মোহাম্মদ আবু নোমান
দেশের-প্রবাসের শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের রক্ত ও ঘামে ভেজানো টাকা পাচার করে কেউ বিদেশে এখন শীর্ষ ধনীর তকমা অর্জন করেছেন। প্রবাসীরা ঘামঝরা কষ্টের আয় দেশে পাঠান ঠিকই, কিন্তু ক্ষমতা ও প্রশাসনের মসনদে বসে রাষ্ট্রীয় সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে চুরি ও লুটপাট করে দেশের টাকায় বিদেশে বউ-সন্তান নিয়ে বিলাসী জীবনযাপন করছেন ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী, এমপি লুটেরারা। কেউ পাচারের টাকা দিয়ে বিদেশে আলাদা সাম্রাজ্য গড়েছেন। এরা সরাসরি আওয়ামী লীগ দলীয় ও শেখ পরিবারের প্রশ্রয়ে দেশ ফোকলা করেছে বলে পাবলিসিটি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইনটেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য অনুসারে, গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দেশ থেকে অন্তত ১৪ হাজার ৯২০ কোটি বা ১৪৯.২০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ১৭ লাখ ৮২ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা।
জীবনে একটু আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আনতে বা পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফোটাতে দেশের বাইরে পাহাড়সম শত প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলা করে বছরের পর বছর ধরে স্বদেশ ছেড়ে অচেনা-অজানা বিদেশে পরে থাকেন বাংলাদেশের তরুণ ও যুবকরা। ১০ ঘণ্টা, ১২ ঘণ্টা বা এর চেয়েও বেশি লম্বা সময় হাড়ভাঙা ঘামঝরা শ্রম দেন স্বপ্ন পূরণের প্রত্যয়ে। ছুটির প্রয়োজন নেই, আরাম নেই, অবসর নেই, শুধু খোঁজেন কাজ আর কাজ।
দেশের সমৃদ্ধ অর্থনীতির চাকা ঘোরানোর চাবিকাঠি দীর্ঘকাল ধরেই প্রবাসীদের নিয়ন্ত্রণে। বাংলাদেশ ব্যাংক বছর ঘুরে গুনছে হাজার কোটি ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা! অথচ এই রেমিট্যান্সযোদ্ধা একটু একটু করে জমানো টাকায় মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে, স্ত্রীর জন্য টুকটাক কিছু মার্কেটিং করে বাংলাদেশের বিমানবন্দরে নেমে দেখেন তার লাগেজ গায়েব! ঢাকার বিমানবন্দরে লাগেজ হারিয়ে শিশুদের মতো গড়াগড়ি ও চিৎকার করে কান্না করতে দেখেছি আমাদের রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের। এছাড়া বিমানবন্দরে বেশুমার হয়রানির কথা লিখতে গেলে তো বড় একটি কিতাব হয়ে যাবে।
জমানো টাকা, জমি বিক্রয়, কিস্তিতে ঋণ নিয়ে অথবা মায়ের ও স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে পরিবার-পরিজনকে টানাটানির সংসারে রেখে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে বিশে^ও বিভিন্ন দেশে আজ লাখো শ্রমিক কাজ করছেন। তাদের নিদারুন দুঃখ-কষ্টের কথা দেশের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা-কামলারা কতটুকুই উপলব্ধি করে থাকেন। বেশির ভাগ শ্রমিক সামান্য বেতনের চাকরি করে থাকে, এক রুমে ১৫-২০ জন করে বসবাস করতে হয়। আজকের রান্না করা ভাত-তরকারি কালকেও খেতে