মোস্তফা কামাল যাত্রা
দ্য ফিল্ম অ্যান্ড টিভি চ্যারিটি কর্তৃক পরিচালিত এক গবেষণার ওপর ভিত্তি করে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘দ্য লুকিং গ্লাস’ শিরোনামের এক গবেষণা। গবেষণাপত্রে যুক্তরাজ্যের টিভি ও চলচ্চিত্র মাধ্যমে কর্মরত কলাকুশলীদের মধ্যে পরিচালিত মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক এই গবেষণার যে পরিসংখ্যান বেরিয়ে এসেছে- তা হলো : ৮৭ শতাংশ সংশ্লিষ্টজন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে তাদের মধ্যে আত্মহননের প্রবণতা প্রকট। অপর এক পর্র্যবেক্ষণে উঠে এসেছে যে ৮৪ শতাংশ সংশ্লিষ্ট কলাকুশলী তাদেও কর্মক্ষেত্রে হয়রানি তথা বুলিং এর শিকার হয়ে থাকে।
মূলত : ট্রমাটিক বিষয় ও গল্প নিয়ে কাজ করতে হয় কলাকুশলীদের। যার ফলে তাদের মধ্যে অতিরিক্ত চাপ অনুভব হয় প্রতিনিয়ত। তারা একাকিত্বে ভোগেন। অনিয়ন্ত্রিত কর্মঘণ্টার কারণে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা নেয়ার সুযোগও নেই।
এছাড়া তো ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং শুটিং চলাকালে নানাবিধ হয়রানির মুখোমুখি হয়ে তাদের দৈনন্দিন জীবনাতিপাতের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা তো রয়েছেই।
সামগ্রিক পরিস্থিতি মূল্যায়নের প্রেক্ষিতে ক্ষতিগ্রস্ত এবং ঝুঁকিতে থাকা এইসব কলাকুশলীকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনা সময়ের দাবি। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে টিভি ও চলচিত্র মাধ্যমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মিরা আরও বেশি ঝুঁকি ও ভোগান্তির শিকার হবে এটা স্বাভাবিক। তাই তাদের সুরক্ষায় এখনই তাদের ‘থিয়েটার ফর থেরাপি’ কর্মসূচির আওতায় আনা জরুরি।
‘হিসট্রনয়িক নিওরোসিস’ নামের ডিজওর্ডারে ভোগা এসব সৃজনশীল কলাকুশলীকে সুরক্ষা দিতে জেকব লিভি মরিনো নামের এক নাট্যদার্শনিক ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে নাট্যবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের যুথবদ্ধতার যে চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রয়োগ করে সমকালে সাফল্য মন্ডিত হয়েছিল তা ছিল ‘থিয়েটার ফর থেরাপি (টিএফটি)’।
মনোবিশ্লেষক এই নাট্য সাফল্যের ইতিবৃত্ত নিম্নে পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো :
মোরিনো যেমনি অভিনয়শিল্পীদের ‘হিস্ট্রায়নিক নিউরোসিস’ থেকে পরিত্রাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন; তেমনি থিয়েটারকে দিয়েছিলেন পান্ডুলিপির দাসত্ব থেকে মুক্তি। ইমপ্রোভাইজেশনাল থিয়েটার এ সময় রূপান্তরিত হয় ‘থিয়েটার অব থেরাপি’ রূপে। যার পরিণত রূপ হলো ‘সাইকোড্রামা’।
সমসাময়িক বিখ্যাত অভিনেত্রী বারবারা একই চরিত্রে বারবার অভিনয় করার ফলে ‘হিস্ট্রায়নিক নিউরোসিস’ রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। বারবারা ইস্টারের ফ্যাশন প্লেতে পরিশুদ্ধ নারীত্বের মডেল রূপে মাদার ম্যারীর ছবি আঁকতেন একনিষ্ঠ হয়ে। যা তার মধ্যে স্থায়ী অবয়ব নিয়ে বসবাস করতে করতে ‘হিস্ট্রায়নিক নিউরোসিস’ এ পরিণত হয়।
