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন বৃহৎ পরিসরে স্বীকৃতি ও আন্তর্জাতিক পরিম-লেও নারী স্বীয় অবস্থান ধরে রাখতে ও মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে পারে। আর এ থেকেই দৃষ্ট হয় নারী বিপুলা পৃথিবীর এক প্রাণবন্ত বিস্ময়।
[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]
গাজী তারেক আজিজ
সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
সময়টা প্রতিনিয়ত উৎকর্ষিত হয় সময়ের হাত ধরে। মানবসন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর আলাদা সংকটে রূপ নেয় যদি সেই সন্তানটি হয় কন্যাশিশু। আর তার বিপরীতে সবারই প্রত্যাশা থাকে ঘর আলো করে আসবে পুত্র সন্তান। বংশকুল রক্ষায় একমাত্র উত্তরাধিকার হিসেবে বিবেচ্য হয় পুত্রধন বংশের প্রদীপ। পিতা-মাতা বৃদ্ধ বয়েসে কামাই-রোজগার করে দুবেলা দুমুঠো অন্ন তুলে দেবে সবাই কামনা করে এমনটি। যদিও উত্তরোত্তর এরূপ ধ্যান-ধারণা
পরিবর্তিত হয়ে কন্যাসন্তানও পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম বা সহায়ক ব্যক্তি হিসেবে প্রায়শই ভূমিকা রাখে কিংবা রাখার ঐকান্তিক ইচ্ছা পোষণ করে। আর তা শুধু নিয়তি নির্ধারিত বললে ভুল হবে।
নারী অধিকারের স্বপ্নদ্রষ্টা মহীয়সী নারী কিংবদন্তি বেগম রোকেয়া ও সুফিয়া কামালের আমলে পথ যতটা না মসৃণ ছিল এখন এই ডিজিটাল যুগে নারী আর নারী রূপে বিবেচিত না হয়ে দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে একজন দক্ষ ও যোগ্য কর্মী হিসেবে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখে। আর এক্ষেত্রে তা হয়ে থাকে পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায়। পরিবারে পিতা-ভ্রাতা, স্বামী-সন্তানের উৎসাহ-উদ্দীপনা ব্যতিরেকে কোনভাবেই নারী নিজেকে এগিয়ে নিতে সচেষ্ট হয় না। নারী গৃহে শোভাবর্ধনকারী শো-পিস হিসেবে কিংবা সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে কাজ করবে এরূপ মান্ধাতা আমলের একরোখা ও গোঁড়া মনোভাব থেকে সবাইকে সরে আসতে হবে। প্রথম বয়সে পিতার উৎসাহে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, শিক্ষা-চিকিৎসা কিংবা মাঠপর্যায়ের কোন পদ-পদবি কিংবা রাজনীতিক, আইনজীবী তথা বিমানের পাইলট হিসেবেও নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পূর্ণমাত্রায় সক্ষমতা অর্জন একান্তই একাগ্রতার বিষয়। নারীর কল্পনার জগত এত বেশি সমৃদ্ধ যে, বেশকিছু নারী মনোনিবেশ করেছেন সাহিত্য সাধনায়। বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার পাতায় তাদের লেখনীতেই স্পষ্ট হয় যে, তাদের আবেগ-অনুভূতিকে ভিন্নমাত্রায় প্রকাশের সক্ষমতা একান্তই নারীকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিই নয়। আর এক্ষেত্রে সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন অগ্রগণ্য। গোয়েন্দা কাহিনীর লেখক রোমেনা আফাজ কিশোর বয়েসের পাঠকদের কাছে খুবই জনপ্রিয় তার লেখনী গুণে। ভাস্কর্য শিল্পেও নারীর মোহিনী ছোঁয়া লেগেছে। ক্রীড়া ক্ষেত্রে নারীর বহুমুখিতা চমৎকারভাবেই লক্ষ্যণীয় হয়। কি ব্যাডমিন্টন, দাবা, ক্রিকেট, ফুটবল ও টেনিস নৈপুণ্যে সর্বক্ষেত্রে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম। পাশাপাশি নিজেকে সৎ নির্ভীক যোগ্য ও সফলতম হিসেবে তুলে ধরতে পারে অনন্য উচ্চতায়।
স্কুলে শিক্ষকতায় নারী, শৈল্য-হোমিও-হেকিমি-দন্ত-মেডিসিন-সার্জারিসহ সেবিকা হিসেবেও সফল। আইন-বিজ্ঞানে বৈপ্লবিক উন্নতি সাধন চোখে পড়ার মতো অগ্রগতি। বর্তমান সময়ে গাড়ি চালনায় পারদর্শিতা উল্লেখ করার মতো। আর রাজনীতিতে যুগান্তকারী উন্নয়ন সাধিত হয়েছে বহুকাল আগে। এ সময়ে বাংলাদেশ নারী প্রগতিতে
পথিকৃতের ভূমিকায় শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। এবং নারীর ক্ষমতায়নে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশ এখন চালকের আসনে, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। একজন লোককেও যুক্তি খ-ন করে এর বিপরীতে অবস্থান নেয়ার ইচ্ছা পোষণ করতে দেখা যায় না এটুকু বিনা বাক্য ব্যয়ে বলা যায়Ñ নারীর ইচ্ছাশক্তি এতই প্রবল যে পুরুষের সমকক্ষ দাবি নয় ক্ষেত্রবিশেষে সুউচ্চ অবস্থায় আসীন করে রেখেছে নিজেকে।
