রহমান মৃধা
বাংলাদেশের প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা, যা দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রতিফলন হিসেবে দেখা যাচ্ছে, দেশবাসীর জন্য এক বড় সংকেত। এই আগুনের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভবনটির আট ও নয়তলা, যা দেশের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রের সঙ্গে জড়িত। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, এই ঘটনায় হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ‘যে বা যারাই এই ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকবে, তাদের বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেয়া হবে না’। তবে, আমার ভাবনায় প্রশ্নটি এখনো রয়ে গেছে: কীভাবে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র এবং দেশের প্রশাসনিক কার্যক্রম সুরক্ষিত থাকবে, যখন এমন ঘটনা ঘটছে?
ডিজিটাল বাংলাদেশ : বাস্তবতা ও বিভ্রম
বাংলাদেশের ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার পরও, দেশের প্রতিটি নথি, সরকারি তথ্য এবং রেকর্ড সুরক্ষিত না থাকলে, তা কোনোভাবেই ডিজিটাল বলা যায় না। যদি ডিজিটাল বাংলাদেশ সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতো, তবে এসব গুরুত্বপূর্ণ নথি আগুনে ধ্বংস হওয়ার ঘটনা ঘটত না, কারণ এগুলো ডিজিটালি সুরক্ষিত থাকার কথা ছিল। তবে, এ থেকে স্পষ্ট যে, ডিজিটাল নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনো কার্যকরী নয়, অথবা এটি কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাহলে প্রশ্ন উঠছে, বাংলাদেশ কীভাবে দাবি করতে পারে যে এটি ডিজিটাল হয়ে উঠেছে?
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ সালে প্রণীত হয়েছিল, সাইবার অপরাধ এবং অনলাইনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তথ্য চুরি এবং নথিপত্র ধ্বংস হওয়ার মতো ঘটনা এর কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। উদাহরণস্বরূপ, সরকারি রেকর্ড ও নথিপত্রের সুরক্ষা এখনো সঠিকভাবে নিশ্চিত করা হয়নি, যা ডিজিটাল বাংলাদেশে থাকা উচিত ছিল। অন্যদিকে, সুইডেনের মতো উন্নত দেশে, যেখানে সমস্ত সরকারি নথি ডিজিটালি সুরক্ষিত থাকে এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাইবার আক্রমণ রোধ করা হয়, সেখানে বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান : ক্যাশলেস বাংলাদেশ
বাংলাদেশে দুর্নীতি এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করতে ক্যাশলেস সিস্টেম একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারত। আধুনিক প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব। দেশে যখন ক্যাশলেস ট্রানজেকশন বা ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম ব্যবহৃত হয়, তখন দুর্নীতি এবং অর্থপাচার কমানোর সুযোগ তৈরি হয়। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের মতো দেশে ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছে এবং এর ফলে বিভিন্ন সরকারের দুর্নীতির মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছে। তবে, বাংলাদেশে ক্যাশলেস সিস্টেমের ব্যাপকতা এখনো সীমিত এবং এর যথাযথ বাস্তবায়ন হলে, দেশের আর্থিক খাতে আরও স্বচ্ছতা আসতে পারত।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট : জাতীয় স্বার্থের বিপরীতে বিদেশি চিত্র?
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক অর্জন ছিল, যা দেশের মহাকাশ গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে, এ স্যাটেলাইটের কার্যক্রম নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠেছে, বিশেষত এটি কীভাবে দেশের স্বার্থে কাজ করছে এবং এর মাধ্যমে ভারতের ছবি বা ব্রডকাস্টিং সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে কিনা। এ প্রশ্নগুলোর উত্তরের দিকে দৃষ্টি দেয়া উচিত, কেননা, যদি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ভারতের চিত্র এবং ব্রডকাস্টিং সুবিধা প্রদর্শন করা হয়ে থাকে, তবে তা বাংলাদেশের জনগণের জন্য কী লাভজনক?