হয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপরই পতিত সরকারের দুর্নীতির নানা দিক বের হতে থাকে। তথ্য-উপাত্ত বলছে, দলটি ক্ষমতায় থাকাকালে গত ১৫ বছরে অনিয়ম-দুর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতার সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ব্যাংকের টাকা লোপাট, আমদানি-রপ্তানির আড়ালে কর ফাঁকি দিয়ে; কিংবা ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে ৮৪৭টি ফ্ল্যাট, ভিলাবাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট ও বাণিজ্যিক স্পেস কেনার তথ্য গণমাধ্যমে এসেছে। ফরেন রিয়েল অ্যাস্টেট ইনভেস্টমেন্টের প্রতিবেদনে এসেছে, গত কয়েক বছরের মধ্যে দুবাইয়ের সবচেয়ে অভিজাত এলাকায় বাংলাদেশি ১৩৪ জন ব্যক্তি মোট ৮৪৭টি ফ্ল্যাট, ভিলাবাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন, যার একেকটি দাম শতকোটি টাকা পর্যন্ত! এদের মধ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নামেই কেনা হয়েছে ১৩৭টি ফ্ল্যাট ও হোটেল অ্যাপার্টমেন্ট। তথ্য-উপাত্ত বলছে, দেশের টাকা পাচার করে ওই চক্রটি দুবাইয়ের শুধু বুর্জ খলিফাতেই কিনেছে ৭৭টি ফ্ল্যাট।
বাংলাদেশ দুবাই না হলেও দুবাই ঠিকই বাংলাদেশ হয়ে গেছে! আমাদের প্রিয় বাংলাদেশতো শুধু লাইনচ্যুত হয়ে গিয়েছিল তা নয়, অন্যদিকেও চলে যাচ্ছিল। এখন সবার দায়িত্ব বাংলাদেশকে লাইনে তোলা। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের ক্ষেত্রে বিরাট একটা সমস্যা এখনও রয়েছে, সেটা স্থিতিশীল অবস্থায় আনতে হবে। আওয়ামী সরকার অনেক বেশি টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছেড়েছে। একদিকে পণ্যের পরিমাণ কম, অন্যদিকে বাজারে অনেক বেশি টাকা। ফলে জিনিসপত্রের উচ্চমূল্য এখনো অব্যাহত রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ বাড়ছে। মানুষ তো চায় দৃশ্যমান পরিবর্তন। এটা ঠিক যে, আমাদের অর্থনীতি একটা শকের মধ্যে রয়েছে, সে শকটা কাটিয়ে উঠতে হবে। অর্থনীতির লাইনচ্যুত ট্রেনকে লাইনে তুলতে হবে।
আওয়ামী সরকার জনবিচ্ছিন্ন সরকারে পরিণত হয়েছিল, তা শুধু বিনা ভোটের বিবেচনা থেকেই নয়; পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ ছিল কয়েকজন রাজনীতিবিদ, তাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং কতিপয় ব্যবসায়ী ও আমলার হাতে। সামিট গ্রুপের মালিক এখন শুধু বাংলাদেশের ধনী হিসেবেই নন, তিনি এখন সিঙ্গাপুরেরও অন্যতম সেরা ধনী। বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন ফোর্বসের তথ্যমতে, সামিট গ্রুপ ১.১২ বিলিয়ন ডলারের মালিক হয়ে সিঙ্গাপুরের ৪১তম শীর্ষ ধনীর তালিকায় আছেন। অথচ এই টাকা তারা বাংলাদেশ থেকে কোনো বৈধ উপায়ে নিয়েছেন বলে কোনো তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে নেই; বরং এ পর্যন্ত দেশের ২০টি প্রতিষ্ঠানের ২৪টি ভেঞ্চারকে সর্বসাকূল্যে ৬৯.৫ মিলিয়ন বা প্রায় সাত কোটি ডলার বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাহলে এত বিপুল অঙ্কের টাকা সামিট গ্রুপ কীভাবে সিঙ্গাপুরে নিয়ে শীর্ষ ধনী হলেন?