একই ব্যক্তিসত্তা অথচ ভিন্ন ভিন্ন রূপ ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা, কন্যা-জায়া-জননী এর বাইরে পরম প্রেমময়ী প্রেয়সীর ভূমিকা ছাড়াও যুদ্ধের ময়দানে সৈনিকবেশে অস্ত্র হাতে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে প্রবল পরাক্রমশালী শত্রুর মোকাবিলায় পরাস্ত করে বিজয় অর্জন দেশ মাতৃকার গৌরব বহুলাংশে বর্ধিত করে। সাংবাদিকতায় নারী আরও বহুদা চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে কখনও কুণ্ঠাবোধ না করে ইতিহাস ঐতিহ্যের গৌরবময় অংশীদার হওয়া কর্মে ব্যাপক উদ্দীপনা জোগায়। বিনোদন জগতেও নারীর অবাধ বিচরণ সমাজে বৃহদাকার বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পুরোমাত্রায় সচেষ্ট। ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠানে ও বিচারক হিসেবেও সাফল্যের অংশীদার। কর্মক্ষেত্রে সুষ্ঠু ও নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে পুরুষের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি যথেষ্ট সহায়ক বিবেচিত হয়। এর উল্টো চিত্রও হয়তো পরিলক্ষিত হয়। তথাপিও তাহা ছাপিয়ে ইতিবাচকভাবেই নিরন্তর সফলতার পেছনে ছুটে চলা নারী সার্বজনীন সমাজ সংগঠকের ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হতে শেখে। বাংলাদেশসহ বহুবিধ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেত্রী স্পিকারসহ পুলিশ বিভাগেও নারীকে সংসারধর্ম সামলে নিয়ে জীবন-জীবিকার তাগিদে কাজ করে যেতে হয়। শ্রমিক হিসেবেও শিল্প-কারখানায় কলের চাকা ঘুরিয়ে দেশের উন্নয়নের চাকা গতিশীল রাখা ও বিদেশে কাজ করে উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠিয়ে রেমিট্যান্সের মাধ্যমে দেশের সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে, যা অত্যন্ত গৌরবের।
পিতার অবর্তমানে মাতার ভূমিকার কথা হরহামেশাই শোনা যায়। অল্প বয়সে বৈধব্য বরণ করার পর অকূল-পাথারে ভাসা পরিবারে মাতা শুধু মাতাই নয়, পিতার ভূমিকায় আসীন হয়ে কাম-বাসনাকে পরিত্যাগ করে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে জীবন পার করে দেয়া নারীকে আমরা সংগ্রামী নারী সর্বোপরি মহীয়সী নারী হিসেবে আখ্যা দিলেও কম হয়ে যায়। দাম্পত্য জীবনে পুত্রসন্তানের অবর্তমানে কন্যাসন্তানকে সামাজিক নিয়মে বিয়ে দেয়ার পর শেষ বয়সে পিতা-মাতার দেখভাল করার কেউ থাকে না। আর্থিক অবস্থাসম্পন্ন হলে ভৃত্যের সহযোগিতায় বা বৃদ্ধাশ্রমই শেষ ভরসা। তবে অনেক সময় কন্যার বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ির সহমর্মিতায় কন্যা তার পিতৃপরিবারের ভালো-মন্দের খোঁজ খবর নেয়া ও সহায়তা করতে পারে। আবার পুত্রসন্তান থাকলে পুত্রবধূ হিসেবে যখন অন্য
পরিবারের একটি মেয়ে স্বামী গৃহে আসে শ্বশুরবাড়ির লোকজন নিজ পরিবারের আদলে গড়ে নেয় সুখ-দুঃখের ভাগিদার হলে অনেকাংশেই কষ্ট লাঘব হয়। আর এ শিক্ষা নারী প্রাপ্ত হয় পরিবার থেকে। দুর্দিনে নারী দুর্জয়ীর ভূমিকায় ইস্পাতের কঠিন দৃঢ়তায় আগলে রাখে পরিবারকে। জীবন সংগ্রামের সাহসী ও সফলদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবেও এখন সম্মানিত করা হচ্ছে। বেসরকারি উদ্যোগেও সম্মাননা প্রদান করা হয়। নারী প্রগতির ক্ষেত্র প্রসারিত করে জীবনে সফলকাম হয়ে সমাজে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয় পুরুষ। নারী ব্যবসায়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে সফল উদ্যোক্তার পাশাপাশি নিজ উদ্যোগে কর্মক্ষেত্র তৈরি করে অপরাপর নারীদেরও কর্মে উদ্দীপ্ত করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে ব্যাপকভাবে। নারী অধিকার নিয়ে ব্যানার বা টকশো সর্বস্ব বক্তৃতাবাজি বাদ দিয়ে প্রকৃতই নারীর মন-মননের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করে যেতে হবে। নারী প্রেরণার একচ্ছত্র আধার, নারীকে বাদ দিয়ে উন্নয়ন চিন্তা অমূলক। নারীকে বাদ দিয়ে জীবন-সংসার প্রকৃতির বিরুদ্ধে কাজ।
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাই নারীকে প্রগতির পথে এগিয়ে রাখে নিরঙ্কুশ। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে নারীকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ভোগবাদী সমাজটাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে নারী কারো দয়া বা করুণায় নয়, নিজের যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠা পেতে বদ্ধপরিকর। পরিবারে এবং মানসিকতায় নারীর মতামতকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এবং গুরুত্ব দিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে এগিয়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত এবং পিছিয়ে পড়ার পথ অনেকাংশে সংকুচিত হবে। সর্বোপরি, নারীকে নারী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন বৃহৎ পরিসরে স্বীকৃতি ও আন্তর্জাতিক পরিম-লেও নারী স্বীয় অবস্থান ধরে রাখতে ও মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে পারে। আর এ থেকেই দৃষ্ট হয় নারী বিপুলা পৃথিবীর এক প্রাণবন্ত বিস্ময়।
[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]