শাসক পরিবারের ভূমিকা
যখন একদিকে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো একটি রাজনৈতিক পরিবারের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে, তখন এটি সরকারের স্বচ্ছতা এবং দায়বদ্ধতার প্রশ্ন তুলে ধরে। দেশে দুর্নীতি, অর্থনৈতিক অসাম্য এবং প্রশাসনিক সংকটের একটি বড় কারণ হিসেবে শাসক পরিবার বা তাদের সমর্থকদের কর্তৃত্বশালী ভূমিকা উল্লিখিত হয়েছে।
প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ : ভবিষ্যতের উন্নয়ন এবং সুরক্ষা
বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা, দুর্নীতি রোধ এবং জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। সঠিকভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা, সাইবার ঝুঁকি এবং তথ্য চুরির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, এবং একটি দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করা অত্যন্ত জরুরি।
ভবিষ্যতের করণীয়
১. প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার ও সুরক্ষা : বাংলাদেশের প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলোর উন্নয়ন করা দরকার, যাতে জনগণের তথ্য সুরক্ষিত থাকে এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
২. দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ : ক্যাশলেস সিস্টেমের ব্যাপক ব্যবহার এবং সরকারী খাতে ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমের বাস্তবায়ন দুর্নীতি কমাতে সহায়ক হতে পারে।
৩. জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নীতিমালার সমন্বয় : বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা আবশ্যক। এর মাধ্যমে শুধু দেশের জন্য উপকারিতা আসতে হবে, বিদেশি স্বার্থে নয়।
৪. শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের উন্নয়ন : সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য পর্যাপ্ত প্রযুক্তিগত শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করা, যাতে তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা এবং সাইবার ঝুঁকি সম্পর্কে আরও সচেতন হয়ে ওঠে।
৫. স্বচ্ছতা ও দায়িত্ববোধ : সরকারের কর্মকর্তাদের মধ্যে স্বচ্ছতা, দায়িত্ববোধ এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, যাতে জনগণ আরও আস্থা ফিরে পায়।
৬. বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণায় বিনিয়োগ : প্রযুক্তিগত খাতে বাংলাদেশকে আরো উন্নত করার জন্য শিক্ষা এবং গবেষণায় বিনিয়োগ প্রয়োজন। ডিজিটাল অপচয়ের পরিমাণ এবং জাতির সুযোগ; বাংলাদেশে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার নামে যে পরিমাণ অর্থ অপচয় হয়েছে, তা একটি বড় প্রশ্ন তৈরি করে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে যে বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ খরচ হয়েছে, সেই অর্থের বিনিময়ে সাধারণ জনগণের কী লাভ হয়েছে? ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম, ই-গভর্নেন্স, এবং অন্যান্য ডিজিটাল সেবাগুলো সরকারি খাতে কিছুটা প্রতিষ্ঠিত হলেও, সাধারণ মানুষ তার সুবিধা কতটা পেয়েছে? এখনও দেশের প্রতিটি জনগণ প্রযুক্তিগত সুবিধা থেকে এক সমানভাবে উপকৃত নয়, বিশেষত শহরের বাইরের জনগণ। এর মধ্যে, সরকারের ডিজিটাল সেবার স্বচ্ছতা এবং কার্যকারিতা নিয়ে তীব্র সন্দেহ রয়েছে, কারণ একটি সুষ্ঠু ডিজিটাল অবকাঠামো না থাকলে, জনগণ কোনোভাবেই তার পূর্ণ সুবিধা লাভ করতে পারে না। বাংলাদেশ যদি সত্যিই স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং ডিজিটাল হতো এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, যদি দেশে সঠিকভাবে জবাবদিহিতা থাকত, যদি দেশের মালিকদের ক্ষমতাচ্যুত না করার উদ্যোগ নেয়া হতো, এবং যদি সিভিল প্রশাসন এবং প্রতিরক্ষা বাহিনী স্বৈরাচারী শাসকের গোলামি না করত, তাহলে বাংলাদেশ আজ সত্যিই স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে বিশ্বে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান পেত। দেশের সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং কার্যকরী প্রশাসনিক কাঠামোর অভাবের কারণে, আমরা এই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি।
এখনও আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, একের পর এক দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে দেশের উন্নয়ন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। তবে, এসবকিছু সত্ত্বেও, ভবিষ্যতের জন্য আশা এখনও বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ, যারা এখনো শৃঙ্খলা, উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির জন্য লড়াই করছে, তাদের সামগ্রিক ভূমিকা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে, আমাদের দেশের জন্য সোনালি ভবিষ্যত নিশ্চিত হতে পারে।
