মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
কমরেড মণি সিংহ কী একজন ‘কমিউনিস্ট নেতা’ ছিলেন নাকি একজন ‘জাতীয় নেতা’ ছিলেন? অনেকে এ নিয়ে তর্ক তোলার চেষ্টা করেন। আসলে তর্কের বিষয়বস্তুই ত্রুটিপূর্ণ। কারণ, কোনো একজন ব্যক্তিকে ‘কমিউনিস্ট নেতা’ কিংবা ‘জাতীয় নেতা’ এ দুয়ের মধ্যে কোনো একটি হতে হবে এমন ধারণাই ত্রুটিপূর্ণ। কমরেড মণি সিংহ ছিলেন নিঃস্বন্দেহে একজন ‘কমিউনিস্ট নেতা’, একই সঙ্গে একজন ‘জাতীয় নেতা’ও বটে।
এ কথা কে না জানে যে কমরেড মণি সিংহ ছিলেন আমাদের উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা, অন্যতম স্থপতি। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সৃজনশীল বৈজ্ঞানিক মতাদর্শে দৃঢ় আস্থাবান একজন খাঁটি কমিউনিস্ট নেতা ছিলেন তিনি। তার এই বিপ্লবী জীবনাদর্শ ও আমৃত্যু অক্ষয় বিপ্লবী কর্মকা-ের মাঝেই তার কালজয়ী পরিচয় লিপিবদ্ধ। তার এই কমিউনিস্ট আত্মপরিচয়কে বাদ দিয়ে তাকে ‘এই পরিচয়ের ঊর্ধ্বে’ একজন জাতীয় নেতা রূপে তুলে ধরার চেষ্টা বৃথা। বস্তুত একজন ‘কমিউনিস্ট নেতা’ হওয়ার ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই তিনি তার শ্রেষ্ঠ জাতীয় নেতা হয়ে উঠেছিলেন।
কমরেড মণি সিংহয়ের জীবন-সংগ্রাম ছিল মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য এবং তিনি বিশ্বাস করতেন যে তার মধ্য দিয়েই সার্বিক মানবমুক্তি। ‘মুক্ত মানবের মুক্ত সমাজ’ তথা সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য আমৃত্যু তিনি লড়াই করেছেন। মানুষই ছিল তার সাধনার কেন্দ্রবিন্দু। তিনি বলতেন যে প্রতিটি কমিউনিস্টকে ‘বিপ্লবী মানবতাবাদের’ উদ্বুদ্ধ হয়ে শ্রেণী-সংগ্রামের ধারায় শোষণের সমাজকে উপড়ে ফেলে সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ অভিমুখীন সমাজ-বিপ্লব সাধনে আত্মনিবেদন করতে হবে। মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও মানবপ্রেমকে বিপ্লবী প্রয়াসের মাধ্যমে সমাজে সার্বজনীন করে তুলতেই তিনি তার বিপ্লবী কর্মকা- পরিচালনা করেছিলেন। এদেশে ও বিশ্বে আজও সেই বিপ্লবী কর্মকা- অব্যাহত আছে। প্রবল প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে হলেও নবজাগরিত শক্তি নিয়ে তা অগ্রসর হচ্ছে।
এদিকে বর্তমানে যখন অপরাজনীতি, ব্যবসায়িক রাজনীতি, হালুয়া রুটির রাজনীতি, আত্মস্বার্থের রাজনীতি এবং ‘বাজার অর্থনীতির’ দানবীয় বিস্তারের মুখে ‘বাজার রাজনীতি’ সবকিছুকে গ্রাস করে চলেছে, যখন জাতির সামনে ‘রাজনীতি বাঁচাও’ আজ এক অগ্রগণ্য কর্তব্য হয়ে উঠেছে তখন জাতির সামনে ‘রাজনীতি বাঁচাও’-এর সংগ্রাম অতীব জরুরি হয়ে উঠেছে। ‘রাজনীতি বাঁচাও’-এর সংগ্রামে কমরেড মণি সিংহ আজ এক অজেয় প্রতীকী শক্তি হয়ে আছেন। কমিউনিস্ট আদর্শবোধই তাকে একজন বিশুদ্ধ, অনুপম, অনুকরণীয় দেশপ্রেমিকের হোয়ার পথ করে দিয়েছে। সততা, ত্যাগ, আদর্শ-নিষ্ঠা, কঠোর শৃঙ্খলাবোধ, মানুষের প্রতি অকৃত্রিম দরদ, দায়িত্ববোধ, দেশমাতৃকার স্বার্থে আত্মস্বার্থ বিসর্জন, জনসেবা-দেশসেবাকে সাধনা হিসেবে গ্রহণ; প্রতিদিনের চিন্তা-কাজে মানবমুক্তি ও দেশপ্রেমের অধ্যয়ন, ছোট-বড় সব কাজে বিপ্লবী জীবনাদর্শের প্রতিফলন ঘটানোর নিরন্তর প্রয়াস কমরেড মণি সিংহের মাঝে দৃষ্টান্ত-স্থানীয় রূপে বিরাজমান ছিল। এসব অমূল্য গুণাবলির সমাহারের কারণেই তিনি আজও এদেশের রাজনীতিতে অনন্য সম্মানের স্থানে অধিষ্ঠিত। তাই, কমরেড মণি সিংহ একজন শ্রেষ্ঠ ‘জাতীয় নেতা’ হয়ে উঠতে পেরেছেন।