গত এক দশকের বেশি সময় ধরে দেশের ব্যাংক খাতে ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটের ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি ব্যাংক খাতকে কৃষ্ণগহ্বরের (ব্ল্যাকহোল) সঙ্গে তুলনা করেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ব্যাংক খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ এখন ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা, যে অর্থ দিয়ে ১৩টি মেট্রোরেল বা ২২টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেত। কমিটি আরও জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে রাষ্ট্রীয় সংস্থার সহায়তায় ব্যাংক দখল করা হয়েছে। কেবল একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতেই সাতটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয়া হয়েছিল। এরপর বড় অঙ্কের অর্থ দেশের বাইরে পাচার করা হয়। মোটাকথা পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী সরকার বিধ্বস্ত করে গেছে আমাদের ব্যাংক খাত।
দেশের ব্যাংকগুলোতে গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে যে অর্থ বের করে নেয়া হয়েছে, তা এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে। ফলে ব্যাংক থেকে বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশই বর্তমানে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। ভবিষ্যতে খেলাপি ঋণ ৩০ শতাংশ হবে বলে অর্থনীতিবিদরা হুঁশিয়ারি করেছেন। অর্থনীতিবিদরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছেন, আওয়ামী সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় ব্যাংক থেকে বিপুল অর্থ লুটপাট হয়েছে, যার একটা বড় অংশই পাচার হয়েছে বিদেশে। নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ থেকে এস আলম গ্রুপ ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ৭৩ হাজার ১১৩ কোটি টাকার ঋণ বের করে নিয়েছে। এই অর্থ ব্যাংকটির মোট ঋণের প্রায় ৫০ শতাংশ।
সবাই দুর্নীতিতে লিপ্ত হলে একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার ঝুঁকি কমে যায়, দুর্নীতির স্বাভাবিকীকরণ করতে সুবিধা হয়। সবাই মিলে দুর্নীতি করলে এককভাবে কারও ধরা পড়ার ভয় থাকে না, ধরা পড়লেও একদল আরেক দলকে সমর্থন জোগাতে পারে। সবাই মিলেমিসে ঠিক এমনই যৌথ দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে আওয়ামী সরকারের আমলে। এতবড় কারসাজি করে লাখ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে বের কওে নিলো অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন রেগুলেটরি অথরিটির চোখে পড়ল না, তারা কিছুই করতে পারলো না? এই অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে সরকার এবং সহযোগীÑ সবাই জড়িত; সুতরাং এদের সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে এবং তাদের সবার দেশ-বিদেশের সম্পদ তালিকা করে বাজেয়াপ্ত করে জনগণের টাকা আদায় করে আইনের আওতায় সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]
মোহাম্মদ আবু নোমান
শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪
দেশের-প্রবাসের শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের রক্ত ও ঘামে ভেজানো টাকা পাচার করে কেউ বিদেশে এখন শীর্ষ ধনীর তকমা অর্জন করেছেন। প্রবাসীরা ঘামঝরা কষ্টের আয় দেশে পাঠান ঠিকই, কিন্তু ক্ষমতা ও প্রশাসনের মসনদে বসে রাষ্ট্রীয় সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে চুরি ও লুটপাট করে দেশের টাকায় বিদেশে বউ-সন্তান নিয়ে বিলাসী জীবনযাপন করছেন ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী, এমপি লুটেরারা। কেউ পাচারের টাকা দিয়ে বিদেশে আলাদা সাম্রাজ্য গড়েছেন। এরা সরাসরি আওয়ামী লীগ দলীয় ও শেখ পরিবারের প্রশ্রয়ে দেশ ফোকলা করেছে বলে পাবলিসিটি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইনটেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য অনুসারে, গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দেশ থেকে অন্তত ১৪ হাজার ৯২০ কোটি বা ১৪৯.২০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ১৭ লাখ ৮২ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা।