ভবিষ্যতের দিকে
ভবিষ্যত যদি সত্যিই ডিজিটাল এবং দুর্নীতিমুক্ত হয়, তবে তার জন্য প্রয়োজন সঠিক রাজনৈতিক পরিবেশ এবং প্রশাসনিক সংস্কার। জনগণের ক্ষমতা প্রয়োগ, আইনি কাঠামোর শক্তিশালীকরণ এবং ন্যায্য ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার মাধ্যমে বাংলাদেশ নতুন দিগন্তে পৌঁছাতে পারবে। নতুন একটি ডিজিটাল রূপান্তরের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্যই সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, যেখানে ডিজিটাল সিস্টেমে সব ধরনের দুর্নীতি এবং অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে। বাংলাদেশকে যদি একটি সমৃদ্ধ, ডিজিটাল, এবং দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হয়, তাহলে স্বৈরাচারী শাসন, দুর্নীতি, এবং রাজনৈতিক অপব্যবহার শেষ করে, জাতির বৃহত্তম স্বার্থে কাজ করতে হবে। সঠিক শাসন ব্যবস্থা এবং কার্যকরী প্রশাসন গঠনই এই দেশকে একটি সমৃদ্ধ এবং উন্নত ভবিষ্যৎ দিতে পারে।
আশার বাণী
বাংলাদেশের জনগণ তাদের প্রগতি ও উন্নতির জন্য এখনও সংগ্রাম করছে। তরুণ প্রজন্ম, যারা প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহী, তাদের হাত ধরেই এই দেশে নতুন পরিবর্তন আসবে। আশা করি, জনগণের সচেতনতা, রাষ্ট্রের সঠিক উদ্যোগ এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সামনে একটি সুখী, উন্নত, এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলবে। এবার সময় এসেছে, আমরা সবাই একত্রিত হয়ে একটি দুর্নীতিমুক্ত, ডিজিটাল এবং স্বশাসিত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাব। আজকে যে সংকট এবং সমস্যা দেখা যাচ্ছে, তা আগামী দিনে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হতে পারে, যদি আমরা সঠিক পথে চলি। বাংলাদেশ যদি সত্যিই ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং স্মার্ট বাংলাদেশ হতে চায়, তাহলে এটি শুধু প্রযুক্তিগত উন্নতির কথা না, বরং রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তনের কথা। ডিজিটাল নিরাপত্তা, দুর্নীতি রোধ এবং জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধ বজায় রেখে সঠিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে এসব ভুল এবং অব্যবস্থাপনা আর না ঘটে, তার জন্য সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ববোধ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সরকারের দায়বদ্ধতা ও যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে যদি ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়, তবে জাতি সেই প্রকৃত ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে পারে।
[লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন]
রহমান মৃধা
মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলাদেশের প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা, যা দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রতিফলন হিসেবে দেখা যাচ্ছে, দেশবাসীর জন্য এক বড় সংকেত। এই আগুনের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভবনটির আট ও নয়তলা, যা দেশের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রের সঙ্গে জড়িত। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, এই ঘটনায় হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ‘যে বা যারাই এই ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকবে, তাদের বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেয়া হবে না’। তবে, আমার ভাবনায় প্রশ্নটি এখনো রয়ে গেছে: কীভাবে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র এবং দেশের প্রশাসনিক কার্যক্রম সুরক্ষিত থাকবে, যখন এমন ঘটনা ঘটছে?
ডিজিটাল বাংলাদেশ : বাস্তবতা ও বিভ্রম
বাংলাদেশের ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার পরও, দেশের প্রতিটি নথি, সরকারি তথ্য এবং রেকর্ড সুরক্ষিত না থাকলে, তা কোনোভাবেই ডিজিটাল বলা যায় না। যদি ডিজিটাল বাংলাদেশ সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতো, তবে এসব গুরুত্বপূর্ণ নথি আগুনে ধ্বংস হওয়ার ঘটনা ঘটত না, কারণ এগুলো ডিজিটালি সুরক্ষিত থাকার কথা ছিল। তবে, এ থেকে স্পষ্ট যে, ডিজিটাল নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনো কার্যকরী নয়, অথবা এটি কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাহলে প্রশ্ন উঠছে, বাংলাদেশ কীভাবে দাবি করতে পারে যে এটি ডিজিটাল হয়ে উঠেছে?
