alt

উপ-সম্পাদকীয়

বনভূমি রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন

কামরুজ্জামান

: মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের দেশ। বাংলাদেশ উপকূলীয় অঞ্চলের দেশ। এ দেশ হিমালয় পর্বতমালার পাদদেশীয় দেশ। এ দেশের ভূমিরূপ বৈচিত্র্যময় এবং বন্ধুর প্রকৃতির। এ দেশ রূপসী বাংলার দেশ। এ দেশের রূপবৈচিত্র্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে বনভূমি। বাংলাদেশের বনভূমির বেশির ভাগই পার্বত্য ও উপকূলীয় বনভূমি। এর বাইরে মধুপুর ও ভাওয়ালের গড় অন্যতম।

ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশের জন্য একটি দেশের মোট ভূমির শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। পাঠ্যপুস্তকের হিসাবমতে আমাদের দেশে বনভূমির পরিমাণ রয়েছে ১৭ ভাগ। কিন্তু বর্তমান তথ্যমতে বনভূমির প্রকৃত চিত্র শতকরা ৯ ভাগের মতো বা আরও কম।

ভূগাঠনিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বাংলাদেশের বনভূমিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়।

১. ক্রান্তীয় চিরহরিৎ এবং পাতাঝরা বৃক্ষের বনভূমি

২. ক্রান্তীয় পাতাঝরা বৃক্ষের বনভূমি

৩. স্রোতজ বনভূমি বা সুন্দরবন

ক্রান্তীয় চিরহরিৎ এবং পাতাঝরা গাছের বনভূমি : বাংলাদেশের খাগড়াঝড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানের প্রায় সব অংশে এবং চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের কিছু অংশে এ বনভূমি বিস্তৃত। পাহাড়ের অধিক বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চলে ক্রান্তীয় চিরহরিৎ এবং কম বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চলে পাতাঝরা গাছের বনভূমি দেখা যায়।

ক্রান্তীয় পাতাঝরা গাছের বনভূমি : বাংলাদেশের প্লাইস্টোসিনকালের সোপানসমূহে এ বনভূমি রয়েছে। এ বনভূমিকে দুই অংশে ভাগ করা হয়েছেÑ

ক. ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও গাজীপুর জেলার মধুপুর ও ভাওয়ালের বনভূমি।

খ. দিনাজপুর ও রংপুর জেলায় বরেন্দ্র বনভূমি। শীতকালে এ বনভূমির বৃক্ষের পাতা ঝরে যায়। গ্রীষ্মকালে আবার নতুন পাতা গজায়।

স্রোতজ বনভূমি বা সুন্দরবন : খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলা নিয়ে এ বনভূমিত গঠিত। এ বনভূমির দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে হরিণঘাটা নদী, পিরোজপুর ও বরিশাল জেলা এবং পশ্চিমে রাইমঙ্গল, হাড়িয়াভাঙ্গা নদী ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের আংশিক প্রান্ত সীমা পর্যন্ত এ বনভূমি বিস্তৃত। এটি খুলনা বিভাগের ৬,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা ও লোনা পানি এবং প্রচুর বৃষ্টিপাতের জন্য এ অঞ্চলের বৃক্ষ সমৃদ্ধ। এর বাইরেও বাংলাদেশের সমতল ভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য বনজঙ্গল ও ঝোঁপঝাড়।

এখন কথা হলোÑ দিন যতই যাচ্ছে বাংলাদেশের বনভূমি ততই কমছে। কেন কমছে বনভূমি তার কারণ খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আমাদের দেশে বনভূমি কমে আসার নানা কারণ রয়েছে। বনভূমি দখল এর মধ্যে অন্যতম একটি কারণ। সারা বাংলাদেশে শিল্প কারখানা নির্মাণ, বাসাবাড়ি তৈরি ইত্যাদি কারণে বনের জায়গা দখল হচ্ছে। বনভূমির সঙ্গে জোতজমি থাকায় জমির মালিকের কেউ কেউ জোতজমির সঙ্গে বনভূমির কিছু কিছু জায়গায় বাড়িঘর তৈরি করে দখল করছে।