কমরেড মণি সিংহকে আমি প্রথম দেখি ১৯৬৬ সালের মে মাসের এক সন্ধ্যায়, ঢাকার কল্যাণপুর এলাকায় এক গোপন ডেরায় অনুষ্ঠিত ছাত্র-কর্মীদের এক বৈঠকে। কমিউনিস্ট পার্টি তখন নিষিদ্ধ এবং তাকে কাজ করতে হচ্ছে আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যবস্থায়। পার্টির তাত্ত্বিক ও সাংগঠনিক শক্তি সংহত করার জন্য মহান মে দিবস উপলক্ষে ঢাকার ছাত্র-কর্মীদের এই সভায় আত্মগোপনে থাকা পার্টির কয়েকজন শীর্ষ নেতা উপস্থিত ছিলেন। কমরেড আজাদ নামে পরিচয় করে দেয়া সাদা পায়জামার ওপর সাদা ফুল হাতা লম্বা কুর্তা-শার্ট গায়ে, ফর্সা, লম্বা, কালো চশমা পরা একজন কমরেড তেজোদীপ্ত কণ্ঠে অনেক কথা বলেছিলেন। পার্টির অন্য নেতারা ফিসফিস করে কানে কানে জানিয়েছিলেন যে তিনিই কমরেড মণি সিংহ। আমরা কমরেড মণি সিংহকে রূপকথার নায়কের মতো গণ্য করতাম। কল্পনার সেই বিপ্লবী নায়ককে কাছে থেকে স্বচক্ষে দেখতে পেয়েছি জানতে পেরে সেদিন প্রবলভাবে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম।
১৯৬৭ সালে তিনি আন্ডারগ্রাউন্ড থাকা অবস্থায় গ্রেপ্তার হয়ে যান। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি মুক্ত হয়ে আসেন। মণি সিংহকে একনজর দেখার জন্য সবাই তখন পাগলপ্রায়। তার সঙ্গে এবার আমি প্রকাশ্য সাক্ষাৎ পরিচয়ের এবং সামনা-সামনি কথা বলার সুযোগ পাই। কিন্তু ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে তিনি আবার আবার গ্রেপ্তার হয়ে যান। তার এই স্বল্পকালীন মুক্ত থাকা অবস্থায় তিনি আমাদের নিয়ে বৈঠক করে অনেক কথার মধ্যে দুটি খুবই গরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন। একটি ছিল ‘মনে রাখবে, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান হলো আসন্ন আরও বড় সংগ্রামের ড্রেস রিহার্সেল মাত্র’। অন্য কথাটি ছিল ‘আর্মড স্ট্রাগল ইজ ইন দি এজেন্ডা নাউ’ (অর্থাৎ ‘সশস্ত্র সংগ্রামের বিষয়টি এখন সামনে’)।
৮ মাস বন্দী থাকার পর ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ জনগণ কমরেড মণি সিংহকে রাজশাহী জেল ভেঙে মুক্ত করেন। তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের কাজে নেমে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কমরেড মণি সিংহের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘনিষ্ঠতা লাভ করে। তখন বেশ কয়েকবার তার সঙ্গে আমার দেখাসাক্ষাৎ হয়। আমরা বেশ কয়েকদিন একই বাসায় কাটিয়েছি। আমি ছিলাম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা, ‘বিশেষ গেরিলা বাহিনী’র প্রথম দলের একজন কমান্ডার। তিনি আমার কাছে অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কে, যুদ্ধ কৌশল সম্পর্কে, গেরিলা দলগুলোর তৎপরতা সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু জানতে চাইতেন। এসব যেন তার একান্ত আপন ভুবনের ব্যাপার। তার সঙ্গে যখন আমার সশস্ত্র যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা হতো তখন তার মুখের দিকে তাকিয়ে যে উজ্জ্বল জ্যোত দেখতে পেতাম তাতে আমার মানসচক্ষে ভেসে উঠত অস্ত্র কাঁধে ঝুলানো সাদা ঘোড়ায় সওয়ার গারো পাহাড় এলাকার টংক প্রথাবিরোধী সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহের সেনাপতি, চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকের মণি সিংহকে।