জীবনে একটু আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আনতে বা পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফোটাতে দেশের বাইরে পাহাড়সম শত প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলা করে বছরের পর বছর ধরে স্বদেশ ছেড়ে অচেনা-অজানা বিদেশে পরে থাকেন বাংলাদেশের তরুণ ও যুবকরা। ১০ ঘণ্টা, ১২ ঘণ্টা বা এর চেয়েও বেশি লম্বা সময় হাড়ভাঙা ঘামঝরা শ্রম দেন স্বপ্ন পূরণের প্রত্যয়ে। ছুটির প্রয়োজন নেই, আরাম নেই, অবসর নেই, শুধু খোঁজেন কাজ আর কাজ।
দেশের সমৃদ্ধ অর্থনীতির চাকা ঘোরানোর চাবিকাঠি দীর্ঘকাল ধরেই প্রবাসীদের নিয়ন্ত্রণে। বাংলাদেশ ব্যাংক বছর ঘুরে গুনছে হাজার কোটি ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা! অথচ এই রেমিট্যান্সযোদ্ধা একটু একটু করে জমানো টাকায় মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে, স্ত্রীর জন্য টুকটাক কিছু মার্কেটিং করে বাংলাদেশের বিমানবন্দরে নেমে দেখেন তার লাগেজ গায়েব! ঢাকার বিমানবন্দরে লাগেজ হারিয়ে শিশুদের মতো গড়াগড়ি ও চিৎকার করে কান্না করতে দেখেছি আমাদের রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের। এছাড়া বিমানবন্দরে বেশুমার হয়রানির কথা লিখতে গেলে তো বড় একটি কিতাব হয়ে যাবে।
জমানো টাকা, জমি বিক্রয়, কিস্তিতে ঋণ নিয়ে অথবা মায়ের ও স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে পরিবার-পরিজনকে টানাটানির সংসারে রেখে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে বিশে^ও বিভিন্ন দেশে আজ লাখো শ্রমিক কাজ করছেন। তাদের নিদারুন দুঃখ-কষ্টের কথা দেশের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা-কামলারা কতটুকুই উপলব্ধি করে থাকেন। বেশির ভাগ শ্রমিক সামান্য বেতনের চাকরি করে থাকে, এক রুমে ১৫-২০ জন করে বসবাস করতে হয়। আজকের রান্না করা ভাত-তরকারি কালকেও খেতে হয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপরই পতিত সরকারের দুর্নীতির নানা দিক বের হতে থাকে। তথ্য-উপাত্ত বলছে, দলটি ক্ষমতায় থাকাকালে গত ১৫ বছরে অনিয়ম-দুর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতার সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ব্যাংকের টাকা লোপাট, আমদানি-রপ্তানির আড়ালে কর ফাঁকি দিয়ে; কিংবা ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে ৮৪৭টি ফ্ল্যাট, ভিলাবাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট ও বাণিজ্যিক স্পেস কেনার তথ্য গণমাধ্যমে এসেছে। ফরেন রিয়েল অ্যাস্টেট ইনভেস্টমেন্টের প্রতিবেদনে এসেছে, গত কয়েক বছরের মধ্যে দুবাইয়ের সবচেয়ে অভিজাত এলাকায় বাংলাদেশি ১৩৪ জন ব্যক্তি মোট ৮৪৭টি ফ্ল্যাট, ভিলাবাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন, যার একেকটি দাম শতকোটি টাকা পর্যন্ত! এদের মধ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নামেই কেনা হয়েছে ১৩৭টি ফ্ল্যাট ও হোটেল অ্যাপার্টমেন্ট। তথ্য-উপাত্ত বলছে, দেশের টাকা পাচার করে ওই চক্রটি দুবাইয়ের শুধু বুর্জ খলিফাতেই কিনেছে ৭৭টি ফ্ল্যাট।
বাংলাদেশ দুবাই না হলেও দুবাই ঠিকই বাংলাদেশ হয়ে গেছে! আমাদের প্রিয় বাংলাদেশতো শুধু লাইনচ্যুত হয়ে গিয়েছিল তা নয়, অন্যদিকেও চলে যাচ্ছিল। এখন সবার দায়িত্ব বাংলাদেশকে লাইনে তোলা। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের ক্ষেত্রে বিরাট একটা সমস্যা এখনও রয়েছে, সেটা স্থিতিশীল অবস্থায় আনতে হবে। আওয়ামী সরকার অনেক বেশি টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছেড়েছে। একদিকে পণ্যের পরিমাণ কম, অন্যদিকে বাজারে অনেক বেশি টাকা। ফলে জিনিসপত্রের উচ্চমূল্য এখনো অব্যাহত রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ বাড়ছে। মানুষ তো চায় দৃশ্যমান পরিবর্তন। এটা ঠিক যে, আমাদের অর্থনীতি একটা শকের মধ্যে রয়েছে, সে শকটা কাটিয়ে উঠতে হবে। অর্থনীতির লাইনচ্যুত ট্রেনকে লাইনে তুলতে হবে।