প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে পাতাঝরা বৃক্ষের বনভূমিতে বৃক্ষের শুকনো পাতা জমা হয়। একশ্রেণীর অতি উৎসাহী মানুষ বনে আগুন ধরিয়ে দেয়। আবার কিছু কিছু জায়গায় পরিকল্পিতভাবেও আগুন দেয়া হয় বৃক্ষনিধনের জন্য। এর ফলে বৃক্ষের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও নতুন বৃক্ষের প্রজনন ব্যাহত হয়। এভাবে প্রাকৃতিক বনায়ন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রতি বছর। গাজীপুরে অবস্থিত ভাওয়ালের জাতীয় উদ্যান ও ভাওয়ালের গড়ে শুষ্ক মৌসুমে প্রতি বছরই আগুন দেয়ার দৃশ্য চোখে পড়ে।

দেশের সার্বিক পরিবেশ দূষণের কারণে বায়ুদূষণ হচ্ছে। আর বায়ুদূষণের প্রভাব বৃক্ষের ওপর পড়ছে। বনের আশপাশে ময়লা-আবর্জনা ফেলার কারণে একটা সময় পরে ময়লার ভাগাড় গড়ে ওঠে। এর প্রভাব পড়ে বনের বৃক্ষের ওপর। মাটি ও বায়ুদূষণের কারণে কিছু কিছু বৃক্ষের মৃত্যু হয়। গাজীপুর ও মধুপুর অঞ্চলের ভাওয়াল গড়ে এই রকম অনেক মৃত বৃক্ষের দেখা পাওয়া যায়।

বিশ্বব্যাপী আরও একটি সমস্যা হচ্ছে বাতাসে কার্বনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। মানুষের আধুনিক জীবনযাপন ও শিল্প কারখানার প্রভাব এর জন্য দায়ী। বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর পরিবর্তনও হচ্ছে এ কারণে। গাছ যে কমছে এর সবচেয়ে বড় নজির হচ্ছে বায়ুম-লে উঞ্চতা বৃদ্ধি, যার প্রভাব বাংলাদেশও লক্ষ্য করা যায়। আয়তনের চেয়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যা এমনিতেই অনেক বেশি। প্রতি বছরই জনসংখ্যা বাড়ছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ পড়ছে খাদ্য ও আবাসস্থলে। বিশেষ করে আবাসস্থলের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে নতুন নতুন বাড়িঘর নির্মাণ হচ্ছে। হচ্ছে বৃক্ষনিধন।

অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ন বনভূমি কমে আসার আরও একটি অন্যতম কারণ। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য শিল্পায়ন ও নগরায়ন হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বনভূমি রক্ষা করে শিল্পায়ন ও নগরায়ন হওয়া প্রয়োজন। অপরিকল্পিত উন্নয়নও বনভূমি কমে আসার জন্য দায়ী। এমন অনেক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় যেখানের পরিবেশ ও প্রতিবেশ অনুযায়ী বৃক্ষের ক্ষতি হয় সবার আগে। এসব উন্নয়ন পরিকল্পনার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনকে আন্দোলনও করতে দেখা যায়। কিন্তু এ দেশে কে শোনে কার কথা!

বনভূমি রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। আর এর জন্য বনভূমি সুরক্ষা আইন কার্যকর করতে হবে। বন বিভাগকে ঢেলে সাজাতে হবে। সৎ ও নীতিবান কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিতে হবে।

প্রাকৃতিক বনায়ন বৃদ্ধির জন্য বনভূমি সুরক্ষা বলয় তৈরি করা এখন সময়ের দাবি। আমাদের যে বনভূমিগুলো রয়েছে সেগুলো নিরাপদ ও প্রাকৃতিক বনভূমি হিসেবে মানুষের চলাচল সীমিত করতে হবে। প্রাকৃতিক বনায়নের বাইরে উপকূলীয় অঞ্চল ও সমতলে নতুন নতুন বনায়ন গড়ে তুলতে হবে। বনের ভূমি উদ্ধার করে গাছ রোপণ করতে হবে। শুধু গাছ রোপণ করলেই হবে না, গাছ হওয়ার জন্য বেড়া দিতে হবে। গাছ নিরাপদভাবে বেড়ে ওঠার জন্য অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ দিতে হবে। নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকদের নতুন বনায়নকৃত ভূমির আশপাশে বসবাস করার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

বনের গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে। বন দখলকারীদের আইনের আওতায় এনে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বনভূমির আশপাশে ময়লা-আবর্জনা ফেলা বন্ধ করতে হবে। যারা এ কাজ করবে তাদের শাস্তির আওতায় নিতে হবে। জরিমানা করতে হবে।