কমরেড মণি সিংহ ছিলেন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্বের অন্যতম একজন। তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টাম-লীর অন্যতম সদস্য এবং কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক-সাংগঠনিক কর্মকা-ের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। ৭০ বছর বয়সের এই মানুষটি ৯ মাস ধরে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, আন্তর্জাতিক, আদর্শিকসহ বহুবিধ কাজে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রগতিমুখীনতা নিশ্চিত করার জন্য, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে দেশি-বিদেশি শক্তির সমাবেশ ও ঐক্য গড়ে তুলতে এবং জাতির এই মরণপণ সংগ্রামকে বিজয়ের পথে নিয়ে যেতে কমরেড মণি সিংহ অমূল্য অবদান রেখেছেন। গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার কাজে ‘বেইস ক্যাম্পে ও রনাঙ্গণেই’ আমার সময় কাটতো বেশি। কমরেড মণি সিংহ ‘বেইস ক্যাম্পে এক-আধবার এসেছিলেন। আমাকেও সময়-সময় বিশেষ কাজে পার্টি হেডকোয়ার্টারের বাসায় ২-৩ দিনের জন্য যেতে হতো। তখন তার সঙ্গে দেখা হতো। আমার সঙ্গে দেখা হলেই কমরেড মণি সিংহের উচ্ছ্বাস বেড়ে যেত। স্পষ্টই বুঝতে পারতাম, আমাকে অস্ত্রধারী অবস্থায় দেখে তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠেছে; যেন তার যৌবন তিনি ফিরে পেয়েছেন।
স্বাধীনতার পর আরও অনেক কাছে থেকে তাকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। অগণিত সভায়, প্রকাশ্য-গোপন বৈঠকে, আন্ডারগ্রাউন্ডে এক ডেনে, জেলা সফরে, জনসভায়, বিদেশ সফরে, পার্টির সমাবেশে, কৃষক সমিতি-ক্ষেতমজুর সমিতির কর্মসূচিতে তার সঙ্গে কাজ করেছি। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে এবং একপর্যায়ে পার্টির কেন্দ্রীয় সম্পাদকম-লীতে তার সঙ্গে কাজ করার সুযোগও আমার হয়েছে। তাকে কাছে থেকে দেখেছি, অনেক কিছু শিখেছি। তার মাঝে আমি খুঁজে পেয়েছি অসাধারণ এক ‘মানুষ’কে, একজন ‘জাত বিপ্লবী’কে।
আমার দুর্লভ সুযোগ হয়েছিল তার সঙ্গে অনেকদিন জেলখানায় একসঙ্গে একই ওয়ার্ডে পাশাপাশি সিটে থাকার। সেটি ছিল ১৯৭৭ সালের কথা। আমার কারাজীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন ছিল কমরেড মণি সিংহের নিবিড় সান্নিধ্য পাওয়া। বিপ্লবী রাজনৈতিক জীবনবোধের নিখুঁত প্রতিফলন তার মাঝে তখন দেখেছি। শৃঙ্খলাপূর্ণ প্রাত্যহিক জীবনাভ্যাস, শিক্ষা-প্রশিক্ষণ-বিনোদন, বন্দিদের প্রতি মমত্ববোধ, সাধারণ কয়েদিদের প্রতি প্রীতিময় আচরণ- ৭৫ বছর বয়সী মণি সিংহের কারাগারের দিনগুলো এসব বৈশিষ্ট্যম-িত ছিল। সঙ্গে সঙ্গে অধিকার ও আত্মমর্যাদার প্রশ্নে কারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তার নিরন্তর লড়াই চালানোর প্রয়াসও আমি দেখেছি। য়ামাদেরকে বন্দি করে রেখেছ তাতে কী? এখানেও লড়াই চলবে! কারাগারেও অব্যাহত থাকবে বিপ্লবী কর্মকা-। হয়তো অন্য পথে, অন্য পন্থায়। জেলখানার বন্দি দিনগুলোকেও কাজে লাগাও বই পড়, পাঠচক্র চালাও, আলোচনা সভা কর। উন্নত পরিবেশের জন্য জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দরবার কর। রেশন কেন খারাপ এলো? পত্রিকা আসতে বিলম্ব হয় কেন? ডাক্তার রাউন্ডে থাকে না কেন? যা বিদ্যমান তাকেই ধ্রুব ধরে নিয়ে, ‘বাস্তবতা’ বলে অজুহাত দিয়ে চলতি অবস্থার কাছে আত্মসমর্পণ করা চলবে না! এসবের মাঝে প্রতিবিম্বিত হতে দেখেছিলাম একজন প্রকৃত বিপ্লবীর অন্তরের অবিরাম সংগীত মূর্ছনার মর্মবাণী।
কমরেড মণি সিংহ ছিলেন একজনও অজেয় বিপ্লবী নেতা। পাকিস্তানের শুরুর দিকে টংক আন্দোলনকে দমন-পীড়ন চালিয়ে স্তব্ধ করে দেয়ার পর নূরুল আমিন সদম্ভ আম্ফালন করে ঘোষণা করেছিলেন ‘কমিউনিস্টদের এবার কবর দিয়ে দিলাম’। এই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মণি সিংহ তার ভাষণে প্রায়ই উপসংহার টানতেন এই বলে যে ‘কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিকের পার্টি, গরিবের পার্টি, ইনসাফের পার্টি। এই পার্টিকে যারা ধ্বংস করতে চাইবে, তারাই ধ্বংস হয়ে যাবে। কমিউনিস্ট পার্টি জিন্দা আছে, জিন্দা থাকবে।’