মোরিনো এই পরিস্থিতি থেকে বারবারাকে মুক্তি দিতে লিভিং নিউজপেপার নাট্য ধারায় কাজ করতে গিয়ে তাকে একটি পতিতা চরিত্রে অভিনয় করান। কারণ মোরিনো মনে করতেন পতিতা হিসাবে বারবারা যখন নতুন নতুন খদ্দেরের মুখোমুখি হবে তখন তার মধ্যে জন্ম নেবে সৃষ্টিশীলতার অপার সম্ভাবনা। কার্যত ঘটেছেও তাই; বারবারা পতিতা চরিত্রটিতে স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে সৃজনশীল অভিনয়শিল্পীর স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং পর্যায়ক্রমে নিজেকে ‘হিস্ট্রায়নিক নিউরোসিস’ রোগ থেকে অবমুক্ত করেছিলেন।
মোরিনো এই নাট্য প্রচেষ্টার একপর্যায়ে বারবারার স্বামী জর্জকেই অংশগ্রহণ করান জনৈক খদ্দের চরিত্রে। ফলে তারা সমর্থ হয়েছিল চমৎকার এক চিত্র দৃশ্যায়িত করতে; যা ছিল হৃদয়গ্রাহীও বটে। পরবর্তীতে মোরিনো এই অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণকে কাজে লাগিয়ে বিবাহিত দম্পতিদের ওপর প্রয়োগ করেন ‘ম্যারাইটাল থেরাপি’।
সত্যিকার অর্থে থিয়েটার এর সেই কাঠামো হয়ে উঠেছিল থেরাপির ফলপ্রসূ কৌশল হিসাবে; যা একই সঙ্গে এনে দেয় অভিনয়শিল্পী ও দর্শকের ওপর কার্যকরভাবে প্রয়োগ সাফল্য।
মোরিনো মনস্থির করেছিলেন থিয়েটারের এই প্রতিবিধানমূলক কাঠামোর পরিচর্যাই হবে তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। যেখানে এই ধারার নাট্যক্রিয়া একই সঙ্গে অভিনয়শিল্পী ও দর্শকের ওপর সৃষ্টি করবে একটি থেরাপিউটিক অভিপ্সা।
মোরিনোর এই আবিষ্কৃত নাট্য ধারণাকে সমালোচকগণ ‘ডিপ ইন্ট্রালেকচুয়াল ন্যাচারাল ক্যাথারসিস’ অভিধা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
স্মরণীয় যে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ-এর প্রতিবেদন মোতাবেক বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ মনোসামাজিক প্রতিবন্ধিতায় ভোগে। আর ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশনের ঘোষণা মোতাবেক উন্নত বিশ্বে মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ মানুষ কোন না কোন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়ে জীবনাতিপাত করে থাকে।
অপরদিকে জাতিসংঘ অনুমোদিত টঘঈজচউ কনভেনশন অনুযায়ী মনোসামাজিক সমস্যা এখন প্রতিবন্ধিতার আওতাভুক্ত। অর্থাৎ উল্লেখিত বিশ্লেষণ মোতাবেক মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ মানুষ প্রতিবন্ধিতার আওতাভুক্ত।
উক্ত ৩০ শতাংশ মানুষের মধ্যে ১০ শতাংশ মানুষ চরম পর্যায়ের মনোসামাজিক ও মনোদৈহিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি। যারা অন্যের সহযোগিতা ছাড়া দৈনন্দিন ব্যক্তিগত পরিচর্যা সুসম্পন্নœ করতে সমর্থ নয়। তাই তাদের জন্য আরও ১০ শতাংশ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে সার্বক্ষণিক সময় দিতে হয়। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো ভাবে উৎপাদনশীল কর্মক্রিয়ার আওতাভুক্ত থাকতে ব্যর্থ হয়। যা আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর ফেলে নেতিবাচক প্রভাব।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা যদি ১৭ কোটি হয়; তবে সেই বিবেচনায় ৫ কোটির ওপরে মানুষ কোন না কোন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছে। ফলে তারা থাকছে উৎপাদন প্রক্রিয়ার বাইরে।
যার আর্থিক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর। তাই আর্থসামাজিক এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের প্রয়োজন বর্ণিত ৪০ শতাংশ মানুষকে মনোবৈজ্ঞানিক ও মনোদৈহিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনা। যার জন্য প্রয়োজন দক্ষ ও প্রশিক্ষিত মনোসামাজিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী জনবল।
এক্ষেত্রে ‘থিয়েটার ফর থেরাপি (ঞভঞ)’ এর প্রয়োগ প্রক্রিয়ায় দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে পারলে এই খাতের সেবাকর্মী সৃষ্টি সম্ভব হবে।
অর্থাৎ প্রায় ৫ কোটিরও অধিক সংখ্যক জনগোষ্ঠীর মনোসামাজিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে দক্ষ জনবল সৃষ্টিতে ‘থিয়েটার ফর থেরাপি (ঞভঞ)’ প্রয়োগ বা পাঠক্রমভুক্ত হওয়া অত্যাবশ্যক। আর তা যদি হয় দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু থাকা নাট্যকলা বিভাগসমূহ; তবে সেই বিভাগগুলো থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের জন্য পেশাদারিভাবে ‘থিয়েটার ফর থেরাপি’ অনুশীলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে।
প্রকারান্তরে নাট্যকলায় বিদ্যায়তনিক পাঠ সম্পন্নকারী শিক্ষার্থীগণ দিনে চেম্বারভিত্তিক কাউন্সিলিং ও সাইকোথেরাপির প্রচলিত ব্যবহার কেন্দ্রিক সেবার পাশাপাশি ‘নাট্যিক থেরাপি’ প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের আর্থিক জোগান যেমনি নিশ্চিত করতে সমর্থ হবে; তেমনি সন্ধ্যায় চলমান গ্রুপ থিয়েটারভিত্তিক নাট্যক্রিয়ায় নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারবে।
তাই যুগের চাহিদা তথা প্রাত্যহিক সামাজিক জীবনে প্রয়োগযোগ্য নাট্যিক কলাবিদ্যা পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা যেমন জরুরি; তেমনি মনোসামাজিক স্বাস্থ্যসেবা কৌশল ‘থিয়েটার ফর থেরাপি (টিএফটি)’ এর নানান প্রয়োগ পদ্ধতির হাতে কলমে পাঠ নাট্যকলা বিভাগগুলোর পাঠ্যক্রমে সিলেবাসভুক্ত করা।
এই প্রসংগে সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অধিপরামর্শ এর পাশাপাশি অবশ্যই সম্মান ও ¯œাতকোত্তর পর্যায়ের পাঠ্যক্রম সংশোধন অত্যাবশ্যক।
নাট্যকলা বিষয়ে বিদ্যায়তনিক পাঠ সম্পন্নকারীদের চাকরির ক্ষেত্র সৃষ্টিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহের শিক্ষকদের পাশাপাশি প্রাক্তনীদের পক্ষ থেকে এই প্রসঙ্গে কার্যকরী উদ্যোগ সময়ের দাবি।
আশাকরি উল্লেখিত পরিসংখ্যান ও সম্ভাবনা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের যৌক্তিক বিবেচনা পাবে এবং নাট্যকলা বিভাগগুলোর পাঠ্যক্রমে ‘থিয়েটার ফর থেরাপি (ঞভঞ)’ এর তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক পাঠ অন্তর্ভুক্ত হবে।
[ লেখক : নির্বাহী পরিচালক, উৎস (টঞঝঅ), চট্টগ্রাম ]
মোস্তফা কামাল যাত্রা
রোববার, ০৫ জানুয়ারী ২০২৫
দ্য ফিল্ম অ্যান্ড টিভি চ্যারিটি কর্তৃক পরিচালিত এক গবেষণার ওপর ভিত্তি করে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘দ্য লুকিং গ্লাস’ শিরোনামের এক গবেষণা। গবেষণাপত্রে যুক্তরাজ্যের টিভি ও চলচ্চিত্র মাধ্যমে কর্মরত কলাকুশলীদের মধ্যে পরিচালিত মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক এই গবেষণার যে পরিসংখ্যান বেরিয়ে এসেছে- তা হলো : ৮৭ শতাংশ সংশ্লিষ্টজন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে তাদের মধ্যে আত্মহননের প্রবণতা প্রকট। অপর এক পর্র্যবেক্ষণে উঠে এসেছে যে ৮৪ শতাংশ সংশ্লিষ্ট কলাকুশলী তাদেও কর্মক্ষেত্রে হয়রানি তথা বুলিং এর শিকার হয়ে থাকে।
মূলত : ট্রমাটিক বিষয় ও গল্প নিয়ে কাজ করতে হয় কলাকুশলীদের। যার ফলে তাদের মধ্যে অতিরিক্ত চাপ অনুভব হয় প্রতিনিয়ত। তারা একাকিত্বে ভোগেন। অনিয়ন্ত্রিত কর্মঘণ্টার কারণে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা নেয়ার সুযোগও নেই।
এছাড়া তো ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং শুটিং চলাকালে নানাবিধ হয়রানির মুখোমুখি হয়ে তাদের দৈনন্দিন জীবনাতিপাতের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা তো রয়েছেই।
সামগ্রিক পরিস্থিতি মূল্যায়নের প্রেক্ষিতে ক্ষতিগ্রস্ত এবং ঝুঁকিতে থাকা এইসব কলাকুশলীকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনা সময়ের দাবি। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে টিভি ও চলচিত্র মাধ্যমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মিরা আরও বেশি ঝুঁকি ও ভোগান্তির শিকার হবে এটা স্বাভাবিক। তাই তাদের সুরক্ষায় এখনই তাদের ‘থিয়েটার ফর থেরাপি’ কর্মসূচির আওতায় আনা জরুরি।
‘হিসট্রনয়িক নিওরোসিস’ নামের ডিজওর্ডারে ভোগা এসব সৃজনশীল কলাকুশলীকে সুরক্ষা দিতে জেকব লিভি মরিনো নামের এক নাট্যদার্শনিক ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে নাট্যবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের যুথবদ্ধতার যে চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রয়োগ করে সমকালে সাফল্য মন্ডিত হয়েছিল তা ছিল ‘থিয়েটার ফর থেরাপি (টিএফটি)’।
মনোবিশ্লেষক এই নাট্য সাফল্যের ইতিবৃত্ত নিম্নে পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো :
মোরিনো যেমনি অভিনয়শিল্পীদের ‘হিস্ট্রায়নিক নিউরোসিস’ থেকে পরিত্রাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন; তেমনি থিয়েটারকে দিয়েছিলেন পান্ডুলিপির দাসত্ব থেকে মুক্তি। ইমপ্রোভাইজেশনাল থিয়েটার এ সময় রূপান্তরিত হয় ‘থিয়েটার অব থেরাপি’ রূপে। যার পরিণত রূপ হলো ‘সাইকোড্রামা’।
সমসাময়িক বিখ্যাত অভিনেত্রী বারবারা একই চরিত্রে বারবার অভিনয় করার ফলে ‘হিস্ট্রায়নিক নিউরোসিস’ রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। বারবারা ইস্টারের ফ্যাশন প্লেতে পরিশুদ্ধ নারীত্বের মডেল রূপে মাদার ম্যারীর ছবি আঁকতেন একনিষ্ঠ হয়ে। যা তার মধ্যে স্থায়ী অবয়ব নিয়ে বসবাস করতে করতে ‘হিস্ট্রায়নিক নিউরোসিস’ এ পরিণত হয়।
মোরিনো এই পরিস্থিতি থেকে বারবারাকে মুক্তি দিতে লিভিং নিউজপেপার নাট্য ধারায় কাজ করতে গিয়ে তাকে একটি পতিতা চরিত্রে অভিনয় করান। কারণ মোরিনো মনে করতেন পতিতা হিসাবে বারবারা যখন নতুন নতুন খদ্দেরের মুখোমুখি হবে তখন তার মধ্যে জন্ম নেবে সৃষ্টিশীলতার অপার সম্ভাবনা। কার্যত ঘটেছেও তাই; বারবারা পতিতা চরিত্রটিতে স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে সৃজনশীল অভিনয়শিল্পীর স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং পর্যায়ক্রমে নিজেকে ‘হিস্ট্রায়নিক নিউরোসিস’ রোগ থেকে অবমুক্ত করেছিলেন।
মোরিনো এই নাট্য প্রচেষ্টার একপর্যায়ে বারবারার স্বামী জর্জকেই অংশগ্রহণ করান জনৈক খদ্দের চরিত্রে। ফলে তারা সমর্থ হয়েছিল চমৎকার এক চিত্র দৃশ্যায়িত করতে; যা ছিল হৃদয়গ্রাহীও বটে। পরবর্তীতে মোরিনো এই অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণকে কাজে লাগিয়ে বিবাহিত দম্পতিদের ওপর প্রয়োগ করেন ‘ম্যারাইটাল থেরাপি’।
সত্যিকার অর্থে থিয়েটার এর সেই কাঠামো হয়ে উঠেছিল থেরাপির ফলপ্রসূ কৌশল হিসাবে; যা একই সঙ্গে এনে দেয় অভিনয়শিল্পী ও দর্শকের ওপর কার্যকরভাবে প্রয়োগ সাফল্য।
মোরিনো মনস্থির করেছিলেন থিয়েটারের এই প্রতিবিধানমূলক কাঠামোর পরিচর্যাই হবে তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। যেখানে এই ধারার নাট্যক্রিয়া একই সঙ্গে অভিনয়শিল্পী ও দর্শকের ওপর সৃষ্টি করবে একটি থেরাপিউটিক অভিপ্সা।
মোরিনোর এই আবিষ্কৃত নাট্য ধারণাকে সমালোচকগণ ‘ডিপ ইন্ট্রালেকচুয়াল ন্যাচারাল ক্যাথারসিস’ অভিধা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
স্মরণীয় যে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ-এর প্রতিবেদন মোতাবেক বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ মনোসামাজিক প্রতিবন্ধিতায় ভোগে। আর ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশনের ঘোষণা মোতাবেক উন্নত বিশ্বে মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ মানুষ কোন না কোন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়ে জীবনাতিপাত করে থাকে।
অপরদিকে জাতিসংঘ অনুমোদিত টঘঈজচউ কনভেনশন অনুযায়ী মনোসামাজিক সমস্যা এখন প্রতিবন্ধিতার আওতাভুক্ত। অর্থাৎ উল্লেখিত বিশ্লেষণ মোতাবেক মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ মানুষ প্রতিবন্ধিতার আওতাভুক্ত।
উক্ত ৩০ শতাংশ মানুষের মধ্যে ১০ শতাংশ মানুষ চরম পর্যায়ের মনোসামাজিক ও মনোদৈহিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি। যারা অন্যের সহযোগিতা ছাড়া দৈনন্দিন ব্যক্তিগত পরিচর্যা সুসম্পন্নœ করতে সমর্থ নয়। তাই তাদের জন্য আরও ১০ শতাংশ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে সার্বক্ষণিক সময় দিতে হয়। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো ভাবে উৎপাদনশীল কর্মক্রিয়ার আওতাভুক্ত থাকতে ব্যর্থ হয়। যা আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর ফেলে নেতিবাচক প্রভাব।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা যদি ১৭ কোটি হয়; তবে সেই বিবেচনায় ৫ কোটির ওপরে মানুষ কোন না কোন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছে। ফলে তারা থাকছে উৎপাদন প্রক্রিয়ার বাইরে।
যার আর্থিক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর। তাই আর্থসামাজিক এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের প্রয়োজন বর্ণিত ৪০ শতাংশ মানুষকে মনোবৈজ্ঞানিক ও মনোদৈহিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনা। যার জন্য প্রয়োজন দক্ষ ও প্রশিক্ষিত মনোসামাজিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী জনবল।
এক্ষেত্রে ‘থিয়েটার ফর থেরাপি (ঞভঞ)’ এর প্রয়োগ প্রক্রিয়ায় দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে পারলে এই খাতের সেবাকর্মী সৃষ্টি সম্ভব হবে।
অর্থাৎ প্রায় ৫ কোটিরও অধিক সংখ্যক জনগোষ্ঠীর মনোসামাজিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে দক্ষ জনবল সৃষ্টিতে ‘থিয়েটার ফর থেরাপি (ঞভঞ)’ প্রয়োগ বা পাঠক্রমভুক্ত হওয়া অত্যাবশ্যক। আর তা যদি হয় দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু থাকা নাট্যকলা বিভাগসমূহ; তবে সেই বিভাগগুলো থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের জন্য পেশাদারিভাবে ‘থিয়েটার ফর থেরাপি’ অনুশীলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে।
প্রকারান্তরে নাট্যকলায় বিদ্যায়তনিক পাঠ সম্পন্নকারী শিক্ষার্থীগণ দিনে চেম্বারভিত্তিক কাউন্সিলিং ও সাইকোথেরাপির প্রচলিত ব্যবহার কেন্দ্রিক সেবার পাশাপাশি ‘নাট্যিক থেরাপি’ প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের আর্থিক জোগান যেমনি নিশ্চিত করতে সমর্থ হবে; তেমনি সন্ধ্যায় চলমান গ্রুপ থিয়েটারভিত্তিক নাট্যক্রিয়ায় নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারবে।
তাই যুগের চাহিদা তথা প্রাত্যহিক সামাজিক জীবনে প্রয়োগযোগ্য নাট্যিক কলাবিদ্যা পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা যেমন জরুরি; তেমনি মনোসামাজিক স্বাস্থ্যসেবা কৌশল ‘থিয়েটার ফর থেরাপি (টিএফটি)’ এর নানান প্রয়োগ পদ্ধতির হাতে কলমে পাঠ নাট্যকলা বিভাগগুলোর পাঠ্যক্রমে সিলেবাসভুক্ত করা।
এই প্রসংগে সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অধিপরামর্শ এর পাশাপাশি অবশ্যই সম্মান ও ¯œাতকোত্তর পর্যায়ের পাঠ্যক্রম সংশোধন অত্যাবশ্যক।
নাট্যকলা বিষয়ে বিদ্যায়তনিক পাঠ সম্পন্নকারীদের চাকরির ক্ষেত্র সৃষ্টিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহের শিক্ষকদের পাশাপাশি প্রাক্তনীদের পক্ষ থেকে এই প্রসঙ্গে কার্যকরী উদ্যোগ সময়ের দাবি।
আশাকরি উল্লেখিত পরিসংখ্যান ও সম্ভাবনা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের যৌক্তিক বিবেচনা পাবে এবং নাট্যকলা বিভাগগুলোর পাঠ্যক্রমে ‘থিয়েটার ফর থেরাপি (ঞভঞ)’ এর তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক পাঠ অন্তর্ভুক্ত হবে।
[ লেখক : নির্বাহী পরিচালক, উৎস (টঞঝঅ), চট্টগ্রাম ]