প্রাকৃতিক বনায়নের পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিটি বাড়ির আঙিনা, পতিত জমি, জমির আইলে দেশীয় গাছ ও ফলদ গাছ বেশি বেশি করে রোপণ করা প্রয়োজন। সরকার-বেসরকারি উন্নয়ন ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করার সময় গাছ যাতে কাটা না পড়ে সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। যদি অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রয়োজনে গাছ কাটতেই হয় তাহলে প্রতিটি গাছের বিপরীতে অন্তত দশটি করে গাছ রোপণ করা বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং এই গাছগুলো বড় হয়ে ওঠা পর্যন্ত পরিচর্যা ও রক্ষাণবেক্ষণ করার ব্যবস্থা নিতে হবে।

প্রাকৃতিক বনায়ন বৃদ্ধি ও বৃক্ষরোপণের জন্য এবং গাছের নিরাপত্তা ও বেড়ে ওঠার জন্য আলাদা অর্থ বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন। বনভূমি রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তর, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়, প্রশাসন ও আইন বিভাগকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে বনে আগুন দেয়া বন্ধ করতে হবে। দখলকৃত বনভূমি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দখলমুক্ত করে বনায়ন গড়ে তুলতে হবে। আর এ কাজগুলো সরকারকেই করতে হবে। তবেই দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা বজায় থাকবে।

[লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, গাজীপুর]

সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন

ধনিক শ্রেণীর চলমান সংকট

ছবি

বৈচিত্র্যের সৌন্দর্য এবং আমাদের প্রান্তিক মানুষ

বায়ু দূষণের কারণে বাড়ছে ওষুধের ব্যবহার

শুভ বড়দিন

উগান্ডায় নতুন ভাইরাস ডিঙ্গা ডিঙ্গা

পরিবেশবান্ধব ঢাকা চাই

ছবি

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা : ফ্যাসিবাদী প্রবণতা সৃষ্টির প্রথম ভ্রুণ

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভূমিকা

প্রগতিতে অগ্রগতি

পরিবারতন্ত্র ও পরিবারতত্ত্ব : উত্তরণের উপায়

উপেক্ষিত উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীরা

সরিষার তেল গবেষণায় সাফল্য

সিরিয়ায় রাজনৈতিক পালাবদল : কার লাভ, কার ক্ষতি?

অতীত থেকে মুক্তি এবং ইতিবাচক জীবনযাপন

মুক্তি সংগ্রামে তিনটি ধারা

বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকা কেন পিছিয়ে

শুধু নিচেই নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর

উপেক্ষিত আটকে পড়া পাকিস্তানিরা

রম্যগদ্য : সিন্দাবাদের বুড়ো ও আমরা

নেই কেনো সেই পাখি

বায়ুদূষণ থেকে মুক্তি কোন পথে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : রাষ্ট্র সংস্কারের দুর্গম পথ

পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র

বিজয়ের প্রেরণা

মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার পুনর্বীক্ষণ

সিদরাত জেবিনের মৃত্যু অথবা প্রশ্নহীন বায়ুদূষণ

বিজয়ের গৌরব ও সম্ভাবনাময় তরুণ সমাজ

ছবি

মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের অবদান

ছবি

বিজয় সংগ্রামের সূচনার সন্ধানে

মানসম্মত কনটেন্ট ও টিআরপির দ্বৈরথ

জিকা ভাইরাস রোধে প্রয়োজন সচেতনতা

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবার গুরুত্ব

ঢাকার বাতাস বিষাক্ত কেন

চরের কৃষি ও কৃষকের জীবন

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বনভূমি রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন

কামরুজ্জামান

মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের দেশ। বাংলাদেশ উপকূলীয় অঞ্চলের দেশ। এ দেশ হিমালয় পর্বতমালার পাদদেশীয় দেশ। এ দেশের ভূমিরূপ বৈচিত্র্যময় এবং বন্ধুর প্রকৃতির। এ দেশ রূপসী বাংলার দেশ। এ দেশের রূপবৈচিত্র্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে বনভূমি। বাংলাদেশের বনভূমির বেশির ভাগই পার্বত্য ও উপকূলীয় বনভূমি। এর বাইরে মধুপুর ও ভাওয়ালের গড় অন্যতম।

ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশের জন্য একটি দেশের মোট ভূমির শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। পাঠ্যপুস্তকের হিসাবমতে আমাদের দেশে বনভূমির পরিমাণ রয়েছে ১৭ ভাগ। কিন্তু বর্তমান তথ্যমতে বনভূমির প্রকৃত চিত্র শতকরা ৯ ভাগের মতো বা আরও কম।

ভূগাঠনিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বাংলাদেশের বনভূমিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়।