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ সালে প্রণীত হয়েছিল, সাইবার অপরাধ এবং অনলাইনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তথ্য চুরি এবং নথিপত্র ধ্বংস হওয়ার মতো ঘটনা এর কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। উদাহরণস্বরূপ, সরকারি রেকর্ড ও নথিপত্রের সুরক্ষা এখনো সঠিকভাবে নিশ্চিত করা হয়নি, যা ডিজিটাল বাংলাদেশে থাকা উচিত ছিল। অন্যদিকে, সুইডেনের মতো উন্নত দেশে, যেখানে সমস্ত সরকারি নথি ডিজিটালি সুরক্ষিত থাকে এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাইবার আক্রমণ রোধ করা হয়, সেখানে বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান : ক্যাশলেস বাংলাদেশ
বাংলাদেশে দুর্নীতি এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করতে ক্যাশলেস সিস্টেম একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারত। আধুনিক প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব। দেশে যখন ক্যাশলেস ট্রানজেকশন বা ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম ব্যবহৃত হয়, তখন দুর্নীতি এবং অর্থপাচার কমানোর সুযোগ তৈরি হয়। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের মতো দেশে ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছে এবং এর ফলে বিভিন্ন সরকারের দুর্নীতির মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছে। তবে, বাংলাদেশে ক্যাশলেস সিস্টেমের ব্যাপকতা এখনো সীমিত এবং এর যথাযথ বাস্তবায়ন হলে, দেশের আর্থিক খাতে আরও স্বচ্ছতা আসতে পারত।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট : জাতীয় স্বার্থের বিপরীতে বিদেশি চিত্র?
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক অর্জন ছিল, যা দেশের মহাকাশ গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে, এ স্যাটেলাইটের কার্যক্রম নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠেছে, বিশেষত এটি কীভাবে দেশের স্বার্থে কাজ করছে এবং এর মাধ্যমে ভারতের ছবি বা ব্রডকাস্টিং সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে কিনা। এ প্রশ্নগুলোর উত্তরের দিকে দৃষ্টি দেয়া উচিত, কেননা, যদি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ভারতের চিত্র এবং ব্রডকাস্টিং সুবিধা প্রদর্শন করা হয়ে থাকে, তবে তা বাংলাদেশের জনগণের জন্য কী লাভজনক?
শাসক পরিবারের ভূমিকা
যখন একদিকে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো একটি রাজনৈতিক পরিবারের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে, তখন এটি সরকারের স্বচ্ছতা এবং দায়বদ্ধতার প্রশ্ন তুলে ধরে। দেশে দুর্নীতি, অর্থনৈতিক অসাম্য এবং প্রশাসনিক সংকটের একটি বড় কারণ হিসেবে শাসক পরিবার বা তাদের সমর্থকদের কর্তৃত্বশালী ভূমিকা উল্লিখিত হয়েছে।
প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ : ভবিষ্যতের উন্নয়ন এবং সুরক্ষা
বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা, দুর্নীতি রোধ এবং জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। সঠিকভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা, সাইবার ঝুঁকি এবং তথ্য চুরির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, এবং একটি দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করা অত্যন্ত জরুরি।
ভবিষ্যতের করণীয়
১. প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার ও সুরক্ষা : বাংলাদেশের প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলোর উন্নয়ন করা দরকার, যাতে জনগণের তথ্য সুরক্ষিত থাকে এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
২. দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ : ক্যাশলেস সিস্টেমের ব্যাপক ব্যবহার এবং সরকারী খাতে ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমের বাস্তবায়ন দুর্নীতি কমাতে সহায়ক হতে পারে।
৩. জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নীতিমালার সমন্বয় : বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা আবশ্যক। এর মাধ্যমে শুধু দেশের জন্য উপকারিতা আসতে হবে, বিদেশি স্বার্থে নয়।
৪. শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের উন্নয়ন : সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য পর্যাপ্ত প্রযুক্তিগত শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করা, যাতে তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা এবং সাইবার ঝুঁকি সম্পর্কে আরও সচেতন হয়ে ওঠে।
৫. স্বচ্ছতা ও দায়িত্ববোধ : সরকারের কর্মকর্তাদের মধ্যে স্বচ্ছতা, দায়িত্ববোধ এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, যাতে জনগণ আরও আস্থা ফিরে পায়।