পার্টির মধ্যে ক্রমপ্রসারমাণ দক্ষিণপন্থি সুবিধাবাদী, মধ্যবিত্তসুলভ প্রবণতা ও বিচ্যুতি সম্পর্কে তিনি খুবই সচেতন ছিলেন। কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিনি বহুবার এ বিষয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। দু-এক সময় ক্রোধান্বিত হয়ে এ-ও বলেছেন, ‘এভাবে যদি চলে তা হলে পার্টি একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। আজ তোমরা যেসব কথা বলছ; দেখো, এসব কথার সুর ধরেই একদিন বলবেÑ পার্টিই বাতিল করা হোক, শ্রেণী সংগ্রাম বাতিল করা হোক। এসব এখনই তোমরা বন্ধ কর। নয়তো সর্বনাশ হয়ে যাবে’। পার্টির ভেতরে আমলাতান্ত্রিক প্রবণতা, প্রদর্শনবাদ, এনজিও-দর্শন, শ্রেণী সংগ্রাম থেকে দূরে থেকে পার্টি নেতৃত্বের কাছে ভিড় করার প্রবণতা, নানা অজুহাতে পার্টির শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, সময়ানুবর্তিতার লংঘন, সার্বক্ষণিকদের কর্মকা-ে ঢিলেঢালা ভাব ইত্যাদির তিনি কঠোর সমালোচক ছিলেন।
কমরেড মণি সিংহ তেমন কোনো বড় মাপের মার্কসবাদী একাডেমিসিয়ান বা প-িত ছিলেন না। তাত্ত্বিক খুঁটি-নাটিতেও তিনি বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। কিন্তু তিনি মার্কসবাদকে গভীরতা দিয়ে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তিনি প্রজ্ঞার সঙ্গে তত্ত্বকে প্রয়োগ করতে পারতেন। তার জীবন পর্যালোচনা করলে তাই দেখা যায় যে, পার্টির অভ্যন্তরে বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে মতপার্থক্য দেখা দিলে প্রায় সবসময়ই তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে সঠিক অবস্থান নিয়েছিলেন।
ব্রিটিশবিরোধী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের ধারা থেকে প্রথম সুযোগেই মার্কসবাদী জীবনাদর্শ গ্রহণ করা, শ্রমিক আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ, নিজ জেলায় পারিবারিক আভিজাত্য ও স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ঐতিহাসিক সশস্ত্র টংক আন্দোলন পরিচালনা, সাম্প্রদায়িক-প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তান রাষ্ট্রের কঠিন বাস্তবতায় সাহসের সঙ্গে তিলে তিলে গণতন্ত্র, স্বাধিকার আন্দোলনের ভিত্তিমি রচনা করা, ‘মাওবাদ’ বিষয়ে সঠিক অবস্থান নিয়ে বামপন্থি বিচ্যুতির বিরুদ্ধে দৃঢ় সংগ্রাম পরিচালনা, দক্ষিণপন্থি পদস্খলনের বিপদ সম্পর্কে সর্বদা সতর্ক হুঁশিয়ারি দেয়া, পার্টিতে বিভেদের বিরুদ্ধে সব সময় অবস্থান নেয়া এবং গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা কঠোরভাবে অনুশীলন এসবই কমরেড মণি সিংহকে পার্টির স্বাভাবিক শীর্ষ নেতৃত্বের আসনে পৌঁছে দিয়েছিল। নীতি-আদর্শ প্রশ্নে সব সময় অবিচল-অনমনীয় থাকলেও তিনি কখনও সংকীর্ণ ছিলেন না। মূল শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যের বিষয়কে বিপ্লবী কর্মকৌশল বলে জানতেন, রণনীতি ও রণকৌশলের আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ে কখনও বিস্মৃত হতেন না ও সব সময় এবং সব অবস্থায় পার্টির স্বাধীন রাজনৈতিক মিকাকে গুরুত্ব দিতেন। জনসেবা-দেশসেবাকে একটি সাধনা হিসাবে গ্রহণ করা, চিন্তায় ও কাজে প্রতিনিয়ত মানবমুক্তির ও দেশপ্রেমের অধ্যায়ন করা, নিত্যদিনের ছোট-বড় সব কাজে বিপ্লবী জীবনাদর্শের প্রতিফলন ঘটানোর নিরন্তর প্রয়াস এসব গুণাবলী কমরেড মণি সিংহের মাঝে দৃষ্টান্ত স্থানীয় রূপে বিরাজমান ছিল। এসব গুণাবলি তঁকে ইতিহাসে একজন ‘জাতীয় নেতার’ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে।
কমরেড মণি সিংহ, সালাম, তোমাকে সালাম!
[লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)]
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪
কমরেড মণি সিংহ কী একজন ‘কমিউনিস্ট নেতা’ ছিলেন নাকি একজন ‘জাতীয় নেতা’ ছিলেন? অনেকে এ নিয়ে তর্ক তোলার চেষ্টা করেন। আসলে তর্কের বিষয়বস্তুই ত্রুটিপূর্ণ। কারণ, কোনো একজন ব্যক্তিকে ‘কমিউনিস্ট নেতা’ কিংবা ‘জাতীয় নেতা’ এ দুয়ের মধ্যে কোনো একটি হতে হবে এমন ধারণাই ত্রুটিপূর্ণ। কমরেড মণি সিংহ ছিলেন নিঃস্বন্দেহে একজন ‘কমিউনিস্ট নেতা’, একই সঙ্গে একজন ‘জাতীয় নেতা’ও বটে।
এ কথা কে না জানে যে কমরেড মণি সিংহ ছিলেন আমাদের উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা, অন্যতম স্থপতি। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সৃজনশীল বৈজ্ঞানিক মতাদর্শে দৃঢ় আস্থাবান একজন খাঁটি কমিউনিস্ট নেতা ছিলেন তিনি। তার এই বিপ্লবী জীবনাদর্শ ও আমৃত্যু অক্ষয় বিপ্লবী কর্মকা-ের মাঝেই তার কালজয়ী পরিচয় লিপিবদ্ধ। তার এই কমিউনিস্ট আত্মপরিচয়কে বাদ দিয়ে তাকে ‘এই পরিচয়ের ঊর্ধ্বে’ একজন জাতীয় নেতা রূপে তুলে ধরার চেষ্টা বৃথা। বস্তুত একজন ‘কমিউনিস্ট নেতা’ হওয়ার ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই তিনি তার শ্রেষ্ঠ জাতীয় নেতা হয়ে উঠেছিলেন।
কমরেড মণি সিংহয়ের জীবন-সংগ্রাম ছিল মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য এবং তিনি বিশ্বাস করতেন যে তার মধ্য দিয়েই সার্বিক মানবমুক্তি। ‘মুক্ত মানবের মুক্ত সমাজ’ তথা সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য আমৃত্যু তিনি লড়াই করেছেন। মানুষই ছিল তার সাধনার কেন্দ্রবিন্দু। তিনি বলতেন যে প্রতিটি কমিউনিস্টকে ‘বিপ্লবী মানবতাবাদের’ উদ্বুদ্ধ হয়ে শ্রেণী-সংগ্রামের ধারায় শোষণের সমাজকে উপড়ে ফেলে সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ অভিমুখীন সমাজ-বিপ্লব সাধনে আত্মনিবেদন করতে হবে। মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও মানবপ্রেমকে বিপ্লবী প্রয়াসের মাধ্যমে সমাজে সার্বজনীন করে তুলতেই তিনি তার বিপ্লবী কর্মকা- পরিচালনা করেছিলেন। এদেশে ও বিশ্বে আজও সেই বিপ্লবী কর্মকা- অব্যাহত আছে। প্রবল প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে হলেও নবজাগরিত শক্তি নিয়ে তা অগ্রসর হচ্ছে।
এদিকে বর্তমানে যখন অপরাজনীতি, ব্যবসায়িক রাজনীতি, হালুয়া রুটির রাজনীতি, আত্মস্বার্থের রাজনীতি এবং ‘বাজার অর্থনীতির’ দানবীয় বিস্তারের মুখে ‘বাজার রাজনীতি’ সবকিছুকে গ্রাস করে চলেছে, যখন জাতির সামনে ‘রাজনীতি বাঁচাও’ আজ এক অগ্রগণ্য কর্তব্য হয়ে উঠেছে তখন জাতির সামনে ‘রাজনীতি বাঁচাও’-এর সংগ্রাম অতীব জরুরি হয়ে উঠেছে। ‘রাজনীতি বাঁচাও’-এর সংগ্রামে কমরেড মণি সিংহ আজ এক অজেয় প্রতীকী শক্তি হয়ে আছেন। কমিউনিস্ট আদর্শবোধই তাকে একজন বিশুদ্ধ, অনুপম, অনুকরণীয় দেশপ্রেমিকের হোয়ার পথ করে দিয়েছে। সততা, ত্যাগ, আদর্শ-নিষ্ঠা, কঠোর শৃঙ্খলাবোধ, মানুষের প্রতি অকৃত্রিম দরদ, দায়িত্ববোধ, দেশমাতৃকার স্বার্থে আত্মস্বার্থ বিসর্জন, জনসেবা-দেশসেবাকে সাধনা হিসেবে গ্রহণ; প্রতিদিনের চিন্তা-কাজে মানবমুক্তি ও দেশপ্রেমের অধ্যয়ন, ছোট-বড় সব কাজে বিপ্লবী জীবনাদর্শের প্রতিফলন ঘটানোর নিরন্তর প্রয়াস কমরেড মণি সিংহের মাঝে দৃষ্টান্ত-স্থানীয় রূপে বিরাজমান ছিল। এসব অমূল্য গুণাবলির সমাহারের কারণেই তিনি আজও এদেশের রাজনীতিতে অনন্য সম্মানের স্থানে অধিষ্ঠিত। তাই, কমরেড মণি সিংহ একজন শ্রেষ্ঠ ‘জাতীয় নেতা’ হয়ে উঠতে পেরেছেন।