১. ক্রান্তীয় চিরহরিৎ এবং পাতাঝরা বৃক্ষের বনভূমি

২. ক্রান্তীয় পাতাঝরা বৃক্ষের বনভূমি

৩. স্রোতজ বনভূমি বা সুন্দরবন

ক্রান্তীয় চিরহরিৎ এবং পাতাঝরা গাছের বনভূমি : বাংলাদেশের খাগড়াঝড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানের প্রায় সব অংশে এবং চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের কিছু অংশে এ বনভূমি বিস্তৃত। পাহাড়ের অধিক বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চলে ক্রান্তীয় চিরহরিৎ এবং কম বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চলে পাতাঝরা গাছের বনভূমি দেখা যায়।

ক্রান্তীয় পাতাঝরা গাছের বনভূমি : বাংলাদেশের প্লাইস্টোসিনকালের সোপানসমূহে এ বনভূমি রয়েছে। এ বনভূমিকে দুই অংশে ভাগ করা হয়েছেÑ

ক. ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও গাজীপুর জেলার মধুপুর ও ভাওয়ালের বনভূমি।

খ. দিনাজপুর ও রংপুর জেলায় বরেন্দ্র বনভূমি। শীতকালে এ বনভূমির বৃক্ষের পাতা ঝরে যায়। গ্রীষ্মকালে আবার নতুন পাতা গজায়।

স্রোতজ বনভূমি বা সুন্দরবন : খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলা নিয়ে এ বনভূমিত গঠিত। এ বনভূমির দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে হরিণঘাটা নদী, পিরোজপুর ও বরিশাল জেলা এবং পশ্চিমে রাইমঙ্গল, হাড়িয়াভাঙ্গা নদী ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের আংশিক প্রান্ত সীমা পর্যন্ত এ বনভূমি বিস্তৃত। এটি খুলনা বিভাগের ৬,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা ও লোনা পানি এবং প্রচুর বৃষ্টিপাতের জন্য এ অঞ্চলের বৃক্ষ সমৃদ্ধ। এর বাইরেও বাংলাদেশের সমতল ভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য বনজঙ্গল ও ঝোঁপঝাড়।

এখন কথা হলোÑ দিন যতই যাচ্ছে বাংলাদেশের বনভূমি ততই কমছে। কেন কমছে বনভূমি তার কারণ খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আমাদের দেশে বনভূমি কমে আসার নানা কারণ রয়েছে। বনভূমি দখল এর মধ্যে অন্যতম একটি কারণ। সারা বাংলাদেশে শিল্প কারখানা নির্মাণ, বাসাবাড়ি তৈরি ইত্যাদি কারণে বনের জায়গা দখল হচ্ছে। বনভূমির সঙ্গে জোতজমি থাকায় জমির মালিকের কেউ কেউ জোতজমির সঙ্গে বনভূমির কিছু কিছু জায়গায় বাড়িঘর তৈরি করে দখল করছে।

প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে পাতাঝরা বৃক্ষের বনভূমিতে বৃক্ষের শুকনো পাতা জমা হয়। একশ্রেণীর অতি উৎসাহী মানুষ বনে আগুন ধরিয়ে দেয়। আবার কিছু কিছু জায়গায় পরিকল্পিতভাবেও আগুন দেয়া হয় বৃক্ষনিধনের জন্য। এর ফলে বৃক্ষের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও নতুন বৃক্ষের প্রজনন ব্যাহত হয়। এভাবে প্রাকৃতিক বনায়ন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রতি বছর। গাজীপুরে অবস্থিত ভাওয়ালের জাতীয় উদ্যান ও ভাওয়ালের গড়ে শুষ্ক মৌসুমে প্রতি বছরই আগুন দেয়ার দৃশ্য চোখে পড়ে।

দেশের সার্বিক পরিবেশ দূষণের কারণে বায়ুদূষণ হচ্ছে। আর বায়ুদূষণের প্রভাব বৃক্ষের ওপর পড়ছে। বনের আশপাশে ময়লা-আবর্জনা ফেলার কারণে একটা সময় পরে ময়লার ভাগাড় গড়ে ওঠে। এর প্রভাব পড়ে বনের বৃক্ষের ওপর। মাটি ও বায়ুদূষণের কারণে কিছু কিছু বৃক্ষের মৃত্যু হয়। গাজীপুর ও মধুপুর অঞ্চলের ভাওয়াল গড়ে এই রকম অনেক মৃত বৃক্ষের দেখা পাওয়া যায়।

বিশ্বব্যাপী আরও একটি সমস্যা হচ্ছে বাতাসে কার্বনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। মানুষের আধুনিক জীবনযাপন ও শিল্প কারখানার প্রভাব এর জন্য দায়ী। বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর পরিবর্তনও হচ্ছে এ কারণে। গাছ যে কমছে এর সবচেয়ে বড় নজির হচ্ছে বায়ুম-লে উঞ্চতা বৃদ্ধি, যার প্রভাব বাংলাদেশও লক্ষ্য করা যায়। আয়তনের চেয়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যা এমনিতেই অনেক বেশি। প্রতি বছরই জনসংখ্যা বাড়ছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ পড়ছে খাদ্য ও আবাসস্থলে। বিশেষ করে আবাসস্থলের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে নতুন নতুন বাড়িঘর নির্মাণ হচ্ছে। হচ্ছে বৃক্ষনিধন।

অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ন বনভূমি কমে আসার আরও একটি অন্যতম কারণ। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য শিল্পায়ন ও নগরায়ন হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বনভূমি রক্ষা করে শিল্পায়ন ও নগরায়ন হওয়া প্রয়োজন। অপরিকল্পিত উন্নয়নও বনভূমি কমে আসার জন্য দায়ী। এমন অনেক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় যেখানের পরিবেশ ও প্রতিবেশ অনুযায়ী বৃক্ষের ক্ষতি হয় সবার আগে। এসব উন্নয়ন পরিকল্পনার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনকে আন্দোলনও করতে দেখা যায়। কিন্তু এ দেশে কে শোনে কার কথা!

বনভূমি রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। আর এর জন্য বনভূমি সুরক্ষা আইন কার্যকর করতে হবে। বন বিভাগকে ঢেলে সাজাতে হবে। সৎ ও নীতিবান কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিতে হবে।

প্রাকৃতিক বনায়ন বৃদ্ধির জন্য বনভূমি সুরক্ষা বলয় তৈরি করা এখন সময়ের দাবি। আমাদের যে বনভূমিগুলো রয়েছে সেগুলো নিরাপদ ও প্রাকৃতিক বনভূমি হিসেবে মানুষের চলাচল সীমিত করতে হবে। প্রাকৃতিক বনায়নের বাইরে উপকূলীয় অঞ্চল ও সমতলে নতুন নতুন বনায়ন গড়ে তুলতে হবে। বনের ভূমি উদ্ধার করে গাছ রোপণ করতে হবে। শুধু গাছ রোপণ করলেই হবে না, গাছ হওয়ার জন্য বেড়া দিতে হবে। গাছ নিরাপদভাবে বেড়ে ওঠার জন্য অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ দিতে হবে। নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকদের নতুন বনায়নকৃত ভূমির আশপাশে বসবাস করার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

বনের গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে। বন দখলকারীদের আইনের আওতায় এনে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বনভূমির আশপাশে ময়লা-আবর্জনা ফেলা বন্ধ করতে হবে। যারা এ কাজ করবে তাদের শাস্তির আওতায় নিতে হবে। জরিমানা করতে হবে।

প্রাকৃতিক বনায়নের পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিটি বাড়ির আঙিনা, পতিত জমি, জমির আইলে দেশীয় গাছ ও ফলদ গাছ বেশি বেশি করে রোপণ করা প্রয়োজন। সরকার-বেসরকারি উন্নয়ন ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করার সময় গাছ যাতে কাটা না পড়ে সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। যদি অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রয়োজনে গাছ কাটতেই হয় তাহলে প্রতিটি গাছের বিপরীতে অন্তত দশটি করে গাছ রোপণ করা বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং এই গাছগুলো বড় হয়ে ওঠা পর্যন্ত পরিচর্যা ও রক্ষাণবেক্ষণ করার ব্যবস্থা নিতে হবে।

প্রাকৃতিক বনায়ন বৃদ্ধি ও বৃক্ষরোপণের জন্য এবং গাছের নিরাপত্তা ও বেড়ে ওঠার জন্য আলাদা অর্থ বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন। বনভূমি রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তর, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়, প্রশাসন ও আইন বিভাগকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে বনে আগুন দেয়া বন্ধ করতে হবে। দখলকৃত বনভূমি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দখলমুক্ত করে বনায়ন গড়ে তুলতে হবে। আর এ কাজগুলো সরকারকেই করতে হবে। তবেই দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা বজায় থাকবে।

[লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, গাজীপুর]

back to top