আওয়ামী সরকার জনবিচ্ছিন্ন সরকারে পরিণত হয়েছিল, তা শুধু বিনা ভোটের বিবেচনা থেকেই নয়; পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ ছিল কয়েকজন রাজনীতিবিদ, তাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং কতিপয় ব্যবসায়ী ও আমলার হাতে। সামিট গ্রুপের মালিক এখন শুধু বাংলাদেশের ধনী হিসেবেই নন, তিনি এখন সিঙ্গাপুরেরও অন্যতম সেরা ধনী। বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন ফোর্বসের তথ্যমতে, সামিট গ্রুপ ১.১২ বিলিয়ন ডলারের মালিক হয়ে সিঙ্গাপুরের ৪১তম শীর্ষ ধনীর তালিকায় আছেন। অথচ এই টাকা তারা বাংলাদেশ থেকে কোনো বৈধ উপায়ে নিয়েছেন বলে কোনো তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে নেই; বরং এ পর্যন্ত দেশের ২০টি প্রতিষ্ঠানের ২৪টি ভেঞ্চারকে সর্বসাকূল্যে ৬৯.৫ মিলিয়ন বা প্রায় সাত কোটি ডলার বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাহলে এত বিপুল অঙ্কের টাকা সামিট গ্রুপ কীভাবে সিঙ্গাপুরে নিয়ে শীর্ষ ধনী হলেন?
গত এক দশকের বেশি সময় ধরে দেশের ব্যাংক খাতে ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটের ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি ব্যাংক খাতকে কৃষ্ণগহ্বরের (ব্ল্যাকহোল) সঙ্গে তুলনা করেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ব্যাংক খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ এখন ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা, যে অর্থ দিয়ে ১৩টি মেট্রোরেল বা ২২টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেত। কমিটি আরও জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে রাষ্ট্রীয় সংস্থার সহায়তায় ব্যাংক দখল করা হয়েছে। কেবল একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতেই সাতটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয়া হয়েছিল। এরপর বড় অঙ্কের অর্থ দেশের বাইরে পাচার করা হয়। মোটাকথা পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী সরকার বিধ্বস্ত করে গেছে আমাদের ব্যাংক খাত।
দেশের ব্যাংকগুলোতে গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে যে অর্থ বের করে নেয়া হয়েছে, তা এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে। ফলে ব্যাংক থেকে বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশই বর্তমানে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। ভবিষ্যতে খেলাপি ঋণ ৩০ শতাংশ হবে বলে অর্থনীতিবিদরা হুঁশিয়ারি করেছেন। অর্থনীতিবিদরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছেন, আওয়ামী সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় ব্যাংক থেকে বিপুল অর্থ লুটপাট হয়েছে, যার একটা বড় অংশই পাচার হয়েছে বিদেশে। নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ থেকে এস আলম গ্রুপ ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ৭৩ হাজার ১১৩ কোটি টাকার ঋণ বের করে নিয়েছে। এই অর্থ ব্যাংকটির মোট ঋণের প্রায় ৫০ শতাংশ।
সবাই দুর্নীতিতে লিপ্ত হলে একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার ঝুঁকি কমে যায়, দুর্নীতির স্বাভাবিকীকরণ করতে সুবিধা হয়। সবাই মিলে দুর্নীতি করলে এককভাবে কারও ধরা পড়ার ভয় থাকে না, ধরা পড়লেও একদল আরেক দলকে সমর্থন জোগাতে পারে। সবাই মিলেমিসে ঠিক এমনই যৌথ দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে আওয়ামী সরকারের আমলে। এতবড় কারসাজি করে লাখ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে বের কওে নিলো অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন রেগুলেটরি অথরিটির চোখে পড়ল না, তারা কিছুই করতে পারলো না? এই অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে সরকার এবং সহযোগীÑ সবাই জড়িত; সুতরাং এদের সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে এবং তাদের সবার দেশ-বিদেশের সম্পদ তালিকা করে বাজেয়াপ্ত করে জনগণের টাকা আদায় করে আইনের আওতায় সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]