কমরেড মণি সিংহকে আমি প্রথম দেখি ১৯৬৬ সালের মে মাসের এক সন্ধ্যায়, ঢাকার কল্যাণপুর এলাকায় এক গোপন ডেরায় অনুষ্ঠিত ছাত্র-কর্মীদের এক বৈঠকে। কমিউনিস্ট পার্টি তখন নিষিদ্ধ এবং তাকে কাজ করতে হচ্ছে আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যবস্থায়। পার্টির তাত্ত্বিক ও সাংগঠনিক শক্তি সংহত করার জন্য মহান মে দিবস উপলক্ষে ঢাকার ছাত্র-কর্মীদের এই সভায় আত্মগোপনে থাকা পার্টির কয়েকজন শীর্ষ নেতা উপস্থিত ছিলেন। কমরেড আজাদ নামে পরিচয় করে দেয়া সাদা পায়জামার ওপর সাদা ফুল হাতা লম্বা কুর্তা-শার্ট গায়ে, ফর্সা, লম্বা, কালো চশমা পরা একজন কমরেড তেজোদীপ্ত কণ্ঠে অনেক কথা বলেছিলেন। পার্টির অন্য নেতারা ফিসফিস করে কানে কানে জানিয়েছিলেন যে তিনিই কমরেড মণি সিংহ। আমরা কমরেড মণি সিংহকে রূপকথার নায়কের মতো গণ্য করতাম। কল্পনার সেই বিপ্লবী নায়ককে কাছে থেকে স্বচক্ষে দেখতে পেয়েছি জানতে পেরে সেদিন প্রবলভাবে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম।
১৯৬৭ সালে তিনি আন্ডারগ্রাউন্ড থাকা অবস্থায় গ্রেপ্তার হয়ে যান। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি মুক্ত হয়ে আসেন। মণি সিংহকে একনজর দেখার জন্য সবাই তখন পাগলপ্রায়। তার সঙ্গে এবার আমি প্রকাশ্য সাক্ষাৎ পরিচয়ের এবং সামনা-সামনি কথা বলার সুযোগ পাই। কিন্তু ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে তিনি আবার আবার গ্রেপ্তার হয়ে যান। তার এই স্বল্পকালীন মুক্ত থাকা অবস্থায় তিনি আমাদের নিয়ে বৈঠক করে অনেক কথার মধ্যে দুটি খুবই গরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন। একটি ছিল ‘মনে রাখবে, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান হলো আসন্ন আরও বড় সংগ্রামের ড্রেস রিহার্সেল মাত্র’। অন্য কথাটি ছিল ‘আর্মড স্ট্রাগল ইজ ইন দি এজেন্ডা নাউ’ (অর্থাৎ ‘সশস্ত্র সংগ্রামের বিষয়টি এখন সামনে’)।
৮ মাস বন্দী থাকার পর ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ জনগণ কমরেড মণি সিংহকে রাজশাহী জেল ভেঙে মুক্ত করেন। তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের কাজে নেমে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কমরেড মণি সিংহের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘনিষ্ঠতা লাভ করে। তখন বেশ কয়েকবার তার সঙ্গে আমার দেখাসাক্ষাৎ হয়। আমরা বেশ কয়েকদিন একই বাসায় কাটিয়েছি। আমি ছিলাম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা, ‘বিশেষ গেরিলা বাহিনী’র প্রথম দলের একজন কমান্ডার। তিনি আমার কাছে অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কে, যুদ্ধ কৌশল সম্পর্কে, গেরিলা দলগুলোর তৎপরতা সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু জানতে চাইতেন। এসব যেন তার একান্ত আপন ভুবনের ব্যাপার। তার সঙ্গে যখন আমার সশস্ত্র যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা হতো তখন তার মুখের দিকে তাকিয়ে যে উজ্জ্বল জ্যোত দেখতে পেতাম তাতে আমার মানসচক্ষে ভেসে উঠত অস্ত্র কাঁধে ঝুলানো সাদা ঘোড়ায় সওয়ার গারো পাহাড় এলাকার টংক প্রথাবিরোধী সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহের সেনাপতি, চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকের মণি সিংহকে।
কমরেড মণি সিংহ ছিলেন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্বের অন্যতম একজন। তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টাম-লীর অন্যতম সদস্য এবং কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক-সাংগঠনিক কর্মকা-ের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। ৭০ বছর বয়সের এই মানুষটি ৯ মাস ধরে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, আন্তর্জাতিক, আদর্শিকসহ বহুবিধ কাজে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রগতিমুখীনতা নিশ্চিত করার জন্য, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে দেশি-বিদেশি শক্তির সমাবেশ ও ঐক্য গড়ে তুলতে এবং জাতির এই মরণপণ সংগ্রামকে বিজয়ের পথে নিয়ে যেতে কমরেড মণি সিংহ অমূল্য অবদান রেখেছেন। গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার কাজে ‘বেইস ক্যাম্পে ও রনাঙ্গণেই’ আমার সময় কাটতো বেশি। কমরেড মণি সিংহ ‘বেইস ক্যাম্পে এক-আধবার এসেছিলেন। আমাকেও সময়-সময় বিশেষ কাজে পার্টি হেডকোয়ার্টারের বাসায় ২-৩ দিনের জন্য যেতে হতো। তখন তার সঙ্গে দেখা হতো। আমার সঙ্গে দেখা হলেই কমরেড মণি সিংহের উচ্ছ্বাস বেড়ে যেত। স্পষ্টই বুঝতে পারতাম, আমাকে অস্ত্রধারী অবস্থায় দেখে তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠেছে; যেন তার যৌবন তিনি ফিরে পেয়েছেন।
স্বাধীনতার পর আরও অনেক কাছে থেকে তাকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। অগণিত সভায়, প্রকাশ্য-গোপন বৈঠকে, আন্ডারগ্রাউন্ডে এক ডেনে, জেলা সফরে, জনসভায়, বিদেশ সফরে, পার্টির সমাবেশে, কৃষক সমিতি-ক্ষেতমজুর সমিতির কর্মসূচিতে তার সঙ্গে কাজ করেছি। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে এবং একপর্যায়ে পার্টির কেন্দ্রীয় সম্পাদকম-লীতে তার সঙ্গে কাজ করার সুযোগও আমার হয়েছে। তাকে কাছে থেকে দেখেছি, অনেক কিছু শিখেছি। তার মাঝে আমি খুঁজে পেয়েছি অসাধারণ এক ‘মানুষ’কে, একজন ‘জাত বিপ্লবী’কে।
আমার দুর্লভ সুযোগ হয়েছিল তার সঙ্গে অনেকদিন জেলখানায় একসঙ্গে একই ওয়ার্ডে পাশাপাশি সিটে থাকার। সেটি ছিল ১৯৭৭ সালের কথা। আমার কারাজীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন ছিল কমরেড মণি সিংহের নিবিড় সান্নিধ্য পাওয়া। বিপ্লবী রাজনৈতিক জীবনবোধের নিখুঁত প্রতিফলন তার মাঝে তখন দেখেছি। শৃঙ্খলাপূর্ণ প্রাত্যহিক জীবনাভ্যাস, শিক্ষা-প্রশিক্ষণ-বিনোদন, বন্দিদের প্রতি মমত্ববোধ, সাধারণ কয়েদিদের প্রতি প্রীতিময় আচরণ- ৭৫ বছর বয়সী মণি সিংহের কারাগারের দিনগুলো এসব বৈশিষ্ট্যম-িত ছিল। সঙ্গে সঙ্গে অধিকার ও আত্মমর্যাদার প্রশ্নে কারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তার নিরন্তর লড়াই চালানোর প্রয়াসও আমি দেখেছি। য়ামাদেরকে বন্দি করে রেখেছ তাতে কী? এখানেও লড়াই চলবে! কারাগারেও অব্যাহত থাকবে বিপ্লবী কর্মকা-। হয়তো অন্য পথে, অন্য পন্থায়। জেলখানার বন্দি দিনগুলোকেও কাজে লাগাও বই পড়, পাঠচক্র চালাও, আলোচনা সভা কর। উন্নত পরিবেশের জন্য জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দরবার কর। রেশন কেন খারাপ এলো? পত্রিকা আসতে বিলম্ব হয় কেন? ডাক্তার রাউন্ডে থাকে না কেন? যা বিদ্যমান তাকেই ধ্রুব ধরে নিয়ে, ‘বাস্তবতা’ বলে অজুহাত দিয়ে চলতি অবস্থার কাছে আত্মসমর্পণ করা চলবে না! এসবের মাঝে প্রতিবিম্বিত হতে দেখেছিলাম একজন প্রকৃত বিপ্লবীর অন্তরের অবিরাম সংগীত মূর্ছনার মর্মবাণী।
কমরেড মণি সিংহ ছিলেন একজনও অজেয় বিপ্লবী নেতা। পাকিস্তানের শুরুর দিকে টংক আন্দোলনকে দমন-পীড়ন চালিয়ে স্তব্ধ করে দেয়ার পর নূরুল আমিন সদম্ভ আম্ফালন করে ঘোষণা করেছিলেন ‘কমিউনিস্টদের এবার কবর দিয়ে দিলাম’। এই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মণি সিংহ তার ভাষণে প্রায়ই উপসংহার টানতেন এই বলে যে ‘কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিকের পার্টি, গরিবের পার্টি, ইনসাফের পার্টি। এই পার্টিকে যারা ধ্বংস করতে চাইবে, তারাই ধ্বংস হয়ে যাবে। কমিউনিস্ট পার্টি জিন্দা আছে, জিন্দা থাকবে।’
পার্টির মধ্যে ক্রমপ্রসারমাণ দক্ষিণপন্থি সুবিধাবাদী, মধ্যবিত্তসুলভ প্রবণতা ও বিচ্যুতি সম্পর্কে তিনি খুবই সচেতন ছিলেন। কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিনি বহুবার এ বিষয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। দু-এক সময় ক্রোধান্বিত হয়ে এ-ও বলেছেন, ‘এভাবে যদি চলে তা হলে পার্টি একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। আজ তোমরা যেসব কথা বলছ; দেখো, এসব কথার সুর ধরেই একদিন বলবেÑ পার্টিই বাতিল করা হোক, শ্রেণী সংগ্রাম বাতিল করা হোক। এসব এখনই তোমরা বন্ধ কর। নয়তো সর্বনাশ হয়ে যাবে’। পার্টির ভেতরে আমলাতান্ত্রিক প্রবণতা, প্রদর্শনবাদ, এনজিও-দর্শন, শ্রেণী সংগ্রাম থেকে দূরে থেকে পার্টি নেতৃত্বের কাছে ভিড় করার প্রবণতা, নানা অজুহাতে পার্টির শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, সময়ানুবর্তিতার লংঘন, সার্বক্ষণিকদের কর্মকা-ে ঢিলেঢালা ভাব ইত্যাদির তিনি কঠোর সমালোচক ছিলেন।
কমরেড মণি সিংহ তেমন কোনো বড় মাপের মার্কসবাদী একাডেমিসিয়ান বা প-িত ছিলেন না। তাত্ত্বিক খুঁটি-নাটিতেও তিনি বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। কিন্তু তিনি মার্কসবাদকে গভীরতা দিয়ে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তিনি প্রজ্ঞার সঙ্গে তত্ত্বকে প্রয়োগ করতে পারতেন। তার জীবন পর্যালোচনা করলে তাই দেখা যায় যে, পার্টির অভ্যন্তরে বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে মতপার্থক্য দেখা দিলে প্রায় সবসময়ই তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে সঠিক অবস্থান নিয়েছিলেন।
ব্রিটিশবিরোধী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের ধারা থেকে প্রথম সুযোগেই মার্কসবাদী জীবনাদর্শ গ্রহণ করা, শ্রমিক আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ, নিজ জেলায় পারিবারিক আভিজাত্য ও স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ঐতিহাসিক সশস্ত্র টংক আন্দোলন পরিচালনা, সাম্প্রদায়িক-প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তান রাষ্ট্রের কঠিন বাস্তবতায় সাহসের সঙ্গে তিলে তিলে গণতন্ত্র, স্বাধিকার আন্দোলনের ভিত্তিমি রচনা করা, ‘মাওবাদ’ বিষয়ে সঠিক অবস্থান নিয়ে বামপন্থি বিচ্যুতির বিরুদ্ধে দৃঢ় সংগ্রাম পরিচালনা, দক্ষিণপন্থি পদস্খলনের বিপদ সম্পর্কে সর্বদা সতর্ক হুঁশিয়ারি দেয়া, পার্টিতে বিভেদের বিরুদ্ধে সব সময় অবস্থান নেয়া এবং গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা কঠোরভাবে অনুশীলন এসবই কমরেড মণি সিংহকে পার্টির স্বাভাবিক শীর্ষ নেতৃত্বের আসনে পৌঁছে দিয়েছিল। নীতি-আদর্শ প্রশ্নে সব সময় অবিচল-অনমনীয় থাকলেও তিনি কখনও সংকীর্ণ ছিলেন না। মূল শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যের বিষয়কে বিপ্লবী কর্মকৌশল বলে জানতেন, রণনীতি ও রণকৌশলের আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ে কখনও বিস্মৃত হতেন না ও সব সময় এবং সব অবস্থায় পার্টির স্বাধীন রাজনৈতিক মিকাকে গুরুত্ব দিতেন। জনসেবা-দেশসেবাকে একটি সাধনা হিসাবে গ্রহণ করা, চিন্তায় ও কাজে প্রতিনিয়ত মানবমুক্তির ও দেশপ্রেমের অধ্যায়ন করা, নিত্যদিনের ছোট-বড় সব কাজে বিপ্লবী জীবনাদর্শের প্রতিফলন ঘটানোর নিরন্তর প্রয়াস এসব গুণাবলী কমরেড মণি সিংহের মাঝে দৃষ্টান্ত স্থানীয় রূপে বিরাজমান ছিল। এসব গুণাবলি তঁকে ইতিহাসে একজন ‘জাতীয় নেতার’ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে।
কমরেড মণি সিংহ, সালাম, তোমাকে সালাম!
[লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)]