৬. বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণায় বিনিয়োগ : প্রযুক্তিগত খাতে বাংলাদেশকে আরো উন্নত করার জন্য শিক্ষা এবং গবেষণায় বিনিয়োগ প্রয়োজন। ডিজিটাল অপচয়ের পরিমাণ এবং জাতির সুযোগ; বাংলাদেশে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার নামে যে পরিমাণ অর্থ অপচয় হয়েছে, তা একটি বড় প্রশ্ন তৈরি করে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে যে বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ খরচ হয়েছে, সেই অর্থের বিনিময়ে সাধারণ জনগণের কী লাভ হয়েছে? ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম, ই-গভর্নেন্স, এবং অন্যান্য ডিজিটাল সেবাগুলো সরকারি খাতে কিছুটা প্রতিষ্ঠিত হলেও, সাধারণ মানুষ তার সুবিধা কতটা পেয়েছে? এখনও দেশের প্রতিটি জনগণ প্রযুক্তিগত সুবিধা থেকে এক সমানভাবে উপকৃত নয়, বিশেষত শহরের বাইরের জনগণ। এর মধ্যে, সরকারের ডিজিটাল সেবার স্বচ্ছতা এবং কার্যকারিতা নিয়ে তীব্র সন্দেহ রয়েছে, কারণ একটি সুষ্ঠু ডিজিটাল অবকাঠামো না থাকলে, জনগণ কোনোভাবেই তার পূর্ণ সুবিধা লাভ করতে পারে না। বাংলাদেশ যদি সত্যিই স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং ডিজিটাল হতো এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, যদি দেশে সঠিকভাবে জবাবদিহিতা থাকত, যদি দেশের মালিকদের ক্ষমতাচ্যুত না করার উদ্যোগ নেয়া হতো, এবং যদি সিভিল প্রশাসন এবং প্রতিরক্ষা বাহিনী স্বৈরাচারী শাসকের গোলামি না করত, তাহলে বাংলাদেশ আজ সত্যিই স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে বিশ্বে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান পেত। দেশের সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং কার্যকরী প্রশাসনিক কাঠামোর অভাবের কারণে, আমরা এই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি।
এখনও আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, একের পর এক দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে দেশের উন্নয়ন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। তবে, এসবকিছু সত্ত্বেও, ভবিষ্যতের জন্য আশা এখনও বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ, যারা এখনো শৃঙ্খলা, উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির জন্য লড়াই করছে, তাদের সামগ্রিক ভূমিকা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে, আমাদের দেশের জন্য সোনালি ভবিষ্যত নিশ্চিত হতে পারে।
ভবিষ্যতের দিকে
ভবিষ্যত যদি সত্যিই ডিজিটাল এবং দুর্নীতিমুক্ত হয়, তবে তার জন্য প্রয়োজন সঠিক রাজনৈতিক পরিবেশ এবং প্রশাসনিক সংস্কার। জনগণের ক্ষমতা প্রয়োগ, আইনি কাঠামোর শক্তিশালীকরণ এবং ন্যায্য ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার মাধ্যমে বাংলাদেশ নতুন দিগন্তে পৌঁছাতে পারবে। নতুন একটি ডিজিটাল রূপান্তরের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্যই সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, যেখানে ডিজিটাল সিস্টেমে সব ধরনের দুর্নীতি এবং অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে। বাংলাদেশকে যদি একটি সমৃদ্ধ, ডিজিটাল, এবং দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হয়, তাহলে স্বৈরাচারী শাসন, দুর্নীতি, এবং রাজনৈতিক অপব্যবহার শেষ করে, জাতির বৃহত্তম স্বার্থে কাজ করতে হবে। সঠিক শাসন ব্যবস্থা এবং কার্যকরী প্রশাসন গঠনই এই দেশকে একটি সমৃদ্ধ এবং উন্নত ভবিষ্যৎ দিতে পারে।
আশার বাণী
বাংলাদেশের জনগণ তাদের প্রগতি ও উন্নতির জন্য এখনও সংগ্রাম করছে। তরুণ প্রজন্ম, যারা প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহী, তাদের হাত ধরেই এই দেশে নতুন পরিবর্তন আসবে। আশা করি, জনগণের সচেতনতা, রাষ্ট্রের সঠিক উদ্যোগ এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সামনে একটি সুখী, উন্নত, এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলবে। এবার সময় এসেছে, আমরা সবাই একত্রিত হয়ে একটি দুর্নীতিমুক্ত, ডিজিটাল এবং স্বশাসিত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাব। আজকে যে সংকট এবং সমস্যা দেখা যাচ্ছে, তা আগামী দিনে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হতে পারে, যদি আমরা সঠিক পথে চলি। বাংলাদেশ যদি সত্যিই ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং স্মার্ট বাংলাদেশ হতে চায়, তাহলে এটি শুধু প্রযুক্তিগত উন্নতির কথা না, বরং রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তনের কথা। ডিজিটাল নিরাপত্তা, দুর্নীতি রোধ এবং জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধ বজায় রেখে সঠিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে এসব ভুল এবং অব্যবস্থাপনা আর না ঘটে, তার জন্য সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ববোধ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সরকারের দায়বদ্ধতা ও যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে যদি ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়, তবে জাতি সেই প্রকৃত ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে পারে।
[লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন]